সাবর্ণিজাতক রক্তিম মুখোপাধ্যায়
সেদিন বড় অপূর্ব দৃশ্য দেখেছিলাম। অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দর্শন আমার নতুন নয়। বরং বলা চলে গড্ডালিকায় মেতে থাকা জাতি তার নিজেরই অন্তরে লুকিয়ে রাখা যে সুধাময়ী রূপের সন্ধান পায় না; সেই রূপ দেখা এবং দেখানোর জন্যই আমার স্রষ্টা আমাকে তাঁর মানসগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ করেছিলেন। তবে সচরাচর সেসব দৃশ্য আমি দেখি আফিংয়ের নেশায়। আমায় চিনতে পারেন? আমি কমলাকান্ত। আমার স্রষ্টা ঋষি বঙ্কিম। আমার মুখে চলিত ভাষার প্রয়োগ দেখে বিস্মিত হওয়ার কিছু নাই। আমার স্রষ্টা ছিলেন আদ্যোপান্ত মূলান্বেষী বৈপ্লবিক। যে যুগে বৈষ্ণব পদাবলী শাক্ত পদাবলীর প্রাঞ্জল দেশজ রূপ ভুলে একদল বাঙালি যাবনিক সংস্কৃতির মোহে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মাতৃভাষাকে পথের কুকুর মনে করতেন; আর একদল বাঙালি সংস্কৃতের অপ্রয়োজনীয় রকমের জটিল গুরুভার আমাদের বঙ্গভাষার আহত স্কন্ধে চাপিয়ে পরম আত্মতৃপ্তি বোধ করতেন; সেই সময় আমার জন্মদাতা বঙ্কিম সমস্ত বিরুদ্ধতা অগ্রাহ্য করে বাংলা ভাষাকে তার লালিত্য ও প্রাঞ্জলতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাই আমিও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এই পথে প্রবৃত্ত হয়েছি। তো যে কথা বলছিলাম। সেদিন অর্থাত্ শারদীয়া শুক্লা সপ্তমীর সন্ধ্যায় সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখেছিলাম। সেদিন ইতস্তত ভ্রমণ করতে করতে গৌড়বঙ্গের এক শান্ত পল্লীর এক প্রাচীন চণ্ডীমণ্ডপে উপনীত হয়েছিলাম। সেই চণ্ডীমণ্ডপে সেই সন্ধ্যায় সপরিবারা দুর্গামূর্তি দর্শন করছিলাম। মায়ের সন্ধ্যারতিতে মেতে উঠেছিল আপামর গ্রামবাসী। পঞ্চপ্রদীপের শিখায় উদ্ভাসিত মাতৃমুখচ্ছবি দেখে আমার সমস্ত হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। আমার চোখে ভাসছিল মাতৃ প্রতিমার অধরে মৃদু স্নিগ্ধ হাসির রেখা আর জ্বাজ্বল্যমান ত্রিনয়নের প্রভা। সে প্রভার উৎস প্রদীপের শিখা নাকি জগন্মাতার নয়নের সহজাত ধ্বান্তনাশক প্রভা; তা বলতে পারি না। সে হাস্য শিল্পীর নিপুণ হস্তের কীর্তি নাকি সন্তানবর্গের অকুণ্ঠ সমর্পণ দর্শনে স্নেহময়ী জননীর অভয় আশ্বাস তাও বলতে পারি না। তবে সেই স্বর্গীয় মুহূর্তে বারবার মনে হচ্ছিল মা স্বয়ং এখানে বিরাজমানা। সন্তানের হৃদয় নিয়ে জগজ্জননীর কাছে যা চাইব তাই পাবো। কিন্তু কি চাইবো? পার্থিব ধনরাশি আমার চাই না। আফিংয়ের অফুরন্ত সরবরাহ চাইলে সারা জীবনের একটা হিল্লে হয় বটে; কিন্তু মায়ের কাছে এই হীন প্রার্থনা করতে হৃদয় সায় দিল না। তবে কি চাইব? আমি রামপ্রসাদ নই, যে ভক্তির জোরে ব্রহ্মময়ীর জমিদারি কিনতে চাইব; রামকৃষ্ণের শিষ্য নরেন্দ্রও নই যে জ্ঞান ভক্তি বিবেক বৈরাগ্যের মহৈশ্বর্য প্রার্থনা করব। সহসা কন্ঠ আমার অজান্তেই বলে উঠল: মায়ের কাছে মায়ের কথা জানতে চাইব। কবে প্রথম মর্ত্যের ধূলি ধন্য হয়েছিল তাঁর পবিত্র চরণস্পর্শে, কে সেই ভাগ্যবান যে সাঙ্খ্যের সুরে তন্ত্রের বীণায় মাতৃনামের প্রথম সঙ্গীত গেয়ে এই জাতির হৃদয়কুসুম মাতৃচরণে অঞ্জলির জন্য উৎসর্গ করেছিল; সেই বিস্মৃত বৃত্তান্ত অবগত হব। যদি দিতেই চাও, অয়ি দ্বিসপ্তকোটিভুজধৃতকরবালে! মা কমলাকান্তপূজিতা কমলাকান্তপালিকে বঙ্গলক্ষ্মী! আদিমাতা দশায়ুধা! সেই সুদূর কালের ইতিহাস আমাকে দর্শন করাও। প্রাণভরে দর্শন করে আমার জন্ম সার্থক করি। কখন দরদর ধারায় অশ্রুবিন্দুরাশি আমার নয়নাকাশ থেকে ঝরে পড়েছিল জানতে পারি নি। সহসা দেখলাম সমস্ত দৃশ্যপট চোখের সামনে হারিয়ে গেল ঘোর অন্ধকারে। সচকিতে অনুভব করলাম আমার সম্মুখে পশ্চাতে পার্শ্বে কেউ নাই; কিছুই নাই। বিস্ময়ে আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়লাম। মায়ের নাম ধরে কাতর শিশুর মতো ডেকে উঠলাম। এমন সময় এক কৃষ্ণবর্ণ মহাকায় পুরুষ আমার সম্মুখে সেই মহাতমসার মধ্যে থেকে আবির্ভূত হলেন। আমার মুখে স্নিগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি জলদগম্ভীর কন্ঠে বললেন: হে গৌড়বঙ্গবাসী! মহামায়া মাতৃকার বরে তুমি তোমার অভিপ্সিত দর্শন লাভ করবে। আমাকে অনুসরণ কর। কালপারাবারের সুদুর্গম পথ অতিক্রম করে সেই দৃশ্য তোমাকে দর্শন করাব। এস। আমার হস্ত ধর। আমি পথহারা বালকের মতো ভীত চিত্তে সেই মুহূর্তে আশ্বাসের একমাত্র চিহ্নস্বরূপ তাঁর হাত ধরলাম। মনের উদ্বেগ কিছুটা শান্ত হলে প্রশ্ন করলাম: আপনি কে? আমরা কোথায় চলেছি?
তিনি বললেন: আমি কালপুরুষ। আমি মহামায়ার চরণে নিত্য শায়িত থাকি। তাঁরই স্পর্শে আমার কালচক্র সঞ্চালিত হয়। আমি তাঁর দ্বারা আদিষ্ট হয়েই তোমাকে কালপরিভ্রমণে প্রবৃত্ত হয়েছি। এই পথের সম্পূর্ণ পরিভ্রমণ ও তাকে নিজের চেতনায় ধারণ করা মানবের সাধ্যাতীত। তাই তোমাকে কিছু দৃশ্যপট দর্শন করাব। তোমার স্রষ্টা তোমার মধ্যে নিজের প্রাজ্ঞ মননের যে শক্তি সঞ্চারিত করেছিলেন তার বলেই তুমি ঐ দৃশ্যপটসমূহ থেকে সম্পূর্ণ মর্মোদ্ধার করতে সমর্থ হবে। আর ঐ দৃশ্যসমূহে দৃষ্ট চরিত্রসমূহের অন্তরভাবনাও তোমার অগোচরে থাকবে না। এখন সম্মুখে দৃষ্টিপাত করো।
তাঁকে অনুসরণ করে সামনে তাকালাম। আর পরমুহূর্তেই বিস্ময়ে পুলকে অভিভূত হয়ে পড়লাম। এতক্ষণ যেখানে সর্বগ্রাসী শূন্যতার ভীষণ অন্ধকার ছিল সেই শূন্যতা পূর্ণ হয়েছে অপূর্ব জ্যোতির উৎসবে। কোটিচন্দ্রশীতল সেই কিরণমালার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন আমার মা; জগদম্বিকা দশভুজা দুর্গা। ললাটে শুভ্র চন্দ্রলেখা, মস্তকে পিঙ্গল জটাজুট। পূর্ণচন্দ্রের থেকেও সুন্দর মুখমণ্ডল। ত্রিনয়নে চন্দ্রসূর্যহুতাশনের সমাহার। অধরে মধুর বিশ্ববিমোহিনী হাস্য। গাত্রবর্ণ তপ্তস্বর্ণাভ। তাঁর বরতনু সর্বালঙ্কারে ভূষিত। দশভুজে মহাপ্রহরণসমূহ সুসজ্জিত। দক্ষিণ চরণ নিজ পৃষ্ঠে ধারণের গৌরবে মত্ত পশুরাজ সিংহনাদে চতুর্দিক পূর্ণ করে তুলেছেন। বামপদের অঙ্গুষ্ঠভারে নিপীড়িত, নাগপাশে বদ্ধ মহিষাসুরের বক্ষ দেবীর শূলাঘাতে বিদীর্ণ। চতুর্দিকে সিদ্ধিরূপ গণপতি, শ্রীমূর্তি লক্ষ্মী, জ্ঞানরূপা সরস্বতী ও শক্তিবিগ্রহ ষড়ানন উপবিষ্ট।
সেই কালপুরুষ বলে উঠলেন: হে গৌড়বঙ্গবাসী। দর্শন কর সপরিবারা দুর্গতিনাশিনী দুর্গার মাতৃমূর্তি। ইনি তোমার পূর্বসূরিগণের মানসপ্রতিমা। আজ যেমন তাঁর মধুর জগতমোহিনী হাস্যে তোমার মর্ত্যের পূজামণ্ডপে স্বর্গের জ্যোতি ফুটেছে; এমনভাবে মা বহুকাল হেসেছেন। তোমার ভূমির অতীতের যত অস্থিরতা যত জীবনযন্ত্রণার যুগযন্ত্রণার অন্ধকার সমস্ত কিছু দশভুজা দশায়ুধের ছটায় ঢেকে রেখেছেন। চার সহস্রাধিক বৎসর পূর্বে চন্দ্রকেতুগড়ে ইনি যেমন স্নেহস্নিগ্ধ হাসি হেসেছিলেন গঙ্গান্তঃপ্রাণ দুর্জয় এই জাতির অকুণ্ঠ সমর্পণে ; তাঁর অমল মুখমণ্ডলে উদ্ভাসিত যে ভয়হারিণী হাসি দেখে আশায় বুক বেঁধেছিল মাৎস্যন্যায়ভীত শতধাবিভক্ত বঙ্গের অধিবাসী; সে হাসি আজও মিলিয়ে যায়নি। এ ভূমিতে বৈদিক আর্যাবর্তের প্রাণস্বরূপা গঙ্গা আত্মসমর্পণ করেছে কপিল সাঙ্খ্যকারের চরণপূত বারিধির পদতলে। অনেক প্রতিকূলতা প্রতিহত করে বলিষ্ঠ বাহুর বিক্রমে এই জাতির আদি প্রজন্মের নায়কেরা তাঁদের চিন্ময়ী মানসপ্রতিমাকে মৃন্ময়ী মূর্তি প্রদান করেছেন। যদি জানতে চাও তোমার মাতৃভূমির সেই ঊষালগ্নের কর্মময়তার রহস্য; তবে এসো অতীতচারণের পথে। সঙ্গে রাখো তোমার আপনভোলা ইতিহাসবৃদ্ধকে। আর জ্বালিয়ে রাখো প্রজ্ঞার উল্কা। বৃথা আবেগে ভেসে যেও না। তোমার ভূমি বস্তুবাদের জননী। এখানে মেধাবর্জিত আবেগের বোঝা কাঁধে নিলেই পদস্খলন অনিবার্য। আছড়ে পড়তে হবে ইতিহাসবিকৃতি ও আত্মবিস্মৃতির অন্ধকূপে। তাই যুক্তির খড়্গ উদ্যত রাখ। মনস্বীতার আলোক যেন ম্লান না হয়। সেই যে তোমার দ্বিশতবর্ষ অতীতের পূর্বসাধক কমলাকান্ত গেয়েছিলেন:
কুরুচি কুমন্ত্রী যত নিকট হতে দিও না কো
জ্ঞান নয়নকে প্রহরী রেখ সে যেন সাবধানে থাকে।
সে কথা বিস্মৃত হয়ো না। যদি প্রত্যক্ষ করতে চাও সেই মূহুর্তকে যেখানে ক্ষাত্রশক্তি ও বৈশ্যশক্তি মেধাশক্তির কাছে শিখছে দুঃখবাদ ও প্রকৃতিপরায়ণার আদি মন্ত্র; দেখতে চাও সেই রাজর্ষির জীবন যিনি বৈদিক থেকে তান্ত্রিক; ক্ষিতিপতি থেকে মাতৃভূমির নায়ক এবং মানব থেকে মনু হয়েছিলেন; তবে এগিয়ে এসো। পেরিয়ে এসো পাঁচসহস্রাধিক বর্ষব্যাপী বিস্তৃত কালসরণীর আলোআঁধারি। পৌরাণিক কালগণনার হিসেবে দ্বিতীয় মনু স্বারোচিষের অধিকারকালে। আজ আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল
এক মহাসমৃদ্ধ হর্ম্ম্যশোভিত আলোকোজ্জ্বল মহানগরী। নগরীর নাম স্বপুর। কারণ এই স্বপুর সমগ্র ক্ষিতীমণ্ডলের একচ্ছত্র রাজা চৈত্রবংশাবতংস পরমভট্টারক সুরথের রাজধানী। সেই সুরথ যিনি রাজা থেকে রাজর্ষি; মানব থেকে মনু হয়েছিলেন মহামায়ার কৃপাবলে। তিনিই এই কাহিনীর নায়ক। তাঁর জীবনকথা বারংবার এই মাতৃপূজক জাতিকে জাতীয় সঙ্কটের কালে আশার আলো দেখিয়েছে। তাই তো মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে স্মরণাতীতকালের এই নৃপতিকে নিয়ে মাতৃসাধক রামপ্রসাদ গান বেঁধেছিলেন:
যদ্যপি কখনও বিপদ ঘটে
শ্রীদুর্গানাম স্মরণ করিও সঙ্কটে
তারায় দিয়ে ভার সুরথ রাজার
লক্ষ অসিঘাতেও প্রাণ গেল না
শ্রীদুর্গানাম ভুলো না ভুলো না ভুলো না ভুলো না
সেই সুদূর অতীতের মহারাজাধিরাজ সুরথের জীবনের সাথে দুর্গানামের মহিমা কিভাবে কালোত্তীর্ণ হয়ে জড়িয়ে রইল; সেই কাহিনীই আজ তুমি প্রত্যক্ষ করবে। কালের যবনিকা ক্ষণিকের জন্য উত্তোলিত করে সেই নৃপনন্দনের জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যেই তুমি খুঁজে পাবে তোমার অন্বিষ্ট জ্ঞাতব্য বিষয়। এসো। জগতের আদি ও অকৃত্রিম উপাস্যা আদিভূতা সনাতনীর নাম নিয়ে আমরা অগ্রসর হই।
সহসা আমরা সেই অন্ধকারের মধ্যে দ্রুতবেগে ধাবমান হলাম। আমাদের গতি যেন আলোকরশ্মির বেগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে লাগল। আমার মনে হল এই মহাবেগে আমার দেহের সমস্ত অণুপরমাণু চূর্ণ হয়ে চারিদিকের অসীম শূন্যতায় মিশে যাবে। আমি আচ্ছন্ন হয়ে চলতে থাকলাম। স্থানকালের বোধ আর থাকল না। কতক্ষণ সেই ঘোরের মধ্যে চলেছিলাম জানি না। যখন আবার প্রকৃতিস্থ হলাম; দেখলাম কালের সেই যবনিকা সরে গিয়ে সুরম্য হর্ম্ম্যরাশি দেখা যাচ্ছে। একটি সুসজ্জিত নগরের মহাসরণীর পাশে আমরা উপস্থিত হয়েছি। তখন সেখানে সন্ধ্যাকাল। নগরের আকাশে সদ্য পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সেই মনোহর নগরের শোভা আমাকে বিমোহিত করে তুলল। নগরের পথে কর্মক্লান্ত জনতা কুলায়প্রত্যাশী পাখিদের মতো গৃহাভিমুখে যাত্রা করছে। নগরের গৃহে গৃহে শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তবে নগরবাসীদের বেশভূষা ব্যবহৃত দ্রব্যাদি অনেক প্রাচীন যুগের বলে মনে হল। মনে পড়ল কালপুরুষ বলেছিলেন আমাদের যাত্রাপথের লক্ষ্য হল স্বারোচিষ মন্বন্তরের একটি অতি প্রাচীন রাজ্য স্বপুর। এই তবে সেই নগরী। কালপুরুষের কন্ঠ শোনা গেল:
ঐ দেখ স্বপুরে চৈত্রবংশীয় নৃপতিবর্গের রাজপ্রাসাদ। এত সুরম্য এই ভবনের হর্ম্ম্যরাজি যে সহসা দেখলে ইন্দ্রজাল বা মায়া বলে ভ্রম হয়। স্বপুরের প্রজারা বলে মায়াবী শিল্পী ময় এই পুরী নির্মাণ করেছিলেন ক্ষিতিমণ্ডলের চক্রবর্তী সম্রাট চিত্রানন্দন চৈত্ররাজার সময়ে। সেই সময় থেকেই স্বপুরের উত্থান। চৈত্ররাজা এখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর সম্বন্ধে নগরের মাগধদের মুখে মুখে কত কাহিনী নিয়ত পল্লবিত হয়। প্রজারা শোনে। তাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবগাথাও মিশে আছে এই কাহিনীতে। শুনতে শুনতে তাদের হৃদয়ের রক্তস্রোতে উচ্ছ্বাস জাগে। চোখে নেমে আসে সোনালি দিনের স্বপ্ন। ঐ দেখ আজও শুনছে তারা। রাজধানী স্বপুরের উপকণ্ঠে মহাসরণীর ধারে ঐ ছায়াঘেরা জলসত্রের চারিদিকে প্রজাগণ সমবেত হয়েছে। আর ঐ যে দেখছ জলসত্রের মধ্যে কৌতূহলী জনতার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে যে বৃদ্ধ লোকটি বসে আছেন উনিই হলেন এই জলসত্রের তত্ত্বাবধায়ক। সারাদিন পথশ্রমে ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত পথিকদের এখানে জলদান করেন তিনি। চৈত্রবংশের রাজাদের প্রজাবত্সলতার এই এক অপূর্ব নিদর্শন। এই রাজ্যে প্রতি এক ক্রোশ অন্তর আছে জলসত্র, পঞ্চ ক্রোশ অন্তর অন্নসত্র ও অতিথিশালা। এছাড়া পথের দুইধারে ছায়াদানকারী বৃক্ষ ও কাকচক্ষু জলে ভরা সরোবর তো আছেই। এই বৃদ্ধও সেইরকম এক জলসত্রের তত্ত্বাবধায়ক। সারাদিন কাজের পর এই সন্ধ্যাবেলায় প্রফুল্ল মনে তিনি নানা মনোরম কাহিনী আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে পরিবেশন করেন। কিছুটা কল্পনা আর কিছুটা গূঢ় রহস্যময় ইঙ্গিত মিশিয়ে বলা এই সব কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবনের অনেক গভীর সত্য; যা দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতার ফল। আর মাঝে মাঝে তিনি শোনান এই রাজ্যের ইতিহাস। পুরাকালের বিস্মৃত কাহিনী। এইরকম ভাবেই পথে প্রান্তরে মানুষের স্মৃতিতে ছড়িয়ে থাকা পুরাকালের ইতিবৃত্ত সুবক্তার বাচনকৌশলে পল্লবিত হয়ে বহু প্রজন্ম পরে পুরাণের রূপ নিয়েছিল। সুত ও মাগধেরা সেই কাহিনী সংকলন করেছিলেন। তবে সেই পৌরাণিক যুগ এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। ঐ শোনো। বৃদ্ধ তাঁর কাহিনী শুরু করেছেন। আমরা অগ্রসর হলাম। বৃদ্ধের কন্ঠস্বর শোনা গেল।
” শোনো সকলে। এই যে আমাদের সোনার রাজ্য স্বপুর। এর গৌরবের সূচনা হয়েছিল এক মেয়ের হাত ধরে।” এই বলে একটু থামেন বৃদ্ধ। শ্রোতাদের আগ্রহ কতটা সেটা একটু মেপে নিতে চান যেন। তবে বেশিক্ষণ থামার অবসর তিনি পান না। চারিদিকে শ্রোতাদের অসংখ্য কৌতূহলব্যঞ্জক প্রশ্ন ছুটে আসে। তিনি মৃদু হেসে আবার বলতে থাকেন: “সেই মেয়ের নাম ছিল চিত্রা। তার মা ছিলেন অপ্সরা ঘৃতাচী। যক্ষরাজ কুবের হলেন এই মেয়ের বাবা। বাবা তো হিমাচলের পার্বত্য প্রদেশের রাজত্ব আর সমুদ্রের তীর বরাবর বিস্তৃত যক্ষণস্থলের কর্মকাণ্ড নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর অধীনস্থ যক্ষেরা রত্নাকরের গর্ভ থেকে কত মণিমাণিক্য সংগ্রহ করেন। সেই সম্পদের জোরেই তো কুবেরের ধনাধীপ উপাধি। এদিকে ঘৃতাচী অপ্সরাও সদাব্যস্ত তাঁর নৃত্যগীত নিয়ে। প্রায়ই ইলাবৃতবর্ষের দেবলোকের সভায় নৃত্য পরিবেশন করতেন তিনি। এদিকে চিত্রার দিন কাটে নিঃসঙ্গতার মধ্যে। কুঁচবরণ কন্যা চিত্রা তার মেঘবরণ চুল এলিয়ে সারাদিন মেতে থাকে অবাধ প্রকৃতির মধ্যে দামাল হাওয়ার মতো। অবলীলায় বন্য হস্তিকে বশ করে তার পিঠে চেপে গভীর অরণ্যে রাত্রিবাস করে। মুগ্ধ চোখে দেখে নিশীথিনীর নিস্তব্ধ রূপ। এরই মাঝে চিত্রার সখ্য গড়ে ওঠে যক্ষজাতির জ্ঞাতি রাক্ষসদের সাথে। তারা অবশ্য নিজেদের দামল বলতেই বেশি পছন্দ করে। চিত্রা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে কিভাবে সমুদ্রের তীরে বড় বড় নৌপোত নির্মাণ করে ঐ দামলজাতির লোকেরা সমুদ্রে পারি দেয়। তাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা তৈরি করে গগনচুম্বী অট্টালিকা, দুর্গ। তাদের কারোর উপাধি বিশ্বকর্মা বা ত্বষ্টা; কেউ আবার ময় নামে পরিচিত। এইভাবে সমুদ্র ও সমুদ্রমেখলা এই ভূমিকে রক্ষা করেন বলেই তাঁরা রক্ষ বা রাক্ষস নামে পরিচিত। আর লক্ষ করে তারা কিভাবে ছোটো ছোটো মৃৎফলকে দেবীমূর্তি তৈরি করে পূজা করে। সেই দেবীদের কেউ বলাকামুখী, কেউ সর্পমুখী। কেউ আবার প্রসবিনী পদ্মমুখী। চিত্রা দেখেছে তার পিতার রাজ্যে উমা হৈমবতী দেবীর পূজা হয়। মায়ের কাছে শুনেছে ঊষা দশভুজি, নিশা কালরাত্রির কথা। তার হৃদয়ে শৈশব থেকেই লালিত হয় মাতৃপূজার ধারা।
ধীরে ধীরে বালিকা চিত্রা কৈশোরে পদার্পণ করে। তার রূপ দিনে দিনে ক্রমেই হয়ে ওঠে শুক্লপক্ষের চন্দ্রকলার মতো মনোমুগ্ধকর। তার আয়ত চক্ষুর শোভা বিকশিত কমলকেও লজ্জিত করে। নিয়ত চঞ্চলা অথচ বুদ্ধিমতী। আর সাহসও তেমনি। একদিন কিশোরী চিত্রা হিমালয়ের দুর্গম পার্বত্য প্রদেশে যাত্রা করেন। পিতৃরাজ্যের মনোহর গিরিশ্রেণী তাঁর নিয়ত চঞ্চল কিশোরী মনে জাগিয়ে তোলে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি। সেখানেই তপস্বীগণের ধ্যানপূত হিমাদ্রির শান্ত সমাহিত রমণীয় প্রদেশে ভ্রমণরত চিত্রা একদা মন্দাকিনীর তীরে নন্দনবনে সাক্ষাত পান এক রূপবান তপস্বীর। তাঁর তখন মধ্যযৌবন। অথচ লাবণ্যময় মুখমণ্ডলে শিশুসুলভ কৌমার্যের কমনীয়তা। চিত্রা তাঁকে দেখে এবং তিনি চিত্রাকে দেখে বিমোহিত হন। চিত্রার কিশোরী হৃদয়ের প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকে হিমাচলের পুষ্পিত উপবন। সেই নির্জন মনোহর নদীতীরে তাঁরা মিলিত হন। চিত্রা জানতে পারেন সেই তপস্বী ইলাবৃতবর্ষের চন্দ্রপুত্র বুধ। যদিও তিনি আঙ্গিরস বৃহস্পতির গোত্রপরিচয় বহন করেন। তাঁর পত্নী মনুপুত্রী ইলা। ইলার পুত্র চন্দ্রবংশের বীজপুরুষ ঐল পুরুরবা।
মিলনের পরেই বুধ চিত্রার সঙ্গ ত্যাগ করে নিজের পথে চলে যান। তাঁর বীজ গর্ভে ধারণ করে চিত্রা ফিরে আসেন তাঁর মাতৃসদনে। আমাদের এই প্রদেশে।” বিশ্রাম নিতে একটু থামলেন বৃদ্ধ। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন চারিদিক থেকে অগণিত আগ্রহী দৃষ্টি তাঁর উপরেই নিবদ্ধ। আবার শুরু করলেন তিনি।
” যথাসময়ে এক পুত্রের জন্ম দেন চিত্রা। এই ভূমি চিরকাল মাতৃতন্ত্র প্রভাবিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই চিত্রার পুত্র চৈত্র নামে পরিচিত হন এবং মাতার নামেই তাঁর বংশপরিচয় হয়। এই চৈত্রের প্রপিতামহী ছিলেন তপস্বিনী অনসূয়া। তিনিও চিত্রার মতো আমাদেরই ঘরের মেয়ে। এই সমুদ্রসন্নিহিত নদীমাতৃক কর্দমাক্ত ভূখণ্ডই ছিল দেবী অনসূয়া ও তাঁর অষ্ট ভগিনীর পিতা কর্দম প্রজাপতির বাসভূমি। অনসূয়ার ভ্রাতাই তো আমাদের পূজ্য আদিবিদ্বান কপিল।”
কপিলের নাম শুনেই সমস্ত জনতা শ্রদ্ধায় নমস্কার জানায়। কালপুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে আমার মাথাও শ্রদ্ধায় নত হয়। কালপুরুষ আমায় বলেন: প্রণিপাত কর তোমার জাতির আকাশে উদিত সেই অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে। কপিলের প্রবর্তিত বস্তুবাদী প্রকৃতিকেন্দ্রিক সাঙ্খ্যদর্শন আজও সমগ্র ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কলেবরের মেরুদণ্ড হয়ে আছে। ঐ শোনো। কথক বৃদ্ধ আবার তাঁর কাহিনী শুরু করেছেন।
