★ মহাভারতে দেবীকে বলিপ্রিয়া বলা হয়েছে দুর্গাস্তবে। নিঃসন্দেহে দুর্গা বলিপ্রিয়া। কিন্তু সন্ধিপুজোয় বলি গ্রহণ করতে যে কোনও চণ্ডীমণ্ডপে স্বয়ং চামুণ্ডা কালীর আবির্ভাব হয়। এবং বলিপ্রিয়া শব্দে আজ আমরা সবাই মা কালীরই বৈশিষ্ট্য বুঝি।
★ স্কন্দপুরাণে উৎকলখণ্ডে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন যে চণ্ডী মূর্তি দর্শন করেছিলেন তিনি মুণ্ডমালিনী।
★ চণ্ডীর অষ্টশক্তির অন্যতম উগ্রচণ্ডা। ইনি অষ্টাদশভুজা এবং এঁর গলায় মুণ্ডমালা।
★ বাশুলী বা বিশালাক্ষী ধ্যানমন্ত্র যা ধর্মপূজাবিধানে পাই, সেখানে বাশুলীকে চণ্ডিকা এবং মঙ্গলচণ্ডিকা আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যাঁকে কালীর সঙ্গে অভিন্ন, এবং মুণ্ডমালিনী বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
★ দেবী ভাণ্ডালী বা বনদুর্গার ধ্যানমন্ত্রে তাঁকেও মুণ্ডমালিনী বলা হয়েছে। দেবী বনদুর্গা মেঘবর্ণা, ভয়ঙ্কর দন্তবিশিষ্টা।
★ বাংলা জুড়ে এমন বেশ কিছু চণ্ডী মন্দির আছে যেখানে অধিষ্ঠাত্রী মা একাধারে চণ্ডী ও কালী আখ্যা পান। গৌড়ের অধিষ্ঠাত্রী মালদার জহুরা চণ্ডী দ্রষ্টব্য, তিনি জহুরা কালী নামেও জনপ্রিয়।
★দেবী মাহাত্ম্য বা শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুযায়ী চণ্ডী শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধ করেছিলেন, এজন্য তাঁর আরেক নাম শুম্ভনিশুম্ভনিসূদিনী। দক্ষিণ ভারতে রাজেন্দ্র চোল তাঁর একটি অনুশাসনে এক প্রাচীন নিশুম্ভ নিসূদিনী মন্দিরের উল্লেখ করেন (এই মন্দিরটি তাঞ্জরে নাকি ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল রাজা বিজয়ালয় কর্তৃক, এই অনুশাসনে বলা হয়েছে, যেখানকার মাতৃমূর্তি রাজেন্দ্র চোলের সময়েও বিদ্যমান)। এই দেবী নিঃসন্দেহে চণ্ডী, কিন্তু ইনিও মুণ্ডমালিনী। এঁর মাথায় জটা, ইনি চতুর্ভুজা, শূল দ্বারা অসুরকে বিদ্ধ করেন, এবং উপবীতের মত ইনি মুণ্ডমালা ধারণ করেন। এছাড়া ইনি সর্পের কাঁচুলি পরিহিতা।
মা কালী সর্বময়ী। সমস্ত দেবীমূর্তির ধ্যানে মা কালীরই প্রকাশ ঘটে।
বাংলায় অর্থ: যিনি শবের হৃদয়ে দক্ষিণপদ স্থাপন করে (ব্যাখ্যা: দক্ষিণপদ হাঁটু থেকে বক্র হয়ে শবের উপর স্থাপিত, প্রত্যালীঢ়ভঙ্গিতে ডান পা হাঁটু থেকে বঙ্কিম থাকে এবং বাম পা সোজাভাবে প্রসারিত থাকে) ঘোর অট্টহাস্য করছেন। যাঁর ওপরের দুই হাতে খড়্গ এবং নীলপদ্ম। যাঁর নিচের দুই হাতে কর্তৃ এবং খর্পর। যিনি হুঙ্কার বীজের উপরে আবির্ভূত হয়েছেন। খর্বদেহী যিনি বিশাল পিঙ্গলবর্ণের জটাজুট ধারণ করেন মস্তকোপরি এবং যিনি উগ্রনাস বিশিষ্ট। যিনি নীলবর্ণ। সেই উগ্রতারা ত্রিজগতের জড়তা বিনাশ করেন।
জয় মা তারা নাকি বাংলা ভাষায় ফেসবুকের সবথেকে বেশি লিখিত বাক্য, কোথাও পড়েছিলাম। সত্যি কি না জানি না। সত্যি হলে বেশ ভালোই হয়। আসুন, সবাই জয় মা তারা লিখে যান কমেন্টে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং আমেরিকায় মাতৃধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ দেখলে অবাক হতে হয়। তন্ত্র এবং শাক্ত ধর্মের ইতিহাস নিয়ে পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কাজ হয়েছে ও হচ্ছে, তার এক শতাংশ আমাদের দেশে হয় না, যা লজ্জার। কিছুদিন আগে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তন্ত্র ইতিহাস বিষয়ক একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল, যেখানে কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল উনিশ শতকের কৃষ্ণনগরে তৈরি এক মৃন্ময়ী কালীমূর্তি।
