
মা সিদ্ধেশ্বরী কালী।
পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিভিন্ন সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি দেখা যায়। মায়ের এই বিশেষ সিদ্ধেশ্বরী রূপ সম্পর্কে আজ আমরা জানব।
★ যিনি মাতৃসাধককে সিদ্ধি প্রদান করেন, তিনিই সিদ্ধেশ্বরী। সিদ্ধেশ্বরী কালীর আলাদা ধ্যানমন্ত্র নেই তন্ত্রসারে। কিন্তু তন্ত্রসারে দেওয়া বেশ কয়েকটি মন্ত্রে মায়ের সিদ্ধিদাত্রী রূপের আবাহন ও উপাসনা করা হয়েছে, সেগুলি সিদ্ধেশ্বরী কালীর পূজায় প্রাসঙ্গিক (যেমন, “দক্ষিণকালিকা প্রোক্তা দেবতা সর্ব্বসিদ্ধিদা”। অন্যত্র, “সিদ্ধির্ভবতু মে দেবি ত্বৎপ্রসাদান্মেহশ্বরী”)।
★ আবার সিদ্ধেশ্বরতন্ত্রের কালীমন্ত্রটিও প্রাসঙ্গিক মা সিদ্ধেশ্বরীর পুজোয়, সেটি তন্ত্রসারে আছে। সেটি বিখ্যাত কালীমন্ত্র: শবারূঢ়াং মহাভীমাং..
★ এছাড়া তন্ত্রসার অনুসরণ করলে বলা যায় যে মায়ের সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন রূপের পূজাই গুহ্যকালী মন্ত্রে হতে পারে, সিদ্ধেশ্বরী কালীও সেই মন্ত্রে পূজিত হতে পারেন।
★ পালযুগের তন্ত্রধর্মে সিদ্ধাচার্যরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। চুরাশি জন সিদ্ধাচার্য বিখ্যাত, তাঁদের জীবন কাহিনী জনমানসে প্ৰচলিত ছিল। কালীক্ষেত্র কলকাতায় কালীঘাটের মা কালীর প্ৰতিষ্ঠা করেন যে চৌরঙ্গী, তিনি নাথপন্থায় যেমন পূজিত, তিনি সমানভাবে পালযুগের সিদ্ধাচার্যদের মধ্যেও গণ্য হন। বস্তুত এই যে কথিত আছে যে আদিকালে তান্ত্রিকরা কালীঘাটের মা কালীকে গুহ্যরূপে পুজো করতেন এর প্রধান কারণ তিনি সিদ্ধাচার্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, কাজেই সিদ্ধেশ্বরী (যদিও আজ সেই তথ্য প্রায় বিস্মৃত) এবং আগেই বলেছি গুহ্যকালী মন্ত্রেই সিদ্ধেশ্বরী কালীর পুজো হতে পারে।
★ বর্ণরত্নাকর, শবরতন্ত্র এবং বিভিন্ন তিব্বতী গ্রন্থে পালযুগের বাংলায় প্রখ্যাত এই চুরাশি সিদ্ধের বর্ণনা আছে। এঁরা আমাদের তন্ত্রধর্মের দিকপাল ছিলেন। এঁরা সিদ্ধযোগী মাতৃকা উপাসক তো বটেই, তা ছাড়া এঁরা অনেকেই বৈজ্ঞানিক ছিলেন, তন্ত্র এবং বিজ্ঞান তো সেযুগে আলাদা ছিল না। বিশেষ করে সিদ্ধাচার্যদের অনেকে রসায়নবিদ ছিলেন, রসেশ্বর দর্শন নামে একটি তান্ত্রিক রসায়নশাস্ত্র ছিল এই সময় যা পালযুগের সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা সৃষ্ট। তন্ত্রাশ্রয়ী পালযুগের ওপরে গবেষণা খুব কম হয়, এই সময় বাঙালি জ্ঞান বিজ্ঞানে অত্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। আয়ুর্তন্ত্র আরেকটি বিষয় যা সিদ্ধাচার্যদের গবেষণার বিষয় ছিল।