” চিত্রার ছেলে চৈত্র ধীরে ধীরে মায়ের তত্ত্বাবধানে বড়ো হতে থাকেন। বালক অবস্থা থেকেই চৈত্র তাঁর সহজাত প্রতিভার পরিচয় দেন। এখন চিত্রা আর সেই দুরন্ত বালিকা নন। তিনি একজন মেধাবী পরিণতবুদ্ধি অভিভাবিকা। পুত্রের প্রাথমিক শিক্ষা মায়ের কাছেই শুরু হয়। চিত্রা শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি পুত্রকে এই ভূমির সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করান। নাগ যক্ষ রাক্ষস অপ্সরা এদের প্রত্যেকের জীবনধারা তাদের সংস্কৃতির উন্নত দিকগুলি সম্বন্ধে অবগত করান পুত্রকে। ইলাবৃতবর্ষের দেবসমাজের রীতিনীতির যেটুকু জ্ঞান মায়ের স্বল্পকালীন সান্নিধ্যে বালিকা অবস্থায় পেয়েছিলেন; তার সম্বন্ধেও অবগত করান পুত্রকে। এভাবেই চিত্রের মানসভূমি ভবিষ্যতের মহান সম্রাটের উপযুক্ত চিন্তনের আধার হয়ে ওঠে। চিত্র কিশোর অবস্থায় উপনীত হতেই বঙ্গের রাক্ষসজাতির কাছে তিনি পুত্রকে পাঠান অস্ত্রশিক্ষা ও মল্লযুদ্ধে দক্ষ হয়ে উঠতে। কজঙ্গলের পার্বত্যসানু থেকে তরঙ্গময়ী গঙ্গার পশ্চিম তটের সমীপ পর্যন্ত বিস্তৃত জনবিরল প্রস্তরময় ভূমিতে সেই রাক্ষসগণ বাস করতেন তাঁদের বৃদ্ধা রাক্ষসী বুড়ির অধীনে। কিশোর চৈত্রকে পেরোতে হয়েছিল সেই ত্রিপান্তর শস্পাচ্ছাদিত ক্ষেত্র যাকে লৌকিক ভাষায় তেপান্তর বলা হয়। তিনি অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলেন এই জনবিরল প্রদেশের বিচিত্র পরিবেশ। গঙ্গার অগণিত উপনদী বারংবার গতিপরিবর্তন করে কখনও একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে এই প্রান্তরটিকে করে রেখেছে জলবেষ্টিত দুর্গের মতো বিচ্ছিন্ন এক ভূভাগ। তার ফলে সেখানে আশ্রয় পেয়েছে এমন সব বিচিত্র জীব যাদের অস্তিত্ব মূল ভূখণ্ডে বহুপূর্বেই লুপ্ত হয়ে গেছে। ত্রিপান্তরে যাত্রার প্রথম রাতেই এক সুবিশাল উদুম্বর বৃক্ষতলে চৈত্রকুমার মুখোমুখি হয়েছিলেন দুই বৃহদাকার পক্ষীর। অতিবৃদ্ধ সেই দুই পক্ষী কিন্তু স্বভাবে নিরীহ। পরে রাক্ষসী বুড়ির কাছে শুনেছিলেন সেই পক্ষীদ্বয় বিহঙ্গমা ও বিহঙ্গমী নামেই পরিচিত। আরো কত বিচিত্র দৃশ্য দেখেছিলেন। রাক্ষসবীর শঙ্কুকর্ণের কাছে অন্যান্য রাক্ষসকুমারদের সাথে সমস্তদিন অস্ত্রাভ্যাসের পরে নিশাকালে যখন সবাই নিদ্রাগত হত; চন্দ্রের রজতবর্ণ জ্যোৎস্না যখন ত্রিপান্তরকে করে তুলত এক রহস্যের মায়াপুরী; তখন রাক্ষসী বুড়ির কাছে বসে তিনি কাহিনী শুনতেন। বারোহাত কাঁকুড়ের গল্প; তিনতালগাছের মরণভ্রমরের গল্প; সাতমহলা পুরীর গল্প। অবাক হয়ে তিনি ভাবতেন এই একই গল্পই তাঁর মায়ের কাছেও তিনি শুনেছিলেন। সোনার কাঠি রূপার কাঠির কথা; হুতুম ভুতুমের কথা। লৌকিক ভাষায় এই রূপকথার কাহিনী বঙ্গের অধিবাসীগণ মাতৃপরম্পরায় শিখে ও শুনে আসছেন সুদূর অতীতকাল থেকে। মায়ের কাছে চৈত্র আরো শুনেছিলেন আর্যাবর্তের বেদাচারী আর্যগণের সাথে বঙ্গের আর্যগণের কিছু প্রভেদ আছে। তাঁরা মাতৃপূজক। তাঁরা মৎস্যভোজী। তাঁরা বৈদিকগণের যজ্ঞকর্মে আস্থা রাখেন না। লিঙ্গ ও যোনিচিহ্নে পুরুষ প্রকৃতির সাধনা করেন। কপিলের সাঙ্খ্যমত তাঁদের হৃদয়ের সম্পদ। তাঁরা মৃন্ময় পুত্তলিকার মধ্যে প্রকৃতিপূজার ভাব ধরে রাখেন। সুললিত গীতিকার ছন্দে প্রহেলিকাময় গাথার মাধ্যমে সাধনতত্ত্বের বর্ণনা করেন। তাঁরা প্রকৃতির মুক্ত সান্নিধ্যে বিভিন্ন ঋতুতে নানা ব্রতকর্মের অনুষ্ঠান করেন। তাই বৈদিক আর্যগণ তাঁদের ব্রাত্য আর্য বলে অভিহিত করে। এই আর্যগণ যখন এই ভূখণ্ডে আসেন তখন প্রাচীন দামলজাতির রাক্ষসদের সাথে বহু প্রজন্ম ধরে চলেছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আঘাত প্রত্যাঘাতের এই দ্বন্দ্বের কাহিনীই রূপকথায় আশ্রয় পেয়েছে। পরে উভয়পক্ষই সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ করেন। সংস্কৃতির আদানপ্রদান হয়। ব্রাত্য আর্যগণের মাতৃসাধনার ধারায় মিশে যায় দামল রাক্ষসজাতির ধারা। রাক্ষসদের কাছে আর্যগণ শেখেন উন্নত নগরায়নের ধারণা। গড় নির্মাণের পদ্ধতি। ব্রাত্য আর্যগণ ছিলেন নৌবিদ্যায় অসম্ভব দক্ষ। আবার রাক্ষসগণেরও রক্তে মিশে ছিল সমুদ্রযাত্রা। সমুদ্রের রক্ষাকারী বলেই এই দামল জাতির নাম ছিল রাক্ষস। এখন এই আর্য আর দামলগণের সংযোগের ফলে বঙ্গের বহিত্র জলতরঙ্গে ভেসে সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে সগৌরবে যাত্রা করে। রাক্ষসগণ ত্রিপান্তর ও নিম্নবঙ্গে তাঁরা নিশ্চিন্তে বসবাস করেন। চৈত্র মায়ের কাছে আর এই রাক্ষসী বুড়ির কাছে কাহিনী শুনতেন আর ভবিষ্যতের এক স্বর্ণময় স্বপ্নে হারিয়ে যেতেন। পরিকল্পনা করতেন রাক্ষস আর বঙ্গীয় আর্যগণকে সম্মিলিত করে এক অখণ্ড শক্তিকেন্দ্র নির্মাণের। সম্ভবত তাঁর মাতাও এই স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই তাঁকে পাঠিয়েছিলেন রাক্ষসবীরদের কাছে। এইভাবেই কেটে গেল আরো কয়েকটি বছর। সহজাত প্রতিভার বলে যৌবনে পদার্পণ করার আগেই চৈত্র হয়ে উঠলেন মহাবীর যোদ্ধা। তার সাথে লাভ করলেন রাক্ষসগণের মৈত্রী আর উন্নত রণকৌশল। আর পেলেন এক যোদ্ধৃ দেবীর মূর্তি। দেবী রণরঙ্গে একটি বৃষাকৃতি পশুকে শরবিদ্ধ করছেন। তাঁর মুখ হিংস্র বৃকের ন্যায়। তাই তিনি কোকামুখী নামে রাক্ষসদের কাছে পরিচিত। চৈত্র সিদ্ধান্ত নেন এই দেবীরই চিত্র তাঁর ধ্বজে শোভা পাবে। এরপর সমবয়সী এক যুবককে নিয়ে মায়ের আদেশে বঙ্গের পূর্বতম সীমায় নিবীড় অরণ্যপ্রদেশে যাত্রা করলেন পালকপ্য গোত্রীয় ঋষিদের আশ্রমে। সেখানে তাঁরা শিক্ষা করলেন হস্ত্যায়ুর্বেদ ও হস্তিচালনার বিদ্যা। ফিরে এসে সেই বিদ্যার প্রয়োগ করে গঠন করলেন রণদুর্মদ হস্তিবাহিনী। সঙ্গী যুবক হলেন তাঁর প্রধান হস্তিপাল। চৈত্রের সৌভাগ্যক্রমে তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল তাঁর উত্থানের অনুকূল। তাঁর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা চন্দ্রবংশীয় ঐল পুরুরবা তখন স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর প্রেমে মগ্ন। অন্যদিকে মনুপুত্র উত্তানপাদের রাজ্য তখন অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত। তাঁর পুত্র ধ্রুব রাজ্যের বহির্ভাগে এক অরণ্যে বিষ্ণুদেবের তপস্যায় নিমগ্ন। ফলে সমগ্র ক্ষিতিমণ্ডলে এক রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন চৈত্ররাজা। তাঁর রণহস্তিবাহিনীর ভীমবিক্রম তথা রাক্ষস ও বঙ্গীয় যোদ্ধাগণের রণপাণ্ডিত্যের বলে তিনি অল্পকালের মধ্যে ইলাবৃতবর্ষ থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত সসাগরা ধরণীর অধিপতি হলেন। সপ্তদ্বীপে ধ্বনিত হত কোকামুখী দেবীর ধ্বজবাহক চৈত্রের মহাপরাক্রমী যোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। চক্রবর্তী সম্রাট হয়েই এরপর তিনি স্বপুরে রাজধানী স্থাপন করলেন। রাক্ষসরাজ্য ও বঙ্গের সীমায় এই নগর উভয় জাতির মিত্রতাকে সুদৃঢ় করল। তখনই নিম্নবঙ্গের রক্ষশিল্পী ময় তাঁর এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন।” এই অবধি বলে অতীতের স্মৃতিমেদুর চোখে ক্ষণিকের জন্য থামেন বৃদ্ধ। আবার বলেন” সে এক দিন ছিল বটে। বাবার মুখে শুনেছি, নিজেও ছোটো বয়সে দেখেছি চৈত্ররাজার দানশীলতা। নিত্য যে পরিমাণে অন্নদান তিনি করতেন তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। তাঁর ভাণ্ডারের অন্নমেরুর উচ্চতা দেখে বুঝি সুমেরুগিরিও লজ্জিত হবে। দুধের সহস্র নদী, মধুর শতসংখ্যক পয়স্বিনী ধারা, ঘৃতের অযুত ধারা তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্যের সমস্ত পুত্রদের ক্ষুধা তৃষ্ণা নিবৃত্ত করত। হ্যাঁ। পুত্র। চৈত্র সব সময় প্রজাদের নিজের ঔরসপুত্র জ্ঞান করতেন। এটিই এখন চৈত্রবংশের চিরন্তন ধারা।”
এই বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ ব্যস্ত হয়ে বলে ” কথা বলতে বলতে রাত্রির যে মধ্যযাম অতিক্রান্ত হতে চলল সে খেয়াল আছে? যাও সব। ঘরে ফিরে যাও। কাল ভোরে আবার উঠে আমাকে জলসত্রের কাজ শুরু করতে হবে।”
কিন্তু সমবেত জনতা এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। আবার প্রশ্ন ভেসে আসে ” তারপরের ঘটনা বলো। কাহিনীর শেষ না শুনে যাব না।” বৃদ্ধের অজান্তেই তার বুক থেকে দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে। চৈত্রের পরে মহারাজ অধিরথ যে প্রবঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন, যেভাবে সমগ্র ধরিত্রীব্যাপী সাম্রাজ্যের অধিকার তাঁর করচ্যুত হয়েছিল সেসব তিক্ত প্রসঙ্গ স্মরণ করতে ভালো লাগে না তার। তাই আপাত ব্যস্ততার ভাব দেখিয়ে কাহিনী শেষ করতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু শ্রোতাদের সামগ্রিক দাবির সামনে তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে কিঞ্চিত সচেতনভাবে বলতে শুরু করেন তিনি। ” চৈত্রের পরে রাজা হলেন অধিরথ। পিতার মতোই প্রজাপালক তিনি। তাঁর শান্ত মুখশ্রী আর করুণাপূর্ণ চোখের দিকে তাকালেই প্রজারা সব কষ্ট ভুলে যেত। কিন্তু রাজনীতির পথ বড়ো বিষম। সে পথে হৃদয়ের স্থান নেই। শুধুই কন্টকাকীর্ণ বন্ধুরতা। অধিরথের কিছু নীতিগত ভুল হয়েছিল। তিনি মাতৃপূজার সংস্কৃতিকে যথাযথ গুরুত্ব দেননি। বৈদিক পরিমণ্ডলের সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। চন্দ্রবংশের রাজা আয়ু হয়েছিলেন তাঁর মিত্র। তাঁর ওপরেই জম্বুদ্বীপের এক বৃহদংশের শাসনভার অর্পণ করে ঋষিদের সাথে তত্ত্বালোচনায় মেতে থাকতেন অধিরথ। আয়ু যতদিন বেঁচে ছিলেন দুই রাজার মধ্যে প্রীতির সম্বন্ধ কখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি। কিন্তু অধিরথের রাজত্বের শেষদিকে আয়ু প্রয়াত হলেন। রাজত্বের ভার নিলেন তাঁর পুত্র নহুষ। নহুষ যেমন বীর তেমনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সুযোগ বুঝে ধীরে ধীরে জম্বুদ্বীপের বহির্ভাগে বিস্তৃত আমাদের বিশাল সাম্রাজ্য তিনি ধীরে ধীরে করায়ত্ত করতে থাকলেন। বৃদ্ধ অধিরথ তাঁকে বাধা দিতে পারলেন না। এই সময় আমাদের সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিমের সামন্ত রাজারা আর বৈদিক ঋষিমণ্ডলীকে সুচতুর নহুষ নিজের পক্ষে টেনে নিলেন। তাঁদের সহায়তায় নহুষ হয়ে উঠলেন অপরাজেয়। তবে স্বপুরের গৌরবে তাতে ভাঁটা পরে নি। তবুও অতীতের সাম্রাজ্যের অধিকার হারানো যেকোনো জাতির পক্ষেই অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এতে জাতির আত্মবিশ্বাস আহত হয়। আমাদের এখনকার রাজা সুরথ তখন কৈশোর অতিক্রম করতে চলেছেন। তিনি নহুষের সাথে যুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অধিরথের শারীরিক অসুস্থতার কারণে মন্ত্রীগণ তাঁকে নিরস্ত করেন। নহুষও অবশ্য স্বপুরের দিকে হাত বাড়াতে সাহস করেন নি। সেই নহুষ এখন আবার দেবেন্দ্র হয়েছেন। স্বর্গের সিংহাসনে উপযুক্ত লোকই বসেছেন !” তিক্ত হাসি ফুটে ওঠে বৃদ্ধের মুখে। তিনি আবার বলতে থাকেন: “তারপর তো একদিন অধিরথ প্রয়াত হলেন। এখন আমাদের প্রজাদের নয়নের মণি সুরথ আমাদের মহারাজা। আমাদের মহারাজা এখন বিশাল বাহিনী নিয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন। পিতামহ চৈত্রের নির্মিত সাম্রাজ্যের পুনর্গঠন করবেন তিনি। আমার বিশ্বাস মহারাজের শৌর্যের সামনে জম্বুদ্বীপের কোনো নৃপতি প্রতিরোধ গঠন করতে পারবে না। সসাগরা ধরিত্রী আবার আমাদের অধিকারে আসবে।” বৃদ্ধ থামতেই জনতা সুরথের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে।
“সবই ভালো। তবে সুরথের মতিগতি আমার ভালো লাগে না। ” বলে ওঠেন এক বৃদ্ধ শ্রোতা। তিনি চৈত্রের সময়ে স্বপুরের নগরপাল ছিলেন। অধিরথ ও সুরথ দুইজনেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। তিনিও তাঁদের যথেষ্ট স্নেহ করেন। আজ চৈত্রবংশের গৌরবকথা শুনে অতীতের সুখস্মৃতি রোমন্থন করতেই তিনি এসেছিলেন। সমবেত জনতা এবার তাঁকে প্রশ্ন করে: “কেন? মহারাজের মতিগতিতে খারাপ কি দেখলেন আপনি?”
বৃদ্ধ বলেন:” অধিরথের প্রভাবে সুরথ ছোটো থেকে বৈদিক সমাজের সঙ্গে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তাদের সামনে নিজেকে গরিমান্বিত দেখাতে পারলেই জীবন সার্থক মনে করেন। কিন্তু বৈদিকরা আমাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। তারা আমাদের দস্যু, ব্রাত্য, পক্ষীভাষী বলে। আমাদের মাতৃপূজাকে নিন্দা করে। নেহাত আদিবিদ্বান কপিলের সর্বাত্মক প্রভাব অস্বীকার করতে পারে না বলে সাঙ্খ্যদর্শনকে সম্মান দেখায়। তাও আবার শুনেছি সাঙ্খ্যের ভাবে নাকি কিসব পরিবর্তন আনতে চায় ওরা। ওদের প্রভাবে মহারাজও আমাদের মাতৃসাধনার সংস্কৃতির প্রতি উদাসীন। যে নৃপতি আপামর প্রজার আচরিত ধর্মের বিষয়ে কিছুই জানেন না; তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত্তি কি আদৌ সুরক্ষিত? তার ওপর ব্রহ্মাবর্তের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিজের অমাত্যপদে বসিয়েছেন। তারা ছাড়া কারোর পরামর্শ শোনেন না। অস্ত্রাদির বিষয়ে ভার্গবদের দায়িত্ব দিয়েছেন বলে বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের শিল্পীগণ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। যাই হোক। আর তিক্ততা তৈরি করে লাভ নেই। রাজার হৃদয় বড় বিশাল। প্রজাদের সুখের প্রতি সদাসতর্ক। আমরা তাঁর মঙ্গলকামনাই করি।”
বৃদ্ধ চলে যান। সুরথের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে বাকিরাও ঘরে ফেরে। কথক বৃদ্ধ একা আকাশের দিকে চেয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে যান।
আবার সম্মুখের দৃশ্য সমুদ্রবক্ষে কুজ্ঝটিকার অন্তরালে ক্ষুদ্র দ্বীপের মতো অকস্মাত্ মিলিয়ে গেল। আমি হস্তে কালপুরুষের টান অনুভব করলাম। আমাকে নিয়ে তিনি আবার স্থানান্তরে এবং সম্ভবত কালান্তরে গমন করলেন। তবে এবার আর মহাশূন্যপথে নয়; ভূমণ্ডলের উপর দিয়ে বায়ুবেগে তাড়িত পরাগরেণুর মতো এগিয়ে চললাম আমরা। সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গ; গঙ্গার উচ্ছল প্রবাহের নিম্নভাগে ত্রিকোণাকৃতি ভূভাগ যা আমার চিরবন্দিত মাতৃভূমি, যার কেন্দ্রস্থলে এই মুহূর্তে স্বপুরের আলোকোজ্জ্বল নাগরিক শোভা এইমাত্র প্রত্যক্ষ করেছি আমি; সেসব পিছনে পড়ে রইল। বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখলাম অগণিত সৈন্যের বিশাল বাহিনী সুরথের ধ্বজ বহন করে চলেছে জম্বুদ্বীপের সমস্ত ভূখণ্ড জয় করতে। স্বদেশবাসীর এই মহাপরাক্রম দর্শনে আমার হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠল। ক্রমে আরো উত্তরে চললাম। হিমাদ্রির উত্তুঙ্গ শিখররাজি আমাদের গতিরোধ করতে পারল না। অতিক্রম করলাম কিম্পুরুষবর্ষ, হৈমতবর্ষ, নীল নিষধ প্রভৃতি তুষারাবৃত গিরিশ্রেণী। কালপুরুষ আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন সমস্ত লক্ষণীয় পর্বত নদী ও ভূভাগ। ক্রমে আমরা উপনীত হলাম সেই মহান শৈলগ্রন্থির মালভূমিতে যাকে আমার কালের মানুষ চেনে পামীর নামে আর পৌরাণিকরা জানতেন মহামেরু বা সুমেরু বা কনকাচল নামে। সহসা গতি মন্দীভূত হল। কালপুরুষ আমাকে নিয়ে গেলেন মেরুর এক প্রান্তে একটি দুর্গম গিরিপথের উপরে অবস্থিত গিরিদুর্গে।
সেখানে গিয়ে দেখলাম প্রায়ান্ধকার সভাকক্ষে স্বল্পসংখ্যক অন্তরঙ্গ সভাসদ পরিবৃত অবস্থায় লৌহনির্মিত সিংহাসনে বসে আছেন রাজা নন্দী। হাতে একটি সুদৃশ্য ভৃঙ্গারে আসব পরিপূর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছে নিঃশেষিত হওয়ার জন্য। পাশে শূন্য অবস্থায় ভুলুন্ঠিত সুরাপাত্রসমূহ নিঃশব্দে রাজার মত্ততার পরিমাণ নির্দেশ করছে। অধুনা রাজার দুই চক্ষু রক্তাভ। আসবের প্রভাবে কন্ঠস্বর স্খলিত হয়ে এসেছে। শিথিল দেহে অনুচ্চ স্বরে তিনি কি স্বগতোক্তি করে চলেছেন তা কারোর শ্রুতিগোচর হচ্ছে না। সভাসদগণের অবস্থাও তথৈবচ। কেউ রাজকীয় বদান্যতায় মাত্রাতিরিক্ত পান করে রক্তাভ মুখে প্রকৃতিস্থ হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। কেউ সুবাসিত তাম্বুলরসে মুখের দুর্গন্ধ ঢাকতে ব্যস্ত। আর কয়েকজন তরুণ সভাসদ সুরা ও সুন্দরী এই উভয়সুখের সামঞ্জস্য বিধানে রত। এ বিষয়ে অবশ্য রাজা বড়োই উদার। তাঁর ধর্মসঙ্গত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ তিনশত সুরূপা ভার্যা অন্তঃপুরে আছেন পুত্রোৎপাদনের জন্য। এছাড়া তাঁর যে নিজস্ব যোষিতভবন আছে সেখানে তিনি দক্ষ মণিসংগ্রাহকের মতো দেশবিদেশের অগণিত নারীরত্ন সংগ্রহ করে রেখেছেন প্রমোদের জন্য। প্রায়ই তাঁর সভাকক্ষ এই রত্নাবলির অনাবৃত রূপের ছটায় আলোকিত হয়ে ওঠে। সম্ভ্রান্ত মদমত্ত পশুগণের লোলুপ হস্ত এই হতভাগিনীদের কোমল তনু দলন মথন করে। আজও নিয়মানুযায়ী কয়েকজন সুন্দরী কন্যা কম্পিতদেহে পাণ্ডুরবদনে চরম সর্বনাশের অপেক্ষা করছে আর লোভাতুর সভাসদগণের অশ্লীল স্পর্শ থেকে নিজেদের রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সভাকক্ষের অয়স্তম্ভের পাদদেশে পড়ে আছে তাদের ছিন্নবস্ত্র। গিরিসঙ্কটের সঙ্কীর্ণ পরিসরে নির্মিত রাজভবনের এই তামসিক সভাকক্ষে যেন সূর্যালোকও প্রবেশ করতে সঙ্কোচ বোধ করে। সভাগৃহের এই অসুস্থ পরিবেশ দেখেই ঘৃণার উদ্রেক হল। অন্তর্যামী কালপুরুষ আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন: সুরথরাজার স্বপুরের গৌরবোজ্জ্বল পরিবেশ থেকে এখানে আচম্বিতে এসে তোমার বিবমিষার উদ্রেক হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বিচলিত হয়ো না। আমাদের আলোচ্য কাহিনীতে এই নন্দী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছে। আপাতত এই সভাকক্ষের বাইরে বেরিয়ে এসো। একটু অতীতচারণ করা যাক। নন্দীর বংশধারার সূত্রপাত হয় বৈবস্বত মনু থেকে। পৌরাণিকগণ মানবেতিহাসকে চতুর্দশ মনুর অধিকারকালে বিভক্ত করেছেন। এঁদের মধ্যে প্রথমজন হলেন স্বায়ম্ভূব। বর্তমানে অর্থাত্ তোমার জীবৎকালে সপ্তম মনু বৈবস্বতের অধিকারকাল। কিন্তু সেই বিশেষ ব্যক্তির জীবনকাল ও তাঁর মনু পর্যায়ে স্বীকৃত হওয়ার সময়ের মধ্যে বহুকালের ব্যবধান থাকে। তাই বহুপূর্বকালের স্বারোচিষ সুরথ ও নন্দীর সময়ে মনুরূপে পরিচিত ছিলেন। নন্দীর বংশের আদিপুরুষ বৈবস্বত। ইনি মনুরূপে গণ্য হবেন তাঁদের বহুকাল পরে। তোমাদের বর্তমান সময়ে শাস্ত্রাদিতে তাঁকেই মনুত্বের আসনে অধিষ্ঠিত দেখানো হয়। ব্যক্তি থেকে কিংবদন্তি হতে চিরকালই এইরকম দীর্ঘ সময় লাগে। এই বৈবস্বত মনুর রাজত্ব ছিল ইলাবৃতবর্ষে।
প্রাচীন ভৌগলিকগণ জম্বুদ্বীপকে সাতটি বর্ষে বিভক্ত করেছিলেন। সর্বদক্ষিণে সমুদ্রমেখলা ভারতবর্ষ। ভারতের উত্তরে হিমবান পর্বত। হিমাচলের উত্তরে হেমকূটের দক্ষিণে কিম্পুরুষবর্ষ। হেমকূটের উত্তরে নিষদ পর্বতের দক্ষিণে হরিবর্ষ। নিষদগিরির উত্তরে নীল পর্বতের দক্ষিণে ইলাবৃতবর্ষ।
এই ইলাবৃতবর্ষই দেবগণের জন্ম ও কর্মভূমি। ইলাবৃতবর্ষের কেন্দ্রে স্বর্ণাভ এক পর্বত অবস্থিত।
পর্বতের পাদদেশ থেকে চতুর্দিকে অগণ্য পর্বতশিরা নির্গত হয়ে চতুঃসমুদ্রের পয়োরাশিতে অবগাহন করেছে। অগণিত ভূধরবেষ্টিত এই কনকবর্ণ পর্বতকে দেখলে সহসা মনে হয় যেন বসুন্ধরার নাভি থেকে উত্থান ঘটেছে তার। পৌরাণিকগণ একে পৃথিবীর ভরকেন্দ্র বলে বিবেচনা করতেন। এই পর্বতের নাম মেরু, সুমেরু, মহামেরু, কনকাচল। পর্বতের শীর্ষ শৃঙ্গাকৃতি নয়; বরং প্রশস্ত সমতল বিশাল। এই সমতল ক্ষেত্রেই দেবগণের রাজধানী অমরাবতী প্রতিষ্ঠিত। পর্বতের পাদদেশে ইলাবৃতবর্ষের ভূমি মনুর অধিকারক্ষেত্র। সেখানে সপ্তর্ষিগণ বাস করেন। মনুর রাজভবনটি মেরু পর্বতের উভয়পার্শ্বে বিস্তৃত মাল্যবান ও গন্ধমাদন পর্বতের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ গিরিসঙ্কটে অবস্থান করছে। অতীতে এই ভূমি বারম্বার আক্রমণের শিকার হয়েছে। তাই প্রতিরক্ষার কথা মাথায় রেখে এই গিরিদুর্গ নির্মাণ করা হয়েছে। মনুর পুত্র উত্তানপাদ। তাঁর দুই পুত্র। সুরুচির গর্ভজাত উত্তর ও সুমতির গর্ভজাত ধ্রুব। পিতার ঔদাসীন্য ও বিমাতার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ধ্রুব বালকবয়সেই গৃহত্যাগ করে গভীর অরণ্যে তপস্যামগ্ন হন। কালক্রমে তাঁর সুতীব্র সাধনায় বিষ্ণুদেব প্রসন্ন হয়ে তাঁকে নক্ষত্রগণের মধ্যে সর্বোচ্চ পদ প্রদান করেন। জম্বুদ্বীপের উত্তর আকাশে যে নক্ষত্রটি চিরকাল একই অবস্থানে থেকে রাতের পথিককে দিশা প্রদর্শন করত সেই নক্ষত্রটিকে তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়। ধ্রুব খ্যাত হন ভক্তরাজ নামে। পরে সংসারে ফিরে এসে ধ্রুব পিতৃরাজ্যে অভিষিক্ত হন। ধ্রুব যখন সংসারের অস্তিত্ব ভুলে সাধনমগ্ন ছিলেন; সেই সময়েই চৈত্ররাজা সসাগরা ধরণী জয় করেন। উদারহৃদয় মহারাজ চৈত্র এই সাধক রাজার মহত্ত্বকে সম্মান করতেন। তাই তিনি ধ্রুবের রাজ্যকে স্বতন্ত্রতা প্রদান করেছিলেন এবং উভয়রাজ্য মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু কালের গতি বড় কুটিল। মহাত্মার গৃহে দুরাত্মার জন্ম একান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। ধ্রুব গতাসু হলে তাঁর পুত্র উৎকল রাজা হন। পূর্বের মৈত্রীর কথা ভুলে চৈত্রপুত্র রাজা অধিরথের দুর্বলতার সুযোগে তিনি তরুণ চন্দ্রবংশীয় রাজা আয়ুপুত্র নহুষকে সমর্থন করেন এবং নহুষের বদান্যতায় ইলাবৃতবর্ষের বিশাল অঞ্চলে তাঁর প্রভুত্ব বিস্তৃত হয়। অধুনা পূর্বতন ইন্দ্র তোমার মাতৃভূমির শিল্পীশ্রেষ্ঠ ত্বষ্টার পুত্রকে হত্যার পাপে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। চন্দ্রবংশীয় নহুষ এখন অমরাবতীর ইন্দ্রাসনে অধিষ্ঠিত। উৎকলের পুত্র নন্দী মনুরাজ্যের বর্তমান অধীশ্বর। পিতার সমস্ত কুটিল বুদ্ধি ছাড়াও তিনি সহজাত লোভ ও কামুকতার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই পিতাকে ছাড়িয়ে উঠেছেন। তাঁর সভাসদগণও সবাই তাঁর যোগ্য সঙ্গী। সৃষ্টির এ এক আশ্চর্য নিয়ম। ক্ষতের দুর্গন্ধ যেমন মক্ষিকাকেই আকর্ষণ করে; তেমনি ভ্রষ্টাচারী রাজার রাজভবন অচিরেই হয়ে ওঠে দুর্মতি রাজপুরুষগণের বিচরণভূমি। এ বিষয়ে বোধহয় ক্ষত ও মক্ষিকা উভয়েরই সমান দায়ভার রয়েছে। এইভাবে উপযুক্ত পার্ষদবর্গ পরিবৃত হয়ে রাজা নন্দী এতদিন নহুষের চরণে যথোচিত তৈলপ্রয়োগ করে নিজের প্রমোদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করে আসছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছে চৈত্রবংশের বর্তমান রাজা মহারাজ সুরথ। তুমি স্বপুরে যে পূর্ণিমার রাতে বৃদ্ধ কথকের কাহিনী শুনে এলে; এই মুহূর্তে তুমি তার পঞ্চবর্ষ পরের হেমন্তকালীন এক রাতে উপস্থিত হয়েছ। এই সময়ের মধ্যে পিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সুরথ তাঁর মহাবীর সৈন্যবাহিনীর সহায়তায় আবার সমগ্র ক্ষিতিমণ্ডলে সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু করেছেন। ভারতবর্ষ ইতিমধ্যেই তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছে। ধীরে ধীরে ইলাবৃতবর্ষের দিকে এগিয়ে আসছে তাঁর হস্তিবাহিনী। বঙ্গবীরগণের রণহুঙ্কার এখন দূরদর্শী নন্দীর অভিজ্ঞ কর্ণে স্পষ্ট ধ্বনিত হচ্ছে। তাই তিনি সম্প্রতি দেবেন্দ্র নহুষের কাছে পত্র প্রেরণ করেছিলেন তাঁর অভিমত জানতে। পত্রের উত্তর না আসা পর্যন্ত তিনি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না। তাই বর্তমানে তিনি সুরার মধ্যে আকন্ঠ ডুবে আছেন দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার আকুল প্রয়াসে।”
