মহাকাব্যে মা কালী: রামায়ণ মহাভারতে মা কালীর উল্লেখ।
একটা বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা আছে যে মা কালীর উল্লেখ প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে পাওয়া যায় না, মা কালীর উত্থানের বিবরণ মধ্যযুগে আগমবাগীশ থেকে শুরু, কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে nothing can be further from the truth: প্রকৃত ইতিহাস হল মা কালীর প্রত্ন প্রমাণ হরপ্পা সভ্যতা থেকে পাওয়া যায়, এবং মা কালীর তত্ত্ব দর্শন ও বিমূর্ত প্রকাশের লিপিবদ্ধ নথি ঋগ্বেদে রাত্রিসূক্ত থেকে শুরু হয়। এমনকি ঐতরেয় আরণ্যকে বয়াংসি শ্লোক যা প্রাচীন বাঙালিকে চিহ্নিত করে, সেটিও মা কালীর দ্যোতনা বহন করে কারণ মা কালীর আদি রূপ বলাকা মাতৃকা। মুণ্ডক উপনিষদ সরাসরি নাম করেই মা কালীর উল্লেখ করে, আগে লিখেছি এই বিষয়ে। এ কথা সত্যি যে বৈদিক সনাতনী বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী সভ্যতায় মা কালী কিছুটা প্রান্তিক কারণ তিনি তন্ত্রের দেবী, তিনি ব্রাত্য-আর্য সভ্যতার অধিষ্ঠাত্রী। কিন্তু তা সত্ত্বেও উত্তর ভারতে আর্যাবর্ত কৃষ্টির বিভিন্ন গ্রন্থে মা কালীর উল্লেখ আছে যা আমাদের জগৎজননীর প্রাচীনত্ব ঘোষণা করে। বৈদিকদের নির্ঋতি দেবী কৃষ্ণা এবং ঘোরা বলে বর্ণিত, তিনিও আমাদের মা কালীর আদি রূপ। বৈদিক বর্ণবাদী আর্যাবর্ত মা কালীকে ভয় করত, ভয় থেকে ভক্তি করত। মায়ের স্নেহময়ী রূপ বাঙালির নিজস্ব সম্পদ, আর্যাবর্ত গ্রন্থে মা কালীর করাল ভয়াল প্রলয়ঙ্করী রূপটি মুখ্য। কাজেই প্রাচীন নথি খোঁজার সময় এই বিষয়টি মাথায় রাখলে সুবিধা হবে।
আজ আমরা দুটি প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্যে মা কালীর উল্লেখ সম্পর্কে সংক্ষেপে জানব।
বাল্মীকি রামায়ণ-এ একজায়গায় কালীকে নৃত্যরতা ভগবতী বলা হয়েছে এবং তিনি শূর্প, ফাল, মুষল প্রভৃতি অস্ত্রের মালা ধারণ করেন, এমন জানানো হয়েছে। বোঝা যায় নৃত্যকালীর মূর্তিকল্প বেশ প্রাচীন।
তবে রামায়ণের তুলনায় মহাভারতে মা কালীর উল্লেখ অনেক বেশি। শল্য পর্ব সমসাময়িক ভারতে পূজিত জনপ্রিয় মাতৃকাদের একটি তালিকা দেয়, সেখানে ভদ্রকালী এবং কালিকার উল্লেখ পাওয়া গেছে।
মহাভারতে দুর্গাস্তোত্র আছে আমরা জানি। সেখানে ভদ্রকালী ও মহাকালী উল্লিখিত: “ভদ্রকালি নমস্তুভ্যং মহাকালি নমোস্তুতে।”মা কালীকে বলিপ্রিয়া রুধিরপ্রিয়া বলি আমরা, সেও এই মহাভারতের শ্লোক থেকেই।
মহাভারতে আর এক জায়গায় ভদ্রকালী উল্লিখিত যেখানে বীরভদ্রকে সঙ্গে নিয়ে স্বয়ং ভদ্রকালীই দক্ষযজ্ঞ বিনষ্ট করেছিলেন বলা হয়েছে। স্পষ্টই এটি দক্ষযজ্ঞ বিনাশের অন্যতম প্রাচীন উল্লেখ এবং পৌরাণিক যুগের আগেকার উল্লেখ।
স্কন্দ বা কার্তিকেয়জন্মের কাহিনী বর্ণনায় ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে মহাভারতে।
সর্বোপরি মহাভারতে সৌপ্তিক পর্বে মা কালীর উল্লেখ আছে। মা কালীর আবির্ভাব ঘটছে যখন অশ্বত্থামা পাণ্ডব শিবিরে রাতের বেলায় হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছেন। স্পষ্টই তিনি এখানে বলিপ্রিয়া রূপে আবির্ভূত, বলি গ্রহণ করতে এসেছেন। এখানে মা কালীকে বলা হয়েছে রক্তাস্যনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, পাশহস্তা, ভয়ঙ্করী।
