
সপ্তসঙ্ঘর্ষে সাহিত্যসম্রাট
বঙ্কিম তাঁর সারা জীবনে অনেকগুলি আদর্শগত যুদ্ধ করেছেন। বঙ্কিমকে নিয়ে গবেষণা সেভাবে হয়নি, যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হয়েছে। আমি আজ বঙ্কিমজীবনের সঙ্ঘর্ষগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত সংকলন করব এখানে।
১। ১৮৮২ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতার বাঙালি ভদ্রলোকরা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেন। রেভারেন্ড হেস্টি নামক এক ক্রিশ্চান মিশনারির এতে মর্মান্তিক হয়। তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি, পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত এতগুলি এনলাইটেনড বাঙালি কিভাবে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটা রিচুয়াল অর্থাৎ শ্রাদ্ধে যোগদান করল। ফলত, হেস্টি একটি থান ইঁট ছুঁড়লেন এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে, ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ রচনা করলেন। এতে হিন্দুধর্মের মূর্তিপুজোকেও আক্রমণ করেন। হিন্দুধর্মকে মন্সট্রাস বা দানবিক আখ্যা দেন, হিন্দু দেবদেবী বিশেষত শাক্ত মাতৃকাদের পার্সনেশন অভ ইভিল বা মূর্তিমান অশুভ আখ্যা দেন, এবং হিন্দুধর্মকে সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন অভ ডিজিজ বা মানসিক রোগ আখ্যা দেন। বঙ্কিম এর কড়া প্রত্যুত্তর দেন। প্রথমে ছদ্মনামে (সরকারি চাকুরে ছিলেন) কিন্তু বিষয়টা গোপন ছিল না। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এবং কপালকুণ্ডলার লেখক হিসেবে পত্রলেখককে চিহ্নিত করেন। পত্রযুদ্ধ হয়েছিল স্টেটসম্যান কাগজে। বঙ্কিম এই পত্রযুদ্ধের শেষ পত্রে স্বনামে সাক্ষর করেছিলেন।
দুঃখের বিষয় সাধারণ বাজারচলতি বঙ্কিম রচনাবলী যেগুলোর দুটো খণ্ড থাকে, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাতে বঙ্কিমের এই ইংরেজি পত্রপ্রবন্ধগুলি সংকলিত হয় না। তবে সুখের কথা সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বাংলা আকাডেমি ছয় খণ্ডে বঙ্কিম রচনাবলী যেটা প্রকাশ করেছে তাতে বঙ্কিমের সমস্ত ইংরেজি লেখা আছে, এবং এই পত্রগুলোও আছে।
২। কৈলাস চন্দ্র সিংহ নামটা আজ প্রায় বিস্মৃত। ইনি আদি ব্রাহ্ম সমাজের বেতনপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন, এবং ছিলেন একজন বঙ্কিম-বিদ্বেষী। বঙ্কিমের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি বিতর্ক হয়েছিল, যে প্রসঙ্গে পরে আসব। সেক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ বিতর্কে প্রবেশ করার আগে এই কৈলাসই প্রথম গুলিগোলা চালাতে শুরু করেন বঙ্কিমের বিরুদ্ধে। কৈলাসের অনেক অভিযোগ বঙ্কিমের বিরুদ্ধে। বঙ্কিমের নিজস্বতা নেই, বঙ্কিম নাকি অন্যের গবেষণা থেকে চুরি করেন, বঙ্কিম গুরুগিরি করেন, বঙ্কিম নেহাত অনুবাদের ওপরে নির্ভর করে কাজ করেন, ইত্যাদি অনেক কুৎসা করেন কৈলাস। কিন্তু এগুলো বাহ্য। আসলে কৈলাস একটা ব্রাহ্ম আতঙ্ককে রিপ্রেজেন্ট করছেন। বাংলার