সহজ সন্ধিপুজোর ঘোষণাপত্র: সহজ মাতৃধর্মের শেকড়ে ফিরুক বাঙালি – তমাল দাশগুপ্ত

★পশুবলি ছাড়া মায়ের পুজো হবে না। তার মানে শহরের বাসিন্দা আপনি নিজের ফ্ল্যাটের মধ্যে দুর্গাপুজো করতে পারবেন না? কারণ সেখানে আপনি পশুবলি দেবেন কিভাবে? নিজের ঘরের মধ্যে ওভাবে পাঁঠা বা মোষ কাটা শুধু যে অসম্ভব তাই নয়, ভারতীয় আইনে দণ্ডনীয়ও বটে। পশুর বদলে জ্যান্ত মাছ বা পাখি বলি দেওয়ার কথা কেউ বলতে পারে, কিন্তু সেগুলোও একেবারেই সহজ নয়।

★গুরুর কাছে তন্ত্রদীক্ষা এবং তন্ত্রাভিষেক ছাড়া কারও মায়ের পুজো করার অধিকার নেই। আচ্ছা, কেউ সার্ভে করে দেখেছে, বিপুলসংখ্যক মাতৃভক্ত বাঙালির মধ্যে কত শতাংশ তন্ত্রে দীক্ষিত এবং অভিষিক্ত? গুরুর কাছে দীক্ষা না নিলেই মাতৃধর্ম পালনে বঞ্চিত হয়ে নরকে যেতে হবে? এ তো মুসলমান আর খ্রীষ্টানদের থেকেও ভয়ানক কথা।

আর প্রকৃত জ্ঞানী গুরু কোথায়? আমি তো একজন গুরুর জ্ঞানগর্ভ বাণী শুনলাম তিনি কালীর সংজ্ঞা দিয়েছেন কালের সঙ্গে যিনি রমণ করেন। ক্ষী ভয়ানক। ওটা তো একটা স্থূল রূপক মাত্র, তাও আগমবাগীশ প্রণীত তন্ত্রসারে পাঁচটি সংকলিত ধ্যানমন্ত্রের মধ্যে মাত্র দুটিতে ওই রমণ বা বিপরীতরতির উল্লেখ, বাকিগুলিতে তো রমণের নামগন্ধ নেই। কালীর আসল অর্থ তো কালের কলন করেন যিনি।

★দশ রকমের মৃত্তিকা ছাড়া দুর্গাপুজোর সপ্তমী তিথিতে নবপত্রিকার মহাস্নান হবে না। ওই দশ রকমের মাটি জোগাড় করে মায়ের পুজো করায় আড়ম্বর থাকতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের যোগ কোথায়? সাধারণ মানুষের পক্ষে সে কাজ অতীব কঠিন, জটিল।

★ভোগের ষোড়শ উপচার ছাড়া দুর্গা পুজো করা যাবে না। অথচ আপনি নিজে যা খান, সেটাই মাকে নিবেদন করার প্রথা। রামপ্রসাদ বলেছেন, যত শোন কর্ণপুটে সবই মায়ের মন্ত্র বটে। আহার কর মনে কর আহুতি দিই শ্যামা মায়ে। আপনি যদি চা বিস্কুট খান, তার মানে মা সেটাই তো খেলেন কারণ তন্ত্রের মূল বার্তা তো অদ্বয়বাদ। কিছু তো পৃথক নয় মায়ের থেকে। মায়ের দরবারে কোনটা অচল, কোনটা অনুপযুক্ত, কোনটা অপবিত্র? সবই তো তাঁর অংশ।

★মোদ্দা, এই ঠিকাদাররা বলতে চান, এটা করা যাবে না, আর ওটাও করা যাবে না। যেটা করা যাবে সেটা এমনই দুরূহ যে সেসব শুনলেই ঘাবড়ে যাবে সবাই। আর মায়ের পুজোয় পান থেকে চুন খসলেই হল, ব্যাস। উচ্ছন্নে যাবে, নির্বংশ হবে।

★এক কথায় মুষ্টিমেয় কিছু অতি ধনী এবং অতি পক্ক ব্যক্তি ছাড়া ভরসা করে মায়ের পুজো কেউই করতে পারবে না।

তাহলে?