কিন্তু নন্দী রাজার অপেক্ষা আর দীর্ঘায়িত হল না। কালপুরুষের বক্তব্য শেষ হতেই দেখলাম গিরিসংকটের পথে আগত অশ্বারোহী দূতকে। সন্তর্পণে অশ্বচালনা করে অচিরেই সে উপনীত হল রাজভবনে। ভবনের দ্বাররক্ষী তাকে শীঘ্র নিয়ে গেল রাজার কাছে। আমরা আবার ঐ তামসিক সভায় প্রবেশ করলাম। দেখলাম দূতের আগমন ঘটতেই পানোন্মত্ত নন্দীর রক্তাভ চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। তিনি এখন সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ। এইটি তাঁর একটি প্রশংসনীয় রাজোচিত গুণ বটে। দূতের কাছ থেকে পত্র নিয়ে জতুমুদ্রা ভগ্ন করে তিনি নিরবে দ্রুত পাঠ করলেন। তারপর আবার তাঁর মুখে ছায়া নেমে এল। সমস্ত উদ্দীপনা আবার প্রত্যাগত শিথিলতার মধ্যে হারিয়ে গেল। রাজাকে আবার সুরাপূর্ণ মণিচষক তুলে নিতে দেখে মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন: মহারাজ। দেবরাজ নহুষ কি সম্মত হন নি?’
‘না।’ বলে উঠলেন নন্দী। ‘ সুরথ অত্যন্ত কূটনীতিজ্ঞ। সে নহুষের কাছে ইতিমধ্যেই বার্তা প্রেরণ করেছে যে দেবরাজের সাথে সংঘর্ষ করার কিম্বা ইন্দ্রপদ লাভের কোনো বাসনাই তার নেই। সে শুধু ক্ষিতিমণ্ডলের একচ্ছত্র সম্রাট হতেই দিগ্বিজয় যাত্রা করেছে। তার মন্ত্রীমণ্ডলে এখন অরুণাশ্ব, সোমপা, সুপ্রতীপ প্রমুখ বেদজ্ঞ আর্যগণ আছেন। তাঁরা দেবেন্দ্রের সম্মানে সুরথের সমগ্র সাম্রাজ্যে যজ্ঞ সম্পাদনের দায়িত্ব নেবেন এবং দেবগণের উদ্দেশ্যে হবি ও ক্রব্যের আহুতিতে কোনো বাত্যয় হতে দেবেন না। তাতেই নহুষ ও অন্যান্য দেবগণ একেবারে বিগলিত হয়ে সুরথকে সমর্থন করেছেন। এমনকি সুরথের বিপদে তিনি যে বজ্রহস্তে তাঁকে রক্ষা করবেন সেই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। পত্রে রাজনৈতিক শালিন্যটুকু মাত্র রক্ষা করে আমার প্রতি যেভাবে তাচ্ছিল্যের প্রদর্শন তিনি করেছেন তাতে বেশ বুঝেছি আমার সাথে মৈত্রীর বিষয়ে তাঁর আর আগ্রহ নেই।
ভেবেছিলাম নহুষকে সুরথের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে পারলে বিনা আয়াসেই আর্যাবর্তের স্বর্ণপ্রসূ ভূমিতে আমার অধিকার বিস্তৃত করতে পারব। কিন্তু সেই আশায় জলাঞ্জলি হল দেখছি।’ শেষের কথাটি বলে এক চুমুকে পাত্রের সুরা নিঃশেষিত করে সেটিকে সবেগে নিক্ষেপ করলেন নন্দী। রত্নচষকটি লৌহস্তম্ভে প্রতিহত হয়ে ধাতব শব্দ ধ্বনিত হল। নিস্তব্ধ সভাকক্ষে সেই শব্দ যেন অন্তঃসারশূন্য রাজার মহত্বাকাক্ষার ব্যর্থ প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ করে গেল। সভায় রাজা ও সভাসদদের গম্ভীর মুখ দেখে উপস্থিত বন্দিনীগণ অন্তরে উৎফুল্ল হল। সাধারণত অপ্রসন্ন অবস্থায় রাজা নন্দী নারীদেহের প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করেন না। হয়ত আজকের রাতটিও তাদের সৌভাগ্যক্রমে সেইরকম একটি ক্ষণস্থায়ী শান্তির রাত হতে চলেছে।
এদিকে মন্ত্রীর দৃষ্টি তখন সেই সুরাশূন্য পাত্রটির দিকে নিবদ্ধ। তাঁর কুটিল মস্তিষ্কে তখন এক ধূর্ত পরিকল্পনার উদয় হয়েছে। উৎফুল্ল কন্ঠে সহসা তিনি বলে উঠলেন: ‘ সমাধান একটা পাওয়া গেছে মহারাজ। নহুষের সাহায্য ছাড়াই সুরথকে পর্যুদস্ত করার একটা উপায় আছে।’
‘কি উপায়?’ নন্দী জড়িত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন।
মন্ত্রী ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে সুরাপাত্রটির দিকে নির্দেশ করে বললেন:’ ঐটিই সমাধানের উপায়।’
নন্দী জলদগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন:’ মন্ত্রী! পরিহাসের স্থানকালপাত্র থাকে। সেই নূন্যতম জ্ঞানটাও কি তোমার লোপ পেয়েছে? এখন কি কৌতূকের সময়?’
মন্ত্রী কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন:’ মহারাজ আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি পরিহাস করছি না।’
‘তাহলে অনুগ্রহ করে আমাকে বোঝাও সুরাপাত্রের মধ্যে কি সমাধান তুমি খুঁজে পেলে।’ রাজা ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলেন।
‘সুরাপাত্রে আপনি কোন্ সুরা পান করছেন বলুন তো মহারাজ? ‘ মন্ত্রী মৃদু হেসে বললেন।
‘দ্রাক্ষারস। যবনদেশের উৎকৃষ্ট সুরা।’ বলেই সচকিতে মন্ত্রীর দিকে দৃষ্টি ফেরালেন রাজা নন্দী। মন্ত্রীর মুখে তখন কুটিল হাসি খেলা করছে। সেই হাসি ধীরে ধীরে তাঁর মুখেও সংক্রামিত হল।
‘ তুমি কি যবনদের সেই উন্মত্ত দেবতার কথা বলছ মন্ত্রী? যে এই দ্রাক্ষারস থেকে মদিরা প্রস্তুতি আবিষ্কার করেছে।’
‘মহারাজ যথার্থ অনুমান করেছেন।’ বললেন মন্ত্রী।
‘ সেই দেবতা শুধু মদিরার আবিষ্কারক নন। মত্ততার ও পরাক্রমের মূর্ত বিগ্রহও বটে। মানবের উন্মত্ত প্রবৃত্তিকে শস্ত্র রূপে ব্যবহার করে কার্যোদ্ধার করতে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।’
‘উত্তম! এই দেবতা তো পশ্চিম সমুদ্রের এক দ্বীপে বাস করেন। তাই না?’ নন্দী রাজা প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ মহারাজ।’ মন্ত্রী জানালেন। ‘ পূর্ববর্তী দেবেন্দ্র দ্যায়ুসের সময় থেকে তাঁর সাথে ইন্দ্রাণীর চরম শত্রুতা বিদ্যমান। সেই কারণে তিনি ঐ নিশা নামক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে মহাকায় দৈত্যগণের সাথে বাস করেন। তিনি দ্যৌনিশাস্ নামে প্রসিদ্ধ। একইসঙ্গে উন্মত্ত পরাক্রম ও কূটবুদ্ধির বিরল সমাবেশ এই দেবপুত্র। দ্রাক্ষালতার মাদকগুণকে তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা কার্যকর আয়ুধে পরিণত করেছেন। তাঁর মদোন্মত্ত দৈত্যবাহিনী রণক্ষেত্রে কালেরও ভীতি উৎপাদনে সমর্থ।’
‘ তবে ইনিই আমাদের সমস্যার সমাধান হতে পারেন মন্ত্রী। যে যবন বণিকগণ ঐ নিশা দ্বীপ থেকে মদিরা নিয়ে আসে তাদের কাল রাজসভায় আহ্বান করো।’ রাজার এই কথায় মন্ত্রী ক্রুরকের মুখে কুটিল হাসির রেখা আরো প্রশস্ত হল। নন্দী এতক্ষণে জড়তা ত্যাগ করে উচ্চকিত অট্টহাসিতে সভাকক্ষ পূর্ণ করে তুললেন। তারপর তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হল সভাকক্ষের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা নারীগণের প্রতি। তারা তখন পাণ্ডুর বদনে কম্পমান বক্ষে লক্ষ্য করছে রাজার আরক্ত চোখে সেই চিরপরিচিত জান্তব কামনার শিখা। আজ আর শেষরক্ষা হল না। রাজার ইঙ্গিতে সভাসদগণ কক্ষত্যাগ করলেন। ভীমকায় প্রহরীগণ খড়্গহস্তে দ্বারের বাইরে স্থান গ্রহণ করল। রুদ্ধদ্বারের পশ্চাতে সভাকক্ষের ম্রিয়মান দীপশিখা শিহরিত হয়ে উঠল সমবেত নারীকণ্ঠের বেদনার্ত শিৎকারের সাথে এক কামান্ধ পুরুষের মদোদ্ধত হাস্যের ভয়াল সমাবেশে। আর আমি এই প্রথম কালপুরুষের হাত ধরে পুনর্বার প্রলয়ঙ্কর বেগে যাত্রারম্ভে ভয়ের পরিবর্তে স্বস্তি বোধ করলাম।
চারিদিকে নীল সমুদ্রের অন্তহীন জলরাশি। তারই মধ্যে বিন্দুর মতো এই ক্ষুদ্র দ্বীপ। যেন প্রকৃতির হাতে গড়া এক রমণীয় খেলাঘর। পাথরের মাঝে মাঝে বর্ষার ধারায় পুষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী ঝর্ণাধারা আপন গতির নেশায় বয়ে চলেছে। তাদের স্পর্শে এই আগ্নেয় শিলায় নির্মিত দ্বীপের মৃত্তিকা হয়ে ওঠে প্রাণশক্তির আধার। সেই জীবনরসের ধারা শোষণ করে প্রাকৃতিক ভাবেই বেড়ে ওঠে অনেক মহীরুহ। আবার সেই মহীরুহদের অবলম্বন করে স্বতঃই বৃদ্ধি পায় দ্রাক্ষালতা। রসপূর্ণ ফলের সমাবেশে প্রায়ই তাদের পত্ররাশি আবৃত হয়ে থাকে। দ্বীপের বহুস্থানেই দেখতে পাওয়া যায় দুটি মহীরুহের বক্রশাখা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে চন্দ্রাতপের সৃষ্টি করেছে এবং সেই চন্দ্রাতপ থেকে বিলম্বিত দ্রাক্ষালতা বিশ্রামকুঞ্জের মায়াজাল সৃজনের জন্যই লম্বমান। দ্বীপের পূর্ব সীমান্তে এইরকমই এক কুঞ্জের ছায়ায় আলস্য অপনোদন করছিলেন তিনি। কপাটবক্ষ, সিংহকটি, বৃষস্কন্ধ প্রভৃতি পৌরুষের চরম প্রকাশজ্ঞাপক সমস্ত বিশেষণই তাঁর বলিষ্ঠ দেহে পূর্ণ সার্থকতা লাভ করেছে। লতামুকুটে বেষ্টিত হিরণ্যবর্ণ কেশরাজি লালিত্যময় মুখমণ্ডলকে আরো কমনীয় করে তুলেছে। তাঁর এই শান্ত প্রসন্ন দেহশ্রী যে কোনো নারীর হৃদয় উদ্বেল করে তুলতে সক্ষম। তাঁর হস্তে ধৃত দ্রাক্ষালতা। দেখে মনে হয় সৃজনশীল সূক্ষ্ম কর্মের জন্যই ঐ হস্ত নির্মিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর এই প্রশান্ত রূপের অন্তরালে যে মহাশক্তি নিহিত আছে তার পরিচয় সহসা পাওয়াই যায় না। তাঁর অধিকাংশ প্রতিপক্ষই এই ভুলেরই শিকার হয়েছেন। তাঁরা ধারণা করতেই পারেন নি যে এই আপাত কোমলস্বভাব যুবা যখন ক্রুদ্ধ হন, যখন রণোন্মত্ততার প্রচণ্ড আবেশে তাঁর গৌরবর্ণ মুখে শোণিতাভা সঞ্চারিত হয়, তখন তাঁর ভীষণ মুদ্গরধারী বাহু, সুভৈরব হুঙ্কার আর তাঁর অনুগত মহাকায় দানববাহিনীর পদধ্বনি স্বয়ং কালেরও ভীতি উৎপাদন করে। জন্মলগ্ন থেকেই তাঁর জীবন দেবগণের অন্তর্দ্বন্দ্বে বারংবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বাল্যকালেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁর পালক পিতার সমগ্র পরিবার কিভাবে দেবরাজ্ঞীর ছলনায় আত্মঘাতী ক্রোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। দেখেছেন দ্রাক্ষালতার প্রতি অতি কৌতূহলে বৃক্ষারোহণ করতে গিয়ে তাঁর মিত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু। এই সমস্ত শোকাবহ ঘটনাই তাঁর মেধাকে আরো তীক্ষ্ম করেছে। দ্রাক্ষারসের মাদকতা ও ক্রোধের মাদকতা উভয়ের রহস্যই তিনি সম্যকভাবে জ্ঞাত আছেন। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী মাদকতার শক্তিকেই নিজের সর্বাপেক্ষা বিধ্বংসী আয়ুধে পরিণত করেছেন তিনি। মধ্যাহ্নের অলস অবসরে ছায়ানিবিড় এই কুঞ্জে বসে তিনি নিজের অতীত জীবন নিয়েই ভাবছিলেন। শিশুকালেই অমরাবতীতে তাঁর তীব্র ক্রন্দনধ্বনি শুনে বজ্রপাণি দ্যায়ুসেরও অন্তরে কম্পন শুরু হয়েছিল। তাই মর্ত্যমানবীর গর্ভজাত নিজের এই গোপন পুত্রের নাম তিনি দিয়েছিলেন বাক্কাস; অর্থাত্ মহানাদকারী। তারপর অনেক নাটকীয় পটপরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি আজ নিশা দ্বীপের অধীশ্বর দ্যায়ুসপুত্র। সকলে তাঁকে দ্যায়ুর্নিশাস বলে সম্বোধন করে। অনেক নির্মম সংগ্রামের পথে তিনি নব্য আবিষ্কৃত দ্রাক্ষারসজাত সুরার প্রসার করে ফেলেছেন জগতের বৃহত্তর অংশে। সাথে সাথে তাঁর প্রতিপত্তিও শিখরচুম্বী হয়ে উঠেছে। তাঁর কাছে ইতিমধ্যেই সংবাদ এসেছে যে স্বর্গের সর্বোচ্চ সম্মানিত দেবমণ্ডলীর দ্বাদশ এবং সর্বশেষ সদস্যরূপে তাঁর স্থান প্রায় সুনিশ্চিত। দুই বর্ষ আগে এই দ্বীপে ইতস্ততঃ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এসে তিনি দেখা পেয়েছিলেন নিজের জীবনসঙ্গিনী আরিয়াদনের। আরিয়াদনে তখন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকের কপটতার শিকার হয়ে ভগ্নহৃদয়ে এই নির্জন দ্বীপে নির্বাসিতা। বাক্কাস তাঁর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে বিলম্ব করেননি। তারপর থেকেই তাঁরা এখানে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে মধুর দাম্পত্য জীবনের রসাস্বাদন করছেন। দ্যায়ুর্নিশাস ভাবছিলেন সমস্ত দেবোচিত কীর্তিই এখন তাঁর করায়ত্ত। শুধু একটি ছাড়া। সেটা সম্পন্ন হলেই…. কিন্তু তাঁর ভাবনায় ছেদ পড়ল। পূর্বদিক থেকে সমুদ্রপথে তাঁরই অনুগামী বণিকগণের একটি নৌযান দ্বীপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি উঠে কুঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসামাত্রই রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের নিচে তাঁর তেজস্বী অবয়ব দেখে সমস্ত নাবিক করজোড়ে তাঁর বন্দনাগীতি শুরু করল। প্রসন্ন হাস্যে তিনি দক্ষিণ কর উত্তোলন করে তাদের অভয় দিয়ে আহ্বান জানালেন নিজের ভবনে।
যুদ্ধক্ষেত্র কোলাপুর। কাশ্মীরের বায়ুকোণে সংকীর্ণ গিরিবর্ত্মের মুখে এক দুর্গনগরী। বহির্জগত থেকে জম্বুদ্বীপে প্রবেশের প্রধান সরণীটির রক্ষণার্থেই এই দুর্গ নির্মিত। দুর্গের সম্মুখের সংকীর্ণ প্রান্তরে সুরথ তাঁর তিরন্দাজ বাহিনীর সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পাশে রাক্ষসনায়ক লম্বোদর এবং ভার্গব সুতীক্ষ্ণ। বাকি সৈন্যগণ দুর্গের মধ্যে সুসজ্জিত অবস্থায় আদেশের অপেক্ষা করছে। ভৃগুবংশীয়দের সাথে যবনদের সম্পর্ক কখনওই মধুর নয়। আবার আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়েও নিজস্ব কিছু উদ্ভাবনী কৌশল তাঁরা জানেন। তাই সুরথ সুতীক্ষ্ণকে নিজ তিরন্দাজ বাহিনীর প্রধানরূপে বরণ করেছেন। যদিও সুরথের বৃদ্ধ মন্ত্রীর এতে মত ছিল না। মহারাজকে তিনি বুঝিয়েছিলেন; এই বিষয়ে বিশ্বকর্মা বা ময় সম্প্রদায়ের শিল্পীদের উপরেই নির্ভর করা উচিত। কিন্তু ইদানিং বৈদিক সমাজে সুরথ কিছুটা প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। ভৃগুবংশীয়দের পরিবর্তে ঐ সমুদ্রতীরের অনার্যদের মাথায় তুলতে তিনি মোটেই আগ্রহী নন। সহসা যবননায়কদের দূরাগত রণধ্বনি কানে এল। সুরথ ভার্গবের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ শিরশ্চালন করলেন। তাঁদের সাথে অবস্থিত তিরন্দাজ বাহিনী আগের মতোই নিশ্চল হয়ে রইল। দেখলাম দুর্গে অবস্থানরত সৈন্যগণ বিস্মিত হয়ে গেছে। শত্রু এত কাছে অথচ মহারাজ আক্রমণের কোনো সংকেত দিচ্ছেন না। কোষবদ্ধ তরবারি সামনে রেখে দাঁড়িয়ে আছেন নিশ্চিন্তে। আবার আজ প্রভাতেই তাদের বলেছেন: শুধু তিরন্দাজ বাহিনী দিয়েই যুদ্ধজয় হয়ে যাবে। তারা সকলেই একথা শুনে হতচকিত হয়ে গেছে। তারা শুনেছে যবনবাহিনীতে মহাকায় দৈত্যগণ আছে। তাদের সম্মুখীন হতে দেবতারাও ভয় পান। এমন এক বাহিনীর দূরাগত নিনাদ শুনেও মহারাজ এইভাবে শান্ত আছেন কি করে? তবে বিস্মিত হলেও বিচলিত হয়নি তারা। তাদের অতিপ্রিয় এই তরুণ নৃপতির রণপাণ্ডিত্যের পরিচয় তারা ইতিপূর্বে দিগ্বিজয়যাত্রার সময়েই পেয়েছে। কিম্পুরুষবর্ষের মায়াবী কিন্নরদের বিরুদ্ধে নৈশযুদ্ধে যেভাবে রাক্ষসজাতির মায়াজালের প্রয়োগ তিনি করেছিলেন; শাকদ্বীপের নৃপতির অজেয় দুর্গের সামনে যেভাবে হস্তিবাহিনীকে সঞ্চালিত করেছিলেন; তারপরে আর তাঁর রণনীতি নিয়ে সন্দেহের কোনো অর্থই হয় না।
আচম্বিতে সামনের গিরিবর্ত্মের পথে তারা দৃষ্টিগোচর হল। তারা বলছি এই কারণেই; কারণ কোনো সাধারণ সৈন্যবাহিনীর সাথে তাদের তুলনাই চলে না। অতিদীর্ঘ পৃথুল কলেবর, লৌহকঠিন পেশল বাহু, মদোন্মত্ত উগ্র দৃষ্টি, অথচ শ্বাপদের মতো ক্ষিপ্রগতি নিয়ে দ্যায়ুর্নিশাসের মহাদৈত্যবাহিনী ছুটে আসছে। তাদের আগে আগে রথারূঢ় হয়ে আসছেন নন্দী ও দ্যায়ুর্নিশা। গিরিবর্ত্মের মুখে এসে দ্যায়ুর্নিশা হাত তুললেন। সমাগত প্রলয়ের মতো সেই ভৈরববাহিনী থেমে গেল। দ্যায়ুর্নিশা নন্দীকে বললেন: আমাদের প্রতিপক্ষকে তো মোটেই আক্রমণের মেজাজে আছে বলে বোধ হচ্ছে না। সঙ্গে আবার দেখছি এক ঋষিও আছেন। তোমাদের ইলাবৃতবর্ষে এঁরা প্রায়ই যাতায়াত করেন দেখেছি। মনে হয় দেবপুত্র স্বয়ং আসছেন দেখে সুরথ যুদ্ধের ইচ্ছা ত্যাগ করেছে।
নন্দী কিন্তু সংশয়াকুল দৃষ্টিতে বিভ্রান্তের মতো চেয়ে আছেন। এ কি করে সম্ভব! সুরথ এতটাও হীনবল নয় যে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করবে। তিনি দ্যায়ুর্নিশাকে বললেন: সেক্ষেত্রে আমাদের সামনে সুবর্ণসুযোগ উপস্থিত। সুরথকে কিন্তু কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সে যদি যুদ্ধ না করতে চায় তাহলে বরং এগিয়ে গিয়ে আমরা তাকে বন্দী করব। তারপর তার বাহিনীর আত্মসমর্পণ আমরা স্বীকার করব।
‘উত্তম। তাই হবে।’ বলে দ্যায়ুর্নিশা তাঁর লৌহপাশ হাতে তুলে নিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর রথ এগিয়ে আসতে থাকল সুরথের দিকে। দূরত্ব কমতে কমতে ক্রমে ত্রিশ হস্তে এসে দাঁড়াল। হঠাত্ সুরথ বিদ্যুতবেগে তাঁর তরবারি তুলে সামনে ইঙ্গিত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসবীর লম্বোদর তাঁর সুদীর্ঘ ভল্ল নিক্ষেপ করলেন দেবপুত্রের রথচক্র লক্ষ করে। অব্যর্থ লক্ষ তাঁর। মুহূর্তে রথচক্র ভেঙে দ্যায়ুর্নিশা ভূপাতিত হলেন। হতচকিত নন্দী ও দৈত্যগণ তাঁর এই অবস্থা দেখে ক্ষণিকের জন্য বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। সামলে নিয়ে দৈত্যগণ শত্রুপক্ষের কূটবুদ্ধি বুঝতে পেরে হুঙ্কার দিয়ে উঠল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তাদের। সম্মুখে তাকিয়ে তারা দেখল আকাশ ছেয়ে গেছে তিরন্দাজ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত অগণিত অগ্নিমুখ বাণে। পলক পড়তে না পড়তে সেই কালসর্পের মতো বাণের বর্ষা শুরু হল তাদের উপর। বাণগুলি ভূমিতে প্রোথিত হয়েই ভীমনাদে বিস্ফোরিত হতে থাকল। আর তার অভিঘাতে দৈত্যবাহিনীর অগ্রণী সৈন্যগণ ধরাশায়ী হতে থাকল। দ্যায়ুর্নিশা আর নন্দী কোনোক্রমে রথ নিয়ে পালালেন। সুরথের সৈন্যরা জয়ধ্বনি দিতে থাকল। সামনের গিরিবর্ত্মের পথে দগ্ধাবশিষ্ট কয়েকজন দৈত্যের মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই থাকল না।
সুরথ উচ্চকণ্ঠে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন: আপাতত এটাই আমাদের যুদ্ধনীতি। যত বড় বাহিনীই হোক; এই গিরিবর্ত্মের মুখে এলেই তারা শমনভবনে যাবে। তিরন্দাজগণ। তোমরা অনলবর্ষী বাণসমূহ প্রস্তুত রাখো।
আবার তাঁরা প্রতীক্ষা করতে থাকলেন। কিন্তু এবার যা ঘটল তার জন্য সুরথ একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি যখন সম্মুখে শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে অপেক্ষারত; তখন হঠাত দুর্গের ভিতর থেকে সৈন্যদের আর্তকন্ঠ শোনা গেল। সুরথ ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন দুর্গে সৈন্যগণ বিশৃঙ্খলভাবে ছোটাছুটি করছে। কি হয়েছে সেখানে? এখনই একবার যাওয়া দরকার। তিনি ভার্গব সুতীক্ষ্ণকে তিরন্দাজ বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে লম্বোদরকে নিয়ে চললেন দুর্গের দিকে। পথে এক কিরাতযোদ্ধাকে দেখতে পেলেন। রক্তাক্ত দেহে ভয়ার্তভাবে সে তাঁর দিকে ছুটে এসে জানাল: আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে মহারাজ। দুর্গের গুপ্তদ্বার খুলে গেছে। সেই পথে ঐ মহাকায় দৈত্যগণ দুর্গে ঢুকে আমাদের আচম্বিতে আক্রমণ করেছে মহারাজ। আমাদের শস্ত্র তাদের দেহ ভেদ করতে পারছে না। সৈন্যগণ বীরের মতো সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করেও প্রতিরোধ করতে পারছে না।
এই বলেই সে অবসন্ন দেহে লুটিয়ে পড়ল। সুরথ ব্যগ্রভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: গুপ্তদ্বারের বিষয়ে ওরা জানল কি করে? কে দ্বার খুলে দিয়েছে?
