
আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা বঙ্কিমকে নিয়ে বহুল প্রচলিত সাতটি মিথ ভাঙব আজ এই লেখায়। বঙ্কিমবিরোধী কেউ পারলে সঠিক প্রতিযুক্তি ও প্রতি-তথ্য নিয়ে অগ্রসর হোন, এই সাতটি মিথ আমি বরাবরের মত এ প্রবন্ধের মাধ্যমে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছি।
প্রথমেই সবথেকে অস্বস্তিকর ও সবথেকে বড় মিথঃ বঙ্কিম মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত স্টেটাসে এর পূর্ণাঙ্গ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এ নিয়ে আমার একটা প্রবন্ধ আছে, “বঙ্কিম কী মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন? মিথ ও মিথ্যার আবরণ সরিয়ে”।
http://shoptodina.blogspot.com/2016/03/blog-post_35.html
বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষ একটি মিথ। কিন্তু এক কথায় যেটা বলা দরকার, সেটা হচ্ছে একশ্রেণীর মুসলমানের বঙ্কিম বিদ্বেষ (সবার নয়, বঙ্কিম সম্পর্কে শ্রদ্ধাবান মুসলমানও আছেন অনেকে) -এর ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করা দরকার এবার। এর একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সে ইতিহাস পাঠ করলে বাংলার ও ভারতের বুকে ইসলামিক মৌলবাদকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।
বঙ্কিমের আনন্দমঠ বা রাজসিংহ প্রমুখ উপন্যাস বা বিভিন্ন প্রবন্ধ সম্পর্কে যেটা মুসলমান বিদ্বেষের অভিযোগ আছে, সেটা উপন্যাস বা প্রবন্ধ সমূহ পড়লেই বোঝা যায়, সেটা বিজাতীয় মুসলমানের আগ্রাসনের প্রতি একজন সৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদীর বিদ্বেষ। এর জন্য বঙ্কিম কৈফিয়ত দেবেন না কারও কাছে, তিনি এই সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি-পুরুষ দ্বৈতবাদের ভূমিতে বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছেন, একে কোনও রেসিস্ট বিদ্বেষের ছাপ দেওয়া অসভ্যতা, কারণ আত্মরক্ষার অধিকার আছে বাঙালির। সব জাতিরই আছে, আমাদেরও আছে। নিজের ভূমিতে দাঁড়িয়ে তো আরও বেশি আছে।
বাংলাভাষী মুসলমানের বিরুদ্ধে বঙ্কিম বিদ্বিষ্ট নন, বরং উল্টো প্রমাণ দিয়েছি আমার প্রবন্ধে। তবে আনন্দমঠের চরিত্রগুলিকে দেখা গেছে, তারা উপন্যাসের শেষে মুসলমানকে দিয়ে জোর করে হরিনাম করাতে চেয়েছে। চরিত্রের কাজকে উপন্যাসলেখকের কাজ ভাবা সুচিন্তিত নয়, এবং সে প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আবার আসব। তবে হরিনাম শেখানোকে বিদ্বেষ বলা যায়?
যবন হরিদাস সুলতানের আদেশে বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতে মৃতপ্রায় হয়েও হরিনাম করেছেন, তিনি মহাপ্রাণ মহাত্মা ছিলেন। তা বলপূর্বক কাজীদলনের জন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন যদি মুসলমান বিদ্বেষী না হয়, তবে আনন্দমঠের লেখক বঙ্কিমও নন।
বাংলার মুসলমানকে রাধাকৃষ্ণের প্রেমগানে মথিত করাকে বিদ্বেষ বলব না। সেটাকে বাঙালিত্ব বলব।
সাহিত্য সম্রাটের সমস্ত লেখায় মুসলমান বিদ্বেষের যাবতীয় অভিযোগের বিস্তারিত খণ্ডন পাবেন ওপরের লেখাটায়। লিঙ্কে গিয়ে অনুগ্রহ করে পড়ুন।
দ্বিতীয় মিথ। বঙ্কিম বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার, বিশেষ করে তাঁর বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন।
