বাস্তুসাপ – ঋতুপর্ণা কোলে (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

বাস্তুসাপ

দশ দিন পর ফিরবে মেয়েটা। শেষ চারদিন তো কথাটুকুও হয়নি। সারাদিন অধীর অপেক্ষায় থাকার পর রাতেরদিকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আসতো “ঠিক আছি। চিন্তা কোরো না”। কাল রাত্রে জানালো “বাড়ি ফিরছি”। বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছে, বন্ধুর বাবা সব ব্যবস্থা করেছে, চিন্তার বিশেষকিছু আছে বলে তখন মনেও করেনি তিন্নির মা। তিন্নির বাবার খুব রাগ যে মেয়েটা এমন হয়েছে কেবল এই মায়ের আশকারাতেই। কদিন ধরে খবরে যা সব দেখছে তাতে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তার উপর ওইসব ঝামেলায় ফেঁসে গেল। ছায়াও এখন নিজেকে দোষী ভাবছে। ভাবছে, আটকাতেই তো পারতো।

সুবিনয় ভাবছে, তিন্নির বয়সের সব মেয়েরা বিয়ে করে বেশ তো সংসার গুছিয়েছে। আচ্ছা সংসার না করুক পড়াশুনা তো করতে পারে? পড়াশুনায় যে খুব খারাপ তা তো নয়। হঠাৎ করে মাথায় চাপলো বাংলাদেশ যাবে। তাতেও মা জানিয়ে দিলো “আচ্ছা যাও”।

-“তুমিই বা কোন আক্কেলে পারমিশন দিলে?”

-তোমার মেয়ে আজ পর্যন্ত কোন কাজের পারমিশন চেয়েছে? বাধা দিই না বলেই জানতে পারি কী করছে না করছে। বাধা দিলে তো জানতেই পারতাম না কিছু। চলে যেত।

-মানে? কী বলতে চাইছো তুমি?

– ওর জেদ তুমি জানো না?

– এই তোমার জন্যেই মেয়েটা এত অবাধ্য হয়েছে।

সুবিনয় এটা বলেই কেমন যেনো মিইয়ে গেলো। এরপর কোন বাণ তার দিকে তেড়ে আসছে তা অজানা নয়।

কিন্তু ছায়া কিছু বললো না। একবার তাকালো মাত্র। সুবিনয় মাথা নামিয়ে নিলো।

মেয়ে তিন্নিকে নিয়ে এভাবেই চলে ছায়া আর সুবিনয়ের সংসার। বাড়িতে আর একজন আছেন তিনি হলেন তিন্নির ঠাকুমা। এককালে ভয়ানক দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে আজ একেবারেই নিভন্ত প্রদীপ। মানে জ্বলছে তো বটেই কিন্তু কোনো তেজ নেই। আছেন সেটা তার দিকে তাকালে তবেই বোঝা যায়।

বাসের জানালার ধারের সিটটাতেই বসলো তিন্নি। তারপাশে ঝিলিক। কিন্তু দুজনের মুখেই অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা। কথা নেই কারো মুখেই। বাস ছাড়লো ঢাকা থেকে। তিন্নি বারবার জানালা দিয়ে ফিরে ফিরে দেখছে। তারপর একসময় ঝিলিকের কাঁধে মাথা রাখলো। ঝিলিক ওর কাঁধটা ভেজা অনুভব করলো। বুঝতে পারলো তিন্নি কাঁদছে। তবুও ঝিলিক চুপ করেই থাকলো। কোনো একটা ব্রীজের  উপর দিয়ে যাচ্ছে বাসটা। অন্ধকার হলেও পূর্ণিমার আলোয় বোঝা যাচ্ছে। গলাটা শুকনো অনুভব করলো ঝিলিক। হাতের কাছেই বোতলটা ছিলো জলটা মুখে দিয়ে ভাবলো তিন্নিও তো অনেকক্ষণ জল খায়নি। দুবার ডাকলো, “অ্যাই তিন্নি। তিন্নি… জল খাবি?” সাড়া না পেয়ে বুঝলো ঘুমিয়ে গেছে। একবার কাকিমাকে ফোন করা দরকার ভেবেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো কাকিমার মেসেজ। কাকিমা মানে তিন্নির মা। লিখেছে, “উঠেছিস বাসে? সব ঠিক আছে তো?” ভালোই করেছে মেসেজ করে। এখন কথা বলতেও ভালো লাগছে না ওর। লিখে দিলো, “হ্যাঁ কাকিমা সব ঠিক আছে। তুমি ঘুমিয়ে যাও। কাল দেখা হচ্ছে”।

এই কদিনে তিন্নি অদ্ভুত বদলে গেছে। কাকিমা ফোন করলেই রেগে যায়। কেবল কাকিমা নয় যে কেউ ফোন করলেই রেগে যাচ্ছে। মেয়ে বাইরে আছে। একের পর এক বিপদ লেগেই আছে। চিন্তা তো হয়। তিন্নিকে না ঘাঁটিয়ে কাকিমা ঝিলিক-কেই ফোন করে খবর নেয়।

কাকিমা বেশ বোঝে। ঝিলিক মাঝে মাঝে ভাবে ওর মা এমন হতে পারতো তো। সারাজীবন কেবল মেয়েদের এই করতে নেই আর সেই করতে করেই করে গেলো। ঝিলিকের বাবা এব্যাপারে অনেক বেশি উদার। ওদের বাংলাদেশ যাওয়া আসার সব ব্যবস্থা ওর বাবা-ই করে দিয়েছিল। ভারত সরকারের উচ্চপদে থাকার এটুকুই সুফল।

নব্বুইয়ের দশকের গোড়াতেই তখন কলেজ কাঁপাচ্ছে তৃতীয় বর্ষের সুবিনয়। কলেজ ইউনিয়নের দাদা সে। গেটের পাশেই আরও চারজন ছেলের সঙ্গে বসে আছে। আজ থেকে নতুন বছরের ক্লাস শুরু। নতুন নতুন ছেলে মেয়েদের কাছে হিরো সাজার দিন। একটা মেয়ে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো “দাদা… বাংলা অনার্সের ক্লাসটা কোনদিকে?” পাশ থেকে অন্য একটা মেয়ে বলে উঠলো “আর কতো দাদার দেখানো পথে চলবি? বড়ো হয়েছিস নিজের পথ নিজে খোঁজ”। বলেই মেয়েটার হাত টেনে নিয়ে চলে গেলো।

অপমানিত বোধ করল সুবিনয়ের বন্ধুরা। কিন্তু মুহূর্তে ভালো লেগে গেলো সুবিনয়ের। মেয়েটা কে? এত তেজই বা কীসের? নতুন জায়গায় এসে বিন্দুমাত্র কুন্ঠা নেই। খোঁজ নিয়ে জানলো মেয়েটির নাম ছায়া বিশ্বাস। ইতিহাসের অনার্সে ভর্তি হয়েছে, বাড়ি নদিয়ার কোথাও একটা। কলকাতার একটা মেসে থাকছে। সুবিনয় নিজেও ইতিহাসের ছাত্র সঙ্গে বাম নেতা। ব্যাপারটা আপাতত এখানেই থেমে যেতে পারতো কিংবা গিয়েও ছিল ছয়মাসের জন্য। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জানা গেল কলেজে ফেস্ট হবে। প্রতি ডিপার্টমেন্ট কোনো একটা বিষয়ের উপর প্রোজেক্ট তৈরী করে স্টল দেবে। তার মিটিং ৩টে নাগাদ যারা স্টলের ব্যাপারে আগ্রহী তারা যেন অবশ্যই মিটিং-এ থাকে। প্রথম বর্ষের তেমন কেউ আগ্রহ দেখালো না। মিটিং-এর আগেই ক্লাসে একটা ছোট মিটিং হয়ে গেল। ঠিক হলো দাদা দিদিরা যা ঠিক করার করুক প্রয়োজন মতো তারা সবাই কাজ করে দেবে। তিনটেয় মিটিং শুরু হলো। ছায়া গিয়ে হাজির। সুবিনয় তখন বক্তৃতা দিচ্ছে। প্রোজেক্টের বিষয় দেশভাগ। সুবিনয় বলে চলেছে একই মায়ের দুই সন্তানকে কীভাবে আলাদা করা হয়েছে, কীভাবে সম্প্রীতি নষ্ট করা হয়েছে, আজ যদি দুই বাংলা এক থেকে আলাদা রাষ্ট্র করতো বাঙালি ভাগাভাগি হতো না, ভারত রাষ্ট্রর অংশ হওয়ার থেকে বৃহত্তর বাংলাদেশ হলে কত ভালো হতো ইত্যাদি। হাততালির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ছায়া দাঁড়ালো। সুবিনয়কে থামিয়ে প্রশ্ন করলো, “জানেন সংখ্যাটা? পুরো বাংলাটাই গেলে কোথায় পালাতেন? বিহার? নাকি বাঁচাতে তুলে নিয়ে যেত আপনার ওই চীনের দাদারা?”

-কী বলতে চাইছেন?

-সম্প্রীতি মারাবার আগে গোটা পৃথিবীর ইতিহাস খুলে দেখুন যেখানে ইসলাম সংখ্যাগুরু সেখানে সংখ্যা লঘুর পার্সেন্টেজ। ইতিহাসেরই ছাত্র তো আপনি? প্রোজেক্ট করতে হলে সত্যিটা তুলে ধরুন।

-কোনটা সত্যি?

-এই যে আমি মূর্তিমান সত্যি। আমার পরিবার সত্যি। আমার দাদু, ঠাম্মা, জেঠু চাপাতির ঘায়ে মৃত। এক পিসি কোথায় আছে জানি না। পনেরো বছর বয়সের একটা মেয়ে পেটের মধ্যে না জানি কার বাচ্চা নিয়ে দেশ ছাড়ে। ছাড়ার আগে আমার বাবার সঙ্গে তার বিয়ে হয় পথে কেবল বাঁচার তাগিদে। সেই পেটের বাচ্চাটা আজকের আমি”। আরও জানতে চান?

সুবিনয় কেমন যেন থমকে গেল। থমকে গেল গোটা ঘরটা। থমকে গেল সেদিনের মিটিং।

পরেরদিন সুবিনয় কলেজে এসে প্রোজেক্টের কনভেনিয়র হিসাবে নাম ঘোষণা করলো ছায়ার। ছায়ার কাছে গিয়ে বললো, “সত্যিটা আরও জানতে চাই”।

প্রোজেক্ট তো ঠিকঠাক উতরে গেল, স্টল দেখে সবারই গলার কাছটা কেমন একটা শুকিয়ে এলো অন্যদিকে দুটো মানুষের মধ্যে বসন্তের দখিনা বাতাসের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল।

এরই বেশ কিছু বছর পর আগে সুবিনয় তার দুবছর পর ছায়া দুজনেই স্কুলের চাকরি পেয়ে গেলো এবং বিয়েটাও সেরে নিল।

-অ্যাই তিন্নি ওঠ। পদ্মা সেতু পাড় হচ্ছে।

-আরে কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম। মাকে ফোন করাও হয়নি।

-কাকিমার সঙ্গে কথা হয়েছে

-আচ্ছা। ঝিলিক!

-বল

-আজকের মতো সেদিনও কোজাগরী পূর্ণিমা ছিলো জানিস। পদ্মা নিশ্চয়ই এতটাই সুন্দর ছিলো সেদিন-ও তাই না?

ঝিলিক চুপ রইলো।

এই কদিন আগেই তো এসেছিল। মাঝে কত কিছুই না ঘটে গেল।  আজ দাদুর কথা বড্ড মনে পড়ছে। শেষ সময়টা দাদু তিন্নি অন্ত প্রাণ ছিলো। যেদিন মারা গেলো তার দুদিন আগে তিন্নির হাত ধরে বলেছিলো, “আমাকে নিয়ে যাবি দিদিভাই? বোনটাকে এবারে ঠিক নিয়ে আসবো। আমার জন্য অপেক্ষা করছে দিঘিটার ধারে”।

তিন্নির মায়ের জন্মের পরই তার দিদা মারা যায়। মাত্র বাইশ বছর বয়সের গোবিন্দ ছোট্ট ছায়ার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। ছায়া যেন সত্যিই ছায়া, গোবিন্দর ছায়া। যেদিন ছায়া চাকরি পেলো গোবিন্দর মেয়েকে জড়িয়ে সে কি কান্না। ছোট্ট ছেলের মতো মেয়ের কাছে নাকি আবদার করেছিল “এবার একবার নিয়ে যাবি?” তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিলো ছায়া। আর কখনো মেয়ের কাছে সেদেশের কথা তোলেনি। তিন্নি যখন একটু বড়ো হলো, দাদুর কাছে গল্পের আবদার করতে শুরু করলো তখন থেকে আবার সেদেশ নতুন করে জন্ম নিলো দাদু নাতনী কাছে। তিন্নির কাছে দাদুর বাড়ি, দাদুর গ্রাম ছবির মতো স্পষ্ট ছিলো এমনকি মানুষগুলোও। খালি গ্রামের নাম দাদু কখনো বলেনি তিন্নিকে। তিন্নির আর তার দাদুর গল্পের জগতে একটা কাদের শেখ আছে রূপকথার দৈত্যর মতো। সেই কাদের শেখের কাছে একটা বন্দিনী রাজকন্যা আছে। কিংবা আজ আর নেই। কিন্তু ওদের গল্পে কোনো রাজপুত্র নেই যে ঐ রাজকন্যাকে মুক্ত করতে পারে।

গোবিন্দ যেদিন মারা গেল সেদিন তিন্নি দাদুর কাছেই বসেছিল। দাদু একটা চাবি তিন্নির হাতে দিয়ে সামনের টেবিলের ড্রয়ারের দিকে আঙুল তুলে কী যেন দেখাতে চাইলো। তিন্নি ড্রয়ার খুলে একটা ডায়েরি পেলো। পড়ার সময় পায়নি সেদিন। দাদুর কাজ কর্ম শেষ হতে একদিন অলস দুপুরে সে তার চিলেকোঠার ঘরে ডায়ারিটা খুলে বসলো। তিন্নির তখন বয়েস সতেরো। সেই দুপুরেই তিন্নি ঠিক করেছিল যে সে যাবে দাদুর বাড়ি, দাদুর গ্রামে। কে জানে হয়তো পেলেও পেতে পারে দাদুর আদরের ছোট বোনকে।

গোবিন্দ মারা গেছে বছর ছয়েক হলো। তিন্নি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ করছে। গোবিন্দ মারা যাওয়ার পর ছায়ার খালি গ্লানিবোধ হয়। সে বোধ হয় সত্যিই মেয়ে হতে পারে নি। গোবিন্দ যতবারই দেশে ফিরতে চেয়েছে ততবারই আটকেছে। রেগে গেছে। আসলে ছায়াও জানে সে গোবিন্দর নিজের মেয়ে নয়। ছায়া দেশটাকে কেবল ঘৃণা নয়, ভয়-ও করে। সেখানে সেই পশুগুলো আছে যাদের অত্যাচারের ফসল সে। সেই নোংরা মানুষগুলোর রক্ত যে তার শরীরেও। তাই পালিয়ে বাঁচাটাই শ্রেয় মনে করে।

তিন্নি যখন যাবার কথা তার মাকে জানায় ছায়া কেবল বলে, “যেতে হলে নিজে যেও। আমাকে বোলো না”

সুযোগ হঠাৎ-ই আসে। ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সেমিনার। সেখানে অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক শাহরিয়ার সুমন। সেমিনারে বক্তব্য রাখলেন বাংলাদেশের উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এবং পুনরায় পাকিস্তানের পথে যাওয়া দেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাহিত্যের পরিবর্তনগুলি যখন তুলে ধরছিলেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল তিন্নি।

সেমিনার শেষে তিন্নি দেখা করতে গেল।

-আপনার থেকে কি একটু সময় পেতে পারি।

-হ্যাঁ। বলুন।

– নমস্কার আমি তিলোত্তমা বসু।

-নমস্কার।

-আসলে আপনার সঙ্গে একটু আলাদা করে কথা বলতে চাইছিলাম। আমাকে প্লিজ ‘আপনি’ বলবেন না।

– আচ্ছা চলো ঐ বারান্দাটায় যাই।

বারান্দায় যেতে যেতে তিন্নি- ক্ষমা করবেন বিব্রত করলাম বলে।

-আরে না না

– আসলে আমি মানে আমার দাদু বাংলাদেশের। যতটা তথ্য পেয়েছি তা হলো নলশোধা বলে একটা জায়গায় ওনাদের বাড়ি ছিল। গ্রামটা নিয়ে জানতে ইচ্ছা করে।

– দাদুর বাড়ি নিয়ে আর কোনো তথ্য জানা আছে?

– দাদুদের পদবী ছিল বিশ্বাস। কোনো দিঘী আছে তার পাশেই বাড়ি ছিলো। বড় বাড়ি।

-আচ্ছা বেশ আমি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি। তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা দাও। যোগাযোগ করতে সুবিধা হবে।

এরপর সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেলো। সন্ধ্যেবেলা নিজের পড়ার ঘরে বসে একটা অ্যাসাইনমেন্ট রেডি করছে তিন্নি। এমন সময় একটা মেসেজ। স্ক্রীনে ভেসে উঠলো ‘সুমন স্যার বাংলাদেশ’

-অন আছো?

– হ্যাঁ আছি। কেমন আছেন?

-একবার ফোন করতে পারি।

-হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার।

হোয়াটসঅ্যাপেই ভয়েস কল ঢুকলো।

“যতটা খবর পেলাম সেই দিনের হামলায় ওই গ্রামের কোনো হিন্দুর বেঁচে থাকার কথা নয়। তাহলে তোমার দাদু?”

-দাদু সেদিন বাড়িতে ছিলো না।

-ও বাড়িতে কাদের শেখ নামে একজনের পরিবার থাকে।

-ওই লোকটাই তো…

-হ্যাঁ জানলাম। তবে সে আর বেঁচে নেই। ওই বাড়ির একটি মেয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেয়েটি ভালো। আজ ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো। সে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তোমার নম্বর কি দেবো?

তিন্নির সঙ্গে বন্যার কথা শুরু সেদিন থেকেই। বন্যা বারবার তিন্নিকে নেমতন্ন করে তাদের বাড়িতে। তিন্নি বুঝে পায় না কী করবে। সেদিন বন্যার মা সাবিনা যখন বললো, “এ তো তোমাদেরই বাড়ি। একবার অন্তত এসো’ তিন্নির যাওয়ার ইচ্ছা আরও প্রবল হয়ে উঠল।

চতুর্থীর রাতে তিন্নি আর ঝিলিক ঢাকার ফ্লাইট ধরেছিল। তিন্নি যখন দাদুর দেশ ছাড়ার গল্প, ওর মায়ের জন্মের গল্প ঝিলিকের কাছে করেছিলো। ঝিলিকের অজান্তেই চোখের কোণ ভিজে উঠেছিলো। ঝিলিক তিন্নিকে জিজ্ঞেস করে বলেছিলো, “যাবি?”

-যেতে তো চাই। কিন্তু কীভাবে?

-বাবা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। দেখি রাজি করাতে পারি কিনা।

সত্যিই ঝিলিকের বাবা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো।

তিন্নির খুব ইচ্ছা ছিলো ফেরাটা যেন বাসে হয়।

ঝিলিকের বাবা টিকিট, পাসপোর্ট, ভিসা সবকিছু রেডি করে ফেললো কয়েকদিনের মধ্যে। এরপর ডেকে পাঠালো তিন্নিকে। ঝিলিকের মা তিন্নির সঙ্গে সামান্য কথাটুকুও বললো না।

-আচ্ছা কাকু, তুমি আপত্তি করলে না কেনো?

– আমার মা বাংলাদেশের। মা খুব চাইতো মরার আগে একবার যদি দেখতে যেতে পারে। মায়ের জন্য ব্যবস্থা তো করতে পারিনি। ঝিলিক গেলে জানবো আমার মা গেছে। মায়ের ইচ্ছাপূরণ করতে পেরেছি।

– ও দেশ থেকে যারা এসেছে তারা এদেশকে কখনো আপন করতে পারেনি না?

– পারা কি সম্ভব? কটা ছুটি পেলেই মানুষ কেনো নিজের বাড়ি ফেরে?

-এখানে তার সব আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তো মানুষগুলোর কিছুই নেই।

– নেই কে বললো। কেবল মানুষ দিয়েই কি দেশ হয়? দেশটাকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিলো কেউ তার দেশের মাটি স্বেচ্ছায় দান করে আসেনি। ছোট বেলায় মনে আছে তোর একটা পুতুল ঝিলিক জোর করে তোর থেকে নিয়ে চলে এসেছিলো, তুই অনেক কান্নাকাটি করেছিলি ও ফেরত দেয়নি। আমরা যখন জানলাম ফেরত দেবো ঠিক করলাম শুনো রাগে ও নোংরা ফেলার গাড়িতে ফেলে দিয়েছিলো।

-সেই পুতুলের জন্য আজ-ও ওকে কথা শোনাই।

-তাহলেই ভাব সামান্য পুতুলকে ভুলতে পারিসনি, মানুষগুলো দেশ, মাটি, মানুষ, স্মৃতি সব ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।

-বুঝতে পারছি। আজ যখন যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ তখন মনে হচ্ছে গিয়েই কী হবে। এতদিন যে ইচ্ছাটাকে মনের মধ্যে লালন করেছি এখন কেমন একটা দ্বিধা কাজ করছে।

– জীবনে প্রথম মা বাবাকে ছাড়া ঘুরতে যাচ্ছিস। নতুন দেশ দেখতে যাচ্ছিস। পুরনো কথা ঝেড়ে ফেলে আনন্দ করে যা।

ঝিলিকের বাবাকে প্রণাম করে তিন্নি বেরিয়ে এলো।

সালটা ১৯৭০। গোবিন্দ স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সপ্তাহ শেষে বাড়ি ফেরে। বাড়ি তার নলশোধায়। ছোট বোন কাজরি ঠিক জানে দাদার ফেরার সময়, দিঘির পাড়ে গিয়ে অপেক্ষা করে। মা, বাবা, দাদা, দিদি, বোন, চাকর-বাকর সব নিয়ে ভরপুর সংসার। গোবিন্দর দাদার বিয়েও পুজো মিটলেই অগ্রহায়ণ মাসেই।

সেদিন ছিল লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন। আসন্ন মা লক্ষ্মীকে মানে ভাবি বৌদিকে তত্ত্ব দিতে গেছিল গোবিন্দ পাশের গ্রামেই। বৌদির মা নাড়ু করেছে সেসব আর কিছু নতুন জামা কাপড় নিয়ে ফিরছিল সে। গোবিন্দদের বাড়িটা গ্রামের একপ্রান্তে। নলশোধা দিঘির গা ঘেঁষে খামার, দুর্গা দালান তারপরেই পেল্লাই দোতলা বাড়ি। দিঘির অপর দিকে যতদূর চোখ যায় গোবিন্দদের জমি। গোবিন্দ তখন মাঠের মাঝে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে। কিন্তু কিছু না বুঝে আরও জোরে পা চালাতে লাগলো। হঠাৎ মাঠের মাঝে শেফালিকে দেখে চমকে উঠলো গোবিন্দ। গায়ে পোশাকের নাম মাত্র নেই সারা শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। কাজরীর প্রাণের বান্ধবী শেফালী। একই বয়স দুজনের। তার থেকে কিছু শোনার আগে গোবিন্দ হাতের ব্যাগে থাকা তত্ত্বে আনা নতুন কাপড় তাড়াতাড়ি জড়িয়ে দিলো শেফালির গায়ে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শেফালি জানালো কাদের শেখের লোকজন গোটা গ্রামের দখল নিয়েছে। চাপাতির ঘায়ে সবারই মাথা আলাদা করে দিচ্ছে। শেফালিকে ছিঁড়ে খেয়েছে কাদের শেখের লোকজন। তারপর মরা ভেবে ফেলে পালিয়েছে। মরার মতো পড়ে থাকতে থাকতে শেফালি শুনেছে কাদের শেখ বলছে “বড় কত্তাদের ছোট মেয়ের গায়ে কেউ হাত দিবি না ওটা আমার”। কাদের শেখের লোকজন চলে গেলে শেফালি কোনো মতে গ্রাম ছেড়ে মাঠে এসে লুকায়। মাঠে লুকিয়ে থাকার সময় শেফালি দেখেছে দিঘির পার থেকে কাজরিকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কাদের।

“দিঘির পাড়ে”?

“হ্যাঁ”

“তবে তো আমার জন্যই দাঁড়িয়েছিলো। ও জানতো আমি ফিরবো”

বলেই দৌড়ে বাড়ির দিকে যেতে যাচ্ছিলো গোবিন্দ। শেফালি কিছুতেই যেতে দিলো না। ও জানতো গোবিন্দ এই যাওয়া জীবনের শেষ সময়কে ঢেকে নিয়ে আসবে। ধান জমির মধ্যে দিনের আলো নেভা অবধি অপেক্ষা করলো। তারপর সোজা হাঁটা। থেমে ছিলো ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগে। ঢাকায় এক অধ্যাপকের বাড়ি। যিনি গোবিন্দকে স্নেহ করতেন। মোদ্দা কথা গোবিন্দ তাই-ই জানতো। অবশ্য কাদের শেখকেও গোবিন্দ তার বন্ধু বলেই চিনেছে এতদিন। একসঙ্গে খেলা, দিঘিতে মাছ ধরা সবই তো তার করেছে। গোবিন্দর মা কাদেরকে নিজের ছেলেদের থেকে আলাদা করে কখনো দেখেনি। কিন্তু হঠাৎ কীভাবে সব যেন বদলে গেল।

-স্যার স্যার দরজা খুলুন স্যার। (বারবার দরজায় কড়া নাড়লো গোবিন্দ)

-(ঘুম চোখে দরজা খুলে) আরে গোবিন্দ যে… একি অবস্থা তোদের। আয় আয় ভেতরে আয়।

ভেতরে যেতেই আগে জামা কাপড় তোয়ালে দিলেন গোবিন্দর স্যার। বললেন, “আগে ফ্রেশ হয়ে আয়”। শেফালিকে নিয়ে গেল স্যারের স্ত্রী ভেতরের ঘরে। গোবিন্দ জামা কাপড় ছেড়ে স্যারের কাছে বসলো। সব জানালো

-স্যার কটা দিন শেফালিকে রাখবেন? আমি একটা কাজ জুটিয়ে ওর জন্য থাকার ব্যবস্থা করবো।

-এই দেশটা তোদের জন্য সেফ নয় রে। তারচেয়ে তোরা ইন্ডিয়া চলে যা না… আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো কোনো সমস্যা হবে না।

-এটা কী বলছেন?

গোবিন্দ কেমন যেন পাথরের মতো হয়ে গেলো আর কথা বাড়াতে পারলো না। সন্ধ্যা নামার আগে একটা গাড়ি এলো। স্যারের নির্দেশ মতো শেফালি আর গোবিন্দ চেপে বসলো। দুজন সদ্য পরিবার হারা, দেশ হারা মানুষ চললো ছিন্নমূল হতে।

গাড়ি ছাড়ার আগে স্যার গোবিন্দর হাতে একটা কাগজ আর তাতে মুড়ে কিছু একটা দিলেন। গোবিন্দর কানের কাছে বললেন, “কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি শেফালি তোর স্ত্রী”। এই কথাতেই শেফালি আর গোবিন্দ স্বামী-স্ত্রী। আলাদা করে আর কোনো বিয়ের প্রয়োজন হয়নি তাদের। বলা ভালো সুযোগ-ও হয়নি।

গোবিন্দ নিরুত্তর রইলো। সে ভেবে পাচ্ছিলো না কৃতজ্ঞ হবে নাকি? লোকটার কাছে গোবিন্দ এসেছিল দেশের মাটিতে একটু নিরাপত্তা পেতে। লোকটা একটা আঙটি আর এক চেনের বিনিময় দেশত্যাগের ব্যবস্থা করে দিলো, দেশটাকেই কেড়ে নিলো। কাদের শেখের সঙ্গে কি কিছুমাত্র ফারাক আছে? কাদের অশিক্ষিত তাই নির্মমভাবে কাড়ে ও মারে। স্যার শিক্ষিত তাই সব ছিনিয়ে নেন হাসিমুখে, কিছু দানাপানি দিয়ে।

তিন্নিদের নিয়ে গাড়ি ছুটলো ঢাকা থেকে নলশোধা। বন্যা ওর বাবাকে নিয়ে এসেছে এয়ারপোর্টে। শহরটা ছাড়ানো মাত্রই একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা, নির্জনতায় মোড়া। কেবল সবুজ আর সবুজ। শরতের প্যাঁজা তুলোর মতো মেঘগুলো ছায়াপথের দুপাশের  দুই বিরাট বিরাট জলাশয়ের মেঝেতে খেলা করছে। “এগুলো কি সোনাই, রূপাই ঝিল”? প্রশ্ন করে উঠলো ঝিলিক। গাড়ির জানালার কাঁচে মুখ রেখে দিগন্তে হারিয়ে গেছিলো তিন্নি। ঝিলিকের প্রশ্নে চমকে উঠলো।

-আরে দাদুর ডায়ারিতে ছিলো না? সোনাই রূপাই ঝিলের পাড় থেকে দাদুকে বাস বদলাতে হত।

– হ্যাঁ তো… ইশ… কীভাবে ভুলে গেলাম… ওই তো ওই তো সেই শামুকখোল পাখিগুলো। ওই যে বকের মতো দেখতে। দাদু বাসের ছাদে উঠে বসলে ওরা ঘাড় তুলে দাদুর চলে যাওয়াটা দেখতো।

ঝিমিয়ে পড়া তিন্নির হঠাৎ চনমনে হয়ে ওঠা দেখে অবাক হয়ে গেল বন্যা। আর অবাক হলো তিন্নি নিজে। দাদুর ডায়েরিটা ঝিলিক নিয়ে গেছিলো বটে কিন্তু এত মন দিয়ে পড়েছে, এত আপন করেছে তা ভাবতে পারেনি।

ঝিলিকের আচরণে বরাবরই অবাক হয় তিন্নি। সেই ছোট থেকে দেখে আসছে। বয়সে ওর থেকে মাস চারেকের ছোট হলেও আচরণে ওর বড় দিদির বাড়া। কে বলেছে কেবল রক্তের সম্পর্ক থাকলে আত্মীয় হওয়া যায়? আত্মার সম্পর্কটাই আসল। তিন্নি বোঝে ঝিলিক কেনো এসেছে। তিন্নির যদি কোনো বিপদ হয় ও যেন ঢাল হতে পারে।

-আচ্ছা বন্যা তুমি কি রোজ যাতয়াত করো? (প্রশ্ন করলো ঝিলিক)

– ইউনিভার্সিটি থেকে?

-হ্যাঁ গো।

-না না। আসা যাওয়া করাই যায় কিন্তু তাতে পড়ার সময় খুব একটা তো পাবো না।

-আঙ্কেল… আমাদের জন্য আজ আপনার গোটা দিনটাই নষ্ট হলো। (এই প্রশ্নটা ঝিলিক ছুঁড়ে দিল বন্যার আব্বুর দিকে)

-আরে কী যে বলো। তোমরা আমার মেয়ের মতো। মতো কেনো বলছি। মেয়েই তোমরা আমার। তোমাদের জন্য আমরা আব্বুরা সব সময় তৈরি। তাছাড়া গতকাল তোমার আব্বুর সঙ্গে কথা হলো। যা বুঝলাম তোমাদের অসুবিধা হওয়া মানে কেবল ইন্ডিয়ায় নয় বিশ্বের দরবারে আমাদের দেশের মুখ পুড়বে।

ঝিলিক একটু লজ্জায় পড়ে গেল। আসলে ও কারো বাড়ি যাওয়ার আগে তাদের সঙ্গে একটু কথা বলে পরিবেশটাকে সাবলীল করতে চাইছিলো।

 তিন্নি আবার হাঁ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। গাড়ি বড়ো রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে ঘুরতেই তিন্নি দু হাত জড়ো করে প্রণাম করলো। বন্যা জিজ্ঞেস করলো, “কী হলো”। তিন্নি কিছু বলার আগেই ঝিলিক বলে উঠলো “শেতলা তলা। মন্দিরটা আছে?” বন্যার আব্বু বললো, “সংস্কারের অভাবে ভাঙতে বসেছে। কাল সকালে নিয়ে আসবো। তোমরা এত ডিটেইলস কীভাবে জানলে”

-প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা গাছ সব বড্ড চেনা লাগছে। এতগুলো বছরে কিছুই তো বদলায়নি। আজ থেকে ৫২ বছর আগে যা ছিলো তাইই তো আছে।

তিন্নির কথা শুনে সুবহান মানে বন্যার আব্বু বলে উঠলো, বিদ্যুৎ আসা, মোবাইলের টাওয়ার বসা আর কয়েকটা টুকটাক বদল ছাড়া তোমার দাদু যেখানে রেখে গেছিলো নলশোধা সেখানেই আছে। কেবল নলশোধা নয় সব গ্রামই এক আছে।

-কেবল গ্রামগুলোর বহু মানুষ নিখোঁজ। যাদের নিরুদ্দেশ সম্পর্কে কোনো ঘোষণা হয় না।

-তিন্নি কী সব বকছিস। (ধমকে উঠলো ঝিলিক)

-ভুল তো কিছু বলিসনি রে মা। বাংলাদেশের যা অবস্থা আমরাও কদিন পর হয়তো নিখোঁজ হয়ে যাবো। (সুবহান বললো)

বন্যাও আর চুপ থাকতে পারলো না। – গ্রামের পরিবর্তন হয়নি কে বললো গো। পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ, দুদিন ছাড়া ওয়াজ…… এই তো দুসপ্তাহ হলো রফিকদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই জানি খালের পাড়ের বডিটা রফিকদারই কিন্তু কেউ কি কিছু করতে পারছি? রফিকদা কি হিন্দু ছিলো।  

-উনি কী করেছিলেন? (প্রশ্ন করলো ঝিলিক)

– রফিকদার অপরাধ প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময় বাংলাদেশে যে হিংসা বেড়ে যাচ্ছে তার উপর একটা প্রতিবেদন করেছিলো এবং সেটা ফেসবুকে দিয়েছিলো। তাতে নাকি সংখ্যাগুরুর অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।

কথা বলতে বলতে ওদের গাড়ি একটা দিঘির কাছে অপেক্ষারত একজনের সামনে এসে দাঁড়ালো। জানালার কাঁচ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সুবহান বললো,

-চাচা, বড্ড দেরি হয়ে গেলো গো

– এই তো এলাম। মেহমান নাকি?