মূর্চ্ছিত হওয়ার আগে কিরাতবীর কোনোক্রমে বলল: অমাত্য ।
বজ্রাহতের মতো বিমূঢ় হয়ে গেলেন সুরথ। এতদিনের দায়িত্ববান অমাত্য এইভাবে অন্তর্ঘাত করবেন এ যেন কল্পনা করাও কঠিন। লম্বোদর বলল: মহারাজ। আপনি তিরন্দাজ বাহিনীর কাছে থাকুন। আমি দুর্গে যাচ্ছি। রাক্ষসী মায়ায় আমি ওদের বিভ্রান্ত করে রাখব যতক্ষণ সম্ভব। প্রণাম মহারাজ।
বলে অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল সুরথের প্রিয় রাক্ষসবীর।
সুরথ সম্মুখে এসে দেখলেন: আবার নন্দী ও দ্যায়ুর্নিশা নন্দীর সৈন্যদের নিয়ে ফিরে এসেছেন গিরিবর্ত্মের মুখে। নন্দীর মুখে কুটিল হাসি। কিন্তু নন্দীর পাশে ও কে? অরুণাশ্ব না? সুরথ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এও সম্ভব? যে অরুণাশ্ব প্রত্যহ অগ্নিহোত্র না করে জলপান করে না; সে আজ তাঁর সাথে অবলীলায় এমন ছলনা করছে? সুরথ বুঝলেন তাঁর আগেই এটা ধরতে পারা উচিত ছিল। অরুণাশ্বকে তিনি স্বর্গসভায় রেখেছিলেন নহুষের সাথে কূটনৈতিক সন্ধি রক্ষা করতে। তার পরেও ইলাবৃতবর্ষ থেকে আচম্বিতে এরকম সমরাভিযান শুরু হল অথচ তিনি তার কোনো অগ্রিম সংবাদ পেলেন না; এর অর্থই হল নহুষের এই অভিযানে সমর্থন আছে এবং অরুণাশ্বও এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছে। তিনি নিজেকে সংযত করে ভার্গবের প্রতি আদেশ করলেন আক্রমণ শুরু করতে। কিন্তু ভার্গবের ধনুক সহসা থেমে গেল। অরুণাশ্ব অশ্বারূঢ় হয়ে এগিয়ে এল তাঁর দিকে। হাতে একটি পত্র। ভার্গবের হাতে তুলে দিয়ে বলল: আপনাদের গোত্রপতি ভৃগু দেবরাজের আদেশে এই পত্র প্রেরণ করেছেন। দস্যুজাতির এই হীন নৃপতিকে সহায়তা করে বৈদিক সমাজের দ্বারা আশ্রিত ধ্রুববংশীয় নন্দীর বিজয়ের পথে আপনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে গোত্রপতি আপনার প্রতি রুষ্ট হবেন। আপনি আপনার আগ্নেয় বাণসমূহ নিয়ে আমাদের পক্ষে আসুন।
তারপর সুরথের দিকে ব্যঙ্গদৃষ্টি দিয়ে বলল: আপনার ক্ষিতিপতি হওয়ার দিন আজই শেষ। প্রস্তুত থাকুন।
সুরথকে একটি কথাও না বলে ভার্গব সুতীক্ষ্ণ তাঁর অস্ত্রসমূহ নিয়ে অরুণাশ্বের অনুগমন করলেন।
সুরথ মুহূর্তকাল নিরব থেকে নিজেকে সংযত করলেন। পরাজয়ের ভয় তাঁর নেই। শত্রুদের দেখিয়ে দিতে হবে বিশ্বাসঘাতকতা করেও তাঁর বিরুদ্ধে জয় অসম্ভব। তাঁর ইঙ্গিতে সৈন্যগণ তূর্যনাদ করে উঠল। গদা ও ভল্লধারী যোদ্ধাগণ মুহূর্তে এগিয়ে এল। সুরথ তাঁর গদা নিয়ে এগিয়ে গেলেন। নন্দী তাঁকে গদা নিয়ে আসতে দেখে রথ থেকে গদা নিয়ে নেমে পড়লেন। তাঁর মনে হল এই এক সুবর্ণসুযোগ উপস্থিত হয়েছে। এই তরুণ তাঁর মতো প্রাজ্ঞ গদাধারীর সম্মুখে এক দণ্ডও দাঁড়াতে পারবে না। তিনি ঘোষণা করলেন: আমাদের এই দ্বৈরথে যে বিজয়ী হবে সেই যুদ্ধজয়ী বলে স্বীকৃত হবে। ইতিমধ্যে দুই পক্ষের সৈন্যগণ প্রাণপণ প্রবল সংগ্রাম শুরু করল। অস্ত্রের সংঘাতে আর সৈন্যদের মুহুর্মুহু নিনাদে রণস্থল মুখরিত হয়ে উঠল।
দ্যায়ুর্নিশার মুখে কিন্তু চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তিনি গদা ধরার ভঙ্গিতেই বুঝেছেন সুরথ যথেষ্ট কুশলী বীর। এত সহজে নন্দী জিততে পারবেন না। তাঁর আশঙ্কা সত্য হতে সময় লাগল না। প্রথম থেকেই উৎসাহের আতিশয্যে নন্দী সুরথকে আঘাত করার চেষ্টা করতে থাকলেন। আর সুরথ শান্তভাবে প্রতিটি আঘাত প্রতিহত করতে থাকলেন। যত সময় অতিবাহিত হতে থাকল; নন্দী ততই ভিতরে ভিতরে শ্রান্ত হতে থাকলেন। তাঁর ঘর্মাক্ত দেহ আর ধীরে ধীরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শ্বাসের গতির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বুঝে সুরথ এবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন। তাঁর উপর্যুপরি আঘাতে নন্দী দিশেহারা হয়ে পড়লেন। সুরথ নন্দীকে প্রায় ভূপাতিত করে গদা নিয়ে চূড়ান্ত আঘাত করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু এবার দ্যায়ুর্নিশা তাঁর অমোঘ কৌশল প্রয়োগ করলেন। যুদ্ধরত সুরথের বাম উরুকে সবেগে বেষ্টন করল তাঁর লৌহপাশ। পরমুহূর্তেই বলিষ্ঠ টানে ভূপাতিত হলেন সুরথ। আর সেই সুযোগে নন্দী নিজের সমস্ত সামর্থ্য দিয়ে চরম আঘাত হানলেন। সুরথের গদা খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল। নন্দী অট্টহাস্য করে উঠলেন। তিনি গদা তুললেন সুরথের মস্তক লক্ষ করে। কিন্তু সহসা চতুর্দিকে ঘোর অন্ধকার নেমে এল। এক কৃষ্ণবর্ণ কুজ্ঝটিকা যেন আচম্বিতে যবনিকা টেনে দিল এই দ্বৈরথের উপর। আহত সুরথ কিছু বোঝার আগেই দুটি বিশ্বস্ত হাত তাঁকে তুলে নিল অশ্বের উপরে। আর প্রবলবেগে ছুটতে থাকল অশ্বটি। সম্বিত ফিরে পেয়ে সুরথ ক্লান্ত স্বরে বললেন: লম্বোদর তুমি!
লম্বোদর রক্তাক্ত দেহে বিদ্যুতবেগে অশ্বচালনা করে সুরথকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে স্বপুরের দিকে নিয়ে চলল। কিছু দূরে মূল ভূখণ্ডে তাঁর সৈন্যদের কয়েকটি গুল্ম অপেক্ষারত এইরকম কোনো অপ্রত্যাশিত বিপদে রাজাকে রক্ষা করে রাজধানী নিয়ে যাওয়ার জন্য। এদিকে অরুণাশ্বের চরেরা কোলাপুর দুর্গের সাথে মূল ভূখণ্ডের মধ্যেকার সেতুটি ভেঙে দিয়েছে যাতে সুরথ পালাতে সক্ষম না হন। কিন্তু তার জানা নেই লম্বোদরের এই বিশেষ অশ্বটির একটি গুণের কথা। স্বাভাবিক ঘোটকের থেকে অন্ততঃ দশগুণ অধিক দূরত্ব একলাফে পেরিয়ে যাওয়া রাক্ষসভূমির এই পক্ষীরাজ ঘোড়ার পক্ষে একেবারেই কঠিন নয়। লম্বোদর ঘোড়ার পেটে জানু চেপে ইঙ্গিত করতেই অকুতোভয়ে পক্ষীরাজ সুরথ ও লম্বোদরকে নিয়ে সম্মুখের অতলস্পর্শী খাতের উপর দিয়ে লাফিয়ে গেল। অপর পারে সৈন্যদল ছুটে এল তাদের প্রিয় মহারাজকে আহত দেখে। সুরথ ও লম্বোদর রক্তাক্ত আহত দেহে অসহায় ভঙ্গিতে দেখলেন লম্বোদরের মায়ায় সৃষ্ট অন্ধকার কেটে গেছে। সুরথকে বধ করতে ব্যর্থ হয়ে নন্দী ক্রোধে আস্ফালন করে দুর্গের দিকে ইঙ্গিত করে কিছু একটা আদেশ দিলেন। পরক্ষণেই সুউচ্চ কোলাপুর দুর্গের প্রাকার ভার্গবদের অনলবর্ষী বাণের উপর্যুপরি আঘাতে ধূলিসাত্ হতে থাকল। ভগ্ন গিরিদুর্গের শিলাখণ্ডগুলিকে মুষ্ট্যাঘাতে চূর্ণ করতে থাকল দ্যায়ুর্নিশার দৈত্যগণ। আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আমার মাতৃভূমির মহারাজ নিজের ভুলে এতবড় সর্বনাশের সম্মুখীন। কালপুরুষ বললেন: এই কোলাপুর ধ্বংস করে নন্দীর ঐ যবনযোদ্ধাগণ জগতে কোলাবিধ্বংসী নামে পরিচিত হল। অস্তায়মান সূর্যালোকে সুরথের বিষণ্ণ মুখ দেখতে দেখতে আমরা আবার কালযাত্রা শুরু করলাম।
ঘোর অন্ধকার এক প্রান্তর। চতুর্দিকে বৃক্ষ প্রাণী পর্বত নদী সরোবর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। চরাচর যেন এক সীমাহীন শূন্যতায় বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি পবনের মৃদুসঞ্চারণের ধ্বনিও যেন সংকোচে মৌন হয়ে আছে। সেই মহা অন্ধকারে তিনি একাকী ইতস্তত ভ্রমণ করে চলেছেন। সাধ্যমতো সমস্ত দিক নিরীক্ষণ করে চলেছেন উদভ্রান্তের মতো। যদি কোথাও একটি ক্ষীণ আলোকরশ্মি দেখা যায়। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সর্বগ্রাসী তমোরাশি সমস্ত চেতনাকে গ্রাস করতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে যেন। একসময় অবসন্ন দেহে ক্ষণিকের জন্য থামলেন তিনি। নিরবতার অসহনীয় ভার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইলেন। কিন্তু কন্ঠ থেকে স্বর নির্গত হল না। আতঙ্কিত চিত্তে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করতে গিয়ে চমকে উঠলেন। তাঁর চরণদ্বয়ের কোনো অস্তিত্বই আর উপলব্ধি করতে পারছেন না যেন। স্পর্শ করে দেখতে গিয়ে আবার আতঙ্কের এক স্রোত সর্বাঙ্গে স্পর্শ করল। একি! তাঁর হস্তদ্বয়ও লুপ্ত হয়েছে ঘোর তমিস্রার মধ্যে। নিঃসীম শূন্যতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয়, সমস্ত চেতনা। ব্যাকুল চিত্তে বেদের ঋকসমূহ স্মরণ করতে গেলেন। বহুকাল যাবত এই ঋকসমূহ ওজঃদীপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন তিনি। যজ্ঞভূমিতে উদ্গাতাগণের কন্ঠে মধুর সামগান তাঁর অন্তরে প্রভূত উদ্যমের সঞ্চার করেছে। কিন্তু আজ এই চূড়ান্ত সংকটে তাদের একটিও স্মরণে আসছে তাঁর। তবে কি এই অন্ধকারেই লুপ্ত হয়ে যাবেন তিনি চিরতরে? কেউ কি তাঁকে রক্ষা করবেন না? তাঁর অন্তর কেঁদে উঠল। মহারাজাধিরাজের তেজ বিক্রম অন্তর্হিত হয়ে এখন তাঁর হৃদয় মাতৃ অদর্শনে কাতর শিশুর মতো ক্রন্দন করে উঠল। তখনি কর্ণে ধ্বনিত হল এক মধুরতম অথচ মন্দ্র কন্ঠস্বর। ‘সুরথ। পুত্র আমার। শঙ্কা ত্যাগ কর।’ কন্ঠস্বর অবিকল তাঁর পরলোকগতা গর্ভধারিণী মাতার মতো; কিন্তু যেন আরো সুমধুর; আরো মর্মস্পর্শী। তাঁর মনে হল যে দুঃসহ শূন্যতার ভার এতক্ষণ তাঁকে পিষ্ট করছিল এক মুহূর্তে যেন তার থেকে মুক্ত হলেন তিনি। সমস্ত চেতনা যেন ঐ ধ্বনির প্রতি ধাবিত। এতক্ষণ যে ভীষণ যবনিকা দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করে রেখেছিল সেই যবনিকা সরে যাচ্ছে যেন। তিনি দেখলেন সম্মুখের অন্ধকারে এক তেজবিন্দু ধীরে ধীরে প্রকটিত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সেই জ্যোতি কখনও ঘোর নীল কখনও তপ্ত স্বর্ণাভ কখনও রজতশুভ্র বর্ণ ধারণ করছে। পুনরায় সেই জ্যোতি থেকে সেই সুধাকন্ঠ ধ্বনিত হল: সুরথ। ভীত হয়ো না। এই তমোরাশি তোমার চেতনায় নিহিত শূন্যতার প্রতীক। তুমি দীর্ঘকাল যাবত পথ হারিয়েছ। আপন অস্তিত্বের মূলান্বেষণ বহুকাল পরিত্যাগ করেছ। বৈদিক কর্মের মধ্যে অন্তঃসারশূন্য যশের মরীচিকার পশ্চাদ্ধাবন করেছ। তোমার কর্ম তোমার গতি তোমার বাণী তোমার অগোচরেই মহত্বাকাঙ্ক্ষার দ্বারা চালিত হয়েছে। তারই ভীষণ পরিণাম আজ তোমাকে গ্রাস করতে উদ্যত। এই অনন্ত শূন্যতা তোমাকে সেই ভীষণ পরিণামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দান করেছে।’
সুরথ অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বললেন: কে তুমি মা! তোমার বাণী তোমার জ্যোতি যেন হৃদয়ের ক্ষতে পরম মমতার প্রলেপ দিচ্ছে। যেন কতকালের সুপ্ত বোধশক্তি আজ জাগ্রত হচ্ছে। আমাকে তোমার স্বরূপ দর্শন করাও।’
মৃদুহাস্য ধ্বনিত হল জ্যোতিপুঞ্জ থেকে। তারপর সেই সুধাকন্ঠ বলে উঠল: দর্শনের সময় শীঘ্রই আসতে চলেছে সুরথ। জড়তা ত্যাগ কর। তোমাকে যে এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। মানব থেকে মনুত্বে পরিণত হতে হবে।’
জ্যোতিপুঞ্জ সহসা অন্তর্হিত হল। নিদ্রা থেকে জেগে উঠলেন সুরথ। এমন স্বপ্ন আগে কখনও দেখেন নি। ঐ কন্ঠস্বর কার? কে তাঁকে অভয়বাণী দিল।
সুরথের ভাবনাসূত্র ছিন্ন হল। দ্বারে মৃদু করাঘাত হল। নির্দিষ্ট ব্যবধানে তিনবার। এই সঙ্কেতধ্বনি বিলক্ষণ চেনেন সুরথ। এই মুহূর্তে প্রাসাদে তাঁর একমাত্র নির্ভরযোগ্য সেবক চন্দ্রই একমাত্র এই সঙ্কেতধ্বনি দিয়ে থাকে। কিন্তু চন্দ্র মধ্যযামে তাঁর শয়নকক্ষে আসতে চাইছে এর অর্থ কোনো গুরুতর সংবাদ আছে। তিনি নিঃশব্দে দ্বার উন্মোচন করলেন। আপাতমস্তক কৃষ্ণবস্ত্রে আবৃত চন্দ্র তাঁকে অভিবাদন করে সতর্কভাবে চারিদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে করতে কক্ষে প্রবেশ করল। তারপর সুরথের কাছে এসে অনুচ্চ কন্ঠে জানাল: ‘মহারাজ। এই মুহূর্তে আপনাকে রাজভবন ত্যাগ করতে হবে।’
সুরথ কন্ঠস্বর যথাসম্ভব সংযত রেখে বললেন: ‘একথা কেন বলছ চন্দ্র? কোনো বিপদ আসতে চলেছে আমার উপর?’