বঙ্কিমের উপন্যাসে সূর্যমুখী নামে একটি চরিত্র বলেছিল, বিধবার বিবাহ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক কথা। চরিত্রের উক্তি যদি উপন্যাসকারের উক্তি হয়, তাহলে পাকিস্তান ও মুসলিম লিগের মৌলবাদকে সমর্থন করার কাজে এখুনি সাত আসমান নামক উপন্যাসের লেখক শামিম আহমেদ অভিযুক্ত হবেন, কারণ ওই উপন্যাসের চরিত্র এমনই করেছে। সেকুলারিজম ভালো, কিন্তু সাহিত্যের আলোচনা এভাবে হলে তো মহা বিপদ হবে। চরিত্রকে চরিত্র হিসেবে দেখাই ভালো, বঙ্কিম সেযুগের একটি বাস্তবোচিত চরিত্র তৈরি করতে গিয়ে তার মুখে একটা সংলাপ দিয়েছেন।
দেখতে হবে বঙ্কিমের প্রবন্ধে বিধবাবিবাহ সম্পর্কে কেমন উক্তি আছে। সেখানে তো দেখছি বঙ্কিম বিধবা বিবাহের অধিকার সম্পর্কে সরাসরি সমর্থন জানাচ্ছেন। সাম্য প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট বলছেন, কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই বলছেন যে পুরুষের যেমন স্ত্রীবিয়োগের পরে পুনর্বিবাহে অধিকার, তেমনই স্ত্রীরও অধিকার আছে বিধবা হলে পুনর্বিবাহে (বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, ৩৪৭)।
তৃতীয় মিথ। বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, বহুবিবাহ বিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে বলেছেন বঙ্কিম, বঙ্কিম বহুবিবাহের সমর্থক ছিলেন। এ সংক্রান্ত বঙ্কিমের প্রবন্ধ যে-ই পড়েছে, সেই জানে, এটা সর্বৈব মিথ।
বঙ্কিম সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে যা বলেছিলেন, তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় ১। বহু বিবাহ একটি মুমূর্ষু রাক্ষস, এ রাক্ষস এমনিতেই মৃতপ্রায়।
২। তথাপি বিদ্যাসাগর একে মারতে উদ্যত হয়েছেন বলে তিনি পুণ্যাত্মা বলে গণ্য হবেন।
৩। যদি পুরুষদের বহুবিবাহ বন্ধ করতে হয় সেক্ষেত্রে বাংলায় অর্ধেক মুসলমান (সেযুগে অর্ধেক), তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত পণ্ডিত কেউ নেই, বিশেষত আরবী কায়দা হেলে না দোলে না, তাই শাস্ত্র উদ্ধৃত করে এই সমাজ সংস্কার করলে চলবে না, এবং শুধু হিন্দুর জন্য এই বহু বিবাহ নিরোধক আইন করলেও চলবে না। শাস্ত্র দেখে নয়, এবং ধর্ম দেখে নয়। সর্বত্র সব ধর্মের মধ্যে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হোক।
বঙ্কিম যা বলেছিলেন, তা থেকে বোঝা যায়, তিনি ইউনিফর্ম সিভিল কোড চেয়েছিলেন। সেযুগের প্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক।
এবং শাস্ত্র উদ্ধৃত করে সমাজ পরিচালনার বিরোধিতা বঙ্কিম অন্যত্রও করেছেন। জীবনের একদম শেষে একবার তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, সমুদ্রযাত্রায় শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তিনি কী মনে করেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, যদি তাতে মনে কর (বাঙালি) জাতির ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখো না, শাস্ত্রবচনের ওপর নির্ভর কোরো না, নির্ভয়ে সমুদ্রযাত্রা করো। ,
চতুর্থ মিথ। বঙ্কিমের সংস্কৃত দুর্বল ছিল এবং এজন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় সংস্কৃতে গ্রেস মার্ক পেয়ে পাশ করেছিলেন। সত্য হল, বঙ্কিম ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত শিখেছেন। এ নিয়ে শ্যামলী চক্রবর্তীর বই আছে, “বঙ্কিমচন্দ্র এবং ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ”, আগ্রহীজন পড়ে নিতে পারেন। এবং আরেকটা সত্য হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় আদৌ সংস্কৃতের কোনও পেপার-ই ছিল না।
পঞ্চম মিথ। বঙ্কিম দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বলে বিদ্যাসাগর তাকে একবার বাংলায় ফেল করিয়েছিলেন।
এটি মিথ কেননা অর্ধসত্য। অতএব মিথ্যার থেকেও ভয়ানক।