– হ্যাঁ চাচা, মেয়েটার দোস্ত।

চাচার হাত থেকে থলেটা নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললো, “আজ রাতে আমাদের দিঘির তাজা মাছ তোমাদের খাওয়াবো”।

“দিঘির ধার ধরে এমন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে”? অনেকটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো তিন্নি

-মা রে একটা কথা বলি। মনে যেন নিস না। তোরা যে গোবিন্দ মামুর কেউ হস, এখানে কেনো এসেছি তা কারো কাছে বলার দরকার নেই। তোরা বন্যার বন্ধু তাই ঘুরতে এসেছিস।

-আচ্ছা। বুঝতে পারছি

একটা বড়ো দরজার সামনে দাঁড়ালো গাড়িটা।

১০

গোবিন্দ শেফালি বিনা বাধাতেই বর্ডার পার করলো। কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে যখন পদ্মা পাড় করছিলো শেফালি তার স্তব্ধতা ভেঙে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। পদ্মার জল আর শেফালির চোখের জল চাঁদের আলোয় একই ভাবে চিক চিক করে উঠলো। নতুন সূর্যের সঙ্গে নতুন দেশ। যাদের বাড়িতে কত কত আশ্রিত আশ্রয় পেয়েছে সেই বাড়ির একমাত্র জীবিত সন্তান নিজের দেশেই পেলো না সামান্য আশ্রয়, সামান্য নিরাপত্তা। যে দেশে যাচ্ছে সেই দেশের মানুষগুলো কখনো কি পারবে গোবিন্দকে আপন করতে? না পারারই কথা। তারা তো অতিথি নয় যে এক তিথি পরে ফিরে যাবে। নিজের ঘরে ভাত না জুটলে অতিথিকেই কেউ পছন্দ করে না তার উপর আবার চিরকালের আশ্রিত। একজন নয় দুজন নয় সংখ্যাটা কয়েক কোটি। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের আর কোথাও বাংলা চলবে না। ইংরেজি গোবিন্দ লিখতে পারে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গোবিন্দ শুনেছে হিন্দি চলে যার কিছুই সে জানে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যদি তাকে থাকতে না দেয়! এসব আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমিয়ে গেছে শেফালিও। মানুষ যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণই তার আনন্দ, তার দুঃখ। ততক্ষণ-ই তার অতীত, তার বর্তমান, তার ভবিষ্যত।

গাড়ি এসে দাঁড়ালো বর্ডারের একটু দূরে। তখনও আলো ফোটেনি। ড্রাইভার ওদেরকে দাঁড়াতে বলে কাউকে একটা ডাকতে গেল। যখন ফিরলো হাল্কা আলো ফুটেছে। শেফালি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই। সামনে একটা দেশ পেছনে একটা দেশ। মাঝখানে দুই অনাহূত। গোবিন্দ পকেট থেকে কাগজটা বের করলো। যাতে হার আর কানেরটা মোড়া ছিল। দেখলো বিমল ঘোষাল বলে একজনের নাম লেখা। তাতে বাড়ির ঠিকানাও লেখা নদীয়ার কৃষ্ণনগরের কাছে। ঘন্টা খানেক পরে ড্রাইভার ফিরে এলো সঙ্গে একটি লোক। দেখতে ভারি অদ্ভুত। প্রথম দর্শনেই ভয় লাগে। ঝাঁকড়া উসকোখুসকো চুল, বড়ো বড় চোখ, চোখগুলো লাল, মুখে হাল্কা দাড়ি… লোকটা দেখে শেফালি গোবিন্দর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।

-“তো কোথায় ছাড়তে হবে”

– “ন… ন… দিয়া” গোবিন্দ উত্তর করলো।

– পুরো পঞ্চাশ টাকা লাগবে

ড্রাইভারটা লোকটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলতে লোকটা ওকে অনুসরণ করতে বললো। গোবিন্দ আর শেফালি রোবটের মতো বিনা প্রশ্নে লোকটার পিছু নিতে লাগলো। এদিকে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। মিনিট পঁয়তাল্লিশ মতো হাঁটার পর একটা জায়গায় দাঁড়ালো। তারপর লোকটা বললো, “তোমাদের কাছে যা আছে দাও” চমকে উঠলো গোবিন্দ। “আরে ভয়ের কিছু নেই। জাকির আমার দোস্ত আছে”

-জাকির?

-যার সঙ্গে এলে তার নাম জানো না?

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো গোবিন্দ। তারপর পকেট থেকে চেন আর আঙটি বের করে দিল। লোকটা হাতের তালুতে রেখে উপর নীচু করতে করতে বোঝার চেষ্টা করলো ওজন কত হতে পারে। তারপর বললো, “এক ভরি হবে বলে মনে হচ্ছে না”। তখনও ছেলে মেয়েদুটো চুপচাপ। লোকটি বললো, “এখন ভরিতে একশো আশি মত চলছে। দেড়শো রাখো। এখানে যে বাসটায় চাপিয়ে দেবো সেটা যেখানে থামবে সেখান থেকে কৃষ্ণনগরের বাস পেয়ে যাবে। আর দাঁড়াও এখনি আসছি”। বলে লোকটা চলে গেল। কিছু পরে এলো। হাতে দুটো রুটি আর একটা পাত্রে জল নিয়ে হাজির। গোবিন্দর হাতে দিয়ে বললো, “পাঁচ পয়সা দাও”। লোকটার দেওয়া টাকা থেকেই একটা পাঁচ পয়সা বের করে দিলো। লোকটা নিয়ে বললো, “এই তো। বেশ শিখে গেছো। খুচরোগুলো বাইরে রেখে নোটগুলো ভেতরের পকেটে রাখো। আর বৌমা! দেখো যা হবার তা তো হয়েছে। তোমাকেই এখন ভায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে”। শেফালি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটাকে দেখে এতক্ষণ ভয় লাগছিলো। ‘বৌমা’ ডাকটায় ভালো লাগলো। লোকটা বললো, “চলো, বাস স্ট্যান্ড যেতে আরও কিছুটা হাঁটতে হবে”। হাঁটতে হাঁটতে লোকটা বলতে লাগলো, “তোমরা জাকিরের খাস লোক বলে তো অনেক ভালো। ও দেশ থেকে পিলে পিলে যা আসছে সবাইকে তো ওই শিবিরে পাঠাচ্ছি। মাথা পিছু দশ টাকা। টাকা না থাকে তো যা আছে তাই দাও। জিন্না টাকা জাকির ভাঙিয়ে দেয়”। গোবিন্দ কিছুটা চমকে উঠে প্রশ্ন করলো, “জাকির ভাই কী করেন”?

-আগে তো তোমাদের মাস্টারের গাড়ি চালাতো। এখন বর্ডার পার করায়। এটায় ভালো কমিশন আছে। তাছাড়া মানুষের উপকার-ও হচ্ছে। তোমরাই বা ওদেশে থেকে কি করবে ওই খুনোখুনির মধ্যে থেকে”। গোবিন্দর খুব ইচ্ছা করছিলো লোকটার নাম জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু পারলো না। লাখ লাখ কোটি কোটি হিন্দুর ক্রাইসিসকে কাজে লাগিয়ে কত মানুষ তার করে খাবার রাস্তা বানাচ্ছে। কাদের শেখদের দখলে গোবিন্দদের বাড়ি জমি। শেষ সম্বলটুকুও ছিনিয়ে নিচ্ছে জাকিরের দলবল তাও আবার উপকারের নামে। এসব ভাবতে ভাবতে জঙ্গলের ভতর দিয়ে লোকটাকে অনুসরণ করে হেঁটে চললো।

“তোমরা কিন্তু ইন্ডিয়ায় ঢুকে গেছো”। লোকটার কথাতে টনক নড়লো। অবাক দৃষ্টিতে চারপাশ তাকিয়ে দেখলো গোবিন্দ আর শেফালি। ওদের দেশের মতোই তো। তবে নতুন দেশ কেনো বলছে। আরও খানিকটা এগোতেই পাকা রাস্তা। লোকটা বললো, “এখানেই দাঁড়াও। গেদে যাওয়ার বাস আসবে তাতে চেপে পড়বে। মিনিট কুড়ি লাগবে। সেখান থেকে কৃষ্ণনগরের বাস পেয়ে যাবে। দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাবে”।

১১

তিন্নি, ঝিলিককে একটা ঘর খুলে দিলো বন্যা। বাড়িটা পুরনো আমলের। কিন্তু নতুন করে সাজানো যে হয়েছে তার ছাপ স্পষ্ট। তিন্নির খুব ইচ্ছা করছিল বাড়িটা ঘুরে দেখতে কিন্তু বলতে পারলো না। বন্যা বললো, “ঐ যে বাথরুম। নাও ফ্রেশ হয়ে নাও” সেসময়ই বন্যার মা সাবিনা ঘরে ঢুকলো হাতে সরবতের গ্লাস নিয়ে। “পানিটা আগে খেয়ে নাও। সেই কখন বেরিয়েছো। শুকিয়ে গেছো একেবারে। বনি, তুইও যা ফ্রেশ হয়ে নে আমি নাস্তা রেডি করে ফেলেছি”। তিন্নি ব্যাগ থেকে তোয়ালে আর জামা বের করে বাথরুমে চলে গেলো। ঝিলিক সরবতের গ্লাস নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। আনমনা হয়ে চারিদিক তাকিয়ে ঢাকায় নামা মাত্রই দুটো সিমকার্ড দুজনকে দিয়েছিলো বন্যার বাবা। বলেছিলো, “রিচার্জ করা আছে। ফোনে লাগিয়ে নাও”। মানুষগুলোকে তো দেখে বড্ড ভালো মানুষ মনে হচ্ছে। আবার কেমন যেন সন্দেহ-ও হচ্ছে। আজ যে নলশোধার বাড়িতে ওরা আপ্যায়ন পাচ্ছে খুব বেশি তো হয়নি মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে এই বাড়িতে রক্ত গঙ্গা বয়ে গেছে। যার পূর্বমানুষদের হত্যা করা হয়েছে তাদেরই উত্তরমানুষ এসেছে, হত্যাকারীর উত্তরমানুষ আপ্যায়ন করছে। বড়ো অদ্ভুত লাগছে ঝিলিকে।

তবে হিসেব মতো এবাড়ির সঙ্গে তিন্নির রক্তের যোগ নেই। তিন্নির মা শেফালির সন্তান হলেও গোবিন্দর বা কাদের শেখের নয়। শেফালি কখনো শয়তানটার নাম বলেনি। গোবিন্দ কেবল জানতো কাদের শেখের লোকজন। কিন্তু কখনো প্রশ্ন করেনি। কৃষ্ণ কি যশোদার সন্তান নয়? ছায়াও তেমনি গোবিন্দরই সন্তান।

-যা স্নান করে আয়।

-তোর হয়ে গেল?

-হ্যাঁ রে।

ঝিলিক জামা কাপড় নিয়ে চলে গেল। তিন্নি ঘরটার চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ওর খালি মনে হতে লাগলো এটা বড় দাদুর ঘর। মানে গোবিন্দর দাদার ঘর। তবে বাথরুমটা নতুন সংযোজন হয়েছে। এমন সময় বন্যা এলো।

-“কাল ঢাকা যাবে”?

– না কেনো? এই তো ঢাকা থেকে এলাম।

– চলোনা কেনাকাটা করার ছিলো কিছু। আর আমার একটা ক্লাস-ও আছে।

– আসলে গ্রামটা ঘোরার ইচ্ছা ছিলো…

– আচ্ছা বেশ। তাহলে কাল তো আমকে যেতেই হবে। তোমরা বরং আম্মুর সঙ্গে যেও।

ঝিলিক বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। -কোথায় যাবি রে?

-আরে এমনিই এই গ্রামটা ঘুরব তাই বলছিলাম।

– আচ্ছা চলো চলো। আম্মু বললো আর নাস্তা করে কাজ নেই। রাত হয়েছে। একেবারে রাতের খাবার খেয়ে নেবে চলো।

বন্যার সঙ্গে তিন্নি আর ঝিলিক খাবার ঘরে গেলো।

সবকিছু ঝিলিকের বড্ড চেনা। ওই তো দালানে সেই চেয়ারটা যেটায় গা এলিয়ে শুয়ে থাকতো তিন্নির দাদুর বাবা। তিন্নি তাকিয়ে রইলো খানিক।

“আম্মু দাদি খেয়েছে”?

“হ্যাঁ। আমি খাইয়ে এসেছি”।

“দাদি মানে”? প্রশ্ন করে উঠলো তিন্নি।

“দাদি মানে দাদি। আব্বুর মা”। উত্তর দিলো বন্যা।

“দাদির কথা আগে তো বলোনি”

“হ্যাঁ। দাদি খুব অসুস্থ। কথাও বলতে পারে না। কাল দাদির সঙ্গে দেখা করাবো”।

সাবিনা কত কিছু রান্না করেছে তা গুণে শেষ করা যাবে না। কিন্তু তিন্নি ঠিকমতো খেতে পারলো না। বারবার মনে হতে লাগলো দাদির কথা কেনো বলেনি। মনের মধ্যে খচখচানি নিয়ে শুতে গেলো ঠিকই কিন্তু সারাদিনের ধকলে ঘুম এলো অনায়াসেই।

১২

বাস এসে কৃষ্ণনগর পৌঁছালো। গোবিন্দ নেমে একটা দোকানে জিজ্ঞেস করলো হলধর মুখার্জীর বাড়ির রাস্তা। একজন দেখিয়ে দিতে ওরা সেই মতো হাজির হলো। পেল্লাই একটা বাড়ি। একদম নতুন বলে মনে হচ্ছে। চারদিক ঘেরা, মাঝে মোটা গ্রিলের দরজা, পাথর বিছানো পথ পেরিয়ে বাড়িটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার সামনে অপ্রস্তুতের মতো দাঁড়িয়ে রইলো শেফালি আর গোবিন্দ। এতক্ষণে শেফালি মুখ খুললো, “তোমাদের বাড়িটা এরচেয়ে বড়ো”।

-সে এক কোনো জন্মে ছিলো।

-সব ঝামেলা মিটলে ফিরে যাওয়া যাবে না?

-যাবে হয়ত…

আবার স্তব্ধতায় কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। ওদের পেছনে কখন একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো ওরা বুঝতেই পারে নি।

“অ্যাই তোমরা কারা?” পেছন থেকে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো কেউ।

“আমরা মানে… হলধর বাবুর কাছে এসেছি” ইতস্তত করে গোবিন্দ বললো।

লোকটি আপাদমস্তক দেখে বললো, “বলো। আমিই হলধর মুর্খাজি”

গোবিন্দ প্রণাম করলো, শেফালিকেও করতে বলে বললো, “নাসের স্যার… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের……”

-আরে তোমরা নাসেরের পরিচিত?

– হ্যাঁ স্যার।

-আচ্ছা ভেতরে চলো।

হলধর বাবু সব কথা শুনে একপ্রকার চোয়াল শক্ত করে বসলেন। বললেন, “সবার প্রতি কর্তব্য করার সাধ্য আমার নেই। তবু যদি একজনের জন্যেও কিছু করতে পারি তাহলে জানবো এজন্মে কিছু পুণ্য সঞ্চয় করেছি। বাড়ির পেছনে একটা ঘর আছে, ড্রাইভারের জন্য করা। কিন্তু তাতে কেউ থাকে না। তোমরা আপাতত থাকো তারপর দেখি কী করা যায়। আপাতত যা লাগবে সবই আছে খালি জামা কাপড় তোমাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে হবে”

গোবিন্দর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। নতুন দেশে এসে এত সহজে মাথা গোঁজার জায়গা পেয়ে যাবে ভেবে নাসের স্যারকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছিলো এমন সময় হলধর বাবু বললেন, “নাসেরকে চিঠি লিখে যদি তোমাদের জায়গা জমিগুলো বেচে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তবে করবে বলে মনে হয় না। ইচ্ছা থাকলে আমার গলায় না ঝুলিয়ে নিয়েই পারতো কিছুদিন তোমাদের আশ্রয় দিতে”। তারপর শেফালির দিকে তাকিয়ে বললো, “তা মা রান্নাবান্না কিছু পারো”?

শেফালি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।

“দেখো আমার গিন্নি তো গত হয়েছেন ওদিকে ছেলে থাকে কলকাতায়। তুমি যদি হেঁসেলটা সামলাতে……”

শেফালি রাজি হয়ে গেল।

“আর গোবিন্দ, আমার বেশ কয়েকটা দোকান আছে তার মধ্যে মুদিখানাটায় একটা বিশ্বস্ত লোক খুব প্রয়োজন যে হিসেব টিসেবগুলো করে দিতে পারবে…”

এই করে গোবিন্দ শেফালির একটা হিল্লে হয়ে গেল। কিন্তু সুখ বেশিদিন ওদের সহ্য হলো না। মাস দুয়েকের মধ্যে শেফালি নিশ্চিত হয়ে গেলো তার গর্ভে বেড়ে উঠছে সন্তান। শেফালি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল কিন্তু পুনরায় মেয়েটা আবার ঝিমিয়ে গেলো। সে এই পাপের সন্তান চায় না। কিন্তু উপায়-ও নেই। গোবিন্দর না আছে অর্থ বল না লোক বল। সে পড়লো মহা সমস্যায়। শেফালি কিছুতেই নিজের যত্ন নেয় না। বারবার একই কথা বলতে থাকে “পাপের রক্ত, পাপের রক্ত…” শেষের দিকটায় যখন ছায়ার জন্মের সময় এলো, শেফালি পুরোপুরি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিলো। গোবিন্দ পড়েছিল মহা সমস্যায়। তবে হলধরবাবু যথাসম্ভব একমাত্র অভিভাবকের মতো পাশে দাঁড়িয়েছিলো। ছায়ার জন্মের দিনই শেফালি দেহ রাখলো। হলধরবাবু ছায়াকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। লোকে তো ছায়াকে গোবিন্দ-র নয় হলধরবাবুর মেয়ে বলেই জানতো।

১৩

পঞ্চমীর সকালে ঘুম থেকে উঠতে তিন্নিদের একটু দেরী হয়ে গেলো। বন্যা বেরিয়ে গেছে তার ক্লাসের জন্য। বন্যার বাবাও চলে গেছে চেম্বারে। সাবিনা রেডি হচ্ছে স্কুলের জন্য।

“এই যে তোমরা উঠে গেছো? বাইরে দুয়ারে যাও বনির দাদি আছে। আমি চা নিয়ে যাচ্ছি”।

“বনির দাদি” বলতেই চমকে উঠলো তিন্নি। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা বয়স্ক মহিলা দাদুর বাবার চেয়ারটায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে। সারাবাড়ি অন্যের দখলে চলে গেছে তিন্নির তাতে রাগ হয়নি চেয়ারটায় একজন আরাম করে বসে আছে এ দৃশ্য যেন তিন্নি সহ্য করতে পারলো না। তিন্নি বন্যার দাদির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বুড়ি এমনভাবে চমকে উঠলো যেনো সে ভূত দেখেছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে লাগলো, পারলো না। চোখগুলো যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো তিন্নি। সাবিনা চা হাতে এসে শাশুড়ির আচরণটাকে অদ্ভুত রকমের স্বাভাবিকভাবে নিলো। বললো,

“আম্মু, বনির বন্ধু এরা। ইন্ডিয়া থেকে এসেছে”। বুড়ির গোঁয়ানি আরও বেড়ে গেলো। তিন্নি ভয় পেয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে ঘরে চলে গেলো। ঝিলিক খানিক বুড়ির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে কিছু বোঝার চেষ্টা করলো। তিন্নি ঘরে চলে যেতেই বুড়ির গোঁয়ানি আরও বেড়ে গেলো। ঝিলিক-ও ঘরে ফিরে গেলো।

সাবিনা ঘরে এসে বললো, “কিছু মনে কোরো না। নতুন মানুষ দেখে অমন করছেন। আম্মুর গল্প পরে তোমাদের কাছে করবো। গ্রাম দেখতে যাবে বলছিলে তো রেডি হয়ে নাও আমার স্কুলে একটা কাজ আছে, রণিকে বলে রেখেছি ও ঘুরিয়ে দেবে তোমাদের”।

-“রণি”? প্রশ্ন করলো তিন্নি।

-তোমাদের চাচুর চেম্বারে কাজ করে। খুব ভালো ছেলে।

গ্রাম কি ঘুরবে তিন্নি। সব যেন ওর চেনা। চেনা চেনা লাগছে ঝিলিকের-ও। দাদুর ডায়েরি আর তিন্নির মুখে দাদুর গল্প অচিরেই তার মনেও একটা ছবি তৈরি হয়েছিল। দিঘির ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা স্নিগ্ধ হাওয়া ওদের আলিঙ্গন করে ছুটে বেড়াতে লাগলো। তিন্নি ঝিলিককে বললো, “ছোট দিদা মনে হয় শেষ এখানেই দাঁড়িয়েছিলো”।

ঝিলিক দিঘির পড়ে ফাঁকা মাঠ চিরে যে আলের মতো রাস্তাটা চলে গেছে তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলো। তিন্নিকে বললো, “রাস্তাটা দেখেছিস” তিন্নিও যেন ধানক্ষেতের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল। পঞ্চাশ বছর আগের এমনি এক আশ্বিনের ঘটনা চোখের সামনে দেখতে পেল।

রণি বললো স্কুলে চলো। তোমরা গেলে তবে তোমাদের নিয়ে চাচি ফিরবে বাড়ি। আজ থেকে তো ছুটিও পড়ে যবে।

“এই গ্রামে পুজো হয়?” প্রশ্ন করলো ঝিলিক

“ওই মাঠের পরে যে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে ওখানে হয়”।

ঝিলিক তিন্নি একে অন্যের মুখের দিকে তাকালো। ওটাই সেই গ্রাম যেখান থেকে তিন্নির দাদু ফিরতে ফিরতে ফেরার হয়েছিল।

কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলো। গ্রামের লোক অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছিলো ওদের। রণি সবাইকে বলতে বলতে গেলো, “বনির বন্ধু। ছুটিতে গ্রাম ঘুরতে এসেছে”।

ওরা গিয়ে দাঁড়ালো মহামায়া স্কুলের সামনে। সামনে দাদুর বাবার মায়ের মূর্তি। দেখেই বুঝলো তিন্নিরা। দাদুর মুখে স্কুলটার গল্প শুনেছিল। বেশ ভালো লাগলো ওদের। ওরা যেতেই হাসি মুখে বেরিয়ে এলো সাবিনা। তারপর বাড়ি।

বাড়ি ফিরে তিন্নির যেটা মনে হলো সেটা হলো বাড়িটাই তো ভালো করে ঘোরা হয়নি। সাবিনাকে বললো, “কাকিমা, আমরা কি একটু ঘরগুলো ঘুরে দেখতে পারি? আর ছাদে যেতে পারি?”

-আচ্ছা, আগে নাস্তা করে নে। তারপর আমি ঘুরে দেখাবো। ঠিকাছে?

তিন্নির সন্দেহ হলো। তবে কি এবাড়িতে ওর একা ঘোরা নিষিদ্ধ বোঝাতে চাইলো। কিছু না বলে ওরা খেয়ে নিলো। সাবিনা দেখাতে শুরু করলো। নিচে তিনটে ঘর আর রান্না ঘর। বাইরে থেকে এলে প্রথম যে ঘরটা পড়ে তাতে সুবহান চেম্বার করে সন্ধ্যায়। তার পাশের একটা ঘর গরমকালে দিনের বেলায় ওটায় থাকে বন্যারা। তারপর রান্নাঘর তারপর সিঁড়ি। সিঁড়ির অন্যপাশে বাথরুম। তার পাশের ঘরটায় থাকে বন্যার দাদি। ঘর লাগোয়া টানা দুয়ারের একপাশে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা অন্য পাশে খাবার টেবিল। উপরেও তিনটে ঘর আর টানা লম্বা দুয়ার। তিনটে ঘরের একটাতে বন্যার মা বাবা, অন্যটায় বন্যা আর বন্যার দাদির ঘরের উপরেরটা অতিথিদের জন্য যেটায় এখন তিন্নিরা আছে। তিন্নি একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললো “দাদির ঘরটায় দাদুর মা বাবা থাকতো”। সাবিনা শুনতে পেল ঠিকই কিন্তু শুনতে না পাওয়ার ভান করে বললো, তোমরা ছাদে যাও আমি দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করি”।

“বাঁচা গেল” ঝিলিক বলে উঠলো।

“আচ্ছা ঝিলিক চিলেকোঠায় ঠাকুর ঘর ছিলো। সেটাকে কী করেছে চল দেখি”

ছাদে উঠতেই ঘরটা চোখে পড়লো। কিন্তু তালা দেওয়া কোনোভাবেই ঘরটাকে দেখার উপায় নেই। ছাদে গিয়ে উত্তর দিক ঘেঁষে তিন্নি আর ঝিলিক বসলো।

“জানিস ঝিলিক, এখানটায় এমন দুপুর বেলাতেই দিদা আর কাজু দিদা বসে গল্প করতো”।

-আচ্ছা শেফালি দিদার বাড়িটা খুঁজে পাওয়া যাবেনা না?

-আরে এ… এটা কেনো মাথায় আসেনি। যাবে তো।

বলেই তিন্নি দৌড়ে গেল ছাদের দক্ষিণ পূব কোণের দিকে। অনুসরণ করলো ঝিলিক। “দাদু তো বলেছিল এখান থেকেই কাজু দিদা শিউলি বলে ডাক দিত আর দিদা ঘর থেকে দৌড়ে ছাতিম গাছের তলায় এসে চিৎকার করে বলতো যাই”।

-কিন্তু এদিকে কোনো ছাতিম গাছ তো দেখছি না।

– পঞ্চাশ বছর আগের কথা। আর কি মেলে?

“কি মিলছে না রে তোদের?” পেছন থেকে বলে উঠলো বন্যার বাবা।

তিন্নি উত্তর করলো, “ছাতিম তলা। এদিকে একটা ছাতিম তলা ছিলো”

-বাপরে তুই তো দেখছি সব জানিস।

-বছর দশেক হলো গাছটা কাটা হয়েছে।

-তার সামনে যে বাড়িটা ছিলো?

-সে বাড়ির কথা কি জানিস?

– পিসি দিদার সই-এর বাড়ি।

– সেসব তো আমার জন্মের আগের কথা। তবে যা শুনেছি দাঙ্গার দিন ওই বাড়ির মেয়েটাকে খুঁজে না পেয়ে বাড়িটাকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

-আচ্ছা কাকু সত্যিই বলোতো দাঙ্গা বলা যায় কি? দাঙ্গা তো দুপক্ষের লড়াইকে বলে। অন্যপক্ষ কি লড়াইয়ের সুযোগ পেয়েছিলো?

-বাদ দে না মা।

– জানো কাকু, যে মেয়েটাকে পাওয়া যায়নি সে-ই আমার দিদা।

-মানে তুই শিউলি মাসির নাতনি?

-হ্যাঁ।

– শিউলি মাসি আর গোবিন্দ মামা বিয়ে করেছিলো? ওদের দেখা হলো কীভাবে?

সবটা বললো তিন্নি। সাবিনা ডাকতে এসে তিন্নির কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল।

তারপর বললো। তখন হিন্দু তাড়িয়েছে, এখন তসলিমাদের তাড়াচ্ছে, ব্লগার মারছে। আমাকেও তো সেদিন শাসিয়ে গেল বনি না পর্দা করলে ওর বিপদ আছে। উঠতে বসতে পোড়া গ্রামে ডাক্তারের নেহাত দরকার তাই বেশি কিছু বলে না।

ঝিলিক জিজ্ঞেস করলো, তোমরা ঢাকায় চলে যাওনা কেনো?

-আম্মুর জন্য। আম্মু যতদিন আছে ততদিন এখানেই থাকব।

-বন্যা কখন আসবে?

-ওর বিকেল হবে। চল খেয়ে নিবি।

-“হ্যাঁ যাই। কাকু যাবে ছাতিম তলাটা যেখানে ছিলো সেখানে নিয়ে”? তিন্নি জিজ্ঞেস করলো।

-আচ্ছা কাল বনির সঙ্গে যাস।

বিকালে বন্যা ফিরলো। সঙ্গে ইয়া বড়ো বড়ো ব্যাগ।

“বললাম সঙ্গে চলো। গেলে না তো। এবার আমার পছন্দের জিনিসই পরবে পুজোয়”

“মানে টা কি”? ঝিলিক, তিন্নি দুজনেই অবাক

“পুজোয় বাড়িতে কেউ এলে তোমারা তো নতুন জামা দাও”

“তাবলে এত নাকি”?

“চারদিনের চারটে তো”।

তিন্নি, ঝিলিক দুজনেই হেসে ফেললো।

পঞ্চমীর রাত থেকে বন্যার দাদির শরীর খুব খারাপ হলো জ্বর। ষষ্ঠীর গোটা দিনটা দাদিকে নিয়েই ব্যস্ততায় কাটলো। সপ্তমীর সকালে অবস্থা খানিক ঠিক হলো। সাবিনা, বন্যা, তিন্নি, ঝিলিক গেলো ঠাকুর দেখতে মাঠের ওপারের গ্রামে। রণি নিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বন্যা বলেছিলো স্কুটিতে ওরা তিনজনে মাঠের রাস্তা দিয়ে চলে যাবে। সাবিনা রাজি হয়নি। তাই ঘুর পথে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।

১৪

মায়ের ঘরে ঢুকলো সুবহান।

“আম্মু আজ শরীর কেমন লাগছে”?

মায়ের চোখের ভাষা ছেলে কী বুঝলো তা কেবল ছেলেই জানে।

পাশে বসে মায়ের হাতটা আলতো করে ধরে বললোও। “আম্মু জানো গোবিন্দ মামা ভারতে চলে গিয়েছিলো। আর শেফালি মাসিও। যে মেয়ে দুটো এসেছে তার মধ্যে একজন ওদের নাতিন। আমি জানি তুমি চিনতে পেরেছো। তাই দেখা মাত্র তুমি অমন করছিলে। তোমার আলমারীতে তোমার আর শিউলি মাসির যে ছবি আছে আমি দেখেছি। পরশু আনতে গিয়ে এয়ারপোর্টে যখন দেখলাম আমিও চমকে উঠেছিলাম তোমারই মতো”।

কাজরি একটা বাচ্চা শিশুর মতো হাঁ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো বাবা তার ছোট মেয়েকে গল্প বলছে। হিসেব মত কাজরির বয়স বেশি নয় ৬৭ বছর হবে খুব জোর। কিন্তু রোগে ভুগে সে আরও বয়স্ক হয়ে গেছে।

“আম্মু ও কেবল তোমার খোঁজেই এসেছে। গোবিন্দ মামার শেষ ইচ্ছাপূরণ করতে এসেছে।

কাজরি অনেক কষ্ট করে বলে উঠলো, “শি শি শি…………” এর বেশি পারলো না।

-হ্যাঁ শিউলি মাসি সেদিন গোবিন্দ মামার সঙ্গে পালাতে পেরেছিলো।

সুবহান ওর মাকে সব বললো যা জেনেছে তিন্নির থেকে। ওরা ফিরলে দেখা করবে? সাপের মতো ফুঁসে উঠলো। মায়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে কিছু বলার সাহস পেলো না সুবহান। বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।

১৫

ঠাকুর তলায় সবে পৌঁছেছে ওরা হঠাৎ ভয়ঙ্কর চিৎকারে কেঁপে উঠলো চারিদিক। যে যেদিকে পারলো ছুটলো। দুমদাম ঘরের দরজা বন্ধ হবার শব্দ। সাবিনা কিছু বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে গাড়ি ছাড়তে বললো। ফেরার রাস্তার দিকে কিছুটা এগোতেই দেখলো কিছু লোক আগুন অস্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসছে। সামনে জন্তুর দল পেছনে হায়নার দল। বাঁদিকের একটা পথ দেখে কোনো মতে গাড়িটা চালিয়ে দিলো রণি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না কিছুদূর গিয়ে রাস্তাটা একটা মাঠের মাঝখানে শেষ হয়েছে।

সাবিনা বললো, ওরা এদিকেও আসবে। গাড়ি রেখে কোথাও একটা লুকাতে হবে। খানিক দূরে সামনে মাঠ, ডানদিকে বিরাট দিঘি, বাঁদিকে একটা বাড়ি সঙ্গে গোয়াল চালা ওরা গিয়ে গোয়ালে আশ্রয় নিলো। ওখান থেকে দেখলো মানুষের মত দেখতে উন্মত্ত জনতা ওদের গাড়িটায় আগুন ধরিয়ে দিলো। সাবিনা কেঁদে উঠলো। তিন্নি, ঝিলিকের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, বন্যা, রনির অবস্থাও তাই। লোকগুলো ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কিন্তু গোয়ালে না ঢুকে বাড়িটায় ঢুকলো কাউকে না পেয়ে ভাঙচুর করে ওদিক থেকে চলে গেলো। আশ্চর্যজনকভাবে মোবাইলে কোনো নেটওয়ার্ক নেই।

সাবিনা বললো, তারমানে পুরোটা প্ল্যান করেই এসেছিল। এরা কাউকে বাঁচতে দেবে না। এখন এখানে থাকাই ভালো। পুলিশ আসুক তারপর মাঠের রাস্তা ধরে ফিরবো।

তিন্নি যেন ৭০সালে ঘটে যাওয়া নলশোধা গ্রামের ঘটনাকে চোখের সামনে দেখতে পেলো। সুমন স্যার সেমিনারে বলেছেন, “পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে পুনরায় পাকিস্তানে যাওয়ার রাস্তা প্রস্তুত হয়েছে”।

পুলিশ এলো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ওরা বেরিয়ে এলো। মণ্ডপের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সকালে এসে যে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়েছিলো তা তছনছ করে দিয়েছে জানোয়ারের দল। প্রতিটা মানুষের চোখে মুখে আতঙ্ক। সাবিনা পুলিশকে তার পরিচয় দিতে পুলিশ পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলো ওদের। রাত তখন দশটা বাজে ওরা বাড়িতে ঢুকলো।

১৬

সারাটা দিন সুবহানের কীভাবে কেটেছে তা কেবল ওরাই জানে। ওদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। টিভিতে খবরে দেখছে বাংলাদেশের নানা মণ্ডপে আক্রমণের খবর। নাটোরের একটা পূজামণ্ডপে গান বাজানো নিয়ে ঝামেলার সূত্রপাত। সেকেন্ডের মধ্যে গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। নিরাপত্তার খাতিরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে প্রশাসন।

অন্যদিকে সুবহানের মা। যার মুখ দিয়ে আজ পর্যন্ত কোন কথা শোনেনি সুবহান। দুপুর থেকে তার শুরু হয়েছে অদ্ভুত গোঁয়ানি আর “মর মর” করে চিৎকার। সন্ধ্যায় অবস্থা এমন তীব্র হয় যে সুবহান বাধ্য হয় ঘুমের ইঞ্জেকশন দিতে।

ইতিমধ্যে ঝিলিকের বাবা দুবার ফোন করেছে…  ওরা ফিরতে যেন ধরে প্রাণ ফিরে পেল সুবহান। ঝিলিকের বাড়িতে, তিন্নির বাড়িতে ফোন করে স্বস্তির শ্বাস নিলো।

সাবিনা আর বন্যা বলতে লাগলো পুরো ঘটনা। ঝিলিক, তিন্নির মুখে কথা নেই। ওরা ওদের ঘরে চলে গেল। কিছু বন্যা খাওয়ার জন্য ডাকতে গেলে ওরা জানায় কিছু খাবেনা।

-বাবাকে বলবো কালকেই ফেরার ব্যবস্থা করতে?

