সাত সমুদ্র তেরো নদীঃ বাঙালির মাতৃধর্মের আদি আন্তর্জাতিক চলাচল – ডঃ তমাল দাশগুপ্ত (মাৎস্যন্যায় পুজোসংখ্যা ১৪২৯)

সিংহমাতৃকা, প্রাচীন মিশর, চতুর্দশ খ্রিষ্টপূর্ব শতক। এঁর নাম ছিল সেখমেট, ইনিই রক্ষা করতেন সূর্যদেবতা রা-কে। ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ এই সিংহমুখ মাতৃকার উপাসনা করতেন।

Abstract: এই প্রবন্ধে বাঙালির শেকড়ে থাকা আবহমান মাতৃকা উপাসনার সবথেকে জনপ্রিয় ফরম্যাট দুর্গাপুজোর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ও চলাচল সম্পর্কে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ঐতিহাসিক আদিযুগ পর্যন্ত সময়ানুক্রম মেনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রেক্ষিতে মূলত ইউরেশিয়া জুড়ে যেভাবে প্রত্নপ্রমাণসহ বিদ্যমান, সেই আলোচনা করা হয়েছে।

Keywords: জগদকারণ প্রকৃতি, সর্বকারণকারণম্‌, ভিলেনডর্ফ ভেনাস, বার্নি রিলিফ, ইনান্না, ইশ্‌তার, আনাহিতা, নানা, আল-লাত, সিংহবাহিনী, হরপ্পা সভ্যতার ব্যাঘ্রধারিণী মাতৃকা, হরপ্পা সভ্যতার ঊষা, সুমের, এলামাইট, মিশর, জাভা, বালি, ইউরোপ, আনাতোলিয়ার উপবিষ্ট সিংহবাহিনী, ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না, চন্দ্রকেতুগড়, গঙ্গারিডাই, সানুচর সসন্তান দশায়ুধা, সিংহবাহিনী চণ্ডী, চুন্দা/চন্দ্রী/চন্দ্রদেবী, মা দুর্গা, ভয়াভয়, যোদ্ধামাতৃকা।

প্রাগ্‌কথন

ইউনেস্কো সম্প্রতি বাঙালির দুর্গাপুজোকে  একটি আন্তর্জাতিক সম্মানের শিরোপা দিয়েছে (Intangible Cultural Heritage of Humanity), যা এই বিপুল মহতী শ্রেষ্ঠ শারদোৎসবের অনন্ত বিস্তারের প্রতি এক সামান্য স্বীকৃতি মাত্র। বাঙালির দুর্গাপুজো সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আগ্রহ আছে, পশ্চিমের গবেষকরা পৃথিবীর একমাত্র জীবন্ত মহামাতৃকাধর্মের প্রতি সঙ্গত কারণেই আগ্রহী, সেজন্য বাঙালির দুর্গা ও কালী সম্পর্কে ইউরোপ আমেরিকায় নিয়মিত আলোচনা, গবেষণা, প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। কিন্তু এই আগ্রহের পেছনে একটি অবচেতন ও অন্তর্লীন সত্য কাজ করেঃ বাঙালির মাতৃধর্ম প্রকৃতপক্ষে সারা পৃথিবীরই মাতৃধর্মের গর্বিত ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহন করে। এই প্রবন্ধে আমরা দেখব, বর্তমান পৃথিবীর একমাত্র মাতৃকা উপাসক মহাজাতি এই বাঙালির মাতৃধর্মে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের প্রাচীন মাতৃধর্মের সারাৎসার এসে মিশেছে, এবং বাঙালির মাতৃকা উপাসক তন্ত্রধর্মের বিশ্বজনীন প্রসার ঘটেছে একাধিক মহাদেশ জুড়ে। বিশেষত বাঙালি হল সমগ্র ইউরেশিয়ার মাতৃধর্মের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী। অতএব আমাদের ধর্মের এই আন্তর্জাতিক চলাচলের ইতিহাস অন্বেষণ বাঙালি হিসেবে আমাদের কর্তব্য।

প্রাচীন যুগে রূপকথার কাহিনীগুলোতে এক আশ্চর্য চলাচলের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত নাবিকরা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে বহন করে নিয়ে যেতেন। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন নানাভাবে ঘটে, এবং তা কিছু ক্ষেত্রে আমাদের স্বার্থে ঘটে, যেমন দু হাজার বছর আগে প্লিনির আক্ষেপ যে রোমের সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা বাংলায় চলে যাচ্ছে পিপ্পলী কিনতে গিয়েঃ তা ছিল বাঙালির বাণিজ্যের বিশ্বায়ন।

রোমান সিংহবাহিনী মাতৃকা সিবিল। এই মূর্তি আছে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে, এই নগরের শ্রেষ্ঠতম প্রতীকগুলির মধ্যে গণ্য। One of the best known symbols of the city of Madrid

বস্তুত ধর্ম সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ গণসংস্কৃতি। ধর্ম হল বৃহৎ মানবসভ্যতা এবং বৃহৎ মানব সম্প্রদায় গঠনের প্রথম ও প্রধান শর্ত। এবং ধর্মের প্রসার, বিস্তার, চলাচল অতি প্রাচীন কাল থেকে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ঘটাচ্ছে। মাতৃধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম,  ত্রিশ হাজার বছর পুরোনো প্রস্তর যুগের মাতৃমূর্তি ((Venus of Willendorf) সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং তন্ত্রধর্ম পৃথিবীর প্রথম বিশ্বজনীন ধর্ম, পাঁচ হাজার বছর পুরোনো হরপ্পা সভ্যতার ব্যাঘ্রধারিণী মাতৃকামূর্তি সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে, কারণ অনুরূপ মূর্তি পাওয়া গেছে এলামাইট থেকে মিশরের সভ্যতা পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুই মহাদেশ জুড়ে। মাতৃকা উপাসক তন্ত্রধর্মী হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত অনেকগুলি প্রত্নফলকে দুদিকে দুটি বাঘকে শমিত করছেন মাতৃকা, যা তন্ত্রের ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যবর্তী সুষুম্না – এই তিন নাড়ির ভারসাম্যের প্রতীক। আমরা সেই আলোচনায় আসব, তবে আমরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ঐতিহাসিক সময়ের ধারাবাহিকতা মেনে এগোব।