যন্ত্র খুবই প্রাচীন কাল থেকে তান্ত্রিক সাধনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যন্ত্র একরকমের ডায়াগ্রাম বা রেখচিত্র, যার মাধ্যমে উপাস্য মাতৃকার আবাহন করা হয়। তন্ত্রে সমগ্র বিশ্বচরাচর পরস্পর সম্পর্কিত, এবং যন্ত্রে দেখা যায়, জ্যামিতিক সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার শক্তিক্ষেত্র পরস্পরের সঙ্গে একটা সার্কিট তৈরি করে। মা কালীর উপাসনা প্রাচীন কাল থেকেই কালীযন্ত্রে হয়। হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রধর্মে নানারকম proto যন্ত্র প্ৰচলিত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তন্ত্রে বিভিন্ন রকমের যন্ত্র আছে, সবথেকে বিখ্যাত যন্ত্র নিঃসন্দেহে কালীযন্ত্র। এটি জগদকারণ প্রকৃতির দ্যোতনা বহন করে। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান দিয়ে বিশ্বজগৎ তৈরি, এবং সেভাবেই যন্ত্র একটি বহুমুখী কাঠামো, এখানে বিভিন্ন রকমের রেখা এবং নানা জ্যামিতিক প্যাটার্ন যেমন কেন্দ্রের ত্রিভুজ, পদ্ম আকৃতির আবরণ, বৃত্ত, বিভিন্ন ভুজ এবং আয়তাকার বহির্দেশ – সব মিলে যন্ত্র এক দৃশ্যসুষমা রচনা করে, জগতের বৈচিত্র্য এবং জগন্মাতার মধ্যে জগতের ঐক্য সূচনা করে। কবিতায় যেমন ছন্দ, যন্ত্রে তেমনই বিভিন্ন রেখার সাযুজ্য। ঐশ্বরিক ও গূঢ় কাব্যময় জ্যামিতি হল এই যন্ত্র, এতে মন্ত্রের শক্তি ধরা আছে।
জগন্মাতা তাঁর বিভিন্ন আবরণ দেবতা কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন যন্ত্রে। সাধনার বিভিন্ন স্তরেরও প্রতীক এই যন্ত্র, অনেক ধাপ পেরিয়ে তবে আমরা আমাদের কৈবল্যদায়িনী মায়ের চরণে স্থান পাই।
আবার তন্ত্রের এই যন্ত্র প্রাচীন কাল থেকেই একটি মহাজাতির মহাসাম্রাজ্যের মানচিত্র সূচনা করে, যেখানে কেন্দ্রে আছেন মাতৃকা, কারণ তিনিই রাষ্ট্রী। পশ্চিমের কিছু গবেষক যন্ত্রকে মহারাজকীয় তত্ত্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন যেখানে বিভিন্ন আবরণ দেবতা, আবরণ রেখা এই তন্ত্রসাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্তম্ভ, যুবরাজ উপরাজদের চিহ্নিত করে এবং কেন্দ্রে থাকেন সম্রাট। তন্ত্রের অভিষেক সহ আরও অনেক তত্ত্ব সাক্ষ্য দেয় যে তন্ত্র চিরকালই রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল।
আবার সমৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক চলাচলের সঙ্গেও যন্ত্র সম্পৃক্ত। শ্রীযন্ত্র আজও বণিকদের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যন্ত্র এক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কের এবং বাণিজ্যিক আদান প্রদানের নেটওয়ার্ক।
যন্ত্র আসলে যোনিমণ্ডল, এ শব্দটি মাতৃচিহ্ন বহন করে। জগৎপ্রসবিনী মায়ের প্রতীক, অব্যক্ত বিশ্বযোনির ব্যক্ত রেখচিত্র হল যন্ত্র। বৃহৎ তন্ত্রসারে আগমবাগীশ কালীযন্ত্রের যেমন বর্ণনা করেছেন, তার মূলানুগ ছবি রইল।
মায়ের যন্ত্র এক মহাশক্তিক্ষেত্র যা দর্শন করে আমরা সবাই ধন্য হই। জয় মা কালী।
শক্তিসঙ্গমতন্ত্র বলেছে, কালী এবং তারা অভিন্ন। তারারহস্য বলেছে যে মা কালী যখন তারণ করেন, রক্ষা করেন তখন তারা নামেই কালীনাম ঘোষিত হয় – অর্থাৎ মা কালীই বিশেষ রক্ষাকর্ত্রী ভূমিকায় মা তারা রূপে বিরাজ করেন।
