পুরুলিয়ার তেলকুপির কাছে রঘুনাথপুর থানার সিমরা গ্রামে আছে কাত্যায়নী মন্দির। মন্দিরের প্রাচীন কাঠামোটি রেখ দেউল রীতির। গর্ভগৃহে পূজিত হন দেবী চর্চিকা/ চামুণ্ডা।
তেলকুপি বা প্রাচীন তৈলকম্প শিখরভূমের অন্তর্ভুক্ত। এখানে পাল ও সেনযুগের শিখর বংশীয় রাজাদের সময়কালে অনেকগুলি মাতৃমন্দির নির্মিত হয়েছিল। কৈবর্ত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে রামপালের অনন্তসামন্তচক্রে তৈলকম্পের রুদ্রশিখর যোগ দিয়েছিলেন। সেনযুগে এখানে মা কল্যাণেশ্বরীর পীঠের প্রতিষ্ঠাও এই বংশের মাধ্যমেই হয়েছিল। পাঞ্চেত জলাধার নির্মাণের সময় সরকারী অবহেলায় তেলকুপির বহু মাতৃমন্দির জলের তলায় চলে গিয়েছে।
চর্চিকা পাল ও সেনযুগের বাঙালির অত্যন্ত জনপ্রিয় মাতৃকা। পালসম্রাট নয়পালের ইষ্টদেবী ছিলেন চর্চিকা। চর্চিকার মধ্যে কালীর আদি মূর্তিতত্ত্বের দ্যোতনা পরিলক্ষিত হয়। উমাপতিধরের একটি স্তবে তাঁর কোটরগত নেত্র মহাকাশে জ্বলন্ত জ্যোতিষ্কদের মতো ভাস্বর। তাঁর শীর্ণ উদর যেন অগ্যস্তের মাধ্যমে জলশূন্য সমুদ্রের তলদেশের পাতালের অনন্ত গভীরতার আভাস দেয়। দাঁতের তটরেখায় আছড়ে পড়া দৈত্যদের দেহখণ্ডের রক্তধারায় তাঁর মুখমণ্ডল আরক্তিম।
আবার পালযুগের কবি শ্রীধরের স্তবে দেবী চর্চিকার চরণধূলি নিয়ে প্রলয়ের পর বিধাতা নতুন করে জগত রচনা আরম্ভ করেন। তিনি লোলরসনা। সমস্ত রিপুগণের রক্ত নিঃশেষে জিহ্বার দ্বারা চর্চন করেন বলেই তাঁর চর্চিকা নাম। অতি শীর্ণ দেহ অস্থিচর্মসার; যেন মূর্তিমতী ক্ষুধা। এই অপরিমিত ক্ষুধার প্রতীক তাঁর উদরের বৃশ্চিক চিহ্ন। যেন ঋষি বঙ্কিমের ভাষায়: মা যা হইয়াছেন। অন্যদিকে নৃত্যচর্চিকা রূপে তিনিই ললিত কলার অধিষ্ঠাত্রী। মত্ততার প্রতীক গজরাজকে মর্দন করে তার অজিন তিনি অঙ্গে ধারণ করেন। তিনি মুণ্ডমালিনী; পঞ্চাশ বর্ণমালা তাঁর কন্ঠে দোদুল্যমান। বিশ্বপদ্মে জগতরূপ শবের উপর তাঁর অধিষ্ঠান।
ভীষণা ভয়হারিণী মাতৃকার কাত্যায়নী নামটি প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায়। হরিবংশ অনুযায়ী এই নামে চণ্ডিকা শবর ও পুলিন্দগণের দ্বারা সেবিতা। শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় লক্ষ্য করেছেন বসুবন্ধুর ‘বাসবদত্তা’ অনুযায়ী গঙ্গাতীরে কুসুমপুরে( বর্তমান মগধ ও গৌড়বঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চলে) কাত্যায়নীরূপে তিনি শুম্ভনিশুম্ভনাশিনী। প্রণত মহাদেবের জটাস্থিত গঙ্গায় তাঁর চরণ অভিষিক্ত। আবার তিনিই “বেতালাভিধানা” বেতালা নামে অভিহিত ( বেতাল প্রমুখ ভীষণ অনুচরগণ পরিবৃতা)। চর্চিকাও তন্ত্রে বেতালবাহনা; ভীষণ ভৈরবীগণ তাঁর সহচরী। পদকর্তা দাশরথির ভাষায়:
চারিদিকে কত দিকপাল ভৈরবী শিবা তাল বেতাল
অতি অপরূপ রূপ বিশাল কালী কলুষনাশিনী
আলোচ্য কাত্যায়নী মন্দিরের চর্চিকা দেবী দশভুজা। শবের উপর নৃত্যরতা। দুই পাশে ডাকিনী যোগিনী। তবে মূর্তিটি সেনযুগের পরবর্তী; মধ্যযুগের প্রথম দিকে নির্মিত বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত পাল-সেনযুগের আদি বিগ্রহের উপর মধ্যযুগের ক্রান্তিকালে তুর্কি আক্রমণে আঘাত নেমে এসেছিল। পরে আবার আদি বিগ্রহের উপরেই সংস্কার করে নবরূপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে প্রাচীন যুগের উৎকৃষ্ট শিল্পকলা লুপ্তপ্রায়। তবুও মাতৃকার অধিষ্ঠান পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। মধ্যযুগের তেলকুপির বাঙালি আবার নমশ্চর্চিকায়ৈ জয়ধ্বনি দিয়ে মাতৃনামে মেতেছিল। তাণ্ডবের তালে ধ্বনিত হয়েছিল মায়ের সেই অভয়চরণের নুপূরের নিক্বন; “যে চরণের পাদপীঠ নির্মিত হয় প্রণত সুরাসুরের মস্তকের শ্রেণী দিয়ে”।
রক্তিম মুখার্জ্জী
তথ্য কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়
ছবি কৃতজ্ঞতা শঙ্খদীপ মহাশয়
