
আমি ছোটবেলায় প্রায়ই চিত্তরঞ্জন দাশ আর বিধান রায়কে গুলিয়ে ফেলতাম। পাঠ্যবইতে কোনও একটা বিধান রায় রচনায় “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ” দিয়ে শেষ করেছিল, সেজন্যই বোধহয়। কিন্তু পরে বড় হয়ে টের পেলাম, দুজনের ভারী চমৎকার মিলও আছে। একজন হিন্দু মুসলমানকে এক করতে চেয়েছিলেন, সেজন্য বেঙ্গল প্যাক্ট করেছিলেন। আরেকজন বাংলা ও বিহারকে এক করতে চেয়েছিলেন, সেজন্য বাংলা বিহার সংযুক্তিকরণ চুক্তি করেছিলেন।
একটা ঐতিহাসিক সংযোগও আছে। বৃদ্ধ রাষ্ট্রগুরু সুরেন ব্যানার্জির বিরুদ্ধে তরুণ ডাক্তার বিধান রায়কে জিতিয়ে আনতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা শেষে বলছি।
★★★
ষাটের দশকের শুরুতে আসামে বাঙালি নিধন হচ্ছে দেখে বিধান রায় সেটার সমাধান করতে এক চমৎকার উপায় বের করে ফেলেছিলেন। সেটা কি জানেন? উনি দার্জিলিং জেলায় গিয়ে সেখানে নেপালি ভাষাকে সরকারি করে দিয়ে বললেন, এভাবেই, এ পথেই আলো জ্বেলে ক্রমমুক্তি হবে। ভাবুন, মরল আসামের বাঙালি, আর অধিকার পেয়ে গেল দার্জিলিং-এর গোর্খা। খেলেন গুলি রামাকান্ত, মেডেলের বেলায় গোবর্ধন 🙄
চিত্তরঞ্জন দাশের এই বেঙ্গল প্যাক্টও খানিকটা সেরকম। গোবর্ধনকে দই খেতে দেওয়া চলবে না বলে রামাকান্তর বিকার বাঁধিয়ে দিলেন। ইংরেজ তাড়াবেন, সুরেন ব্যানার্জিকে তাড়াবেন, স্বরাজ্য দলের নতুন ভোর আনবেন। অতএব বাংলার হিন্দুর ঘাড় ভেঙে বেঙ্গল প্যাক্ট করে দিলেন। সেযুগের আইনসভার বর্ণনাগুলো দেখছিলাম, স্বরাজ্য পার্টির সে কি মুসলিম দরদ। উফ! সে দরদিয়া মরমিয়া মিঞাদরদ ভদ্রলোক বাঙালির আর হয়নি, আর হবে না।
সে দেখে চোখে সম্প্রীতির জল চলে আসবে, আসতে বাধ্য। তার কাছে কোথায় লাগে গর্গান্ডু, কোথায় লাগে কাংলাপক্ষ, কোথায়ই বা লাগেন মমতা, এমনকি তার পাশে আজকের বামজেহাদিও ফিকে লাগবে। সে ছিল স্বর্ণযুগের তোষণ একেবারে।
★★★
তবে শ্রীচিত্তর মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। দেশ স্বাধীন করবেন। বলা হয় করপোরেশনকে চোরপোরেশন প্রথম উনিই বানান। সেটাও মহৎ উদ্দেশ্যেই ছিল। ইংরেজিতে বলে, the road to hell is paved with good intentions, অর্থাৎ নরকে যাওয়ার রাস্তা মহৎ সব উদ্দেশ্য দিয়ে বাঁধানো হয়। আজকের চাড্ডি দেখুন, মহৎ উদ্দেশ্য। হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই। হিন্দু ঐক্য, ভারতের সংহতি। আজকের ছাগু দেখুন, তারও মহৎ উদ্দেশ্য। হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই। বিশ্বমানব দেখুন। সেও বড় মহৎ। সবার উপরে মানুষ সত্য।