এক

জগদকারণ প্রকৃতি থেকে সমগ্র বিশ্বচরাচর সৃষ্ট হয়েছে। তিনি সকল কারণের কারণ, সর্বকারণকারণম্‌। তিনিই উৎস, তিনিই আদ্যা। তিনি অব্যক্ত, কারণ তাঁকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু ধ্যানের সুবিধার জন্য তাঁকে মা বলে উপাসনা করার প্রথা সুপ্রাচীন। কারণ মা যেমন সন্তান প্রসব করেন, তিনিই উৎসে আছেন, জগদকারণ প্রকৃতি তেমন জগৎপ্রসবিনী। তিনি প্রথাগত অর্থে আল্লা ঈশ্বর গডের মত মানবকল্পনা নন, প্রকৃতি হলেন আদিবস্তু, primordial matter। সাংখ্য দর্শনের সবথেকে বিখ্যাত উক্তি ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ, অর্থাৎ ইশ্বরের অস্তিত্ব অসিদ্ধ। প্রকৃতির দর্শন এবং মাতৃধর্ম আর পাঁচটা ধর্মের মত ভাববাদী নয়। তন্ত্র অতীব বস্তুনিষ্ঠ, সাংখ্য অনুযায়ী মনন এসেছে প্রকৃতি থেকেই, অর্থাৎ ম্যাটার থেকে কনশাসনেস এসেছে। এ যে কত বড় বৈপ্লবিক ধর্ম তা শতসহস্রমুখে বলে শেষ করা যায় না।

পৃথিবীর সর্বপ্রথম মাতৃমূর্তি রূপে ত্রিশ হাজার বছর পুরোনো প্রাচীন প্রস্তর যুগের ভিলেনডর্ফের ভেনাস গণ্য হয়ে থাকে। এটি একটি গর্ভিনী পৃথুলা মূর্তি, সিঁদুর (red ochre) চর্চিত, মধ্য ইউরোপে অস্ট্রিয়ার ভিলেনডর্ফ নামক স্থানে পাওয়া গেছে বলে এই নাম, এমন একপ্রকার লাইমস্টোন দ্বারা এই মূর্তি নির্মিত যা ঐ স্থানে পাওয়া যায় না, অতএব সেই প্রাচীন প্রস্তর যুগেই এই মূর্তি নির্মাণে কাঁচামাল রূপে ব্যবহৃত পাথর বাইরে কোথাও থেকে এখানে এনে তবেই এটি তৈরি করা হয়েছিল। এই মূর্তি বর্তমানে ভিয়েনার মিউজিয়ামে আছে। মাতৃধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম, মানব সভ্যতার উষাকালে প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তরযুগে তা প্রচলিত হয়েছিল, এই মাতৃমূর্তি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রসঙ্গত এই রকমের পৃথুলা গর্ভিনী মাতৃমূর্তি ইউরেশিয়া অঞ্চল থেকে আরও অনেক পাওয়া গেছে, এগুলোকে ইউরোপের গবেষকরা ভেনাস বলেন।

ভিলেনডর্ফের ভেনাস
ইউরোপ জুড়ে প্রাপ্ত আদি মাতৃমূর্তি, তথাকথিত ভেনাস মূর্তি। এই মাতৃকা দিগবসনা, নগ্নিকা, কারণ তিনি আদ্যা এবং তিনি জন্মদাত্রী। যেহেতু ভেনাস নামে রোমানদের এক নগ্ন দেবী ছিলেন, তাই এই নগ্ন মাতৃমূর্তিগুলির এমন নাম দিয়েছেন ইউরোপের গবেষকরা।

মাতৃকা উপাসক তন্ত্রধর্ম বাঙালির গৌরবের উত্তরাধিকার। সাংখ্য ও তন্ত্রের জগদকারণ প্রকৃতিই আমাদের কাছে জগৎপ্রসবিনী জগন্মাতা। মা দুর্গার মূর্তিকল্প আজ এই এই বিমূর্ত অব্যক্ত প্রকৃতিকেই চিহ্নিত করে। সেই জগদকারণ প্রকৃতির প্রথম বিমূর্ত ধারণা থেকে প্রথম বাস্তব মূর্তিকল্প রূপে এই মূর্তি অবশ্যই বিশ্বপ্রসবিনী জগন্মাতার দ্যোতনা বহন করে।

দুই

বর্তমান তুরস্কের অর্থাৎ আদি গ্রীসের আনাতোলিয়া অঞ্চলে চ্যাটালহুইক (Çatalhöyük) নামক স্থানে একজন পৃথুলা (যিনি সম্ভবত গর্ভিনী) মাতৃকার উপবিষ্ট মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে, আক্ষরিক অর্থেই সিংহাসনে বসে আছেন তিনি, দুদিকে দুটি সিংহ। এটি নব্য প্রস্তর যুগের মূর্তি, মোটামুটি ছয় হাজার বছর পুরোনো। এবং পৃথিবীর আদিতম সিংহবাহিনী মূর্তি এটিই। 

