আজ কার্ত্তিক সংক্রান্তি। বাঙালির কার্ত্তিক উপাসনার তিথি। কার্ত্তিকের উপাসনার সাথে উপমহাদেশের মাতৃসাধনার ধারার সংযোগ নিয়েই আজ আলোচনা করব।
কার্ত্তিকের জন্মের কাহিনীটি পুরাণসাহিত্যে অত্যন্ত ঘটনাবহুল। বিভিন্ন পুরাণে তাঁকে কখনও শিব তথা অগ্নির পুত্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত কাহিনীর মধ্যেই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল মাতৃকাগণের দ্বারা তিনি রক্ষিত। তাঁর কার্ত্তিকেয় নামটি এসেছে “ছয় কৃত্তিকা মাতার পুত্র” এই কারণে। তিনি কুমার; শিশুপুত্র। স্কন্দরূপে তিনি সিংহবাহিনী আদিজননীর কোলে অধিষ্ঠিত এবং আদিশক্তির সেই রূপ স্কন্দমাতা নামে নবদুর্গার পঞ্চম বিগ্রহ রূপে পূজিত হয়। তাঁর সাথে ষষ্ঠী তথা হারিতির সংযোগ আছে; যিনি শিশুদের রক্ষাকারিণী বলে সমগ্র উপমহাদেশে এবং বাঙালির ব্রাত্য পরিমণ্ডলে বারো মাসে তেরোবার পূজিত হন।
সন্তানকোলে মাতৃকার মূর্তি উপমহাদেশের মাতৃসাধনার প্রাচীনতম অধ্যায়ের অন্তর্গত। হরপ্পার সমস্ত মাতৃমূর্তির মধ্যে সন্তান কোলে মাতৃকার মূর্তি সবথেকে বেশি পাওয়া গেছে; আসকো পারপোলা জানাচ্ছেন। কার্ত্তিকের শিশুরূপ সেই মাতৃকার কোলের সন্তানের তত্ত্বটিকেই প্রকাশ করে। বাংলায় যে শিশুরূপ ন্যাঙটা কার্ত্তিকের পূজা এত জনপ্রিয়; তার একটি সম্ভাব্য কারণ এইই। গণেশজননী, কার্ত্তিক গণেশ দুইজন পুত্র নিয়ে উমা বিশালাক্ষী, চার সন্তান নিয়ে গঙ্গারিডির দশায়ুধা থেকে আজকের দুর্গা, পালযুগের দেবী পূর্ণেশ্বরী, শিশুপুত্র কোলে সর্পমাতৃকা মনসা সকলেই এই তত্ত্বকেই প্রকাশ করেন। প্রকৃতি সমস্ত সৃষ্টির আদি উৎস। তাঁর গর্ভ থেকেই সকলের উৎপত্তি। আমাদের মাতৃকা যদি সেই অব্যক্ত জগদকারণ প্রকৃতির ধ্যানগম্য রূপ হন; তবে তাঁর কোলে শিশুর মতো আশ্রিত জগতসংসারের প্রতীভূ হলেন কুমার কার্ত্তিক।
আবার মাতৃসাধনার আরেক সুপ্রাচীন ধারা সপ্তমাতৃকার উপাসনার সাথেও তাঁর সংযোগ আছে। হরপ্পাতে আমরা অশ্বত্থ গাছে পূজিতা মহিষমর্দিনীর আদিরূপ ঊষা মাতৃকার চারপাশে সপ্তমাতৃকার মণ্ডলের আদিতম নিদর্শন দেখতে পাই। চণ্ডীতে এই সপ্তমাতৃকার অন্যতম মাতৃকা কৌমারী কার্ত্তিকের স্বরূপ ধারণ করেন। তিনি শক্তি অস্ত্র হাতে ময়ূর ও কুক্কুটদের দ্বারা পরিবৃতা। কার্ত্তিকের সাথেও এই ময়ূর ও কুক্কুটদের বারংবার উল্লেখ পাই। কার্ত্তিক শিখিবাহন, কুক্কুটকেতু। পক্ষীমাতৃকার উপাসনার সুপ্রাচীন রীতিটিও কি এখানে নিজের প্রভাব রেখেছে? সম্ভবত তাইই।