মা সিদ্ধেশ্বরী কালী কাজেই শুধু সিদ্ধযোগীদের উপাস্য নন, তিনি বৈজ্ঞানিকদের আরাধ্যা দেবী হিসেবেও গণ্য হবেন। বাঙালি আজকে শেকড়বিচ্ছিন্ন, তন্ত্রবিস্মৃত, তাই মা সিদ্ধেশ্বরী কালীর জয়ধ্বনি করলে আমাদের উপকার হবে।
★ সিদ্ধি কাকে বলে? সিদ্ধি অর্থ সাফল্য। নিজের সাধনপথে শীলমার্গে সফল হওয়াই সিদ্ধি। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে প্রাচীন যুগের বাঙালির বর্ণপরিচয় গ্রন্থ ছিল সিদ্ধিরত্থু। সিদ্ধি হোক, বলেই বাঙালি শিশুকে অ আ ক খ শেখানো হত। আগে লিখেছি এই গ্রন্থটি সম্পর্কে, আমার পেজেই।
মা সিদ্ধেশ্বরী কালীকে কাজেই সাফল্য কালী বললে অত্যুক্তি হবে না।
তবে তন্ত্রমতে সিদ্ধির মূল অর্থ হল জীবন্মুক্ত হওয়া, চতুর্বর্গ লাভ করা, বলা বাহুল্য অন্তিমে মোক্ষলাভ করা, এবং (এটি পরবর্তী যুগের কুসংস্কার) আশ্চর্য ভোজবাজি ক্ষমতা প্রাপ্ত হওয়া, শেষেরটি লোকমুখে সিদ্ধাই বলে পরিচিত হয়।
আজ তন্ত্র অর্থে এই যে ম্যাজিক্যাল ক্ষমতা বলে ভাবা হয়, সেই ক্ষমতা আসলে সিদ্ধির একটি পরবর্তীযুগের অর্থ। কিন্তু মা স্বয়ং প্রকৃতি। অপ্রাকৃত কোনও কিছু প্রকৃতির অভিপ্রায় হতে পারে না, কথাটা মনে রাখলে তন্ত্রসাধনার পথে ভুল ভ্রান্তি কম হবে।
★ মা সিদ্ধেশ্বরী কালী নানা রূপে বাংলা জুড়ে পূজিত হন। অনেক সময় তাঁর পরিধানে বস্ত্র থাকে কারণ জ্ঞান বিজ্ঞান সাধনা সর্বোপরি সিদ্ধি তাঁর আবরণ হয়ে দেখা দেয়। কারণ যদিও জগৎকে আবৃত করতে পারে এমন বস্ত্র হয় না, সেজন্য মা কালী দিগম্বরী, কিন্তু তাও সাধনায় সিদ্ধিলাভের এমনই অদ্ভুত ক্ষমতা তা জগৎ আচ্ছাদিত করতে পারে।
শিবশঙ্কর ভারতীর বই বাংলার প্রাচীন কালীকথায় দেখছি যে তেইশটি সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ির বর্ণনা আছে, তার মধ্যে অনেকগুলি বিখ্যাত, যেমন কলকাতায় ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি।
বাংলা জুড়ে আজ যে সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি দেখা যায়, তার মধ্যে অল্প কয়েকটিতে বামাকালী এবং বেশিরভাগ মন্দিরেই দক্ষিণাকালী প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু অন্য রকম রূপও আছে, যেমন শবশিব বিহীন সিদ্ধেশ্বরী কালীও কোথাও কোথাও পূজিত। কাজেই মা সিদ্ধেশ্বরী কালীর মূর্তিতত্ত্বে এবং উপাসনায় বৈচিত্র্য আছে।
জয় মা কালী। জয় জয় মা।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
মায়ের ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, সতেরো জানুয়ারি দুহাজার তেইশ