-কালকে বেরোনো কি ঠিক হবে? তাছাড়া এদের গাড়িটাও তো…

-তা ঠিক কালকের মধ্যে সব হবে না। তাহলে পরশু।

– আচ্ছা। কালকের দিনটা যাক। কাকু তো বলছিলো সারা বাংলাদেশের নানা জায়গায় হচ্ছে।

তবু ঝিলিকের মন মানলো না। বাবাকে মেসেজ করলো। ওর বাবা উত্তর করলো, “পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি। এখন বেরোনো ঠিক হবে না। ওখানেই থাক কিছুদিন। আর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার দরকার নেই।”

১৭

অষ্টমীর সকাল হতেই বন্যা দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করলো। ঝিলিক দরজা খুললো। “তোমরা একটু নীচে যাবে গো। দাদি খুব উতলা হয়ে পড়েছে দেখা করার জন্য”।

ঝিলিক, তিন্নি চোখে মুখে জল দিয়ে নেমে গেলো। তিন্নিকে ধরে সুবহান মায়ের পাশে বসালো। কাজরি তিন্নির মুখটা দুহাতে ধরে কী যেন দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বন্যা বললো, “দাদি তোমার শিউলি এখন আমার বন্ধু”। চমকে উঠলো তিন্নি আর ঝিলিক। কাজরি বন্যাকে হাত নেড়ে পাশে বসতে বললো। তেইশ বছরের জীবনে এই প্রথম বন্যাকে কাছে ডাকলো কাজরি। বন্যা দাদির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। স্কুলে পড়া অবধি বন্যা দাদিকে পাথর ছাড়া আর কিছুই ভাবতো না। দুয়ারে ও খেললে দাদি ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিত। সাবিনা খাবার দিয়ে এলে সে দিব্বি খেয়ে নিত। বাড়ির মধ্যে সাবিনাকেই পছন্দ করে কাজরি। এই আচরণগুলো বন্যাকে খুব দুঃখ দিতো।

তখন সে ক্লাস নাইনে পড়ে। সুবহান আর সাবিনা বাড়িতে ছিলো না। বন্যা জল তোলার মটরটা বন্ধ করতে গেলো। কাজরি বসেছিলো দুয়ারেই ওর বাবার চেয়ারে। কোনো এক কারণে সুইচে হাত দেওয়া মাত্রই টেনে ধরলো বন্যাকে। কাজরি মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে বাড়ির মেন সুইচ নামিয়ে দেয়। বন্যা পড়ে যায় এবং জ্ঞান হারায়। কাজরিই তার জ্ঞান ফেরায়। রান্নাঘর থেকে দুধ এনে খাওয়ায়। বন্যা একটু সুস্থ বোধ করলে টেবিলে থাকা বন্যার মোবাইলটা বন্যার হাতে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সেদিন বন্যা তার দাদিকে নতুন করে চিনেছিলো। মা-কে প্রশ্ন করেছিলো, “দাদি কেনো এমন”? বন্যাকে বলেছিলো, “ইকবালতো তোমাকে খুব জ্বালায়? তুমি তো বিরক্ত বোধ করো। মনে করো একদিন ইকবাল আমাদের বাড়ি এসে আমাকে আর তোমার আব্বুকে মেরে দিয়ে এই বাড়ি দখল করে নিলো আর তোমাকে বিয়ে করলো গায়ের জোরে তাহলে তুমি কী করবে?”

-এ আবার কেমন কথা? কি ভয়ানক। হয় ইকবালকে মারবো নয়তো মরবো।

-দাদিও তো বেঁচে আছে লাশের মতো।

তারপর নলশোধার ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে বন্যা জেনেছিলো ৭০ সালে ঘটা ঘটনার কথা। তাই যখন তিন্নির কথা জানতে পারলো ও কেবল ওর দাদির কথা ভেবেই বারবার অনুরোধ জানিয়েছিলো বাংলাদেশ আসার জন্য।

১৮

নবমী, দশমী বন্যাদের বাড়ি আনন্দ উৎসবে ভেসে রইলো। তিন্নি তার মায়ের সঙ্গে দেখা করালো কাজরির ভিডিও কলে। ছায়া বারবার বললো পরের বছর অবশ্যই আসবে। কাজরি অদ্ভুত একটা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। যে তাকানোটা ঝিলিকের একদমই ভালো লাগে না।  অঘটনটা ঘটলো দশমীর রাত্রে। খেয়ে দেয়ে সবাই যখন শুতে চলে গেছে তারপর। একাদশীর দিন সাবিনা চা দিতে গিয়ে দেখলো শাশুড়ির ঘরের দরজা বন্ধ। অনেক ধাক্কাতেও যখন খোলে না। সুবহানকে ডেকে দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করা হলো। দরজা ভাঙতেই চোখে পড়লো কাজরির ঝুলন্ত দেহ। আর বিছানায় একটা চিঠি।

“তোমরা যখন এই চিঠি দেখবে তখন আমি দাদার অনেকটাই কাছে চলে গেছি। অনেক প্রশ্ন বাকি আছে। এতদিন যে অপেক্ষায় বেঁচেছিলাম তা শেষ হয়েছে। আমি রুবিনা বেগম নই। আমি কাজরি। কাজরি বিশ্বাস। তাই আমার এই দেহ পারলে আগুন দেওয়ার ব্যবস্থা কোরো।

তিন্নি, দাদার দিকটা তুমি জানো। আমার দিকটাও তোমার জানা দরকার। সেদিন দিঘির পাড়ে আমি দাঁড়িয়েছিলাম কেবল দাদার জন্য। দাদাও আসছিল। ওরা তখনও ওদিকটায় আসেনি। আমি তো অপেক্ষা করছিলাম। দাদা হয়তো পারতো আমাকে বাঁচাতে, শিউলি নিজেকে বাঁচাতে দাদাকে আটকাল। তুমি আমার দাদার নয় ওই শিউলির নাতিন যখন জানলাম  আমার ভেতরের কালসাপটা ফোঁস করে উঠছিলো বারবার। হাজার হোক তুমি আমার দাদার খবর এনেছো তাই তোমাকে মারতে পারবো না। নিজেই সরে যাচ্ছি। নাহলে তোমার অবস্থা কাদের শেখের পরিবারের সকলের মতোই হতো।

সাবিনা, তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। তোমার শরীরে কাদের শেখের রক্ত নেই। হাজার চেষ্টা করেও তোমার বর আর মেয়েটাকে মারতে পারিনি। যেদিন বনিকে শক লাগলো তারটা আমিই কেটেছিলাম। কিন্তু পারলাম না শেষটা দেখতে। মনে হলো কেবল শেখের নয় বিশ্বাস বাড়ির রক্ত-ও আছে ঐ শরীরে। ভেবেছিলাম সবাইকে শেষ করে এই বাড়ি আগলে পড়ে থাকব দাদার জন্য। আজ আর আক্ষেপ নেই।

আর একটা কথা। তোরঙ্গে আমার মায়ের সব গয়না আছে। তা বেচে যা টাকা হয় মহামায়া স্কুলকে দান কোরো। এ বাড়িটা ছেড়ে চলে যেও”।

১৯

তোরঙ্গ খুলে গয়না তো পাওয়া গেলো সঙ্গে পাওয়া গেলো আর-ও কিছু জিনিস। কারো বুঝতে অসুবিধা হলো না কাদের শেখ, কাদের শেখের মা বাবা, ভাই, বোন, বোনের ছেলের মৃত্যুগুলো কীভাবে হয়েছে। এত কৌশলে প্রতিশোধ নিয়েছে যে কারো মনে হয়নি মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়। দুবছর, তিনবছরের ব্যবধানে একটা করে মৃত্যু ঘটেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিলো সুবহানের পিসির পাঁচবছরের বাচ্চাটার মৃত্যু। মামারবাড়ি ঘুরতে এসেছিলো। ভরা দুপুরে দিঘিতে পড়ে যায়। সন্ধ্যায় বডি ভেসে ওঠে। আজ সবাই বুঝছে কে ঠেলেছিল।

কাজরি যে আদতে হিন্দু একথা নলশোধা গ্রামের কারো অজানা নয়। কিছুজন ঝামেলা করলেও দাহ করতে বিশেষ কিছু অসুবিধা হয়নি।

২০

একাদশীর দিনই ঝিলিক আর তিন্নিকে পুলিশ নিয়ে গেল ঢাকায়। ঝিলিকের বাবা পাঠিয়েছিলো। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার ছিলো তাই আরও চারদিন ওদের থাকতে হলো।

আজ পূর্ণিমার রাত। পুলিশের দুজন ঝিলিক আর তিন্নিকে বাসে তুলে দিয়ে গেলো।

সেদিনও পূর্ণিমা ছিলো। সেদিনও দুটো মানুষ দেশটা ছেড়েছিলো। ফারাক কেবল এটুকু সেদিন দুটো মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিলো আজ দুটো মানুষ ঘরে ফিরছে।

কেউ কথা রাখেনি – সৌভিক সরকার (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

ধুধু তেপান্তরের মাঠ। যেদিকে দুচোখ যায় ,সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু ধূলিকণায় আবৃত ছোট ছোট ঘাসের ‌ঝোপ। এটাই কি তবে পৃথিবীর শেষ প্রান্তর?

 রুক্ষ জনমানবহীন প্রান্তরে নেমে আসছে গোধূলির নরম আলো। হেমন্তকাল । আর কিছুক্ষণ পরে কুয়াশা নেমে আসবে।

 শুধু বহুদূরে ময়ূরাক্ষী নদী তির তির করে বয়ে চলেছে। দৃষ্টি সীমার শেষ প্রান্তে হঠাৎ করে কালো মেঘের আনাগোনা দেখা গেল। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে।

 মেঘ নয় ,পর্বতের মত চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসছে একপাল হাতি ।শীতকালে নদীতে জল কম। তাই পেরোতে সমস্যা হলো না। একের পর এক হাতি সার বেঁধে ছন্দোবদ্ধ ভাবে নদী পার হতে থাকে। মনে হল নদীটি বোধহয় পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে। বদলে এক পাল কালো পর্বত এগিয়ে আসছে।

 প্রত্যেকটা হাতি যুদ্ধ সাজে সজ্জিত। অঙ্কুশ বল্লম তীর-ধনুক নিয়ে যোদ্ধারা প্রস্তুত। তেপান্তরের এক দিক থেকে আরেক দিক পর্যন্ত চলমান কালো পর্বতের সারিতে  ছেয়ে গেছে। ঘনাঘন হাতি বাহিনী এগিয়ে চলেছে ।একমুহুর্তের বিরতি। দ্রিমি দ্রিমি যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। যোদ্ধারা সবাই নিজের নিজের  অস্ত্র শক্ত করে ধরে থাকে। এই উত্তেজনা হাতিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। হেমন্তের পড়ন্ত বেলায় ধর্মচক্র ও দুই হরিণের ছবি সহ রাজকীয় পতাকাটা এক বার নড়ে উঠলো।

গৌড়বঙ্গ রাঢ় বঙ্গাল

 মগধ নরেশ ধর্মপাল।।

 প্রত্যেক যোদ্ধার গলা থেকে বেরিয়ে এলো অমানুষিক জয়ধ্বনি। গৌড়বঙ্গ ও মগধের একচ্ছত্র অধিপতি ধর্মপাল দেব অজেয় বাহিনী নিয়ে আবার যুদ্ধ করতে বেরিয়েছেন। দামামার আওয়াজ ও জয় ধ্বনিতে তেপান্তরের মাঠ আকাশ-বাতাস ধূলিকণা অনুরণিত হতে থাকে।

 চন্দন উঠে বসলো। বেশ কদিন ধরেই ভালমতো ঘুম হচ্ছে না তার। এই স্বপ্ন দেখার রোগটা …অনেক বেলা হয়ে গেছে।

***************************

উঠোনে দাঁত মেজে কুলকুচি করতে করতেই মাইকের শব্দ শুনতে পেল- আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে ডাঙ্গা গ্রামের ছেলে, পাড়ার ছেলে ,এলাকার ভূমিপুত্র, কাজের ছেলে, সুখ-দুঃখের সাথী আপনার-আমার ঘরের ছেলে সুপ্রিয় লাহাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। আগামী দিনে ‘…

পরের কথাগুলো আর খেয়াল করল না সে। ঘরের ছেলে না শুয়োরের বাচ্চা। খিস্তি দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল চন্দন। খিস্তি দেওয়ার কিছু কারণ আছে । গত তিনদিন ধরে চন্দনের জ্যাঠতুতো দাদা সুবল শয্যাশায়ী।

****************************

 পার্টি অফিসে সুবলের গলাটা একটু বেশি চড়ে গেছিল-‘ গত তিন-চার বছর ধরে আমি পতাকা লাগিয়েছি …নেতা মন্ত্রী এলে বাইকে করে এলাকায় ঘুরিয়েছি.. মিছিলে ঝান্ডা ধরেছি আর টিকিট পেল ওই শালা সুপ্রিয়…’

নিতাই ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে দেখলেন। সুবল কে কীভাবে সামলাবেন সেটা ভাবছেন কি?…. মনে হয় না।

-‘ শোন তুই যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিস। দল সেটা অস্বীকার

করছে না। কলিমপূর বুথে তুই হচ্ছিস আমাদের দলের সম্পদ।’

 ‘তাহলে?’

 নিতাই হাসলেন -‘সুবল ,তুই এমএ পাস। শিক্ষিত। কিন্তু.. তাতে কি ?. তুই খুব সরল। সবকিছু সমীকরণ মেনে হয় না। তুই জানিস না !.. ..এখন দল এমন লোককে চায় যে আরও দুটো লোক কে ভয় দেখিয়ে চমকিয়ে দাবিয়ে রাখতে পারবে …’

সুবল এত সহজে মানতে চাইলোনা-‘ নিতাইদা আপনি কিন্তু কথা দিয়েছিলেন।’

‘ দিয়েছিলাম…তাই নাকি? মনে পড়ছে না তো। ‘ নিতাই এককথায় অস্বীকার করলেন। সুবলের শুধু অবাক হতে বাকি ছিল।

-‘এটা কোর কমিটির নির্দেশ। সুপ্রিয় এই বুথের পক্ষে বেস্ট চয়েস। আমি শিওর… আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলছে।’

‘আপনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। ছাগলের আবার আমিষ জ্ঞান।’

‘ মুখ সামলে কথা বলিস…. জানিস আমি…’

সুবল মুখ ভেংচিয়ে ওঠে। নিতাই আগের বার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। ষাট হাজার টাকা খরচ করে মাংস ভাত, মদ খাইয়ে মাত্র বারটা ভোট জোটে।

গণনার দিন সকালে ল্যা ল্যা করতে করতে বিডিও  অফিসে গিয়ে…. বিকালে কলিমপুর হাটে মদের দোকানে ফ্যাকার মত মুখ করে বসে ছিলেন। 

পুরনো দিনের সেই স্মৃতি সুবল খুঁচিয়ে দিতেই নিতাইয়ের মাথা থেকে ভালমন্দের ভেদাভেদ টা কিছুক্ষণের জন্য মুছে গেল।

***********************

অ্যাম্বুলেন্সে করে স্ট্রেচারে শুয়ে সুবল যখন বাড়ি ফিরল, তখন তার মাথায় আটটা স্টিচ, ঘাড়ে ও কনুইতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, মুখ চোখে কালসিটে পড়ে গেছে।

********************************

ডাঙা গ্ৰামের কলিমপুর মৌজা। গ্ৰামের মাঝখান দিয়ে কলকলার খাড়ি চলে গেছে। এককালে আত্রাই নদীর সঙ্গে যোগ ছিল। নৌবাণিজ্যে এই খাড়ির গুরুত্ব ছিল। এখন আর সেযুগ নেই।

শীতকালে খাড়িতে জল থাকে না বললেই চলে। বরং এখন অপঘাতে মরলে খাড়ির ধারে  পুড়িয়ে দেয়া হয়।অন্য সময়ে মদ গাঁজার আসর বসে।

যদিও গ্ৰামে প্রচুর বড় বড় পুকুর রয়েছে। উঁচু উঁচু তালগাছে ঘেরা পুকুরগুলো গ্ৰামের সৌন্দর্য বাড়ালেও এখানকার জনসাধারণ এসব নিয়ে সচেতন নয়।

এই এলাকায় বহু গ্ৰাম রয়েছে। রাজকীয় নাম তাদের। হাতিশাল, ঘোড়াশাল, রাজারানীর ঘাট, মহারানীর ঘাট- নাম শুনলেই বোঝা যায় এককালে এই গ্ৰামগুলোর প্রচুর গুরুত্ব ছিল। আর এখন … শ্মশানের নীরবতা বিরাজ করে এখানে।

দুপুরে পুকুর পাড়ে বসে চন্দন আনমনে ভাবতে থাকে। ভাবতে তাঁর  ভাল লাগে। এদিকে পারতপক্ষে কেউ আসে না। গ্ৰামের নিশ্চিন্ত নিস্তরঙ্গ জীবনধারাকে অনুভব করার চেষ্টা করে সে। মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে যায় মহীন দাদুর কথা।

মহীনদাদুর কথায় প্রত্যেকটি গ্ৰামের নামের পিছনে কোন না কোন গল্প আছে। হাতিশাল গ্ৰামে সত্যিই হাতি থাকত। ঘোড়াশাল গ্ৰামে ঘোড়া, রাজারানীর ঘাটে রাজা রানীরা স্নান করতে আসত।  হ্যা বড় বড় দীঘি পুকুর দেখে মনে হয় এটা সত্যি।

-‘ কোন রাজা দাদু ?’

-:পাল রাজা গো..পাল রাজা।’

 মহীন দাদু ব্যাখ্যা করে। মাৎস্যন্যায়ের পরে গোপালকে প্রজারা সবাই মিলে রাজা হিসেবে নির্বাচন করেছিল। আদতে এই বরেন্দ্রভূমি থেকেই পাল রাজাদের উত্থান। ধীরে ধীরে পাল রাজাদের দাপট বাড়তে থাকে। বরেন্দ্র মগধ রাঢ় বঙাল সমতট কামরূপ – বিভিন্ন দেশে তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। পাল বংশের চূড়ান্ত সমৃদ্ধির যুগে ধর্মপালের নামে ঘরে ঘরে কীর্তন বসত।

দাদুর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। চন্দন অবাক হয়ে শুনতে থাকে, পন্চাশ হাজার  হাতি নিয়ে যখন পাল সৈন্য যুদ্ধে যেত , কুরু পাঞ্চাল হুণ গুর্জর দ্রাবিড় মাথা নিচু করে সম্মান জানাত। পঞ্চগৌড়ের অধিপতি পাল রাজারা কিন্তু বিনয়ের অবতার ছিলেন। বিক্রমশিলা মহাবিহারে ঢুকলে ছাত্ররা রাজা কে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাত না বরং উল্টোটাই ঘটতো।

চন্দন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জ্ঞানী-গুণীদের সম্মান আজকের দিনে…

 দাদু আফসোস করলেন-‘ আগে আমরা পার্টিটা ভালোবেসে করতাম.. খেয়ে না খেয়ে এলাকায় পড়ে থেকেছি…

টাকাপয়সার ব্যাপারে কোনদিন ভাবতাম না।’

-‘ থাক বাবা আর পুরনো পাঁচালী ঘাটবেন না তো। আপনার হাঁটুর বয়সী সব… তারা পার্টি করে দোতলা তিনতলা বানিয়ে ফেলল…’

 চন্দন এর মা ধমকে ওঠে। দাদু চুপ করে গেলেন। চন্দন শুধু মাথা ঘুরিয়ে  একবার দাদু কে,  আরেকবার মাকে দেখে। চন্দনের মায়ের রাগের যথেষ্ট কারণ আছে ।পুরনো দিনের গল্প শুনে তো আর পেট ভরবে না।

সে গজ গজ করতে থাকে -‘আমরাও তো পার্টি করি। মিছিলে যাই । অথচ কি লাভ টা হল ?…না হল ইন্দিরা  আবাসের ঘর না জুটল একশো দিনের কাজ…’

চন্দনের বাবা বলেন-‘ ওরা তো বলল জবকার্ড নাকি ডিলিট হয়ে গেছে। কিছু বলতে গেলে বলে যান বিডিও অফিসে গিয়ে জানান….’

এই ওরা যে কারা চন্দন ভালমতো জানে। পাড়ার ছিচকে নেতা। আর বিডিও অফিসে তো আস্ত একটা চিড়িয়াখানা। কাকে ধরলে কাজ হবে বোঝা মুশকিল।

*******************************

চন্দন লাইব্রেরী থেকে আনা বই খুলে বসলো। মহীসন্তোষ, মহীপাল দীঘি, মাহীনগর- রাজা মহীপালের নামে এতগুলো জায়গার নাম। ধান ভানতে মহীপালের গীত- আজ প্রবাদবাক্যে পরিণত। এতো আর একদিনে হয়নি।

এত বড় সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল এই বরেন্দ্রভূমি। ধল দীঘি,

কাল দীঘি, গড় দীঘি, আলতা দীঘি, মলিয়ান দীঘি – কোন সুদূর অতীতে পাল রাজারা খনন করে গেছেন। আজ আর

লোকে মনে রাখেনি। রাখতেও চায় না।

এই তো সেদিন মাটি খুঁড়তে গিয়ে রাজা রানীর ঘাট থেকে দুটো কষ্টিপাথরের মূর্তি উদ্ধার হল। নেতা, মন্ত্রী ,  মিডিয়া এসে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিল। সবাই বক্তব্য রাখল। সবচেয়ে সেরা বক্তব্য রাখেন পন্চাদা। গ্ৰামে মিউজিয়াম তৈরী করা থেকে শুরু করে আরো অনেক দাবী তুলেছিলেন। লোকেও হাততালি দিয়েছিল। অথচ এই পন্চাদার বাড়িতে সুবল গেছিল, সেদিন….

-‘তুই ঠিকাদারি করবি ?’পঞ্চা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল।

‘ হ্যাঁ দাদা ।’

পঞ্চাদা এলাকার  এক নম্বর ঠিকাদার ছিল।ব্লক মহকুমা ছাড়িয়ে জেলাতে পর্যন্ত টেন্ডারে অংশ নিত ।এখন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে ঢুকেছে ।

-‘তোর পুঁজি কত ?’

-‘এই পাঁচ লাখ ।’

‘পাচ মোটে?… তুই কি ইয়ার্কি মারছিস ?’

সুবল কুকড়ে গেল-‘ দশলাখ পর্যন্ত ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

 জমিটা বিক্রি করেই অবশ্য …মনে মনে হিসাব করে নেয় সুবল। সেইসঙ্গে পাড়ার আরো তিনটে ছেলে ও কিছু দেবে । সব মিলিয়ে দশ লাখ হয়ে যাবে।

পঞ্চাদা মোবাইল বের করে দেখায় -‘এইটা এক্স ইউ বি ৭০০… পনেরো লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট। চায়নাদির বর নান্টুদাকে এবছর প্রেজেন্ট করেছে।’

‘নান্টুদা মানে?’

‘এম এল এর ভাই ।চায়না দিকে তো আর এমনি এমনি

পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি করা হয়নি। রীতিমতো… নান্টুদার পকেট ভরিয়ে দিতে হয়েছে…. শুধু কি পকেট… শুনেছি টিকিট পাওয়ার আগে নান্টুদার সঙ্গে বিছানায় ঢলাঢলি…চায়নাদির যা একখানা শাসালো ফিগার..’ পন্চা চোখ মারল -‘…নান্টুদার আবার দয়ার শরীর… কাউকেই খালি হাতে ফেরান না…চায়নাদির কপাল খুলে গেল।’ পন্চা ব্যাখ্যা করে ।

সুবল বুঝতে পারেনা তার ঠিকাদারির সঙ্গে চায়না, এসইউভি, নান্টু… এসবের কি সম্পর্ক ?

পঞ্চা এবার সত্যিই রেগে যায়-‘ শোন, তোর দ্বারা হবে না। একটা কন্ট্রাক্ট বাগাতে হলে এম এল একে দিতে হবে, তার পিএকে দিতে হবে,সভাপতিকে দিতে হবে, অঞ্চল প্রেসিডেন্টকে দিতে হবে, এরপর সরকারী বাবুদের টেবিলে টেবিলে। তারপর নান্টু দাকেও দিত হবে।’

-‘ কেন? নান্টুদাকে দিতে হবে কেন?’

-‘ওরে গাধা নান্টু দা হলো এলাকার ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি। ওনাকে ভাগা না দিলে এক রাতেই  তোর সব মাল হাপিস হয়ে যাবে।’

সব শুনে সুবল হতাশ হয়ে গেছিল-‘ আমাদের কিছু হবে না রে… বুঝলি কপালটাই খারাপ।’ পুকুর পাড়ে বসে চন্দনকে কথাটা সে বলছিল ।

 তখনো পন্চার কথাগুলো কানের কাছে গুন্ গুন্ করে ভেসে আসছে-‘  দিতে হবে না।… তুই কি  বলিস ? নান্টুকে প্রতিমাসে পঞ্চাশটা ছেলেকে পালতে হয়। তাদের খাওয়া পরা, ভোটের সময় ম্যাগাজিনের যোগান, বাইকের তেল সব কিছুর ব্যবস্থা

রাখতে হয়। কারণ পার্টিটাকে কেউ ভালোবেসে ভোট দেয় না দেয় ভয়ে।… আর এই ভয়টা কে টিকিয়ে রাখতে…’

পুরো ছবিটা পরিষ্কার হতেই সুবল তার পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়।

-‘ চন্দন শুনেছিস পরের মাস থেকে আবার দুয়ারে সরকার শুরু হবে ।’ চন্দন বুঝতে পারলনা দাদার মাথায় আবার কি নতুন মতলব খেলছে।

****************************

ডাঙ্গা হাইস্কুলের লম্বা বারান্দা বরাবর টেবিল চেয়ার পাতা। সরকারি বাবুরা চেয়ারে বসে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। টেবিলের ওপারে একেবারে জনসমুদ্র। দুয়ারে সরকার না দুয়ারে জনতা বোঝা মুশকিল। স্কুলের সামনের মাঠে এত ভিড়। ডাঙ্গাগ্রামে এত লোক কোথা থেকে জুটল। এতসব ভাবার সময় চন্দনের ছিল না।

স্কুলের সামনে আম গাছের নিচে একটা বেঞ্চি পেতে সুবল, নুটু আর চন্দন বসে পড়ল ।

‘ ফর্ম নিয়ে যান দাদা….ফর্ম। কন্যাশ্রী রূপশ্রী স্বাস্থ্য সাথী। প্রত্যেক ফর্ম মাত্র….’

 সুবল থেকে থেকে হাঁক মারতে থাকে ।মুহূর্তের মধ্যেই লাইন করে লোক দাঁড়িয়ে যায়। চন্দনের উপর দায়িত্ব ছিল ফর্ম লিখে দেওয়ার । ফর্ম পিছু দর পন্চাশ টাকা ।

নুটু বলে দিয়েছিল-‘ দেখ চন্দন। প্রচুর লোক হবে। টাইম শর্ট। একটা করে ফর্ম নিবি। টেনে ফিলাপ করে ছেড়ে দিবি। ঠিক হলো না ভুল… অত দেখতে যাবি না।’

‘লোকগুলোকে যে ঠকানো হবে দাদা..’

‘হবে… হবে। আরে ঠিকঠাক ফর্ম ফিল আপ করলেই কি কাজ হবে? সবাই কি সরকারি সুবিধা পাবে?’

-‘ পাবে না?’ চন্দন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

নুটু হেসে যা বলল, চন্দন অবাক হয়ে যায়।

‘ ওরে গাধা …ওরা যত ঘুরে ফিরে আসবে…তত আমাদের লাভ বুঝলি…নে নে হাত চালা।’

চন্দন প্রাণপণে লিখে যায়। ঘন্টা খানেক পরে দুই সিভিক পুলিশ ছুটে আসে-‘ হেই হেই, তোরা সব গুটিয়ে নে। আর বসা যাবে না।’

‘কেন দাদা?’ নুটু জিগ্যেস করল।

-‘ তোরা লোকের কাছে পয়সা নিচ্ছিস।’

এবার সুবল অবাক হয়ে যায়’ বারে… এতদিন ধরে দুয়ারে সরকারে আমরা এভাবেই চালিয়ে আসছি।’

সিভিক পুলিশ এবার খেপে যায়-‘ শোন কেস খাড়া করবি না তো.. উপর থেকে অফিসাররা ভিজিট করতে আসবে… তার আগে কেটে পড়।’

বাধ্য হয়ে সব গুটিয়ে উঠে যেতে হল। সুবলের এই প্ল্যানটাও ফেল হল।

চন্দন নিজের মনে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল।

ভিড়ের মধ্যে তিলধারণের জায়গা নেই। একদিকে চা, আলুকাবলি,চপের দোকান বসেছে। অন্যদিকে সরকারি বাবুদের নাভিশ্বাস উঠছে। চারদিকে ক্যাওম্যাও চলছেই।

এরমধ্যে হঠাৎ একটা টেবিলে চিৎকার উঠল-‘ একি মাসিমা। আপনি তো বার্ধক্য ভাতা পাবেন না। তবু কেন বারবার আসছেন?’

‘ ওসব জানিনা। রেশন ডিলারের বৌ  থেকে পন্চায়েতের বৌ ….সবাই পাচ্ছে। আমি কেন পাব না?’

‘ আরে মাসিমা, আপনার ছেলে তো রেলে সার্ভিস করে। বিডিওর চেয়ে ডবল স্যালারি পায়। তবু,…’

কথা আর শেষ হয় না। বিশাল জনতা যেন টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মার মার কাট কাট শুরু হয়ে যায়। ধাক্বাধাক্বি, হাতাহাতি, ঘুষোঘুষি- কেউ কাউকে চিনতে পারছেনা। এতদিনের চাপা রাগ এবার ফেটে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। গোটা মাঠ জুড়ে শুধু রণক্ষেত্র।

যে কয়টা সিভিক পুলিশ ওখানে ছিল, সব ইউনিফর্ম খুলে লুকিয়ে পড়ল। কে নিয়ন্ত্রণ করবে জনতাকে?

চন্দন প্রথমে ঘাড়ে একটা গুতো খায়… তারপর ধাক্কা খেয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল।

অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে যখন বের করে আনল ঘাড়ে আর কানে মাঝখানে ভীষণ জ্বালা বাম কনুইতে ব্যথা কোন রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুলের পিছনে পুকুরের পাড়ে এসে বসল।

*************************

একদিন রেগেমেগে সে মহিন দাদু কে বলেছিল-‘ দাদু তুমি কেন বারবার পাল রাজাদের কথা বল বুঝতে পারিনা? ইতিহাস বইতে তো চার পাতার বেশি লেখা নেই।’

 মহিন দাদু হাসেন -‘দাদুভাই.… পরে একদিন বুঝবি.. আমরা হলাম গিয়ে পাল রাজার বংশধর… উত্তরাধিকারী….. মহিন পাল…সুবল পাল…. চন্দন পাল …বুঝলি..’

 চন্দন বিশ্বাস করতে পারেনা-‘ এও হতে পারে?’

-‘ হয় হয়… তবে শোন..’

সেদিন মহিন দাদু এক আশ্চর্য কথা বলেছিলেন। কালিন্দ্রী নদীর তীরে পালরাজ তৃতীয় গোপাল ও সামন্ত বিজয় সেন এর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। বহু সামন্ত আগেই পাল রাজের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে যায়।

যুদ্ধের মাঝপথেই গতি প্রকৃতি টের পেয়ে মহাসামন্ত ঐড়দেব তৃতীয় গোপালের সঙ্গে দেখা করেন -‘মহারাজ আপনি এখনই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যান।’

-‘ চলে যাবো ..’নিজের মনে বলে ওঠেন শ্রী মন্মহারাজ পরম ভট্টারক শ্রী গোপাল দেব। যুদ্ধ ছেড়ে চলে যাওয়া  যে মহাপাপ। এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো।

-‘ক্ষমা করবেন মহারাজ ।এই যুদ্ধে আপনি জয়ী হবেন না।‌আর আত্মসমর্পণ করলেই যে শত্রু আপনাকে ছেড়ে দেবে তা কিন্তু নয়। আপনার পুরো পরিবারকে শেষ করে দেবে। বরেন্দ্রভূমি থেকে পালবংশের চিহ্ন মুছে দিতে চায় ওরা।’

জনকভূ বরেন্দ্রভূমি থেকে তাদের মুছে দিতে চায়, যে মাটিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা খেলেছেন বড় হয়েছেন রাজত্ব করেছেন.. সেই পিতৃভূমি বরেন্দ্রে আর তাদের কোন চিহ্ন থাকবে না ।গোপাল দেবের দুই চোখে জল চলে আসে। -‘মহারাজ সময় বেশি নেই ।দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন ।’

‘কিন্তু’- ঐড়দেবের দিকে তাকালেন-‘ মহাসামন্ত পালিয়ে কোথায় যাব বলতে পারেন ? বিজয় সেন যুদ্ধের পরেও খুঁজে বার করবেই…’

‘তারও প্রতিকার ভেবে রেখেছি।’

 পরিকল্পনা শুনে গোপাল দেব মাথা নাড়লেন -‘না এভাবে

মিথ্যাচার করে আপনাকে বিপদে ফেলে পালান …ক্ষাত্র ধর্মের অপমান হবে ।’

ঐড়দেব এবারে জোর করতে বাধ্য হলেন -:এই ছাড়া আর কোন কিছু করার নেই মহারাজ। আপনার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ প্রচারিত হলে  বিজয়সেন আর বরেন্দ্রে  থাকবেন না। মিথিলার নান্যদেবকে আক্রমণ করবেন। সেই সুযোগে আপনি নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবেন।… যুদ্ধের ফলাফল বদলাতে পারবো না আমরা ,কিন্তু আপনি বেঁচে থাকলে যদি ভাগ্যে থাকে …তবে আবার একবার বরেন্দ্রের আকাশে ধর্মচক্র সহ পতাকা উড়বে।’

-‘বেশ ।’গোপাল দেব বিশ্বস্ত মহাসামন্ত কে জড়িয়ে ধরলেন সেই ছিল তাদের শেষ সাক্ষাৎ। ইতিহাস সাক্ষী। যুদ্ধের গতি ঐড়দেব পাল্টাতে পারেননি ।

গোপাল দেব সপরিবারে বহুদূর চলে যাওয়ার পর …

ঔড় দেব চিরাচরিত সর্বতোভদ্র শৈলীতে ব্যূহ সাজিয়ে আক্রমণে মন দিলেন। ধর্মচক্রকে মাঝখানে রেখে সামনে রাখলেন অগ্রবাহিনীকে। দুই পাশে বর্গসৈন্য ও ধানুকীরা। সঙ্গে রইল ঘোড়সওয়ার বিশ্বস্ত ডোম সৈন্যরা। বাদ্যকররা রণবাদ্য বাজাতে বাজাতে এগিয়ে চলল।

 আগে‌ ডোম বাগে ডোম

 ঘোড়া ডোম সাজে

 ঢাক মৃদঙ্গ ঝাঁজর বাজে

 বাজাতে বাজাতে চললো ঢুলি…

……..

