“বঙ্কিম আর করা যাবে না”: সত্যজিতের না হওয়া ‘ছবি’ – তমাল দাশগুপ্ত

সত্যজিৎ রায় দেবী চৌধুরাণীর স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলেছিলেন শোনা যায়। ১৯৬০ সাল নাগাদ, অথবা ষাটের দশকের শুরুর দিকেই। এ ছবি তিনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন সুচিত্রা সেনকে নায়িকা করে। প্রেমচাঁদ আঢ্যি নামে একজন প্রযোজকের এ ছবিটা প্রযোজনা করার কথা ছিল। কিন্তু সুচিত্রা সেন নাকি তাঁর ডেট ব্লক করতে রাজি হন নি, আর সেটাই সত্যজিতের শর্ত ছিল। দেবী চৌধুরাণীর শুটিং যতদিন চলবে, ততদিন সুচিত্রা আর কোনও ছবিতে অভিনয় করবেন না। এ শর্তে তখন সুচিত্রা রাজি হন নি বলেই ছবিটা নাকি হয়নি।

সুচিত্রা তখন বাংলা ছবির এক নম্বর নায়িকা, পারিশ্রমিকের দিক দিয়েও তিনি ষাটের দশকের শুরুতে রেকর্ড স্থাপন করেন। ১৯৬১ সালে আসবে সেই কাল্ট ক্ল্যাসিক সপ্তপদী। ১৯৬২ সালের বিপাশা ছবির জন্য সুচিত্রা এক লাখ টাকা নিয়েছিলেন, সেই প্রথম বাংলা ছবির কোনও স্টার এক লাখ পারিশ্রমিক নিলেন। এ ছবিতে উত্তমের থেকেও বেশি পারিশ্রমিক নিয়েছেন সুচিত্রা। সেযুগে বিশাল অঙ্ক নিঃসন্দেহে। তা সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করার জন্য সবাই কম পারিশ্রমিকেই কাজ করতে রাজি হতেন, সেটায় সম্ভবত অসুবিধা ছিল না। কিন্তু কেরিয়ারের মধ্যগগনে অসম্ভব ব্যস্ত সুচিত্রা নিজের এক্সক্লুসিভ ডেট দিতে পারবেন না, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

কিন্তু সত্যজিতের নায়কে যে ছোট্ট অংশটা আছে, সিনেমার শুটিং, যেখানে অরিন্দম তার প্রথম ছবিতে ব্রজেশ্বরের ভূমিকায়, দেবী চৌধুরাণী তৈরির ক্ষেত্রে সত্যজিতের আগ্রহ ওই জায়গায় বেশ খানিকটা পরিস্ফুট বলে মনে করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, উত্তমকে নিয়ে নায়ক করার সময় সত্যজিৎ ওরকম কোনও এক্সক্লুসিভ ডেটের শর্ত দেন নি, তবে নায়ক তো ধ্রুপদী বা ইতিহাসনির্ভর সাহিত্য থেকে তৈরি চলচ্চিত্র নয়। অনুমান করা যায় সত্যজিতের দেবী চৌধুরাণী বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে না তৈরি হওয়া ছবির আক্ষেপ-তালিকায় একদম প্রথম দিকেই থাকবে। এরপর ১৯৭৪ সালে দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় সুচিত্রার দেবী চৌধুরাণী হয়েছে বটে, কিন্তু সুচিত্রা তখন চল্লিশোর্ধ্ব, তিনি আর আগের সুচিত্রা নন, ষাটের দশকের সেই গ্ল্যামার আর নেই।

সত্যজিতের তৈরি ইতিহাসনির্ভর ছবি আমরা পাইনি। ইতিহাসের সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ বঙ্কিমের আনন্দমঠ এবং দেবী চৌধুরাণীতে ব্যাকড্রপ হিসেবে ব্যবহৃত, যদিও বঙ্কিম পুরোমাত্রায় ঔপন্যাসিকের লাইসেন্সের সদ্ব্যবহার করেছেন। দেবী চৌধুরাণী যদি সত্যজিতের হাতে চলচ্চিত্রায়িত হত, সেটা বাঙালির জন্য আনন্দের ঘটনা হত সন্দেহ নেই। শাস্ত্রে বলে গতস্য শোচনা নাস্তি। কিন্তু শোচনা না করেও থাকা যায় না। বিশেষত বঙ্কিমকে আবিষ্কার করতে গিয়ে সত্যজিতের ক্যামেরা ও কলম কোনদিকে মোড় নিত কে জানে!