তন্ত্রের ইতিহাস অবৈদিক, যা পশ্চিমে স্বীকৃত। মাতৃকার আদি ধর্মর প্রত্নতত্ত্ব যেভাবে পশ্চিমে আলোচিত, পৌরাণিক গ্রন্থে এবং পরবর্তী যুগে তন্ত্রশাস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে জগন্মাতার চিত্র বিবর্তিত হল, সেই গবেষণা পশ্চিমে হয়েছে যেভাবে, তার জুড়ি নেই। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্ত্র কোর্স করতে গিয়ে এই উপলব্ধি হয়েছে যে আমরা কয়েক যোজন পিছিয়ে আছি। এবং তন্ত্রভূমি বাংলা, কালীক্ষেত্র বাংলাকে তো শুধু লজ্জিত হলে চলবে না, প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
কিন্তু একটা আশ্চর্য বিষয় হল মা কালী সম্পর্কে ইংরেজদের আগ্রহ সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগ থেকে লিপিবদ্ধ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে কালীঘাটে পুজো দেওয়া হয়েছিল, জোশুয়া মার্শম্যান লিখে গেছেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই বিবরণ থেকে জানতে পারছি যে গভর্মেন্টের প্রতিনিধি কয়েকজন ইংরেজ কালীঘাটের মাতৃমন্দিরে গিয়ে পাঁচ হাজার টাকার পুজো দেন। সেযুগের পাঁচ হাজার টাকা! পুজোর উপলক্ষ ছিল উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাম্প্রতিক কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধজয়।
মার্শম্যান আরও লিখেছিলেন, হাজার হাজার বাঙালি সমবেত হয়েছিলেন সেদিন ইংরেজের কালীপুজো দেখতে। তবে মার্শম্যান যেমন ভেবেছিলেন, বাঙালি সম্ভবত ততটাও অবাক হয়নি। কলকাতার বুকে বউবাজারে অনেক আগে থেকেই ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি আছে। আগে লিখেছি ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি সম্পর্কে আমার পেজে।
ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করা প্রয়োজন সন্দেহ নেই। সব রকমের আগ্রাসনের নিন্দা করতে হবে। কিন্তু এও সন্দেহ নেই, কালীঘাট গিয়ে পুজো ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের কোনও প্রতিভূ দেবেন না, আর শাকাহারী গোবলয়ও কালীঘাট এড়িয়ে চলেন কারণ আমরা পাঁঠাবলি দিই।
গিভ দ্য ডেভিল ইটস ডিউ, ইংরেজি প্রবাদে বলে: শয়তানকে তার প্রাপ্যটুকু দাও। ইংরেজ শয়তান হতে পারে, কিন্তু ইংরেজ আমাদের মা কালীকে সম্মান করেছিল। এখনও করে। যে কথা বাকি সমস্ত বিজাতীয় বলয় সম্পর্কে সহজে বলতে পারি না। লুট করে তো সবাই। কিন্তু কতজন তন্ত্র সম্পর্কে সারস্বত গবেষণা করে গেছে? কে করবে? সঙ্ঘ পরিবার করবে? বামজেহাদি-কংগ্রেস- তৃণমূল করবে? বাংলাদেশ করবে? বাংলার হিন্দুকে লুট তো এরা সবাই করে। কিন্তু আমাদের শেকড়ে থাকা তন্ত্র ও শাক্ত ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধা কে দেখিয়েছে? কেউ দেখায় নি। আর আমাদের ভেতরে থাকা অমর্ত্য সেন বা মহুয়া মৈত্র টাইপের বিশ্বমানব তো আমাদের বুকের ওপরে বসে বসে নিজেদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থের খিচুড়ি রেঁধে যাচ্ছে, তারা আজ পর্যন্ত আমাদের কেবলমাত্র শেকড়বিচ্ছিন্ন ও আত্মবিস্মৃত করাতেই উদ্যোগী হয়েছে। এদের থেকে ইংরেজ সম্ভবত ভালো, কথাটা বিতর্কিত শোনাবে, তবুও বলা দরকার।