চন্দ্র ব্যাকুল কন্ঠে বলল: ‘এখানে থাকলে আজই শেষরাত্রে আপনার প্রাণসংশয় হবে মহারাজ। অমাত্যপ্রবর অরুণাশ্ব আজই নন্দীরাজের সুবিশাল বাহিনী নিয়ে যাত্রা করেছেন কোলাপুর থেকে। কাল দ্বিপ্রহরের মধ্যে তাঁরা স্বপুরে উপনীত হবেন। তবে তাঁদের অগ্রভাগে অরুণাশ্বের গুপ্তচরদের সাথে নন্দীর নিয়োজিত একদল সুদক্ষ ঘাতক অশ্বযোগে শীঘ্রগতিতে যাত্রা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য প্রভাত হওয়ার আগেই আপনাকে নিধন করা। তাহলেই নন্দী কাল নিষ্কন্টকে স্বপুরের সিংহাসনে আরোহণ করবেন। কারণ তিনি এবং অরুণাশ্ব ভালো ভাবেই জানেন যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন স্বপুরের প্রজাগণের আনুগত্য প্রকাশ্যে বা গোপনে আপনার প্রতিই সমর্পিত থাকবে। কিন্তু এখন তারা শক্তিহীন। নন্দীর যবনসৈন্যগণের ভীতি তাদের গ্রাস করেছে। তাই সমগ্র রাজ্যের স্বার্থে আপনার কর্তব্য এখন কোনো সুরক্ষিত স্থানে আত্মগোপন করা। উপযুক্ত সময়ে আপনি আবার আত্মপ্রকাশ করবেন। রাজ্য আবার সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগে ফিরে যাবে। দোহাই আপনার মহারাজ। শীঘ্র চলুন। অশ্বাগার থেকে আপনার প্রিয় অশ্ব কুন্দধবলকে আমি আগেই রাজভবনের পশ্চাতে লুকিয়ে রেখে এসেছি। আপনি চলুন মহারাজ।’
যেখানে সমস্ত রাজপুরুষগণ তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সেখানে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সেবকের এই আচরণ দেখে সুরথের হৃদয় স্নেহার্দ্র হয়ে উঠল। কিন্তু এখন আবেগের সময় নয়। দ্রুত নিঃশব্দ পথসঞ্চারে তাঁরা প্রাসাদের একটি গুপ্তপথে ভবনের পশ্চাতে উপনীত হলেন। সুরথকে দেখে তাঁর অশ্ব কুন্দধবল মৃদু হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। চন্দ্রকে সুরথ প্রাসাদেই থাকতে বললেন। আপাতত এই নির্বাসনের পথে একাকীই যাত্রা করতে ইচ্ছুক তিনি। চন্দ্র অভিবাদন জানিয়ে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
সঙ্গীহীন অবস্থায় অরণ্যের পথে চললেন সুরথ। সঙ্গে শুধুমাত্র তাঁর প্রিয় অশ্বটি ছাড়া আর কেউ নেই। পালাচ্ছেন সুরথ। ঋগ্বেদদ্রষ্টা ঋষিগণের রাজর্ষি সুরথ আজ পলায়নপর। নিজের থেকে। রাজ্যের থেকে। প্রজাবর্গের থেকে। সেই প্রজাবর্গ যাদের আপন ঔরসজাত পুত্রের মতো পালন করেছিলেন বলে একদা তাঁর অন্তর নিজের অজান্তেই মহত্ত্বগর্বে স্ফীত হয়ে উঠেছিল। আজ কেউ তাঁর সঙ্গে নেই। তিনি আজ পরাজিত। সকলকে নিয়ে বিজয়গর্বে পথ চলতে গিয়ে ভীষণ সর্বগ্রাসী একাকীত্বের কাছে তিনি পরাজিত। বিশ্বাসঘাতকতা ছেদন করেছে তাঁর ঐকান্তিক বিশ্বাস ও নির্ভরতার মহীরুহ। সাম্রাজ্যের জনারণ্যের বিভীষিকা তাঁর এতক্ষণে উপলব্ধি হয়েছে। সকলেই কি এরকম বিশ্বাসঘাতক? না। একজন আছেন। যিনি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের সঙ্কটকালে আশ্রয়দানের। তাঁর আশ্রমের দিকেই অশ্বচালনা করলেন সুরথ। নগরের সীমা অতিক্রম করার সময় দূরাগত ঘাতকগণের অশ্বক্ষুরধ্বনি কর্ণগোচর হল। সতর্কভাবে নগরের প্রধান সরণি থেকে অরণ্যের সংকীর্ণ পথে নেমে গেলেন রাজ্যহীন রাজাধিরাজ সুরথ।
এরপরে কেমন করে সুরথ পুষ্পভদ্রা নদীতটে পুষ্করতীর্থে মেধসাশ্রমে সমাগত হলেন; কেমন করে সেখানে মহাবৈশ্য সমাধির সাথে পরিচিত হলেন; কেমন করে মেধসের কাছে নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সমাধান জানতে গিয়ে তাঁরা সাঙ্খ্যের দুঃখবাদের সাথে পরিচিত হলেন; কেমন করে অবগত হলেন সেই মহাদেবীর মহিমা যিনি নিত্যা, জগদকারণস্বরূপা, হরিহরব্রহ্মাদি দেবগণের আদিমাতা; সেইসব বিবরণ সপ্তশতী চণ্ডীতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেই বহুপরিচিত আখ্যানের পুনরুক্তি করব না। শুধু এইটুকুই বলব; কালপুরুষের সহায়তায় মেধসাশ্রমে মাতৃনামের মহিমা শুনে এই কমলাকান্তের জীবন সার্থক হয়েছে। অন্তর্চক্ষুতে কখনও দেখেছি প্রলয়ান্ধকারে সুপ্ত বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপে তাঁর মধুকৈটভদলনলীলা; কখনও দেখেছি সর্বদেবতার অন্তরে নিহিত স্বীয় শক্তিবিম্বসমূহকে আকৃষ্ট করে সর্বশক্তিস্বরূপিণী মহিষমর্দিনী রূপের অপরূপ রণরঙ্গ; আবার কখনও গৌরীদেহোদ্ভূতা কৌষিকীর শুম্ভবধের মহোদ্যম দেখে ধন্য হয়েছি। দেখেছি আমার মা কেমন করে কালীরূপে করালবদন বিস্তার করে অরিকুল গ্রাস করেন; কেমন করে ভীমাভৈরবী মহাকালীর চরণচাপে ধরণী কেঁপে ওঠে। মেধসাশ্রমে এই বৃত্তান্ত জেনে সুরথ ও সমাধির অন্তরে যে নবচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল তার পূর্ণতাপ্রাপ্তির কাহিনীই আমি এবার বলব। যেদিন দেবীমাহাত্ম্যবর্ণন সমাপ্ত হল; সেদিন প্রভাতে আমি দেখলাম সুরথ আর সমাধি এক অভূতপূর্ব প্রফুল্লতায় প্লাবিত হৃদয়ে মেধার সম্মুখীন হয়েছেন।
‘ মুনিবর!’ বলে উঠলেন রাজা সুরথ। ‘আপনার কৃপায় আজ অবহিত হলাম মহামায়া আদ্যাশক্তির বিষয়ে। যাঁর অনুগ্রহে জগৎপালক শ্রীহরি যোগনিদ্রা থেকে জাগ্রত হন; যিনি বিপদাপন্ন জগৎবাসীর পুনরুত্থানের সুতীব্র ইচ্ছা ফলবতী করতে দেবগণের তেজপুঞ্জ থেকে আত্মপ্রকাশ করেন; আবার নিপীড়িত বিশ্ববাসীর প্রতি করুণা যাঁর শরীরকোষে মূর্ত হয়ে উঠে জাগরিত হয় অনুপমা বিপদনাশিনী কৌশিকী রূপ; সেই জগন্মাতৃকার পরম লীলারহস্য জ্ঞাত হয়েছি আমরা। বুঝেছি আমার মাতৃভূমির প্রাণশক্তি নিহিত আছে মাতৃকাবন্দনার বীজে। সেই বীজ থেকে মহামহীরূহের উত্থান ঘটাতে; সেই শক্তিকে পুনর্জাগরিত করতে; এই মহাপুণ্যময়ী ভূমির অধীনতার যন্ত্রণার অবসান করতে আমাদের একমাত্র উপায় মহামায়ার উপাসনায় সিদ্ধিলাভ করা।’
সমাধি বলে উঠলেন ‘কিন্তু আপনার কাছেই শুনেছি এই বিশ্বচরাচরে দেবী অগণিত রূপে প্রকাশিতা। আমরা তাঁর কোন রূপের সাধনা করব? কোন্ মূর্তি ধরে তিনি পুনর্বার সঙ্কটনাশিনী রূপে আবির্ভূতা হবেন? ‘
চিন্তামগ্ন হলেন মেধা ঋষি। সমগ্র আশ্রম উৎকর্ণ হয়ে উঠল। পুনর্বার দেবীর জাগরণের লগ্ন সমাগত। কোন্ রূপে এই জাতির কর্ণধার হবেন তিনি? মেধার মেধাশক্তি তাঁর কোন্ বিগ্রহের ভাবে নিমজ্জিত হতে চলেছে? সহসা বিদ্যুচ্চমকিতের মতো শিহরিত হয়ে উঠলেন মেধা। অনির্বচনীয় পুলকে রোমাঞ্চিত হল তপস্বীর তনু। দৃষ্টি নাসাগ্রে ন্যস্ত। যেন হৃদয়কন্দরের সমস্ত অমিয়ধারা তাঁর দুই নয়নের সম্মুখে ঘনীভূত হয়ে মূর্তি পরিগ্রহ করেছে। সুরথ ও সমাধির কর্ণপথে সহসা ধ্বনিত হল প্রজ্ঞাদর্শী মেধার জীমূতমন্দ্র কন্ঠে মহাশক্তির আবাহনী। ভাবাবিষ্ট আবেশবিভোর স্বরে তিনি বলে উঠলেন ‘তিনি জটাজুটসমাযুক্তা। ললাটে শোভিত অর্ধেন্দু। ত্রিনয়নসমন্বিত মুখমণ্ডলে পূর্ণচন্দ্রের শোভা। গাত্রবর্ণ অতসীকুসুমের ন্যায়। সুপ্রতিষ্ঠিত তনু। ত্রিনয়নের করুণাপূর্ণ দৃষ্টি অতি মনোহর। নবযৌবন তাঁর বরতনুর প্রতি অঙ্গে সাদরে সাজিয়ে দিয়েছে তার শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য। তিনি সর্বপ্রকার আভরণে ভূষিতা। দন্তরাশির চারুশোভা অতি মনোরম। জগন্মাতৃকা মহাদেবী পীনোন্নত পয়োধরা। ত্রিভঙ্গভঙ্গিমায় লীলায়িত তনুশালিনী দেবী মহিষাসুরকে মর্দন করছেন। তাঁর দশবাহু যেন করকমলে সংলগ্ন দশটি মৃণাল। সেই বাহুসমূহে ধৃত আয়ুধের সজ্জা এইরূপ। দক্ষিণের পঞ্চ বাহুতে অধঃক্রমে শোভিত ত্রিশূল খড়্গ চক্র তীক্ষ্ম বাণ ও শক্তি। বামহস্তে ধৃত খেটক পূর্ণচাপ অর্থাত্ মহতী ধনু পাশ অঙ্কুশ ঘন্টা ও পরশু। মহিষ তাঁর অধোদেশে। তার ক্ষতবিক্ষত দেহে শিরাসমূহ নির্গত। তথাপি দেবীর শিরোচ্ছেদের মানসে সে খড়্গ উদ্যত করেছে। হৃদয় শূলাঘাতে নির্ভিন্ন। সমস্ত দেহ রক্তাপ্লুত। তথাপি নেত্র ক্রোধে রক্তবর্ণ। তার সর্বাঙ্গ বন্ধন করেছে দেবীর নাগপাশ। তার আনন ভ্রুকুটিকুটিল। দেবীর পাশসমন্বিত হস্তে তার কেশ দৃঢ়মুষ্টিতে ধৃত। দেবীর সিংহের বদন মহিষরক্তে লিপ্ত। দেবীর দক্ষিণ চরণ সিংহপৃষ্ঠে। বামপদ কিঞ্চিত উত্থিত করে বামাঙ্গুষ্ঠ মহিষের উপরে সমলগ্ন। দেবগণ সমবেতভাবে দেবীর স্তবরত। উগ্রচণ্ডা প্রচণ্ডা চণ্ডোগ্রা চণ্ডনায়িকা চণ্ডা চণ্ডবতী চণ্ডরূপা ও অতিচণ্ডিকা এই অষ্টশক্তি কর্তৃক দেবী পরিবৃতা। এইরূপে সেই ধর্মকামার্থমোক্ষদাত্রী দেবীকে চিন্তা করবে।’
মেধা নীরব হলেন। কিন্তু সমগ্র আশ্রমের চেতনা তখনও যেন সেই পরমা প্রকৃতির ভাবে লীন, আত্মস্থ। তাঁর সম্মুখে উপবিষ্ট দুই কর্মবীর ভাবী সাধকের মুখে সমস্ত হতাশার অমানিশার অবসান ঘটিয়ে আশার অরুণোদয় হয়েছে। এতদিনে তাঁরা নিজেদের পথ খুঁজে পেয়েছেন। বিশ্বাসঘাতকতার মরুভূমিতে ব্যর্থতার তৃষ্ণা বুকে নিয়ে মরীচিকার পিছনে অনেক ছুটেছেন তাঁরা। কিন্তু আর পথ হারাবেন না। সমগ্র জাতির জন্য নতুন পথের সন্ধান আজ পেলেন তাঁরা। পেয়েছেন এমন এক মূর্তিকল্প যার মধ্যে যুবশক্তি পাবে উদ্যম ও শৌর্যের অফুরন্ত প্রেরণা; ললিতকলা পাবে অমৃতের উৎসধারা; সাধক তপস্বী পাবেন মুক্তির পথ; অত্যাচারিত দুর্বল পাবেন পুনরুজ্জীবনের নির্ভরতা; আবার যে রূপের দর্শনে দুষ্টের হৃদয় ভয়কম্পিত হবে; অত্যাচারীর খড়্গ স্তব্ধ হবে।
উভয়ে ঋষিকে প্রণাম করে তপস্যার উদ্দেশ্যে গমন করলেন। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি উভয়মার্গেই মহামায়ার আবির্ভাব ঘটাতে চললেন ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ ও বৈশ্যপ্রবর।
ঋষির আশ্রম থেকে কিছুদূরে বয়ে চলেছে পুষ্পভদ্রা নদীর শান্ত শীতল জলধারা। নদীর কাকচক্ষু জলে অবগাহন করে নদীতটে নিজেদের সাধনক্ষেত্র নির্মাণ করলেন দুই সাধক। ঋষি মেধা দেবী দশভুজার যে অপূর্ব বিগ্রহকে মানসচক্ষে দর্শন করেছেন সেই চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ী রূপ দান আরম্ভ করলেন তাঁরা। ইতিমধ্যে ঋষির শিষ্যগণের মাধ্যমে গোপনে এ সংবাদ স্বপুরের প্রজাগণের কাছে পৌঁছে গেছে। যবনদের অত্যাচার থেকে এই ভূমিকে মুক্ত করতে এক অভূতপূর্ব তপস্যায় মেতেছেন তাঁদের রাজা। প্রবীণ প্রজাগণের চক্ষু অশ্রুসজল হল; যুবাগণের হৃদয় নবোল্লাসে মত্ত হল; রমণীগণ দৃপ্ত চিত্তে মঙ্গলশঙ্খে ফুৎকার দিলেন। সুরথের প্রিয় সেবক চন্দ্রের সহায়তায় রাজ্যের দক্ষ ভাস্কর শূলপাণি গোপনে সাধনক্ষেত্রে গিয়ে রাজার অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করে দিলেন দশভুজার মৃন্ময়ী রূপ। প্রজাদের মধ্যে যারা রাজরোষ উপেক্ষা করে সে রূপ দেখতে এল তারাই অপার্থিব পুলকে রোমাঞ্চিত হল। ফিরে গিয়ে অন্যান্যদের মধ্যে প্রচার করল সেই কাহিনী। স্বপুরের প্রতিটি প্রজার হৃদস্পন্দনে শোনা যেতে লাগল মহামায়ার নাম।
সুরথ ও সমাধি ধীরে ধীরে তপস্যার গভীর থেকে গভীরতম স্তরে প্রবেশ করতে লাগলেন। নিজেদের গাত্রনিঃসৃত রুধিরধারাকে দেবীর বলিরূপে কল্পনা করে আত্মসর্বস্ব তাঁর চরণে সমর্পিত করে মগ্ন থাকলেন তপস্যায়। নিদাঘের প্রচণ্ড দাবদাহ, বর্ষার প্রবল বারিধারা, শীতের শুষ্ক মরুতের দীর্ঘশ্বাস, বসন্তের সমীরণের মধুর আহ্বান কিছুই তাঁদের ধ্যানস্থ চিত্তে রেখাপাত করতে পারল না। কালপুরুষের আহ্বানে এবার সুরথ ও সমাধিকে তপোরত অবস্থায় রেখে উপস্থিত হলাম স্বপুরের রাজভবনে। সেখানে নন্দীরাজার মনোভাব বিষয়ে ধারণা লাভ করা যাবে।
দেখলাম নন্দীরাজ চৈত্রবংশের সিংহাসনে উপবিষ্ট। পাশে তাঁর মন্ত্রী ধূর্তশিরোমণি ক্রূরক। সভায় সুরথের অমাত্যগণের অনেকেই আছেন। আর আছেন দুর্ধর্ষ যবনযোদ্ধাগণ। নন্দীরাজ মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন: স্বপুর অধিকারের প্রায় তিন বৎসর অতিক্রান্ত হতে চলল। সুরথের কোনো সংবাদ পেলে মন্ত্রী?
ক্রুরক চিন্তিত কন্ঠে বললেন: হ্যাঁ মহারাজ। সেই যে আমাদের আগমনবার্তা পেয়ে সুরথ প্রাসাদের রক্ষীব্যূহ ভেদ করে অন্তর্হিত হয়েছিল ; তারপর বেশ কিছুকাল অমাত্যবর অরুণাশ্ব তাঁর গুপ্তচরগণের মাধ্যমে বহু প্রচেষ্টা করেও পার্শ্ববর্তী কোনো নগর বন্দর রাজ্যে তার কোনো সন্ধান পান নি। সম্প্রতি প্রজাদের মধ্যে একটি জনশ্রুতির বার্তা গুপ্তচরের মাধ্যমে আমি অবগত হই। সে এতদিন স্বপুর থেকে তিন ক্রোশ দূরে অরণ্যের মধ্যে মেধাঋষির আশ্রমে লুকিয়ে ছিল। সম্প্রতি পুষ্পভদ্রা নদীতীরে তপস্যায় রত।
নন্দীর ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হল। ‘ কার তপস্যা করছে সুরথ? ইন্দ্র, বরুণ, রুদ্র, বিষ্ণু, অগ্নি? তুমি প্রয়োজনে ইলাবৃতবর্ষে দেবেন্দ্র নহুষের কাছে উপঢৌকন প্রেরণ করো। বেদজ্ঞ যাজ্ঞিকগণ তাঁর স্তব করে তাঁকে তুষ্ট করুন। সুরথের আহ্বানে কোনো দেবতাই যাতে সহায়তা করতে না আসেন সেটা সুনিশ্চিত করো মন্ত্রী।
ক্রুরক বললেন: সুরথ এঁদের কারোরই তপস্যা করছে না মহারাজ। সে যে কার তপস্যা করছে তা কেউ জানে না। গুপ্তচরের তথ্য অনুযায়ী এক মৃন্ময়ী দেবীমূর্তির সম্মুখে সে ধ্যানস্থ হয়ে থাকে। দেবীর ত্রিনয়ন। পীতবর্ণ, সিংহ বাহন, দশভুজে দশায়ুধ।
নন্দী বিস্মিত কন্ঠে বললেন: এরূপ কোনো দেবীর কথা পূর্বে শ্রুতিগোচর হয়নি। সভায় উপস্থিত বৈদিক আচার্যগণকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
‘ আপনারা বলুন। বেদে এরূপ কোনো দেবীর বর্ণনা আছে ? ঊষা নিশা সরস্বতী প্রমুখ দেবীগণের সাথে এই দেবীর কোনো সাদৃশ্য পাচ্ছেন কি?’
বৈদিক ঋষিগণের মুখপাত্র হবির্বহ বললেন: না মহারাজ। তবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এই অঞ্চলে এরূপ অনেক অবৈদিক দেবী পূজিত হন। ব্রাত্যগণ বেদচর্চা ত্যাগ করে এইসব দেবীমূর্তির পূজনে ব্যস্ত থাকে। সুরথও সম্ভবত তাই করছে। ও নিয়ে আপনার উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।
তাঁর পাশেই বসে ছিলেন তরুণ ঋষি বিশ্বপা আম্ভৃণ। তিনি বললেন: আর্যশ্রেষ্ঠ। আমার কিন্তু ভিন্ন অভিমত। আপনারা তো জানেন আমি অম্ভৃগোত্রীয়। বহুকাল পূর্বে আমাদের গোত্রপুরুষ অম্ভৃর কন্যা বাক পরমাত্মসূক্তের দ্রষ্টা হয়েছিলেন। এই চরাচরের হেতুভূতা পরাপ্রকৃতির ভাব তাঁর অন্তরে সঞ্চারিত হয়েছিল। সেই সূক্তের সাথে এই দেবীর আমি আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। পরমাত্মসূক্তে সেই দেবী নিজেকে রুদ্র, বসু, আদিত্য, বিশ্বদেব, মিত্রাবরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি, অশ্বিদ্বয়ের আদিশক্তি বলেছেন। তিনিই ব্রহ্মদ্বেষীদের নাশার্থে রুদ্রের পিনাকে জ্যা রোপণ করেন। বেদের উমা হৈমবতীর কাহিনী স্মরণ করুন। আমার ধারণা সুরথপূজিতা এই দেবী তাঁরই সাকার রূপ।
হবির্বহ বললেন: তোমার এই ধারণা নিতান্তই অমূলক। সেই পরমাত্মদেবী নিরাকারা। তাঁর সাধনক্রমও অজ্ঞাত। সুরথ তাঁর সাধনা করবে কিভাবে? সর্বোপরি মহারাজ নন্দীর মতো বৈদিক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষক নৃপতি এই মুহূর্তে আর কেউ নেই। তিনি যজ্ঞে দেবমণ্ডলীকে নিয়মিত হবিঃ উৎসর্গ করেন। সমগ্র দেবসমাজ ও ঋষিসমাজ তাঁর সমর্থক। তাঁর উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।
সভাসদদের মধ্যে থেকে যবনগণ বলে উঠলেন: আমাদের মহান দ্যায়ুনিশার ছত্রচ্ছায়ায় যতদিন আছেন; ততদিন মহারাজ সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত। তিনি দেবপুত্র। মহাবলী। সুরথের ঐ দেবীরও ক্ষমতা নেই তাঁর সম্মুখীন হওয়ার।
নন্দী প্রফুল্ল চিত্তে ক্রুরককে বললেন: শুনলে তো মন্ত্রী। আর বৃথা চিন্তা করো না। নারী আমাদের অঙ্কশায়িনী। তার কোমল বাহু শুধু মাল্যের ভার বহনের জন্য ও নয়নযুগল পুষ্পশরের আমন্ত্রণের জন্যই নির্মিত। সসাগরা ধরিত্রীর একচ্ছত্র সম্রাট আমি। যবনসৈন্যগণ ও স্বয়ং দেবেন্দ্র আমার সহায়। সুরথ এই অনার্য ভূমির এক অজ্ঞাত মৃন্ময়ী মূর্তির সামনে তপস্যা করতে করতে পক্বকেশ হয়ে যাবে। ভালোই হয়েছে। সে বৈরাগ্য অবলম্বন করে অরণ্যবাসী হয়েছে। মন্ত্রী। তুমি আমার নামে যে কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করিয়েছ সেখানে এই পংক্তিটি সংযোজন করে দিও। যাঁর ভুজবিক্রমের ভয়ে সুরথরাজা তপোবৃত্তি অবলম্বন করেন…’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন নন্দী। সভাসদগণের মুখেও কৌতুকের রেখা। মন্ত্রী রাজার আদেশ কার্যকর করার নির্দেশ দিলেন অমাত্য বরুণসেনকে।
এইভাবে দম্ভের ঘোরে ক্ষমতার মোহে নন্দী কালাতিপাত করতে থাকলেন। প্রজাগণ সুরথের তপস্যার সমাপ্তির আশায় উৎকন্ঠিত হয়ে প্রহর গণনা করতে থাকল। এরই মধ্যে যবন আক্রমণের তৃতীয় শরৎকাল উপস্থিত হল। পক্ষকাল পূর্বেই ভাস্কর কন্যারাশিতে গমন করেছেন। আজ শুক্লাষ্টমী তিথি। এবার সুরথ ও সমাধির সাধনক্ষেত্রে যাওয়া যাক।
ঐ রাজর্ষি সুরথ। নদীতে অবগাহন করে প্রাতঃসূর্যের দিকে চেয়ে আছেন। শ্মশ্রু ও কেশরাশিতে আবৃত মুখে তপঃতেজ এক অপূর্ব শ্রী দান করেছে। তিনি অপলকে প্রত্যক্ষ করছেন ঊষার পদচিহ্ন ধরে হিরণ্যপ্রভ আদিত্যের দ্যুতি কিভাবে সুপ্ত জগতে বিস্তৃত হচ্ছে। ইদানিং তাঁর এক আশ্চর্য উপলব্ধি হয়। ধ্যান করতে করতে প্রায়ই দেখেন সমগ্র দৃশ্যমান প্রকৃতি যেন এক মহাশক্তির অনন্তবিস্তৃত বরতনুকে আশ্রয় করে আছে। যেন সেই মহাদেবীর অঙ্গে আভরণ হয়ে ধন্য হয়েছে নদী পর্বত সুনীল আকাশ বৃক্ষরাজি। তখন তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন মধুগন্ধে লুব্ধ ভ্রমরের মতো সেই দেবীর রাতুল চরণে নিবিষ্ট হয়ে যায়। সমাধির দিকে দৃষ্টি ফেরালেন সুরথ। মহাবৈশ্য নিজ আসনে দৃঢ়বদ্ধ ভঙ্গিতে আসীন। অর্ধোন্মীলিত নেত্রের দৃষ্টি নাসাগ্রে ন্যস্ত। নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় তাঁর অচঞ্চল তনু যেন সহসা স্তব্ধ এক মহাসিন্ধুর ঊর্মিমালা। মাসাধিককাল অতীত হতে চলল। সমাধি এর মধ্যে একবারও জাগ্রত হন নি। সুরথ নিজেও সবসময় দিবারাত্রির বিষয়ে সচেতন থাকেন না। ধ্যানস্থ হয়ে নিজের অজান্তেই কয়েকদিন কেটে যায়। কিন্তু এখনও তো অভীষ্ট পূর্ণ হল না। দেবীর মহিমা হৃদয়কন্দরে উদ্ভাসিত হতে লেগেছে সত্য। কিন্তু তিনি যে সমগ্র জাতির উত্তরণের মার্গ খুঁজতে এসেছেন। আত্মারামে মগ্ন হয়ে থাকলে তাঁর সেই লক্ষ্য তো পূর্ণ হবে না। তবে কি তাঁদের সাধনা ব্যর্থ হবে? ঋষিবরের কাছে শুনেছেন মহামায়ার কৃপা পেতে সিদ্ধ ও দেবগণও যুগযুগ ধরে প্রতীক্ষা করেন। তাঁরা দুইজন কি পারবেন নিজেদের সীমিত সামর্থ্যে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে?