তবে আর একটা কথা। বস্তুত যে কথাটা বলতে চাই আজকে সত্যজিতের নিরানব্বই বছরের জন্মদিনে, যেজন্য এই লেখা। সুচিত্রা তো দেবী চৌধুরাণীর ভূমিকায় নামতেন। ব্রজেশ্বরকে সাধারণত নন-এনটাইটি ভাবা হয়, সে চরিত্রের অভিনেতা কে হতেন, তা নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু ভবানী পাঠকের ভূমিকায় কাকে ভেবেছিলেন সত্যজিৎ? এ নিয়ে কোথাও কেউ কিচ্ছু লিখেছেন বলে দেখিনি।

আমার এ সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত আছে, আপনাদের জানাতে চাই।

ছবি বিশ্বাস গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯৬২ সালে। রবি ঘোষ লিখেছেন, ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুসংবাদ শুনে প্রথম যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন সত্যজিৎ তা হল এইঃ বঙ্কিম আর করা যাবে না।

আশ্চর্য। অন্য কোনও কিছু নয়। অন্য অনেক চরিত্রে তো ছবি কালবিজয়ী। সত্যজিতেরই একের পর এক ছবিতে। রাশভারী জমিদার, অথবা ইঙ্গবঙ্গ চরিত্র – ছবি বিশ্বাসকে ছাড়া অনেক চরিত্রই তো রূপায়িত করা অসম্ভব হয়ে গেছিল। কিন্তু আর কিছু না বলে সত্যজিৎ এটাই কেন বললেন? বঙ্কিম আর করা যাবে না।

এখানে প্রথমে শুনে মনে হয়, সত্যজিতের কোনও পরিকল্পনা ছিল নাকি, বঙ্কিমকে নিয়ে বায়োপিক করার? না, সেরকম কোনও তথ্য অনেক খুঁজেও কোথাও পাইনি আমি। রবি ঘোষও আর কিছু লেখেন নি। আমার এখন ধারণা, দেবী চৌধুরাণী আর করা যাবে না অর্থেই সত্যজিৎ সেদিন বঙ্কিম আর করা যাবে না বলেছিলেন। অর্থাৎ ছবি বিশ্বাসকে ছাড়া আর সম্ভব নয়, সেজন্য দেবী চৌধুরাণী করেন নি সত্যজিৎ।

ছবিকেই সেক্ষেত্রে ভবানী পাঠকের ভূমিকায় ভেবেছিলেন সত্যজিৎ?

সুচিত্রার অভিনয় দক্ষতা নিয়ে যাঁদের নানা প্রশ্ন আছে, তাঁরাও অবশ্য একমত হবেন যে তাঁর থেকেও বেশি সুন্দরী সম্ভবত চার সহস্র বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে আর কেউ আসেন নি। সুচিত্রাকে ছাড়া কি দেবী চৌধুরাণী সম্ভব ছিল না? সুচিত্রাকে নিয়ে সত্যজিৎ একটিও ছবি করেন নি। সেযুগে দেবী চৌধুরাণীর ভূমিকায় মানানসই আর কোনও দাপুটে নায়িকা ছিলেন না? এ প্রশ্নের উত্তর আজ খুঁজে কাজ নেই। কিন্তু ছবিকে যদি ভবানী পাঠকের ভূমিকায় ভেবে থাকেন সত্যজিৎ, তবে আর কাউকে সেই জায়গায় কল্পনা করা সত্যিই কঠিন। ছবিটা যে শেষ পর্যন্ত হয়নি, তার কারণ কি তাহলে শুধু সুচিত্রার ডেটের সমস্যা নয়, ছবি বিশ্বাসের অকালপ্রয়াণও?

পারিবারিক বংশলতিকা অনুযায়ী ছবি বিশ্বাস সম্রাট শশাঙ্কের বংশধর ছিলেন (নও শুধু ছবি নামে একটি সংকলনগ্রন্থে বংশলতিকা দেখেছি যদ্দুর মনে পড়ছে)। ওঁকে ওই রুদ্রতেজ ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় চরিত্রে মানাত বটে।

কল্পনা করুন। সেই সিগনেচার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। ছবি বিশ্বাস ভবানী পাঠকের ভূমিকায়, প্রফুল্লের বেশে সুচিত্রা, অরণ্যের মধ্যে ক্যামেরাট্র্যাক। সত্যজিতের তুলিতে বঙ্কিমের দেবী চৌধুরাণী আঁকা হচ্ছে সেলুলয়েডে!

কিছু স্বপ্ন অপূর্ণ থাকে!

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২রা মে ২০২০

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s