মহেশ্বরের রূপকল্প

মহেশ্বর অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির আরাধ্য দেবতা। কখনও পশুপতিরূপে; কখনও ললিতকলার অধিষ্ঠাতা নটরাজ রূপে; কখনও পঞ্চানন কখনও মৃত্যুঞ্জয় রূপে তিনি বাঙালির প্রাণের অর্ঘ্য লাভ করেছেন। আবার তন্ত্রে তিনিই আগমশাস্ত্রের প্রবক্তা; নিগমশাস্ত্রের শ্রোতা; আদ্যাশক্তি কালীর চরণাশ্রিত বাহনস্বরূপ। তিনি নির্বিকার নিষ্ক্রিয় মহাপ্রেতরূপে শয়ন করেন আদি প্রকৃতির চরণে। তিনিই করুণারূপিণী তারার অঙ্কে শয়ন করেন বালকরূপে। আবার লিঙ্গরূপে তাঁকে ধারণ করে আদিমাতৃকার যোনিপীঠ।
এই মহেশ্বরের যে রূপকল্প বঙ্গে আরাধিত হয় তা বহুলাংশে তন্ত্রপ্রণোদিত। যথা: বাণেশ্বর মহাদেবের রূপ। অসুররাজ বলির পুত্র বাণরাজা এই মূর্তির ধ্যান করতেন। এই রূপে শিব প্রমত্ত; শক্তিসংযুক্ত; কামস্বরূপিণী প্রকৃতিকে বামে ধারণ করেছেন; শৃঙ্গারের আদিরসের উল্লাস তাঁর মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই রূপ নিঃসন্দেহে তন্ত্রসম্পৃক্ত। এই তন্ত্রভূমিতে প্রকৃতিবিহীন পুরুষরূপ বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি কখনওই। উমামহেশ্বরের যুগলমূর্তির মধ্যে এই ভাবই প্রকাশিত।
মহেশ্বরের অন্যান্য যে রূপ প্রচলিত আছে তার মধ্যে একটি কিঞ্চিত অপরিচিত রূপ হল ওড়ম্বা। শব্দটির অর্থ হল নিষ্কর্মা প্রগলভ অমিতব্যয়ী। আশুতোষের এই বিশেষ রূপটির বর্ণনা পাওয়া যায় একটি শিবস্তোত্রে।
বিলম্বিতব্যালবপুবিশালম্
ব্যাঘ্রাম্বরম্ চারুদিগম্বোড়ম্বা
অম্বাম্বুজাতান্বিতবামভাগম্
শ্রীআশুতোষম্ শিরসা নমামি।।
অর্থাত্ ওড়ম্বা রূপে তিনি বিশালবপু; দেহের ওপর বিলম্বিত জটা; কখনও ব্যাঘ্রাম্বর কখনও দিগম্বর; দেবী পার্বতী ও দেবী গঙ্গা তাঁর বামভাগে অবস্থিতা।
এই রূপের মধ্যেও তন্ত্রের সুস্পষ্ট উপস্থিতি রয়েছে। দেহতত্ত্বের দিক দিয়ে দেবী পার্বতী ও দেবী গঙ্গা এখানে ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ির প্রতিভূ। প্রকৃতিরূপিণীর দুই প্রকাশ দেবী পার্বতী ও দেবী গঙ্গার মধ্যমণিরূপে সুষুম্নানাড়ির প্রতিভূরূপে ওড়ম্বারূপী মহাদেব। এই রূপে তিনি নিষ্ক্রিয়। অর্থাত্ পরোক্ষভাবে তাঁর চালিকাশক্তি আদিমাতৃকাই এখানে তাঁকে আশ্রয় করে বিদ্যমান।
তাঁর পঞ্চানন রূপের মূল তাৎপর্যও একই। রূপাদি পঞ্চস্কন্ধ বা পঞ্চভূত বা পঞ্চতন্মাত্রা যে ভাবেই তাঁর পঞ্চমস্তকের ব্যাখ্যা করা হোক না কেন; মূলগতভাবে এখানেও প্রকৃতির লীলায় অঙ্গীভূত পুরুষের রূপই প্রকাশিত।
এছাড়া অঘোর মৃত্যুঞ্জয় প্রভৃতি তাঁর যে প্রাচীন রূপ আমরা খুঁজে পাই তার সবের মধ্যেই একই ভাব বিদ্যমান। পুরুষরূপী মহাদেব নির্গুণ নিষ্ক্রিয় নির্বিকার। তাঁকে অবলম্বন করে প্রকৃতিরূপিণী আদ্যাশক্তিই জগত সঞ্চালন করেন। তাই তিনি কখনও পৃথুল উদর নিয়ে মহাকালীর চরণে শয়ন করেন; কখনও দেবী দুর্গার চালচিত্রে নির্গুণ নিরালম্বতত্ত্বের দ্যোতক হয়ে অবস্থান করেন। তাঁর রূপের মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করেন সর্বরূপময়ী বিশ্বযোনি আদিমাতৃকা।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s