পরক্ষণেই সুরথ আশান্বিত হলেন। দেবীই তো তাঁকে স্বপ্নে বলেছিলেন সময়কালে তাঁর অভীষ্ট পূর্ণ করতে মাতৃরূপে আসবেন। মা আদ্যার অপার করুণার উপর তাঁর আস্থা আছে। মা আদ্যা। হ্যাঁ। এই নামেই সুরথ ডাকেন মহামায়াকে। যিনি ত্রিদেবেরও মাতা, যিনি বসুন্ধরা রূপে সমগ্র জীবজগতকে ধারণ করে থাকেন, সেই আদিমাতৃকা ছাড়া এই নাম আর কারই বা হতে পারে। তিনি নিজ আসনে ফিরে এসে আদ্যা নাম স্মরণ করে পুনর্বার ধ্যানমগ্ন হলেন। দেখতে দেখতে দিবা অবসান হল। রাক্ষসী বেলার বহ্নুৎসব শেষ হয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল। সহসা সুরথের ধ্যানভঙ্গ হল। চরাচর নিস্তব্ধ। কোনো কোলাহল নেই। তবে আচম্বিতে কি এমন হল যে তপস্যারত চিত্ত সজাগ হয়ে উঠল। পাশে তাকিয়ে দেখেন সমাধিও জাগ্রত। মাসাধিককাল পরে সমাধিও জেগে উঠেছেন। তাঁর দৃষ্টি সম্মুখে নিবদ্ধ। অনির্বচনীয় পুলকে তাঁর চক্ষু থেকে পুলকাশ্রু নির্গত হচ্ছে। তাঁকে অনুসরণ করে সম্মুখে দৃষ্টি ফিরিয়েই শিহরিত হলেন সুরথ। আবেশে সর্বাঙ্গ কম্পিত হল। তাঁদের সম্মুখে সহসা বিদ্যৎরেখার মতোই আচম্বিতে আবির্ভূত এক জ্যোতিঃপুঞ্জ। তার ছটা সহস্র সূর্যের যুগপৎ প্রভাকেও হেলায় পরাভূত করে। অথচ সেই তেজোরাশির কোনো দহন নেই। নয়নাভিরাম কোটিচন্দ্রশীতল সেই অপরূপ জ্যোতি। তারই কেন্দ্রে যেন জগতের সমস্ত লালিত্য সমস্ত মমত্ব একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করেছে। সর্বালঙ্কারে ভূষিতা রাজরাজেশ্বরী সেই দেবী। স্বর্ণকেশরযুক্ত শ্বেতবর্ণের এক মহাসিংহের পৃষ্ঠে দেবী ললিতাসনে আসীনা। চতুর্ভুজা দেবী। হস্তে পাশ অঙ্কুশ বর ও অভয়। সুরথের মনে হল তাঁর সমগ্র চেতনা ধীরে ধীরে এক অমৃতসাগরে হারিয়ে যাচ্ছে। আকন্ঠ পান করছেন তিনি সেই সুধাসিন্ধু। সহসা তাঁর কর্ণপথে বীণাবিনিন্দিত এক পরিচিত কন্ঠস্বর ধ্বনিত হল: বৎস সুরথ। পুত্র সমাধি। তোমাদের তপে আমি প্রসন্ন। জগতের মঙ্গলার্থে দুষ্টের দমনার্থে তোমরা আমার শরণাগত। তাই সর্বরূপাত্মিকা আমি এক্ষণে শিবারূপে আবির্ভূতা।’
‘মা!’ বলে সুরথ লুটিয়ে পড়লেন দেবীর চরণে।
চোখে শীতল স্পর্শ পেয়ে ধীরে ধীরে সুষুপ্তি ভঙ্গ হল সুরথের। পূর্বাকাশে নবারুণের উদয় হয়েছে। ভোরের শীতল সমীরণ তাঁর শরীর স্পর্শ করে ছুটে যাচ্ছে আপন গতিতে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে তিনি দেখলেন তাঁর প্রিয় সেবক চন্দ্র তাঁর মস্তক নিজ ক্রোড়ে ধারণ করে একটি মৃৎপাত্র থেকে তাঁর মুখে বারিসিঞ্চন করছে। তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি সুরথের মুখে নিবদ্ধ। তিনি চেতনা ফিরে পেয়েছেন বোঝামাত্রই সে মৃদুকন্ঠে কুশল প্রশ্ন করল। সুরথ গদগদস্বরে চন্দ্রকে জানালেন তাঁর সাধনা সার্থক হয়েছে। মহামায়ার অশেষ করুণায় তিনি ও সমাধি তাঁর দেবদুর্লভ রূপের দর্শন করে ধন্য হয়েছেন। চন্দ্রের সাথে কথা বলতে বলতে সুরথ নিজ স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। মা আদ্যা তাঁকে ও সমাধিকে স্নেহধারায় অভিষিক্ত করে কত মধুরভাষণ করেছিলেন। মাতৃকন্ঠে সুধামাখা অমৃতবাণী শ্রবণে এক অপার্থিব আনন্দসিন্ধুতে নিমজ্জিত হয়েছিলেন তাঁরা। সব তাঁর মনে নেই। শুধু অন্তরে বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মায়ের সেই আশ্বাসবাণী: ‘তুমি শত্রুজয় করে অবিভ্রংশ রাজ্যলাভ করবে। মানব থেকে মনুত্বে উত্তীর্ণ হবে। তুমি হবে অষ্টম মনু সাবর্ণি।’ এ কেমন প্রহেলিকাময় আশীর্বাণী? মানব থেকে মনুত্বে উত্তরণ কিভাবে ঘটবে তাঁর জীবনে? ভাবতে ভাবতে সুরথের মনে পড়ল দেবী যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন তো সায়ংসন্ধ্যা। এখন সূর্যোদয় হচ্ছে। তবে কি সমগ্র রাত্রি তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন? সমাধির দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। তিনি একটি বৃক্ষমূলে বসে আছেন দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। চক্ষে অনির্বচনীয় পুলকে বারংবার অশ্রুবিন্দুর সঞ্চার হচ্ছে। চন্দ্র আবেগমথিত কন্ঠে বলল: ‘মহারাজ। এবার আমাদের জয় সুনিশ্চিত। দেবীর কৃপায় এবার ঐ দুষ্ট নন্দী ও তার যবনসৈন্যদলের পরাভব এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।’
‘চন্দ্র। আমি কি সমস্ত রাত সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলাম?’ সুরথ প্রশ্ন করলেন।
চন্দ্র বলল:’ হ্যাঁ মহারাজ। আমি প্রতিদিন রাত্রিকালে আপনাকে গোপনে একবার করে দর্শন করতে আসি। কাল রাত্রির প্রথম প্রহরে এসে দেখলাম আপনি ও বৈশ্যপ্রবর দেবীমূর্তির পদতলে প্রণিপাতরত অবস্থায় শায়িত। আমি ভাবলাম হয়তো তপশ্চর্যারই কোনো এক অঙ্গের অনুষ্ঠান করছেন আপনারা। তাই নিরবে প্রতীক্ষা করতে থাকলাম। শেষরাতে মহাবৈশ্য জাগ্রত হয়ে সরবে মাতৃনাম উচ্চারণ করে করতালি দিতে থাকলেন। তারপর ঐ বৃক্ষতলে বসে ধ্যানস্থ হলেন। কিন্তু আপনি তখনও একই অবস্থায় আছেন দেখে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। নিকটে গিয়ে দেখে বুঝলাম আপনি সংজ্ঞা হারিয়েছেন। তাই আপনার চেতনা ফেরানোর প্রয়াস করছিলাম। এখন আমি আসি মহারাজ। আপনি এখানে বিশ্রাম করুন। আজ সমস্ত রাজ্যবাসী জানবে আপনি মহাদেবীর কাছে বিজয়ের বরলাভ করেছেন। শীঘ্রই অত্যাচারীগণ তাদের কৃতকর্মের ফলভোগ করবে। প্রজাগণ বহুদিন যাবৎ এই দিনের অপেক্ষায় আছে। আমি এই শুভ সংবাদ সর্বত্র প্রচার করি।’
চন্দ্র গমনোদ্যত হতেই সমাধি হাস্য করে উঠলেন। বালক যেমন কোনো এক গূঢ় রহস্য অবগত হলে কৌতুকবোধ করে; তিনিও সেইভাবে হেসে বললেন: ‘যাঁর কাজ তিনিই করেছেন। তুমি বৃথাই ব্যতিব্যস্ত হচ্ছ।’
চন্দ্র কিঞ্চিত অপ্রতিভ হয়ে থেমে গেল। সমাধি তাকে বললেন: ‘কিছুকাল প্রতীক্ষা কর। সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’ তারপর সুরথের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাস্য করতে লাগলেন। সুরথও আশ্চর্যান্বিত। তারপরেই তাঁর মনে পড়ল দেবীর বরদান। দেবী সমাধিকে বলেছিলেন তার হৃদয়ে তিনি নিত্য অধিষ্ঠিত হবেন। বৈশ্যশ্রেষ্ঠ কি তবে ভবিষ্যতের কোনো এক দৈবী ঘটনার ইঙ্গিত করছেন? তিনি চন্দ্রকে অপেক্ষা করতে বললেন। বেশিক্ষণ অবশ্য প্রতীক্ষা করতে হল না। দূরাগত জনরব শুনে তাঁরা সচকিত হয়ে উঠলেন। চন্দ্র একটি বৃক্ষের উচ্চশাখায় আরোহণ করে দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল: ‘ স্বপুরের অগণিত প্রজা এইদিকেই আসছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা পরম প্রফুল্ল। সম্ভবত আপনারই দর্শন অভিলাষে তারা আসছে। কিন্তু এতজন একসাথে প্রকাশ্য দিবালোকে আসছে আর নন্দীর সৈন্যদল তাদের আসতে দিচ্ছে! এ কি করে সম্ভব?’
সুরথ বাষ্পাকুল কন্ঠে বললেন: ‘আমার সন্তানগণ বিপদ তুচ্ছ করে তাদের রাজাকে দেখতে আসছে! স্বপুরবাসীগণ আমাকে এত ভালোবাসে! ওদের এখানে নিয়ে এস চন্দ্র।’
‘যথা আজ্ঞা’ বলে চন্দ্র এগিয়ে গেল। অল্পকাল পরেই তার সাথে যাঁরা এলেন তাঁদের দেখে সুরথ বিস্ময়ে হতবাক। রাজ্যের আবালবৃদ্ধবনিতাকে সাথে করে তাঁর বৃদ্ধ অমাত্য দণ্ডধৃক এবং প্রকৃতিপুঞ্জের অধিকাংশই উপস্থিত হয়েছেন। সুরথকে দেখেই তাঁরা সমস্বরে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিল। তারপর অমাত্যপ্রবর দণ্ডধৃক্ সকলের মুখপাত্র রূপে তাঁর নিকটে এসে প্রণিপাত করে বললেন:’ স্বপুরের রাজধানী এখন নিষ্কন্টক মহারাজ। আপনার জন্য চৈত্রবংশের রাজসিংহাসন অপেক্ষা করছে। আপনার নির্দেশমতোই সব কাজ হয়েছে। নন্দী এবং বিশ্বাসঘাতক অমাত্য অরুণাশ্ব উভয়েই যমসদনে প্রেরিত হয়েছে। যবননায়কগণও পরাভূত হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করেছে। আপনি মহাদেবীর বরলাভ করেছেন। তপস্যা সার্থক হয়েছে। প্রজাগণ তাদের প্রাণাধিক প্রিয় মহারাজকে তাই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। আপনি ফিরে চলুন মহারাজ।’
চন্দ্র ও সুরথ উভয়েই বিস্ময়ে বাক্যহারা হলেন। এ কি বলছেন বৃদ্ধ অমাত্য! সুরথের নির্দেশে প্রজাগণ যুদ্ধ করে নন্দীকে বধ করেছে! স্বপুর তাঁদের অধিগত হয়েছে! কিন্তু তিনি তো সমস্ত রাত্রি এখানে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। চন্দ্রও এখানেই ছিল। তবে তাঁর নির্দেশ নিয়ে সেখানে কে গিয়েছিল? সুরথকে বিস্মিত হতে দেখে দণ্ডধৃক বললেন: ‘ আপনি কি আমার কথায় বিশ্বাস করছেন না রাজন?’
সুরথ বললেন:’ আপনি আমার পিতার সময় থেকে চৈত্রবংশের অনুগত। আমিই মোহবশে অরুণাশ্বের কথা বিশ্বাস করে আপনাকে অমাত্যপদ থেকে অপসারিত করেছিলাম। অথচ আপনি পুনরায় আমার দুর্দিনে আমার সহায় হলেন। আপনাকে অবিশ্বাস করার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু আমি তো কোনো নির্দেশ পাঠাই নি। আমি কাল দেবীর দর্শনলাভ করে সমস্ত রাত এখানেই ছিলাম। চন্দ্রও আমার কাছে ছিল।’
‘সেকি! তবে যে সেই কন্যা বলল…’ বিস্মিত কন্ঠে বললেন অমাত্য।
‘কন্যা?’ সুরথ জিজ্ঞাসা করলেন।
‘হ্যাঁ। এক কিশোরী বালিকা। কাল রাত্রির দ্বিতীয় যামে আমি প্রকৃতিপুঞ্জের এক গোপন সভা আহ্বান করেছিলাম। সহসা সেই কন্যা সেখানে এসে আমাদের জানাল সে মেধাঋষির আশ্রমচারিণী। তাকে আপনি পাঠিয়েছেন। তাকে অবিশ্বাসের কোনো হেতু ছিল না। কারণ ঐ গোপন সভাস্থলে প্রবেশের পথ আপনি ও আমি ভিন্ন আর কেউ জানে না। তার কাছেই আমরা অবগত হলাম যে আপার সাধনা সফল হয়েছে। মধ্যযাম উত্তীর্ণ হওয়ামাত্রই যেন আমরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে প্রাসাদের পশ্চাতের পরিখার সমীপে উপস্থিত হই। এই বলেই সে সেখান থেকে চলে গেল। আমরা মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে সৈন্যদল ও অস্ত্রাদি সহ পরিখার উদ্দেশ্যে গমন করলাম। সেখানে উপনীত হয়ে দেখি ইতিমধ্যেই নিঃশব্দ পথসঞ্চারে বহু নগরবাসী সেখানে উপস্থিত হয়েছে। তারাও সেই কন্যার দ্বারাই আহুত হয়েছে এখানে। মহারাজ। সেই কন্যা না জানি কি ইন্দ্রজাল জানে। তার কন্ঠে আপনার আহ্বান শুনে সমস্ত প্রজার অন্তর মত্ত হয়ে উঠেছে তখন। তাদের চক্ষে বিগতদিনের সেই তেজোদীপ্তি পুনরায় প্রত্যক্ষ করে আমি হর্ষে অভিভূত হলাম। আমরা বৃক্ষান্তরাল থেকে সর্তক দৃষ্টিপাতে দেখলাম ভবনের পশ্চাতদ্বারে মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রহরী ছাড়া আর কেউ নেই। আর যারা আছে তারাও কি এক অজ্ঞাত কারণে যেন কোনো মায়ার ছলে রাজরোষ ভুলে নিদ্রাদেবীর উপাসনায় রত। তাদের হস্তপদ বন্ধন করে প্রবেশদ্বার নিষ্কন্টক করতে আমাদের মোটেও বিলম্ব হল না। যখন তাদের চৈতন্য এল তখনও তারা কোনো শব্দ না করে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইল। মনে হল কোনো মোহ উৎপাদক ঔষধির প্রয়োগ করা হয়েছে তাদের ওপর। ফলে তাদের বোধশক্তি সাময়িকভাবে লুপ্ত হয়েছে। এদিকে আর কালবিলম্ব না করে আমাদের সৈন্যগণ ও শস্ত্রধারী পুরবাসীগণ অবারিত দ্বারপথে সুপ্ত ভবনে প্রবেশ করল। তাদের ভীমগর্জনে যতক্ষণে প্রাসাদের অধিবাসীরা জাগ্রত হল ততক্ষণে তাদের যমসদনে গমন ভিন্ন আর কিছুই করার নেই। প্রাসাদে যে যবনসৈন্যগণ ছিল তারা সকলেই আমাদের তীক্ষ্ম বাণের আঘাতে গতায়ু হয়েছে। নন্দীর নিজস্ব দেহরক্ষীগণের অধিকাংশই এই দুর্বিপাক দেখে স্বেচ্ছায় আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। নন্দী তো শুধু উৎকোচদানে তাদের আনুগত্য ক্রয় করেছিল। তাই বিপদকালে তারা সহজেই তার বিরুদ্ধাচরণ করল। নন্দীর সেনানায়ক অবশ্য প্রবল আক্রমণ গড়ে তোলার একটা চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু আমাদের তরুণ যোদ্ধাগণের অপার সাহসিকতা আর ভুজবলে সে সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সেনানায়ক অগণিত শস্ত্রাঘাতে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।’
‘আর নন্দী? তার কি পরিণতি হল?’ সুরথ প্রশ্ন করলেন।
অমাত্যবর বললেন ‘ সে এক আশ্চর্য প্রহেলিকা মহারাজ। সেনানায়ককে পরাজিত করে আমরা নন্দীর কক্ষে প্রবেশ করে দেখি শয্যার পার্শ্বেই তার প্রাণহীন দেহ ভূপতিত। তার সর্বক্ষণের সঙ্গী খড়্গটি করচ্যুত হয়ে পড়ে আছে। তার হৃদয় শূলাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেছে। মুখে অপার বিস্ময় আর আতঙ্কের রেখা তার অন্তিমকালের মনোভাব ব্যক্ত করছে। তবে তার মন্ত্রী ক্রুরক আর প্রাসাদের যবননায়ককে আমরা খুঁজে পাইনি। সম্ভবত অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে তারা পলায়নে সমর্থ হয়েছে।’
শুনতে শুনতে সুরথের মনে হচ্ছিল তিনি বিস্ময়ের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছেন। কে এক অজ্ঞাত কন্যা তাঁর নামে সমস্ত প্রজাগণকে একত্রিত করল। তারপর কি অনায়াসেই স্বপুর তাঁর অধিকারে এল। প্রহরীদের ঐ বিমূঢ় আচরণ, নন্দীর মৃত্যু; যেন অন্তরালে থেকে কেউ একজন তার সুদক্ষ পরিচালনায় এই কর্মকাণ্ড সমাধা করেছে। তিনি প্রশ্ন করলেন: সেই কন্যা কোথায়?
অমাত্যের সঙ্গে থাকা এক তরুণ যোদ্ধা বলে উঠল: তাকে আমরা আর খুঁজে পাই নি। যেমন আচম্বিতে এসেছিল, তেমনি অতর্কিতে কোথায় চলে গেছে। তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রীর কমনিয়তা দেখলে হৃদয় নিজে থেকেই আপ্লুত হয় স্নেহধারায়। আমার গৃহের সামনে উপস্থিত সকলকে যখন সে আপনার নির্দেশ শোনাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল প্রতিটি শব্দের সাথে কি এক ওজস্বিতা আমাদের অন্তরে প্রবেশ করছে। মুহূর্তে কেটে যাচ্ছে এতদিনের সঞ্চিত ভীরুতা, শঙ্কা, সংকোচ। আমার বারংবার মনে হচ্ছিল ঐ কন্যাকে হৃদয়ে ধরে তার শির আঘ্রাণ করে নিজের নিঃসন্তান জীবনের দহন শীতল করি। আমার পত্নী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে কে? কোথায় পাওয়া যাবে তাকে? সে উত্তরে হেসে বলেছিল ‘এখন আমাকে তোমরা কোথাও খুঁজে পাবে না। তবে খুব শীঘ্রই তোমাদের রাজা আমাকে এই স্বপুরে নিয়ে আসবেন। তখন প্রাণভরে তোমাদের সাথে আলাপ করব।’
বিস্মিত সুরথ অনুচর চন্দ্রের দিকে চাইলেন। চন্দ্র জিজ্ঞাসা করল ‘আচ্ছা সেই কন্যার নাম কি? ‘ সেই তরুণ বলল: ‘ আমার স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছিল যে মহারাজ তাকে আদ্যা নামে সম্বোধন করেন।’
শ্রবণমাত্র সচকিতে তাকালেন সুরথ। তাঁর সমস্ত শরীর এক অনির্বচনীয় পুলকে শিহরিত হল। আদ্যা। এই নাম তো সেই মহাদেবীর; যাঁকে প্রসন্ন করতে তিনি ও সমাধি জীবনপণ তপস্যায় রত; যিনি কালই তাঁদের দর্শনদানে ধন্য করেছেন। এক মুহূর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল তাঁর কাছে। তাঁর প্রজাগণের অভাবনীয় সাফল্য, নন্দীর পরিণাম সমস্ত কিছুর মর্ম এক নিমেষে তাঁর বোধগম্য হল। তাঁর চোখ ভরে এল পুলকাশ্রুতে। সমাধি মাতৃনাম করতে করতে বালকের মতো করতালি দিতে থাকলেন।
কালপুরুষ এবার আমাকে নিয়ে এলেন স্বপুরের সভাগৃহে। তিন বছর পরে আজ আবার সুরথ নিজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। মুখে রাজকীয় তেজের সাথে মিশেছে তপস্বীর শান্তশ্রী। স্বজাতির হৃদয়বন্দিতা মহাদেবীর দর্শনলাভ করে এখন তিনি রাজর্ষির পর্যায়ে উন্নীত। প্রজাগণ তাঁর নামে জয়ধ্বনি করছেন। আর দেখলাম মহারাজের পাশে দুই তরুণ তরুণী উপবিষ্ট। কালপুরুষ আমাকে বললেন: ঐ দীর্ঘদেহী তরুণ পুণ্ড্রাধীপ নারায়ণ। পাশে তাঁর ভগিনী তারিণী। পুণ্ড্ররাজবংশের সাথে চৈত্রবংশের সম্পর্ক বহু প্রাচীন। শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়; সংস্কৃতিগত কারণেও বটে। এই পুণ্ড্রবংশীয়গণ ভাগবতধর্মের উপাসক। তন্ত্রাশ্রিত পাঞ্চরাত্র সাধনা এঁদের পূর্বপুরুষ নারায়ণ প্রবর্তিত করেছিলেন। আর্যদের মধ্যে তিনিই প্রথম মাতৃসাধনার ধারাকে গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা শ্রী বা কমলালয়া বা অপরাজিতা শক্তিকে ধ্যান করেন ইষ্টদেবীরূপে। আদি নারায়ণ সমগ্র বসুন্ধরায় স্বীয় প্রভাবের কারণে বাসুদেব নামে খ্যাত হয়েছিলেন। সেই থেকেই এই বংশের নেতৃস্থানীয়ের উপাধি কখনও নারায়ণ; কখনও বাসুদেব। এই নারায়ণের বংশধর পৌণ্ড্র বাসুদেব খ্যাতিমান নরপতি হবেন। এখানে এক সুবিশাল সভ্যতার বিকাশ ঘটবে। স্বপুরের নিকটেই এই নারায়ণের একটি রাজধানী আছে। যবন আক্রমণের সময় ইনি সুরথের মিত্রপক্ষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজ রাজ্যে। আজ তাঁর ভগিনীর সাথে সুরথের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে চলেছে।
আমার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হল। আনন্দাশ্রুপূর্ণ নয়নে দেখলাম তারিণীর কর নারায়ণ সুরথের করে সমর্পণ করলেন। সকলে জয়ধ্বনি দিতে থাকল। শঙ্খনাদ ধ্বনিত হল সভাকক্ষে।
পরের দৃশ্যে অন্তরীক্ষ থেকে দেখলাম দ্যায়ুর্নিশা যুদ্ধে চলেছেন। তাঁর আশ্রিত রাজা নন্দীর শোচনীয় মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে যবনসৈন্য ও দৈত্যদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাঁর শকট। জম্বুদ্বীপের এক বৃহৎ অংশে সুরাবাণিজ্য তথা তাঁর দেবত্বের যে সাম্রাজ্যের পত্তন হয়েছে তার ভিত্তি সুদৃঢ় করতে তথা ভক্তদের সামনে নিজের দৌর্দণ্ডপ্রতাপ ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতেই তাঁর এই অভিযান। গত এক পক্ষকাল ধরে ব্রহ্মাবর্ত নামক উত্তর পশ্চিম ভারতের সীমায় নির্মিত নিশস্ নামক তাঁর জয়স্কন্দাবার থেকে গঙ্গা নামক নদীটির প্রবাহ ধরে পূর্বদিকে এগিয়ে চলেছেন। লক্ষ্য তাঁর পর্বতবেষ্টিত জঙ্গলাকীর্ণ কজঙ্গলের সমীপে মুদ্গগিরি নামক সেই গিরিদুর্গ। তিনি শুনেছেন সেখানেই সৈন্যসমাবেশ করেছেন সুরথ। কিন্তু অগণিত যুদ্ধের নায়ক দ্যায়ুর্নিশা আজ অন্তর থেকে কোনো উৎসাহ পাচ্ছেন না। কেবলই মনে হচ্ছে যে অক্ষয় কীর্তি স্থাপনের জন্য ভারতের মূল ভূখণ্ডে তাঁর সমরাভিযান; তা অধরাই থেকে যাবে। এছাড়া যে পরিস্থিতিতে তিনি পড়েছেন তাও তাঁর মতো তীক্ষ্মবুদ্ধি নায়ককে হতভম্ব করে দিয়েছে। ক্রুরক উন্মাদ হয়ে গেছে। ধুরন্ধর কূটবুদ্ধি ক্রুরক এক রাতের মধ্যে মানসিক ভারসাম্য চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। সর্বদাই শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। আর থেকে থেকে কোনো এক বালিকার নাম করে অবর্ণনীয় আতঙ্কে চিৎকার করে। তাকে নিয়ে তাঁর নগরে আহত দেহে যে দুইজন যবননায়ক এসেছিল; তাদের কাছেই দ্যায়ুর্নিশা জেনেছেন স্বপুরের প্রজাবিপ্লবের কথা; নন্দী ও তার অমাত্যদের বিনাশের কথা। এসবই তাঁকে হতচকিত করে দিয়েছে। যে স্বপুরের প্রজারা সুরথের পলায়নে এবং তাঁর বিক্রমের ভয়ে একেবারে প্রতিরোধহীন হয়ে পড়েছিল; তিন বছর পরে সুরথের অনুপস্থিতিতে তারা এমন সফল প্রজাবিপ্লব ঘটালো কিভাবে? তাছাড়া তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন ক্রুরকের সেই প্রলাপবাক্য। তাঁর সম্মুখে তাকে আনার সময় থেকে তিনি এই অভিযানে বেরোনো পর্যন্ত একই কথা বারবার বলে চলেছে সে। ” ঐ কন্যা আসছে। আসছে আমাকে ধ্বংস করতে। আমার পাপের দণ্ড দান করতে।”
প্রথমবার কৌতূহলবশে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন: কোন্ কন্যার কথা বলছ ক্রুরক?