মাতৃকাদের সাথে কার্ত্তিকের এই সংযোগের প্রসঙ্গে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় লক্ষ্য করেছেন; দাক্ষিণাত্যের কদম্বদিগের বহু লেখে নৃপতিগণ হারিতীপুত্র এবং স্বামি-মহাসেন ও মাতৃকাদিগের পূজক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন (স্বামিমহাসেন-মাতৃগণানুধ্যাতানাং…হারিতীপুত্রাণাং)।
চালুক্যদের লেখসমূহেও এই বিষয়টি দেখা যায়। “হারিতীপুত্রানাং সপ্তলোকমাতৃভিঃ সপ্তমাতৃভিরভিবর্ধিতানাং কার্তিকেয়ানুগ্রহ পরিরক্ষণ প্রাপ্তকল্যাণ পরম্পরাণাং)। এজন্য Fleet যথার্থই বলিয়াছেন যে স্বামী মহাসেন (স্কন্দ কার্তিকেয়) ও সপ্তমাতৃকাগণ প্রাচীন কদম্ব ও প্রাচীন চালুক্য কুলের বাস্তুদেবতা বা ইষ্টদেবী স্বরূপ ছিলেন।…’
মধ্যভারতের গুপ্তোত্তরযুগের গাঙ্গধর মন্দিরের শিলালেখে ডাকিনীগণ এবং উগ্রা ভীষণ হুঙ্কারকারিণী মাতৃগণের বিবরণ পাওয়া যায়। এঁরা বিষ্ণুর মন্দির রক্ষা করেন। এঁদের সাথেই স্কন্দের উল্লেখ আছে। অর্থাত কার্ত্তিকের সাধনক্রম মাতৃকার উগ্র ভৈরবী সহচরীগণের সাধনার সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিল। অন্যদিকে ছয় বা সাত সংখ্যক মাতৃকার সাথে তাঁর সংযোগ তন্ত্রের দেহতত্ত্বের ষটচক্রের নিগূঢ় তাৎপর্যের ইঙ্গিত দেয়। আবার আজকের দিনেই বাংলার স্থানবিশেষে মাতৃকার নিত্য সহচর ভৈরবগণের পূজা হয়। বিষয়টি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহ নেই।
আবার কার্ত্তিকের বাহন ময়ূর; সর্পভীতি থেকে উত্তরণের দ্যোতক। এই তত্ত্ব তন্ত্রের মহামায়ূরী এবং মনসার ত্বরিতা রূপের সাথে অভিন্ন। শবরীপার চর্যাপদে ময়ূরপুচ্ছ মস্তকে নিয়ে গলায় গুঞ্জাফুলের মালা ধারণ করে যে শবরবালিকা উচ্চ পর্বতে বিচরণ করেন; তাঁরও একই তত্ত্ব।
সব মিলিয়ে উপমহাদেশে কার্ত্তিকের উপাসনার ধারা অন্যান্য সাধনক্রমের মতোই মাতৃপূজার আবহমান পরম্পরার দ্বারাই সম্পৃক্ত। তিনি ধুরন্ধর যোদ্ধারূপে ভীষণা মাতৃগণের মণ্ডলে বিচরণ করেন। তিনিই শিশুপুত্র রূপে আদিজননীর কোলে অবস্থান করেন। তাঁর পূজা ন্যাঙটা কার্ত্তিক রূপেই হোক বা শিখিবাহন দেবসেনাপতি রূপেই হোক; তাতে তান্ত্রিক সংস্কৃতির চিরন্তন গরিমাই ধ্বনিত হয়।
রক্তিম মুখার্জ্জী
তথ্য কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়।
ছবিতে মুর্শিদাবাদের নবগ্রামে প্রাপ্ত পালযুগের ময়ূরবাহন কার্ত্তিক। ছবি কৃতজ্ঞতা জ্যোতির্ময় মিত্র মহাশয়।