 মরণপণ যুদ্ধ হলো। রাজভক্ত ঐড়দেব ক্ষত বিক্ষত শরীরে

যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপর এক অনুগত সামন্ত মিজাং গোপাল দেব ও ঐড়দেবের শ্রাদ্ধ শান্তি করে নিমদিঘিতে প্রশস্তি বসান:

শ্ৰীমদ গোপালদেব স্বেচ্ছায় শরীর ত্যাগ করে স্বৰ্গত হয়েছেন এবং তার পদধূলি মিজং নামে প্রথিত আমি (হায়!) এখনও বেঁচে আছি। পিতৃ আজ্ঞায় (রাজার প্রতি) প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অসীম কৃতজ্ঞাসম্পন্ন ঐড়দেব সেনশত্রুকে একশোটি তীক্ষ্ণ তীর দিয়ে ধ্বংস করে আটজন সহচরসহ রাজার সাথে স্বর্গে গিয়েছেন। যুদ্ধদ্বারা নিজের (জীবিতাবস্থা) অতিক্রম করে চন্দ্ৰকিরণের মতো আমল যশ অর্জনপূর্বক শুভদেবানন্দন (ঐড়দেব) দেবতাগণের মতো ত্ৰিদশ সুন্দরীগণের দৃষ্টি নিয়ে খেলা করছেন। তার (ঐড়দেবের) গীতবাদ্যপ্রিয়, ধর্মধর অমৎসর, গলবস্ত্ৰ, দানশূর সুসংযত বেশ বৈমাত্ৰেয় ভ্ৰাতা শ্ৰীমান ভাবিক যজ্ঞাদি ধর্মকার্য (শ্রাদ্ধ) সম্পাদন করেন। শরশিল্য দ্বারা নিহত বহু প্ৰাণীকে (সৈন্যকে) যে স্থানে দগ্ধ করা হয়েছিল, সেই স্থানে ভাবকাদাসকৃত এই কীর্তি (মন্দির) বিরাজ করছে।…’

গোপাল দেব আর জীবিত নেই… এই খবর শুনে বিজয় সেন তার বাহিনী নিয়ে প্রত্যাশামতোই মিথিলার দিকে অভিযান শুরু করলেন। যদিও পরবর্তীকালে পাল বংশের অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গ মগধ আর অঙ্গরাজ্যে রাজত্ব করলেও পাল বংশের মূল ধারা টি কোথায় হারিয়ে গেল… কেউ বলতে পারেনি। ধীরে ধীরে পাল বংশের উত্তরাধিকারীরা সাধারণ জনসমাজে মিশে যেতে শুরু করল ।তারা ভুলে গেল তাদের অতীত ঐতিহ্য ও গরিমার কথা।  যে যোগীপাল ভোগীপালের গীত

শুনে তারা বড় হল, জানতেই পারলো না সেইসব মহান পুরুষদের রক্ত তাদের গায়ে বইছে।

**********************

স্কুলে শৈলেন বাবু ইতিহাস পড়াতেন। একদিন একা পেয়ে তাকে গল্পচ্ছলে চন্দন জিজ্ঞাসা করেছিল।

তিনি কিছুক্ষণ ভাবেন-‘তাই কি?.. অতীতের একটা দুটো ঘটনাকে পাল্টে দিলেই কি ইতিহাসের গতিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়?… যায়না ।’

চন্দন অবাক হয়ে শুনতে থাকে-‘দ্যাখ, চন্দন আমরা যে ইতিহাস বইতে পড়ি, সোজাসাপ্টা কথায় একটা ন্যারেশন মাত্র। ধারাবিবরণী ।আমরা এ থেকে তথ্য জানতে পারছি কিন্তু ইতিহাসকে বুঝতে পারছিনা।  ইতিহাস শুধুমাত্র রাজা বা যুদ্ধের কথা বলে না। এখানে সমাজ রাজনীতি ধর্ম – সব কিছু জড়িয়ে রয়েছে। আজ নাদের শাহ যুদ্ধে হেরে গেলে কি হতো এই প্রশ্নটা অবান্তর। নাদের শাহ ভারতে আসার বহু আগে থেকেই মোগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়ে গেছিল । মোহাম্মদ ঘোরীর বিরুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহান কে কোন রাজা সাহায্য করেনি । আরে ঘোরী যখন গুজরাট আক্রমণ করেছিল চৌহান তখন মূলরাজকে কেন সাহায্য করেনি? পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদৌলা যদি না হারতো ?….আরে বাবা পলাশীর যুদ্ধের বহু আগে থেকেই বাংলার নবাবী দুর্বল হয়ে পড়েছিল। অপদার্থ হিসেবে সিরাজদৌলা ও শওকত জং একই ক্যাটাগরীর ছিল। না হলে কেউ বৃষ্টির সময় গোলাবারুদ খোলা অবস্থায় রাখে । একটা কমনসেন্স থাকবে না?’

চন্দন কথা বাড়ায়নি। সত্যিই তো… ইতিহাসের গতিমুখ কেউ

পাল্টাতে পারে নি। আর সেটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কোন মানে হয় না। কালিন্দ্রীর যুদ্ধে গোপাল দেব বেঁচে ফিরলেও পালবংশের জয়পতাকা আর কোনদিন বরেন্দ্রের আকাশে ওড়েনি।

চন্দনের ‌খেয়াল হল। কলকলা খাড়ির ধার বরাবর ছোট ছোট বাড়িগুলোতে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। নিস্তরঙ্গ ডাঙ্গা গ্ৰামে আরও একটা নিস্তদ্ধ রাত নামতে চলেছে। পুকুরপাড়ে বসে উলু ও ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পেল সে।

বেলা পড়ে আসছে। একে একে সবাই ঘরে ফিরবে। স্কুলের মাঠে এখন কি অবস্থা? তার আর ইচ্ছা হলনা যে গিয়ে দেখে আসে।

আর বসে সময় নষ্ট করা চলে না। সুবল আর নুটু এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ি চলে গেছে। সেও চুপচাপ পা ফেলে বাড়ির দিকে হাটতে থাকে।

চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানিচ দুখানি চ। ।

‘সুখ আর দুঃখ সময়ের আবর্তে বারবার ফিরে আসে। আজ যে রাজা কাল সে ফকির। এতো হামেশাই হচ্ছে। আজ যে মন্ত্রী কাল সে জেলের আসামি। সাম্রাজ্যের গঠন একদিনে যেমন হয়না,  তেমনি পতনও একদিনে হয়না। দোষটা হল আমাদের যে, ইতিহাস থেকে আমরা কিছুই শিখিনা।’

শৈলেন বাবুর কথাগুলো কানের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

এককালে মে গ্ৰামগুলো গমগম করত, বিশাল হস্তীবাহিনী আর্যাবর্তকে পায়ের নীচে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলত, বরেন্দ্রের আকাশ বাতাস পন্চগৌড়ের অধিপতি পাল রাজার জয়ধ্বনিতে কেঁপে উঠত,…আজ সেখানে সেই বংশের

উত্তরাধিকারীদের সামান্য দুটো পয়সার জন্য নেতাদের দরজায় দরজায় ঘুরে তেল মারতে হচ্ছে।

সত্যিই ভাবা যায় না। চন্দন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কেউ টেরও পেল না … শুধু কলকলা খাড়ির ধারে গ্ৰামের নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি ছাড়া…

চক্র – রৈবতক সেনগুপ্ত (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

রাত্রি এখন তিন প্রহর। নিজ গৃহ প্রাঙ্গণে উৎসুক হয়ে বসে আছেন ত্রিবিক্রম। রত্নগোমীনের আসতে এত দেরী হচ্ছে কেন?

ত্রিবিক্রম দাশ সরস্বতী গঙ্গানগরের প্রসিদ্ধ বৈদ্য। তাঁর পাণ্ডিত্য ও চিকিৎসাদক্ষতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে গঙ্গাল রাজ্য অতিক্রম করে প্রাচী, বৃহত্তর মগধ, কাশী, কোশলে। চরকের টীকা রচনা করার জন্য মহারাজ বিরাটদন্তী তাঁকে সম্প্রতি ‘চরকানন’ উপাধি ও অন্যান্য নানা উপহারে ভূষিত করেছেন। ভিষকগোষ্ঠীতে জল্পনা চলছে, অনতিবিলম্বেই হয়তো ত্রিবিক্রম ‘রাজান্তরঙ্গ’ অর্থাৎ মহারাজের প্রধান বৈদ্য পদে নিযুক্ত হবেন। অন্যান্য ভিষকেরা তাঁকে ঈর্ষা করেন, তবে সম্মান করেন তার থেকে বেশী।

কিন্তু সম্প্রতি ত্রিবিক্রমের মনে একটা অভূতপূর্ব আলোড়ন দেখা দিয়েছে। নিজের পুরাতন দর্শন, নিজের বাহ্যিক আত্মপরিচিতির সঙ্গে একটা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন তিনি। ধ্রুপদী ঘরানায় তাঁর ছাত্রজীবন লালিত। তাঁর গুরু এবং তস্য গুরুর প্রদর্শিত পথে তিনি তাত্ত্বিক গবেষণা ও তত্ত্বপ্রয়োগ করে এসেছেন, তাতে আরোগ্যকর্মে যেমন সাফল্য এসেছে, এসেছে উত্তরাপথের অন্যান্য বৈদ্য সম্প্রদায়ের থেকে প্রশংসাবাণীও। যা আসেনি, তা হল মানসিক সন্তুষ্টি। অনবরত পাঠে মগ্ন ত্রিবিক্রমের মনে হয়, কোথাও গিয়ে যেন একটা আটকে যাচ্ছেন তিনি। নিজের বুদ্ধি, যুক্তিকে নিরপেক্ষভাবে প্রশ্ন করতে করতে দেখছেন অনেক জিজ্ঞাসারই সঠিক উত্তর, ঋজু উত্তর তিনি তাঁর হস্তগত শাস্ত্ররাজিতে পাচ্ছেন না। চরক পড়তে পড়তে তাঁর মনে হয়, অনেক প্রসঙ্গ যেন সেখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চরাচরব্যাপী এই সৃষ্টি এবং তথিমধ্যে এই দেহভাণ্ড – এর গতিপ্রকৃতি, এর অস্তিত্ব, এর কারণ – এইসব অসামান্যভাবে ব্যাখ্যা করেও যেন ঋষিরা অনেক কিছু উহ্য রেখে দিয়েছেন, যেন নীরব ইঙ্গিত করেছেন অনেক কিছুর প্রতি। মাঝে মাঝে ত্রিবিক্রমের মনে হয়, পরবর্তী ঋষিরা আয়ুর্বেদকে একটা নির্দিষ্ট খাতে বওয়াতে গিয়ে বৃহৎত্রয়ীর, বিশেষ করে চরকের একপ্রকার অঙ্গহানি ঘটিয়েছেন। সেইসব নিয়ে প্রশ্ন করতে গেলে সুস্পষ্ট অস্বস্তি লক্ষ্য করেছেন তিনি তাঁর গুরুদের চোখে। যত দিন গেছে, চিকিৎসাশাস্ত্রের মূলধারার পাঠ্যসূচীতে স্বাভাবিক বিবর্তন ও পরিবর্ধনের বদলে নানাপ্রকার অলঙ্ঘ্য সীমাবদ্ধতা চেপে বসেছে – এমনটাই ত্রিবিক্রমের মনে হয়েছে।

অথচ গতানুগতিকতার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে একটু অন্যধারায় গবেষণা কিন্তু অদ্ভুত ফলপ্রসূ হয়েছে। দক্ষিণে রসশাস্ত্রীরা যে বিপ্লব এনেছেন সে সম্পর্কে ভিষকগোষ্ঠীতে প্রাথমিক প্রতিরোধ দেখা গেলেও আজ রাসায়নিক প্রয়োগ সম্বন্ধে সংস্কার ধীরে ধীরে দূরীভূত হচ্ছে। যোগের প্রয়োগবিধিতেও নিষেধাবলী উপেক্ষার সাহস দেখিয়েছেন অনেক পণ্ডিত, যদিও এইজাতীয় পাঠ সম্বন্ধে যাজকমহলে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অতন্দ্র প্রহরায় কাজ করতে হয় স্বাধীনচেতা গবেষকদের। তাই দীর্ঘদিন ধরে বৌদ্ধসাধকদের চর্চিত কিছু তত্ত্ব সম্বন্ধে জানার আগ্রহ থাকলেও প্রকাশ্যে তাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা করার সাহস পাননি ত্রিবিক্রম। অথচ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, অবারিত পরিবেশে বিভিন্ন ধারায় বস্তুমুখী অনুসন্ধান করলে তবেই তাঁর মনের কিছু প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে। কিন্তু ধ্রুপদী ভিষকদের সম্বন্ধে বৌদ্ধতন্ত্রসাধকেরাও অনেকেই বিরূপ, ফলে এ বিষয়ে ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারছিলেন না ত্রিবিক্রম।

অবশেষে তিনি শরণাপন্ন হয়েছেন রত্নগোমীনের। রত্নগোমীন মহাসঙ্ঘিকাবাদী ভিক্ষু, কিন্তু সঙ্ঘের নিয়মবিধি সম্বন্ধে উদাসীন হওয়ায় এবং মহিলাদের সন্ন্যাস সম্বন্ধে কিছু ব্যতিক্রমী মতপ্রকাশ করায় সঙ্ঘের প্রভাবশালী ভিক্ষুদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন তিনি। শোনা যায়, খুব শীঘ্রই সঙ্ঘত্যাগ করে স্বাধীন প্রব্রজ্যা অবলম্বন করবেন তিনি। ত্রিবিক্রম অনুরোধ করায় তাঁকে কিছু গোপন তত্ত্ব ও ব্যাখ্যান জানাতে সম্মত হয়েছেন রত্নগোমীন। কিন্তু প্রকাশ্যে আলোচনায় সম্মিলিত হতে সাহস হয়নি ত্রিবিক্রমের। তাই নিশাচর রত্নগোমীন গভীররাতে ত্রিবিক্রমের কাছে এসে বিমর্শে উপবেশন করবেন এমনই ঠিক হয়েছে। আজ দ্বিতীয় পাঠ।

রত্নগোমীনের অপেক্ষা করতে করতে তারাখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে গতদিনের বাক্যালাপের কথা ভাবছিলেন ত্রিবিক্রম। মুহুর্মুহু প্রশ্ন করছিলেন তাঁকে রত্ন, এবং সেখানে শ্লেষ ও ব্যঙ্গের ভাগ নিতান্ত কম ছিল না। যেমন – “বৌদ্ধদের সম্বন্ধে তোমাদের যে এত অনীহা, জীবক পুনরায় অবতীর্ণ হলে তাঁকেও কি তোমরা উপেক্ষা করতে?”।

ত্রিবিক্রম এ প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে নিশ্চুপ ছিলেন। কারণ বৈদ্যমাত্রেরই সম্মানীয় ভিষক জীবক কুমারভট্ট শুধু যে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন তাই নয়, তাঁর পালক বিম্বিসারই সারস্বতব্রাহ্মণগোষ্ঠীর ভিষকদের পূর্বভারতে কেন্দ্রীভূত করেন। ত্রিবিক্রমের পূর্বপুরুষদের বিম্বিসার তাঁর প্রথমা স্ত্রী-র জন্মভূমি কোশল থেকে মগধে নিয়ে আসেন। ত্রিবিক্রমের ধন্বন্তরি গোত্রীয় মাতুলেরা এসেছিলেন মদ্র থেকে, বিম্বিসারের তৃতীয়া স্ত্রী ক্ষেমার সূত্রে। ফলে বুদ্ধের প্রতি একান্ত অনুগত জৈনরাজা বিম্বিসার এবং বৌদ্ধভিষক জীবক, এই দুজনের প্রতি এই সারস্বত ভিষক গোষ্ঠী কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। এখনও সারস্বত অতীতের প্রতি আবেগতাড়িত হয়ে তাঁরা নামান্তে সরস্বতী যোগ করেন, তা সেই মগধেই থাকুন বা গঙ্গালদেশে। মধ্যদেশে থাকলে প্রতিদ্বন্দ্বী যাজকগোষ্ঠীর প্রাবল্যে তাঁদের নিজস্ব পরিচিতি, নিজস্ব ধ্যানধারণা ক্রমেই যে বিপন্ন হতো সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। বিশেষ করে এই গঙ্গালরাজ্যে ভিষকেরা অনেক নির্বিঘ্নে তাঁদের স্বাধ্যায় ও চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারছেন। 

তারপরে রত্নগোমীন বলেছিলেন “কৃষ্ণযজুর্বেদী বা সামবেদীদের সঙ্গে আমাদের নাহয় আড়াআড়ি সম্পর্ক, কিন্তু তোমাদের এই আমাদের সঙ্গে দেওয়াল তৈরির বিষয়টায় আমি যুক্তি খুঁজে পাই না”। ত্রিবিক্রম বোঝেন, রত্ন বৌদ্ধঘরানার সঙ্গে আয়ুর্বেদের দার্শনিক সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করছেন। মহাযানীরা তাঁদের তত্ত্বের কাঠামো তৈরি করেছেন সাংখ্য থেকে, যে সাংখ্য আবার চরকসংহিতার মূল ভিত্তি। আদি তন্ত্রধর্মকে মেনে চলা সাংখ্যদর্শন ও আদিতম বেদ অথর্বই ধ্রুপদী ভিষকদের অধ্যয়নের ভিত্তি। কিন্তু তন্ত্রবিরোধী একটা ধারা সূত্র ও ব্রাহ্মণ রচয়িতাদের মধ্যে প্রকট হওয়ার পরে সাংখ্য এবং অথর্ববেদ দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্বপ্রথম সঙ্কলিত বেদসংহিতা হওয়া সত্ত্বেও অথর্বের বেদত্ব নিয়ে প্রভাবশালী যাজকগোষ্ঠী প্রশ্ন তুলে মন্ত্রের প্রকৃতি অনুসারে বেদের ত্রিবিধবিভাগে প্রবৃত্ত হয়েছেন, ফলে অথর্বাঙ্গিরসদের ক্ষমতা কমে গিয়ে তাঁদের অনেকেই হয়েছেন দেশান্তরী। অপরপক্ষে সাংখ্যের আদিগ্রন্থগুলিও আজ বিলুপ্ত। ভিষকদের উপর নানা নিষেধবিধি আরোপ করা যাজকেরা সকলেই কৃষ্ণযজুর্বেদী ও সামবেদী। সে তুলনায় বৌদ্ধধর্মে সাংখ্যের, এবং কিছুটা তন্ত্রের প্রতিও বিরোধভাব ছিল কম। ত্রিবিক্রমের জ্ঞাতিত্বসূত্রে এক বৃদ্ধপ্রপিতামহ মোদগল্যায়ণ ছিলেন বুদ্ধের প্রিয় এবং প্রধান শিষ্যদের একজন। ত্রিবিক্রম আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করেন “না আমরা তো বিষ্ণুপূজা করি, দেবীপূজা করি, তোমাদের তো এসব…”। তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রত্ন বলেন “দেবীপূজা আমরাও কেউ কেউ করিনা তোমায় কে বলল?” রত্নের মুখে রহস্যময় হাসি দেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন ত্রিবিক্রম। তবে কি রটনাটা সত্যি? তন্ত্রচর্চায় আনুষ্ঠানিক সম্মতিপ্রাপ্তির পর থেকেই মহাসঙ্ঘিকাপন্থীদের মধ্যে দেবদেবীপূজার গোপন ধারা প্রাবল্য লাভ করছে বলে যে শোনা যায়, রত্ন কি সেদিকেই ইঙ্গিত করছেন?

ফলে ত্রিবিক্রমের আগ্রহটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যাভাষা আর প্রতিপ্রশ্নের শেষে আজকে তত্ত্বব্যাখ্যান শুরু করবেন রত্নগোমীন, সেই আশায় অধীর আগ্রহে বসে রয়েছেন তিনি। কিন্তু রত্নের দেখা নেই।

খটখট একটা শব্দে সহসা সচকিত হয়ে উঠলেন ত্রিবিক্রম। দূরে তাকিয়ে দেখলেন ক্রমে পরিস্ফুট হচ্ছে রত্নগোমীনের অবয়ব। তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন রত্ন, আর তাঁর হাতে কিছু একটা রয়েছে যা থেকে খটখট শব্দটা আসছে। ক্রমে ত্রিবিক্রমের সম্মুখে এসে দণ্ডায়মান হলেন রত্ন। হাতের বস্তুটা তুলে দেখালেন তাঁকে। সেটা একটা দণ্ডযুক্ত কৌটা। ধাতব কৌটার তলদেশ থেকে নির্গত দণ্ডটা ধরে রত্ন যখনই ঘোরাচ্ছেন তখনই কৌটার সঙ্গে দড়ি দিয়ে সংযুক্ত একটি প্রস্তর আঘাত করছে দণ্ডটাকে, আর খটখট শব্দ হচ্ছে। “এই নাও, তোমার জন্য খেলনা এনেছি” – হেসে বলে উঠলেন রত্ন। তাঁর মতো প্রসিদ্ধ বৈদ্যর সঙ্গে পরিহাস করছেন একজন সাধারণ ভিক্ষু? অনেক কষ্টে ক্রোধসম্বরণ করে ত্রিবিক্রম বলে উঠলেন “কি এটা, দয়া করে বলুন”।

একটু চুপ করে থেকে রত্ন বললেন “এটা চক্র”। চক্র? সে তো অন্যরকম দেখতে হয় বলে জানেন ত্রিবিক্রম, তন্ত্রের মঙ্গলচিহ্নস্বরূপ চক্রের ধারণা থেকেই বৌদ্ধরা তাঁদের ধর্মচক্রের রূপ নিয়েছেন। ত্রিবিক্রম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে রত্ন বললেন – “তবে তুমি যে চক্রের কথা ভাবছো, তা নয়। এ হল কালচক্র”। “আমি কি ভাবছি আপনি বুঝলেন কি করে?” – বিস্মিতকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ত্রিবিক্রম। রত্ন বলে উঠলেন – “আগেও ভেবেছো, তাই এখনও ভাবছো, আরও ভাববে”। উফ, আবার সেই সন্ধ্যাভাষা। এবার বিরক্তি বাড়তে লাগল ত্রিবিক্রমের। রাতের ঘুম ছেড়ে তিনি কিছু জানার জন্য বসে আছেন, অথচ এখনও কিছুই নতুন জানা হলো না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন তিনি।

“এই নাও। হাতে নিয়ে দেখো”, বলে কৌটোটা ত্রিবিক্রমের হাতে তুলে দিলেন রত্ন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৌতূহলের বশে সেটাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন ত্রিবিক্রম। কৌটো অংশটার মাঝবরাবর কতগুলি কীলকযুক্ত অংশ তিনটি সারিতে সজ্জিত। প্রতিটি অংশে একটি করে সংখ্যা লেখা রয়েছে। প্রতি সারিতে সঙ্খ্যাগুলি ০ ১ ২ ৩ করে ৯-এ পৌঁছে একটি বেষ্টন সম্পূর্ণ করে।

এরকম কোন বস্তু এর আগে দেখেননি ত্রিবিক্রম। “কি হয় এই সংখ্যাগুলো দিয়ে?” বলতে বলতে অন্যমনস্কভাবে ত্রিবিক্রম তিন সারিতে ০, ৯ আর ৬-এ আঙ্গুল চেপে ধরতেই হঠাত কি যেন একটা হয়ে গেল। ত্রিবিক্রমের মনে হল তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন কোন গহন সুড়ঙ্গে, অবারিত গতিতে। আর্তনাদ করে কিছু আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোথায় কি? একবার মনে হল তিনি শূন্যে ভাসমান, আরেকবার মনে হল তিনি কোন জলপ্রপাতের ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছেন নিচের দিকে। গতিরোধের আরও কিছু উপায় ভাবার আগেই হঠাৎ চারিদিকটা আলোকিত হয়ে উঠল, আর ত্রিবিক্রম দেখলেন তিনি শুয়ে আছেন মাটিতে।

উঠে বসতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ল তাঁর। সম্মুখে সুবিশাল সুনীল জলক্ষেত্র, ঊর্ধে শারদনীল আকাশ, তিনি উপবিষ্ট স্বর্ণময় বালুকায়, আর দুপাশ দিয়ে অর্ধবেষ্টন করে পশ্চাতে বিস্তৃত হয়েছে এক অনুচ্চ বন্ধুর পর্বত।  ত্রিবিক্রম বুঝতে পারলেন তিনি কোন সমুদ্রের ধারে বসে আছেন, সম্ভবতঃ এটা কোন দ্বীপভূমি । মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যে।

“কি দেখছ? সুন্দর, তাই না?” – রত্নগোমীনের কণ্ঠ শুনতে পেলেন ত্রিবিক্রম। কিন্তু তাঁকে দেখতে পেলেন চারিদিকে তাকিয়েও। “আমায় দেখতে পাবে না” – যেন ত্রিবিক্রমের মনের কথা শুনতে পেয়ে উত্তর এল। উপর্যুপরি বিস্ময়ের ধাক্কায় ত্রিবিক্রম তখন বিহ্বল। রত্নের আনা যন্ত্রটি স্পর্শ করে এ কোথায় চলে এলেন তিনি? প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রাথমিক মুগ্ধতা কাটিয়ে এবারে বিচলিত হয়ে উঠলেন ত্রিবিক্রম। এ কি কোনও মায়া? রত্ন কি তাঁকে সম্মোহিত করে কোন কিছু বোঝাতে চাইছেন?

“এখানে সবই কিন্তু সুন্দর নয়, ঐ দেখো দক্ষিণে” রত্নের কথায় ত্রিবিক্রম তাকিয়ে দেখলেন এক ব্যক্তি অদূরে বসে রয়েছে তটভূমিতে। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁপে কেঁপে উঠছেন বারেবারে। ত্রিবিক্রমের মনে হল লোকটি কাঁদছে। তাঁর অনুমানই ঠিক। হঠাত ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে সরবে কেঁদে উঠল লোকটি। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, কিন্তু বর্ণিল অধোবাসটি কেমন অদ্ভুত লাগল ত্রিবিক্রমের। পায়ের পাদুকাটি অনেকটা গঙ্গাল রাজ্যে প্রচলিত চর্মপাদ্যের মত। কে এ? অবয়বে তো বিদেশী বলে মনে হচ্ছে না। এইসময় রত্নের গলা শোনা গেল – “এ তোমার এক ৯৬তম স্তরের উত্তরপুরুষ। এর নাম রমেশ মাদুগলে। শ্রীলঙ্কার অধিবাসী”। অন্যসময় হলে যুক্তিবাদী ত্রিবিক্রম এমন অদ্ভুত কথা হেসে উড়িয়ে দিতেন, কিন্তু যা ঘটছে তাতে তাঁর সে প্রবৃত্তি হল না। ক্ষীণকণ্ঠে বলে উঠলেন “লঙ্কা? মানে লঙ্কাদ্বীপ?”। – “সেই লঙ্কাদ্বীপ নয়, এ হল শ্রীলঙ্কা, যাকে তোমরা সিংহল বলে চেনো”। ত্রিবিক্রম অবাক হয়ে চেয়ে আছেন। আবার রত্নবাণী – “মহারাজ তিষ্যর শাসনকালে ভিষক হিসেবে তোমার অধস্তন অষ্টমস্তরের একজন বঙ্গ থেকে এসেছিলেন সিংহলে। বিজয়সিংহের উত্তরসূরি শাসকেরা জন্মভূমির সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করেন নি, তাই বৈদ্য, শিক্ষক বা শিল্পী তাঁরা নিয়ে আসতেন রাঢ় থেকেই।”।

ভবিষ্যৎদর্শন? এও কি সম্ভব? ত্রিবিক্রম ব্যক্তিটির মুখাবয়বে তাঁর নিজের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন। না কি তিনি সে সাদৃশ্য কল্পনা করছেন? লোকটির কান্না কেমন একটা স্পর্শ করলো তাঁকে। “ও কাঁদছে কেন?” অদৃশ্য রত্নের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন তিনি। “ও এখন সর্বস্বান্ত। শুধু ও নয়, সমগ্র দেশবাসীর একই অবস্থা। শাসক সমুদ্রগভীর ঋণে নিমজ্জিত করেছেন দেশবাসীকে। অপরিণামদর্শী কর্মের ফল ভুগতে হচ্ছে সবাইকে। বহির্বাণিজ্য প্রায় বন্ধের মুখে”।

ঋণ? ত্রিবিক্রমের মনে পড়ে গেল গঙ্গাল রাজ্যের করসুগমের কথা। ত্রিবিক্রমকে অল্প কিছুদিন আগেই ভূমিদান করেছেন তিনি। অসংখ্য কৃষিজমির অধিকারী করসুগম সম্প্রতি সম্পূর্ণভাবে বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেছেন। গঙ্গাল রাজ্যের সুদূরের পিয়াসী বণিকদের সাথে তিনিও যাবেন সমুদ্রযাত্রায়। মহারাজের সঙ্গে শ্রেষ্ঠীদের আলোচনাসভায় তিনি যোগদান করবেন, বলছিলেন করসুগম। বণিক ও উদ্যোগীদের ঋণপ্রদানের যে সুব্যবস্থার জন্য গঙ্গাল রাজ্য বিখ্যাত, তাকে আরও রাজকোষসহায়ক করা যায় কিভাবে সে নিয়েই আলোচনা হবে। তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনের সমৃদ্ধ রাজ্যে বাস করে সুখে কালাতিপাত করছেন, আর তাঁর বংশধরের এই দুর্গতি! বেদনাহত হলেন ত্রিবিক্রম। হঠাত তাঁর কানে এল দূরে বসে থাকা ব্যক্তিটি বাষ্পরুদ্ধ গলায় গাইছে “নমো নমো মাতা”। সে কি কোন দেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করছে? “বলতে পারো। শ্রীলঙ্কা মাতাকে এরা উপাসনাই করে একরকম” – রত্নগোমীনের গলা শোনা গেল। দেশমাতা ! অসাধারণ লাগলো ত্রিবিক্রমের কল্পনাটা । “অহং রাষ্ট্রী, মনে পড়ে? এখানে ভিক্ষুরা দেবীপূজা বন্ধ করেও সন্তানকে মায়ের নাম ভোলাতে পারেনি” – তৃপ্তি ধ্বনিত হল রত্নকণ্ঠে।

হঠাত ত্রিবিক্রমের দেহটা আলোড়িত হয়ে উঠল, চোখে নেমে এল অন্ধকার। তলিয়ে যাওয়ার সেই অনুভূতি আবার। তারপর স্থিরতা এলে ত্রিবিক্রম চেয়ে দেখলেন সমুদ্রের রং গেছে বদলে, নীলের বদলে তাতে সবুজের আভা। একটা কলরব কানে এলো তাঁর। বামদিকে তাকিয়ে দেখলেন অসংখ্য মানুষ জমা হয়েছে তটভূমিতে। অদ্ভুত তাদের বস্ত্র। অগ্রভাগে কয়েকজন অশ্বারোহী। তাদের পশ্চাতে কয়েকজন একটি প্রতিমা বহন করে আসছে স্কন্ধে। প্রতিমাটি কোনও দেবীর, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। দেবীর মাথায় অদ্ভুত এক মুকুট, আর সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত শ্বেত বস্ত্রে। কে এই দেবী? এমন সময় অশ্বারোহীগণ গলা ফাটিয়ে যেন জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল – “কালী ! সেন্ট সারা ! সারা–লা-কালী!”। আর সেই একই রব প্রতিধ্বনিত হল সম্মিলিত জনতার কন্ঠে। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ত্রিবিক্রম শুনে। কালী? এরকম সর্বাঙ্গে বস্ত্র-আচ্ছাদিতা? এরা কি প্রতিমা নিরঞ্জন করতে এসেছে? “না ! নিরঞ্জনের রীতি এঁদের মধ্যে আর নেই, এই বিদেশে এরা আর সেটা ধরে রাখতে পারেনি” – রত্নের কণ্ঠ ধ্বনিত হল। “সিংহল বিদেশ?”। – “হ্যাঁ সিংহলও বিদেশ হয়ে যাবে বটে, কিন্তু এখন তুমি সিংহলে নেই। তুমি এখন গলদেশের সমুদ্রতটে। আর ঐ যে সামনে লম্বা অশ্বারোহীকে দেখছ, ও তোমার ৮৬তম স্তরের বংশধর, নাম সেবাস্তিয়েন মোদিগিলানি”। আবার হতবাক হবার পালা ত্রিবিক্রমের। গলদেশের নাম তিনি গন্ধবণিকদের কাছে শুনেছেন। সে বহুদূর, সাতসাগর পেরিয়ে যেতে হয়। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে সিংহল থেকে সেখানে না হয় মায়াবলে রত্নগোমীন নিয়ে এসেছেন, কিন্তু তাঁর বংশধর এখানে এসে পৌঁছল কোন মায়াবলে? সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এল রত্নের – “তোমার জন্মের প্রায় হাজার বছর পর বহিরাগত এক দুর্বৃত্ত পারস্য থেকে এসে ধংসলীলা চালাবে বঙ্গসহ সমগ্র উত্তরাপথ জুড়ে। ফেরার সময় সে বন্দী করে নিয়ে যাবে বহু যোদ্ধা, সঙ্গীতজ্ঞ, কারিগর, শিল্পীদের। তোমার বংশের এক বৈদ্যকেও সে নিয়ে যাবে। স্বাধীনতাহীন দুর্বিষহ জীবন কাটাবে তারা দীর্ঘদিন সেই পরভূমে। তারপরে সেই শাসকের মৃত্যু হতেই দলে দলে তারা পালাতে থাকবে। পূর্বদিকে ভারতের আগে পর্যন্ত দুরতিক্রম্য বর্বররাজত্ব, তাই দেশে না ফিরে নতুন জীবনের আশায় তারা পশ্চিমে অগ্রসর হবে। ছদ্মবেশে, মিশরীয় বলে পরিচয় দিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়বে পশ্চিমা ভূখণ্ডের নানা দেশে। শ্বেতকায়েরা এই শ্যামবর্ণ আগন্তুকদের কোনওদিনই সমাজে স্থান দেবে না, তাই ভ্রাম্যমান জীবনেই শান্তি খুঁজে বেড়াবে এরা। উত্তরাপথের চলিত ভাষায় এরা নিজেদের ‘রমতা’ বলে ডাকে। শ্বেতজাতি সেটাকে বলবে ‘রোমা’ বা ‘রোমানি’। পরিবর্তন আসবে ভাষায়, পরিবর্তন আসবে পরিচ্ছদে। নানা জাতির সমন্বয়ে গঠিত এই যাযাবরদের শিকড়ে সংযুক্ত রাখার কাজ করবে তোমার সেই বংশধরের উত্তরপুরুষেরা। বংশপরম্পরায় তারা ধর্ম, ভাষা, চিকিৎসা, জ্যোতিষ শিক্ষা দেবে এদের। তাই বহিরঙ্গে নানা পরিবর্তন এলেও এদের ভাষায় এখনও তুমি তোমার ভাষাকে আবিষ্কার করতে পারবে। গলদেশের যাজকদের চোখে ধুলো দিয়ে এরা এক দেবালয়ে পরিবর্তিত রূপে প্রতিষ্ঠিত করে মা কালীকে, স্বাভাবিকভাবেই মায়ের দিগম্বরী রূপ তাদের আচ্ছাদিত করতে হয়েছিল। বছরের এই নির্দিষ্ট সময়ে এদের যে যেখানেই থাকুক না কেন, এসে জড়ো হয় মায়ের থানে। গানবাজনা উৎসব আনন্দ করে, প্রতিমা বিসর্জনের আদিম স্মৃতি উদযাপন করে সবাই মিলে দেবীমূর্তিকে সমুদ্রতীরে নিয়ে এসে। কিন্তু নিরঞ্জন না দিয়ে প্রতিমাকে জলে অর্ধনিমজ্জিত করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় মন্দিরে। মায়ের কাছে এসে এরা সংগ্রহ করে সারা বছরের বেঁচে থাকার, অন্যায় অত্যাচার সহ্য করার শক্তি। তাই হাজার চেষ্টা করেও এই যাযাবরদের দমিয়ে রাখতে পারবে না শ্বেত বর্বরেরা।”