তান্ত্রিক, শাক্ত, বৈষ্ণব হিন্দুধর্মের একটা পুনরুত্থান ঘটছে। বঙ্কিম বলছেন হিন্দুধর্মের শেকড়ে সাংখ্য, এবং সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে আমাদের হিন্দু ধর্ম – সেই প্রকৃতি বৈষ্ণবের রাধা, সেই প্রকৃতি শাক্তের কালী। অর্থাৎ অলিখিত সাব টেক্সটঃ যে বেদ, যে বেদান্ত নিয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলন এত মুগ্ধ, সেটা আসলে বাংলার হিন্দুধর্মের শেকড়ই নয়। ফলত, কৈলাসের বঙ্কিম দূষণ।
প্রসঙ্গত, কৈলাস খানিকটা যাকে বলে কন্সটিপেটেড লোক ছিলেন। কেবল বঙ্কিমদ্বেষী তিনি নন। প্রসঙ্গান্তরে তিনি বাঙালির ইতিহাসের অন্যান্য দিকগুলির প্রতিও বিদ্বেষ দেখিয়েছেন, তবে তা নিয়ে আজ আলোচনার প্রয়োজন নেই।
বঙ্কিম একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিধ্বংসী প্রবন্ধে (আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়) কৈলাসকে ভৃত্য ও নায়েব আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি খণ্ডন করেন।
৩। রামগতি ন্যায়রত্ন। এঁকে আমরা ancient regime বা রক্ষণশীলতার প্রতিভূ ধরতে পারি। বঙ্কিম সম্পর্কে একটা মিথ হল যে বঙ্কিম রক্ষণশীল ছিলেন। না। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছিলেন। জাতীয়তাবাদ কিন্তু রক্ষণশীলতা নয়। যেমন বঙ্কিমকে একবার জিগ্যেস করা হয়েছিল, যে সাগরপাড়ি দেওয়া সম্পর্কে শাস্ত্র-নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তিনি কি ভাবছেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। যদি মনে কর তাতে ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখো না।
বঙ্কিম সম্পর্কে মিথ নিয়ে আজ আলোচনা করছি না, সেটা আরেকদিনের জন্য তোলা থাকল। কিন্তু বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রোক্তি-নির্ভর সমাজসংস্কার সম্পর্কেও বঙ্কিমের আশ্চর্য রকমের মুক্তমনা উক্তি ছিল, যদি মনে করি তাতে আমাদের জাতির ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। বস্তুত বঙ্কিমের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের একটি তাত্ত্বিক সঙ্ঘর্ষ হয়েছিল। কিন্তু সেটা বিধবা বিবাহ নিয়ে নয়। বিধবার যে বিয়ে দেয় সে যদি পণ্ডিত হয় তাহলে মূর্খ কে, এই মর্মে তাঁর উপন্যাসে একটি চরিত্রের উক্তি কোনও তাত্ত্বিক অবস্থান নয়, চরিত্রের উক্তিকে লেখকের উক্তি বলে ভাবা অশিক্ষিতের কাজ। কাজেই বিধবা বিবাহ নিয়ে বঙ্কিমের বিরুদ্ধতা তাতে প্রমাণ হয় না। বরং অন্যত্র বঙ্কিম উল্টোটাই বলেছেনঃ হিন্দু বিধবার পুনরায় বিবাহের অধিকার থাকা উচিত, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে গেছেন বঙ্কিম। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে যে বিষয়ে বঙ্কিমের প্রকৃত বিতর্ক হয়েছিল, সেটা ছিল বহুবিবাহ নিবারণে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রোক্তি-নির্ভরতা। বঙ্কিম কিন্তু বহুবিবাহ সমর্থন করেন নি একবারও। বরং বিরোধিতাই করেছেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, যদি বহু বিবাহ নিবারণ করতে হয়, তাহলে শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। এবং বাংলার অর্ধেক মুসলমান (সেযুগে অর্ধেক)। যদি বহু বিবাহ নিবারণ করতে হয়, তাহলে তাদের জন্যও করা হোক, তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত শাস্ত্রোক্তি-উদ্ধৃত করা পণ্ডিত কেউ আসেন নি বলে তাদের মেয়েরা সতীনজ্বালা ভোগ করবে, আর হিন্দুদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত শাস্ত্রজ্ঞ এসেছেন বলে হিন্দুদের মেয়েরাই কেবল উদ্ধার হবে, এটাকে বঙ্কিম একচোখোমি বলেছেন।
প্রসঙ্গে ফিরি। রামগতি ন্যায়রত্ন বিদ্যাসাগরি বাংলার সমর্থক ছিলেন। যারা বঙ্কিমি বাংলাকে দুরূহ ভাবেন, তারা বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ছাড়া আর কিছু পড়েন নি। বস্তুত বঙ্কিমের বাংলা সেযুগে এক বিপ্লব, এবং বিদ্যাসাগরের বাংলাই ছিল দাঁতভাঙা। বঙ্কিমকে বিদ্যাসাগর দুবার ফেল করিয়েছিলেন বাংলা পরীক্ষায়। কিন্তু সে ফেল বঙ্কিম দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বলে নয়। বঙ্কিম সেযুগে ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্য, প্রথমে হুগলি কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্কিমের পরীক্ষার খাতায় তাঁর বাংলা সেযুগে বিদ্যাসাগরের কাছে অতিরিক্ত র্যাডিক্যাল প্রতিভাত হয়েছিল নিঃসন্দেহে।
রামগতির আপত্তি ছিল প্রচলিত কথ্য ভাষা কেন অনুপ্রবেশ করবে বাংলা সাহিত্যে। কারণ এই ভাষা তো দুই ভ্রাতা অথবা পিতা পুত্র একসঙ্গে বসে পাঠের অযোগ্য। বঙ্কিম এই অবস্থানকে ল্যাম্পুন করে, ব্যঙ্গ করে একটি প্রবন্ধে দেখান, যে শুদ্ধ সংস্কৃতে দুই ভাই অথবা পিতা-পুত্র আলোচনা করলে সেটা কি ভীষণ বিষম লাগার মত ব্যাপার হবে।
৪। চণ্ডী চরণ সেন। ইনি কৃষ্ণনগর আদালতের মুন্সেফ ছিলেন। একটি রায়দানে তিনি লেখেন, ৯৯% বাঙালি বিধবা চরিত্রহীন হয়। বঙ্কিম অতি সংক্ষিপ্ত একটি প্রত্যুত্তর লিখেছিলেন। তাতে একটা রসিকতা স্মরণ করেছিলেন। গুরু এসেছে শিষ্যবাড়িতে। শিষ্য দশখানা বড় বড় কই ধরে এনে ঝোল রেঁধেছে অতি উপাদেয়। গুরু খেতে শুরু করে লোভে পড়ে ন’খানাই খেয়ে ফেললেন। মোটে একখানা কই পড়ে আছে দেখে শিষ্য তখন হতাশ স্বরে গুরুকে বলেছিল, ওটি আর দয়া করে রাখলেন কেন, ওটিও খেয়ে নিন। বঙ্কিম ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ওই এক শতাংশ বাঙালি বিধবাকে আর কেন বাকি রাখলেন, একটি নতুন রায় লিখে তাতে ওই এক শতাংশকেও টেনে নিন চণ্ডীবাবু।
মূর্খ বাঙালির স্বজাতিবিদ্বেষের সংক্ষিপ্ত প্রত্যুত্তর কিভাবে দিতে হয়, বঙ্কিম এভাবে শিখিয়েছেন।