ঘটনা যা ঘটেছিল বলি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে বিদ্যাসাগর পরীক্ষক ছিলেন। ইংরেজি ও বাংলা মিশ্রিত একটি ল্যাঙ্গুয়েজ পেপার ছিল। ইংরেজি অংশের পরীক্ষক ছিলেন Grapel এবং বাংলা অংশের বিদ্যাসাগর। ইংরেজিতে খুব ভালো নম্বর পেয়েছিলেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরের পেপারে বঙ্কিম পাশ করতে পারেন নি। প্রসঙ্গত, এই একবার মাত্র নয়। এর আগে একবার হুগলি কলেজে যখন বঙ্কিম ছাত্র এবং বিদ্যাসাগর বাংলার পরীক্ষক, তখনও বঙ্কিমের বাংলা পছন্দ হয়নি বলে বিদ্যাসাগর তাঁকে ফেল করিয়েছিলেন। বঙ্কিমের ছাত্রজীবনের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় হগলি কলেজে পাঠরত অবস্থায় প্রত্যেক বছরই তিনি ডিস্টিংশন পেয়েছিলেন। ওই একটা বছরেই পান নি।
বঙ্কিম কিন্তু এর আগেই ঈশ্বর গুপ্তের প্রিয় শিষ্য। কিশোর বয়সেই তিনি সংবাদ প্রভাকরে লিখছেন। কালেজীয় কবিতাযুদ্ধ নামে একটা ভারী চমৎকার সিরিজ (একরকম কবির লড়াই বলতে পারেন) হয়েছিল এইযুগে সংবাদ প্রভাকরে, ঈশ্বর গুপ্তের তিনজন স্নেহভাজন কিশোর লেখকের মধ্যেঃ বঙ্কিম, দীনবন্ধু আর দ্বারকানাথ অধিকারী। দ্বারকানাথের অকাল মৃত্যু না হলে বাকি দুজনের মত তিনিও সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রূপে আত্মপ্রকাশ করতেন।
তো যে বঙ্কিমকে বিদ্যাসাগর ফেল করাচ্ছেন, সে বঙ্কিম কিন্তু দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন না। কারণ তাঁর এই সময়ে লেখা বাংলা ঈশ্বর গুপ্তের কল্যাণে সুরক্ষিত আছে, চাইলে আপনিও দেখে নিতে পারবেন। এবং যারা ভাবেন বঙ্কিমের বাংলা দাঁতভাঙা ছিল, আসলে তারা বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ছাড়া আর কিছুই পড়েন নি। বস্তুত দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বিদ্যাসাগর নিজেই, সেটা যারা বিদ্যাসাগরের গদ্য রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত সবাই জানেন, এবং সেজন্যই সম্ভবত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ছাত্রের লেখা unorthodox বাংলা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পছন্দ হয় নি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র জ্ঞান আছে সেই জানে বিদ্যাসাগরের বাংলা কতটা রক্ষণশীল আর বঙ্কিমের বাংলা কতটা বৈপ্লবিক ছিল সে যুগে।
ষষ্ঠ মিথ। বঙ্কিম ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট ছিলেন। বস্তুত বঙ্কিম ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের হাতে বিধ্বস্ত হয়েছেন বারবার। পুরো চাকরিজীবন ধরে ইংরেজদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছেন, এবং সেজন্য বারবার আঘাত পেতে হয়েছে শাসকের থেকে। সেটা বঙ্কিমের জীবন সম্পর্কে ওয়াকবহাল প্রত্যেকে জানেন। আনন্দমঠ লেখার পর বারবার শাস্তিমূলক বদলি এবং এমনকি ডিমোশন হয়েছে বঙ্কিমের। এ নিয়ে বঙ্কিমের মৃত্যুদিনে লিখেছি, সেটার লিঙ্ক দিলাম।
আনন্দমঠের শেষে ইংরেজ জিতছে, সেটা দেখানোর জন্য বঙ্কিমকে যদি ইংরেজ-অনুগত ভাবতে হয়, তাহলে স্মরণ করাতেই হয়, ঐতিহাসিক উপন্যাসের শেষটা কেমন হবে সেটা নিয়ে লেখকের হাত বাঁধা থাকে। ম্যাজিক রিয়েলিজম জাতীয় কিছু ঘটানোর প্রথা তখনও আসেনি। সীতারামের শেষে সীতারামের পরাজয় দেখিয়েছেন বলে তাহলে বঙ্কিমকে হিন্দুবিদ্বেষী বলতে হবে, যদি আনন্দমঠে ইংরেজের বিজয় দেখানোর জন্য তিনি ইংরেজপ্রেমিক হয়ে থাকেন। ইতিহাসে ইংরেজ জিতেছিল, আর ইতিহাসে সীতারাম হেরেছিলেন। ঐতিহাসিক উপন্যাসে বঙ্কিম কেমনভাবে অন্যরকম দেখাবেন?