সে উত্তরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলেছিল: তাকে তুমি দেখ নি। তোমরা কেউ দেখো নি। দেখেছি আমি। আর দেখেছিলেন আমার প্রভু নন্দী। আমাদের রুদ্ধদ্বার মন্ত্রণাকক্ষে সে আচম্বিতে বজ্রপাতের মতো উদয় হল রাত্রির মধ্যযামে। মহারাজ খড়্গহাতে তাকে আঘাত করতে যেতেই অট্টহাস্য করে উঠল সে। তার নেত্রদ্বয়ে চোখ রাখতেই আমরা কেমন আচ্ছন্নের মতো হয়ে পড়লাম। আমার চোখের সামনে সে মহারাজকে সেইভাবে টেনে এনে মাটিতে ফেলল; যেমন করে বন্য পশুকে বন্দি করা হয়। তারপর যেমন করে যোদ্ধাগণ দুরন্ত বন্য মহিষকে বিনাশ করেন; ঠিক তেমনিভাবে তাঁর কন্ঠে পদাঘাত করে মহারাজের উন্মুক্ত বক্ষ শূলাঘাতে বিদীর্ণ করে দিল। আমি পালাতে যেতেই দেখলাম সেই কন্যা অগণিত মূর্তি ধরে আমার চতুর্দিক ঘিরে রেখেছে। কোনো রূপে সে পীতবর্ণা; আমায় গদাহত করতে উদ্যত। কোনো রূপে সে বরাহবদনা। তার তীক্ষ্ম দ্রংষ্ট্রাঘাতে আমার উদর বিদীর্ণ করতে চায়। আবার কোনো রূপে সে সিংহের মতো নখর ধারণ করেছে। ঐ দেখো। ঐ সে আসছে। আমার রক্তপান করতে খড়্গহাতে সেই উলঙ্গিনী ধেয়ে আসছে। তোমরা কেউ দেখতে পাচ্ছ না। শুনতে পাচ্ছ না সেই অশিব অট্টহাসি। সে সবাইকে বিনাশ করবে। আমাদের নিস্তার নেই।
বলেই পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে অচেতন হয়ে পড়েছিল ক্রুরক। বৈদ্যগণ পরীক্ষা করে বলেছিলেন: কোনো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ফলে তার মানসিক স্থিতি চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। তারপর দ্যায়ুর্নিশা দেখেছেন কিভাবে সেই উন্মাদ মন্ত্রী সমস্ত দিন সেই কন্যার ভয়ে চিৎকার করে চলেছেন। প্রভাতের ঊষা ; অন্ধকার রাত্রি; নদীর কলধ্বনি সবেতেই সে সেই অজ্ঞাত কন্যাকে দেখতে পায়। গভীর রাতে তাঁর জয়স্কন্দাবার মুখরিত হয়ে থাকে তার প্রলাপধ্বনিতে।
তারপরে সেই স্বপ্ন। এই অভিযানে যাত্রারম্ভের আগের রাতে দেখা সেই বিকট স্বপ্ন তাঁর সর্বাঙ্গে ভয়ের শিহরণ জাগায়। স্বপ্নে দেখেছিলেন এক দুর্গম পর্বতগাত্রে অসহায়ের মতো আহত দেহে শায়িত আছেন তিনি। চতুর্দিকে বীভৎস শৃগালের দল তাঁর সৈন্যদের রক্তাপ্লুত মৃতদেহ ভক্ষণ করছে। আর তাদের মাঝে সমরক্ষেত্রে নৃত্য করছেন এক ভীষণা নারী। প্রলয়মেঘের মতো গাত্রবর্ণ; হস্তে সদ্যচ্ছিন্ন মুণ্ড; কটিতে ছিন্ন হস্তের মেখলা; জিহ্বা রক্তপানে শোণিতবর্ণ; হস্তে রক্তপূর্ণ নরকরোটি ও তীক্ষ্ম খড়্গ। বিকট মুখগহ্বরে বোধহয় সমগ্র সৃষ্টি অনায়াসে লয় হতে পারে। তার মেঘবর্ণ দেহে শুভ্র অস্থির মালা; যেন নীলাকাশে বলাকাশ্রেণী। তার অট্টহাসিতে চতুর্দিক কম্পমান। নৃত্য করতে করতে সেই শীর্ণকায়া নারী আলুলায়িত কেশ দুলিয়ে ছুটে এসে তাঁর বক্ষে সবেগে পদাঘাত করছে; এই অবধি দেখেই তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হয়েছিল। জীবনে সেই প্রথম চরম ভীতি তাঁকে গ্রাস করেছিল। আবার নন্দীর সভার যবননায়কদের কাছে তিনি শুনেছেন; ঠিক ঐরকম এক দেবীকে সুরথের প্রজারা বহুকাল ধরে পূজা করে। তবে কি এবার কোনো এক ভীষণা দেবীর সাথে সংঘর্ষ হবে? তিনি বজ্রপাণির পুত্র; প্রয়োজনে অলিম্পাসের সকল দেবতার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হতেও ভীত হন না। তবে এই দেবীকে দেখে তাঁর ভয় জাগে কেন? যেন সাক্ষাত নেমেসিস নাইক ও বায়া এক দেহে একত্রিত হয়েছেন।
আমি দেখলাম এইভাবে চিন্তিত অবস্থায় দ্যায়ুর্নিশা তাঁর কোলাবিধ্বংসী বাহিনীকে নিয়ে মুদগগিরির দুর্গের সামনে উপনীত হলেন।
দেখলাম সুরথের সৈন্যবাহিনী প্রতিপক্ষের আক্রমণের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। সুরথের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রাক্ষসবীর লম্বোদর, মহারাজের শ্যালক নারায়ণ ও পত্নী তারিণী। আশ্চর্য হলাম না। বাঙালির প্রাচীন নারীগণ যথার্থই পরাক্রান্তা ছিলেন। তখনও পর বা পুরুষ কারোর দ্বারাই তাঁরা আক্রান্ত ছিলেন না। সুবিন্যস্ত বিশাল বাহিনী মহারাজের আদেশের অপেক্ষা করছে সমস্ত শক্তি সংহত করে। তাদের এই রণনাট্যের প্রেক্ষাপট রচনা করছে নীলমেঘের মতো শ্যামল দিকচক্রবাল; গিরিদুর্গকে ঘিরে। সেই শ্যামলিমার উৎস কি বুঝতে পারলাম না। দেখলাম অগণিত রক্তবর্ণ ধ্বজে সমগ্র রণভূমি এক অপূর্বশ্রী ধারণ করেছে। যেন অন্ধকার দিগন্তে অরুণোদয়। আর সেই ধ্বজে অঙ্কিত কোকামুখী মহিষমর্দিনী দেবীর রণরঙ্গিণী মূর্তি। মাতৃনামে বলীয়ান হয়ে সুরথের সৈন্যরা সাক্ষাত কালের রূপ ধারণ করেছে। দেখলাম সুরথের ধ্বজের ঐ মূর্তি দর্শন করে যবনসৈন্যগণের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। তারা ভীতস্বরে এই ভয়ঙ্করী দেবীর উপাসকদের নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছে। দ্যায়ুর্নিশা নিজেও খুব একটা স্বস্তি বোধ করছেন না। তবু নিজেকে সংযত করে তিনি প্রতিপক্ষের সৈন্যবল নিরীক্ষণ করলেন। তারপর ক্রৌঞ্চব্যুহ নির্মাণের আদেশ দিলেন। সম্মুখের যবনসৈন্যগণ দ্রুতগতিতে ভল্ল ও অর্ধচন্দ্রাকার চর্মের প্রাকার নির্মাণ করল। সেটি এই ক্রৌঞ্চের মুখ। দ্যায়ুর্নিশা থাকলেন তার চক্ষুতে। এরপর দুই অতিকায় পক্ষ নির্মাণ করল কোলাবিধ্বংসী দৈত্যগণ। পশ্চাতে তিরন্দাজগণ ব্যুহের পুচ্ছ নির্মাণ করল। দ্রুতবেগে ক্রৌঞ্চব্যুহ ধেয়ে এল সুরথের সৈন্যদের গ্রাস করতে। এমন সময় সুরথের ইঙ্গিতে রণভেরী বেজে উঠল। সুরথকে কেন্দ্রে রেখে রণকুঠার ও ভল্লধারী বর্মাবৃত সৈন্যগণ ব্যুহবিন্যাস শুরু করলেন। ক্রৌঞ্চের প্রত্যুত্তরে শ্যেনব্যুহ। তাঁদের উজ্জ্বল বর্মে প্রতিফলিত রৌদ্রের প্রখরতা দেখে মনে হল যেন শত সহস্র সূর্য নেমে এসেছে রণাঙ্গনে। এ বর্ম,কুঠার,ভল্ল সবই বঙ্গের বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের শিল্পীগণ কর্তৃক নির্মিত। ধনুর্ধারী সৈন্যগণ অগ্নিমুখ বাণ উদ্যত করে শ্যেনের পুচ্ছ নির্মাণ করল। এমন সময় সহসা দিগন্তের সেই নিশ্চল মেঘমালা ভৈরবনাদে সচল হয়ে উঠল। তারা মেঘ নয়। তারা জম্বুদ্বীপের ত্রাস বঙ্গের সুবিশাল আকৃতির মহাহস্তিবাহিনী। এই হস্তিবাহিনী পরিচালিত হচ্ছে পুণ্ড্রের দুর্ধর্ষা হস্তিপালিকাগণের অঙ্কুশের ইঙ্গিতে। পদভরে ভূমিকে কম্পিত করে তারা মত্ত বৃংহণে শত্রুদের বিমূঢ় করে শ্যেনের বিস্তৃত পক্ষ নির্মাণ করল। আজ এদের যেমন আমি সুরথের বাহিনীতে দেখছি; তেমনি তারা হয়েছিল গঙ্গারিডি জাতির বিজয়স্তম্ভ, জয়নাগ ও শশাঙ্কের গৌড়ের রক্ষাকবচ ; পালসম্রাটগণের ঘণাঘণ বাহিনীর মহাভীম যোদ্ধা। এইভাবে শ্যেনব্যুহ নির্মিত হল। শ্যেন এবার ক্রৌঞ্চশিকারে নির্গত হল অভ্রান্ত লক্ষ্যে। অচিরেই রণভূমি ঢেকে গেল ধূলিজালে।
দ্যায়ুর্নিশা প্রবল পরাক্রমে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁর মুদ্গরের ভীষণ প্রহারে সুরথের অগ্রগামী কুঠারধারী যোদ্ধাগণ বিপর্যস্ত হতে থাকল। কিন্তু তাঁর বাকি সহযোদ্ধারা কেউই তাঁর মতো এই অগ্রগামী বাহিনীকে ভেদ করতে পারল না। বরং সুদীর্ঘ ভল্লধারী বর্মাবৃত যোদ্ধাগণ তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করতে থাকল। ফলে অচিরেই ক্রৌঞ্চব্যুহের মুখ বিদীর্ণ হয়ে গেল। সেই পথে দ্রুত প্রবেশ করতে থাকল শ্যেনব্যুহের গ্রীবায় অবস্থিত কৃপাণধারী সৈন্যগণ। এবার ব্যুহরক্ষার্থে ছুটে এল দেবপুত্রের প্রিয় দৈত্যগণ। তারাই কোলাবিধ্বংসী আখ্যা পেয়েছিল সুরথের কোলাপুর দুর্গ ধ্বংস করে। তাদের বাহুতে এত বল যে অনায়াসে অস্ত্র ছাড়াই একজন বলিষ্ঠ যোদ্ধার দেহ খণ্ড খণ্ড করে দিতে পারে। কিন্তু সুরথের বাহিনীর উপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারল না। তার আগেই তাদের পশ্চাতে আছড়ে পড়ল মত্ত গজবাহিনীর প্রবল স্রোত। অমন মহাকায় দৈত্যদের কেউ নিজের রক্তে হস্তিদন্তে সিন্দুরাভা সঞ্চারিত করল; কেউ তাদের পদভারে দলিত দেহে শেষ শয্যা গ্রহণ করল। যবনবাহিনীর ধনুর্ধররা অবিরাম শরবর্ষণ শুরু করল। কিন্তু পর্বতাকার সেই হস্তিযূথ বিচলিত হল না। দ্যায়ুর্নিশার দৈত্যবাহিনীর প্রধানগণ বিপদ বুঝে গজবাহিনীর থেকে দূরে সরে এসে তাদের প্রভুর অনুগণন করাই শ্রেয় মনে করল। দ্যায়ুর্নিশা উপনীত হলেন শ্যেনব্যুহের একেবারে মধ্যভাগে। দেখলেন সেখানে সুরথ তাঁর রাক্ষসবীরদের নিয়ে প্রবল পরাক্রমে কৃপাণ ও পরশু হস্তে শত্রুসংহারে রত। কি অদ্ভুত বীরত্ব। একসাথে ত্রিশ বা চল্লিশজন যবনবীরও তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। বিদ্যুতের মতো অসিচালনা করতে করতে সবেগে পরশুর আঘাতে শত্রুদের মস্তক ছিন্ন করে বীর সুরথ সিংহনাদ করছেন। দ্যায়ুর্নিশা তাঁর সঙ্গী দৈত্যদের আদেশ দিলেন সুরথকে এড়িয়ে দুর্গের প্রতি অগ্রসর হতে। একবার দুর্গ অধিকৃত হলে সুরথ দ্বিমুখী আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। অন্যথায় সরল পথে তাকে হারানো অত্যন্ত দূরূহ। তারা নায়কের আদেশমতো মায়াবলে সৈন্যজাল কাটিয়ে অগ্রসর হল। দ্যায়ুর্নিশার নিজের লক্ষ্য সুরথ। রাজা পরাজিত হলে সেই বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে কোনো অসুবিধা হয় না। সম্মুখের রাক্ষসগণকে পাশবদ্ধ করে বায়ুবেগৈ মুদ্গরের আঘাত করতে করতে তিনি অগ্রসর হলেন। রণভূমি ধূলায় আচ্ছন্ন। সুরথের আশেপাশের রাক্ষস সেনাপতিগণ সকলেই যুদ্ধে ব্যস্ত। সুরথ নিজে যবনদের একটি সৈন্যগুল্মকে একা প্রতিহত করছেন। এই সুযোগ। দ্যায়ুর্নিশা নিজের মুদ্গর সুরথের মস্তক লক্ষ্য করে নির্ভুল লক্ষ্যে নিক্ষেপ করলেন। এই আঘাত সুরথকে ধরাশায়ী করবেই। কিন্তু একি! তাঁর আর সুরথের মাঝে সহসা এক ধূলিস্তম্ভ গগনচুম্বী প্রাকারের মতো দাঁড়িয়ে গেল। আর তাঁর বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে তাঁর মুদ্গর সেই স্তম্ভে লেগে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। তিনি তাঁর সঙ্গের সৈন্যগুল্মকে আদেশ দিলেন সমস্ত অস্ত্র একযোগে সুরথকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করতে। অগণিত ভল্ল, কৃপাণ, মুদ্গর সুরথের দিকে ধেয়ে গেল এবং সেই স্তম্ভে প্রতিহত হয়ে ধূলিসাত্ হল। দ্যায়ুর্নিশা মুদ্গর হস্তে প্রবল আক্রোশে সেই স্তম্ভে আঘাত করতে ছুটে গেলেন এবং আঘাতের চেষ্টা করতেই দেখলেন সেই ধূলিরাশির মধ্যে উপনীত হয়েছেন তিনি। তাঁর চারিদিকে শুধু প্রবলবেগে ঘূর্ণায়মান ধূলিকণা। অথচ তিনি তার বেগ একটুও বুঝতে পারছেন না। যেন রণভূমির মধ্যে এক আশ্চর্য জগত তৈরি হয়েছে এই ধূলিস্তম্ভের গর্ভে। এ কি রাক্ষসী মায়া? কিন্তু তাঁর মতো মায়াবিদ্যায় পারদর্শী যোদ্ধাকে বিভ্রান্ত করবে এমন মায়া পৃথিবীতে কে জানে? তবে কি এ সেই দেবী? সুরথ যার উপাসনা করে? তাঁকে জানতেই হবে এই দেবীর স্বরূপ। এর জন্যই নন্দী মৃত; ক্রুরক উন্মাদ; তিনি স্বপ্নদর্শনে ভীত। তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন: কে তুমি ছলনাময়ী? মায়ায় আমাকে বিভ্রান্ত করো না। আমি তোমার স্বরূপ জানতে আগ্রহী। কেন তুমি সুরথকে রক্ষা করছ? আমি তো কোনো দেবতার সাহায্য ছাড়াই নিজ বাহুবলে যুদ্ধ করছি। তবে তুমি কেন পক্ষপাত করছ?
অদৃশ্য নারীকন্ঠে অট্টহাসি শোনা গেল। “আমার স্বরূপ জানতে চাও? আমি তো সর্বত্র বিরাজিতা। আমি নির্গুণা; আমি পুরুষ, আমিই নারী। আমি ভিন্ন এই জগতে আর কে আছে? সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড আমারই নিয়মে সঞ্চালিত হয়। আর পক্ষপাতিত্ব কিসের? আমিই তো যুদ্ধ করছি তোমার সাথে। তোমার দম্ভ, তোমার মত্ততা আমার সাধকগণের এই ভূমিতে বিলয়প্রাপ্ত হবে। তাই এই লীলাচ্ছলে তোমাকে সমরসৌভাগ্য দান করেছি।” দ্যায়ুর্নিশার মনে হল যেন তাঁরই হৃদয় থেকে কথাগুলো ভেসে আসছে। তাঁর ভাবনার প্রতিধ্বনি করে সেই কন্ঠ বলে উঠল: হ্যাঁ। আমি তোমাতেও আছি। শুধু তুমি আমাকে অন্বেষণ করোনি। তাই সন্ধান পাও নি। এই বিশ্বের সমস্ত প্রাণকে আমিই প্রসব করি। আমি আদিমাতা প্রকৃতি।”
দ্যায়ুর্নিশা চমকে উঠলেন। ইনিই তবে ফাইসিস; যিনি সৃষ্টিশৃঙ্খলা রক্ষা করেন। ইনিই নেমেসিস; যিনি সমস্ত জগত গ্রাস করেন। ইনিই গাইয়া; যিনি বসুন্ধরারূপে সকলকে ধারণ করেন। আবার ইনিই ইউরেনাস রূপে মহাকাশে অধিষ্ঠিতা। দেবেন্দ্রের বজ্রেও ইনি; জলাধিপতির ত্রিশূলেও ইনি; পাতালরাজের শূলেও ইনি। তাঁর অন্তরে এক অপূর্ব ভাবের উদয় হল। এই সর্বব্যাপিনী মহাশক্তিই তো তাঁর শক্তি। তবে আর কেন নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ? কিসেরই বা মহত্বাকাঙ্ক্ষা? নিজের সমস্ত কীর্তি; সমস্ত অকীর্তি সেই দুর্জ্ঞেয়ার চরণেই সমর্পিত হোক। দ্যায়ুর্নিশা অস্ত্রত্যাগ করে নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। ধূলিস্তম্ভ অদৃশ্য হল। রণভূমিতে এই অভাবিত দৃশ্য দেখে সকল সৈন্য যুদ্ধ বন্ধ করে হতচকিত হয়ে দেখতে থাকল। সুরথ অন্তরে বুঝলেন এই অভাবিত ঘটনা কার ইঙ্গিতে ঘটেছে। তিনি মাতৃনামে জয়ধ্বনি করে উঠলেন। তাঁর সৈন্যবাহিনীও বিজয়োল্লাসে মাতৃনামে দিঙ্মণ্ডল পূর্ণ করল।
যবননায়ক দেবপুত্র দ্যায়ুর্নিশার এই পরিবর্তন দেখে তার অধীনস্থ মহাভীম দৈত্যগণও হতোদ্যম হয়ে পড়ল। সুরথের যোদ্ধাগণের সুপরিকল্পিত ক্ষিপ্র আক্রমণে তারা এমনিতেই পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। তবুও দেবপুত্রের আত্মশক্তিই তাদের রণোন্মাদনায় ভাঁটা পড়তে দেয়নি এতক্ষণ। কিন্তু এখন আর তারা স্থির থাকতে পারল না। সমগ্র বিশ্ব সেই প্রথম অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল সমগ্র ক্ষিতিমণ্ডলের ত্রাস সেই অজেয় দৈত্যগণ রণভূমি থেকে পশ্চাদপসরণ করছে। কয়েকজন দৈত্যপ্রধান বিজয়ের শেষ চেষ্টা করে গিরিদুর্গের উচ্চ বন্ধুর পথে আরোহণের উদ্যোগ করছিল। কিন্তু তাদের চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত করতে গিরিদুর্গের উপর থেকে যোদ্ধাগণ অনলবর্ষী সুতীক্ষ্ণ বাণবর্ষণ আরম্ভ করল। সুউচ্চ মুদ্গগিরি গিরিদুর্গের খাড় ঢাল তাদের দগ্ধাবশিষ্ট মৃতদেহের স্তূপ বুকে নিয়ে জগতবাসীর সামনে অবিমৃষ্যকারিতার পরিণাম বিষয়ে এক চিরন্তন সাক্ষ্য উপস্থিত করল।
চতুর্দিক তখন আমার মাতৃভূমির বহুপ্রাচীন যোদ্ধাদের জয়ধ্বনিতে পূর্ণ। এতদিনে দেবীপ্রদত্ত প্রথম বর পূর্ণ হল। সুরথ সমগ্র ক্ষিতিমণ্ডলের অপ্রতিহত কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করলেন। দেখলাম মহারাজাধিরাজ সুরথের আদেশে রাজধ্বজে অঙ্কিত দেবী কোকামুখীর চিত্রের উদ্দেশ্যে নতি জানিয়ে বিজয়বাদ্য বেজে উঠল। মাতৃনামের হুঙ্কারে মুদ্গগিরির পাদদেশস্থ সুবিশাল প্রান্তর তখন প্রকম্পিত। সেই ধ্বনির মধ্যে নিহিত ছিল অন্ধকার জয় করে নবোদ্যমে পুনরুত্থিত এক মহাজাতির প্রাণশক্তির স্বতোৎসারিত উল্লাস। এই মাতৃনামই একদা বহুখণ্ডে বিভক্ত এই ভূমির অধিবাসীদের এক সূত্রে গেঁথে এক গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। আজ আমি, উনবিংশ শতকের ক্রান্তিকালে জাত, স্রষ্টার মহাপ্রয়াণের পর বিংশ ও একবিংশ শতকের ঘাতপ্রতিঘাতে জর্জরিত বাঙালির মর্মবেদনার একমাত্র সাক্ষী, আফিংয়ের নেশায় আচ্ছন্ন কমলাকান্ত; ধূসর সাক্ষীহীন অতীতের আমার স্বজাতির হৃৎস্পন্দন সেই মাতৃনামের ধ্বনিতে সম্যকভাবে উপলব্ধি করলাম।
তারপরে আমার দৃষ্টি পড়ল দূরের একটি টিলার ওপর দণ্ডায়মান এক মনুষ্যমূর্তির দিকে। বুঝতে অসুবিধা হল না ঐ ঋজুদেহী স্বয়ং সমাধি বৈশ্য।
যুদ্ধক্ষেত্রের অভূতপূর্ব দৃশ্য তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন তিনি। এই কালপরিক্রমায় যে যে দৃশ্য আমি দেখব তার চরিত্রসমূহের অন্তরভাবনা আমার অজ্ঞাত থাকবে না; কালপুরুষ যাত্রারম্ভেই বলেছিলেন। তাই সমাধির চিত্তের কথা বুঝতে পারলাম আমি। তিনি মেধসাশ্রমে কাটানো সময়ের এবং নিজ তপস্যাকালের স্মৃতিচারণ করছেন তখন। মহাবৈশ্য উপাধি জীর্ণ খোলসের মতো ত্যক্ত হয়েছে তাঁর। মেধা ঋষি তাঁকে বলেছিলেন: সার্থকনামা হবে তুমি। সমাধিবৈশ্য অর্থাত্ সমাধিরাজ্যে প্রবেশে উদ্যত। তোমার পথ নিবৃত্তির পথ।
তবু তিনি সংশয়াকুল ছিলেন। কি প্রার্থনা করবেন মহামায়ার কাছে? স্বজনগণের স্বার্থগন্ধী সান্নিধ্য আর তাঁকে আকৃষ্ট করে না। তবুও তারা তাঁর আত্মীয়। তাদের কাছেই ফিরে যেতে চাইবেন? কিন্তু তাহলে আবার মহাবৈশ্য পদবীর ভার; আবার অহমিকার কঠিন প্রাকারে বন্দীজীবন। তাঁর মন কেঁদে উঠেছিল। তারপর তপোরত হয়ে এই চিন্তা কোথায় হারিয়ে গেল। অন্তরে তখন শুধুই দুর্গারূপের অকলঙ্ক চন্দ্র। মৃন্ময়ীতে চিন্ময়ীকে প্রকটিত করার সর্বস্বপণ প্রয়াস। সুরথের সাথে দেহমনের সমস্ত চেতনা একত্রিত করে তিনি আহ্বান করে চললেন পরমা প্রকৃতি মহামায়াকে। হৃদয়ের রক্তধারার বলি নিবেদন করতে থাকলেন তাঁর রাতুল চরণে। নদীতীরে সেই কঠিন তপস্যায় কেটে গেল তিন বছর। তারপর একদিন সাধনা সার্থক হল। করুণাময়ী মহামায়া বরদায়িনীরূপে তাঁর আর সুরথের আকুল নয়নের পথে কোটিচন্দ্রস্নিগ্ধ প্রভা নিয়ে আবির্ভূত হলেন। সেদিন জগন্মাতৃকার ঐ বিশ্ববিমোহিনী রূপ দেখে তিনি আত্মহারা হলেন। জগতের প্রতি অণু পরমাণুতে চৈতন্যময়ী দেবীর নিত্যলীলা তাঁর চোখে ভাস্বর হয়ে ধরা দিল এক লহমায়। অনাস্বাদিতপূর্ব পরম পুলকের প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে প্রথমে ক্ষণিকের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন সমাধি। তারপরে সহসা যেন এক পরম মমতাময়ী স্পর্শে চেতনা ফিরে পেলেন। তন্ময় হয়ে যখন তিনি বিশ্বপ্রসবিনী জগন্মাতার তেজোময়ী রূপ দর্শন করছেন তখন সহসা দেবীর কোটিকোকিললাঞ্ছিত বীণাবিনিন্দিত কন্ঠের বাক্যসুধা তাঁর শ্রুতিগোচর হল। ‘ পুত্র সমাধি! তোমার অভীষ্ট প্রার্থনা কর বৎস। তোমার কঠোর সাধনা আমাকে পরিতুষ্ট করেছে।’ পুত্র! কথাটি শ্রবণমাত্র সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ জাগে। মেধা ঋষির কাছে তিনি শুনেছেন মহামায়ার মহিমা। স্বয়ং জগদীশ্বরও যাঁর মায়ায় বিমোহিত; এই নিখিল সংসারের যিনি একমাত্র সঞ্চালিকা সেই আদিশক্তি আজ তাঁকে পুত্র বলেছেন! তাহলে আর কিসের দ্বিধা? কিসের সংশয়? মায়ের ছেলের যোগ্য বরই তিনি প্রার্থনা করবেন। সুরথ অবিভ্রংশ্য রাজ্য চেয়েছেন। তিনি চাইলেন অন্তরের ভাবরাজ্যে নিরঙ্কুশ শাসন। প্রজ্ঞার শাসনদণ্ড নিয়ে জগদীশ্বরীর যোগ্য পুত্রের মতো তত্ত্বজ্ঞানের অসীম রাজ্যের রাজা হতে চান তিনি। নিবৃত্তিই বটে; তবে রাজোচিত। জগন্মাতা স্মিত হাস্যে চতুর্দিক আলো করে তাঁকে দেবসিদ্ধঋষিগণেরও দুর্লভ তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করলেন। অন্তরের বহুকালের ক্ষতলাঞ্ছিত শুষ্ক হৃদয়ভূমে যেন একমূহুর্তে জেগে উঠল সুধাসমুদ্র। সেই থেকে তিনি সর্বক্ষণ আত্মজ্ঞানের সমুদ্রে নিমজ্জিত থাকেন। চরাচরের সব কিছুই মায়ের লীলারূপে ধরা দেয় তাঁর চোখে। যেমন এই মূহুর্তে তিনি দেখছেন সম্মুখের যুদ্ধভূমির দৃশ্য। স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সুরথ অতুল পরাক্রমের সাথে বিপুল যবনবাহিনী বিধ্বস্ত করছেন। যবনগণ ত্রস্ত দৃষ্টিতে দেখছে সুরথের অপূর্ব রণকৌশল। সুরথের সৈন্যগণ এমন মহাবল রণপণ্ডিত যোদ্ধার সান্নিধ্যে এসে উৎফুল্ল। তারা মরণভয় ত্যাগ করে শত্রুসংহারে মত্ত হয়ে রাজার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। কিন্তু তত্ত্বদর্শী সমাধি দেখছেন অন্য দৃশ্য। সহস্রকরশালিনী রণচণ্ডী রূপে মহামায়া স্বয়ং রণক্ষেত্রে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর অভয়করচ্ছায়ায় সুরথ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। লক্ষ লক্ষ কালান্তক যবনসৈন্য তাঁর ওপর একযোগে আক্রমণ করেছে। কিন্তু সমাধি জানেন সুরথের কোনো ক্ষতি হবে না। স্বয়ং বিশ্ববিধাত্রী তারিণী তাঁর ভার নিয়েছেন। দেবীর এই লীলা দর্শন করে ভাববিহ্বল হয়ে উঠল সমাধির অন্তর। সহসা তাঁর চিত্তের তন্ময়তাকে আলোড়িত করে এক অপূর্ব স্তুতি ধ্বনিত হল। বহুদূরাগত কল্লোলিনীর কলনাদের মতো শব্দঝঙ্কার ভেসে আসছে:
বিজিতসহস্রকরৈকসহস্রকরৈকসহস্রকরৈকরুতে
কৃতসুরকারকসঙ্গরতারকসঙ্গরতারকসুনূসুতে
সুরথসমাধিসমানসমাধিসমাধিসমাধিসুজাতরতে
কে এই আকুলকরা স্তবে মায়ের বন্দনা করছে? তাঁর অন্তর থেকে অন্তরবাসিনী দেবী বলে উঠলেন: ভাবীকালের এক সাধক। তার স্তোত্রে পুলকিত হবে জগত। স্তবের ছন্দে আমি স্বয়ং নৃত্যরতা হব। তোমার আর সুরথের জীবনে আমার এই অভিনব লীলা তার স্তোত্রে চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। সমাধির সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগল। প্রাণমন দিয়ে তিনি শুনতে থাকলেন সেই অমৃতক্ষরা স্তোত্র….