৫। যুবক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রৌঢ় বঙ্কিমের একটি বিতর্ক ঘটেছিল। বিতর্কের বিষয় ছিল সত্য। ব্রাহ্মরা সেযুগের ভিক্টোরীয় চিন্তাধারায় বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন, এবং সত্যকে একটি ধ্রুব গুণ মনে করতেন। বঙ্কিমের চিন্তা এক্ষেত্রে ছিল বৈপ্লবিকঃ তিনি বলছেন সত্য আপেক্ষিক। কথাটা অবশ্য নতুন নয়। প্রি-রোম্যান্টিক কবি উইলিয়াম ব্লেকের বড় মনোরম পংক্তি আছে এ প্রসঙ্গেঃ আ ট্রুথ টোল্ড উইদ ব্যাড ইন্টেন্ট, ইজ ওয়ার্স দ্যান অল লাইজ ইউ ক্যান ইনভেন্ট। অর্থাৎ যতগুলি মিথ্যা তুমি কল্পনা করতে পারো তাদের সবার থেকে খারাপ হল, খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে বলা একটি সত্য। প্রাচীন ভারতেও এরকম একটা নীতি ছিল। সত্য প্রকাশ করে একজন মুনিকে নরকস্থ হতে হয়েছিল, কারণ তাঁর সত্যনিষ্ঠার জন্য একজন প্রাণ হারিয়েছিল। কৃষ্ণচরিত্রে বঙ্কিম এই ঘটনাটি তুলে ধরে সত্য ও মিথ্যার আপেক্ষিক চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। আমাদের সত্য অনেকটা পুরোনো ইংরেজি শব্দ troth এর মত, বঙ্কিম বলেন। অর্থাৎ সত্য এবং truth এক নয়। একইভাবে আমরা অবশ্য জানি, ধর্ম আর religion এক নয়, যাই হোক।
এই সত্য নিয়ে বঙ্কিমকে আক্রমণ করে আদি ব্রাহ্ম সমাজ। প্রথমে বেতনভূক কৈলাস, তারপরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অবতীর্ণ হন। এ বিতর্কে বঙ্কিমকে হারাতে পারেন নি রবীন্দ্রনাথ। এবং ব্রাহ্মদের ট্রুথ কাল্ট যে ইংরেজের অন্ধ অনুকরণ, তা আমাদের দেশজ ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত, এ ঐতিহাসিক নির্ণয় করেছিলেন বঙ্কিম।
৬। এই নামটি বড় আশ্চর্যের। ঈশ্বর গুপ্ত।
আসলে, বঙ্কিম তাঁর গুরু ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর পরে কিছুটা সময় ইংরেজপ্রেমী এবং হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন। ভিক্টোরিয়ান চিন্তাভাবনা তাঁর যুগধর্ম ছিল, এবং যতদিন না এরপর তিনি তাঁর যুগযন্ত্রণা অনুভব করেন এবং শেকড়ে ফেরার উদ্যোগ নেন, এই মাঝের সময়টা তিনি ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন। শুধু ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি নয়। রাজমোহন’স ওয়াইফ গ্রন্থে দেখবেন তিনি ক্র্যাব লাইক ফিগার অভ দুর্গা এবং গ্রিম ব্ল্যাক ফিগার অভ কালী লিখেছেন। বঙ্কিম একটা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, পশ্চিমি প্রভাব আসছিল। বাদবাকি শিক্ষিত বাঙালির মত বঙ্কিমকেও গ্রাস করছিলেন মেকলে। প্রসঙ্গত, বঙ্কিম যখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলেন, প্রায় সেই সময়েই ঈশ্বর গুপ্ত মারা যান। ২৩শে জানুয়ারি ১৮৫৯। এর মাত্র বছরখানেক আগে বঙ্কিম গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন।
ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে বঙ্কিম বলেছেন, তিনি খাঁটি বাঙালি কবি ছিলেন, খাঁটি বাঙালি কবি আর জন্মায় না, জন্মানোর উপায় নেই, জন্মে কাজ নেই। শেষ বয়সে তিনি ঈশ্বর গুপ্তের লেখার সংকলন করেন, এটি তাঁর গুরুদক্ষিণা ছিল সম্ভবত। কিন্তু মাঝের সময়টায়? বঙ্কিম তাঁর একটি ইংরেজি প্রবন্ধে ঝাঁজালো ভাষায় স্বর্গত একদা-গুরুকে আখ্যা দিয়েছেন অনৈতিক, অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। ঈশ্বর বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানতেন না, সেজন্যও সমালোচনা করেছেন। ঈশ্বরের মতামত ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং সংকীর্ণ। কবির যে উচ্চতর গুণ থাকা উচিত তার কিছুই ছিল না। ভাষা ছিল অভদ্র, কৃষ্টিবিহীন। মোটা দাগের অশ্লীলতা ছিল তাঁর লেখা কবিতায়। সৌভাগ্যের কথা কবি ঈশ্বর গুপ্ত দ্রুত বিস্মৃত হচ্ছেন, বঙ্কিম লিখেছেন।