শ্বাসরুদ্ধ করে রত্নের কথা শুনছিলেন ত্রিবিক্রম। এমন সময় তাঁর কানে এলো জনতা ফিরে যাচ্ছে। তাদের চার পাঁচ জন বীণার মত কি একটা বাদ্যযন্ত্র হাতে নিয়ে গান গাইছে। একটা কলি বারেবারে শোনা গেল – “গেলেম গেলেম, ই বড়ো থান”। ত্রিবিক্রমের মনে হল গঙ্গাল রাজ্যের কোন অন্তেবাসীর ভাষায় যেন তারা গান গাইছে।

হঠাত আবার সেই ঝাঁকুনি। চোখ বুজে রইলেন ত্রিবিক্রম, তাতে কষ্টটা কম হচ্ছে।  ঝাঁকুনি থামলে দেখলেন সমুদ্র আবার নীল। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, অনেকগুলো নারকেল গাছ গজিয়ে উঠেছে সমুদ্রতীরে, হয়তো রত্নেরই মায়াবলে। “আবার তুমি ফিরে এলে ভারতে, তবে পশ্চিমদিকে।” – রত্নের বাণী কানে এল – “এই তীরভূমির নাম রামবোল, রাম নামে তোমার এক বংশধরের নামে। গোকর্ণের নাম শুনে থাকবে হয়তো, তারই কাছে। তোমার জন্মের ১২০০ বছর পর পুণ্ড্র ও বঙ্গে পাল-নামান্তের এক রাজবংশের শাসনে সেনাবাহিনীর এক অভিযানে বৈদ্য ও সেনাপতি হয়ে অনেক ভিষকবংশীয় গোকর্ণে আসবে। তাদের একাংশ এখানেই থেকে যাবে, রাম তাদের নেতা। কিন্তু মাতৃভূমি থেকে বিচ্যুত হয়েও তারা বিশেষ বদলাবে না খাদ্যাভাস বা ভাষা।”। ত্রিবিক্রম সকৌতুকে বলে উঠলেন – “আমার বংশের বিস্তার দেখছি প্রায় ত্রিভুবন। তা এদের এখন নাম কি শুনি?” – “পরিচয় বদলায়নি। গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ। গঙ্গাল রাজ্যের পশ্চিম অংশের পরে নাম হয় গৌড়। দক্ষিণদিকে তাকিয়ে দেখ, বেশও অপরিবর্তিত”।

চমৎকৃত ত্রিবিক্রম দেখলেন, জলে ডুব দিয়ে সূর্যপ্রণাম করছে এক ব্যক্তি। গোলগাল, গৌরবর্ণ, মাথায় টাক। পরিধানে রঙিন পট্টবস্ত্র, উপবীত আর উত্তরীয়। রত্ন বলে উঠলেন – “ও তোমার ৭৮তম স্তরের উত্তরপুরুষ, রামের প্রত্যক্ষ বংশধর । নাম মঞ্জেশ্বর পাই বৈদ্য। আজ শান্তাদুর্গা মন্দিরে বিশেষ পূজা আছে। তারই জন্য অবগাহনে এসেছে। পূজার শেষে ভাতের সঙ্গে বিশেষ পুইশাকের ব্যঞ্জন আর মৎস্যভক্ষণের সমারোহ। তাই পেটুক মঞ্জেশ্বরের এত তাড়া।” লোকটি জল থেকে উঠে আসছে, এমন সময় আরেকটি লোক, সম্ভবতঃ মৎস্যজীবী তার কাছে গিয়ে বলে উঠল “বামোন! কোসো আসো? মাসোলি?”। লোকটি মৎস্যজীবীর হাতে ধরা ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল “আইজ বাইর খাবচো না”। ত্রিবিক্রম বুঝলেন আজ মঞ্জেশ্বর বাইরের মাছ খাবে না। রত্ন বললেন – “এই আমিষভক্ষণের জন্য এখানকার অন্যান্য ব্রাহ্মণরা বহুভাবে অপদস্থ করবে এদের। কিন্তু এরা ধর্মচ্যুত হবে না। দুর্গাপূজা আর প্রচলিত জীবনরীতি দুইই সংরক্ষণ করবে প্রাণপনে। ঐ দেখো ও মাথায় হলুদ উষ্ণীষ বাঁধছে, তোমরা উৎসবের সময় যেমন বাঁধো”।

“আচ্ছা, ঐ পাহাড়ে উঠবো না? তখন থেকে তো সমুদ্রতীরেই বিচরণ করাচ্ছেন” – ত্রিবিক্রম বেশ একটা মজা পেয়েছেন এই অভিজ্ঞতায়, তাই ছোট ছেলের মত আব্দারের সুরে বলে উঠলেন। রত্নের প্রত্যুত্তর এলো – “হে হে, সমুদ্রই তো তোমাদের চিরকাল আশ্রয় দেবে। আচ্ছা, চলো”।

সেই ঝাঁকুনির পুনরাবৃত্তি শেষে ত্রিবিক্রম দেখলেন তিনি এক পাহাড়ের গায়ে একটু সমতল স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু সমুদ্র আর দেখতে পেলেন না তিনি। একটা শব্দ শুনে ঘুরে দেখলেন একদিকে একটি মন্দির, আর শোভাযাত্রা করে একদল পার্বত্যজাতীয় ব্যক্তি সিংহাসনে উপবিষ্ট এক রাজাকে নিয়ে আসছে মন্দির অভিমুখে। “তুমি এখন নেপাল মণ্ডলে। ঐ যে সম্মুখে লোহিতবস্ত্র পরিহিত আয়তচক্ষু লোকটি হেঁটে আসছে, ওর নাম অম্বিকাপ্রসাদ কৈরালা। তোমার ৬৮তম স্তরের উত্তরপুরুষ এক চিকিৎসক, নেওয়ার রাজবংশ কর্তৃক তাঁর প্রপিতামহ আনীত হবেন এই ভূমিতে। নেওয়ার বংশের নতুন রাজার আজ অভিষেক। তাই রাজমন্ত্রী অম্বিকাপ্রসাদ রাজাকে নিয়ে আসছেন গড়ীমাতা কালীমন্দিরে। উত্তর হিমালয়ের গোরক্ষজাতি নেপাল অধিকারের পরিকল্পনা করছে দীর্ঘদিন ধরে। নতুন রাজা কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন, তার উপরেই নির্ভর করবে নেওয়ার রাজ্য আর কতদিন এই আগ্রাসী জাতির সঙ্গে যুঝতে পারবে।”

বাতাসের একটা দ্রুত ঝটকা। তারপরেই ত্রিবিক্রম দেখলেন শোভাযাত্রায় যারা ছিল তাদের অবয়ব ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন অস্পষ্টতা কাটলো, দেখা গেল উপস্থিত জনগণের বেশভূষা, মুখশ্রী সব বদলে গিয়েছে। পার্বত্য শোভাযাত্রীদের স্থলে এখন উত্তরাপথের সাধারণ বেশভূষা পরিহিত এক জনতা সম্মিলিতভাবে ধ্বনি তুলছে “শিবকোটনরেশ রাজা কল্যাণ সেন জয়তু”। সম্মুখে প্রহরী পরিবেষ্টিত হয়ে দণ্ডায়মান অপরূপ সম্ভ্রান্ত রূপবান এক রাজপুরুষ। এক পণ্ডিত এসে তাঁর সামনে দাঁড়াতে সেই রাজপুরুষ তাঁর পদস্পর্শ করলেন। “তুমি এখন শিবকোটের রাজধানীতে। ঐ দেখো রাজা কল্যাণ সেন তাঁর মাতুল প্রভাকর দাশ শাস্ত্রীকে প্রণাম করলেন। প্রভাকর তোমার ৬২তম স্তরভুক্ত উত্তরপুরুষ। এই কল্যাণ সেনের পূর্বজেরা সমগ্র পূর্বভারত জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন, ইতিহাসে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তোমার আরেক বংশধর পন্থদাশ হবেন সেই সাম্রাজ্যের প্রধান সেনাপতি, এই প্রভাকর পন্থেরই এক ভ্রাতার বংশজ। কালে বহিরাক্রমণে রাঢ়ে সেনরাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে রাজবংশের এক শাখা গুরু পুরোহিত বৈদ্য পণ্ডিতসহ উত্তরাপথ ধরে ক্রমে চলে আসবেন হিমালয়ের কোলে এই শিবকোটে। প্রাচীন পাঞ্চাল রাজ্যের অন্তর্গত এই শিবকোটে সেনবৈজয়ন্তী হবে উড্ডিয়ান। এরপরে এরা চলে যাবেন সুক্ষেত্র  ও মাণ্ডিতে। প্রতিষ্ঠা করবেন শ্যামাকালী ও আরও অনেক মন্দির।”

ত্রিবিক্রম বললেন “একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। আমার উত্তরপুরুষদের কারুরই ভাষার বিশেষ পরিবর্তন ঘটবেনা। সকলেই দেখলাম বঙ্গভাষারই নানা প্রকারভেদ বলবে। এটা দেখে নিশ্চিন্ত লাগছে, ভাষাই তো জাতির প্রাণ। ভাষা এক থাকলে আর কিছু চিন্তা করার দরকার নেই।” রত্নের কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না। “রত্নগোমীন? রত্ন?” আক্ষরিক অর্থেই হাওয়ায় প্রশ্ন ভাসিয়ে দিলেন ত্রিবিক্রম। সঙ্গে সঙ্গে আবার ঝাঁকুনি, বেশ জোরেই। আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন গঙ্গাল রাজ্যের বৈদ্যরত্ন।

একটি সুমধুর সঙ্গীত কানে আসায় চোখ মেললেন ত্রিবিক্রম। দেখলেন এক আলোকোজ্জ্বল প্রাঙ্গণে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সম্মুখে এক সুউচ্চ তোরণ, তাতে অপরূপ সব কারুকার্য আর নানা দেবদেবীর মূর্তি খোদিত। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি, এত সূক্ষ্ম কাজ ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত গঙ্গাল রাজ্যেও তাঁর চোখে পড়েনি। তোরণদ্বার দিয়ে একসারি লোক বেরিয়ে এল। তারা নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, আর সম্মুখে রয়েছে এক গায়ক, তারই গলার মধুর ধ্বনি একটু আগে শোনা গিয়েছিল। এদের পশ্চাতে বেশ কয়েকজন হেঁটে এগিয়ে এলেন। কেন্দ্রস্থলে যিনি ছিলেন তাঁর দুপাশে দুইজন প্রহরী আর পশ্চাতে একজন ছত্রধারী। শিরোভূষণ দেখেই ত্রিবিক্রম বুঝলেন ইনি কোন রাজা। ধীরপদে রাজন তোরণসম্মুখস্থ প্রাঙ্গনের মধ্যস্থলে এসে দাঁড়ালেন। একজন শ্বেতবস্ত্রপরিহিত ব্রাহ্মণ, সম্ভবতঃ রাজপুরোহিত এসে তাঁর ললাটে একটি টিকা এঁকে দিলেন। এবারে সামনে এগিয়ে এলেন এক পণ্ডিত। তাঁর হাতে একটি গোটানো ভূর্জপত্র। উদাত্ত কণ্ঠে একটি স্তবক পাঠ শুরু করলেন তিনি। ভাষাটা ত্রিবিক্রম ঠিক বুঝতে পারলেন না। বেশ কয়েকটি শব্দ সংস্কৃত, কিন্তু সেগুলি আলঙ্কারিক। মূল ভাষাটি সংস্কৃত নয়, দক্ষিণাপথের এক পণ্ডিতের কাছে একবার এইজাতীয় একটি ভাষা তিনি শুনেছিলেন।

“ঠিকই ধরেছো। ভাষাটির নাম তামিল” – অনেকক্ষণ পর আবার রত্নগোমীনের গলা শোনা গেল – “তুমি এখন মাদুরাইতে। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলে তুমি আমার সৌজন্যে। আজ প্রবল পরাক্রমী পাণ্ড্যরাজা নেডুঞ্জাদাইয়ান জটিল পরন্তক উপস্থিত হয়েছেন মীনাক্ষী মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার উদ্দেশ্যে। প্রশস্তি যিনি পাঠ করছেন, সম্মুখের ঐ পণ্ডিত, উনি গণপতি বজ্রশর্মা বঙ্গলণ্ডৈ। তোমার ৪৮তম স্তরীয় উত্তরপুরুষ।”

একটু বিচিত্র লাগছিল ত্রিবিক্রমের। এতক্ষণ পর্যন্ত যত উত্তরপুরুষ তিনি দেখেছেন সবাইকার ভাষা অল্পবিস্তর তিনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু এই অবোধ্য ভাষায় তাঁর এই বংশধরের পাঠ, যতই ঝংকৃত সুললিত হোক না কেন, কেমন বিজাতীয় লাগছিল। রত্নগোমীন বলে চললেন – “বজ্রশর্মা পাণ্ড্যরাজ্যের বিখ্যাত বৈদ্যকুলসম্ভূত। এর আগেও তাঁর দুই জ্যেষ্ঠতাত পূর্বতন পাণ্ড্যরাজ মারবর্মণ রাজসিংহের মহামন্ত্রী হিসেবে কাজ করবেন। বজ্রশর্মা নিজেও অমাত্য হিসেবে জীবন শুরু করবেন, কিন্তু পাণ্ডিত্যবলে তিনি অচিরেই মহারাজ পরন্তকের ধর্মীয় উপদেষ্টা পদে বৃত হবেন। মীনাক্ষী মন্দিরই দাক্ষিণাত্যের প্রথম মন্দির যা সুন্দরেশ্বর শিবের নামে পরিকল্পিত হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার মুখ্য দেবতা হিসেবে পরিগণিত হবেন মীনাক্ষী আম্মানরূপী দুর্গা। এই সিদ্ধান্ত নিতে মহারাজ পরন্তককে বহু প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হবে, কিন্তু তিনি ও বজ্রশর্মা নিজ প্রত্যয়ে দৃঢ় থাকবেন। বঙ্গলণ্ডৈর এই বৈদ্যকুল বজ্রশর্মার দেড় শতাব্দী আগে বঙ্গদেশ থেকে তামিলদেশে বসতিস্থাপন করবেন। বর্তমানে তামিলভাষী হলেও নিজ আদিভূমির নামেই তাঁরা নিজ অঞ্চলের নামকরণ করবেন বঙ্গলণ্ডৈ। বজ্রশর্মার প্রপিতামহের পিতামহ বঙ্গরাজ শশাঙ্ক কর্তৃক শিব ও নীলাবতীর বিবাহ-উৎসব প্রবর্তনের একজন সাক্ষী। দীর্ঘ চিন্তনের পর বজ্রশর্মা শিব-নীলাবতী বিবাহের অনুকরণে সুন্দরেশ্বর ও মীনাক্ষীর বিবাহের উপাখ্যান রচনা করবেন। এই পদক্ষেপটি না নিলে এই প্রবল শৈবভূমির কেন্দ্রে কোন মাতৃকামন্দির স্থাপন এক অসাধ্য কাজ ছিল।”

ত্রিবিক্রম বিস্ময়াবিষ্ট। তিনি বলে উঠলেন “কি অদ্ভুত ! ভারতভূমের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সর্বত্র আমার বংশ ছড়িয়ে পড়বে, এমনকি দূর গলদেশেও। তাদের পরিচ্ছদ, ভাষা, নামের ধরন, পদবী সবই পরিবর্তনশীল। ভিষক ঐতিহ্য এরা অনেকেই ধরে রাখবে দেখে আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু সেটাও সকলের ক্ষেত্রে বলা যাবে না। তাহলে এদের সঙ্গে আমার যোগসূত্র কি? শুধুই রক্ত?”। “তা কেন?” – রত্নের গলা শোনা গেল পুনরায় – “একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য তোমার চোখে পড়ল না? যেটা এদের সবার ক্ষেত্রেই ধ্রুবক?”

“কি বলুন তো?” ত্রিবিক্রমের কণ্ঠে সংশয়।

– “সারা-লা-কালী, শান্তাদুর্গা, গড়ীমাই কালী, শ্যামাকালী, মীনাক্ষী… বুঝতে পারছো?” রত্নের কথা শুনে ত্রিবিক্রম কি যেন ভাবছেন। গুণগুণ সুরে রত্নকে গাইতে শোনা গেল – “নমো নমো মাতা”। বিদ্যুৎঝলকের মত বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেল ত্রিবিক্রমের।

মাতৃপূজা! বিভিন্ন রূপে মাতৃকা উপাসনা! তাঁর উত্তরপুরুষেরা যেখানেই যাবেন সেখানে মাতৃপূজার ধারা অক্ষুণ্ণ রাখবেন। যেভাবে তাঁরা মেতে ওঠেন দশায়ুধার বন্দনায়, সেই একই ধারা ধ্রুবতারার মতো পথ দেখাবে তাঁর উত্তরপ্রজন্মকে। মায়ের আশীর্বাদে সকলেই তাঁরা স্বমহিমায় ভাস্বর।

রত্নের গলা শোনা গেল – “আর এই ধারায় ছেদ পড়লে কি হবে জানো? দেখো”। আবার সেই ঝোড়ো হাওয়ায় বেসামাল হলেন ত্রিবিক্রম। একটু স্থির হয়ে যে দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল তাতে অন্ধকার হয়ে গেল তাঁর মুখ। চন্দ্রাতপযুক্ত একটি প্রাঙ্গণ। এক বৃদ্ধ সেখানে বসে মাথায় হাত দিয়ে আকুল নয়নে কেঁদে চলেছেন। একটি অল্পবয়স্ক নারী, সেও ক্রন্দনরতা, বৃদ্ধের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বৃদ্ধের বস্ত্র, নারীর শাড়ি সবই ছিন্নকৃত। মাথায় আঘাতের চিহ্ন। প্রাঙ্গণের এক কোণে একটি ভগ্ন দেবীমূর্তি, মুণ্ডহীন। এদিক ওদিক মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে পুষ্পপাত্র, নানা অর্ঘ্য, কোশাকুশী। কেউ যেন আসুরিক তাণ্ডব চালিয়েছে এই প্রাঙ্গণে। শিহরিত হয়ে উঠলেন ত্রিবিক্রম। “এ কি? আমি সহ্য করতে পারছি না! কি হয়েছে এখানে?” আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। রত্ন বলে উঠলেন – “ইনি তোমার ৯৭স্তরীয় উত্তরপুরুষ যতীন দাশশর্মা। তোমাদের এখনকার গঙ্গাল রাজ্যের পূর্বপ্রান্তের ভূখণ্ডে এঁর বাস। শুনলে অবাক হয়ে যাবে, ঐ ভূখণ্ড কিন্তু এই সময় বিদেশ। যতীনের আত্মীয়স্বজন প্রায় সকলেই পশ্চিমদিকে চলে যাবেন। যতীন জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে যেতে পারবেন না, নানা সমস্যাতেও পড়বেন। দরিদ্র যতীন নিজের সারাবছরের সঞ্চয় দিয়ে ভক্তিভরে দুর্গাপূজা শুরু করেছেন। কিন্তু গতবছর থেকে পাড়ার কয়েকজন সদস্য এই পূজা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। দুঃখের কথা তার মধ্যে যতীনের এক ধর্মান্তরিত জ্ঞাতিও রয়েছে। তাঁর বাবা খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু ছেলে গানবাজনা জিনিসটা বিশেষ পছন্দ করে না। দুর্গাপূজা বন্ধ করে নববর্ষের সমারোহে যাতে যতীন তাঁর সব টাকা দিয়ে দেন সেজন্য অনেকদিন ধরে জোরাজুরি করছে তারা। আজই প্রতিমার বোধন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার আগেই একদল দুর্বৃত্ত এসে মণ্ডপে এই ধ্বংসলীলা করে যাওয়ার সময় হত্যার হুমকি দিয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ যতীনের পক্ষে এই ধাক্কা সামলানো মুশকিল”।

“আমাকে ফিরিয়ে আনো, ফিরিয়ে আনো” – মুখে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন ত্রিবিক্রম। রত্নগোমীন কোনও উত্তর দিলেন না। কাঁদতে আরম্ভ করলেন ত্রিবিক্রম, এমন সময় পা পিছলে গেল তাঁর। তাঁর মনে হল তাঁর দেহটা যেন শূন্যে উঠে যাচ্ছে। অনেক ছায়াপথ নক্ষত্ররাজি অতিক্রম করে তিনি আবার ভূপতিত হলেন। চোখ খুলে দেখেন সম্মুখে রত্নগোমীন দণ্ডায়মান। মুখে তাঁর মৃদু হাসি।

“ এ কি মায়া দেখালেন আপনি?” ত্রিবিক্রম বলে উঠলেন।

– “কালচক্রযান। এ এক নতুন সাধনপন্থা। ভিক্ষুরা এই বিষয়টি ধরতে পারেনি। আমি গত দশ বছর ধরে এই মার্গে সাধনা করে আসছি। মাধ্যমিক ধারার দুই প্রাক্তন পণ্ডিত আমাকে এই বিষয়ে পাঠ দিয়েছেন। সময়, তথা কালই আসল নিয়ন্ত্রক। মহাবিশ্ব প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে লয়প্রাপ্ত হচ্ছে। পূর্ব পর – সবই আপেক্ষিক। আসলে সব চক্রাকারে আবর্তিত। কালের গতি উভমুখী।  মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য শুধু এই তত্ত্ব দ্বারাই সমাধান করা সম্ভব। আর মহাবিশ্বের ক্ষুদ্ররূপ এই জীবদেহভাণ্ড, তাও প্রকৃতিমধ্যে কালচক্রে নিয়ন্ত্রিত, অস্তমিত ও পুনরুত্থিত হয়।”

ত্রিবিক্রম বিস্ময়স্তব্ধ হয়ে আছেন দেখে রত্নগোমীন বলে উঠলেন “এসো, সর্বাগ্রে তোমাকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের চতুর্কুল নিয়ে বলি। তুমি ভিষক, প্রাণ ও শরীরের গূঢ়তত্ত্বই তোমার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ”। – “না!” বলে উঠলেন ত্রিবিক্রম। রত্নগোমীন বিরক্ত হয়ে বললেন – “কালচক্রযানের বিষয়াবলীও চক্রাকার। প্রথম অধ্যায় থেকেই শুরু করতে হবে এমন কোন কথা নেই।”

“সে কথা আমি বলছি না” – ধরা গলায় বলে উঠলেন ত্রিবিক্রম – “শেষে ঐ দৃশ্য দেখে আমি বড়ই বিধ্বস্ত বোধ করছি। আমাকে একটু শান্ত হতে সহায়তা করুন। একটু আনন্দের কোন দৃশ্য আমাকে দেখান, আমার উত্তরপুরুষকে উৎফুল্ল দেখে আমি একটু ধাতস্থ হই”। একটু চুপ করে থেকে রত্ন বললেন “আচ্ছা। এই নাও যন্ত্র। ০, ৯, ৯ চিহ্নিত কীলকগুলি সবলে স্পর্শ করো, একসঙ্গে”।

ত্রিবিক্রম তাই করলেন। আবার সেই তলিয়ে যাওয়া, তবে এবারে প্রস্তুত ছিলেন বলে আর অতটা সমস্যায় পড়তে হয়নি তাঁকে। কিছুক্ষণ পরে স্থিরতা এলে চোখ মেলে দেখলেন তিনি এক কক্ষে একটি শয্যায় শুয়ে আছেন। কিন্তু কক্ষ বা শয্যা কোনটাই তাঁর অচেনা লাগলো না।

এমন সময় ঘরে ঢুকল রত্নদীপ। বলে উঠল – “কিরে ভিকি, এখনও শুয়ে আছিস, ঠাকুর দেখতে যাবি না?” বিরক্ত হয়ে উত্তর করলেন তিনি – “ভিকি ভিকি করিস না তো, বিক্রম বল। বিক্রম বললে যে জোশটা ফিল করি তোর ঐ ভিকি শুনে সেটা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।                                 

একটু পরে বিক্রম দাশগুপ্ত আর রত্নদীপ বড়ুয়া সুসজ্জিত হয়ে পাড়ার মণ্ডপে প্রবেশ করলো। ঢুকতেই মন উচ্ছলিত হয়ে উঠলো তাদের। সম্মুখে বিশালাকৃতি মাতৃকামূর্তি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। সেই দশ প্রহরণ ধারণ করে আছেন, শুধু গঙ্গানগরের রীতিতে যেমন চুলের খোঁপায় সেগুলি সজ্জিত হয়, তার পরিবর্তে এখানে দেবীর দশ হস্তে সেগুলি ধৃত। সেই আদি ঐশ্বর্যময়ী মুখ। চার অনুচরও উপস্থিত। পায়ের তলায় যেন শক্ত মাটি ফিরে এল বিক্রমের। চারিপাশের আনন্দোজ্বল মুখগুলো স্পর্শ করছিল তাঁর চিত্ত। ত্রিনয়নী দুর্গার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে প্রণাম করলো বিক্রম। রত্ন দেখলো, মণ্ডপের এক পার্শ্বে কাঠ দিয়ে বানানো একটি চক্র সমানে ঘুরে চলেছে।   

*****

ভারতীয় জাদুঘরে মা দুর্গাকে নিয়ে সাম্প্রতিক প্রদর্শনীঃ একটি আলোচনা – সুমন কুমার ঘোষ (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

এই বছরে (২০২২ সালে) বাঙালির দুর্গাপূজা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃতি পাওয়ায় দুর্গাপূজা নিয়ে কলকাতাস্থিত ভারতীয় জাদুঘর মা দুর্গাকে নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করে। 

প্রদর্শনের উদ্দেশ্য, মা দুর্গাকে নিয়ে ভারতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে যা যা সামগ্রী আছে, যেগুলো সর্বসমক্ষে প্রদর্শিত হয় না, আলমারিতে তালাবদ্ধ অবস্থায় পরে থাকে, সেগুলোকেই প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। এই প্রদর্শনী ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ শুরু হয়েছিল। চলবে ২৩শে অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত। 

বাংলার দুর্গাপূজা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃতি পাবার অনেক আগে থেকেই (২০১৯ সালেরও আগে থেকে) সপ্তডিঙা আন্দোলন বাঙালির সচেতনতা বৃদ্ধিতে একটি কথা সর্বসমক্ষে বারবার বলে আসছিল। সেটা হল, বাঙালির দুর্গাপূজা চার হাজার বছরের পুরানো ও হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে চলে আসছে। ভারতীয় জাদুঘরের এই মা দুর্গাকে নিয়ে প্রদর্শনী সেটারই স্বীকৃতি দিল। হরপ্পা সভ্যতার সময়ের মানুষের মাতৃকা উপাসনার মাতৃমূর্তি এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। অতএব, আমাদের দুর্গাপূজা (মাতৃকাপূজা) যে চার হাজার বছরের পুরানো হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই হয়ে আসছে, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না৷

শুধু তাই নয়। মা দুর্গা যে প্রথমে “মহিষমর্দিনী” ছিল, মানে আগে অসুরের জায়গায় শুধু মহিষ ছিল এবং কালের বিবর্তনে (anthropomorphic বিবর্তন) ধীরে ধীরে মহিষের জায়গায় অসুর চলে এসে আমাদের মা “মহিষাসুরমর্দিনী” হয়েছেন এবং সেটা কোন সময়কাল থেকে হয়েছে সেই ব্যাপারেও পরিস্কার ইঙ্গিত দিয়ে গেছে এই প্রদর্শনী। অর্থাৎ সপ্তডিঙা আন্দোলনের আরো একটি বক্তব্য স্বীকৃতি পেল এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে। সেটা হল, মা দুর্গা “মহিষমর্দিনী” ছিলেন প্রথমে। অসুরের ধারণা তার বহু শতাব্দী পরে এসেছে৷

প্রদর্শনীটির উপস্থাপনাও যে খুব উচ্চমানের গবেষনালব্ধ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রদর্শনীতে শুরুর দিকে একদম হরপ্পা যুগ থেকে শুরু করে আদি যুগ, তারপর মধ্যযুগীয় মাতৃমূর্তি, তারপর আধুনিক যুগের মাতৃমূর্তি হয়ে বর্তমানের মাতৃমূর্তিতে এসে শেষ হয়েছে। মূর্তিগুলি এইভাবে পরপর সাজিয়ে রাখা আছে। প্রতিটি মুর্তির নীচে সেটা কোন সময়কার কিসের মুর্তি পরিস্কার করে লেখা আছে৷

প্রদর্শনীটির সেই উপস্থাপনাই আমি ছবির মাধ্যমে তুলে দিলাম সবার কাছে। চারিদিকে মায়ের নামে জয়ধ্বনি হোক। জয় মা দুর্গা৷

আর একটি বিষয় এখানে পরিস্কার করে দিই। আমি লক্ষ্য করেছি, সাল, তারিখ, শতক, সময়ের হিসাবটা সবাই গুলিয়ে ফেলেন। আগুপিছু বুঝতে পারেন না৷

ছবিতে উল্লেখিত মুর্তিগুলোতে সময়ের হিসাবটা এইভাবে লেখা “Century CE” এটার মানে পড়বেন Century Christian Era বা Century Common Era. মানে খ্রীষ্টজন্মের পরবর্তী শতক। একই ভাবে BCE মানে Before Common Era, মানে খ্রীস্টপূর্ব যুগের ১০০ বছরের মধ্যেকার সময়৷

সাল নির্দিষ্ট করা থাকলে খ্রীষ্টাব্দ উল্লেখ হয়। যেমন আজকের দিনটা ২০২২ ‘খ্রীষ্টাব্দ’। কিন্তু সাল নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা না গেলে একশ বছরের মধ্যেকার একটা সময় ধরে নেওয়া হয়। এভাবে ধরলে বুঝবেন, 1st Century CE মানে 1st Century Common Era, মানে প্রথম খ্রীষ্টীয় শতক। মানে শূন্য থেকে ১০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যেকার সময়টা। একইভাবে 4th Century CE মানে চতুর্থ খ্রীষ্টীয় শতক, মানে ৩০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৪০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেকার সময়। 12th Century CE মানে খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতক, মানে ১১০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দর মধ্যেকার সময়। 19th Century CE মানে খ্রীষ্টীয় উনবিংশ (উনিশ) শতক, মানে ১৮০০ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেকার সময়টা। আশা করি বোঝাতে পারলাম। 

চেষ্টা করেছি মাতৃমূর্তিগুলোর সাথেই তার নীচে লেখা মূর্তিগুলোর বর্ণনা টা একই ফ্রেমে নেবার। ছোটো ছোটো মুর্তিগুলোর ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হলেও বড় মুর্তিগুলোর ছবি নেবার সময় সেটা একই ফ্রেমে তোলা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে আমি আলাদা করে বর্ণনা করা অংশটির ছবি তুলেছি। এই ফটো এলবামে কোনো মাতৃমূর্তির সাথে তার বর্ণনা দেখতে না পেলে তার পরের ছবিটিতেই সেই বর্ণনার ছবিটি জুড়ে দিয়েছি। আশা করি এতে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না মুর্তিগুলো চিনতে৷

এবার দেখা যাক ছবি গুলো৷

ভাগলপুরের বাঙালিটোলার স্মৃতি – জয়ন্ত মুখার্জি (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

স্মৃতি কথা কয়।

বর্ষায় ভেজা দুটো মাসের পর আসে শরত , আর শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে আসে মায়ের আগমনী বার্তা। আমাদের ভাগলপুরের আকাশ টা এবারের বর্ষায় ছিল কঠিন ইস্পাতের মত ধূসর নীল। শ্রাবণ মাসের  আকাশে কালো মেঘ থাকার কথা। আগুনের মতো রোদ বৃষ্টির বদলে ঠাণ্ডা  জলের বড় বড় ফোঁটা ঝড়ে পড়ার কথা। কোথায় কি ! সরকার থেকে শুনেছি রাজ্যে খরা ঘোষণা করেছে। করুক। অনেক শ্রাবণ পার করে এসেছি আমি। আছে অনেক স্মৃতি বৃষ্টি ঝরে পড়ার , যা আমাকে এখনো ভেজায়, শীতল করে। শান্তি দেয়।

                   যখন ছোট ছিলাম, ভাগলপুরে কালী বাড়ির মাঠে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলে যে আনন্দ পেয়েছি, আজকালকার বাচ্চারা স্মার্ট ফোনে পাব্জি খেলে পায় কি? জল কাদায় চিৎপাত হওয়ার যে আনন্দ, আহা, এখনকার ছেলে মেয়েরা তার খবরও রাখে না। সে আনন্দ তো অনেক টাকা দিয়েও কেনা যায় না। সত্তরের দশকে যখন আমাদের বেড়ে ওঠা, পুরো বাঙালি টোলাটাই ছিল এক পরিবারের মত। শুধু বাঙালিটোলা কেন ? আশপাশের পাড়া গুলো , – মশাকচক, খরমনচক, যোগসর, খঞ্জরপুর, ভিখনপুর ,সব জায়গায় ছিল প্রচুর বাঙালি। শুনেছি আজকের মুসলিম বহুল এলাকা তাতারপুরেও অনেক বাঙালির বসবাস ছিল এক সময়।