প্রসঙ্গত, তন্ত্র সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, এবং তন্ত্র সম্পর্কে শিক্ষিত সমাজে খারাপ ধারণা কেটেছিল প্রথমবারের জন্য একজন ইংরেজের কারণে। শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের শিষ্য স্যার জন উড্রফ ছিলেন সেযুগে ভারতের রাজধানী কলকাতায় অবস্থিত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি আর্থার আভালন ছদ্মনামে তন্ত্র বিষয়ক অনেকগুলি বই লিখে পশ্চিমে তন্ত্র গবেষণার উদ্বোধন করেন।
দেড়শ বছর আগে কৃষ্ণনগরে তৈরি এই মৃন্ময়ী কালীমূর্তি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আছেন। এই মাতৃমূর্তিই ব্রিটিশ মিউজিয়ামে Tantra: From Enlightenment to Revolution শীর্ষক সারস্বত প্রদর্শনীর কেন্দ্রে ছিলেন। ছবি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ডেটাবেস থেকে।
পৃথিবীর কোথাও, উপমহাদেশের কোথাও, ভারতের কোথাও বাংলাভাষী হিন্দু আক্রান্ত হলে কালীক্ষেত্র কলকাতা নিজের দায় এড়াতে পারে না। We need to develop our own version of Karaganov doctrine.জয় মা কালী!
বাংলা নাটকের অবিস্মরণীয় শিল্পী উৎপল দত্ত বাংলা বাণিজ্যিক ছবির একজন জনপ্রিয় চরিত্রাভিনেতাও ছিলেন। তিনি একবার অভিযোগ করেছিলেন, পুরো সিনেমা জুড়ে যে খল, আচমকা লাস্ট সিনে এসে, কি আশ্চর্য, সে ভালো হয়ে যাচ্ছে, স্রেফ একটি কাঁচা চিত্রনাট্যের হ্যাপি এন্ডিং হবে বলে। উৎপল নিজে এরকম চরিত্রে অনেক বাংলা চলচ্চিত্রেই অভিনয় করেছেন, এবং বিষয়টা নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। তবে এটা উৎপল দত্তকে নিয়ে পোস্ট নয়।
বখতিয়ার থেকে শুরু করে অন্ধকার মধ্যযুগ জুড়ে সমস্ত বিজাতীয় আগ্রাসন, ইংরেজ আসার পর তিতুমীরের ওয়াহাবি ও দুদুমিয়ার ফরাজী থেকে শুরু করে বিংশ শতকে ঢাকায় মুসলিম লীগ স্থাপনা, বিংশ শতকের প্রথম চার দশক জুড়ে অনবরত বিক্ষিপ্ত হিংসা চালিয়ে হাত পাকিয়ে তারপর ছেচল্লিশ সালে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং ঐ বছরেই নোয়াখালির অসামান্য রক্তাক্ত ইতিহাস, এর পরে পঞ্চাশ সালে পূর্ববঙ্গ জুড়ে বিশেষ করে বরিশালের সেই বিখ্যাত গণহত্যা – এসবের পরে আচমকা সেকুলার চেতনা নিয়ে বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হলেন ওঁরা।
কি আশ্চর্য। বাংলাভাষী মুসলমানরা সবাই বাহান্ন সালে এসে অসাম্প্রদায়িক ভাষা আন্দোলন করে ফেললেন। তাঁরা একুশে ফেব্রুয়ারির অমর মিথের জন্ম দিলেন। যে মুজিব ছেচল্লিশ সালে ছিলেন কলকাতায় লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ঝাণ্ডাধারী, ছিলেন কশাই সুহরাওয়ার্দীর অনুগামী, তিনিই বাহান্ন সালে এসে অসাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছেন। কিভাবে এই আশ্চর্য ঘটনা সম্ভব হল?