এসব ফুৎকারে উড়িয়ে এইভাবে নিজের বাড়িতে নিজের হাতে আপনার নিজের মা দুর্গার পুজো করুন। আজ সন্ধিপুজোয় আমি একটা লাউ বলি দিয়েছি। মা মহাভারতে বলিপ্রিয়া আখ্যা পান। সন্ধিপুজোর এই বলি দুর্গাপুজোর কেন্দ্রীয় অংশ। এই বলি গ্রহণ করেন মা চামুণ্ডা কালী।

বারোয়ারি বা মন্দিরের পুজোয় পশুবলি দেওয়া যায় দেওয়া উচিতও। কিন্তু ব্যক্তিগত পুজোয় পরিসরের সমস্যা থাকলে কেবল পশুবলি নিয়ে এত ঝামেলা কেন পোয়াতে হবে মাতৃভক্ত সন্তানকে?

আরে তন্ত্রে তো নরবলিও দেওয়া যায়। কিন্তু তন্ত্র অত্যন্ত নমনীয় ধর্ম। আমি দুহাজার কুড়ি থেকে সহজ পুজো শুরু করি। আমি এই সহজ পথে, ঋজু পথে মায়ের পুজোয় সুফল পেয়েছি। আপনারাও পাবেন। এবং বিশেষ করে এই বাসন্তী উৎসবের দিনে মা দুর্গার পুজোয় হাজার ফ্যাচাং অথচ দোকান থেকে একটা লেজ কিনে পেছনে লাগিয়ে হাতে একটা গদা বা ছুরি হাতে মিছিলে হাঁটলেই রামের পুজো হয়ে যাচ্ছে, এরকম হলে তো বিপদ।

তাই না? নইলে বলুন তো, তন্ত্রে তো বর্ণভেদ নেই, লিঙ্গ বৈষম্য নেই। তন্ত্রে ভেদাভেদ নেই, যদিও স্ত্রীলোক ও শূদ্রর পক্ষে বেদপাঠ নিষিদ্ধ। কিন্তু মায়ের পুজোয় আপনাকে বাধা দেবে কিভাবে? মায়ের পুজোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করবে কিভাবে, বলুন তো?

একটু নায়কের উত্তমকুমারের মত বলতে হচ্ছে। ওই দৃশ্যটা স্মরণ করুন। উত্তম যেখানে টেবিল চাপড়ে বলছেন। চোয়াল শক্ত করে। “আমাকে নতুন পেয়ে, হুমকি দিয়ে, দাবড়ানি দিয়ে” …

হ্যাঁ, ভয় দেখিয়ে, দাবিয়ে দিয়ে, রক্তচক্ষু দেখিয়ে, চেপে দিয়ে আপনার কন্ঠ রোধ করতে চাইবে এরা। কিন্তু আপনি পাত্তা দেবেন না। সহজভাবে মায়ের পুজোয় আপনার জন্মগত অধিকার। যারা আপনাকে মায়ের পুজো সহজে করতে দেয় না, তারা বিজাতীয় বলয়ের হয়ে সক্রিয়ভাবে আপনাকে আত্মবিস্মৃত ও শেকড়বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে। এরা বাঙালির মধ্যে একটা ভ্যাকুয়াম তৈরি করছে, যাতে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়বে গরুর বলয় আর মরুর বলয়। এদের ফোঁপর দালাল বলা দরকার। দীর্ঘদিন এদের দাপাদাপির জন্য এমন সব শেকড়বিচ্ছিন্ন শিক্ষিত বাঙালি তৈরি হয়েছে যারা শান্তিনিকেতন যাবে কিন্তু তারাপীঠ যাবে না। বিশ্বমানব হবে, কিন্তু মা জগৎজননীর পুজো করবে না।

এরা নিপাত যাক। বাঙালি তার মায়ের উপাসনার শেকড়ে ফিরুক।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

জয় মা চামুণ্ডা। নমশ্চর্চিকায়ৈ! জয় মা দুর্গা। জয় মা কালী। জয় জয় মা।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, ঊনত্রিশ মার্চ দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s