আর সব পাড়ার কথা থাক। নিজেদের পাড়া বাঙালিটোলার কথাই বলি বরং। ঐ যে বললাম এক পরিবারের মতো ; এটা শুধু কথার কথা নয়। ছোট বেলায় দেখেছি পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে কেল্লা জয় খেলছে পুরো পাড়া জুড়ে । কার বাড়ির পাঁচিল , কার বাড়ির ছাদ, কার বাড়ির উঠোন , সব একাকার হয়ে যেত। সারা পাড়া জুড়ে হতো দৌড়াদৌড়ি হুটোপাটি। আর পাড়ার কালী বাড়ির মাঠে হতো ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল। ক্রিকেট আর ভলিবল হত শীতকালে। ফুটবল বর্ষাকালে। একবার ঠিক হোল ফুটবল টুর্নামেন্ট হবে। টিম তৈরি হোল। কি সব জমকাল নাম ! প্যারামাউন্ট, চ্যালেঞ্জার্স, সেভেন ফ্রেন্ডস। ম্যাচের দিন গুলো একটা কাগজে লিখে কালী বাড়ির গায়ে থামের ওপর সেঁটে দেওয়া হত। বেশ কিছুদিন ধরে চলতো সেই টুর্নামেন্ট। পাড়ার লোকেরা তো বটেই, অন্যান্য় পাড়া থেকেও প্রচুর মানুষ আসতো ফুটবল ম্যাচ দেখতে।  উৎসবের চেহারা নিতো পুরো পাড়াটা। সে সব দিন গেছে একটা ! আমরা ছোটরা গুল্লি খেলতাম, মার্বেল। লাহিড়ীদের পুকুর পাড়ে জন্মান গাছের ডাল কেটে গুলী ডাণ্ডা বানাতাম। ক্রিকেট খেলার জন্য উইকেট ও বানিয়েছি। এ ছাড়াও ছিল কাবাডি। এমনি কাবাডি আর রাজা কাবাডি।  আরও অনেক খেলা ছিল যার নাম আর মনে নেই ; সবার হাতে কঞ্চির মতো সরু লাঠি থাকতো আর সেটা দিয়ে লাল ইট ছুঁতে হত, তারপর কোন একটা গাছের পাতার নাম বললে একজন সেই পাতা আনতে ছুটত। কি নাম, কি ভাবে খেলে সব ভুলে গেছি ! আর মনে রেখেই বা কি হবে ? এখন তো বাচ্ছাদের হাতেই নানা রকমের গেম। ও সব পুরনো খেলা ওদের কাছে হাস্যকর আর obsolete.। কিম্বা হয়তো না। ওরা তো জানলোই না। আমরাই জানালাম না। এই সব খেলা জানলে হয়তো ফোনের এডিক্সান থেকে বাচ্চারা একটু বাঁচত। কিছুদিন আগে ঝুলন পূর্ণিমা গেল। মনে আছে পাড়ার প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ীতে ছোটরা ঝুলন করতো। আমরাও করেছি। কি উত্তেজনা !  কি তোড়জোড় ! বড় দুর্গাচরন স্কুলের রাস্তা থেকে বড় বড় পাথরের টুকরো কুড়িয়ে আনা। মাটি সমেত ঘাসের চাপড়া। এই সব দিয়ে ঝুলনের পাহাড়, মাঠ তৈরি হবে। রং করা কাঠের গুড়ো দিয়ে রাস্তা ঘাট। ফোয়ারা তৈরি হত, আর তাতে নাচত পিংপং বল। দোলনায় ঝুলত রাধা কৃষ্ণের মূর্তি। আর থাকত মাটির তৈরি নানা রকমের পুতুল।মাথা নাড়ানো বুড়ো, একজোড়া সেপাই আরও কত কি, সে গুলো আমরা কিনতাম বেহুলা পুজোর মেলায়। আমাদের বাড়ীতে ছোট একটা ঝুড়ি তে সেই সব পুতুলগুলো তোলা থাকতো। মনে আছে সেই ঝুড়িতে একটা মাথা নাড়ানো বুড়ো ছিল।বসে আছে, তার লম্বা সাদা দাড়ি। মাথাটা একটা স্প্রিং দিয়ে ঘাড়ের সঙ্গে আটকান। টোকা মারলেই টুক টুক করে মাথাটা নড়ত।  গায়ের নীল রঙের ওপর পিঠের দিকে আঁচড় কেটে লেখাছিল  ‘ চাঁদু ‘। বোধহয় দাদা নিজেই লিখেছিল।চন্দ্রনাথ মুখার্জি, আমার দাদা আজ পাঁচ বছর হোল আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। সেই ঝুড়ি ভর্তি পুতুলগুলোর হদীসও আর নেই।

 প্রচলিত খেলা ছাড়াও বাঙালিটোলার কিছু নিজস্ব খেলা ছিল। একটা, কেল্লা জয়। দাদাদের মুখে শুনেছি, খেলিনি কখনো। আর একটা খেলায় গাছের শক্ত শক্ত ফল, স্থানিয় ভাষায় ‘ গুল্লার ‘ ছুঁড়ে দুই দলে মারামারি। এটাই খেলা ! বিশ্বাসদের বাড়ির পেছনে সিয়েমেস(C.M.S) স্কুলের মাঠ আর বাঙালিটোলার মাঝে একটা নালা ছিল। নালার দু পাড়ে দুই দলে ভাগ হয়ে এই বিচিত্র খেলাটি চলতো। খেলার কথাই যদি উঠলো তবে গঙ্গায় মাছ ধরার কথা না বললে অন্যায় হবে। মাছ ধরাও তো একটা স্পোর্ট। আমাদের পাড়ায় মাছ ধরার জন্য দুটো জায়গা ছিল। এক গঙ্গা, দুই চুনচুন কাকাদের পুকুর। বাংলায় যেমন পুকুরের ছড়াছড়ি বিহারে কিন্তু পুকুর সহজ লভ্য নয়। আমাদের বাঙালিটোলা ছিল ব্যাতিক্রম। বোধ হয় দেশের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতেই লাহিড়ীদের কোন এক পূর্বপুরুষ একটি পুকুর কাটিয়ে ছিলেন বাড়ির লাগোয়া জায়গায়। একবার মনে আছে আমি আর আমার বন্ধু লোটন পুকুরে ছিপ ফেলে বসেছি। আর কেও নেই। আমাদের টার্গেট পুকুরের পুঁটি মাছ। হটাত পেছন থেকে আওয়াজ- কাকে বলে বসেছ এখানে? একটু খোনা খোনা আওয়াজ। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি চুন চুন কাকার দাদা বংশী কাকা! – বলবো বাবাকে ? এই রে ! আমি চুপ। কিন্তু লোটন খুব স্মার্টলি উত্তর দিল – ধুত, এখানে তো মাছ ই নেই। কতক্ষণ বসে আছি। তারপর আমার হাত ধরে টেনে বলল – চল আমরা নালার ধারে বসি। তারপর কি হয়েছিল  এতদিন বাদে আর মনে নেই।

বাঙালিটোলার আর একটা আকর্ষণ ছিল যাত্রা আর নাটক। যে কোন ছোটখাটো অনুষ্ঠানে নাটক নেবে যেত কয়েক দিনের মহড়ায়। প্রতি বছর দুর্গা পুজোয় দুটো দিন নির্দিষ্ট থাকতো যাত্রার জন্য। প্রথম দিকে ছিল অষ্টমী আর নবমি , পরে হোল একাদশি দ্বাদশী।  আকর্ষণ বলে আকর্ষণ ! আমাদের অর্থাৎ ছোটদের প্রধান ইন্টারেস্ট ছিল যাত্রার রিহার্সালে। আসলের চেয়ে যেমন সুদে বেশী মজা , তেমনি যাত্রার চেয়ে যাত্রার রিহার্সালে। কোনোরকমে পড়া শেষ করে ছুটতাম যাত্রার রিহার্সাল দেখতে। নানান জায়গায় হোতো সেটা। কখনো অশোক চ্যাটার্জীদের বাইরের ঘরে , কখনো হাওয়া অফিসের বাড়ীতে , মেঘা বাবুদের (আচার্যি ) বাইরের ঘরে। সে এক আশ্চর্য পরিবেশ। এক জায়গায় হয়তো যাত্রার কোন দৃশ্যের মহড়া চলছে। একজন প্রম্ট করছে। ডাইরেক্টর সুবোধদা নয়তো অশোকদা। ঘরের আর এক দিকে অরেকটা জটলা। সেখানে পূর্ণেন্দুদা সন্তোষদারা বসে যাত্রার গানের সুর তৈরি করছে।সন্তোষদা আবার যাত্রায় বিবেক সাজতেন। এদিকে চা এসে গেছে বড় কেটলি তে। আমরাও  ভাগ পেতাম। সে বড় মধুর স্মৃতি।

  কয়েকদিন আগে লালটু দার সঙ্গে দেখা। বাকি ভাইয়েরা গত হয়েছেন ,অবিবাহিত লালটুদা একাই ভাগাল্পুরে আছে। সত্তরের ওপর বয়সে এখনো খাড়াই শরীর। কথাটা বলতেই একগাল হাঁসি। পাড়ায় পুরনো লোক বলতে আমরাই কয়েকটি পরিবার । লালটুদার সঙ্গে দেখা হলে পুরানো কথাই হয়। কেমন করে তিন চার জনে মিলে  বাঙালিটোলার ঘাট থেকে বর্ষার ভরা গঙ্গা পার হয়ে ওপারের একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় জিরিয়ে নিয়ে ফের বাঙালিটোলার ঘাটে ফিরে আসতো, সেটা শুনে বাঙালি হিসাবে বেশ গর্ব হচ্ছিল। তবে, এখন কি এই ধরনের নির্ভীক দামাল ছেলে বাঙালিদের মধ্যে পাওয়া যায় ?

বর্ষাকালে বাঙালিটোলার ঘাট ছিল খুব মজার জায়গা। দিনের বেলায় ছিপ দিয়ে মাছ ধরা আর একটু বেলায় স্নানে নেবে জলের মধ্যে হুট পাটি । তবে বিকেল বেলার মজাটা একটু অন্য রকম । আমাদের বাঙালিটোলার ঘাটে সার সার ছই ওয়ালা বড় নৌকা এসে ভিড়ত। ঘাটে জমা হতো প্রচুর লোক। বড় বড় মাটির জালার মতো হাড়ি নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত। বর্ষার সেই সময়টায় আসলে মাছের চারা কেনা-বেচা হোতো। শুনেছি বাংলা থেকেও নৌকা করে লোক আসতো। ছোট ছোট আলুমুনিয়ামের বাটিতে করে মাছের চারা মেপে বিক্রি হোতো। যারা কিনতো তারা চারাগুলো বড় বড় হাড়িতে ঢেলে দিত। হাড়িতে ভরা গঙ্গার ঘোলা জলে ছোট ছোট পোকার মতো মাছের চারা গুলো মিশে যেত। একটা লোক সেই হাড়ি ধরে ক্রমাগত নাড়িয়ে যেত। নাহলে স্থির জলে মাছ মরে যাবে।  এখনো যেন শুনতে পাই সেই হাড়ি নাড়ানোর শব্দ।

ছলাত, ছলাত। ছলাত ছলাত।

 পায়ের তলায় গঙ্গার ভিজে কাদা মাটিও যেন অনুভব করি। নাকে  পাই  বর্ষা কালের ভরা গঙ্গার ঘোলা জল থেকে ভেসে আসা সোঁদা সোঁদা আঁশটে গন্ধ।

                             বাঙালিটোলা বদলে গেছে। কালী বাড়ির সামনে বিশ্বাসদের যে মাঠে আমরা খেলাধুলো করতাম তার অর্ধেকটায় বাড়ি উঠেছে  । বাঁকি অর্ধেকটার অত্যন্ত শ্রীহীন অবস্থা। বিশ্বাস বাড়ির গায়ে অযত্নের ছাপ। সবুজ ঘাসে ছাওয়া এই মাঠে কত ফুটবল ক্রিকেট খেলা হয়েছে। ভলিবল। সন্ধ্যাবেলায় এখানেই দাদাকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দেখেছি ; বাড়ীতে বসে সেই আড্ডার শোরগোল বাড়ি থেকে শোনা যেত, যেমন শোনা যেত কালীবাড়ির আরতিতে বাজা ঘন্টার মধুর আওয়াজ। আরতির সময় হলে আড্ডা থেকে উঠে কেও গিয়ে বাজিয়ে আসত ঘণ্টাটা। এই কালী বাড়ির মাঠটাই আবার নিস্থব্ধ দুপুরে অন্য রকম হয়ে যেত। মাঠের উত্তরে দুটি পরিবারের পাশাপাশি বাস ছিল। তাদের একজনের ছিল কাঁসার বাসন পত্রের ব্যবসা। কাঁসার বাসনে ঠুকে ঠুকে নকশা কাটতেন উনি। ঠং ঠং ঠং ঠং । তখন পাড়ায় এতো ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হয়নি। আওয়াজটা বাড়ি থেকেই শোনা যেত। কেন জানিনা শব্দটা দুপুরের নিস্থব্ধতাটা আরও বাড়িয়ে দিত।

আজ দু হাজার বাইশে দাঁড়িয়ে যখন আমার ছোট বেলাটা দেখি , মনের মধ্যে kaleidoscope এর মতো  নানান বর্ণের ক্ষন ভঙ্গুর ছবি ভেসে ওঠে । মাঝে মাঝে নিজেরই সন্দেহ হয়, ঘটনাগুলো ঠিক এই ভাবেই ঘটেছিল তো ! সময় বদলায় । তার সাথে পারিপার্শ্বিক। বাঙালিটোলায় একসময় ভরা বাঙালি ছিল। যে দু একটা অবাঙালি পরিবার বাস করতো, তারাও দিব্বি বাংলা বুঝতে পারতো, কেও কেও দিব্বি বলতে পারতো। বাড়ির কাজের লোকেরা বাংলা শিখে যেত বাড়ির মা বৌদের সাথে কথা বলতে বলতে। আজ ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। হাতে গোনা কয়েকটা বাঙালি পরিবারের ছোট ছেলে মেয়েরা হিন্দিতে যতটা স্বছন্দ বাংলায় ততোটা না। ওদের বলা হিন্দিতে কোন বাংলা টান নেই , যেটা আমাদের আছে।  অবশ্য এসব নিয়ে প্রবাসী বাঙালিদের বিশেষ চিন্তা করে লাভ নেই , খোদ বাংলার অবস্থাই এ বাবদে ভালো না।

এতো পরিবর্তনের মধ্যেও কিছু কিছু জিনিষ একই রয়ে যায়। বাঙালিটোলার গঙ্গাঘাটে এখনো সূর্যাস্তের রং একই ভাবে গঙ্গার জলে খেলা করে। বর্ষার ভরা জলে এখনো শুশুক ভুস করে ভেসে ওঠে। ভাগলপুরে শরতের নীল আকাশে চিলের ওড়া আর সাদা মেঘের আনাগোনাও তো একইরকম! বাড়ির নারকোল গাছের গায়  কাঠবেরালির পরিবার শীতকালের রোদ পোয়ায় একই ভাবে। শীতের হিমেল হাওয়া আর গরম কালের লূ একই ভাবে বয়। আমাদের পুরনো বাড়িটাও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এখনো পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি বকে নিয়ে।  এসবের মাঝে দাঁড়িয়ে তাই শুনতে পাই সেই ছোট বেলার ঠং ঠং শব্দ। বুকের মধ্যে আনুভব করি – ছলাত !

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণ বাংলাদেশ থেকে – রণদাপ্রসাদ তালুকদার (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

‘মহালয়া’ শব্দটা কানে আসার সাথে সাথে নাকে এসে লাগে এক মিশ্র ঘ্রাণ। সে বড় পুরাতন ঘ্রাণ অথচ প্রতিবারই নতুনের আমেজ। ধূপ,ঘৃত প্রদীপ, ফুল-বেলপাতা,ফল,দুধ,মধু,চাল,সাবুদানা,ছোলা-মটর,নতুন কাপড় ইত্যাদি ইত্যাদির মিশ্রণে মিশ্রিত এক অপার্থিব ঘ্রাণ। চোখে ভাসে দশভুজা দেবীমূর্তি, লোকসমাগম, কানে বাজে ঢাকের বাদ্য। এইতো পুজা শুরু হয়ে গেলো।
অপরাপর ধর্মগুলো যখনও বঙ্গে আসে নি,বাঙালি যখনও বিভিন্ন ধর্মে ভাগ হয় নি,সেই সুপ্রাচীন কালের বাঙালির শরৎ কালের তথা সারাবছরের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গোৎসব। এখনো বলা হয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় উৎসব। যেহেতু বাঙালি ভাগ হয়েছে বিভিন্ন ধর্মে, ফলে বাংলাদেশে দুর্গোৎসব এখন হয়ে গেছে শুধু হিন্দুদের। কিন্তু গ্রাম বাংলা বা শহরেও এখনো অন্য ধর্মের অনেকেই স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন করেন, আনন্দের অংশীদার হোন।

এবছর মহালয়ার দিন বাংলাদেশে এক ট্র্যাজেডি ঘটে গেলো! বিকাল নাগাদ ভালোই ছিলো সব। মহালয়ার গোধূলিতে উত্তর বঙ্গের পঞ্চগড়ে করতোয়া নদী পাড় হচ্ছিলেন পুণ্যার্থীরা। মহালয়া উপলক্ষেই নদীর ওপাড়ে বোধেশ্বরী দেবী মন্দিরে অর্চনা শেষে নদী পাড় হবার সময় মাঝি নৌকার ধারণ ক্ষমতার থেকে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী তুলে ফেলে। মাঝ নদীতে এসেই ঘটলো নৌকাডুবি! আমি যখন লিখছি ইতোমধ্যে ৫০ জন মানুষ মারা গেছেন! নিখোঁজ আছেন আরও ৪০ জন প্রায়! কী ভয়াবহ! এতো বড় ট্র্যাজেডি ঘটে গেলো! মহালয়ার দিন থেকেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে। তারউপর পূজা আসলে অশনিসংকেত তো একটা ভিতরে কাজ করেই। পূজা মানেই আনন্দ, হৈচৈ, রৈরৈ, ঢাকের বাদ্য,দেবীদর্শন,প্রসাদ খাওয়া,নতুন কাপড় এসবই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা শুধু এসবের মধ্যেই থাকতে পারি না। বিষাদ,চাপাভয় কাজ করে। ইতোমধ্যে নির্মাণাধীন প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে সাতক্ষীরা,বরিশাল সহ বেশ কিছু জায়গায়। গতবছর অর্থাৎ ২০২১ সালে নোয়াখালী, চাঁদপুর,কুমিল্লাসহ কী ভয়াবহ অবস্থা ছিলো পূজায় দেশ বিদেশের মিডিয়া সে সবের কিছুটা তুলে ধরেছে। এ অবস্থা নতুন না,কিন্তু একবিংশ শতকেও এসব ঘটেই চলছে এটা দেশ ও জাতির জন্য দুঃখজনক এবং একই সাথে অসম্মানেরও। তবে সেসব ঘটনার বিচারও হচ্ছে বা প্রক্রিয়াধীন। এবছর আবার কোথায় কী হবে এই একটা আশংকা,চাপা ভয় এসব নিয়েই পূজোর উচ্ছ্বাস।
আজকাল ওপার বাংলায় বিশেষত কোলকাতায় যে থিম পূজোর ছড়াছড়ি, প্রায় শত বছর আগে পূর্ববঙ্গে ব্রিটিশদের কাঁপিয়ে দিয়েছিলো,ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো এমন একটি থিম পূজো। সে খবর আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ এ পাই। তিনি লিখেছেন… ‘পঞ্চমীর দিন প্রতিমার আবরণ উন্মোচন করা হল। সকলেই হতবাক। অন্যান্য বছর ছিন্নমুণ্ড মহিষের দেহ ভেদ করে উত্থিত অর্ধেকটা দেখা যায় অসুরকে। এবারে মহিষাসুর সম্পূর্ণ দণ্ডায়মান, পুরোপুরি মিলিটারির পোশাক,বুট জুতো সমেত এবং তার মুখ অবিকল সাহেবদের মতন। অর্থাৎ ইংরেজ অসুর। আর দুর্গার ছোট ছেলে কার্তিক হচ্ছেন সুভাষ বসু, তিনিও সামরিক বেশে সজ্জিত,তীর-ধনুকের বদলে হাতে রাইফেল,সেটা অসুরের বুকে তাক করা। ‘
মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো সে খবর,হাজারো মানুষ দেখতে এসেছিলো কিছুক্ষণের মধ্যে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ শাসকেরা সেই পূজো হতে দেয় নি। প্রতিমা লুকিয়ে ফেলতে হয়েছিলো রাজদ্রোহের ভয়ে। ঘট পূজা হয়েছিলো সেবার ওখানে।
স্বদেশে অন্য কেউ রাজত্ব করছে এটা বাঙালি কখনোই সহ্য করে নি। আন্দোলন সংগ্রামে হটিয়ে দিয়েছে তাদের। এমনকি বাঙালি হিন্দুরা নিজেদের দেবতার রূপ,সাজ পোশাক পাল্টে দিয়েও এক অনন্য প্রতিবাদের নজির সৃষ্টি করেছিলো সেবার,শাস্ত্র সম্মত না এটা জেনেও করেছে! মানে ধর্মেরর উর্ধ্বে স্বদেশপ্রীতি! অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে,বাঙালির নিজ ভাষা,নিজ দেশে একদল কেবল সংখ্যায় অল্প বলে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ক্রমাগত হামলার শিকার হতে হয়! কী দুর্ভাগ্য!
১৯৭১ এর ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই পীড়িত,মূর্ছিত, অর্ধঅনাহারে যখন বাংলাদেশের বাঙালিরা জীবন মরণ লড়ছে,তখন পশ্চিম বাংলার অনেক পূজামণ্ডপ থেকে,পূজা কমিটি থেকে অনেক অনুদান যুদ্ধ বিপর্যস্ত বাংঙালিদের ফান্ডে দিয়ে দিয়েছে। বাঙালিত্বের এক অকৃত্রিম টান থেকেই এমন হওয়া স্বাভাবিক।
এতোকিছুর মাঝেও পূজো এক মহা মিনল মেলার নাম। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় নাগাদ পূজো এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে আত্মিক মেল ঘটায়। তখন আসলে আমরা ভুলে যেতে বাধ্য হই হানাহানি, হিংসাগুলো। বাঙালি ভ্রাতৃত্ব ই জেগে থাকে শেষে। পূজোয় নারিকেল, তিল এর নাড়ু, ক্ষীরের সন্দেশ আমাদের মা কাকী জ্যেঠিরা এখনো বেশি করেই তৈরি করে। এর কারণ আছে। তাদের ছেলেটা বা মেয়েটা কোথাও পড়ে মানে হলো তারা তাদের বন্ধুদের জন্য পূজোর পর সেই নাড়ু সন্দেশ অবশ্যই নিয়ে যাবে। অনেক বন্ধুদের আবদারও থাকে। আবার পূজোর মাঝেই অনেকে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে বাড়িতে আসতেছে যাদের সাথে ধর্মের মিল নেই,আত্মিক টানেই এই আসা। পূজোর প্রসাদেই হচ্ছে অতিথি আপ্যায়ন।একই বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে থাকে কিংবা পরিচিত সেই সুবাদে একজন অন্যজনের কেনাকাটার অঙ্গী হচ্ছে অনায়াসে,এই দম না ফলতে পাড়া ব্যস্ততার মাঝেও। সিনিয়র পড়ুয়া জুনিয়র পড়ুয়াকে,বন্ধু বন্ধুকে পূজো উপলক্ষে নতুন জামাকাপড় উপহার দিচ্ছে। ছেলে-মেয়ের টিউটর, যিনি ধর্মে হিন্দু নন, তাকে কিন্তু পূজোয় বোনাস দেওয়া হচ্ছে বা নতুন পোশাক উপহার দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক ছাত্রদের, ছাত্ররা শিক্ষককে নতুন জামাকাপড় উপহার দিচ্ছে। এগুলো জীবন্ত সত্য।
আসলে বিশ্বজোড়ে কীসের মোহে কীসের টানে,কে বা কার জোড়ে উগ্রতা বাড়ে সেসব সাধারণ মানুষ অনেক পরে টের পায়। কিন্তু ততোদিনে অনেক ভাঙন,অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক সৌন্দর্য, কালের ইতিহাস নিমেষে উগ্রতার বলি হয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মানুষেরই সৃষ্টিকে গুড়িয়ে দেয় আরেকদল মানুষ! তবুও মানুষকে দিনশেষে মানুষের কাছেই আসতে হয়। আনন্দ, দুঃখে মানুষের পাশে দাঁড়ায় মানুষ।
এবছরের দুর্গোৎসবে মহামিলন ঘটুক হৃদয়ে হৃদয়ে, প্রাণে প্রাণে,মনে মনে। মহামারি,যুদ্ধ এসবকে ছাপিয়ে মানুষের জয় হোক, দেবী যেনো সেই কৃপা করেন আমাদের। অভয়া অভয় দান করুন, জয় দুর্গা।
শুভেচ্ছা সবাইকে।

প্রসঙ্গ বাংলাদেশঃ সমকালের ধারাবিবরণী – চর্চা ডাকিনী (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

চল মিনি আসাম যাব

  দেশে বড় দুখ রে,  


কিন্তু হায়! সেখানেও যে যদুরাম বসে আছেন। ৯ই অগাস্ট, দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন সিলেটের চা বাগানগুলোর প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। ক্রমে আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় বিভিন্ন সমাবেশ, মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বন্ধুদের সাথে আমিও সেখানে যোগ দিই। ২৭ আগস্ট, শাহবাগে যখন সমাবেশ চলমান তখন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী চা কোম্পানির মালিকদের সাথে মিটিং করছেন।উল্লেখ্য  চা শ্রমিকদের কোন প্রতিনিধি সেখানে ছিলেন না। সমাবেশ চলা অবস্থায় আমরা জানতে পারি মুজুরি ১৭০ টাকা ধার্য্য করা হয়েছে এবং শ্রমিকরা এই মুজুরি মেনে নিয়ে কাল থেকে কাজে যোগাদান করবেন। মাত্র ৫০ টাকা বাড়িয়েছে বলে চা শ্রমিকরা তাদের বাগানে নেচে গেয়ে এটাকে উদযাপন করলেন। তারা কি জানেন  বিশ্ব ব্যাংকের মানদন্ড অনুযায়ী দৈনিক ১.৯০ ডলারের নিচে মুজুরি পাওয়া লোক চরম দরিদ্র। লেখাটা যখন লিখছি তখন কারেন্সি রেট ১০৩.৭৫। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় আসে ১৯৭.১২ টাকা।দেড় দশক আগেও দেশে চা আমদানির পরিমাণ ছিল ৭০ থেকে ৮০ লাখ কেজি। প্রতি বছর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে সেই আমদানির পরিমাণ এখন ৮ থেকে ৯ লাখ কেজির নিচে নেমে গেছে। মূলত ২০০১ সাল থেকেই দেশে ধারাবাহিকভাবে চা উৎপাদন বেড়েছে।সে বছর উৎপাদন হয়েছিল ৫ কোটি ৩ লাখ কেজির মত। প্রতিবছর এই উৎপাদন বেড়ে ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজিরও বেশি।ইদানীংকালে রপ্তানিও কমে গেছে কারণ দেশের বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে এবং ভাল দাম পাচ্ছে। কাপ প্রতি চা আগে ছিল ৫ টাকা এখন সেটা ৮টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। জায়গা বিশেষ টাকা প্রতি ১০। এতকিছুর পরও চা শ্রমিকের মুজুরি ১২০ই রয়ে গেল। চা শ্রমিকের সন্তান সন্তোষ রবি দাশ নামক এক যুবকের ফেসবুক পোস্ট কে কেন্দ্র করে মূলত আন্দোলন গড়ে উঠে এবং দৈনিক ৩০০ টাকা মুজুরি দাবি করেন। অবশেষে চা কোম্পানির মালিকদের ঠিক করে দেওয়া ১৭০ টাকাই আমাদের মাননীয়া চূড়ান্তভাবে ঘোষনা দেন।কি করুণ খেলা তাদের সাথে খেলছেন আমাদের মাননীয়া!

এবার আসুন আমরা তাদের রোজকার খাবার খরচটুকু দেখার চেষ্টা করি-
যেমন , সকালবেলা তারা ভাত খায়। ভাতের সঙ্গে ডাল বা ডিম সঙ্গে কোনো তরকারি। এখন সে যদি ১০০ গ্রাম চালের ভাতের সাথে ২০ গ্রাম ডাল ও একটা ডিম নেয় তাহলে তার বাজারমূল্য আসে ২৩ টাকা (১০০ গ্রাম চাল ৮ টাকা, ২০ গ্রাম ডাল ৩ টাকা ও একটি ডিম ১২ টাকা) তিনবেলা সমপরিমাণ খাবার খেতে  দৈনিক খরচ প্রায় ৭০ টাকা। মাসে খরচ হবে ২১০০ টাকা। এই টাকা যদি একজনের পিছনে খরচ হয় সেখানে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের খাবার খরচ মেটাবে কি করে? (পরিবারে গড়ে তিন থেকে চারজন সদস্য)  চা বাগানের শ্রমিকদের না আছে ভাল থাকার জায়গা না আছে ভাল চিকিৎসা।জ্বর থেকে শুরু করে টিউমার রোগের একই ঔষুধ দিয়ে চলছেন বছরের পর বছর। যখন দেখছেন অবস্থা বেগতিক তখন সদরে আনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন কিন্তু অবস্থা এতটাই খারাপ হলে রোগীকে সদর হসপিটাল নেওয়ার পরামর্শ দেয় তখন রোগীর হাতে আর বেশি সময় থাকে না। মাঝ পথেই এক্সপায়ার। শিক্ষার কথা না হয় নাই বললাম,সারাদেশে শিক্ষার যে বেহাল দশা সেখানে প্রান্তভূমির জনগণদের কথা কিভাবে বলি! এই মুজুরি আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলো থেকেও কম। অথচ আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি দেশ দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে, উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে,বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার রোল মডেল, প্রতি প্রহরে জিডিপির রোজনামচা। অর্থনীতির তত্ত্বগুলো তাদের গুলিয়ে খাইয়ে দিলেও বুঝবে না তাদের সাথে হচ্ছে কি !প্রান্তিক মানুষগুলোর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করে একটা দেশ কেমন করে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে পারে?

২.
২৭শে আগস্ট সমাবেশ শেষ করে ফিরতি বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম নগরীর ব্যস্ততম স্টেশনে। হঠাৎ সামনে দিয়ে এক রিকশা চলে গেল; রিকশার পুরুষযাত্রী উঠকো মন্তব্য করে গেলেন  ‘মাথায় ঘোমটা দাও’। চেনা নেই জানা নেই এমন মন্তব্য কেউ কাউকে করতে পারেন? আমার মাথা আমাকে ভাবতে দিন সেটা ঢেকে রাখবো না খুলে রাখব। অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে যে অনধিকার চর্চা করা যায় না সেটা আরবের গিলুহীন জাতিকে কে বোঝাবে? কেউ কি আছ এমন? যুগ যুগ ধরে এ অন্যায় আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। এই যে মাথা শরীর ঢেকে রাখার কথা মোল্লারা বলেন এর পিছনে কারণ বলেন এভাবে মেয়েরা নিরাপদ। আমরা দেখেছি হিজাব পরিহিতা মেয়েও ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে এবং এই হুজুরদের দ্বারাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় এগুলো অহরহ চোখে পড়ছে। কপালে টিপ পড়ার কারণে রাস্তাঘাটে মেয়েদের হেনস্তা করা হচ্ছে। সিগারেট ফুঁকতে দেখলে মেয়েমানুষ কেন সিগারেট নিচ্ছে?” কই সিগারেট যখন ছেলেদের হাতে থাকে তখন তো কিছু বলতে শুনি না।  সিগারেট স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর তা ছেলেমেয়ে উভয়েই। বাংলাদেশের মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশীপ হলে তাদেরকে বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনা দিয়ে সারা শহর ছাদ খোলা বাসে করে ঘুরানো হয়। তারই কয়েকদিন পর গানের পাখি কোরআনে হাফেজ হন এক ছেলে তাকেও হুজুরের দল গিয়ে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা জানাল। আগেও অনেকে কোরআনে হাফেজ হয়েছেন তাদের বেলায় এমন সংবর্ধনা দেখিনি। এমনটা করা হয়েছে যাতে করে নারীদের এমন জয় দ্রুতই মিডিয়ার আড়ালে চলে যায়।
মেয়েদেরকে এভাবে একচোখে দেখার সংস্কৃতি ক্রমশ অগ্রগতি পাচ্ছে বলতেই হবে। নরসিংদী স্টেশনে এক মেয়েকে হেনস্তা করেছে আরেক মধ্যবয়সী মহিলা, স্লিভলেস জামা পরিধান করার জন্য। ইতিমধ্যে আমরা হাইকোর্টের রায় শুনেছি যেখানে বলা হচ্ছে এই ঘটনার জন্য মেয়ের পোশাকই দায়ী। একটা গণতান্ত্রিক দেশের উচ্চ আদালতের কাছ থেকে এমন রায় কখনোই কাম্য হতে পারে না। এই কাঠমোল্লাদের খুশি রাখতে এরকম নারী বিরোধী রায় আমরা আগেও শুনেছি যেখানে বলা হচ্ছে কোন নারী বিয়ের রেজিস্টার বা কাজী হতে পারবেন না কারণ নারীরা ঋতুমতী। নারীদের এভাবে হেনস্তা করার ঘটনা দিনকেদিন বেড়েই চলছে এবং আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় যায়ওায় পর তাদের সাহস বেড়ে গেছে এটা বলতেই হবে। আমাদের মাননীয়া এদের শক্তহাতে দমন করছেন এমনটা বলা যায় কি? যদি কেউ এমনটা দাবি করে থাকেন তাহলে ধরে নিবেন সেটা তার কষ্টকল্পিত ছাড়া আর কিছুই নয়।

৩.
এবার আসি ইরানী নারী মাআশা আমিনি এবং আমাদের দেশের হিজাব ইজ মাই চয়েজ বলা মৃগী রোগীদের প্রসঙ্গে।
ইরানে নারীদের একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং ইরানের সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু নারী নয়  সাথে যোগ দিয়েছেন ইরানের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী তরুণ-তরুণীসহ সর্বস্তরের মানুষ। মেয়ে মাআশা আমিনি তার ভাইয়ের সাথে বেড়াতে এসেছিল তেহরানে। তার মাথার হিজাব  যথাযথ ছিল না এই বলে পুলিশ মাআশা আমিনিকে ওদের ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে মাআশা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ।পরবর্তীতে মেয়েটার মৃত্যু হয়। মূলত এটাকে কেন্দ্র করেই ইরানে নারীদের বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ইসলামিক শাসনের পতনের দাবি জানায়।

আশির দশকে শুরুর দিকে ইরানে ইসলামিক শাসন শুরুর পর থেকে সেখানকার নারীদের উপর একের পর এক কঠোর নিয়মনীতি আরোপ করা শুরু হয়। বর্তমানে ইরানী নারীদের এমন বিপ্লব দেখে আর বুঝার বাকি নেই যে বিগত চল্লিশ বছরের ইসলামিক শাসনামলে তারা ভিতরে ভিতরে কতটা ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারীর পোশাক নারীর দেহ নিয়ে রাজনীতি চরম বর্বরতা ।আশার কথা এই যে ইরানে নারীরা যদি সফল হয় তাহলে পার্শ্ববর্তী ইসলামিক দেশগুলো এমনকি আমাদের বাংলাদেশের নারীদের জন্যও এটা সুফল বয়ে আনবে। যেমনটা তালেবান ক্ষমতা দখলের পর এদেশের মোল্লাদেরর সাহস যেভাবে বেড়েছিল। এখন কথা হচ্ছে সবাই কি চায় এই স্বাধীনতা? না চায় না।তারা বলবে হিজাব ইজ মাই চয়েজ। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া একটা মেয়েকে ইসলামিক শাসননীতি, হাদিস এসব শুনিয়েই বড় করা হয়। তাদেরকে বলা হয় শরীর ঢেকে রাখতে হবে, কথা নিচু স্বরে বলতে হবে আরও নানান বিধিনিষেধ। এসব শুনে শুনে এবং মেনে নিয়ে একটা মেয়ে যখন বড় হয়ে বলে হিজার ইজ মাই চয়েজ তাহলে সেটাতো তার চয়েজ হল না এটাকে হিজাব সিনড্রোম বলা যেতে পারে। মাআশা আমিনি মেয়েটাও তো হিজাব পড়েছিল মাত্র দুগাছি চুল দেখা গেল বলে মোরাল পুলিশ মেয়েটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলল! এখন হিজাব ইজ মাই চয়েজ বলা মৃগী রোগীরা কোথায়? আপনাদের কিছু কি বলার আছে? দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারছেন না বলে দরজায় খিল এটে বসে আছেন? এখানকার বাম ঘরানার লোকগুলো কেমন পিনপতন নীরবতা পালন করছে। কিছু হলেই গলা ফাটিয়ে সম অধিকার সম অধিকার চাই চাই।ইরানী মেয়েটির বেলায় এই আওয়াজ উবে গেলে কেন? কাল যদি হিজাব পড়ার জন্য কোন মেয়েকে কিছু বলা হয় বামজেহাদিরা যাচাইবাছাই না করেই রাস্তায় নেমে পড়বে। হিপোক্রেটস্! বামজেহাদি (ইউনিয়ন, ফ্রন্ট) এদের মধ্যেই চৌদ্দদল তৈরি হয়ে গেছে। আদর্শের জগাখিচুরি। ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় যেখানে সাধারণ শিক্ষাকে মর্যাদা দেওয়া হয় না সেই কওমী শাখার ছাত্রদের নিয়ে তারা শিক্ষা দিবস পালন করছেন, সেদলই মাশা আমিনি হত্যার প্রতিবাদে মোল্লতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁ বলে সমাবেশের আয়োজন করেছেন। চারপাশ বড়ই অদ্ভুত!