জয় জয় হে মহিষাসুরমর্দিনী রম্যকপর্দিনী শৈলসুতে।
উদ্যানে একাকী পদচারণা করতে করতে সহসা সুরথ সচকিত হয়ে উঠলেন। উদ্যানটির বামদিকে প্রশস্ত রাজপথ চলে গিয়েছে নগর থেকে দক্ষিণে। সেইদিক থেকে একজন এগিয়ে আসছেন তাঁর উদ্যানের দিকে। সূর্য এখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। দিনান্তের অস্তরাগের শেষ খেলায় মেতে উঠেছে আকাশের মেঘমালা। সেই পড়ন্ত অপরাহ্নের শেষ আলোয় মানুষটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তবু সুরথের তাঁকে চিনতে ভুল হল না। সমাধি আসছেন। যাঁর মৈত্রীর উষ্ণ সান্নিধ্যে তাঁর জীবনের সবথেকে দুর্বল মুহূর্তগুলো খুঁজে পেয়েছিল পরম নির্ভরতার আশ্বাস সেই সমাধি বৈশ্য আসছেন। সুরথ দ্রুত পদচারণা করে উদ্যান থেকে বেরিয়ে পৌঁছে গেলেন তাঁর সাধক বন্ধুর কাছে। তাঁকে দেখে সমাধির মুখ প্রশান্ত হাস্যে ভরে উঠল।
তিনি বললেন: ‘মিত্র! তোমার সাথে দেখা করতেই আসছিলাম। চলে যাওয়ার আগে শেষবারের জন্য তোমাকে দেখতে বড়ো ইচ্ছা করছিল।’
সুরথ জিজ্ঞাসা করলেন: ‘পুষ্কর তীর্থে?’ সমাধি মৃদু হেসে সম্মতি জানালেন।
‘তুমি ভাগ্যবান। আসক্তির সমস্ত বন্ধন তুমি নিঃশেষে ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছ।’ সুরথ ম্লান হেসে বললেন। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক থেকে।
সমাধি লঘু কন্ঠে বললেন: ‘তুমিই বা কম সৌভাগ্যবান কিসে মিত্র? স্বয়ং মহামায়া তোমাকে সংগ্রামে চিরবিজয়ী হওয়ার আশীর্বাদ দিয়েছেন। তুমি যখন যবনসৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করছিলে তখন আমি দূর থেকে সমস্ত ঘটনা লক্ষ্য করেছি। সকলের অলক্ষ্যে তোমাকে রক্ষা করতে স্বয়ং সহস্রভুজা মূর্তি ধারণ করে অভয়া অবতীর্ণ হয়েছিলেন রণাঙ্গনে। তোমার মতো এমন সৌভাগ্যবান আর কে আছে? যাঁর অভয়করের ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় পেতে হরিহরব্রহ্মাও সদা ব্যগ্র হয়ে থাকেন; সেই বরাভয়ার করপদ্ম তোমার ওপর আসা প্রতিটি শস্ত্রাঘাতে অলঙ্কৃত হয়েছে।’
‘আমিও উপলব্ধি করেছিলাম মায়ের রক্ষাকবচ অভেদ্য বর্মের মতো ঘিরে আছে আমাকে। সাক্ষাত কালের ন্যায় উদ্যত খড়্গ আমার মস্তকে আঘাত করতে গিয়ে যেন অদৃশ্য কোনো শক্তিবলয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। মহাসর্পের ন্যায় বিষাক্ত শরজাল আচম্বিতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। কিন্তু সেটাই যে আমার মনোঃপীড়া আরো বাড়িয়ে তুলেছে মিত্র। সর্বেশ্বরী আদ্যাশক্তির এমন অপার করুণার অমৃতোপম প্রসাদ পেয়েও আমি বাসনার মরীচিকার শুষ্ক বালুকারাশিই প্রার্থনা করলাম। রাজসকাশে গিয়ে সামান্য পুত্তলিকা চেয়ে নিলাম।
তোমার মতো মায়ের ছেলে হয়ে উঠতে পারলাম কই? মনে পড়ে মিত্র? তিন বছরের কঠোর তপস্যার পরে বরদায়িনী যখন আবির্ভূতা হলেন তখন তুমি ক্ষণিকের জন্য সংজ্ঞা হারিয়েছিলে। তোমার সেই তপোঃক্লিষ্ট মুখ দেখে স্বয়ং জগন্মাতার নয়নে অশ্রু ঝরেছিল দরদর ধারায়। মহামায়া তোমাকে কোলে তুলে বারংবার তোমার ললাটে হস্ত সঞ্চালন করে তোমার চৈতন্য উৎপাদনের প্রয়াস করেছিলেন। যেন সেই মূহুর্তে তিনি আর সর্বেশ্বরী নন। প্রিয় পুত্রের আকুল ডাকে তিনিও হয়ে উঠেছেন মর্ত্যের গর্ভধারিণী মায়ের মতো। তেমনি শঙ্কাব্যাকুলা। তেমনি স্নেহময়ী। আমি বিমোহিত হয়ে দেখছিলাম মাতাপুত্রের সেই মধুরতম বাৎসল্যলীলা। তিনি বলেছিলেন: পুত্র সমাধি। তুই আমার এমন তপস্যা করেছিস যা সুরাসুরমুনিসিদ্ধ কেউ কোনোদিন করেনি। যারাই আমার তপস্যা করে সকলেই কোনো কামনাপূর্তির বাসনা নিয়েই করে। কিন্তু পুত্র। তুই সেই বিরলতম সাধক যে শুধু অবোধ বালকের মতো তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন মায়ের দর্শন ভিন্ন আর কিছুই কামনা করে না। তাই আমি তোকে সেই পরমপদ প্রদান করব যে পদের মহিমার সম্মুখে ইন্দ্রত্ব ব্রহ্মত্ব সিদ্ধত্ব প্রমুখ সুদুর্লভ বরও স্বর্ণাসনের সম্মুখে কাষ্ঠাসনের মতো হীন প্রতিপন্ন হবে। আমার অক্ষয় নিত্যধামের অধিকারী হলি তুই।’ আবেগমথিত কন্ঠে একটানা বলে শান্ত হন সুরথ।
সমাধির চক্ষু তখন অশ্রুসজল। তিনি সুরথকে বলেন:’ মিত্র। তুমিও মায়ের কৃপা লাভ করেছ। মানব থেকে মনুত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার দ্বার তোমার সম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে। এ বর সামান্য নয় মিত্র। এই জগত মহামায়ার লীলাক্ষেত্র। মনুর আসনে বসে প্রলয় অবধি সমস্ত জগতে মায়ের লীলা নিত্য প্রত্যক্ষ করবে তুমি। মনু পদের অর্থ অতি গভীর। মনুষ্যের ব্যষ্টিচেতনার সীমা ছাড়িয়ে সমগ্র মানবচৈতন্যের ঘনীভূত রূপ যার হৃদয়ে প্রতিভাত হয় তিনিই মনু। তোমার কাজ হবে এই পদের পূর্ব অধিকারীগণ যে ভ্রান্তি করে গেছেন তার অপনোদন। সমগ্র সমাজের হৃদয়ে মহামায়া আদ্যাশক্তির ভাব জাগ্রত করতে হবে। এই ভূমির সাঙ্খ্যকারের মনীষা যে সত্য বহু আগে উপলব্ধি করেছিল; যে প্রকৃতিপূজার পথে বারংবার এই বঙ্গের জাতীয় জীবনের সমস্ত সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটেছে সেই পথ সেই সত্য হৃদয়ে ধারণ করো। তারপর সমগ্র জগতকে পথ দেখাও। তবেই তুমি সেই কীর্তিময় অবিভ্রংশ রাজ্যের অধীশ্বর হবে যার বরদান মহাদেবী করেছেন। তবে তার আগে তোমাকে একটি পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সম্ভবত আজই আসবে সেই পরীক্ষার লগ্ন।’
তন্ময় হয়ে এতক্ষণ সমাধির বাক্যসুধা পান করছিলেন মহারাজ সুরথ। সমাধির কথা শুনলে মনে হয় যেন মহামায়াই তাঁর জিহ্বায় অধিষ্ঠিত। কিন্তু শেষের কথাটি কানে যেতেই সুরথ যেন সচকিতে বাস্তবে ফিরে আসেন। পরীক্ষা? কিসের পরীক্ষা? কেই বা হবে পরীক্ষক? সেই পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হবেন তো? একঝাঁক প্রশ্ন এসে ভিড় করে তাঁর মনে। সমাধি তাঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারেন তাঁর বিমূঢ়তা।
মৃদু হেসে বলেন: তোমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কাল সূর্যোদয়ের আগেই পেয়ে যাবে তুমি। মা মহামায়া সনাতনীর এক নতুন লীলানাট্যের পাত্র হতে চলেছ তুমি। মিত্র। এবার আমাকে যেতে হবে দুষ্কর পুষ্কর তীর্থে। সেখানে সমস্ত কর্মব্যস্ততার ঊর্দ্ধে নিত্যলীলার সুধাসাগরে ভাসতে চলেছি আমি। আর কোনো পিছুটান নেই। শুধু মা আর তাঁর অবোধ শিশু। আমি নিবৃত্তির পথে সমস্ত জাগতিক ভাব মায়ের চরণে অর্পণ করব; আর তুমি প্রবৃত্তির পথে মায়ের ভাব জগতের কোণে কোণে পৌঁছে দেবে। এই ভূমির তন্ত্রপথের এই দুটিই পথ। দুই পথেই আমরা সেই মাকেই খুঁজে পাব। বিদায়বেলা সমাগত মিত্র। তবে তার আগে তোমাকে একটি উপহার দিয়ে যাব।’
সুরথ আবেগঘন কণ্ঠে বলেন: ‘আমার সাধক বন্ধুর উপহার আমি শিরোমণি করে রাখব। কি সেই উপহার মিত্র?’
সমাধি নিজের বস্ত্রখণ্ডের মধ্যে থেকে সযত্নে বের করে আনলেন একটি মৃন্ময়ী মূর্তি। সেটির দিকে দৃষ্টি পড়তেই সুরথ বিস্ময় আর পুলকে অভিভূত হয়ে পড়লেন। এ কি মধুর মূর্তি! দেবী শান্ত অথচ তেজোদৃপ্ত ভঙ্গিতে কটিতে দক্ষিণ হস্ত ন্যস্ত করে দণ্ডায়মানা। বামকর বরদানের মুদ্রা প্রদর্শন করছে। মস্তকে প্রশস্ত ছত্র। অধরের মৃদু হাস্যরেখা আর আয়ত নয়নদ্বয় যেন স্নেহনির্ঝরের অমৃতধারার অফুরন্ত উৎস। ঘনোপম কেশরাশি ত্রিবেণীবন্ধনে ধম্মিলীকৃত। বেণীমধ্যে দুইদিকে পাঁচটি করে মোট দশটি তীক্ষ্মাগ্র আয়ুধ কন্টকাকারে সজ্জিত। দেবীর দুই পাশে দুই দণ্ডধারিণী সহচরী ঋজুদেহে দণ্ডায়মানা। পদযুগলের দুই পাশে দুই পুত্রোপম সহচর দেবীর নির্মাল্য মস্তকে ধরে তাঁর বরদভুজচ্ছায়ায় উল্লসিত হয়ে উঠেছে। এ কি অপূর্ব রূপ! সুরথের মুখ দেখে বোধ হল ভক্তিসিন্ধুর ঊর্মিমালা তাঁর অন্তরে জেগে উঠেছে। দুই চক্ষু হতে পুলকাশ্রুর ধারা গণ্ড প্লাবিত করে বক্ষে নেমে এসেছে। আর আমি; বহুকালের ওপার হতে আগত অবোধ মূঢ়মতি কমলাকান্ত; আমার মনে হল ঐ রাতুল চরণে নিজেকে মিশিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই। আমার স্রষ্টাকে শতকোটি নমস্কার জানালাম। যদি তাঁর মেধা থেকে জন্ম না নিতাম; তাঁর অন্তরের সমস্ত সুধাধারায় অভিষিক্ত না হতাম; তবে কি মায়ের কৃপায় কালযাত্রার শেষে এই বিশ্ববিমোহিনী রূপ আমার নয়নপথে উদিত হত?
কালপুরুষ বললেন: ‘এই মূর্তি দেবীর সপরিবারা দশায়ুধা মূর্তি। সমাধির অন্তরের ভাবসমুদ্র থেকে জাত এই মূর্তি সুরথ কর্তৃক পূজিতা হবেন আগামী দিনে। এই দশায়ুধার নামে একত্রিত তোমার মাতৃভূমির সমস্ত বীর সন্তানগণ গঙ্গাকেন্দ্রিক এক মহাসভ্যতার কায়া নির্মাণ করবে। সেই সভ্যতার আলোক বিশ্ববাসীর হৃদয় পুলক ও বিস্ময়ে পূর্ণ করে তুলবে।’
আমি সচকিতে তাঁর দিকে তাকালাম। এ কি দেখছি? ত্রিকালের নির্মোহ দর্শক যিনি; কোটি কোটি জগতের সৃজন ও লয়ের যিনি একমাত্র সাক্ষী; সেই মহাবৈরাগীর কন্ঠ আবেগাপ্লুত! চক্ষু ছলছল! আমার বিস্মৃত দৃষ্টির অর্থ তিনি সহজেই বুঝতে পারলেন। মৃদু হেসে বললেন: যতই তত্ত্বদর্শী হই না কেন, মায়ের এমন রূপ কোন্ ছেলের হৃদয়ে অপার আনন্দ বয়ে আনে না বলো? আমি তোমাদের আদিবিদ্বানের মতোই নির্মোহ; মহামায়ার নিত্যলীলার কালচক্রের সারথি। তথাপি আমিও তাঁরই পুত্র। এই মধুর লীলারসের আস্বাদ পেলে সমস্ত তত্ত্বজ্ঞান সমস্ত বৈরাগ্য সেই লীলাময়ীর চরণে সমর্পণ করে তাঁর জগতখেলায় মেতে উঠতে হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এখানেই সাঙ্খ্য এসে নতিস্বীকার করে তন্ত্রবন্দিতা বিশ্বজননীর চরণে।’
কালপুরুষের ভাবগম্ভীর কন্ঠ নীরব হল। আমার কথা আর কি বলব! একদিন বড় তৃষ্ণার্ত অন্তরে বলেছিলাম:” কই আমার মা? কোথায় কমলাকান্তপ্রসূতি বঙ্গভূমি?” আজ সেই তৃষ্ণা নিবৃত্ত হল। ঐ মাতৃকাই আমার দেশমাতৃকারূপে কোটি কোটি বঙ্গবাসীর হৃদয়মন্দিরে নিত্য পূজিতা। ঐ রূপ যে দেখেছে; নিত্যপ্রবাহিনী সুরধুনির কলধ্বনি আর সুনীল আকাশের বিশালতায় সেই জগদ্ধাত্রীর বন্দনা যে শ্রবণ করেছে; সেই বলতে পারে:
সাধ আছে মা মনে
দুর্গা বলে প্রাণ ত্যজিব জাহ্নবী জীবনে মাতৃরূপসুধা আকন্ঠ পান করে মধুমত্ত ভ্রমরের ন্যায় আমার ভাবজগত এক আবেশে আবিষ্ট। আমার স্রষ্টার রচিত অপূর্ব মাতৃস্তোত্র তখন আমার অন্তরে গীত হচ্ছে।
সপ্তকোটিসন্তানকলকলনিনাদকরালে
দ্বিসপ্তকোটিভুজধৃতকরবালে
অবলা কেন মা বলে
বহুবলধারিণীম্ নমামি তারিণীম্
রিপুদলবারিণীম্ মাতরম্ বন্দে।।
অশ্রুপ্লাবিত নেত্রে কতক্ষণ ভাবাপ্লুত হয়েছিলাম জানি না। সুরথের কন্ঠস্বরে আমার সম্বিত ফিরল। দেখলাম সসাগরা ধরণীর অধিপতি দশায়ুধা সপরিবারা মাতৃকার মৃন্ময়ী মূর্তি মস্তকে ধারণ করে সমাধিকে বলছেন: এই অপরূপ দানে তুমি আমাকে কিনে নিলে মিত্র। আমার রাজ্যের সর্বত্র জগন্মাতার এই মধুর রূপ পূজিত হবে। আমার মাতৃভক্ত প্রজাগণ শারদ প্রকৃতির অপরূপ শোভার মধ্যে এইরূপ ধ্যান করে ধন্য হবে।
সমাধিকে আলিঙ্গন করেন সুরথ। দুজনেরই নয়ন অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তারপর সুরথের শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টির সামনে সমাধি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেন তাঁর পথে। ঘনায়মান সন্ধ্যার শ্যামলিমা ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাঁর বিলীয়মান অবয়ব।
আবার সম্মুখের দৃশ্যপট মুছে গেল। অবশ্য সে ক্ষণিকের জন্য। আগেরবারের মতো বায়ুবেগে ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবার হল না। কালের কুজ্ঝটিকা সরে গেলে দেখলাম আগের স্থানটিতেই আছি। শুধু সময়কাল এখন মধ্যরাত্রি। সুরথের প্রাসাদে এত রাতে কেউ জেগে নেই। আমরা তবে এখানে কি করছি? সহসা মনে পড়ল সুরথকে বলা সমাধির সেই রহস্যময় কথাটি। আজ রাতে সুরথের এক পরীক্ষার লগ্ন আসতে চলেছে। তবে আমরা কি সেই দৃশ্যেরই সাক্ষী হতে চলেছি?
অন্তর্যামী কালপুরুষ বলে উঠলেন: যথার্থ অনুমান করেছ। ঐ দেখ রাজপুরীর মধ্যে সুরথের শয়নকক্ষ। আমাদের গন্তব্য।
তাঁর সাথে বায়ুপথে সুরথের শয়নকক্ষে উপনীত হলাম। নৃপতি নিদ্রামগ্ন। কিন্তু তাঁর নিদ্রা সুখকর বলে বোধ হচ্ছে না। সম্ভবত তাঁর সুষুপ্তি বিঘ্নিত হচ্ছে কোনো অস্বস্তিকর স্বপ্নদর্শনে। কি সেই স্বপ্ন? তার মধ্যেই কি নিহিত আছে সমাধিকথিত সেই পরীক্ষা? আমি কি তা জানতে পারব না? সহসা মনে পড়ল, যাত্রারম্ভে কালপুরুষ বলেছিলেন আমি সমস্ত চরিত্রসমূহের অন্তরভাবনা অনুভব করতে পারব। মনে মনে মহামায়াকে স্মরণ করে সুরথের চেতনার সাথে একাত্ম হতে চেষ্টা করলাম। এই কাজ আমার পক্ষে একেবারেই কঠিন নয়। আমার স্রষ্টা ঋষি বঙ্কিমের প্রেরণায় আমার হতভাগ্য স্বজাতির সাথে বহুবার একাত্ম হতে পেরেছি। হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি তাদের যুগযন্ত্রণা। আজও বিশেষ বেগ পেতে হল না। অচিরেই আমার চেতনা নিমজ্জিত হল ঘোর তমিস্রার গর্ভে। মনে হল আমি আর কমলাকান্ত নই; আমি চক্রবর্তী সম্রাট সুরথ। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি এক জনহীন পথে অজ্ঞাত তমসাচ্ছন্ন পথের পথিক। আমার সম্মুখে পার্শ্বে পশ্চাতে কেউ নাই। এক হিমশীতল বায়ুপ্রবাহ থেকে থেকে আমার অন্তর কাঁপিয়ে তুলছে। নীরবতার ভীষণ গুরুভার যেন আমার বক্ষে চেপে আছে। এ আমি কোথায় চলেছি? কেউ কি নাই এখানে? আমার অন্তর ব্যাকুল হয়ে উঠল। হৃদয় মাতৃহারা বালকের মতো কেঁদে উঠল। “মা” “মা” বলে ডেকে উঠলাম। হঠাত্ বিকট পাশবিক অট্টহাসিতে চতুর্দিক পূর্ণ হয়ে গেল। ঘোর অন্ধকারে লক্ষ কন্ঠে একযোগে সেই জান্তব হাস্যধ্বনি যে কি বিভীষিকাময় সে অন্যকে বোঝানো অসম্ভব। আমার অন্তর কেঁপে উঠল যেন। কিন্তু পরক্ষণেই মাতৃনাম স্মরণমাত্র অন্তর শান্ত হল। এতক্ষণ অজানিতের আতঙ্কে চক্ষু মুদে ছিলাম। এখন চতুর্দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। দেখলাম সেই তমসাচ্ছন্ন প্রান্তর আর জনহীন নেই। আমার চারিদিকে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে অগণিত ছায়ামূর্তি সমবেত অট্টহাসিতে অন্ধকারকে পূর্ণ করে তুলেছে। ভালো করে তাদের লক্ষ করতেই চমকিত হলাম। তাদের বক্ষ থেকে পদ অবধি বলিষ্ঠ মানবাকৃতি। হস্তে শাণিত খড়্গ। কিন্তু বক্ষের উপরিভাগে নরমুণ্ডের পরিবর্তে বৃহদাকার ছাগমুণ্ড। বর্তুলাকার চক্ষুতে শীতল জিঘাংসা; অট্টহাস্যের প্রাবল্যে জিহ্বা মুখ থেকে নির্গত। এ কি ভয়াবহ দৃশ্য! সহসা লক্ষ করলাম তারা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। বিকটস্বরে হাসতে হাসতেই খড়্গ উদ্যত করে আমাকে ঘিরে তৈরি করা বৃত্তটিকে ক্রমশঃ সঙ্কুচিত করে চলেছে। আমি জগত্তারিণী মা অভয়ার নাম স্মরণ করলাম। সহসা অন্ধকার মহাশূন্যে এক জ্যোতির্বলয়ের আবির্ভাব হল। সেই ত্বিষামণ্ডল কখনও শ্বেত কখনও পীত কখনও নীল কখনও লোহিতবর্ণ। বুঝলাম; আমার চিন্ময়ী মা এসেছেন। অচিরেই মায়ের সুধাকন্ঠ ধ্বনিত হল। ” বৎস সুরথ। এই ছাগরূপী প্রেতগণ তোমার বিগত কামনার প্রতীক। কখনও মহত্বাকাঙ্ক্ষায়; কখনও প্রলুব্ধ চিত্তে যে সমস্ত বাসনা তোমার অন্তরে জেগেছিল এরা তারই প্রতিমূর্তি। তুমি আমার চরণে লক্ষ বলিদান করে আত্মগরিমায় অহঙ্কার করেছিলে। সেই বলিদত্ত লক্ষ মুণ্ড তোমার কামনাময় অন্তরতনুর সাথে সংযুক্ত হয়ে তোমার চৈতন্যকে আক্রমণে উদ্যত। “
” আমার তবে কর্তব্য কি মা? তুমি পথ দেখাও?”
আমি বলে উঠলাম।
দেবী বললেন: ” এই লক্ষ মূর্তির মধ্যে আমাকে অনুধাবন করো। সমস্ত প্রাপ্তি সমস্ত অপ্রাপ্তির ভার আমার চরণে নিবেদন করো। আত্মদর্শন করো। সুরথ। তবেই তুমি বিজয়ী হবে।”
সেই বাক্য শ্রবণমাত্রই আমার সমস্ত ভয় লুপ্ত হল। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম সমগ্র চেতনায় কি এক আপার শক্তি জাগ্রত হয়েছে। বুঝলাম এ আমার নয়; আমি যাঁর সাথে একাত্ম হয়ে আছি সেই মাতৃসাধক সুরথের চেতনাই এই অসাধ্যসাধনে রত হয়েছে। আমার অন্তরে তাঁর অন্তরবাণী ধ্বনিত হতে থাকল। ” আমার অন্তরবাসিনী মা। তুমি শুধু জ্ঞান বিবেক বৈরাগ্য অথবা ঐশ্বর্যমাত্র নও। আমার যত অজ্ঞান, অবিবেক, আমার অবৈরাগ্য, অনৈশ্বর্যের যত ক্লেদ; সেও তুমি বই আর কেউ নয়। আমার সুচেতনাও তুমি। বিবেকান্ধ চিত্তের মূঢ়তাও তুমি। এই কামনারাশিও তোমার রূপ। সাধনসমরে আমি তোমার বাহন বজ্রনখদ্রংষ্ট্রায়ুধ মহাসিংহ। আমি দশায়ুধার চরণাবলম্বী কিঙ্কর। আমি সেই চিরন্তন বণিক যে মাতৃনাম নিয়ে মহাসিন্ধুতে নির্ভয়ে বহিত্র ভাসাই। আমি সেই দার্শনিক যে পরমা প্রকৃতির মহালীলা সাঙ্খ্যকারের চোখে দর্শন করি। আমি সেই রাজা যে মায়ের নামে সমগ্র জাতিকে একত্রিত করি। চরাচরের সর্বত্র তোমার নিত্যলীলা দর্শনকারী আমি; মহামায়ার বরপুত্র সুরথ। “
সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে আমার অন্তরতনু যেন বৃহদাকার হয়ে উঠছে। দেখলাম সেই লক্ষ মূর্তি একযোগে খড়্গাঘাত করতে থাকল আমার দেহে। সে এক আশ্চর্য যুদ্ধ। প্রতি খড়্গাঘাতে আমার তনু এক হস্ত পরিমাণে হ্রাস পাচ্ছিল আর এক একটি ছাগমনুষ্যমূর্তি তার সাথেই অন্তর্হিত হচ্ছিল। এইভাবে ক্রমে ক্রমে লক্ষ মূর্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সাথে সাথেই দেখলাম আবার পূর্বের আকার ফিরে পেয়েছি। এ কি বিচিত্র অভিজ্ঞতা! সহসা দেখলাম সম্মূখে এক স্বর্ণবর্ণ আলোকোজ্জ্বল পথ আবির্ভূত হয়েছে। আমার চতুর্দিকের অন্ধকার সেই দীপ্ত পথের আরম্ভবিন্দুতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই পথের দিকে দৃষ্টিপাত মাত্রই চিত্তে এক অপূর্ব শান্তি জাগল। সমস্ত দ্বন্দ্ব সমস্ত সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে এই পথ সহজানন্দের দ্বার উন্মোচন করেছে আমার সম্মুখে। আমার চরণ নিজের অজান্তেই সেই পথের দিকে এগিয়ে গেল। যেখানে এতক্ষণের তমসাবৃত সরণী জ্যোতির্পথে পরিণত হচ্ছে সেই সন্ধিতে উপনীত হলাম। গগনে আবার মাতