মা কালীর পূজা আর কৃচ্ছ্রসাধনকে অনেকেই এক করে ফেলেন। কালীপূজা মানেই সমস্ত দিন উপবাস, কঠোর বিধিনিয়ম, সংযমের আতিশয্য, শরীর পাতনের সংকল্প। এমনটাই ধারণা আমাদের সমাজের সিংহভাগ মানুষের। কিন্তু …. মায়ের পূজার তন্ত্রোক্ত বিধি কি আদৌ তাইই বলে?
বাঙালির তন্ত্রের কেন্দ্রে আছেন মা কালী। কলৌ কালী কলৌ কালী কলৌ কালী ন সংশয়:। আর কালীকেন্দ্রিক এই তন্ত্রধর্মের নামকরণের অগণিত ব্যাখ্যার একটি হল : ” তনুকে ত্রাণ করা।” যদিও এটি অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন ব্যাখ্যা। তন্ত্রের আদি অর্থ তন্তু বা weaving এর সাথে সংযুক্ত। প্রকৃতির সমস্ত শৃঙ্খলা, মানবদেহ ও চেতনার সমস্ত নিয়মের নির্যাসই এই তন্ত্রধর্মের প্রাণ। তাই যে ব্যাখ্যাই ধরি না কেন; তন্ত্রে সব অর্থেই দেহকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তন্ত্র মতে:
“ব্রহ্মাণ্ডে যে গুণা সন্তি তে তিষ্ঠন্তি কলেবরে”
বাঙালি সাধকের ভাষায়:
যাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাহাই আছে দেহভাণ্ডে
এই দেহ মায়ের অধিষ্ঠান। কালীকিঙ্কর কবিরঞ্জন রামপ্রসাদের পদে আমরা তার সোচ্চার ঘোষণা শুনি:
“আনন্দে রামপ্রসাদ রটে মা বিরাজে সর্বঘটে
ঘটে ঘটে যত রূপ মা আমার সে রূপ ধরে”
উপমহাদেশে যত সুপ্রাচীন শক্তিপীঠ আছে; তন্ত্র তাদের প্রতিটির দ্যোতনা খুঁজে পেয়েছে মানবদেহে। এই তত্ত্বটি কৌলাচারে তোড়লতন্ত্রে এভাবে প্রকাশিত হয়েছে:
মূলাধারে কামরূপ, হৃদয়ে জলন্ধরপীঠ, তার ঊর্ধ্বে পূর্ণগিরি ও উড্ডিয়ান। ভ্রূমধ্যে বারাণসী। নেত্রে জ্বালামুখী। মুখে মায়াবতী।
এ হেন তন্ত্রমার্গে মা কালীর উপাসনা কখনোই শরীরকে ক্লেশ দিয়ে সম্ভব নয়।
রামপ্রসাদের পদে আমরা দেখি:
চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় যত রস এ সংসারে
আহার করো মনে করো আহুতি দেই শ্যামা মা’রে
এটাই হল তন্ত্রের মানসপূজার তত্ত্ব। তোমার দেহে মায়ের অধিষ্ঠান। যা কিছু তোমার প্রিয়; তোমার শরীরের পুষ্টির জন্য আবশ্যক; তার আস্বাদনের মাধ্যমেই জগতজননীকে তৃপ্ত করো। অনাবশ্যক উপবাস, অতি অল্পাহারের ক্লেশ এই পথে একান্তই নিরর্থক। বরং এই জগতে আনন্দের যে অপূর্ব ধারা বয়ে যাচ্ছে; তার বারংবার আস্বাদন এবং তার গভীরে যে অপূর্ব প্রজ্ঞা নিহিত আছে; বারংবার তার উপলব্ধির পথেই তন্ত্রে কৈবল্যের বিধান আছে। কৌলমার্গের সেই সুবিখ্যাত শ্লোক এই প্রসঙ্গে স্মরণ করি:
পিত্বা পিত্বা পুনঃ পিত্বা পপাত ধরণীতলে
উত্থিত্বা চ পুনঃ পিত্বা পুনর্জন্মং ন বিদ্যতে