অবশ্যই মা তারা এবং মা কালীর মূর্তিকল্প পৃথক, দুজনের ইতিহাস পৃথক, দুজনের উপাসনা পদ্ধতিও আলাদা। কিন্তু মা তারা সহ সকল মহাবিদ্যাই মা কালীর ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ তাতে সন্দেহ নেই। মা কালী এক মহাসমুদ্র, আমরা সেই অনন্ত মহাসমুদ্রের এক এক তরঙ্গরাশিতে গিয়ে এক এক নামে তাঁর জয়গান করি।
আমরা জানি, মা কালী ছাড়া কলিকালে অপর কোনও দেবতা নেই (কলৌ কালী কলৌ কালী নান্যদেবঃ কলৌ যুগে) এবং কলিকালে একমাত্র মা কালীর সাধনায় সুফল অর্জিত হয় (কালিকা মোক্ষদা দেবী কলৌ শীঘ্র ফলপ্রদা)। মা কালীর পাদস্পর্শে শবও শিবে পরিণত হয়েছে। কালীসাধনায় সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলি কি কি? কালীসাধক যে সুফল পান, তার একটি তালিকা দেওয়া আছে কালিকাতন্ত্রে, সেটি আজ আমরা জানব।
কালীসাধকের মুখে সরস্বতী এবং গৃহে লক্ষ্মী অধিষ্ঠান করেন এবং দেহে সকল তীর্থ বিরাজ করে। কালীসাধক ধনে কুবের, তেজে সূর্য এবং বলে পবন; সঙ্গীতে গন্ধর্ব, দানে কর্ণ এবং জ্ঞানে দত্তাত্রেয়; শত্রুনাশে বহ্নি, মলিনতা নাশে গঙ্গা, এবং পবিত্রতায় অগ্নি তুল্য হন। কালীসাধক চন্দ্রের মত সুখদায়ক, কালের মত দুর্বার, সমুদ্রের মত গম্ভীর, বজ্রের মত দুর্ধর্ষ, বৃহস্পতির মত বাগ্মী, পৃথিবীর মত সহিষ্ণু এবং কন্দর্পের মত সুদেহী হয়ে থাকেন।
স্পষ্টই বোঝা যায় যে কালীসাধনায় মাতৃসাধক চতুর্বর্গ ফল লাভ করেন: ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ।
ইনি মা কালীর অন্যতম জনপ্রিয় রূপ যেখানে মা কৃষ্ণাঙ্গী নন, শ্যামাঙ্গী। শ্যামাকালী সাধারণত নীল বর্ণের হন। এঁর বর্ণ ঘন নীল কাজলের মত (নীলাঞ্জনচয়প্রখ্যা- বামন পুরাণে মা কালীর বর্ণনা)। আজ আমরা মা শ্যামার তাৎপর্য সম্পর্কে জানব।
★ শ্যামাকালীর মধ্যে অন্তর্লীন আছেন একদা জনপ্রিয় দেবী নীলা। ইনি মহাবিদ্যাদের কয়েকটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছেন।
★ মা কালীর বর্ণ সাধারণত কালো। তিনি রাত্রি, তাই কালো। কিন্তু নীলও রাত্রির রঙ।
★ আগুন এবং মা কালী অভিন্ন। মা কালীর জিহ্বা আগুনের শিখার সঙ্গে তুলনায়িত হয় প্রাচীন কাল থেকেই। আগুনের শিখায় একটি নীল আভা থাকে, আগুনের রঙ নীল। প্রদীপশিখার একটি অর্থ কৈবল্য বা নির্বাণ। মা কালী এজন্যও নীল। ভদ্রকালীকে আগুনের সু-উচ্চ শিখার মত নীল বলা হয়েছে।
★ কূর্ম পুরাণে মহাদেবী (যাঁরা পুরাণ পড়েছেন, তাঁরা জানবেন যে আদিতে পার্বতী ছিলেন কালী, পরে গৌরী। এই মহাদেবী পার্বতী কালীর কথা হচ্ছে) যখন বিশ্বরূপ সম্বরণ করেন, মানবীর দেহ ধারণ করেন, তখন তিনি নীলোৎপলবর্ণা। তাঁকে নীল পদ্মের মত দেখতে।
কালিকাপুরাণেও পার্বতী কালীকে নীল পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে: “নীলোৎপলদলশ্যামাং”।
★ দেবী নীলতারা বা নীলসরস্বতীর গুরুত্ব তন্ত্রে অসীম। এঁর নীলবর্ণের নানা তান্ত্রিক দ্যোতনা, গূঢ় তাৎপর্য আছে। নীলতারার একটি রূপ একজটা, আরেকটি মহাচীনতারা। আজকে মা শ্যামাকালীর মধ্যে এঁরা বিদ্যমান।
সবশেষে একটি ধাঁধা। একদা তুমুল জনপ্রিয় নীলাবতী পরবর্তী যুগে কেন হারিয়ে গেলেন?