দেখুন, সবাই কেমন সার বেঁধে নিজেরা নরকে যাচ্ছে এবং আস্ত বাঙালি জাতিকেই সেই সঙ্গে নরকস্থ করছে।
কিন্তু উদ্দেশ্য মহৎ।
প্রসঙ্গত, চোরপোরেশন অভিযোগ সি আর দাশ সম্পর্কে বহুল প্রচলিত। কিন্তু শুধু সেটা না, সেই সঙ্গে ছিল বহুল নির্বাচনী দুর্নীতি। সমসাময়িক নথিতে বলা হয় প্রথম নির্বাচনী রিগিংও ওই সময়েই হয়েছিল, সি আর দাশের নেতৃত্বেই। হ্যাঁ, পুরোদস্তুর গুণ্ডা ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে রিগিং। সেই প্রথম বাংলায় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটে।
এছাড়া ব্যারাকপুর কেন্দ্রে বৃদ্ধ সুরেন ব্যানার্জিকে হারাতে একটি বেশ্যা ভাড়া করে নিয়ে গিয়ে জনসভায় মিথ্যা বলানো হয়েছিল, যে সুরেনের চরিত্রদোষ আছে। ভাবা যায়? কি বলবেন? মহৎ উদ্দেশ্যেই, তাই ভয়াবহ মিথ্যাও বলা যায়?
★★★
বাঙালির প্রাতঃস্মরণীয় দুই মহৎ মহাপুরুষকে প্রণাম। প্রাতঃকৃত্য করারও আগে এঁদের স্মরণ করবেন, আধুনিক যুগের মহাপুরুষদের থেকে বাঙালি জাতির যে কি ভয়াবহ উবগার হয়েছে, সে কথা যদি ভুলে যাই তো ভয়ানক কৃতঘ্নতা হবে।
জয় বাংলা। আমি সাধারণত এ কথাটা বলি না, এটা বাংলাদেশের আওয়ামি স্লোগান, তৃণমূল ঝেঁপে দিয়েছে, তা তৃণমূল তো চালচুরি করেই থাকে, নাহয় একটু বোলচালচুরিও করল। তো আমি জয় মা কালী ছাড়া আর কিছুই বলি না, কিন্তু এঁদের মত মহাপুরুষদের উদ্দেশ্যে জয় বাংলা না বলে থাকা যায় না। বস্তুত জয় বাংলা ছাড়াও সবার উপরে মানুষ সত্য বলে আজকের এই লেখা শেষ করতে হবে।
টেকলাভ, মহাপুরুষগণ। আপনারা আজও জীবন্ত আছেন। আপনারা ছিলেন ও আছেন বলেই বাঙালি আজ এত কষ্টে সৃষ্টে টিঁকে আছে।
© তমাল দাশগুপ্ত
বিধিমোতাবেক সতর্কীকরণ। এই পোস্টে বাঙালির আধুনিক যুগের মহাপুরুষদের বন্দনার বদভ্যাসকে খিল্লি করা হয়েছে। মহাপুরুষ করেছেন বলেই আপনিও করবেন, এমন ভাবলে মহা ভুল করবেন। মহাপুরুষদের কথার কাট পেস্ট অনুকরণ করলে বিপর্যয় হয়, বাঙালিরও তাই হয়েছে।
সংযোজন
১.