কৌলমার্গে তো এমন নির্দেশও আছে যে উপবাসক্লিষ্ট অশক্ত দেহে যে কালীপূজা করে সে কখনোই অভিষ্ট লাভ করে না।
সহজযানের সিদ্ধাচার্যরাও একই কথা বলেছেন। সরহবজ্র জটিল ধর্মাচরণের অনর্থক পরিশ্রমকে তিরস্কার করে বলেছেন:
এস জপ হোমে মণ্ডল কম্মে
অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে
তো বিন তরুণী নিরন্তর নেহে
বোহি কি লবভই প্রণ বি দেহে
এই হোম, মণ্ডল রচনার কঠিন বিধি তোমাকে ধর্মের বহিরঙ্গেই আটকে রাখে। এই দেহে বোধিলাভ তখনই সম্ভব; যখন সেই তরুণী স্নেহধারা বর্ষণ করেন। এই তরুণীই অদ্বৈতা আদিমাতৃকা; বাঙালির মা কালী।
আমাদের তন্ত্রধর্ম; আমাদের মা কালীর সাধনা আমাদের নিঃশ্বাসের মতোই জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। জগতবিচ্ছিন্ন হয়ে; প্রকৃতির স্বাভাবিক গতির বিরুদ্ধাচরণ করে মর্কট বৈরাগ্যকে তন্ত্র সযত্নে পরিহার করেছে। এই পথ এতটাই জীবনসম্পৃক্ত যে অনায়াসেই বস্তুবাদী ধারণা আর গূঢ় তত্ত্বকে আমরা একাকার করতে পারি। ঐহিক চেতনায় যা সুখদায়ক বলে পরিচিত; সেই মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুনকেই আমরা পঞ্চ ম কারের তত্ত্বে মাতৃসাধনার সোপানে পরিণত করি। আমাদের চর্যাপদের কবি পদ্মার খালে বজ্রনৌকা চালনা করে আত্মোপলব্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়কে বঙ্গালী নাম দেন।
পুণ্যের জন্য সুদূর তীর্থে পাড়ি দেওয়াকেও তন্ত্রে অপ্রয়োজনীয় বলা হয়েছে।
তীর্থভ্রমণ দুঃখসাধন মন উচাটন হয়ো না রে
তুমি আনন্দত্রিবেণীর মূলে শীতল হও না মূলাধারে
সাধক কবি রামপ্রসাদ গেয়েছিলেন।
আবার সাধক কমলাকান্তের মৃত্যুকালে যখন বর্ধমানের রাজা তেজশ্চন্দ্র তাঁকে গঙ্গাতীরে নিয়ে যেতে চান; তখন সাধক কমলাকান্ত বলেছিলেন:
আমি কেন কি কারণে গঙ্গাতীরে যাব?
কেলে মায়ের ছেলে হয়ে বিমাতার কি শরণ লব?
অর্থাত সহজ পথে স্থির থাকো। কালীতত্ত্বে অটল থাকো। আর কিছুই দরকার নেই। এই পথে চলেই রাণী রাসমণি কাশীযাত্রা না করে বাংলার বুকে তন্ত্রপীঠ দক্ষিণেশ্বরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সংক্ষেপে বলতে গেলে শারীরিক ক্লেশ, জটিল আচার, ক্লান্তিকর যাত্রা কোনো কিছুই তন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ নয়। মায়ের এই সাধনমার্গ বড়ো সরল; বড়ো ঋজু। অহেতুক জটিলতার দুর্গম পথে তাঁকে পাওয়া যায় না। কালী ধরা দেন প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিতে; একান্ত সহজ পথেই।
উজুরে উজু ছাড়ি মা জাহু রে বঙ্ক
নিঅড়ি বোহি মা জাহু রে লঙ্ক
© কালীক্ষেত্র আন্দোলন