তথাকথিত সিটেড উয়োম্যান অভ চ্যাটালহুইক। ইনি আদি সিংহবাহিনী।

এখান থেকেই পরবর্তী যুগে গ্রীসে পূজিত মাতৃকা সিংহবাহিনী মাতৃকা সিবিল (Cybele) এসেছেন এমন মনে করেন গবেষকরা। পরবর্তীকালে রোমানদের মধ্যেও গ্রীক সিংহবাহিনী মাতৃকা সিবিল জনপ্রিয় ছিলেন, তাঁকে Magna Mater বলা হত, যে নামের অর্থ মহামাতৃকা, মহাদেবী।

ফ্রিজিয়ানদের কাছে ইনিই মাটার কুবিলেয়া (Matar Kubileya), যে নামের অর্থ গিরিবাসিনী মাতা। প্রসঙ্গত  পার্বত্য সিংহ এঁর বাহন ছিল। চিত্তাকর্ষকভাবে এই ফ্রিজিয়ান সিংহবাহিনী মাতৃকার মণ্ডলে বাহন সিংহ ছাড়াও শিকারি পাখি উপস্থিত থাকত বলে জানা যাচ্ছে, যদিও এই আদর্শে নির্মিত মণ্ডল আমি খুঁজে পাইনি।

ফ্রিজিয়ান সিংহবাহিনী গিরিবাসিনী মাতা। গ্রীক/রোমান Kybele/Cybele এর পূর্বসূরী ইনিই

প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক যুগের পৃথিবীর সিংহবাহিনী নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মেসোপটেমিয়া  থেকে প্রাপ্ত বার্নি রিলিফ উল্লেখ্য। মোটামুটি ১৮০০-১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে উৎকীর্ণ এই মূর্তি, অর্থাৎ প্রায় পাণ্ডু রাজার ঢিবির সমান পুরোনো, বা চার হাজার বছর পুরোনো। বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অবস্থিত। এঁর মূর্তিমণ্ডলে সিংহ এবং শিকারি পাখি (প্যাঁচা) দেখা যেত। আমাদের লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা, এবং মহালক্ষ্মী সিংহবাহিনী হন। পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে বলাকামাতৃকা পূজিত হতেন, এবং সমসাময়িক পরিণত বা অন্তিম হরপ্পা সভ্যতার মাতৃধর্মেও একজন বলাকামাতৃকা ছিলেন। আজ এই পক্ষীমাতৃকার ঐতিহ্য মা কালীর মধ্যে বহমান, এই বিষয়ে আমি আগে লেখালেখি করেছি। কালিদাসের কাব্যে মা কালী বলাকিনী বলে উল্লিখিত, এবং মা কালীর আবরণ “নিত্যা”গণের মধ্যে একজন বলাকা। পৃথিবীতে বলাকামাতৃকার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যার উত্তরাধিকার বাঙালি জাতি বহন করে, বাঙালির পূর্বসূরী বলাকামাতৃকার পুজো করতেন, এজন্যই বাঙালিকে বয়াংসি বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে বৈদিক সাহিত্যে। অতুল সুর সিদ্ধান্ত করেছিলেন, এই বয়াংসি অর্থ এই যে আদি বাঙালি বলাকাপূজক ছিলেন। আজকের বাঙালি এই ঐতিহাসিক তথ্য জানে না, কিন্তু সে কালীপুজোর মাধ্যমে নিজের সেই শেকড়কে আজও উদযাপন করে, এবং সেই সঙ্গে আদি মাতৃধর্ম ও তন্ত্রধর্মের এক বিশ্বজনীন প্রসারের সাক্ষ্য বহন করে।

বার্নি রিলিফ। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত এই প্রত্নফলকের দেবীমূর্তিকে রাত্রির অধিষ্ঠাত্রী (কুইন অভ দ্য নাইট) বলা হয়। স্মর্তব্য, অনেকেই ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্ত থেকে মা কালীর উৎস গণ্য করেন, যদিও আমরা জানি মা কালী বেদপূর্ব।

সিংহবাহিনী মাতৃকার প্রসঙ্গে ফিরি। বার্নি রিলিফ যে মাতৃকার রূপকল্প বহন করে, তাঁকে সুমের সভ্যতার এরেশ্‌কিগাল বা পৃথ্বীদেবী আখ্যা দেওয়া হয়েছে গবেষকদের দ্বারা, আবার তাঁকে সুমের সভ্যতায় পূজিত ইনান্না, এবং পরবর্তীকালের আক্কাডিয়ান, ব্যাবিলনিয়ান ও অ্যাসিরিয়ান  সভ্যতায় পূজিত ইশ্‌তার রূপেও দেখা হয়েছে, যেখানে তিনি আকাশমাতৃকা। মেসোপটেমিয়ার উরুক নগরের অধিষ্ঠাত্রী স্থানেশ্বরী মাতৃকা ছিলেন ইশ্‌তার, আজ থেকে ছয় হাজার বছর আগেকার কথা। তিনি সিংহবাহিনী অষ্টকোণ তারা রূপেও পূজিত হতেন।

সিংহবাহিনী ইশ্‌তার, আক্কাডিয়ান সিল, ২৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট মিজিয়ামে রক্ষিত আছে এই সিংহবাহিনী ইশতার ফলক।
আকাশের অধিষ্ঠাত্রী ইশতার, সিংহবাহিনী। ওয়ার্ল্ডহিস্ট্রি ডট অর্গ থেকে।
আনাহিতা সিংহবাহিনী। ছবি পিন্টারেস্ট থেকে

