
পুজো-অর্থনীতির খুঁটিনাটি
কলকাতার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর ঘোষণায় ‘Intangible Cultural Heritage’ এর স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে ‘পুজো-ইন্ডাস্ট্রি’র অর্থনৈতিক প্রভাব আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। সামষ্টিক অর্থনীতি অর্থাৎ ম্যাক্রোইকোনমিক স্তরের হিসেব তো আছেই, কিন্তু এক-একটি পুজোর আয়োজন কিভাবে আশেপাশের এলাকার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে, তা সেভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। এই প্রবন্ধে আমরা সেই ব্যষ্টিক অর্থাৎ মাইক্রোইকোনমিক স্তরের এককে ভেঙে পুজো-অর্থনীতিকে বিশ্লেষণের দিকেই নজর দেব।
এবছর একটি ছোটখাট সমীক্ষা করলাম নদীয়ার হরিণঘাটা অঞ্চলের বালিন্দী কল্যাণ সঙ্ঘের পুজো সম্পর্কে। কল্যাণ সঙ্ঘ বালিন্দী গ্রামের প্রধান ক্লাব। গ্রামের চারটি প্রশাসনিক বিভাগের দুটোয় মূলত বাংলাভাষী হিন্দুদেরই বাস, তাঁরাই এই ক্লাব তথা পুজোর চালিকাশক্তি। কল্যাণী-কাঁচরাপাড়া রোডের ধারেই কল্যাণ সঙ্ঘ ক্লাব। ক্লাবের লাগোয়া মাঠে প্যান্ডেল করে পুজো হয়, মাঠের সামনেই রাস্তার ধারে পুকুর, সেখানেই বিসর্জন হয়ে থাকে। এই ক্লাব শারদীয়া দুর্গোৎসব ছাড়াও লক্ষ্মীপুজো, সময়বিশেষে কীর্তনের আসর, শীতলাপুজো, সরস্বতীপুজো, চৈত্রে রক্ষাকালী পুজোর মত বিভিন্ন পুজো আয়োজন করে সারা বছর ধরে। ক্লাব সদস্যরা জানালেন, তাঁদের প্রতিমা আশেপাশের বেশকিছু পুজোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হয়ে থাকে, তাই গ্রামবাসী ও বাইরের দর্শনার্থী মিলিয়ে প্রায় দুহাজার মানুষ তাঁদের প্যান্ডেলে আসেন। পুজোর বয়স ছত্রিশ হল, এবারে তাঁরা একটি স্থায়ী দুর্গামঞ্চও বানাচ্ছেন, যেখানে ভবিষ্যতে পুজো করা যাবে। একাধারে গর্ব ও আক্ষেপের সঙ্গে তাঁরা উল্লেখ করলেন, অন্যান্য সমস্ত পুজো, উৎসবগুলির আয়োজন এবং দুর্গামঞ্চ নির্মাণের খরচ না থাকলে, এবার তাঁরা আরও বড় করে পুজো করতে পারতেন।
বাজেটের বিশ্লেষণে আসা যাক। সদস্যদের থেকে জানা গেল, কল্যাণ সংঘের এবারের মোট বাজেট দেড় লাখের মত। এর মধ্যে প্রতিমা চল্লিশ হাজার টাকার, প্যান্ডেল-আলোকসজ্জা-সাউন্ড সিস্টেম মিলিয়ে সত্তর হাজারের কাছাকাছি। এই পুজোয় থিম নেই, সাবেকি ধরনের প্রতিমা ও সাজসজ্জা, তাই থিমপুজোর তুলনায় খরচ হয়তো কমই পড়েছে। পুজো হয় বৈষ্ণবমতে, বলি হয় না। পুজোর আয়োজনে দশকর্মা দ্রব্যাদির খরচ পড়ছে ন’হাজারের মত। সদস্যরা জানালেন, প্রতিমা আসে কাছেই হরিণঘাটায় এক মৃৎশিল্পীর ফ্যাক্টরি থেকে, দশকর্মার দোকানও তার পাশেই। আর পুজোর প্রয়োজনীয় ফুলমালা ইত্যাদি সাপ্লাই দেন নিকটবর্তী সগুনা বাজারের এক ব্যবসায়ী, তার দাম পড়ে তিনহাজার-সাড়ে তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ এগুলো সবই স্থানীয় স্তরের মৃৎশিল্প ও