নীলা, নীলচণ্ডী, নীলসরস্বতী, নীলতারা – এঁরা স্বতন্ত্র অস্তিত্বে আজকে তুলনায় কেন অপ্রচলিত বলুন তো? নীলা একদা অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু শশাঙ্কযুগে দেবী নীলা এবং শিবের বিবাহ উৎসবের পরিকল্পনা হয়। বাংলা নববর্ষের উৎসব সেই থেকে শুরু। সে তো ভালো কথা, কিন্তু শিবের মধ্যে দেবী নীলার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়ে গেল। আজকে বাংলায় নীল সরস্বতীর মন্দির কটি আছে কে জানে। একটি আছে হুগলির হরিপালে, এবছর সরস্বতী পুজোর দিন মাকে দর্শন করে এসেছিলাম।
আরও অনেক আগে একানংশা এইভাবে হারিয়ে গেছিলেন। তিনি অবশ্য স্ত্রী নন, ভগ্নী (বাসুদেব ভগ্নী) রূপে কল্পিত হয়েছিলেন। আগে লিখেছি মা একানংশা কালী সম্পর্কে। ইনিও কৃষ্ণের প্রবল জনপ্রিয়তার মধ্যে হারিয়ে গেছেন, অথচ শুরুতে এই একানংশা অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিলেন, চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় তাঁর অনেক মূর্তি পাওয়া গেছে।
কথাসরিৎসাগর একটি প্রাচীন ও রঙিন গল্পের বই। একাদশ শতকে লেখা। মনোহর কাহানিয়া যাকে বলে হিন্দিভাষীরা, এ হল তাই। এতে এক জায়গায় ভয়ানক একজন ডাকিনীকে দেখানো হয়েছে, যে গপ্পের ভিলেন, এবং তার দ্বারা আক্রান্ত নায়ক হল একজন সুকুমারমতি কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ। এতে তন্ত্রকে বীভৎস রকমের খারাপ একটা বিষয় দেখানো হয়েছে, নরমাংস ভোজন তন্ত্রের ব্রতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দেখানো হয়েছে, উৎকট সব কামাচার দেখানো হয়েছে, আকাশে উড়ন্ত কামপিপাসু সব ডাকিনীদের দেখানো হয়েছে। বস্তুত আজকের দিনে বাংলায় যত উদ্ভট রোমহর্ষক ভয়াল গল্প লেখা হয় তন্ত্রকে নিয়ে, তার সবই টেমপ্লেট খুঁজে পাওয়া যাবে কথাসরিৎসাগরের এই অংশে।
এই ডাকিনীর নাম কি? কালরাত্রি। হুম। এই নামই দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু নবরাত্রির সময় সপ্তম রাতে যে দেবী পূজিত হন, তিনিও তো কালরাত্রি?
হুম। নাম ছাড়াও বর্ণনায় কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়।
সে যাক, কথাসরিৎসাগর কোনও শাস্ত্র নয়।
★★★
মহাভারতে শল্য পর্বে ষটচত্বারিংশ অধ্যায়ে সমসাময়িক ভারতে পূজিত মাতৃকাগণের তালিকা দেওয়া আছে। এই তালিকায় পূজিত মাতৃকাদের মধ্যে অন্যতম নাম পূতনা।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। পূতনা?
হুম।। সেই যে, যিনি ভাগবত পুরাণ, হরিবংশ, বিষ্ণু পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে একজন রাক্ষসী এবং কৃষ্ণ কর্তৃক নিহত (মূল ও আদি মহাভারতে যদিও কাহিনীটি নেই)।
একটা মজার কথা কি জানেন? খ্রিষ্টপূর্ব যুগে মথুরা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি ধর্ম অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল, প্রত্ন প্রমাণ অনুযায়ী। না, বৈষ্ণব ধর্ম নয়, এটিও ছিল, কিন্তু মুখ্য নয়, গৌণ ছিল। মথুরায় জনপ্রিয় ধর্মের মধ্যে একটি ছিল নাগ উপাসনা ধর্ম। আর একটি ছিল মাতৃধর্ম। এছাড়া যক্ষ উপাসক সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ছিল। বৌদ্ধ ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলে প্রাচীন যুগে সবথেকে বেশি সম্ভবত মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে, মথুরা মিউজিয়াম ঘুরে দেখে আমার তাই সিদ্ধান্ত।
তো কালীয় দমন কাহিনী বোঝাই যায় এই নাগদের দমন। আর পূতনা? মাতৃকা ধর্মকে দমন? মাতৃকার vilification?
■■■
পূতনা অনেক গ্রন্থেই বলাকা হিসেবে বর্ণিত। পূতনা কি সেক্ষেত্রে প্রাচীন বলাকা মাতৃকার স্মারক? আগের ওই কথাসরিৎসাগরের কাহিনীটিতে দেখি, ডাকিনীরা সব খেচরী বিদ্যা অনুশীলন করছে। তারা উড়ছে।
◆◆◆
বলাকা থেকে মনে পড়ল। কবি কালিদাস মা কালীকে বলাকিনী বলে উল্লেখ করেছেন। কোথায় জানেন?কালিদাস তাঁর রঘুবংশে লিখেছেন, রামের সঙ্গে যুদ্ধরত তাড়কা রাক্ষসীকে মা কালীর মত দেখাচ্ছিল: “তাড়কা চলকপালকুণ্ডলা কালিকেব নিবিড়া বলাকিনী”।
★★★
তাড়কা রাক্ষসী? মা কালী? এক পংক্তিতে? একই রকম দেখতে? হুম, কালিদাস তেমনই লিখেছেন।
আচ্ছা, এই তাড়কা কোনও প্রান্তেশ্বরী মাতৃকা ছিলেন না তো?
ও, ভালো কথা। পূতনা নিয়ে বলছিলাম না? যে মাতৃকাগণের তালিকা মহাভারতে আছে, সেখানে পূজিত মাতৃকাদের মধ্যে পূতনার পাশাপাশি কালীও উল্লিখিত।
পূতনা, কালী একই পংক্তিতে?
ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন।
★■■★
তাহলে, আমরা কি সিদ্ধান্ত নেব? প্রশ্নটি সহজ, আর উত্তরও তো জানা। The answer my friend is blowin in the wind…
আমাদের মাতৃকা শত্রুহস্তে চিত্রিত। বঙ্কিমের সেই anecdote মনে আছে? একটা চিত্র, তাতে একজন মানুষ একটা সিংহকে শিকার করছে। সে ছবিটা দেখানো হয়েছিল এক সিংহকে। সিংহ ছবিটা ভালো করে দেখে শুনে বলেছিল, সিংহরা ছবি আঁকতে জানে না, জানলে ছবিটা অন্যরকম হত।
উত্তর ভারতের তন্ত্রবিরোধী বর্ণবাদী বৈদিক গোবলয়ের হাতে মাতৃকা বিকৃত হয়েছেন, মাতৃকা দূষণ ঘটেছে। আজ হুদূর দেখে ভাববেন না, এই এক নতুন। কিচ্ছু নতুন নয়, এগুলো সব বিজাতীয় বলয়ের অভ্যস্ত বাঁদরামি। এখনও দেখেন না, মা কালী সম্পর্কে ভয় দেখায় ওরা? মা কালীর পুজো গৃহস্থ বাড়িতে করতে নেই, এসব জ্ঞান শোনেন নি ফেসবুকে? মা সম্পর্কে সন্তানকে ভুল বুঝিয়ে সন্তানকে বিপথে চালিত করতে চায় এরা।
আপনি জানেন না, আপনার প্রাণের তন্ত্র ধর্মের বিরুদ্ধে, মাতৃকা উপাসনার বিরুদ্ধে কত ধরণের আগ্রাসন ঘটেছে অতীতে। জানলে শিহরিত হবেন।
বাল্মীকি রামায়ণে রামের অকালবোধন নেই। বাল্মীকির রাম লঙ্কায় রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের আগে সূর্যের উপাসনা করেন, দুর্গার নয়। অকালবোধন অর্বাচীন কাহিনী, পূর্বভারতে রামকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে নির্মিত, মধ্যযুগে কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে জনপ্রিয় করেন, এছাড়া দুয়েকটি অর্বাচীন পুরাণে পাওয়া যায় সেগুলোও মধ্যযুগের, এবং পূর্ব ভারতের।
মহাভারতে দুর্গাস্তব আছে। ঋগ্বেদে দেবী সূক্ত আছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দুর্গা সপ্তশতী আছে। এসব তো আছেই। তবে সবগুলোই পরবর্তীতে প্ৰক্ষিপ্ত, আদি রচনায় ছিল না, ইতিহাসবিদদের মতে। আমি নিজেই শল্যপর্বে উল্লিখিত উপাস্য মাতৃকাদের তালিকা ব্যবহার করেছি এই লেখায়।
অর্থাৎ দুই ধরণের প্রক্ষেপ হচ্ছে।
এক, আর্যাবর্ত গ্রন্থে মাতৃকা উপাসনা আসছে। সে আসতে বাধ্য। হরপ্পা সভ্যতার প্রভাব এত সহজে নষ্ট করা যায় না। উত্তর ভারতে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাতৃকা উপাসনা এথমও অসম্ভব জনপ্রিয়। ওদের রাম শিব প্রমুখ পুরুষ দেবতারা তো ওদের ধর্মের কেন্দ্রে আছেন সন্দেহ নেই কিন্তু সাধারণ মানুষ দস্তুরমত ছাগল বলি দিয়ে এখনও মায়ের পুজো করে। বাঙালি তো হরপ্পা থেকে হনুমানের মত লাফ দিয়ে পূর্ব ভারতে পৌঁছে যায়নি। উত্তর ভারতের দাস জাতি যাঁরা মহাভারতে উল্লিখিত তাঁরা হরপ্পা সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করেন, তাঁরা বাঙালির সঙ্গে সম্পর্কিত, এ সম্ভাবনা আছে। বস্তুত পশ্চিমে বালুচিস্তান থেকে উত্তর ভারতের মধ্যে দিয়ে পূর্ব ভারত অবধি মাতৃকা উপাসক সম্প্রদায়ের এক বিস্তীর্ণ বেল্ট আছে, সে সংস্কৃতি গরুর বলয় আর মরুর বলয়ের সমস্ত আগ্রাসন সত্ত্বেও আজও মুছে যায় নি।
দুই, বাংলায় রাম আসছে। কিন্তু এ দুটোই পরে আসছে। আদি সাবর্ণ গোবলয় মাতৃকা উপাসক নয়, আদি বাংলাও রামকে মানত না। খাঁটি গোবলয় এখনও ভেতর থেকে মাতৃকাকে মানে না (ইয়ে দুর্গা কওন হ্যায়, দিলু ঘোষের উবাচ)। কিন্তু মাতৃধর্মকে বাদ দিয়ে উপমহাদেশের কোনও ধর্মই চলতে পারেনি। এখানে স্থানীয় ইসলাম যদি বনবিবির পুজো করে থাকে তাহলে বাংলার বিজেপিও ঘটা করে সল্ট লেকে দুর্গা পুজো আয়োজন করেছিল।