আসলে এই দিনটি শুধু কাঁচা চিত্রনাট্য নয়, একটি মিথ্যাচারও বটে। পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমান আরব্য রজনীর সিন্দবাদের বুড়োর মত প্রথমে উর্দুভাষী মুসলমানের ঘাড়ে চেপে ভারত ভেঙে পাকিস্তান এবং তারপর বাংলাভাষী হিন্দুর ঘাড়ে চেপে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করেছেন। বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলন সিন্দবাদের বুড়োটির এক ঘাড় থেকে অন্য ঘাড়ে মাইগ্রেশন হিসেবে গণ্য হবে।
ভাষাটা আরবি ফার্সি অনুপ্রবেশ করে বিকৃত হয়ে গেছে, সংবিধান শুরু হয় বিসমিল্লাহ বলে, বাংলাভাষী হিন্দুরা সেই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। অনবরত এথনিক ক্লিনজিং এর ফলে সাতচল্লিশ সালে পূর্ববঙ্গে যে পঁয়ত্রিশ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা ছিল, আজ সম্ভবত পাঁচ কিংবা ছয় শতাংশ। নিয়মিত হিন্দুর জমি লুট হয় ওই দেশে, নিয়ম করে হিন্দুর ধর্মস্থানে আঘাত নামে, হিন্দুর মেয়েরা গনিমতের মাল হিসেবে গণ্য হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা নারকীয় পরিস্থিতিতে বেঁচে আছেন।
কিন্তু কি আশ্চর্য, তাও বছর বছর একটা অসাম্প্রদায়িক একুশে ফেব্রুয়ারি দিবস চলে আসে, আর এদের ঢপের চিত্রনাট্যের হ্যাপি এন্ডিং হয়ে যায়। এরপর অলীক সেকুলার প্রেক্ষাগৃহে আলো জ্বলে ওঠে, আর পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবাদীরা জয় বাংলা বলে আনন্দাশ্রু ফেলতে থাকে।
মা কালী ও তন্ত্র: ইতিহাস, তত্ত্ব, প্রয়োগ। পয়লা বৈশাখ অনলাইন কোর্স শুরু হবে। কোর্সের কাঠামো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ধাঁচে করা হচ্ছে। জয় মা বলে সঙ্গে থাকুন।
গড়পঞ্চকোট খণ্ডহর আজকে যা দেখি, তা আদিতে একটি মাতৃমন্দির কমপ্লেক্স ছিল। পালসেনযুগে মা কল্যাণেশ্বরীর আদি মন্দির এখানেই ছিল, যদিও মা কল্যাণেশ্বরীর মন্দির অনেক শতাব্দী হল মাইথনে সরে গেছে। কিন্তু পালদের (পরে সেনদের) সামন্তরাজা শিখর রাজবংশ মাতৃকা উপাসক ছিলেন, সমস্ত ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান: পুরো অঞ্চলটিই মাতৃকা উপাসক ছিল বলেই ‘ধলেতে রঙ্কিণী মা গো শিখরে কল্যাণী” প্রবাদ লোকমুখে প্ৰচলিত। এই গড়পঞ্চকোট পালসেনযুগে তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃধর্মের অন্যতম কেন্দ্র ছিল।
তবে মধ্যযুগে এখানে রাধাকৃষ্ণময় বৈষ্ণব ধর্ম প্ৰচলিত হয়। সেই ধারার প্রভাবে বর্তমানে গড় পঞ্চকোটে পুনস্থাপিত মন্দির কাঠামোগুলো হুবহু মধ্যযুগের বিষ্ণুপুরের বৈষ্ণব স্থাপত্যর মত করে দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। কি ভালোই না হত, যদি এখানে বিদ্যমান পালসেনযুগের আদি কল্যাণেশ্বরী মাতৃমন্দিরের কাঠামো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হত।