৪.
গতবছর দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর কিরকম অত্যাচার হয়েছে তা আমরা সকলেই জানি। কুমিল্লার এক পুজামন্ডপে হনুমানের পায়ে কোরআন শরীফ রাখাকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর গণহত্যা হয়ে গেল। পুলিশি তদন্তে বের হয়ে আসে এক মুসলিম যুবক একাজ করেছেন। পরে তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাবি করছেন যদিও এরকম নাটক আমরা সবসময় দেখে আসছি। মূলত ১৯৪৭ সালের পর থেকেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারাাহিকতায় ২০২২ সালেও আমরা এর চরম নির্মম রুপ দেখতে পাচ্ছি। ২০০১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে এদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ১৬.৮৩ মিলিয়ন।
২০১১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাড়ানোর কথা ছিল ১৮.২ মিলিয়ন। কিন্তু ২০১১ সালেই পরিসংখ্যানে দেখা যায় এই সংখ্যা ১২.৩ মিলিয়নে এসে দাড়ায়। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭.৯৫ শতাংশ হলো হিন্দু।দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় মাল্টিমিডিয়া নিউজ এজেন্সি এএনআই-এর সঙ্গে সাক্ষাতকারে আমাদের মাননীয়া বলছেন সংখ্যালঘুদের উপর হামলায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দিনদুপুরে এমন মিথ্যাচার কেউ করতে পারে যেখানে আমরা হাতের মোবাইল ফোনে সব দেখতে পাচ্ছি হিন্দুদের সাথে কি হচ্ছে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে হিন্দুদের সংখ্যা এত কমছে কি করে?মাননীয়া যখন অমোঘ কাব্য আউরে যাচ্ছেন তখন তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রেস মিটিংয়ে বলছেন দেশে মন্দিরের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, এটা কমাতে হবে নয়তো সাম্প্রদায়িক হামলা বাড়তে পারে বলে উনার ধারণা। কিন্তু মশাই নেত্রী যে বলছেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়! হ্যাঁ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় যখন কোন মোল্লা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে অপমান করেন এবং রাতের আঁধারে তা গুড়িয়ে দেন তখন। এর পরপরই আমরা দেখছি হাইকোর্টে নারী বিরোধী রায় (নারী কাজী)দিয়ে মোল্লাদের খুশি রাখতে। জনগণ এসব প্রশ্ন করতে পারবে না, ডিজিটাল আইনের খড়গ মাথায় নিয়ে দিন কাটছে আমাদের। ডিজিটাল আইনে জেলে পুরে দিবে নয়তো গুম করে দিবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পুজা উদযাপন পরিষদ-এর সাধারণ সম্পাদক ড.চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলছেনে এবছর দেশে ৬৬টি সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। এরমধ্যে প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়িতে হামলা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরও বলেন মানসিক ভারসাম্যহীনদের যেন এবার আগে থেকেই সাবধানে রাখেন। আমারও একই মন্তব্য মানসিক ভারসাম্যহীন জাতিকে দয়া করে সাবধানে রাখুন। এই ভোটব্যাংক রাজনীতি খেলে আখেরে নিজের ভয়াল দিন ঢেকে আনবেন না।

প্রসঙ্গ বাংলাদেশ: আওয়ামি ‘সেকুলারিজমের’ প্রপঞ্চ ও সংখ্যালঘুর সর্বনাশের ধারাবাহিকতা  – উত্তম দেব (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশে আরও একবার রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘনাতে শুরু করেছে। তেইশের ডিসেম্বরে নির্বাচন হ‌ওয়ার কথা। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে কোনও একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে টানা পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাধিক্যে জিতে ঢাকায় সাত বছর পর সরকারে ফেরে আওয়ামি লিগ। এর পর আরও দুটি নির্বাচন লিগের নৌকা কীভাবে উতরেছে, তা নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বিশেষ উচ্চবাচ্য না করলেও হাসিনার দেশে‌ ব্যাপক হাসাহাসি চলে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সাউথ ব্লক যে পর্দার পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ে, তা হাসিনার দোস্ত-দুশমন, সব পক্ষই জানে।‌

শেখ হাসিনাকে বর্তমান সময়ের দক্ষিণ এশিয়ায় সব থেকে চতুর রাষ্ট্রনায়ক বললে ভুল হবে না।‌ গদিতে বসার দিন থেকে হাসিনার জন্য প্রতিটি মুহূর্তই বিপজ্জনক। কিন্তু তারপরেও এখনও পর্যন্ত হাসিনাকে কেউ গদি থেকে টলাতে পারে নি। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ যে দলটির‌ নেতৃত্ব দেন, সেই আওয়ামি লিগের শরীরে একটি লেবাস আছে। লেবাসটি পরিয়ে দিয়ে গেছেন হাসিনার আব্বাজান শেখ মুজিবুর রহমান। লেবাসটি হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার। আওয়ামি লিগ ক্ষমতাচ্যুত হলেই বাংলাদেশ ইসলামিক মৌলবাদীদের খপ্পরে গিয়ে পড়বে- এই জুজু দেখিয়ে প্রতিবেশী ভারত ও আমেরিকা সহ পশ্চিমী শক্তিকে তাঁর পেছনে দাঁড়াতে একপ্রকার বাধ্য করেছেন হাসিনা। হাসিনা ভালোই জানেন, দিল্লি তাঁর পাশে থাকলে ওয়াশিংটন তাঁকে বড় বেশি ঘাঁটাঘাটি করবে না। বাংলাদেশ নিয়ে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভারতের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে থাকে পশ্চিমী দেশগুলি। এই কূটনৈতিক চ্যানেলের কারণেই তেরো ও আঠারো, পরপর দু’বার নির্বাচনের নামে প্রহসন করেও পার পেয়ে গেছে আওয়ামি লিগ। তেরোতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-জামাত সহ বিরোধীরা নির্বাচনে অংশ‌ই নেয় নি। একতরফা ভোটে ড্যাং ড্যাং করে সব আসন জিতে নেয় শাসকদল আওয়ামি লিগ। আঠারোর নির্বাচন আসতে আসতে নিবন্ধন কেড়ে নিয়ে জামাতের দফতরে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন হাসিনা। নেতৃত্বহীন ছন্নছাড়া বিএনপি‌ সহ বাকি বিরোধীরা ভোটে অংশ নিলেও লিগের ‘নৈশভোটের’ কাছে দাঁড়াতেই পারে নি। ভোট তো হয় দিনেদুপুরে। বাংলাদেশে রাতে কেন? বিরোধীদের অভিযোগ, আঠারোর সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই পুলিশ দিয়ে বুথে বুথে ছাপ্পা মেরে ব্যালটবাক্স বোঝাই করার কাজটি সেরে ফেলেছিল শাসকদল।

সাউথ ব্লকের সঙ্গে আওয়ামি লিগের কূটনৈতিক বোঝাপড়া দীর্ঘদিনের এবং তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আমাদের সকলের জানা। বাম-ডান নির্বিশেষে ভারতের রাজনৈতিক মহলের সঙ্গেই আওয়ামি লিগের খাতির ভালো। পশ্চিমবঙ্গের ‘সেকুলার’ বাঙালিকুলের মুজিব ও আওয়ামিপ্রীতিও নতুন নয়।‌ এই কথা সত্যি, ঢাকার তখতে আওয়ামি লিগ থাকলে পূর্ব সীমান্ত নিয়ে অনেক স্বস্তিতে থাকে দিল্লি। শেখ হাসিনার জামানায় ভারত-বাংলাদেশ‌ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় অনেক বেশি মজবুত। বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পুঁজির প্রভাব ক্রমবর্ধমান। হাসিনা সরকার সহায় থাকায় উত্তরপূর্বাঞ্চলের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে দমন করা ভারতের পক্ষে সহজ হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ভারত বাংলাদেশে হাসিনাকেই চায় অথবা হাসিনা সরকারকে হাতে রাখতে চায়। দিল্লির হাসিনাপ্রীতির কারণটা বোঝা গেল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ‘সেকুলার’ বাঙালি কেন আওয়ামি লিগের প্রতি দুর্বল? তারা মনে করে,‌ একমাত্র আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় থাকলেই বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। সত্যিই কি বাংলাদেশকে উদার-ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংখ্যালঘু সহিষ্ণু রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখার কোন‌ও ঠিকা আওয়ামি লিগ অথবা শেখ হাসিনা নিয়েছে? মদিনা সনদ মেনে দেশ চালানোর অঙ্গীকার করা একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনি কীভাবে ‘সেকুলারিজম’ আশা করতে পারেন?

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার গরজে, নির্বাচনের আগে মক্কা থেকে ওমরাহ সেরে দেশে ফিরে মাথায় হিজাব ধারণ করতে হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু’ কন্যাকে। সেবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে পাঁচটি আসন কম থাকায় নির্বাচন শেষে সরকার গড়তে জামায়াতে ইসলামির‌ও সাহায্য নিতে হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামি লিগকে।‌ ২০০১ থেকে ২০০৬- বাংলাদেশ শাসন করে বিএনপি-জামাত জোট। এই পাঁচ বছরে নিজেদের কৃতকর্মের কারণেই সাউথ ব্লকের বিরাগভাজন হয় বিএনপি-জামাত জোট সরকার। হাওয়া ভবন থেকে খালেদাপুত্র তারেক রহমান পরিচালিত সমান্তরাল সরকারের দৌলতে বিএনপি-জামাত আমলে বাংলাদেশ‌ হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের সিক্রেট এজেন্সি ‘আইএসআই’-এর মুক্তাঞ্চল। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে বাংলাদেশের মাটি ও প্রশাসনের বিভিন্ন উইংসকে খুল্লামখুল্লা কাজে লাগায় আইএস‌আই। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ঢাকায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে ভারত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল ম‌ঈন ইউ আহমেদ। জেনারেল ম‌ঈনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর প্রভাব খাটায় দিল্লি। ভারতের চাপে আইএসআই- এর এলিমেন্টদের প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমদের সরকার। ঢাকায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে থাকতেই বিএনপিকে সবক দিতে চোয়াল শক্ত করে ফেলে সাউথ ব্লক। এরপর আর ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ ছিল না খালেদা জিয়ার। ভাগ্য খোলে শেখ হাসিনার। ২০০৮-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ভোটে প্রত্যাশিতভাবেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরেন মুজিবের মেয়ে। সেই থেকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আওয়ামি লিগ।

এই ১৪ বছরে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কোন দুর্ভেদ্য দুর্গ তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা? তিনি বামহাতে জামাতকে নিষিদ্ধ করেছেন। ডানহাতে হেফাজতে ইসলামকে ‘সার-পানি’ দিয়েছেন। বাংলাদেশ জুড়ে আজ ‘দার-উল-উলুম দেওবন্দ’ ও ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ পরিচালিত ১৯ হাজার ১৯৯টি ক‌ওমি মাদ্রাসা। হাসিনা শুধু আজ শেখের বেটি‌ই নন ক‌ওমিজননীও বটে। ১৪ বছর আগেও ঢাকার রাস্তায় হিজাব পরিহিত নারীর দেখা মিলত হাতেগোনা। এখন হিজাব হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মুসলমান নারীদের আত্মপরিচয়ের গর্বিত প্রতীক। শেখ হাসিনার জামানায় ‘ওয়াজ মাহফিল’ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সবথেকে ‌জনপ্রিয় বিনোদন। মাঠে-ময়দানে, টিভি-ইউটিউবে ওয়াজ করেই আলেম-উলেমারা কোটিপতি। ওয়াজ মাহফিলগুলিতে ১৫-২০ হাজার লোকের জমায়েতে প্রকাশ্যে ভিন্নধর্মকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন বক্তারা। ধর্মীয় বিদ্বেষ ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা সংখ্যাগুরু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজটি নিখুঁতভাবেই করে চলেছে ওয়াজ মাহফিল। বাংলাদেশের মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক ও ধার্মিক এই আওয়ামি জামানায়। শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন, ক্রমবর্ধমান ইসলামিক মৌলবাদকে দমন করার শক্তি তাঁর নেই বরং ইসলামের খিদমতে খামতি থাকলে ‘তখত’ টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। এই আওয়ামি শাসনের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বটবৃক্ষ যারা দেখতে পায়, তারা কারা?

দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লিগ ভেঙে আওয়ামি মুসলিম লিগের জন্ম ১৯৪৯ সালে। আওয়ামি মুসলিম লিগের দুই বড় খলিফার একজন ৪৬-এর দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস-এর মূল কারিগর হোসেন শহিদ সোর‌ওয়ার্দি অপরজন আব্দুল হামিদ খান ভাসানি। তিন ও চার নম্বরে ছিলেন শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবের উচ্চশিক্ষা কলকাতায়। সোর‌ওয়ার্দিকে রাজনৈতিক গুরু মানতেন মুজিব। চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত সাফল্য লাভের পর ‘মুসলিম’ শব্দটা বাহুল্য মনে‌ হতে থাকে আওয়ামি মুসলিম লিগের নেতাদের কাছে। পরের বছর দলের তৃতীয় কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি স্নানের পর গা থেকে জল ঝাড়ার মতো ঝেড়ে ফেলে দেন সোর‌ওয়ার্দি-ভাসানি-মুজিবেরা। পদবি থেকে সাম্প্রদায়িকতা খসে পড়লেও আওয়ামি লিগের অন্তরাত্মা এক‌ই থাকল। সোর‌ওয়ার্দি-ভাসানি-মুজিবদের লাভের লাভ যেটা হল, রাতারাতি উদার, পরধর্মসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক নেতায় পরিণত হলেন তাঁরা। সেই সময় থেকেই আওয়ামি লিগের অঙ্গে এবং সঙ্গে সংখ্যালঘু বা হিন্দুদরদী তকমা জুটে গেল। যা আওয়ামি লিগের জন্য বিড়ম্বনার কারণ না হয়ে রাজনৈতিকভাবে সুদূরপ্রসারী পরমপ্রাপ্তি হয়ে দাঁড়ায়। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রশ্নাতীত। ষাটের ‌দশকের শুরুতেই মুজিব বুঝে যান-‌ শুধু মাত্র ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অবসান অবধারিত। পূর্ব পাকিস্তানে কোন ধরণের রাজনীতি করলে ভারতের রাজনৈতিক মহলের সুনজরে আসা যাবে, তা আওয়ামি লিগের নেতাদের মধ্যে সবথেকে ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন একমাত্র মুজিবুর রহমান‌ই। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই ভারতের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক মুখ হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। তিনি উদার, অসাম্প্রদায়িক ও হিন্দুদরদী না সাজলে এটা সম্ভব হত না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতটা উদার-অসাম্প্রদায়িক ও সংখ্যালঘু বান্ধব ছিলেন শেখ মুজিব? কতটা তাঁর দল আওয়ামি লিগ?

১৯৭১-এর ডিসেম্বরে দুই বাংলা ‌জুড়ে জয় বাংলার জয়জয়াকার। ১৬ ডিসেম্বর ‘মুক্তিযুদ্ধে’ মিত্রবাহিনীর বিজয়লাভ- স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। এক কোটির বেশি বাংলাদেশী শরণার্থী দেশে ফিরে গেলেও বহু হিন্দু পরিবার ওই রাস্তা মাড়ায় নি। যারা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের দেশে ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁই হয়ে সুখে শান্তিতে বাস করবেন বলে দেশের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন, তাদের ভুল ভাঙতে দেরি হয় নি। আওয়ামি লিগ নেতাদের মধ্যে প্রতিবেশী হিন্দুদের পরিত্যক্ত জমি-বাড়ি দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। গায়ের জোরে যারা সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি জবরদখল করতে লাগলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বাহাত্তরের অক্টোবরে শারদীয়া দুর্গাপূজায় প্রতিমাভাঙায় কোন‌ও ছেদ পড়ল না। মাত্র দশ মাসের ব্যবধানে কর্পূরের মতো বাংলাদেশের বায়ু থেকে কীভাবে মিলিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা! একটা বিষয় খুব পরিস্কার- বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মানস থেকে হিন্দু বিদ্বেষ-ঘৃণা দূর করতে ব্যর্থ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ প্রসূত ক্ষণিকের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিবের শাসন স্থায়ী হয়েছিল ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট ভোর পর্যন্ত। ততদিনে হিন্দুরা বুঝে যায়, তাদের জন্য পাকিস্তান আর বাংলাদেশে কোনও প্রভেদ নেই। মুজিব বেঁচে থাকতেই বহু হিন্দু পরিবার জমি-বাড়ি খুইয়ে পাড়ি দেয় ভারতে। পাকিস্তান জামানা হোক কি বাংলাদেশ, আওয়ামি রাজত্ব হোক কি জিয়া-এরশাদ-খালেদার শাসন, পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু নিষ্ক্রমণের ধারা কখনও বন্ধ হয় নি।

১৯৪১-এর আদমশুমারিতে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। দেশভাগের বছর সংখ্যাটা তিরিশ-বত্রিশ থাকার‌ই সম্ভাবনা। দেশভাগের পর ১৯৫১-য় পাকিস্তানের প্রথম সেনসাসে দেশটির পূর্ব অংশে হিন্দুর সংখ্যা কমে দাঁড়াল ২২ শতাংশ। দেশভাগ-দাঙ্গার জেরে মাত্র চারবছরে পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু হ্রাস পেল আট থেকে দশ শতাংশ। ১৯৬১-র জনগণনায় পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা নেমে হল ১৮.৫ শতাংশ। ৫১ থেকে ৬১- এই দশ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু কমল ৩.৫ শতাংশ। একাত্তর জুড়ে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ- পূর্ব পাকিস্তান টালমাটাল। আদমশুমারি হল না। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনগণনা- হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা দেখা গেল ১৩.৫ শতাংশ। মুক্তিযুদ্ধের তিন বছর পর থেকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা থিতু হওয়ার‌ই তো কথা। অথচ সাত বছর পর ১৯৮১-তে বাংলাদেশের দ্বিতীয় জনগণনায় দেখা গেল দেশটিতে হিন্দুর সংখ্যা কমে ১২.১ শতাংশ। ৭৪ থেকে ৮১- এই সাত বছরে বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট ভোরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নিধন- রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে আওয়ামি লিগের দীর্ঘ বিচ্ছেদের সূচনা। সামরিক অভ্যুত্থান- পাল্টা অভ্যুত্থান। শেষে সেনানায়ক জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল। ৭৪-৮১, এই সাত বছরে বাংলাদেশে হিন্দু হ্রাস পেল ১.৪ শতাংশ। ১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা আরও কমে হল ১০.৫ শতাংশ। ৮১ থেকে ৯১- দশ বছরে হিন্দু কমল ১.৬ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ একুশ বছর পর বাংলাদেশে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামি লিগ। পাঁচ বছর পরে সেনসাসে দেখা গেল, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতাপাদিত্যের দেশে হিন্দুর সংখ্যা কমে এক অঙ্কে- মাত্র ৯.২ শতাংশ! ১৯৯১ থেকে ২০০১- এই দশ বছরে বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ১.৩ শতাংশ। শেখ হাসিনার প্রথম পাঁচ বছরের শাসন‌ও হিন্দুদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে ব্যর্থ।

২০১১ সালে বাংলাদেশের পঞ্চম আদমশুমারিতে শেখ মুজিবের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের দেশ প্রথমবারের মতো নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে পরিণত হল। হিন্দুর সংখ্যা কমে দাঁড়াল মাত্র ৮.৫ শতাংশে! দশ বছরে হিন্দু কমল ০.৭ শতাংশ। ২০০১ থেকে ২০১১- এই সময়কালের মধ্যে পাঁচ বছর (২০০১-০৬) ছিল বিএনপি-জামাতের শাসন। একে বিএনপির সরকার, তায় দোসর জামায়াতে ইসলামি- সংখ্যালঘুদের অবস্থা কী হয়েছিল সহজেই অনুমেয়। আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের হিন্দুরা এক ধরণের মানসিক স্বস্তিতে থাকে। আওয়ামি লিগ সরকার প্রদত্ত নিরাপত্তার ছদ্মআশ্বাস‌ই এই স্বস্তির কারণ। বিএনপির মতো দলের আমলে এই আশ্বাসটুকুও মেলে না। ২০০১ থেকে ০৬- বিএনপি-জামাতের শাসন সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত হয়ে আছে। করোনা অতিমারির কারণে নির্ধারিত বছরে বাংলাদেশে আদমশুমারি করা সম্ভব হয় নি। তবে বাইশের অগাস্টে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ষষ্ঠ আদমশুমারির রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। বিবিএস-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭.৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১১ থেকে ২২- এই এগারো বছরে বাংলাদেশে হিন্দু কমেছে ০.৫৯ শতাংশ। এই এগারো বছরের পুরোটাই মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী (?) আওয়ামি লিগের অনমনীয় শাসনকাল। বিএনপি বিপর্যস্ত। জামায়াতে ইসলামি নিষিদ্ধ। মতিউর রহমান নিজামি সহ জামাতের চার শীর্ষনেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছেড়েছেন হাসিনা। কয়েকজন পচছে জেলে। কিন্তু তাতে সমাজ থেকে হিন্দু বিদ্বেষ বিন্দুমাত্র দূর হয় নি। বাংলাদেশ ‘ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস’-এর একটি হিসেব বলছে, স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে দেশটিতে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে ৭৫ লক্ষ। প্রতি দশকে গড়ে ১৫ লক্ষের বেশি হিন্দু কমে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। বিবিএস-এর প্রাথমিক সেনসাস প্রতিবেদন অনুযায়ী এই মুহুর্তে বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা ১ কোটি ৩১ লক্ষ ৩০ হাজার ১০৬। প্রতি দশকে ১৫ লক্ষ করে হিন্দু অদৃশ্য হতে থাকলে আগামী তিরিশ বছর পর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের দেশে কটা হিন্দু অবশিষ্ট থাকবে?

আওয়ামি লিগের সবথেকে বড় রাজনৈতিক সাফল্য হল, ভারত সহ বহির্বিশ্বকে এটা বিশ্বাস করানো যে তাদের আমলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা সবথেকে নিরাপদ ও শান্তিতে থাকে। আওয়ামি লিগ সংখ্যালঘুদের কেমন ভালবাসে, এই নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে অনেক রসিকতা চালু আছে। নিঃসন্দেহে আওয়ামি লিগ হিন্দুদের ঘনিষ্ঠ। কারণ হিন্দুদের ভোট ও জমিবাড়ি- দুটোর উপরেই সবথেকে বেশি হক মুজিবের দলের। বাহাত্তর থেকেই আওয়ামি লিগের নেতারা বুঝে যান, মালাউন মরলেও লাভ, বাঁচলেও লাভ। মালাউন দেশ ছাড়লেও লাভ, মার-গুঁতো খেয়ে দেশে থাকলেও লাভ। বাংলাদেশের নির্বল হিন্দুদের কাছে আওয়ামি লিগের অনুকম্পাটুকুই যথেষ্ট। তাই ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে নৌকা মার্কাতেই ছাপ মারে তারা। দেখা গেছে, হিন্দুর সম্পত্তি আত্মসাতে আওয়ামি লিগের নেতাদের অনেক পেছনে বিএনপি-জামাতের লোকেরা। বিএনপি-জামাতের লোকেরা হিন্দুর জমিবাড়ি, ভিটেমাটি লুটে খেয়েছে শত্রু হিসেবে। আওয়ামি লিগের মস্ত সুবিধা, তারা বন্ধু সেজেই নিষ্ক্রমণরত হিন্দুর সম্পত্তি জলের দরে হাতিয়ে নিতে পারে। আওয়ামি লিগের ধূর্ত কোন‌ও গ্রাম্যনেতা তাই পান চিবুতে চিবুতে বলতেই পারে- “মালাউন দ্যাশে থাকলে তাগো ভোটটা আমাগো। চ‌ইল্যা গ্যালে মালাউনের জমিডা আমাগো।” টানা ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশ আওয়ামি শাসনে। এই ১৪ বছরে কি জমিবাড়ি, ভিটেমাটি থেকে হিন্দুদের উচ্ছেদ বন্ধ আছে? বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের দাবি, শেখ হাসিনার আমলেও প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি হামলা-জুলুমের ঘটনা ঘটছে সংখ্যালঘুদের উপর। অধিকাংশ ঘটনাই সংবাদ মাধ্যমে আসে না। হামলা-হুমকি-ধামকির একটা বড় কারণ দুর্বল সংখ্যালঘু পরিবারের এক ছটাক জমি দখল অথবা পরিবারের কিশোরী মেয়েটির দিকে নজর। গ্রামের দিকে নীরবে হিন্দু পাড়াগুলির চরিত্র বদলে যাচ্ছে। হিন্দু ঘর কমছে। হিন্দুর জমি-বাড়ি গোপনে হস্তান্তর হয়ে যাচ্ছে মুসলমানের কাছে। দশ বছর আগেও যেই গ্রামে ১০০ ঘর হিন্দু পরিবার ছিল। এখন সেখানে ২০-৩০ ঘর হিন্দু বাস করছে। নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দাবি করা আওয়ামি লিগের ঘোর জামানাতেই সংখ্যালঘু গ্রামগুলি এইভাবে সংখ্যাগুরুদের দখলে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের অভিযোগ, গত দশ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ১০ হাজার হামলার ঘটনা ঘটেছে।

শেখ হাসিনার জামানায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে অপমান-অপদস্থ ও নির্যাতন করার সবথেকে বড় উছিলা, ধর্মানুভূতিতে আঘাত। কলেজ পড়ুয়া থেকে কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুলের শিক্ষক থেকে গ্রামের‌ নিরীহ যুবক- হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউই নিরাপদ নন। ফেসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক পোস্ট করা হয়েছে- এই অভিযোগে যখন তখন যে কার‌ও বাড়িতে হামলা চলতে পারে। যে কার‌ও বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মিথ্যে অভিযোগ তুলে তাকে গ্রেফতার করানো যেতে পারে। এরপর বাকি থাকে- এই অজুহাতে গোটা হিন্দু গ্রাম আক্রমণ করে লুটপাট, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেওয়া। হিন্দুদের মন্দির-উপাসনালয় অবাধে ভাঙচুর করা। মসজিদে মাইক ফুঁকিয়ে হাজার হাজার লোককে উত্তেজিত করে হিন্দু গ্রাম আক্রমণের ডাক দেওয়া হয়। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। মালাউনের মহল্লা পুড়ে শ্মশান হ‌ওয়ার পর পুলিশ গিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। প্রত্যেকটি ঘটনায় পরে প্রমাণিত হয়েছে- হিন্দু সম্প্রদায়ের কার‌ও নামে ভুয়ো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য পোস্ট করে পরিকল্পনামাফিক উত্তেজনা ছড়ানো হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত সাপেক্ষে সত্যাসত্য যাচাই করার আগেই, ষড়যন্ত্রের শিকার হিন্দুকেই গ্রেফতার করে জেলে ভরেছে হাসিনার পুলিশ!

অদূর ভবিষ্যতে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় থাকুক আর নাই থাকুক, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির ইসলামিকরণ থেমে থাকবে না। তেইশের শেষে বাংলাদেশে নির্বাচন। শেখ হাসিনা যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরীয়া বলেই মনে হচ্ছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হাসিনাকে ডবল গেম খেলে যেতে হবেই। একদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হাসিনাকে প্রমাণ দিয়ে যেতে হবে, তিনি সাচ্চা ঈমানদার মুসলমান এবং নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে তাঁর চেয়ে ভালো ইসলামের খিদমত অন্য কেউ করতে অক্ষম। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে মুজিবকন্যাকে প্রমাণ করতে হবে ইসলামিক মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি একজন নিরলস যোদ্ধা। আওয়ামি লিগ সরকার কৌশলগত কারণে ভারতবান্ধব হলেও দেশের সংখ্যালঘুদের সুহৃদ নয়। হিন্দুদের প্রতি আওয়ামি লিগের ঐতিহাসিক প্রেমটিও আসলে একটি ধ্রুপদী রাজনৈতিক ছলনা। কোনও সন্দেহ নেই, আওয়ামির ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি মোহ‌ পূর্ববঙ্গের বাঙালিহিন্দু জনগোষ্ঠীর সর্বনাশের অন্যতম কারণ।

বাংলা পুঁথি ও মলাট-পাটাচিত্রের সন্ধানে – সুমন কুমার ঘোষ (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

বাংলা পুঁথি ও পাটাচিত্রর সন্ধানে

তন্ত্রাশ্রয়ী বাংলায় আদি-মধ্য যুগের (পাল – সেন যুগ) অবদানের একটি ছিল “কুল ও শীল”। অর্থাৎ, বাংলার মানুষ তাঁদের জীবিকা ও কাজ অনুযায়ী এক বিশেষ শ্রেনীর মর্যাদা পেতেন। তেমনই এক বিশেষ শক্তিশালী শিল্পগোষ্ঠী ছিলেন “সূত্রধর” সম্প্রদায়। এঁরাই কাঠ ও পাথরের ভাষ্কর্য থেকে শুরু করে পাটাচিত্র পর্যন্ত অঙ্কন করতেন। এই সম্প্রদায়েরই কয়েকজন আবার তাদের শিল্পকর্মের মর্যাদা হিসাবে “ভাস্কর” উপাধিও পেতেন। এখনকার দিনে যেমন বই, বইএর লেখক একজন হন, সেই বই হাজারটা কপি ছাপা হয়ে বেরোয়। সেযুগে তো তেমন ছাপাখানা ছিল না। সুতরাং, সেযুগে বই (পুঁথি) রচিত হত লেখকের দ্বারা, কিন্তু সেই বই কপি করতে হত হাতে লিখে ও হাতেই এঁকে। সেই পুঁথি লেখা ও পাটাচিত্র অঙ্কনের কাজটাই করত এই বিশেষ সূত্রধর সম্প্রদায়ের শিল্পীরা৷

এই সূত্রধর সম্প্রদায় ছাড়াও সেযুগে শিল্পকর্মে জড়িত ছিল আরো অনেক সম্প্রদায়। যেমন, তন্তুবায়, কংসাকার, কর্মকার, স্বর্ণকার ইত্যাদি। এনারা সামাজিক অবস্থানে নীচের দিকে হলেও সম্মান পেতেন। কারণ তখনও বৈদিক বর্ণবাদ খুব প্রকট ভাবে প্রভাব বিস্তার করেনি। ফলে, এইসব শিল্পকর্ম শুধু রাজা-জমিদার বা বড় ব্যাবসাকেন্দ্রীক বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সব শ্রেণীর মানুষই এই শিল্পকর্ম উপভোগ করতেন। যেমন, মঙ্গলকাব্য – জীবনী – আখ্যান কাব্য – পদাবলী কীর্তন – লোকসংগীত ইত্যাদি৷

অর্থাৎ, মধ্যযুগের এই বাংলার শিল্পকলা ছিল জন-উৎসের। পাল-সেন যুগের পর থেকে সেইসব “মার্গ” (ক্ল্যাসিক্যাল), শিল্পকলার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। অর্থাৎ, তেরো শতকের পর থেকে বাংলায় সেইসব “মার্গ” শিল্পকলা আর দেখাই যায় না প্রায়৷

ভাস্কর-সূত্রধর সম্প্রদায় যেমন পটচিত্র এঁকেছেন বহুযুগ ধরে, জাতপটুয়ারাও তেমন দিঘল পট এঁকে আসছেন। এই দুই গোষ্ঠীরই পরম্পরাগত শিক্ষা ছিল। জাতপটুয়াদের কাজ অনেকটা লোকায়েত উৎসের আর ভাস্কর-সূত্রধর বা কুম্ভকারদের পটে নকশা, সূক্ষ্ম কারুকাজের প্রাধান্য ছিল। বাংলার প্রাচীন টোরাকোটা মন্দিরগুলোতে এইসব পাটাচিত্র ও পটেরই ভাস্কর্যরূপ দেখা যায়৷

চিত্রকলায় পারদর্শী সূত্রধর শিল্পীদের সম্পর্কে কবিকঙ্কণচণ্ডীতে মুকুন্দরামের উল্লেখ –

ছুতারপুরের মাঝে চিঁড়া কুটে মুড়ি ভাজে কেউ চিত্র করায় নির্মাণ।
হুদ্দারার চৌকাঠে সূত্রধর চিত্র গঠে সবপু সমান কপাট।”

অতএব বোঝাই যাচ্ছে, চিত্রকররা আদৃত ছিলেন সেযুগে। উপেক্ষিত হলে মঙ্গলকাব্য, জীবনীকাব্যগুলোতে তাঁদের উল্লেখ পাওয়া যেত না৷

পাল-সেন যুগের পরে ষোড়শ শতকের দিকে বাংলায় চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব আন্দোলনে বাংলায় ভক্তিবাদ প্রবল হয়েছিল। জাতিভেদ (বৈদিক বর্ণবাদ) ও অস্পৃশ্যতা বিরোধী এই আন্দোলন সেই সময়ে সব শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। এই ভাবপ্রাবল্য, সেই সময়টায় বঙ্গীয় শিল্পীসমাজ বৈষ্ণব ভাবধারার প্রাবল্য হেতু চৈতন্যকেন্দ্রিক ও কৃষ্ণকেন্দ্রিক শিল্পকলায় প্রাণীত হয়েছিলেন। এরই ফল হল, ষোড়শ শতকের দিকে রচিত পুঁথির লেখা সহ পাটায় চৈতন্যদেব ও কৃষ্ণচিত্রের আধিক্য। এরই প্রভাবে বাংলায় গড়ে উঠেছিল বহু টোরাকাটা মন্দির ও ওইসব মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির ভাস্কর্য। টোরাকাটা মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্য গুলো সহ সেই সময়কার পুঁথিগুলোর পাটায় দশাবতার কৃষ্ণের বিবিধ লীলা, পৌরাণিক কাহিনি, চৈতন্যলীলা, রামায়ণ মহাভারতের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়। বাংলার শিল্পকলায় এই বৈষ্ণব ভাবপ্রাবল্য ষোড়শ শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল৷

পনেরো শতকের দিকে বাংলায় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মা মনসা। বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-নৃত্যে মা মনসার কাহিনির এক বিশিষ্ট স্থান আছে, তার প্রমাণ হল প্রায় শতাধিক মনসামঙ্গলের রচয়িতার পরিচয় আবিস্কৃত হওয়ায়। এ পর্যন্ত যত দিঘল পট বা লাটাই পট পাওয়া গেছে, তার এক পঞ্চমাংশই হল মা মনসার পট৷

বাংলায় পনের শতকের আগে কোনো লিখিত মনসামঙ্গলের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে, পনেরো শতকের পরের দিকে অনেকগুলো মনসামঙ্গলের সন্ধান পাওয়া গেলে সেটা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, মনসামঙ্গল বাংলায় কতটা জনপ্রিয় ছিল। আজও বিবিধ আঙ্গিকে মনসাপূজার প্রচলন আছে। পটুয়ারা এখনো মনসাপট আঁকেন৷

বাংলার সংস্কৃতিতে মনসার এই জনপ্রিয়তার কারণ হল, সেযুগে মা মনসার পুজোর প্রচলনটা ব্যাপক ভাবেই ছিল। সমসাময়িক সময়ে জনপ্রিয়তায় প্রথম সারিতে ছিলেন আর এক মাতৃকা, চন্ডী। এই চন্ডীর জনপ্রিয়তা দিয়ে মা মনসাকে ঢাকা দেবার একটা প্রয়াস এযুগে (সেযুগে নয় কিন্তু) হয়েছে। বলা বাহুল্য, চন্ডি আর মনসা উভয়েই তন্ত্রাশ্রয়ী বাঙালির নিজস্ব মাতৃকা।

বর্তমানে যা দেখা যায়, মা মনসার বিভিন্ন থানে উপাসনায় যোগ দেন মূলত নিম্নবর্গীয় ও আদিবাসী বাঙালীরা। এসব দেখিয়ে মা মনসার উপরে একটা বর্ণবাদী তকমা জুটিয়ে দিয়ে মনসাকে আরো পিছনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই মনসামঙ্গল প্রমাণ করে নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গ নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণির মধ্যেই মা মনসার পূজার প্রচলন ছিল সেযুগে। যেটা তন্ত্রের বর্ণবাদ পরিহার করার দর্শনের অনুসারী।

উনিশ শতকের দিকেই বাংলায় চিত্রিত পুঁথির যুগ শেষ হয়। এরপর থেকেই ছাপাখানার যুগ চলে আসে। ১৮১৬ সালের দিকে সচিত্র অন্নদামঙ্গল ছাপা হয়৷

খুব দুঃখের বিষয়, বাংলার মধ্যযুগের পুঁথি ও চিত্রকলার বৃতান্ত নিয়ে কাজও হয়েছে খুব সামান্য। সংরক্ষণের অভাবে সেযুগের পুঁথি সহ চিত্রকলার নিদর্শন প্রায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। রক্ষা পেয়েছে শুধু কয়েকটি পুঁথি আর পাটাচিত্র। তবে নিঃসন্দেহে একথাটা বলা যায় যে, মধ্যযুগের সর্বস্তরের মানুষ এখনকার চেয়েও অনেক বেশি করে সাহিত্যরস ও চিত্রালোকে উপভোগ করতেন৷

বাংলার পুঁথি নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের কিছু অভিজ্ঞতা শুনুন –

পুঁথি সংগ্রহের কাজটি মুখে বলা যত সহজ, বাস্তবে তেমনি দুরূহ। আমাদের দেশের পুঁথি-মালিকরা (যাঁরা পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পুঁথির অধিকারী) অধিকাংশক্ষেত্রেই সাধারণ গৃহস্থ মাত্র। অনেকেরই আর্থিক অবস্থা আগের মত সচ্ছল নয়। খুব কম ক্ষেত্রেই শিক্ষিত-মার্জিত পুঁথি-মালিকের সন্ধান মেলে। সকলেই পূর্বপুরুষের সযত্নলালিত প্রাচীন পুঁথির রাশিকে আশ্রয় দিয়েছেন গোয়ালঘরের মাচা, জ্বালানী বা ঘুঁটের মাচা, কোঠাবাড়ির তেতলায় ভাঙ্গা তোরঙ্গে কাগজপত্র বা ভাঙা আসবাবপত্রের সঙ্গে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে পুঁথিকে ভক্তিভরে পূজো করা হলেও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি আবর্জনার সামিল। চরম অবজ্ঞার শিকার৷

অবহেলা অনাদরে পড়ে থাকা এইসব পুঁথি ভিক্ষা চাইতে গেলেই নানা আপত্তি। ধারণা, এসব পুঁথি বিক্রি করে বা গোপনে বিদেশে পাচার করে সংগ্রাহক প্রচুর অর্থ উপার্জন করে থাকেন!

