ইংরেজদের কালীপুজো – তমাল দাশগুপ্ত

ইংরেজদের কালীপুজো!

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং আমেরিকায় মাতৃধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ দেখলে অবাক হতে হয়। তন্ত্র এবং শাক্ত ধর্মের ইতিহাস নিয়ে পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কাজ হয়েছে ও হচ্ছে, তার এক শতাংশ আমাদের দেশে হয় না, যা লজ্জার। কিছুদিন আগে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তন্ত্র ইতিহাস বিষয়ক একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল, যেখানে কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল উনিশ শতকের কৃষ্ণনগরে তৈরি এক মৃন্ময়ী কালীমূর্তি।

তন্ত্রের ইতিহাস অবৈদিক, যা পশ্চিমে স্বীকৃত। মাতৃকার আদি ধর্মর প্রত্নতত্ত্ব যেভাবে পশ্চিমে আলোচিত, পৌরাণিক গ্রন্থে এবং পরবর্তী যুগে তন্ত্রশাস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে জগন্মাতার চিত্র বিবর্তিত হল, সেই গবেষণা পশ্চিমে হয়েছে যেভাবে, তার জুড়ি নেই। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্ত্র কোর্স করতে গিয়ে এই উপলব্ধি হয়েছে যে আমরা কয়েক যোজন পিছিয়ে আছি। এবং তন্ত্রভূমি বাংলা, কালীক্ষেত্র বাংলাকে তো শুধু লজ্জিত হলে চলবে না, প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

কিন্তু একটা আশ্চর্য বিষয় হল মা কালী সম্পর্কে ইংরেজদের আগ্রহ সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগ থেকে লিপিবদ্ধ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে কালীঘাটে পুজো দেওয়া হয়েছিল, জোশুয়া মার্শম্যান লিখে গেছেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই বিবরণ থেকে জানতে পারছি যে গভর্মেন্টের প্রতিনিধি কয়েকজন ইংরেজ কালীঘাটের মাতৃমন্দিরে গিয়ে পাঁচ হাজার টাকার পুজো দেন। সেযুগের পাঁচ হাজার টাকা! পুজোর উপলক্ষ ছিল উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাম্প্রতিক কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধজয়।

মার্শম্যান আরও লিখেছিলেন, হাজার হাজার বাঙালি সমবেত হয়েছিলেন সেদিন ইংরেজের কালীপুজো দেখতে। তবে মার্শম্যান যেমন ভেবেছিলেন, বাঙালি সম্ভবত ততটাও অবাক হয়নি। কলকাতার বুকে বউবাজারে অনেক আগে থেকেই ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি আছে। আগে লিখেছি ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি সম্পর্কে আমার পেজে।

ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করা প্রয়োজন সন্দেহ নেই। সব রকমের আগ্রাসনের নিন্দা করতে হবে। কিন্তু এও সন্দেহ নেই, কালীঘাট গিয়ে পুজো ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের কোনও প্রতিভূ দেবেন না, আর শাকাহারী গোবলয়ও কালীঘাট এড়িয়ে চলেন কারণ আমরা পাঁঠাবলি দিই।

গিভ দ্য ডেভিল ইটস ডিউ, ইংরেজি প্রবাদে বলে: শয়তানকে তার প্রাপ্যটুকু দাও। ইংরেজ শয়তান হতে পারে, কিন্তু ইংরেজ আমাদের মা কালীকে সম্মান করেছিল। এখনও করে। যে কথা বাকি সমস্ত বিজাতীয় বলয় সম্পর্কে সহজে বলতে পারি না। লুট করে তো সবাই। কিন্তু কতজন তন্ত্র সম্পর্কে সারস্বত গবেষণা করে গেছে? কে করবে? সঙ্ঘ পরিবার করবে? বামজেহাদি-কংগ্রেস- তৃণমূল করবে? বাংলাদেশ করবে? বাংলার হিন্দুকে লুট তো এরা সবাই করে। কিন্তু আমাদের শেকড়ে থাকা তন্ত্র ও শাক্ত ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধা কে দেখিয়েছে? কেউ দেখায় নি। আর আমাদের ভেতরে থাকা অমর্ত্য সেন বা মহুয়া মৈত্র টাইপের বিশ্বমানব তো আমাদের বুকের ওপরে বসে বসে নিজেদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থের খিচুড়ি রেঁধে যাচ্ছে, তারা আজ পর্যন্ত আমাদের কেবলমাত্র শেকড়বিচ্ছিন্ন ও আত্মবিস্মৃত করাতেই উদ্যোগী হয়েছে। এদের থেকে ইংরেজ সম্ভবত ভালো, কথাটা বিতর্কিত শোনাবে, তবুও বলা দরকার।

প্রসঙ্গত, তন্ত্র সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, এবং তন্ত্র সম্পর্কে শিক্ষিত সমাজে খারাপ ধারণা কেটেছিল প্রথমবারের জন্য একজন ইংরেজের কারণে। শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের শিষ্য স্যার জন উড্রফ ছিলেন সেযুগে ভারতের রাজধানী কলকাতায় অবস্থিত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি আর্থার আভালন ছদ্মনামে তন্ত্র বিষয়ক অনেকগুলি বই লিখে পশ্চিমে তন্ত্র গবেষণার উদ্বোধন করেন।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

দেড়শ বছর আগে কৃষ্ণনগরে তৈরি এই মৃন্ময়ী কালীমূর্তি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আছেন। এই মাতৃমূর্তিই ব্রিটিশ মিউজিয়ামে Tantra: From Enlightenment to Revolution শীর্ষক সারস্বত প্রদর্শনীর কেন্দ্রে ছিলেন। ছবি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ডেটাবেস থেকে।

জয় মা কালী। জয় জয় মা।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, বাইশ ফেব্রুয়ারি দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s