বাংলায় একপ্রকার সমন্বয়বাদ তৈরি হয়েছিল, নইলে চণ্ডীদাস সবার উপরে মানুষ সত্য লিখতেন না। উপমহাদেশে এত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমত ছিল, সংস্কৃতির এত বিভিন্নতা ছিল, জাতপাতের এত বৈচিত্র্য ছিল, যে একটা পারস্পরিক সম্মানের সুস্থ সম্পর্ক রাখা শুধু নয়, একটা সংশ্লেষ প্রয়োজন। তার ভিত্তি অবশ্যই প্রকৃতি পুরুষ দ্বৈতবাদ। বাঙালি বারবার সেই চেষ্টা করেছে, বাকি ভারতকে সাধ্য মত দীক্ষা দিয়েছে সে এই সমন্বয় আদর্শের, সেজন্যই বাকি ভারতকে সে বন্দে মাতরম শিখিয়েছে। যখন উত্তর ভারতের অবাঙালি সাধুকে জয় কালী কলকাত্তাওয়ালী বলতে শুনি, অথবা ভারত জুড়ে একান্ন শক্তিপীঠ, প্রকৃতি উপাসনার মাধ্যমে সারা উপমহাদেশকে একীকৃত করার সেই প্রয়াস চোখে পড়ে। এ হল বাঙালির প্রাচীন হেজিমনি। মা দুর্গার পরিবার দেখুন, পঞ্চোপাসনার নির্যাস আছে সেই কল্পনায়, শৈব শক্তি প্রধান অবশ্যই, কিন্তু সঙ্গে গাণপত্য, উপরন্তু যেটা পঞ্চ-উপাসনায় নেই, তাও আছে মা দুর্গার পরিবারে, দক্ষিণের মুরুগান এবং বেদের স্কন্দ, অর্থাৎ কার্তিক। লক্ষ্মীর মধ্যে তান্ত্রিক বৈষ্ণবধর্ম আছে। সরস্বতী সুপ্রাচীন দেবী, আদিতে তান্ত্রিক, সেখান থেকে বৈদিক, সেখান থেকে পৌরাণিক। বাঙালি তার ধর্মে বেদকেও খানিকটা জায়গা করে দিয়েছিল, আজও সেরকম সে রাম হনুমানকে জায়গা করে দিচ্ছে সমন্বয়ের উদারতায়। দুর্গাপুজোয় এমনকি সৌর উপাসনাও মিশে আছে, প্রমাণ করা যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংস যখন যত মত তত পথ বলছেন, তখন এইরকম একটা প্রাচীন বাঙালি সিনথেসিসের আদর্শের দ্বারা চালিত হয়েই বলছেন।
সমস্যা হল সে আদর্শ মাঝে মাঝে ভেঙেও গেছে। অশোক প্রচুর জৈন সাধুকে হত্যা করিয়েছিলেন। শশাঙ্ক বোধিবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছেন, যদিও তার পেছনে কোনও প্রোভোকেশন ছিল না জোর দিয়ে কেউ বলতে পারে না, কারণ শশাঙ্কের ইতিহাসটা একপেশে সোর্স থেকে লেখা। এদিকে পালরা বৌদ্ধ হলেও ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়েছেন, অথচ সেনেরা বৌদ্ধদের প্রতি সেই উদারতা দেখাতে পারলেন না। অবশ্য বৌদ্ধ পালদের হাতে নির্যাতিত কৈবর্ত জাতিকে সেনেরা সামাজিক মর্যাদা দিয়েছিলেন।
এই পরিবেশে ইসলাম এসে যেটা হয়েছে সেটা বেশ চিত্তাকর্ষক। বাংলার ইসলামীকরণ কিভাবে হয়েছে সেটা নিয়ে রিচার্ড ইটন একটা পর্যায়ক্রমিক চিত্র দিয়েছেন, সেটাকে সমর্থন করে লিখছেন জাহিরুল হাসান।
“বাংলার ইসলামীকরণ… প্রক্রিয়ার তিনটি ধাপ বর্ণনা করেছেন ইটন। এক, অন্তর্ভুক্তি অর্থাৎ পূর্বের যে সংস্কারগুলি ছিল তার মধ্যে ইসলামকেও জায়গা করে দেওয়া। দুই, সংযুক্তিকরণ অর্থাৎ হিন্দু বা বৌদ্ধের ঈশ্বর বা নিরঞ্জনের সঙ্গে আল্লাহ্র সমার্থক হয়ে যাওয়া। তিন, স্থানচ্যুতি অর্থাৎ আগের দেবদেবীদের হটিয়ে আল্লাহ্-রসুলের নাম জনমানসে স্থায়ী হওয়া।”
(জাহিরুল হাসান। বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর।)
সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে? একটা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই। দুহাজার ষোলোয় বাংলা নববর্ষের দিন দেখেছিলাম অ্যাকাডেমি অভ ফাইন আর্টসের সামনে রানুছায়া মঞ্চে এক বাউল নেচে নেচে গাইছে, গোপনে প্রেম করেছে আল্লায় ও রসুলে। এটা সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি-পুরুষের প্যারাডাইম থেকে নেওয়া, ভারতের প্রাচীনতম ধর্ম-সংস্কৃতি, সেই সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার সময় থেকে এই শিব-শক্তির দ্বৈতবাদ চলে আসছে। এই দ্বৈতবাদ সবাইকে জায়গা দিতে পারে। মা দুর্গার পরিবার যেমন একটা উদাহরণ। এখন আল্লা আর তার রসুল, মানে মহম্মদকে যদি সেই দ্বৈতবাদের ছাঁচে ফেলে বাঙালির কাছে তুলে ধরা হয়, বাঙালি স্বাভাবিকভাবেই নিজের সহজিয়া মরমী সাধনার অঙ্গ হিসেবে তাকে দেখতে পারবে।
কিন্তু খেয়াল করুন, এটা তো ইসলামীকরণের প্রথম ধাপ। এ তো শেষ হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মহম্মদূর রসুলাল্লাহ বলে। তাহলে? বাঙালির এই সহজাত সহজিয়া উদারতা বজায় যাতে থাকে, তার জন্য আজ ইসলামিস্টদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব নিতেই হবে। সমন্বয় তারই জন্য থাক, যে মা কালীকে সম্মান দেবে, শ্রীরাধাকে সম্মান দেবে, আমাদের তান্ত্রিক ধর্মকে মান্য করবে। সেটা যে করবে না, যেমন ধরা যাক চাড্ডিরা রাধাদ্রোহী, বৈষ্ণবদ্বেষী, ওদিকে ইসলামিস্টরাও তাই, তাদের প্রতি উদারতা দেখানো অর্থহীন। আমরা প্রকৃতি উপাসক বাঙালি জাতি। আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে, এমন কোনও আত্মঘাতী সমন্বয়বাদী উদারতা দেখানো চলবে না।
(তিন চার বছর আগেকার লেখা, ফেসবুকে সংরক্ষণ করে রেখেছিল আমার এক প্রিয় ভ্রাতা, তাকে ধন্যবাদ)
© তমাল দাশগুপ্ত
http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২২শে নভেম্বর ২০১৯