সংস্কৃত সাহিত্যের এক প্রবীণ অধ্যাপকের বাড়ির ঘুঁটের মাচায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা অর্ধশতাধিক বাংলা-সংস্কৃত-তুলট ও তালপাতার পুঁথি তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার উদারতায় হস্তগত করেও পরে এই অধ্যাপকের অভিশাপআর রক্তচক্ষুরতাড়নায় নিরূপায় হয়ে আবার তা ফেরৎ দিয়ে আসতে হয়। ১৯৭৮ এর বন্যায় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কোন এক গ্রামে সেই অধ্যাপক মহোদয়ের পুরোনো মাটির বাড়িটি ভেঙে যায়, বিনষ্ট হয় সেই সব অমূল্য পুঁথি। এই জেলারই ঘাটাল মহকুমার এক একদা জমিদার বাড়ির ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গীতে রক্ষিত বিশাল পুঁথির স্তুপ একবার দেখতে চেয়েও পাওয়া যায়নি। সেগুলি বন্যায় বিনষ্ট হয়৷

এ ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে বহুস্থানে (আবার বাড়ি এসেও কেউ কেউ পুঁথি দিয়ে গেছেন।) নিজেদের বিষয়সম্পত্তি বা গুপ্তধনের খোঁজ বাইরের লোক জেনে ফেলবে, এজন্যও পুঁথি বা দলিলদস্তাবেজ কাউকে দেখানো হয় না৷

বর্ধমান জেলার উখড়ার কোন এক স্থানে নাগরী লিপির অজস্র পুঁথি আর পুরোনো দলিল দস্তাবেজ নেড়ে চেড়ে দেখার সময় কর্তৃপক্ষ কড়ানজর রাখেন, কোন নোট” নেওয়া হচ্ছে কীনা তা দেখতে৷

পুঁথিকে নিয়ে এদেশের মানুষের নানা লোকবিশ্বাসের অস্ত নেই। বহু পুঁথি তাই নদীতে, পুকুরে বা জ্বলন্ত আগুনে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। উৎকট ভক্তিবশতঃ নিয়মিত ফুল জল দিয়ে পুজো করে বহু পুঁথিকে নষ্ট করা হয়েছে৷

১৯৭৮ এর বন্যায় মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী জেলার নানা স্থানের হাজার হাজার পুঁথি ভেসে গেছে। সময়মত এসব পুঁথি সংগ্রহশালায় দান করলে বা আগ্রহী গবেষকের হাতে তুলে দিলে সেগুলি রক্ষা পেতো। অবশ্য কিছু উদার হৃদয় মানুষের করুণায় যযৎসামান্য কিছু পুঁথিই সময়মত রক্ষা পেয়েছে৷

পুরোনো ছাপা বই, হাতে লেখা যে কোন পুরোনো কাগজ সবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা পুঁথির গবেষকের কাছে সংস্কৃত পুঁথি অতি প্রয়োজনীয়না হলেও অবশ্যই সংগ্রহ ও সংরক্ষণযোগ্য। পুঁথির সন্ধান পাওয়া গেলেই তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা জাতীয় কর্তব্য – যদি তা অনাদৃত অবস্থায় থাকে। মূল্য দিয়ে, উপহার দিয়ে, ছাপা বই দিয়ে পুঁথি পাওয়া যাবে। অনেক সময় ছলনার আশ্রয় নিয়েও পুঁথিকে রক্ষা করতে হবে৷

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা পুঁথি সংগ্রহের পথপ্রদর্শক। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিংশবার্ষিক অধিবেশনে তিনি (৩১ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১) সভাপতির ভাষণে বলেন –

ভট্টাচার্য মহাশয় পুঁথি পড়িয়া পণ্ডিত হইয়াছিলেন, পৈতৃক পুঁথিগুলিকে প্রাণাপেক্ষাও প্রিয় দেখিতেন, সর্বদা সেগুলিকে ঝাড়াঝুড়া করিতেন, পুরু কাপড়ে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া রাখিতেন। তাহার ছেলে ইংরাজী স্কুলে পড়িতে গেল, ক্রমে চাকরি করিতে গেল, বাবার বড়ো আদরের জিনিষ, পুঁথিগুলিকে রক্ষা করিল, ফেলিয়া দিল না। ভট্টাচার্য মহাশয়ের পৌত্র অল্প ইংরাজী লেখাপড়া শিখিল, তার পরে চাকরি করিতে গেল, পুঁথি-পাজির কোনো ধারও ধারিল না। পৌত্রবধূ বাড়ি আসিয়া দেখিলেন এক জায়গায় কত আবর্জনা রহিয়াছে। ছেঁড়া ময়লা কালো ন্যাকড়ায় জড়ানো কতকগুলা কাগজ রহিয়াছে, তিনি সেইগুলিকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিলেন। হয়তো রাঁধিবার সময় কাঁচা কাঠে ফুঁ দিতে দিতে সেই ধোঁয়ায় চোখ জ্বলিতে লাগিল, তখন পুঁথি অথবা তাহার পাটার (কাঠের কভার / যেগুলোকে আমরা বর্তমানে হার্ড কভারবলে জানি) কথা মনে পড়িল। সুবিধা পাইলেন তো একখানা পুঁথি উনানে দিয়া ফেলিলেন অথবা পুথির পাতাগুলি ফেলিয়া দিয়া বহুকালের শুষ্ক কাঠের পাটা দুখানি উনানে দিয়া সেদিনকার রান্না সারিয়া লইলেন৷

১৯০৪ সালে একবার নবদ্বীপ গিয়াছিলাম, দেখিলাম একজনের বাড়ির পিছনে রাস্তার ধারে রাশীকৃত পুঁথির পাতা পচিতেছে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম যে, ওই পুঁথিটির পাটাগুলি পোড়ানো হইয়াছে। বাড়ির গিন্নিমা সরস্বতীকে পোড়াতে চান না, তাই পুঁথির পৃষ্ঠাগুলি বাড়ির বাহিরে ফেলিয়া দিয়াছেন। যে বাড়ির গিন্নির মা সরস্বতীর উপর এতটুকু কৃপা নাই, তাহারা পুঁথির পাতা লইয়া কী করেন, অনায়াসে বুঝা যায়।” (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১ম সংখ্যা, ১৩২১)৷

একটি বেদনাময় অনুভূতি এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না। এদেশের পুঁথি প্রেমীদের বোধহয় যন্ত্রণা দিয়ে চলে এই কারণেঃ –

এদেশের লক্ষ লক্ষ পুঁথি তো দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেছে। চীনা পরিব্রাজকদের সময় থেকে শুরু করে আজও ভারতীয় পুঁথির বিদেশযাত্রা অব্যাহত আছে। প্রাচীন কালের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। মধ্যযুগও তাই। আধুনিককালে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি হয়ে এসে (১৭৮৩ খ্রীঃ) এদেশে প্রচুর পুঁথি সংগ্রহকরেন স্যর উইলিয়াম জোন্স (ইনিই বিশ্ববিখ্যাত সারস্বত প্রতিষ্ঠান, এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন)। সব না হলেও কিছুই কি তিনি নিজের দেশে নিয়ে যান নি? মার্ক অরেল স্টাইন, কর্নেল বাওয়ার, মাক্সমূলার, এদেশের হাজার হাজার পুঁথি সংগ্রহ করেছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। সেইসব পুঁথি ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়ার সংগ্রহশালায় আছে৷

মহারাষ্ট্র সরকারে চাকরী করতে এসে ব্যুলার (১৮৬৩ খ্রীঃ) এদেশের হাজার হাজার পুঁথি সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। এইসব বিদেশগত লক্ষাধিক পুঁথির মধ্যে বাংলা পুঁথি কি আদৌ ছিল না? ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীর বাংলা পুঁথিগুলিতো এদেশ থেকেই নিয়ে যাওয়া!

এভাবেই যে কত গুরুত্বপূর্ণ পুঁথি এদেশে কারোর ব্যাক্তিগত সংগ্রহে থেকেও হারিয়ে গিয়েছে, তার ইয়াত্বা নেই। তেমনই কিছু হারিয়ে যাওয়া পুঁথির নমুনা শোনা যাক এখানে –

১. চুঁচুড়া গীতগোবিন্দ-

চুচুঁড়ার এক প্রাচীন জমিদার পরিবার, জে সি মন্ডলের ব্যাক্তিগত সংগ্রহে গীতগোবিন্দের একটা পুঁথি ছিল। যতটুকু জানা যায়, পুঁথিটির ৩৭ টি পাতা ছিল। প্রতিটি পাতার সাইজ ৩৫ সেন্টিমিটার বাই ২৮ সেন্টিমিটার। আয়তাকার প্রতিটি পাতার চারিদিকে ঘিরে চারটি বা ছয়টি কাংড়া শৈলীতে রাধাকৃষ্ণ বা কৃষ্ণ লীলার ছবি অঙ্কিত। প্রতিটি অঙ্কিত পাতার মধ্যাংশে বাংলা অক্ষরে গীতগোবিন্দের কয়েকটি করে শ্লোক, পংক্তি লেখা ছিল। বঙ্গাক্ষরে লেখা শ্লোকগুলা আর ছবির কিছু অংশ ‘হাইলাইট’ করার জন্য সোনার জল ব্যবহার করা হয়েছিল। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য ওই গীতগোবিন্দের পুঁথিটির নামই হয়ে ছিল “চুঁচুড়া গীতগোবিন্দ”৷

চুঁচুড়া গীতগোবিন্দর পুঁথিটির একটি পাতা

পুঁথিটির বর্তমানে আর কোনো হদিস নেই..!! ১৯৩৪ সালের দিকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় “জার্নাল অব ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট” নামে বইতে সম্পাদনা করতেন ডঃ স্টেলা ক্রামারিশ। এই ডঃ স্টেলা ক্রামারিশ ওই চুঁচুড়া গীতগোবিন্দের অঙ্কনশৈলী নিয়ে কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ছবি সহ। এটাই একমাত্র সম্বল ওই চুঁচুড়া গীতগোবিন্দের সম্পর্কে জানার জন্য। তবে, জার্নাল অব ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট এর বইগুলো ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে হয়ত একসময় এই চুঁচুড়া গীতগোবিন্দের আর কোনো প্রমাণই থাকবে না। ডঃ ক্রামারিশ চুঁচুড়া গীতগোবিন্দের অঙ্কনশৈলী থেকে অনুমান করেছিলেন পুঁথিটি উনিশ শতকে লিখিত৷

২. ত্রিপুরার একটি অখ্যাত গ্রাম থেকে বাংলা অক্ষরে লিখিত এক প্রাচীন ভগবত পুরাণের পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত।  পুঁথিটির বিবরণ সম্পর্কে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলেন, “পুঁথিটির পাটায় চিত্রিত আছে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান (বোধহয় চিত্রকর কোনো নবাব বা বাদশাহের আদর্শ লইয়া ছবি আঁকিয়াছেন) গালিচার উপরে সুখোপবিষ্ট। সন্মুখে গড়গড়া। গড়গড়াটা একটা বিচিত্র রকমের। চিত্রিত মানুষটি তাকিয়া ঠেসান দিয়া এক হাতে গড়গড়ার নলটি ধরিয়া তামাক খাইতেছে। অপর হাতখানা তাকিয়ার উপরে রক্ষিত ছোরা ধরিয়া অবস্থিত। পাটাখানির ভিতরের দিকে নয়টি মাতৃ মূর্তি। পিছনের পাটায় দশাবতার অঙ্কিত।”৷

বর্তমানে এই পুঁথিটিরও কোনো হদিস নেই৷

৩. রজতানন্দ দাশগুপ্তর লেখা থেকে জানা গিয়েছিল, পনের শতকের চিত্রিত বঙ্গলিপতে হরিবংশের একটি চিত্রিত পুঁথি এশিয়াটিক সোসাইটিতে দেখেছিলেন রাই কৃষ্ণদাস। বিস্তারিত বিবরণ খুব বেশি নেই, তবে এই পুঁথিটিও হারিয়ে গেছে৷

৪. ডঃ ত্রিপুরা বসু ব্যাক্তিগত উদ্যোগে দুর্গাপুরের অদূরে সাগরভাঙা গ্রামের সাধন গুঁইয়ের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে একটা পুঁথি উদ্ধার করে এনেছিলেন। পুঁথিটির পাটাচিত্রটি এরকম ছিল – “দু-দল বৈষ্ণব কোমর বেঁধে ঘুষি বাগিয়ে পরস্পরের উদ্দেশে মারমুখী ভঙ্গিতে। একদল বৈষ্ণবের মাঝে কোনো বিশিষ্ট বৈষ্ণব দন্ডায়মান।”

এরকম অনাবিষ্কৃত, অনালোচিত পুঁথির পাটাচিত্রের সন্ধান আজ গ্রাম বাংলায় অনেক পাওয়া গেলেও, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সাথে সহজিয়া বৈষ্ণবদের এমন মারামারির দৃশ্য নিয়ে আর কোনো পুঁথির পাটাচিত্র অঙ্কিত হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে, বর্তমানে ওই পুঁথি সহ তার পাটাচিত্র হারিয়ে গিয়েছে৷

৫. আর এক হারিয়ে যাওয়া পুঁথি হল, শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্ণামৃত। এই সদুক্তিকর্ণামৃতর কোনো পান্ডুলিপি আর অবশিষ্ট নেই। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্স সদুক্তিকর্ণামৃতর যে পাঠোদ্ধার করিয়েছিলেন, ওটাই একমাত্র সম্বল।

“সদুক্তিকর্ণামৃত” হল, লক্ষ্মণ সেনের সময়ের জনপ্রিয় কয়েকজন কবি, জয়দেব, শরণ, উমাপতিধর, ধোয়ী, গোবর্ধন আচার্য ছাড়াও ধ্রুপদী যুগের লেখক যেমন, কালিদাস, ভবভূতি, অমরু, প্রবরসেন, রাজশেখর, বরাহমিহির, বিশাখদত্ত প্রভৃতি বাঙালি কবির লেখা কিছু বিখ্যাত ও জনপ্রিয় শ্লোক সংগ্রহ করে লেখা এক সংকলন। এর মধ্যে বল্লালসেন, লক্ষ্মণ সেন, কেশবসেন প্রমুখ রাজকবির শ্লোকও স্থান পায়। এরকম প্রায় ৪৭৫ টিরও অধিক কবির রচিত প্রায় ২৩৭০ টি শ্লোক / পংক্তি (যার মধ্যে আবার অনেকগুলো শ্লোকের রচয়িতার নাম জানতেন না শ্রীধর দাস। সেযুগে বিখ্যাত শ্লোক হিসাবে শ্লোক গুলো নথিবদ্ধ করেছেন শ্রীধর দাস) উদ্ধৃত করার মাধ্যমে শ্রীধর দাস সংকলিত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিল “সদুক্তিকর্ণামৃত” নামে৷

লক্ষ্মণ সেনের পঞ্চরত্নের একজন, উমাপতিধর। এর কোনো মুখ্য রচনা আজও পাওয়া যায়নি। একমাত্র লক্ষ্মণ সেনের পিতামহ বিজয়সেনের দেওপাড়া শিলালেখটি উমাপতিধর রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। আর জয়দেবের গীতগোবিন্দতে উমাপতিধরের একটু প্রশংসা শোনা যায় শুধু। কিন্তু, শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্ণামৃততে উমাপতিধরের বিখ্যাত ৯২ টি শ্লোক স্থান পেয়েছে৷

অতএব, বোঝা যাচ্ছে সদুক্তিকর্ণামৃতর গুরুত্ব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর পান্ডুলিপি আর একটাও নেই। হারিয়ে গিয়েছে৷

এরকমই হারিয়ে যাওয়া পুঁথির নমুনা দেখাতে গেলে অকারণে হতাশা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। আমাদের এইসব পুঁথি যে এক মুল্যবান সম্পদ, আশা করি যথেষ্ট বোঝাতে পারলাম। পুঁথিগুলোর দুরবস্থা সম্পর্কে এতক্ষন অনেক কিছুই লিখলাম। এবার গৌড়-বঙ্গে রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য, গীতগোবিন্দকে নিয়ে কিছু তথ্য ও তার দার্শনিক গুরুত্ব আলোচনা করে লেখাটা সমাপ্ত করি। বলা বাহুল্য, বাঙালির গীতগোবিন্দ নিয়েও যা টানাহেঁচড়া চলছে বোধহয় এই মূল্যবান সম্পদটিও খুব দ্রুত হারিয়ে যাবে বাঙালির ইতিহাস থেকে।

জয়দেব ও তার রচিত গীতগোবিন্দ বাঙালি জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জয়দেবের গীতগোবিন্দই আমাদের প্রথম বুঝতে শিখিয়েছিল “রাধা ব্যাতিত কৃষ্ণ সম্ভব নয়”৷

চর্চার অভাবে, গুরুত্বের অভাবে, ঔদাসিন্যে বাঙালির এই অমুল্য সম্পদটিও চুরি হয়ে গেছে। কারা চুরি করেছে?? পাশের রাজ্য, উড়িষ্যা…!!! বলা বাহুল্য, আর এক অমূল্য সম্পদ, “সদুক্তিকর্ণামৃত” র পান্ডুলিপিও হারিয়ে গেছে ওই ঔদাসিন্যে।

সরকারি মদতে এমন চুরি নজিরবিহীন…!! ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। চুরির নমুনা দেখুন –

১.  ইন্টারনেট ঘাঁটলে ১২ শতকের (12 th Common Era, মানে ১১০০ থেকে ১২০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। এটাই লক্ষ্মণ সেনের সময়কাল।)  লেখা গীতগোবিন্দের পান্ডুলিপির আসল তথ্য সহ ছবি কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। সব জায়গায় দেখা যাবে উড়িয়া লিপিতে তালপাতার পান্ডুলিপি গীতগোবিন্দ। উড়েদের দাবী, গীতগোবিন্দ উড়িয়া(?? নাকি সংস্কৃত?) ভাষায় উড়িয়া লিপিতে লিখেছিল জয়দেব!

অথচ ইতিহাস বলছে, জয়দেবের গীতগোবিন্দর একটি পান্ডুলিপি আবিষ্কার করেছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স। যিনি ওই গীতগোবিন্দের ইংরেজি অনুবাদ করে ইউরোপে ভারতীয় সংস্কৃতির মাধুর্য সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। এবং ওই থেকেই বিশ্ববিখ্যাত সারস্বত প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সদুক্তিকর্ণামৃতের পান্ডুলিপিরও পাঠোদ্ধার করিয়েছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স। তবে উভয় পান্ডুলিপি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয় (এর মধ্যে সদুক্তিকর্ণামৃতর পান্ডুলিপি তো হারিয়েই গেছে। অন্যটিরও হারিয়ে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়)। তার বদলে “সমসাময়িক” (যদিও অনেক পরে রচিত) সময়ে রচিত পরিস্কার বাংলা লিপিতে লেখা বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভগবত’ পান্ডুলিপি এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরিতে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে৷

বাংলা লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা গীতগোবিন্দের পান্ডুলিপি কিছু আছে। তবে, সেগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহশালায় গীতগোবিন্দের একটা পান্ডুলিপি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত আছে, যেটা বাংলা লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা। তবে ওটা দ্বাদশ শতকের লেখা পান্ডুলিপি নয়। ওটা সপ্তদশ শতকে (অর্থাৎ ১৬০০ থেকে ১৭০০ খ্রীস্টাব্দে) লেখা গীতগোবিন্দের পান্ডুলিপি৷

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহশালায় রক্ষিত গীতগোবিন্দের পান্ডুলিপির অংশ।

২. উড়িষ্যার সরকারি মদতে একটা চক্র ক্রমাগত ইতিহাসবিকৃত করে জয়দেবকে উড়িয়া বলে, পুরীর অদূরে কেন্দুলি শ্মশান নামক গ্রামে জয়দেবের জন্মস্থান হিসাবে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে৷

অথচ জয়দেবের আসল জন্মস্থান হল বীরভূমের সিউড়ির অদূরে অজয় নদীর তীরে কেন্দুলি গ্রামে। সেই মধ্যযুগ থেকে আজও পৌষ মাসে বিখ্যাত জয়দেব মেলা হয় কেন্দুলিতে। সেই মেলায় যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা পরিস্কার দেখেছেন ওখানে জয়দেব ও পদ্মাবতীর নাম মুখে মুখে ফেরে এবং ওদের মন্দিরও আছে ওখানে। বাউল ও কীর্তনীয়াদের বিপুল সমাগমের এমন বিখ্যাত মেলা হয় একমাত্র বীরভূমের কেন্দুলির জয়দেব মেলায়, জয়দেবের স্মরণে৷

৩. উড়েদের দাবী, জয়দেব কস্মিনকালেও লক্ষ্মনসেনের রাজসভায় যাননি। গীতগোবিন্দ রচিত হয়েছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে বসে! এই মর্মে ওরা কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে একটা স্ট্যাম্পও প্রকাশ করিয়েছে। এমনকি ২০১১ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসে উড়িষ্যার ট্যাবলয়েডে দেখা গিয়েছিল জয়দেব গীতগোবিন্দ রচনা করছে, জয়দেবের ঠিক পিছনেই পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির৷

কিন্তু গুজরাট থেকে প্রাপ্ত একটা মিনিয়েচার পেইন্টিং ইঙ্গিত করছে লক্ষ্মনসেনের সভার পঞ্চরত্নের ছবিতে জয়দেবের উপস্থিতি!

এই সেই মিনিয়েচার পেইন্টিং। Pancharatna of the court of King Laxmansena, Miniature Painting, Jain technique, Gujrat, C. 1520 A.D.

৪. কৌন বনেগা ক্রোড়পতি নামে অমিতাভ বচ্চনের একটা টেলিভিশন অনুষ্ঠানে জয়দেবকে লক্ষ্মণসেনের সভাকবি বলার অপরাধে উড়িষ্যা থেকে মামলা করা হয়েছিল!

উড়িষ্যা সরকারের এই বিপুল উদ্যোগ আর মদতে আজও ইন্টারনেটে সমস্ত রিসোর্সে দেখা যাবে জয়দেব উড়িয়া কবি!

এরকম চুরি নতুন নয়৷ এর আগেও বাঙালির চর্যাপদ চুরি করেছে উড়ে রা। এর ফল হল, উড়িয়া ভাষার ধ্রুপদী মর্যাদা জুটে গেল। বাংলা ভাষা আর বাঙালির কপালে ফাঁকা হাড়ি জুটল (যার আওয়াজটাও আবার জোরালো নয়)৷

এবার বোঝা যাচ্ছে, জয়দেব ও তার রচিত গীতগোবিন্দর গুরুত্ব??!! এত চুরি সত্বেও “দর্শন” টা তো আর চুরি করা যায় না। গীতগোবিন্দের মধ্যে নিহিত বাঙালির নিজিস্ব দর্শন সম্পর্কে গবেষণাতেও বাঙালি গবেষকদের অনীহা চোখে পড়ার মত। মাত্র দুজন, প্রশান্ত দাশগুপ্ত এবং হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় জয়দেব ও গীতগোবিন্দ নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে এই দু’জনে প্রায়ত। এবং এখন একমাত্র তমাল দাশগুপ্ত নিজস্ব উদ্যোগে গীতগোবিন্দের দার্শনিক গুরুত্ব বাঙালির সামনে আনার চেষ্টা করেছেন ও যুক্তি দিয়ে এইসব উড়িয়া দাবী খন্ডন করেছেন মাত্র, তাও বহু হুমকি, বহু বাধা বিপত্তির ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে৷

এবার একটু গীতগোবিন্দের দার্শনিক গুরুত্বটা অনুধাবন করা যাক। তবেই তো বোঝা যাবে গীতগোবিন্দ আসলে কি জিনিস!

১. লক্ষ্মনসেনের পঞ্চরত্নের একজন জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দ। গীতগোবিন্দ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ নিহাররঞ্জন রায় বলেছেন –

“রাধাকৃষ্ণর প্রেমলীলার উপর শ্রুতিমধুর, শৃঙ্গার ভাবনাময়, রসাবেশময় গানের রচয়িতা হিসাবে জয়দেবের পক্ষে রসিক বৈষ্ণব সমাজে এবং জনগনের মধ্যে প্রতিষ্ঠালাভ সহজেই সম্ভব হয়েছিল। পরে একবার যখন গীতগোবিন্দ চৈতন্যোত্তর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম মূল প্রেরণা বলে স্বীকৃত হইল, তখন গীতগোবিন্দ হয়ে উঠিল ধর্মগ্রন্থ এবং জয়দেব হইলেন দিব্যোন্মাদ সাধক”৷

কি বোঝা গেল? গীতগোবিন্দ একসময় “ধর্মগ্রন্থ” মর্যাদা পেয়েছিল। এই মর্যাদার বলে গীতগোবিন্দ দেশের সর্বত্র বিভিন্ন লিপিতে কপি সংস্করণ বেরিয়েছিল। (সেযুগে তো আর ছাপাখানা ছিল না, যা হত সবই এই হাতে লেখা তালপাতার পুঁথি। বই এর মত বিক্রিও হত কপি করে লেখা। অবশ্য সংস্কৃত ভাষায়। মনে রাখতে হবে, সংস্কৃত কেবলমাত্র ভাষা, এর নিজস্ব কোনো লিপি নেই। সংস্কৃত ভাষা আঞ্চলিক লিপি দিয়েই প্রকাশ হত সারা দেশের অঞ্চলভেদে।)৷

২. বর্তমানে যেমন “বন্দেমাতরম” একটা স্লোগান বা জয়ধ্বনী। ঠিক সেইরকমই একটা স্লোগান বা জয়ধ্বনী মধ্যযুগের প্রথম দিকে সম্রাট লক্ষ্মনসেনের সময়ে ছিল “রাধামাধবয়োর্জয়ন্তী”। এটা কোথা থেকে গৃহীত বলুন তো? এই জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে গৃহীত৷

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত গীতগোবিন্দের পান্ডুলিপির অংশ। পরিস্কার একটা শব্দ “রাধামাধবয়োর্জয়ন্তী” দেখতে পাচ্ছেন কি??

৩. এই গীতগোবিন্দের আর এক অমর পংক্তি “দেহি পদপল্লবমুদারম” এটাই হল বাঙালির নিজস্ব দর্শনের প্রমাণ। দেহি পদপল্লবমুদারম অর্থাৎ শ্রীরাধার পা ধরে সাধনারত কৃষ্ণ। যেটা বাঙালির আবহমানকালের নিজস্ব দর্শন। ঠিক যেমনটা মা কালীর পায়ের নীচে শুয়ে থাকা শিব, অর্থাৎ “শক্তির পায়ের তলায় শুয়ে থাকা শিব”৷

কি বোঝা গেল? বাংলার অবৈদিক ঐতিহ্য, “প্রকৃতি” কে খুঁজে পাওয়া গেল গীতগোবিন্দতে? প্রকৃতি, যাকে ইংরেজিতে বলে Feminine Principle. যেটা দার্শনিক দৃষ্টিতে বৈষ্ণবের রাধা আর শাক্তের কালী বা দুর্গা। এই প্রকৃতির উপাসনা বাঙালির নিজস্ব উত্তরাধিকার। এই দর্শন বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবন৷

“দেহি পদপল্লবমুদারম” শব্দটা খুঁজে পেলেন কেউ ছবিটায়??!! ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহশালায় রক্ষিত সপ্তদশ শতকে লিখিত পান্ডুলিপির একটা অংশের শেষ লাইনে স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে পংক্তিটি।
চুঁচুড়া গীতগোবিন্দে দেহি পদপল্লবমুদারম মুহুর্তের চিত্র৷

৪. দর্শন বিষয়ে প্রচলিত “সাপ্লিমেন্ট” নামে একটা শব্দের মর্ম বুঝতে হবে। সাপ্লিমেন্ট এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে “সম্পূরক”। দর্শনে কিছু সাপ্লিমেন্ট মূল টেক্সট বা কনসেপ্টকে ছাপিয়ে যেতে পারে। যেমন, মৌখিক ভাষার সাপ্লিমেন্ট হিসাবে মানুষ একসময় উদ্ভাবন করেছিল লিপি। লিপি শুরুতে ভাষার ‘সম্পুরক’ বা ‘সাপ্লিমেন্ট’ হিসাবে কাজ করে, কিন্তু গুরুত্বের বিচারে লিপি, ভাষাকেও ছাপিয়ে যায়৷

ঠিক তেমনই দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে, জয়দেবের গীতগোবিন্দতে অসামান্য মধুর রাধা ভাবনা হল বৃন্দাবনে কৃষ্ণের গোপীপরিবৃত প্রেমলীলার সাপ্লিমেন্ট। এবং স্বাভাবিকভাবেই এই সাপ্লিমেন্ট গুলো তাদের অরিজিনালকে ছাপিয়ে গেছে। এবং এটাই কৃষ্ণচরিত্রকে সুমহান করে তুলেছে। কাজেই, শ্রীরাধাকে বাদ দিয়ে আজ আর কোনো কৃষ্ণ সম্ভব নয়, ঠিক যেমনটা বর্ণমালাকে বাদ দিলে ভাষা আর দাঁড়াতে পারে না৷

এই হল গীতগোবিন্দের “দর্শন”। যা “মাতৃকা উপাসক” বাঙালির আবহমানকালের নিজস্ব দর্শন। যেটা উড়ে দের মধ্যে নেই৷

বোঝা গেল এবার, কেন “রাধা ব্যাতিত কৃষ্ণ সম্ভব নয়” এবং বাংলার পুঁথি ও তার পাটাচিত্র কেন খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির দুর্ভাগ্য, ধীরে ধীরে এইসব অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে৷

তথ্যসূত্রঃ-
১. “The Radha Idea at the Crossroads of History, Culture and Politics: Gitagovinda and the Boishnob Movement in Bengal”. By Tamal Dasgupta, Journal of Bengali Studies, Vol. 3, No. 1, 14 May 2014, Buddhapurnima, 30 Boishakh 1421, Summer Issue.

২. বাঙালির সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাস ১৫ সেনযুগ – সঙ্ঘর্ষ, সমন্বয়, সৃষ্টি, সপ্তডিঙা কালীপুজো সংখ্যা ১৪২৫, Shoptodina Vol 4 No 4 2018,  ISSN 2395 6054, – ডঃ তমাল দাশগুপ্ত।

৩. গীতগোবিন্দ ও ভারত-সংস্কৃতি। The Asiatic Society publication, November 2019.

৪. বাংলার চিত্রকলা মধ্যযুগ থেকে কালীঘাট – অঞ্জন সেন৷

৫. বাংলা পান্ডুলিপি পাঠ পরিক্রমা – ত্রিপুরা বসু৷

৬. সরসীকুমার সরস্বতী – পাল যুগের চিত্রকলা৷

৭. বাংলার চিত্রকলা – অশোক ভট্টাচার্য।