কিন্তু খাঁটি বাঙালি রাম টাম মানে না, আল্লা ফাল্লা মানে না। কৃষ্ণ মানলেও সে রাধার পা ধরে থাকা কৃষ্ণ।
পাঠকদের কমেন্ট
রক্তিম মুখার্জি বলছেন: হরিবংশে এবং শ্রীমদভাগবতে পূতনা হলেন বকাসুর এবং অঘাসুরের ভগিনী। বকাসুর বিশালদেহী বলাকা এবং অঘাসুর এক সুবিশাল নাগ। তাঁরা আবার আদিদৈত্য শঙ্খাসুরের বংশধর। এখানে বলাকা আর নাগের সংযোগ তো লক্ষণীয় বটেই। শঙ্খ নামটিও আবার আদিবিদ্বান কপিলের সাথে সংযুক্ত। মাতৃপূজক সংস্কৃতির অনেকগুলি হারানো সূত্রই এভাবে জড়িয়ে আছে।
জয়মাল্য ভট্টাচার্য বলছেন: সামবেদী মনুষ্য বাস্তুযাগে মনুষ্য বাস্তুমণ্ডলের এক দেবী হলেন পূতনা। তিনি পিলীপিঞ্জাদি ৫৩ জন বাস্তু দেবদেবীদের মধ্যস্থ নৈঋত কোনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন পূতনা।
সুন্দরবন অঞ্চলের অধিষ্ঠাত্রী স্থানেশ্বরী মা বনদুর্গা/বনচণ্ডী বা বনদেবীকে বনবিবি আখ্যা দিয়ে, ইসলামিক সংস্কৃতি আরোপ করে জহুরানামা শীর্ষক দুটি অর্বাচীন কাহিনী রচিত হয়েছিল, একটি বাংলা ১২৮৭ এবং অন্যটি বাংলা ১৩০৫ সনে, অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষে। প্রথম কাহিনীর লেখক মহম্মদ খাতের তাঁর গ্রন্থকে বলেছেন বনবিবি কেচ্ছা। তবে তুলনায় দ্বিতীয় লেখক মহম্মদ মুনসির লেখায় আরবি ফার্সি শব্দের বাহুল্য আরও বেশি দৃষ্টিকটু।
বনবিবি নামটি সম্ভবত মধ্যযুগেই প্ৰচলিত। কিন্তু এই নামটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যে বিশেষ কাহিনী জহুরানামায়, সেটি সম্ভবত অর্বাচীন, এবং তার ইসলামিক zeal নিঃসন্দেহে সমসাময়িক ওয়াহাবি ফরাজী আন্দোলনের ফসল। এবং এই কেচ্ছা বা কিসসা জনপ্রিয় হওয়ায় একাধিক যাত্রাপালার নির্মাণ ঘটে ইসলামিক কাহিনীটি আরও ছড়িয়ে পড়ে। বনবিবি সম্পর্কে আগে তমাল দাশগুপ্ত পেজে লেখা হয়েছে, লিংক কমেন্টে। আমাদের দেশে অরণ্যচণ্ডী বা বনদুর্গার উপাসনার সুপ্রাচীন প্রথা ছিল, সেটিই আজ বিবর্তিত রূপে বনবিবি। সুন্দরবন অঞ্চলে এর পাশাপাশি সম্ভবত বাঘে মানুষে একটি প্রাচীন সঙ্ঘাতের কাহিনী ছিল, অত্যাচারী বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বনদেবীর শরণাপন্ন হতেন প্রাচীন বাঙালি। সেই কাহিনীই পাল্টে দিয়ে বাঙালির আবহমান মাতৃকাকে বনবিবি নাম দিয়ে জহুরানামা তৈরি।
বনদেবী ছিলেন আদি থেকেই। তিনি বনবিবি হয়েছেন। এই পর্যন্ত আমরা মোটামুটি জানি, বনদুর্গা সম্পর্কে বা উত্তরবঙ্গে পূজিত রালদুর্গা সম্পর্কে আমরা অবগত।
যেটা অনেকেই জানেন না, তা হল অরণ্যকালী বা জঙ্গলকালীর কথা, যাঁর প্রকাশ ঘটে বনবিবির মধ্যে। কারণ এই বনবিবির একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রের শুরুতে তাঁকে মা কালীর সঙ্গে অভিন্ন বলা হয়েছে। বাংলায় মন্ত্রটি, যা স্বাভাবিক। কারণ সংস্কৃতায়ন ঘটেনি এই প্রাচীন মাতৃকা উপাসনার। এই পুজোর পুরোহিতরা অনেকেই বাউল নামে অভিহিত হন, এই উপাসনা সহজধর্মী তন্ত্রের অন্তর্গত সন্দেহ নেই।
এই মন্ত্রের পুরোটা শশাঙ্কশেখর দাসের বনবিবি গ্রন্থে উদ্ধৃত। আরো কয়েকটি মন্ত্র আছে, যেখানে ডাকিনী যোগিনী উল্লিখিত হয়েছেন, এই ডাকিনী যোগিনী মা কালীর গণ বা অনুচর হিসেবে গণ্য এবং মা কালীর দুই পার্শ্বে পূজিত হন কালীপুজোর সময় (যদিও আসলে এঁরা মা ছিন্নমস্তার মণ্ডল থেকে এসেছেন)।