আবার পরবর্তী পারস্যে জনপ্রিয় মাতৃকা আনাহিতাকে দেখা যাচ্ছে সিংহবাহিনী রূপে, তিনি আবার জলদেবী। তিনি পদ্মালয়া, পদ্ম তাঁর প্রতীক। জরাথুস্ট্রের ধর্মেও এই আনাহিতা পূজিত ছিলেন। প্রসঙ্গত প্রাচীন পারস্যের একটি মূর্তি ইন্টারনেটে বেশ জনপ্রিয়, সিংহবাহন বা সিংহবাহিনী এই মূর্তির পেছনে অনেকগুলি শিখা বা শলাকা দেখা যাচ্ছে, এঁকে আনাহিতা বলছেন বেশ কিছু গবেষক, কিন্তু এখানে ইনি সম্ভবত সূর্যের প্রতীক। প্রসঙ্গত হরপ্পা সভ্যতায় উপাস্য ছিলেন ঊষা (ডি ডি কোসাম্বি দ্রষ্টব্য) যিনি সূর্যমাতৃকা। এমন ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে হরপ্পা সভ্যতায় ব্যাঘ্রধারিণী মায়ের মাথার পেছনে যে শলাকার আভাস দেখি, সেগুলি কিরণ। ঊষাকে দশভুজা বলা হয়েছে বৈদিক সাহিত্যে, এবং তাঁর শারদীয়া বোধন হত, সুকুমার সেন দ্রষ্টব্য।

এই চিত্রে রাজা দ্বিতীয় Artaxerxes সিংহবাহিনী আনাহিতার উপাসনা করছেন, booksfact.com সাইটের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে।

প্রাচীন ব্যাক্ট্রিয়া বা বর্তমান পূর্ব ইরান ও আফগানিস্তান অঞ্চলে একজন জনপ্রিয় মাতৃকা ছিলেন নানা,  তাঁর সঙ্গে আনাহিতার সম্পর্ক আছে। কুষাণ যুগে এই সিংহবাহিনী মাতৃকা বিশেষভাবে আরাধ্যা, অর্থাৎ ইনি খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ভারতভূমিতে পূজিত হতে থাকেন, এবং এরপর গুপ্তসাম্রাজ্যের সময় থেকে ভারতে আমরা নিয়মিত সিংহবাহিনী দেখতে পাই। গুপ্তোত্তর কালে শশাঙ্কযুগে বৃহৎ বঙ্গে সিংহবাহিনী চণ্ডী পূজিত হতেন, সেই প্রত্নপ্রমাণ নালন্দা থেকে প্রাপ্ত ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের একটি সিংহবাহিনী মূর্তির সীল দিচ্ছে, যে ছবি আমার ফেসবুক পেজে দিয়েছি আগে। আর এই যুগেই অর্থাৎ ষষ্ঠ শতকেই সিংহবাহিনী মাতৃকার আরাধনায় শ্রীশ্রীচণ্ডী রচিত হয়, যেখানে হরপ্পা সভ্যতার প্রাচীন মহিষমেধের স্মৃতিবাহী, মহাভারতের দুর্গাস্তবে মহিষসৃক্‌প্রিয়ে (মহিষের রক্ত যাঁর প্রিয়) সম্বোধনে আরাধ্যা মা দুর্গার উপাসনায় বলির  মোষটি প্রথমবারের জন্য মহিষাসুরে রূপান্তরিতঃ খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকেই মহিষমর্দিনী মূর্তি নিয়মিত পাওয়া গেছে, যেখানে মা স্বহস্তে মহিষমেধ করছেন। কিন্তু শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রভাবে মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি আসবে, এবং সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি প্রথমবারের জন্য অষ্টম শতকে মামাল্লাপুরমে দেখা যায়। পালযুগে তা বাংলায় প্রচলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

পঞ্চম শতকের মূর্তি। সিংহবাহিনী নানা। বর্তমান আফগানিস্তান অঞ্চলে পূজিত ছিলেন। শক্তিপীঠ হিংলাজ তীর্থে পূজিত বিবি নানী এই নানা মাতৃকার স্মৃতিবাহী। মূর্তিটি মেট মিউজিয়ামে আছে।

এর কিছু আগে থেকেই মূলত বাঙালি বণিকদের উদ্যোগে চুন্দা বা চণ্ডীর উপাসনা মালয় উপদ্বীপপুঞ্জের সুমাত্রা বালি, জাভা, বোর্নিও প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত হয়, দীনেশ সেনের বৃহৎ বঙ্গ গ্রন্থে এরকম একটি পর্যবেক্ষণ আছে। আমরা জানি অষ্টম শতকে পালসম্রাট গোপালের আরাধ্যা উপাস্য মাতৃকা ছিলেন চুন্দা। আদি মহিষমর্দিনী রূপেই জাভা অঞ্চলে মায়ের পুজো চালু হয়েছিল, কারণ পদতলে বধ্য মহিষটি এই অঞ্চলের সমস্ত দুর্গামূর্তির একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য।

জাভা অঞ্চলে উৎকীর্ণ দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের দুর্গামূর্তি, Mpu Tantular Museum, Pasuruan Candis, East Java

চণ্ডী নামটি আসলে এসেছে চন্দ্রী থেকে, এই মত সুকুমার সেনের। আমরা জানি পালযুগের চুন্দাও চন্দ্রমাতৃকা। এই প্রসঙ্গে ইসলামপূর্ব আরবের আল-লাত স্মর্তব্য হতে পারেন। তিনি চন্দ্রদেবী, এবং তিনি সিংহবাহিনী। এঁকে অবশ্য পরে আল্লার কন্যা বলে চালানোর একটা প্রয়াস হয়েছে (কোরানের কয়েকটি আয়াত এই মাতৃদেবীর উদ্দেশ্যে, যদিও মহম্মদ পরে সেগুলি ফেরত নেন এবং বলেন শয়তানের প্রভাবে এগুলি সৃষ্ট, সেই থেকে রুশদির সেটানিক ভার্সেস)। তা সে তো মাতৃধর্মের বিশ্বজনীন বিড়ম্বনা, কিন্তু সিংহবাহিনী আল-লাত আসলে আল্লার তুলনায় বেশি প্রাচীন, মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