আমার সেলফিটি গড়পঞ্চকোট আদি কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে তোলা, মাসখানেক আগে। সেই প্রাচীন মাতৃমন্দিরের কাঠামোর ভিত্তি যতটুকু দেখা যাচ্ছে, জুম করে দেখুন। রোমাঞ্চিত হন। এই আপনার শেকড়, এই আপনার ইতিহাস। এই ইতিহাস মুছে দিতে দেবেন না কোনও ডান, কোনও বাম, কোনও বিশ্বমানবকে। কোনও স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সিলেবাস আপনাকে এই ইতিহাস জানতে দেবে না, কোনও টিভি স্টুডিও জানতে দেবে না, কোনও বাজার পত্রিকা জানতে দেবে না। কিন্তু আপনি তবুও ঠিকই জানতে পেরে যাবেন, সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে। কারণ আপনি মায়ের সন্তান, আপনি বাঙালি, এই ভূমি তন্ত্রভূমি, এখানকার মাতৃধর্মে আপনার অস্তিত্ব সংজ্ঞায়িত হয়।
শিবরাত্রির পুণ্য ক্ষণে মাতৃধর্ম ও শিবের সুপ্রাচীন সম্পর্কের ঐতিহাসিক বর্ণনা।
১. হরপ্পা সভ্যতার তথাকথিত পশুপতি মূর্তির ব্যক্তিটি ছিলেন হরপ্পার তন্ত্রধর্মের পুরোহিত। বর্তমানে সব গবেষক একমত, শিরিন রত্নাগর দ্রষ্টব্য। আলেক্সিস স্যান্ডারসন একজন বিখ্যাত হিন্দুধর্মীয় তাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ, বিশেষ করে শৈবধর্ম বিশেষজ্ঞ, তিনিও এই মত প্রকাশ করেছেন। তারা সবাই পশুপতি মূর্তিটিকে Shaman আখ্যা দিচ্ছেন, অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতার পুরোহিত বা তান্ত্রিক।
২. এখানে একটা আশ্চর্য বিষয় হল যোগী শব্দের আদি অর্থই তাই, ইতিহাসবিদ ও ভাষাবিদ সুকুমার সেনের মতে: যিনি পুজোয় যোগান দেন। যোগী ও যোগিনী আমাদের তন্ত্রধর্মের মাতৃকা উপাসনায় উপচার যোগান দিতেন, মায়ের পুজো করতেন, এই ছিল আদি অর্থ। পরবর্তী যুগে যোগাসনকারী অর্থে যোগী হয়েছে। তাই আদিযোগী শব্দের পুরোনো এবং আদি অর্থ হবে যিনি মায়ের পুজোর আদি পুরোহিত, মায়ের তন্ত্রধর্মীয় উপাসনায় আদি যোগানদার।
৩. এখানে আরেকটি চিত্তাকর্ষক বিষয় হল, শিব শক্তির দাম্পত্য পরিকল্পনা চিরকালের নয়। ষষ্ঠ শতকে শ্রী শ্রী চণ্ডী গ্রন্থে দেখি, শিব ও দুর্গার মধ্যে আদৌ কোনও স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক কল্পিত নয়।
৪. বৈদিক সাহিত্যে বাজসনেয়ী সংহিতা গ্রন্থে রুদ্রকে অম্বিকার ভ্রাতা বলা হয়েছে, অর্থাৎ একসময় শিব ও শক্তির ভ্রাতা ভগ্নী সম্পর্ক কল্পিত হয়েছিল।
৫. তারাপীঠে শিশু শিব আছেন মা তারার কোলে। সুপ্রাচীন জগন্মাতার সন্তান রূপে শিবের তত্ত্ব তৈরি হয়েছিল, যা চন্দ্রকেতুগড়ের কিছু মূর্তি দেখলে বোঝা যায়, সেখানে মাতৃকার কোলে ছোট্ট সন্তানটি শিবের মত জটাজুট বিশিষ্ট।
৬. আবার আদিযুগে চামুণ্ডা এবং পালসেনযুগে কালীর পদতলে থাকা শবটি মায়ের পাদস্পর্শে শিব হয়েছে, এই বিবর্তন সেই যুগের মাতৃমূর্তি যাঁরা দেখেছেন সবাই জানেন: প্রথম দিকে শব, পরের দিকে সেটিই শিবের আদল পেয়েছে।