শোলা-চুমকির কাজ, সলতে পাকানো, ধূপধুনো ও কর্পূরের মত জিনিসের প্যাকেজিং, প্রতিমার পোশাক ও অলঙ্কার, অস্ত্রসজ্জার নির্মাণের মত হস্তশিল্প-ভিত্তিক ছোট ছোট অসংগঠিত ইন্ডাস্ট্রি ও আশেপাশের এলাকারই ব্যবসায়ীদের সাপ্লাই ব্যবস্থার মাধ্যমেই আসে। ফুল সাপ্লাইয়ের মূল উৎস সন্ধান করে অবশ্য জানা গেল, স্থানীয় সাপ্লায়ার নিজে ফুল আনেন বাদকুল্লা, হাওড়া, বড়বাজার এসব এলাকার বড় ফুলবাজার থেকে। একশো আট পদ্মফুল ছাড়া পুজো হয় না, এদিকে এই অঞ্চলে পদ্মের চাষ হয়না সেভাবে। ফলে দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় সাধারণ গাঁদাফুলের ক্ষেত্রে যেখানে একটা গোটা চেন বাজারে দশ টাকায় পাওয়া সম্ভব, জবা কি দোপাটিরও দাম যথেষ্ট নাগালের মধ্যেই, সেখানে পদ্মফুল এক-একটির দামই দশ টাকার কম নয়, পরিস্থিতি অনুযায়ী কুড়ি টাকা পর্যন্তও উঠতে পারে। পাইকারি দরে এবং পরিচিত বিক্রেতার কাছ থেকে কিনলে যে ছাড় পাওয়া যায়, তা ধরেও অন্যান্য ফুলের তুলনায় পদ্মের দাম বাড়াবাড়ি রকমের বেশি পড়ে বলেই দেখা যাচ্ছে। পুজোর বিধির মধ্যে পদ্মফুল অত্যাবশ্যক না হলে এত দামি ফুল হয়তো আয়োজকরা সহজে কিনতেন না। পদ্ম চাষ ও সংগ্রহ করেন যাঁরা , তাঁদেরও এভাবে লাভ হয়। বস্তুত, এই পুজোর দিনে পদ্মফুল নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি পড়ে যায় ফুলবাজারে, যা সারা বছর একেবারেই দেখা যায় না।
অন্যদিকে, এই পুজোর জন্য ঢাকি পারিশ্রমিক নেন দশ হাজার টাকা প্রায়। সদস্যরা জানালেন, ঢাকি আসেন বর্ধমান থেকে। বোঝাই যায়, তাঁদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা বিশেষ পোক্ত নয়। উপরন্তু চামড়ার ঢাকের পরিচর্যা এবং মেরামতি বেশ কঠিন কাজ, ভিজে হাওয়ায় ঢাকের ছাউনির ক্ষতি হয় এবং তা ঠিক করে আবার বাজাতে বেশ কিছু কসরত করতে হয়। বাধ্য হয়ে ঢাকি সম্প্রতি ফাইবারের ছাউনি দেওয়া ঢাক ব্যবহার শুরু করেছেন। স্পষ্টতই, পুজোর এই রোজগার তাঁর সারা বছরের এক বিরাট অবলম্বন, তাই সুদূর বর্ধমান থেকে বালিন্দী ছুটে আসা। পুরোহিত দুজন দক্ষিণা নেবেন আট হাজার মত, তাঁদের আনা হচ্ছে কাছাকাছির মধ্যেই গয়েশপুর থেকে। ক্লাব সদস্যরা জানালেন এঁদের মূলত পৌরোহিত্যই পেশা, সারা বছর নানা পুজোপার্বণে পৌরোহিত্য করেই সংসার চালান। দুর্গাপুজোর এই পাঁচদিনের নিশ্চয়তা এঁদের কাছে অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্গাপুজোর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল অষ্টমীর ভোগ রান্না ও বিতরণ। ক্লাবের সেক্রেটারি নেপালবাবু বলেন, কল্যাণ সঙ্ঘের পুজোয় খিচুড়ি, লাবড়া, লুচি, পায়েস এসবই ভোগ দেওয়া হয়। ভোগ বিতরণের নির্ধারিত সময়টুকুতে দর্শনার্থীরা সকলেই প্রসাদ পান, সে গ্রামবাসীই হন আর বহিরাগত। কম করেও তিন-চার হাজার টাকা ভোগের জন্য খরচ হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই পুজোয় ভোগ রান্না করেন বালিন্দী গ্রামের মহিলারা নিজেরাই, ফলে নগদ পারিশ্রমিকের বিশেষ প্রশ্ন নেই। বাইরের পেশাদার রাঁধুনিদের কারুর সাহায্য সাধারণত নেওয়া হয় না, এমনকি রান্নার বাসনপত্র পর্যন্ত ক্লাবের নিজস্ব। ফলে ভোগ রান্নার খাতে ক্লাবের খরচ নিতান্তই ন্যূনতম। চাল,ডাল,সব্জি,ময়দা,দুধ,তেল,মশলা,চিনি এরকম সাধারণ ‘র মেটিরিয়াল’গুলো বাজার থেকে কেনা ছাড়া, সেভাবে কিছু খরচ ওঁদের লাগছে না ভোগের জন্য। সব পুজোয়, বিশেষত শহরের পুজোয় এই সুবিধা পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে পেশাদার ক্যাটারিং সার্ভিস বা রাঁধুনির সাহায্য নিতে হয়, রান্নার বাসনপত্রও ভাড়া করে আনতে হয়। ফলে নগদ অর্থের আদানপ্রদান আরও বেড়ে যায়, আরেকটি অতিরিক্ত ইন্ডাস্ট্রিও পুজোর কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে।
কল্যাণ সঙ্ঘের সদস্যদের বক্তব্য, তাঁরা পুজোয় বা বিসর্জনে ডিজে বাজান না। সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজে সারাদিন, তবে রাত দশটার পর নিয়ম মেনে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ক্লাবের নিজস্ব সাউন্ড সিস্টেমও আছে বলে জানা গেল, তবে তার ক্যাপাসিটি যথেষ্ট না হওয়ায় দুর্গাপুজোয় ওঁরা বাইরে থেকে অতিরিক্ত লাউডস্পিকার ভাড়া করে আনতেই পছন্দ করেন। গান ছাড়াও পুজোর মন্ত্রোচ্চারণ ও পুষ্পাঞ্জলীর সময়ে মন্ত্র ও ঘোষণা মাইকে সম্প্রচার করা এবং পুজোর সন্ধ্যায় গ্রামের শিশুদের বিচিত্রানুষ্ঠান আয়োজন করতে সুবিধা হয় এতে। মূলত ডিজে না থাকায় সাউন্ড অ্যারেঞ্জমেন্টের খরচ অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা। থিমের পুজো না হওয়ায় প্যান্ডেলের খরচও বেশ খানিকটা কম হয়। আলোকসজ্জা সহ প্যান্ডেল, সাউন্ড সবকিছুর জন্য ডেকরেশনের মোট খরচ সত্তর হাজারের মত। বিসর্জনের খরচ বলতে গেলে নেই, যেহেতু প্যান্ডেলের থেকে দশ মিটারের মধ্যেই পুকুরে বিসর্জন হয়। স্পষ্টতই গ্রামের যুবকরা নিজেরা কাঁধ দেন প্রতিমা আনয়ন ও নিরঞ্জনের সময়ে। অন্য পুজোতে এখানে ডিজে, ব্যান্ডপার্টি, প্রতিমা বয়ে নামানোর জন্য অর্থের বিনিময়ে লোক নিয়োগ করারই সম্ভাবনা বেশি, ফলে এই খাতে খরচ বাড়বে, আরও বেশি লোকের কর্মসংস্থানও হবে। এরকম নাগালের মধ্যেই প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য পুকুরও খুব কম পুজোতেই থাকে, ফলে পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে।
সেক্রেটারি নেপালবাবুর কাছ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া গেল। সরকারি অনুদান হিসেবে পুজো কমিটিগুলিকে ষাট হাজার টাকা দেওয়ার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, নেপালবাবু জানালেন, তা মূলত কোভিড-সতর্কতা ও সচেতনতামূলক প্রচারের কাজে, অথবা সামাজিক কর্মকাণ্ডেই ব্যয় করতে হবে, পুজোর মুখ্য অংশে নয়। তাই তাঁরা ঠিক করেছেন, পুজোর সময়ে গ্রামের প্রতিবন্ধী দুঃস্থ মানুষদের ক্রাচ বিতরণ, বস্ত্র বিতরণ করা হবে। এছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণ তথা বৃক্ষরোপণে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তাঁরা গাছের চারা কিনে গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করবেন।