সিরিয়ার প্রাচীন পালমিরা নগরে প্রাপ্ত সিংহবাহিনী আল-লাত। প্রথম শতক। যুদ্ধদীর্ণ ও ইসলামিক স্টেট আক্রান্ত সিরিয়ার দামাস্কাসের জাতীয় মিউজিয়াম থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে, এই মাতৃমূর্তির বর্তমান অবস্থান জার্মানির Mainz শহরে RGZM জাদুঘর।

সিংহবাহিনী মাতৃকার বিপুল উপস্থিতি পৃথিবীর মাতৃসাধনার এক ধারাবাহিক ঐতিহ্য নির্মাণ করে। একটি মাতৃধর্মী সভ্যতার পতন ঘটলে সেখান থেকে রসদ নিয়ে আরেকটি সভ্যতা যেন রিলে রেসের মত এই সিংহবাহিনী জগন্মাতার উপাসনার ঐতিহ্যের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে, আজকে যে জীবন্ত জ্বলন্ত বহমান শিখায় বাঙালি মহাজাতিরই চূড়ান্ত অধিকার ও উত্তরাধিকার।

তিন

চন্দ্রকেতুগড় থেকে দুই হাজার বছর আগেকার একটি নৃত্যরত সিংহবাহিনী মূর্তি পাওয়া গেছে, সানুচর, চার সহচর রয়েছে। মূর্তির পাদদেশে দুটি সিংহ। এই মূর্তি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে, কারণ ভারত তথা গৌড়বঙ্গভূমিতে সিংহবাহিনীর ইতিহাসে এই মূর্তি একটি মাইলস্টোন, সম্ভবত বাংলায় প্রথম সিংহবাহিনী মূর্তি এটিই।  যদিও চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতার অন্তিম কালে কুষাণ সাম্রাজ্য সবে শুরু হয়ে থাকতে পারে, ফলে সেখান থেকে একটি চলাচলের সম্ভাবনা আছে। রাঢ়বঙ্গে সেই সময় সিংহ ছিল। বিজয়সিংহের কাহিনী সাক্ষ্য দিচ্ছে, সিংহ সম্পর্কে রাঢ় অঞ্চলে রূপকথকতা ও মহাকাব্যিক চেতনা ছিল। চন্দ্রকেতুগড়ে কোনও নিয়মবদ্ধ পর্যাপ্ত খনন হয়নি, কাজেই সেখানে কি ছিল আর কি ছিল না নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু গজদন্ত নির্মিত ক্ষুদ্র সিংহ পাওয়া গেছে এবং ডানাসহ সিংহ পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতুগড়ে, কাজেই সিংহ পরিচিত প্রাণী ছিল। কিন্তু চন্দ্রকেতুগড়ের এই নির্দিষ্ট সিংহবাহিনী মূর্তির ছবি এখানে দেব না (আমার ফেসবুক পেজে আগে দিয়েছি), কারণ আমরা এই প্রবন্ধে বাংলা তথা ভারত ব্যতিরেকে বাকি বিশ্বের মাতৃসাধনার চলাচল কিভাবে আমাদের এই মাতৃকা উপাসক মহাজাতির গর্বের উত্তরাধিকারে মিশে আছে সেই আলোচনা করছি, তাই চন্দ্রকেতুগড় সিংহবাহিনী মূর্তি সরাসরি আমাদের আলোচনার প্রতিপাদ্যের অংশ নয়।

হরপ্পা সভ্যতা মাতৃধর্মী ছিল, কিন্তু সেখানকার উৎখননে এখনও পর্যন্ত কোনও সিংহবাহিনী পাওয়া যায় নি। একজন ব্যাঘ্রধারিণী মাতৃকার বেশ কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গেছে, যিনি দুই হাতে দুটি বাঘের টুঁটি চেপে ধরে শমিত করছেন। এই মূর্তিটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আস্কো পার্পোলা তাঁর রুটস অভ হিন্দুইজম গ্রন্থে বলছেন এই মূর্তির নানা রূপান্তর পাওয়া গেছে সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতায়। মিশরে এই মূর্তিতে দুদিকে দুটি সিংহ, এবং তাদের ধরে আছেন প্রিস্ট কিং। এলামাইট সভ্যতায় বৃষ উপাসনা প্রচলিত ছিল, সেখানে একটি বৃষ দুদিকে দুটি সিংহকে ধরে শমিত করছে। এই আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় মোটিফগুলিকে কন্টেস্ট বা দ্বন্দ্ব আখ্যা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এটি প্রকৃতপক্ষে দ্বন্দ্ব নিরসন, কন্টেস্ট রেজলিউশন। আমি আগে আমার বিভিন্ন লেখায় বলেছি হরপ্পা সভ্যতায় তন্ত্রধর্ম প্রচলিত ছিল। এখানে হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে বাকি পৃথিবীর তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার তন্ত্রধর্মীয় চলাচল সম্পর্কে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ রাখব।

হরপ্পা সভ্যতার ব্যাঘ্রধারিণী মাতৃমূর্তি

প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতার তথাকথিত পশুপতি মূর্তি আসলে হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃধর্মের পুরোহিত ছিলেন, তিনি মহিষমেধ রিচুয়ালে পৌরহিত্য করতেন এবং বলির মহিষটির শৃঙ্গ তাঁর মস্তকে ধারণ করতেন যোগাসনে উপবিষ্ট হয়ে। এই মর্মে সাম্প্রতিককালের গবেষক বিশেষ করে শিরিন রত্নাগর এবং আস্কো পার্পোলার মধ্যে ঐক্যমত্য আছে। মূর্তিটি যোগাসনে উপবিষ্ট। সুকুমার সেন বলেন যোগী শব্দের আদি ব্যুৎপত্তি হল যিনি পুজো ও উপাসনার যোগান দেন। যোগ ও যোগাসন সেক্ষেত্রে হরপ্পা সভ্যতার মাতৃধর্মের  যোগান দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। যোগাসনে উপবিষ্ট আদি পশুপতি মূর্তির সঙ্গে বিষয়টা মিলে যাচ্ছে।