আর্য সারথী হ্যাট, এত কিছু আমি কেন করব? একটা ছোট পেটোর বেশি কিছু ডিজার্ভ করেন না এইসব আধুনিক মহাপুরুষ এবং তাদের একুশ শতকের ভক্তগণ। কারও সাধ্য হলে খণ্ডন করুক।
চোরপোরেশন অভিযোগ সি আর দাশ সম্পর্কে বহুল প্রচলিত। শুধু সেটা না, সেই সঙ্গে ছিল বহুল নির্বাচনী দুর্নীতি। সমসাময়িক নথিতে বলা হয় প্রথম নির্বাচনী রিগিংও ওই সময়েই হয়েছিল, সি আর দাশের নেতৃত্বেই।
ব্যারাকপুর কেন্দ্রে সুরেন ব্যানার্জিকে হারাতে একটি বেশ্যা ভাড়া করে নিয়ে গিয়ে জনসভায় মিথ্যা বলানো হয়েছিল, যে সুরেনের চরিত্রদোষ আছে।
এসব নোংরা বেশি ঘাটব না। একটি বোমার বেশি সময় দেব না এসবের পেছনে। দ্যাখ, আমি মায়ের নাম করতে এসেছি, কিন্তু মোল্লার দালালরা বড় ব্যাঘাত করছে, তাই তাদের চিত্তকেন্দ্রিক ওয়াজ মাহফিলে একটু বিস্ফোরক ছুঁড়ে দিচ্ছি।
২.
আর্য সারথী ওরে গাধা বেশিরভাগ ফেসবুকীয় বাঙালিই বাজে বকে। বিতর্কর বেশিরভাগই অতি বাজে ও নিম্নমানের। তাতে ভয় পেলে চলে না। তুই আমার বিরোধিতা করেছিস আমি বলি নি, কিন্তু তুই মোল্লার দালালি করিস, সেটা ফ্যাক্ট, তোর কাজকর্ম সম্পর্কে আমি ওয়াকিফ। অতএব আমিই তো তোর বিরোধিতা করছি।
আমি কি এইসব বিষয় নিয়ে বেশি লিখি? বাধ্য না হলে লিখি? রাজনীতি একেবারে নর্দমার মত নোংরা, ওকে শখ করে ঘেঁটে সময় নষ্ট করব কেন? সি আর দাশ মোল্লার দালালদের প্রিয় আইকন, তাই একটু স্ট্র্যাটেজিক আইকোনোক্লাজম করা হল।
৩.
একটা কুচো চাড্ডির কমেন্ট পড়ে সকাল সকাল মাথাটা গরম হয়ে গেল। আমি নাকি এই লেখায় চিত্তকে দালাল বলেছি। এই কাংলাপক্ষ আর আওয়ামীর থেকে যেমন জামাত ভালো তেমনই কুচো চাড্ডির থেকে ভিরাট চাড্ডি অনেক ভালো। কুচোর অক্ষরজ্ঞান নেই, কেবল হোদলগড়ের সম্রাট ভজা রায় টাইপের ফেকপ্রোফাইল বানিয়ে ফেসবুকে রাজা উজির মেরে বেড়ায়। বাংলা পড়তে যে জানে সেই দেখতে পাবে, আমার লেখায় কোথাও চিত্তকে দালাল বলা হয়নি। বরং মহৎ বলা হয়েছে। দালাল তো ছিল শ্যামা। পিওর দালাল, একদা ইংরেজের, তারপর পাকিস্তান প্রস্তাবের জনক ফজলুলের, তারপর কংগ্রেসের, তারপর আর এস এস এর। সেই শ্যামাকে পশ্চিমবঙ্গের জনক বানিয়ে সঙ্ঘ স্পন্সর্ড কুচো চাড্ডির যাত্রাপার্টি “পশ্চিমবঙ্গের জন্য” নিয়মিত নাচন কোদন করে থাকে। সে যাক।
চিত্ত মহাশয় ব্যক্তি। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এইসব গ্যাঁড়াকল করেছিলেন। অস্যার্থ কিঞ্চিৎ জুমলাবাজ ছিলেন, যদিও উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। কিন্তু কিছুতেই মোদির ভাই বা খচ্চর বলা যাবে না। যেটা কুচো চাড্ডি সম্পর্কে বলা যায়, শ্যামা সম্পর্কে তো অবশ্যই বলা যায়।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, পাঁচ নভেম্বর দুহাজার বাইশ