৭. মহাকাল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাতৃধর্মের তত্ত্ব। মহাকাল হলেন মহাকালীর পুরুষ রূপ। তিনিই ভৈরব। পালযুগের তন্ত্রে মহাকাল অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তাঁকে ধর্মপালও বলা হত। সম্রাট ধর্মপালের আদলে এই স্ফীতোদর গোঁফদাড়িসহ মহাকাল মূর্তি তৈরি হত, এমন সিদ্ধান্ত করার পেছনে কিছু যুক্তি আছে। ধর্মপাল নিজেই মাতৃভক্ত ছিলেন, মা তারার পতাকা থাকত তাঁর সেনাবাহিনীর ধ্বজায়। আমাদের সমস্ত মাতৃপীঠে অতন্দ্র ভৈরব হিসেবে মহাকাল স্বয়ং আছেন প্রহরায়।
শিবের সঙ্গে একজন আদিমাতা (সতী/পার্বতী)র বিবাহ পৌরাণিক যুগে ঘটে। বাংলায় শশাঙ্কযুগে শিব ও নীলচণ্ডী/নীলাবতী/নীলা দেবীর বিবাহ উৎসব ঘটে এবং বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়।
জয় জয় মা। জয় জয় মহাকালী। জয় জয় মহাকাল।
ছবিতে পালযুগের মহাকাল মূর্তি। বর্তমান অবস্থান মেট মিউজিয়াম।
১. শক্তিপীঠধারণা অত্যন্ত প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহাভারতে বনপর্বে তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে তিনটি শক্তিপীঠ উল্লিখিত, এর মধ্যে দুটি ছিল জগন্মাতার যোনিকুণ্ড: একটি পঞ্চনদের বাইরে ভীমাস্থানে এবং অন্যটি উদ্যতপর্বত নামক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ছিল। এছাড়া একটি স্তনকুণ্ড ছিল, গৌরীশিখর নামক পাহাড়চূড়ায়।
এই ভীমাস্থান মহাভারত রচনার এক হাজার বছর পরেও সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং দেখে গেছেন এবং লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ভীমা দেবীর গাঢ় নীল প্রস্তর মূর্তি দেখেছিলেন তিনি।
বোঝা যায়, উপমহাদেশের তন্ত্রনির্ভর মাতৃকা উপাসনায় শক্তিপীঠের ধারণা আবহমান: প্রাচীন যুগ থেকেই ছিল, এবং অনেক হাজার বছর ধরে একটানাভাবে আছে।
২. কিন্তু বিষ্ণুচক্র কর্তৃক সতীর দেহ খণ্ড বিখণ্ড করে শিবের তাণ্ডব থামানোর কাহিনীটি একেবারেই প্রাচীন নয়, সেটি প্রথম পাওয়া যায় দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে সেনযুগে রচিত বৃহদ্ধর্ম পুরাণে। এই কাহিনী অন্যত্র নেই। বেশিরভাগ পুরাণে সতী দক্ষযজ্ঞে তনুত্যাগ করেন, অথবা অগ্নিপ্রবেশ করেন, এবং তাঁর পুনর্জন্ম ঘটে পার্বতী রূপে। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু তাঁর দেহকে বিষ্ণুচক্র কর্তৃক খণ্ড বিখণ্ড করা পরবর্তী যুগের পৌরাণিক কল্পনা।
৩. খণ্ড সমাধি (ফ্র্যাগমেন্ট বেরিয়াল) উপমহাদেশের প্রাচীন তান্ত্রিক প্রথা। পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতায় খণ্ড সমাধি দেখা গেছে। চার হাজার বছর আগে পাণ্ডু রাজার ঢিবি, যা ছিল মাতৃকা উপাসক, এবং পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন প্রত্ন সভ্যতা, সেখানেও খণ্ড সমাধি দেখা গেছে। এই ধারাতেই কোনও পূজ্য আদি মাতার দেহখণ্ড উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রোথিত করা হয়ে থাকবে।
তিব্বতের তন্ত্র ধর্মে এখনও খণ্ড সমাধি দেখা যায়। গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে যখন রক্ষিত হয়েছিল, তা অবশ্যই এই তন্ত্রধর্মের প্রথার অনুসরণ ছিল।