এই মূর্তিটির অনুরূপ মূর্তি প্রাচীন কেল্ট জাতির মধ্যে পাওয়া গেছে। নিঃসন্দেহে এটি তন্ত্রধর্মের আন্তর্জাতিক চলাচলের অন্যতম সাক্ষ্য। এই মূর্তির ব্রাত্য অবৈদিক আর্য তাৎপর্য নিয়ে ডঃ রৈবতক সেনগুপ্ত আগে পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ লিখেছেন।

Gundestrup Cauldron যা হরপ্পার পশুপতির অনুরূপ, যা তন্ত্রধর্মের পুরোহিত বা কেল্ট জাতির ড্রুইড শ্রেণী বোঝায়
হরপ্পা সভ্যতার ‘পশুপতি’

দ্বিতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতার ব্যাঘ্রধারিণী মাতৃকা এবং এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে তাম্রাশ্ম সভ্যতায় এই মূর্তির নানা রূপভেদ আসলে তন্ত্রের প্রথম বিশ্বজনীন ধর্ম হয়ে ওঠার এক সাক্ষ্য বহন করে, কারণ মূর্তিটি ইড়া পিঙ্গলার মধ্যবর্তী সুষুম্নার প্রতীকঃ এটি দ্বন্দ্বের নিরসন ও সুষম ভারসাম্যের বার্তা বহন করে, এবং বুদ্ধ অনেক পরে যে মঝঝিম পন্থার বার্তা দেবেন, সেটির প্রেরণা অবশ্যই তন্ত্রের এই প্রাচীন প্রতীকের প্রজ্ঞা থেকে স্রোতস্বিনী হয়ে বহমান। এরপর প্রাচীন গ্রীসে সক্রেটিসের হাত ধরে যে ডায়ালেক্টিক্স দর্শনের উদ্ভব, তা তন্ত্রের এই দ্বন্দ্ব নিরসনের আবহমান বার্তা থেকেই জাত হয়েছিলঃ থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিস থেকে সিন্থেসিস-এ উত্তরণ।

প্রাচীন মিশর, ৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। লুভর মিউজিয়ামে আছে।
প্রাচীন ইরান। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক।
আস্কো পার্পোলার বই রুটস অভ হিন্দুইজম থেকে
আস্কো পার্পোলা, রুটস অভ হিন্দুইজম।

তৃতীয়ত, হরপ্পা পরবর্তী ভারতে এই মূর্তির আদি দ্যোতনা কিছুটা লুপ্ত হলেও নানাভাবে এই তিনের দ্যোতনা ফিরে এসেছে, যখন অনেক পরে আমরা বুদ্ধ ধর্ম সঙ্ঘ এই তিনের শরণ নিয়েছি। এই  ত্রিপাদ ত্রিরত্ন নানা রূপে ফিরে এসেছে, বল-কৃষ্ণ-একানংশা থেকে আজকের জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা দ্রষ্টব্য। এবং চন্দ্রকেতুগড়ে পূজিত মায়ের দুদিকে দুজন গণ দেখা যায় অনেক মূর্তিতে। যদিও অধিকতর জনপ্রিয় দশায়ুধা মূর্তির সঙ্গে দুদিকে দেখি চার অনুচর, যে চার সংখ্যাটি দুই থেকে বর্ধিত হয়ে এসেছে বলে সিদ্ধান্ত করা যায়। দুই সহচর এবং চার সহচর পরিবেষ্টিত মাতৃকার মণ্ডল তন্ত্রের সঙ্গে সাযুজ্য বহন করে। তন্ত্রে তিন নাড়ির ধারণা যেমন আছে, তেমন পাঁচ নাড়িও আছে। গঙ্গারিডাই সভ্যতার এই জনপ্রিয় মূর্তিকল্প আর্যাবর্ত আগ্রাসনে বিলুপ্ত হলেও তা বাঙালির মধ্যে  অন্তর্লীনভাবে বহমান থাকে, তাই আজও মা দুর্গার সপরিবার স-সন্তান উপাসনা করে বাঙালি। পালযুগের মাতৃমূর্তির দুদিকে জয়া বিজয়া বা গণেশ ও স্কন্দ থাকেন, এবং চার সন্তান বা চার অনুচর-সহ পালযুগের দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। দুই হাতে দুটি সর্প ধারণ করে আছেন এমন মনসা মূর্তি আমি গোয়ায় দেখেছি। আবার শান্তাদুর্গা, যিনি গোয়ায় গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণদের পূজিত মা দুর্গা, তিনি দুই হাতে  যুজুধান পুরুষ দেবতা শিব ও বিষ্ণুকে শমিত করেন, এই মূর্তিকল্প আছে।

দুদিকে দুই সহচর পরিবেষ্টিত ফ্রিজিয়ান মাতৃমূর্তি। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক, আনাতোলিয়া।

চার

মাতৃধর্ম এককালে সর্বাধিক জনপ্রিয় বিশ্বব্যাপী গণধর্ম ছিল। লৌহযুগ নেমে আসার পরে সর্বত্র দেখা যাচ্ছে মাতৃধর্ম পিছু হটছে, তাম্রাশ্ম যুগে মাতৃধর্ম যেমন শক্তিশালী ছিল, লৌহযুগ আসার পরে মাতৃধর্ম ক্রমশ পিছু হটে যেতে থাকে। লৌহযুগ পরবর্তী পৃথিবীতে বর্তমানে বাঙালিই একমাত্র মহাজাতি যার কেন্দ্রে মাতৃকা উপাসনার ধর্ম রয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশে এই মাতৃধর্ম অন্যত্র প্রচলিত আছে কিন্তু আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যে শক্তিশালী পুরুষ দেবতারা এসে অনেকটাই জায়গা নিয়ে নিয়েছেন। মাতৃকা সেখানে কিছুটা গৌণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তিনি কোনও পরাক্রান্ত পুরুষ দেবতার মা-বউ-বোন-কন্যা হয়ে যান।

সন্তানকোলে মাতৃকা আদি পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাস্য, ইনি হরপ্পা সভ্যতায় সবথেকে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন, চন্দ্রকেতুগড়েও সন্তানকোলে মাতৃকার মূর্তি আছে। এঁকে ষষ্ঠী বলা হত সম্ভবত। আজকে দুর্গাপুজোর বোধন যে প্রাচীন যুগে ঊষার শারদীয়া বোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেটা সুকুমার সেন অনেক আগে বলেছিলেন। কিন্তু দুর্গাপুজো ষষ্ঠী তিথিতে হয়, সেটির তাৎপর্য আছে। দুর্গাপুজো অবশ্যই সন্তানকোলে জগন্মাতার উপাসনা।

হরপ্পার সন্তানকোলে মাতৃমূর্তি

আবার একটি চন্দ্রকেতুগড় মাতৃমূর্তির কোলে সন্তানটির মাথায় শিবের মত জটা, তা দেখে শিশু শিবকে কোলে নিয়ে মা তারার মূর্তি বলে মনে হয়। একটি বৈদিক স্তোত্রে আবার রুদ্রকে অম্বিকার ভ্রাতা বলা হয়েছে, ওদিকে কৃষ্ণ আবার দুর্গার ভ্রাতা হয়েছেন মহাভারতের দুর্গাস্তবে। এক্ষেত্রেও সেই মাতৃকার উপাসনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে তারপর মাতৃকাকেই আড়ালে পাঠিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি কাজ করে।

এই সন্তানকোলে মাতৃকার ওপরে ভর দিয়ে অনেক পুরুষ দেবতার ধর্ম উঠেছে, পরে পুরুষ দেবতাটিই মুখ্য হয়ে মাতৃকা আড়ালে চলে গেছেন।

যশোদার কোলে শিশু কৃষ্ণ দ্রষ্টব্য, এবং কৃষ্ণের বৈদিক নামগুলির মধ্যে প্রাচীনতম কিন্তু কৃষ্ণ দেবকীপুত্র। ইনি ঋষি ছিলেন, সম্ভবত গীতার দর্শন এই কৃষ্ণের নির্মাণ। কৃষ্ণ অনেকে ছিলেন। বৃষ্ণি বাসুদেব ও পৌণ্ড্র বাসুদেবের সঙ্ঘাত হয়েছিল, তা সম্ভবত তন্ত্রধর্মের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ভাষ্যের ও শক্তিকেন্দ্রের পরস্পর যুদ্ধ ছিল।  

খ্রিষ্টধর্ম যে মাতা মেরির কোলে শিশু যিশুর উপাসনা করে, সেটি আমাদেরই সন্তানকোলে মাতৃকার উত্তরাধিকার।

জার্মানির এসেন (Essen) অঞ্চলে স্বর্ণমণ্ডিত মাতৃমূর্তি (ম্যাডোনা), মাতা মেরির কোলে যীশু। এটি ইউরোপের প্রাচীনতম ম্যাডোনা মূর্তি, ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ।

এই জগন্মাতার গর্ভধারণ এবং জগতের উৎপত্তি সর্বদাই অবিশ্বাস্য রকমের ঐশ্বরিক, এবং প্রায়শ অযৌন, কারণ জগৎ যাঁর থেকে উৎপন্ন, তিনি অদ্বয়, সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে তাঁর একমাত্র সম্পর্ক মাতা ও সন্তানের। তাঁর কোনও স্বামী থাকতে পারে না। এজন্য মাতা মেরির ইমাকিউলেট কনসেপশন। আসলে প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক যুগের মাতৃধর্মে জগৎপ্রসবিনী মা কর্তৃক জন্মদান একটি ঐশ্বরিক ও আশ্চর্য ঘটনা, তার পেছনে কোনও পুরুষসঙ্গী ও যৌন জননের ভূমিকা কল্পনার ধারণা অনেক পরবর্তীকালের, এটি আদিযুগে ছিল না, এবং প্রকৃতির নিয়মে ও মানুষের পারিপার্শ্বিকে নতুন উৎপাদন ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে যৌন জনন মোটেই সর্বব্যাপী নয়। বিশ্বের উৎপত্তির দর্শন হিসেবে প্রকৃতির সর্বময়ী কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য ছিল আদি সাংখ্য দর্শনে, এমনটা মনে করেন অনেক গবেষক।

পাঁচ

বিশ্বব্যাপী পুরুষতন্ত্রের উত্থানের ফলে অব্যক্ত জগদকারণ প্রকৃতিকে মা বলে ডাকা, মাতৃধর্মীয় উপাসনার এই মহতী ঐতিহ্যটি নানা বিরোধিতা, চ্যালেঞ্জ ও অন্তর্ঘাতের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে নিয়ম করে একদল জেহাদি দুর্গাপুজো এলেই মাতৃমূর্তি ভাঙতে থাকে। এটি নির্দিষ্টভাবে ইসলামের মূর্তিবিরোধী জেহাদের অংশ, কিন্তু এটি আদ্যোপান্ত এক পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের আগ্রাসনও বটে, যা নানাভাবে মায়ের পুজোর ধর্মকে উচ্ছেদ করতে চায়।