কল্যাণ সঙ্ঘের পুজোটি প্রায় পুরোপুরি গ্রামের মানুষের চাঁদার উপর নির্ভরশীল। ক্লাব সদস্যরা বললেন, রাজনৈতিক নেতাদের তরফ থেকে অর্থানুকূল্য বা দলীয় হস্তক্ষেপ এই পুজোয় বিশেষ নেই। স্বাভাবিকভাবেই কোভিড পরিস্থিতিতে পুজোর জাঁকজমকে কিছুটা কোপ পড়েছেই গত দুবছর। এবার অবশ্য তাঁরা সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। বালিন্দী গ্রামের বাসিন্দারাই যেন একটি বৃহৎ পরিবারের মত মিলেমিশে অংশগ্রহণ করে এই পুজোটি সাফল্যমণ্ডিত করে তোলেন। পুজো সম্পর্কে তাঁদের একটাই আশা-আকাঙ্ক্ষা, “আগামী দিনে আমরা যেন পুজোটা আরও ভালভাবে, আরও বড় করে করতে পারি।”
কলকাতার কয়েকটি নামকরা পুজোর সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত তুলনা টেনে আলোচনা শেষ করি। এই তুলনাটি দিলে পাঠক বুঝতে পারবেন গ্রামের পুজোর বাজেট ও বিভিন্ন খাতের খরচের হিসেবের সঙ্গে শহরের, বিশেষত কলকাতার পুজোর স্কেলের পার্থক্য কতটা- এবং শেষ পর্যন্ত সার্বিকভাবে দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি ও শ্রমিকদের উপর পুজোর অর্থনৈতিক ইম্প্যাক্ট কতটা হতে পারে। সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্কের পুজোয় এবারে প্যান্ডেল-প্রতিমা-পুজো-বিসর্জন সবকিছু নিয়ে মোট বাজেট ২৫ লাখ, সামাজিক কর্মকান্ডের (মূলত পোশাক ও খাবার বিতরণ) জন্য আরও পাঁচ লক্ষ বরাদ্দ হয়েছে। বাঘাযতীন বিবেকানন্দ সমিতির পুজোর বাজেট চার লাখ, এর মধ্যে প্রতিমা ৫০-৫৫ হাজারের মত। কুমোরটুলির শিল্পী সোমনাথ রুদ্র পাল দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে একটি ইন্টারভিউতে জানান, প্রতিমার কারিগরদের দৈনিক মজুরি ১৫০০ টাকার মত, আর তাদের সাহায্যকারীর প্রায় ৮০০। তাঁদের স্টুডিওর এক-একটি সম্পূর্ণ প্রতিমার দাম পঁচাত্তর হাজার থেকে দেড় লাখ পর্যন্তও হতে পারে। এবছর কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে কলকাতার পুজোগুলোর বাজেট কিছুটা টানাটানির মধ্যে থাকার কারণে তাঁরা অসুবিধায় পড়েছেন। তবে বাজার ঘুরে দাঁড়ালে হয়তো আবার ‘পুজো-ইন্ডাস্ট্রি’ আগের মত লাভজনক হয়ে উঠবে।
আশাবাদী আমরাও। মহামারি-পরবর্তী পৃথিবীতে মায়ের আগমনে বাংলা দিশা ফিরে পাক। দেশ-বিদেশ বাংলার যে শারদোৎসবে মুগ্ধ, তা যথার্থই ‘মহাপূজা’ হয়ে উঠে বাঙালিকে অভীষ্ট ফল দিক।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শর্মিলি চক্রবর্তী, বালিন্দী কল্যাণ সঙ্ঘ ক্লাব)
(ছবি : আলোচ্য ক্লাবের এবারের প্রতিমা, পঞ্চমীর বিকেলে)