৪. শক্তিপীঠ কিন্তু কেবল খণ্ড সমাধির স্মৃতিবাহী নয়। সবথেকে প্রাচীন, যেমন মহাভারতের শক্তিপীঠ উল্লেখ খণ্ড সমাধিরই প্রথা, সেটা বোঝা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বিভিন্ন স্থানেশ্বরী অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তীর্থস্থান শক্তিপীঠের আখ্যা পেয়েছিল। ইতিহাসবিদ নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেছেন যে আঞ্চলিক মাতৃকাদের উপাসনা এক বিশ্বজনীন মাতৃধর্মে সুসংহত করার পদ্ধতি হিসেবে শক্তিপীঠ তত্ত্বের উত্থান ঘটেছিল।
৫. এই প্রসঙ্গে শক্তিপীঠ তত্ত্বের পেছনে উপমহাদেশের আরেকটি তন্ত্রধর্মীয় প্রথাও স্মর্তব্য: একাধিক মাতৃকার উপস্থিতি, যেমন হরপ্পা সভ্যতা থেকে পূজিত সপ্ত মাতৃকা, যেমন পৌরাণিক কাহিনীর কৃত্তিকা। মহাভারতে শল্য পর্বে ষটচত্বারিংশ অধ্যায়ে মাতৃকাগণের নামের একটি তালিকা আছে: বিশালাক্ষী, ভদ্রকালী, কালিকা, চতুষ্পথরতা, চতুষ্পথনিকেতা – এরকম অনেক নাম সেখানে পাওয়া যায়। নাম দেখে বোঝা যায় এঁরা অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত প্রাচীন পথের স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারসেকশনে পূজিত হতেন, কারণ দেবী নগরেশ্বরী অধিষ্ঠাত্রী হন। আজও আমরা দেখি মাতৃমন্দির স্থাপনার স্থানগুলি ব্যস্ত নাগরিক পথের নিকটে হয়, যদিও নির্জন সাধনস্থানেও মাতৃমন্দির স্থাপনার প্রথা আছে (বিজাতীয় আগ্রাসনের অন্ধকার নেমে এলে নির্জন স্থানে মাতৃমন্দির স্থাপনের কিছু কৌশলগত প্রয়োজন বৃদ্ধি হয়ে থাকবে)।
যোগিনীর সংখ্যা চৌষট্টি, এই প্রসঙ্গে অগ্নিপুরাণের বক্তব্য বেশ চিত্তাকর্ষক। মাতৃকা আট জন, এবং প্রত্যেকের আট রকম প্রকাশ, তাই পূজিত মাতৃকার সংখ্যাটা চৌষট্টি, অগ্নি পুরাণে বলা হয়েছে।
৬. বৃহদ্ধর্ম পুরাণে প্রদত্ত একান্ন শক্তিপীঠের সংখ্যা কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে দেওয়া তালিকার সঙ্গে মেলে না। কিন্তু বলা দরকার এই একান্ন শক্তিপীঠের বেশিরভাগ বাংলায় অবস্থিত। সবথেকে বিখ্যাত শক্তিপীঠ অবশ্যই কলকাতা, যা কালীক্ষেত্র, যেখানে কালীঘাট অবস্থিত, যেখানে দেবীর ডান পায়ের আঙুল আছে।
৭. দেবী ভাগবত পুরাণে ভারত জুড়ে শক্তিপীঠ এবং সেখানে পূজিত শক্তিপীঠেশ্বরীর তালিকা আছে, সেখানে বৃন্দাবন শক্তিপীঠে পূজিত শ্রীরাধার উল্লেখ আছে!
সবশেষে বলা দরকার, তন্ত্রধর্মের রাষ্ট্রধারণা, ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় আমাদের জগন্মাতা আছেন। দেবী বলেছেন অহং রাষ্ট্রী। এই শক্তিপীঠগুলি আমাদের শক্তিকেন্দ্র, আমাদের জাতির রাষ্ট্রবিন্দু। বীরভূমে লাভপুরে দেবী ফুল্লরা, নলহাটিতে দেবী নলাটেশ্বরী, মুর্শিদাবাদে দেবী কিরিটেশ্বরী সহ অনেকগুলি শক্তিপীঠ আছে পশ্চিমবঙ্গে। আমাদের ভূমি শাক্তভূমি, আমরা জয় মা ধ্বনি দিয়ে নিজেদের বাঙালি জন্ম সার্থক করি।