মাতৃধর্ম এক্ষেত্রে যে স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সফলভাবে প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে, আমি এর আগে মা কালীর সম্পর্কে আমার প্রবন্ধে সেই মূর্তিকল্প এবং সেই দর্শনকে “ভয়াভয়” আখ্যা দিয়েছি। অর্থাৎ একটা সময় থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মাতৃকামূর্তি যুগপৎ ভয় এবং অভয় উদ্রেক করে। স্কন্দের ধাত্রী ছয় কৃত্তিকা এই ধারায়। বলি গ্রহণ করতে উপস্থিত থাকা হরপ্পা সভ্যতার সপ্তমাতৃকা এই ধারায়। সিংহবাহিনী মূর্তি এই ধারায়। সুকুমার সেন এই ধারাতেই ইউরোপের পৃথিবীমাতৃকার সঙ্গে নেকড়ের সংযোগের কথা বলেন, এবং বাঙালির তন্ত্রধর্মে কোকমুখী মায়ের উল্লেখ করেন। হরপ্পা যুগের ভয়াল মাতৃকামূর্তি বেলুচিস্তানে ঝোব উপত্যকায় পাওয়া গেছে, যা আজকে মা কালীর প্রাচীন রূপ হতে পারে। পৃথিবীর মাতৃধর্মকে টিঁকে থাকতে  গিয়ে অনেক সময়েই রণং দেহি রূপ নিতে হয়েছে, এবং একটা সময়ের পরে দেখা যায়, মূলত যুদ্ধদেবী হিসেবে যে মাতৃকাদের উপাসনা হচ্ছে, তাঁদের কেন্দ্র করেই মাতৃধর্ম নতুন করে নবজাগরণের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছে, মা দুর্গা এবং মা কালী দুজনেই একটি আক্রান্ত সভ্যতার উপাস্য যুদ্ধমাতৃকা, এবং দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর দ্যোতনা ছিল এই – যুদ্ধযাত্রা শুরু করা। কার্তিকী অমাবস্যায় মুণ্ডমালা সাজিয়ে মোক্ষ বা কৈবল্যের প্রতীক মা কালীর উপাসনায় সেই যুদ্ধযাত্রা একটি তাত্ত্বিক পূর্ণতায় পৌঁছে যায়।  মা বলিপ্রিয়া, বলিদানের প্রথাও মাতৃধর্মের অস্তিত্ব রক্ষায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। এই ধারায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভয়াল মাতৃকার ধারণা প্রচলিত আছে, যিনি শুধু পালন করেন না, তিনি ধ্বংসও করেন। মাতৃধর্ম অহিংস হলে টিঁকবে না, তাই সিংহ, তা প্রতীকী হিংসার প্রতীক।

তন্ত্র একটি বহু প্রাচীন ধর্ম, বেদ আসার অনেক আগে থেকে তন্ত্র আছে। আজকের হিন্দুধর্ম থেকে তন্ত্র তুলে নিলে আর কিছু বাকি থাকে না। সুপ্রাচীন শাক্তধর্ম থেকেই মাল মশলা নিয়ে পঞ্চোপাসনার বাকিগুলি তৈরি হয়েছে। তন্ত্র ও শাক্তধর্মের লিপিবদ্ধ নথিগুলি পঞ্চম ষষ্ঠ শতকে গৌড়ের উত্থান থেকেই পাওয়া যাচ্ছে, তার আগের মাতৃধর্মী সভ্যতাগুলির পতনের পরে যুদ্ধবিদীর্ণ এই জাতির পুনরভ্যুদয়ের পীঠস্থান গৌড়ে আমাদের আবহমান তন্ত্র পুনঃপ্রকাশিতা হয়েছিল, এবং আমাদের আবহমান মাতৃধর্ম এই সময় থেকে মূলত যোদ্ধামাতৃকাদের মূর্তিকল্পে উদযাপিত হতে থাকে। এই কারণে সিংহবাহিনী অসুরদলনী মা, এই কারণেই আমাদের অভয়া মা মুণ্ডমালিনী। পৃথিবীর যেখানে ভয়াভয় মাতৃকার উপাসনা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে, বাঙালি মহাজাতি সেই সব মাতৃকার আবাহনে পৌরহিত্য করার অধিকারী।

পালযুগের তন্ত্রধর্মে ডাকিনীরা প্রজ্ঞার অধিকারী, কিন্তু তাঁরা ভয়াল ছিলেন। মা কালীর দুইপাশে ডাকিনী যোগিনী থাকেন, তাঁরা বজ্রযোগিনী মণ্ডলে মা বজ্রযোগিনী বা পরবর্তী কালের ছিন্নমস্তার দুইদিকে দুই বজ্রডাকিনীর স্মৃতিবাহী। তন্ত্রধর্মের এই ডাকিনীরা সারা এশিয়া জুড়ে আদৃত ছিলেন। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের চীনে সিল্ক রোড অঞ্চলে নির্মিত একটি ডাকিনী চিত্র দিয়ে আমরা এই আলোচনা শেষ করব।

মুণ্ডমালিনী শববাহনা ডাকিনী, চীনের সিল্ক রোড, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক। ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।

তথ্যসূত্র

দীনেশচন্দ্র সেন।

ডি ডি কোসাম্বি।

সুকুমার সেন।

আস্কো পার্পোলা।

শিরিন রত্নাগর।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ।

সপ্তডিঙা পত্রিকা।

মাৎস্যন্যায় ব্লগজাইন।

রৈবতক সেনগুপ্ত।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s