সপ্তম মিথ। বঙ্কিম হিন্দুধর্মের কুসংস্কারগুলোকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। যিনি সেযুগে প্রখর জনপ্রিয় শশধর তর্কচূড়ামণির দ্বারা হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও জনপ্রিয়করণের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছেন, সেই বঙ্কিম কুসংস্কারের পক্ষপাতী, এই অভিযোগে বাঙালির ইতিহাস হেসে ফেলবে (প্রসঙ্গত যারা জানেন না, তাঁদের বলি, শশধর আজকের হিন্দুত্ববাদীদের বৈজ্ঞানিক অস্পৃশ্যতা, অথবা গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি, অথবা মহাভারতে ইন্টারনেট ইত্যাদি তত্ত্বের পূর্বসূরী ছিলেন, উদাহরণস্বরূপ তিনি হিন্দুধর্মের টিকিতে ইলেক্ট্রিসিটি পেতেন)
বস্তুত, বঙ্কিম প্রখর যুক্তিবাদী ছিলেন। এককালে নাস্তিক ছিলেন। এবং যদিও পরে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে পড়েন, কিন্তু তাঁর লেখা কৃষ্ণচরিত্র বা ধর্মতত্ত্ব পড়লে বোঝা যায় নাস্তিকেরও কোনও সমস্যা হয় না এই ধর্মের সংজ্ঞায়, কারণ এই ধর্ম ধারণ করে। যে সাংখ্যের সবথেকে বিখ্যাত উক্তি ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ, অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্বই অসিদ্ধ, তাকে বাংলার হিন্দুধর্মের কেন্দ্রস্থলে স্থান দিয়ে বঙ্কিম অবশ্যই একাধারে ধর্ম ও দর্শনের বিবর্তনের প্রক্রিয়ার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকার, অন্যদিকে তিনি বাঙালিকে এমন এক ধর্মের ঈঙ্গিত দিয়ে গেছেন, যাকে বিনা কুসংস্কারে এমনকি বিনা ঈশ্বরবিশ্বাসেও গ্রহণ করতে অসুবিধা হয় না। এছাড়া তাঁর বঙ্গদর্শনের বিজ্ঞান নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন বঙ্কিম, তিনি বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার একজন বীজপুরুষ। জ্যোতিষ নিয়ে এককালে আগ্রহ থাকলেও তাঁর মেয়ের জ্যোতিষী নির্ধারিত “রাজজোটক” বিবাহের পর জামাইটি মেয়েকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার পর (আদালতে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়েছিল, শোনা যায় জামাইয়ের দাদুর কাতর আবেদনের ফলে বঙ্কিম আর জামাইয়ের শাস্তিবিধান করেন নি, নইলে সে রত্নটির ফাঁসি হত) বঙ্কিম প্রৌঢ় বয়সে এই জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতায় আস্থাশীল হন। হ্যাঁ, তিনি কালাপাহাড় বা ইয়ং বেঙ্গল ধরণের বিদ্বেষ দেখান নি বাংলার হিন্দুধর্ম সম্পর্কে (ভাগ্যিস দেখান নি), কিন্তু সেজন্যই তিনি ঋষি। তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না। তিনি সেযুগে বসে ধর্ম সম্পর্কে যা অনুধাবন করেছেন, তা বৈপ্লবিক। তাঁর ধর্মতত্ত্ব ও সাম্য পাশাপাশি রাখলে সেই কাজ বিংশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকায় লিবারেশন থিওলজি, বর্তমান ইউরোপে ঈগলটন বা জিজেক প্রমুখের মার্ক্সবাদী ক্রিশ্চান তত্ত্বর সমপর্যায়ে আসবে। তিনি যুক্তিবাদের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে যুক্তিকে বৃহতের আঙ্গিকে এনেছেন। তিনি ধর্মের সঙ্গে শুধু সামাজিক ন্যায়কে জোড়েন নি। তাঁর প্রবন্ধে বোঝা যায়, তিনি সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত বাঙালির শাক্ত, বৈষ্ণব ও অজস্র লোকায়ত ধর্মাচারের ন্যারেটিভগুলির প্রয়োজনীয়তা সেযুগে বসেই অনুধাবন করেছেন। আজকে ইউভাল হারারির মত পণ্ডিতও সে প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, অর্থাৎ ধর্মের কাহিনীগুলো আমাদের মধ্যে সমষ্টি নির্মাণ করে। সে সমষ্টি প্রয়োজনীয়। ডকিন্স, বিখ্যাত নাস্তিক, তিনি বলছেন, ইংল্যান্ডের স্কুলে বাইবেল পড়ানো বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের আইকন বঙ্কিমকে নমস্কার করে, তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত সাতটি মিথকে যথোপযুক্তভাবে ধ্বংস করে এই লেখা শেষ করছি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যে যে বাঙালি আছেন বঙ্কিমবিরোধী, তাঁদের সকলের উদ্দেশ্যে খোলা চ্যালেঞ্জ রাখলাম, সাধ্য থাকলে প্রতিযুক্তি ও প্রতিতথ্য সহকারে আমার সঙ্গে সম্মুখ তর্কযুদ্ধে আসবেন। নতুবা এ সাতটি মিথকে বরাবরের মত এই আমি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করলাম।
বন্দেমাতরম।
© তমাল দাশগুপ্ত
http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২০শে এপ্রিল ২০২০