ভিক্টোরিয়ান বঙ্কিমকে এখানে খুঁজে পাচ্ছি আমরা। প্রৌঢ় বয়সে বঙ্কিমকৃত ঈশ্বর গুপ্ত রচনা সংকলনের ভূমিকা দেখলে বোঝা যায়, বঙ্কিম তাঁর মতামত অনেকাংশে পাল্টেছেন। পরিণত বঙ্কিমের লেখা ঈশ্বর গুপ্ত-অনুরাগী ভূমিকা বহুলপ্রচারিত, ইংরেজিতে যুবক বঙ্কিমের ঈশ্বর-বিদ্রোহ আমরা ভুলে গেছি। বঙ্কিম ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শুরু করেছেন। পশ্চিমি এনলাইটেনমেন্ট হয়ে, মেকলে হয়ে তবে পুনরায় ফিরেছেন ঈশ্বরে। এঁকে বলে ফুল সার্কল।
৭। ইংরেজ। আজকের আলোচনায় শেষ বঙ্কিম সঙ্ঘর্ষ।
আনন্দমঠ লিখে বঙ্কিম ইংরেজের বিষদৃষ্টিতে পড়েন, এবং এজন্য প্রথম সংস্করণের ইংরাজ-ভাঙিতেছে-চলো-আক্রমণ-করি পালটে গিয়ে নেড়ে-ভাঙিতেছে-চলো-আক্রমণ -করি হয়ে যায়। এই উপন্যাস লেখার ফলে বঙ্কিমের ডিমোশন হয়েছিল চাকরিতে, বারবার অপমানজনক ও শাস্তিমূলক বদলি শুরু হয়। আনন্দমঠ যে ইংরেজের বিরুদ্ধে লেখা নয়, এই মর্মে একটি শংসাপত্র যোগাড় করতে বাধ্য হন কেশব সেনের ভাইয়ের কাছ থেকে (সেযুগের ভারতীয়দের মধ্যে কেশব সেন সবথেকে বেশি ইংরেজের আস্থাভাজন ছিলেন)। কিন্তু ইংরেজের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ শুধু আনন্দমঠে হয়নি। ইংরেজের বিরুদ্ধে ও ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বঙ্কিমের লেখা বারবার লড়াই করেছে। এশিয়াটিক রিসার্চের নামে সাহেবদের কাণ্ডকারখানার বহু সমালোচনা তিনি করেছেন। ইংরেজের নীতি ছিল বাঙালির মধ্যে বিশ্বমানবতা ও স্বজাতিবিদ্বেষ তৈরি করা (আজও আমাদের শিক্ষানীতি সেটাই করছে বাস্তবিকপক্ষে), বঙ্কিম তার বিরুদ্ধে বারবার লেখনী ধরেছেন। চাকুরিজীবনে ইংরেজের দ্বারা বহুবার অপমানিত হয়েছেন বঙ্কিম, সেজন্যই রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, তিনি ইংরেজের জুতোর চোটে বেঁকে গেছেন। বঙ্কিম কম্প্রাদর শ্রেণী থেকে এসেছিলেন। তাঁর বাবাও ইংরেজের কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম যে স্বজাতির পক্ষ বেছে নিলেন, তাতে তাঁর শ্রেণীগত অবস্থানের সঙ্গে তাঁর আদর্শগত অবস্থানের একটা যুদ্ধ হয়, সে যুদ্ধের ফল তাঁর মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়ে মৃত্যু।
বঙ্কিম দীর্ঘজীবী হোন। তাঁকে পাঠ করার প্রয়াস আমি এবং আমরা জারি রাখব।
© তমাল দাশগুপ্ত
আমার একটি ইংরেজি প্রবন্ধ আছে যথাক্রমে বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের পৃথক পৃথক সাতটি আদর্শযুদ্ধ নিয়ে, সেটা জার্নাল অভ বেঙ্গলি স্টাডিজে প্রকাশিত হয়েছিল, এই লিঙ্কে গিয়ে পড়তে পারেন https://bengalistudies.blogspot.com/2018/03/jbs-vol-6-no-1-age-of-bhadralok-bengals.html
ছবিঋণ ঋতু
http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৫ই মার্চ, ২০২০