বলা দরকার রাণী রাসমণি তাঁর সুন্দরবনের জমিদারিতে বনবিবি থান তৈরি করেন। বনবিবি নাম বলা হলেও এই মাতৃকা মূলত হিন্দুদের দ্বারাই পূজিত, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যেও তাঁর সমান জনপ্রিয়তা, এবং মাতৃকা উপসনার প্রবল ধারাকে culturally appropriate করতেই এই বনবিবি কেচ্ছা তৈরি।
কিন্তু ওপরের মন্ত্রটি সাক্ষ্য দেয়, এই দেবী কালীর সঙ্গে অভিন্ন। আমরা জানি দুর্গা অবশ্যই মা কালীর এক রূপ। জয়দুর্গা যেমন মা কালীর সঙ্গে অভিন্ন। দুর্গা ভদ্রকালী অভিন্নতার কথাও আমরা জানি। সেভাবেই, বনদুর্গা/বনদেবী/বনবিবি আসলে মা কালীরই প্রকাশ। বৃহৎ বঙ্গের বিভিন্ন জঙ্গলাকীর্ণস্থানে জংলা কালী পূজিত হন, সেই পর্যায়ে আসবেন সুন্দরবনের অধিষ্ঠাত্রীও। তিনি কালীর মত কালো নন কিন্তু কালী সর্বদা কৃষ্ণবর্ণা নন (কাছাড় অধিষ্ঠাত্রী মা কাঁচাকান্তি স্মর্তব্য)। তাঁর মুণ্ডমালা থাকে না, এদিক থেকে মূর্তিকল্পের সঙ্গে কালীর মিল নেই। কিন্তু মা কালীর একটি তত্ত্ব হল তিনি জগদকারণ, জগতের উৎস, সেই তত্ত্বের মূর্ত প্রকাশ রূপে তিনি আমাদের তন্ত্রের প্রাচীন উপাস্য মাতৃকা, হরপ্পা থেকে চন্দ্রকেতুগড় থেকে পালসেনযুগে সমান জনপ্রিয় সন্তানকোলে মাতৃকার প্রতীকে। সন্তানকোলে মা তারার মূর্তি এক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য। বনবিবিও সর্বদা সন্তানকোলে চিত্রিত হন। এই তো মাতৃধর্ম। সুন্দরবনের বাঙালি মায়ের কোলে, মায়ের পায়ে চিরকাল পরম আশ্রয় খুঁজে নিক। জয় মা কালী। জয় জয় মা।
ছবিটি ইউনাইটেড কিংডমের “টাওয়ার হ্যামলেট আর্টস” ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
রাজা মানসিংহ যুদ্ধ করতে এসে রটিয়ে দিয়েছিলেন যে মা যশোরেশ্বরী বিমুখ হয়েছেন সম্রাট প্রতাপের প্রতি, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সরল বিশ্বাসে সেই গুজবে প্রতীতি স্থাপন কোরে যশোর সম্রাট প্রতাপাদিত্যর সৈন্য ভয়ানক মুষড়ে পড়ে এবং যুদ্ধে হেরে যায়।
ভাবুন, মধ্যযুগের ক্রুসেড হচ্ছে। যদি এমনটা হত, যে আরবদের মধ্য থেকে কেউ সুকৌশলে রটিয়ে দিত, যে যীশু ক্ষুব্ধ এবং বিমুখ হয়েছেন খ্রিষ্টান নাইটদের প্রতি। তাহলে কি তাঁরা বিভ্রান্ত হতেন?
না, হতেন না। বরং এই ব্ল্যাসফেমি দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে আরও বেশি শক্তি প্রয়োগ করে গুজব রটনাকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন।
কেন বলুন তো? কারণ খ্রিষ্টধর্মের সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব আছে। ওঁরা যুদ্ধ করতেই এসেছিলেন সেই তত্ত্ব এবং সেই ধর্মের স্বার্থে, যীশুর ধর্মের আদর্শ কি, সেই ক্রিড এবং সেই ধর্মের অর্থোডক্সি তাঁরা জানতেন। অতএব আচমকা এসব গুজব ছড়ালে লাভ হত না।
এই জায়গায় বাঙালির বারবার সমস্যা হচ্ছে, শাক্তধর্মের বারবার সমস্যা হচ্ছে। আমরা জানি মহিষাসুর শাহাদত দিবস পালনকারীদের কথা, এই দুর্বৃত্তরা আমাদের জগন্মাতার নামে অকথ্যকথন করেও পার পেয়ে যান কারণ শাক্তরা বিভ্রান্ত, শাক্তদের সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব নেই। এমন তথাকথিত শাক্ত গ্রূপও আছে যেখানে মহিষাসুরের প্রেমগাথা লেখা হয়েছে। ভাবুন অবস্থাটা!
ধলভূমে উপাস্য স্থানেশ্বরী অধিষ্ঠাত্রী মাতৃকা রঙ্কিণী। তাঁর সম্পর্কেও এমন গুজব ছড়ানো হয়েছিল। একবার একজন বৈষ্ণব গুরু ধলভূমে এলেন সশিষ্য, এবং রটিয়ে দিলেন যে মা রঙ্কিণী নিতান্ত দাসীর মত সেই গুরুর অনুগমন করছেন, পায়ে পড়ে কৃপা চাইছেন। আবার মধ্যযুগে একজন মুসলমান সেনাপতি, নাম লোহানী, তিনিও নাকি দেবীকে জব্দ করে দিলেন, রঙ্কিণী নাকি সেই জাঁদরেল সেনাপতির ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। এইসব গল্প ছড়ানো হল। লোকে বিশ্বাসও করল।
কেন হয়েছে এমন? আজও কেন আমাদের জগন্মাতার তত্ত্ব বিকৃত হচ্ছে? কখনও মহিষাসুরবাদী শরদিন্দু উদ্দীপন এসে মাতৃকা দূষণ করছে, কখনও মা সরস্বতীর নামে উল্টোপাল্টা বলছে, আবার কখনও দিলীপ ঘোষ বলছে ইয়ে দুর্গা কওন হ্যায়। কেন এমন হচ্ছে এরকম বলুন তো?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। আমাদের সুনির্দিষ্ট কালী তত্ত্ব চাই। খ্রিষ্টধর্মর অনুরাগীকে কেউ বোঝাতে পারবে উল্টোপাল্টা যীশুর বিষয়ে? আল্লা সম্পর্কে তো ছেড়েই দিন। কিন্তু মা দুর্গা সম্পর্কে আনন্দবাজারে ভাট লেখা যায়। অনেক বাঙালি বিশ্বাসও করে ফ্যালে। মা কালী আমাদের আবহমান তন্ত্রধর্মের কেন্দ্রে অবস্থান করেন, কিন্তু তাঁর উপাসনা এবং প্রাচীন ধর্ম সম্পর্কে প্রচুর বিভ্রান্তি আছে (মহুয়া মৈত্র মনে আছে?) এবং সঠিক তথ্যর রীতিমত অভাব আছে।
এজন্যই কালীক্ষেত্র আন্দোলন। এজন্যই আমাদের উদ্যোগে “মা কালী এবং তন্ত্র” কোর্স শুরু হতে চলেছে পয়লা বৈশাখ থেকে। মায়ের নামে জয়ধ্বনি করে এগিয়ে আসুন, আসুন আমরা মায়ের ঋজুপথে একসঙ্গে এগিয়ে চলি, এই পেজের সমস্ত পাঠকদের কাছে এই অনুরোধ।
আড়াই হাজার থেকে দুই হাজার বছর আগেকার চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গাল সভ্যতায় আজকের দুর্গাপুজোর মত চার সন্তানসহ জগন্মাতার উপাসনা প্ৰচলিত থাকার প্রচুর প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এই মায়ের মাথার পেছনে চুলের খোঁপায় দশটি কাঁটা ছিল দশটি ক্ষুদ্র আয়ুধ। আজকেও দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী হন।
এই মায়ের পুজোয় একদম আজকের পুজোর মতোই ঢাক বাজত এবং ছাগবলি হত, সেরকম প্রত্ন ফলক পাওয়া গেছে।
বাঙালি জাতির সংজ্ঞায়ন হয় এই মাতৃকা উপাসনায়। চন্দ্রকেতুগড় থেকে অনেক মাতৃ মূর্তি পাওয়া গেছে, এবং এঁদের মূর্তির সংখ্যা দেখলে বোঝা যায় যে মাতৃকা উপাসনা খুবই জনপ্রিয় ছিল।
এই জনপ্রিয় মাতৃমূর্তিগুলিকে বিদেশের প্রায় সব মিউজিয়ামই দেবী বা গডেস আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ইতিহাস বিভাগের এক শ্ৰেণীর কায়েমী স্বার্থান্বেষী এই মাতৃমূর্তিগুলিকে অপ্সরা বা যক্ষী বলে চালানোর অপপ্রয়াস করেন।
প্রসঙ্গত এরকম দশায়ুধা মূর্তি উত্তরবঙ্গে বাণগড়, দক্ষিণবঙ্গে তমলুক, মধ্যবঙ্গে মঙ্গলকোট প্রভৃতি নানা স্থানে পাওয়া গেছে।
আজকে আমাদের মধ্যে যত দেবী পূজিত হন প্রায় সকলেই চন্দ্রকেতুগড়ের গঙ্গারিডাই সভ্যতায় উপস্থিত ছিলেন। আপনারা আগ্রহী হলে এই পেজের মাধ্যমে আমরা তাঁদের সম্পর্কে আরও তথ্য এবং ছবি দেব। জয় জয় মা।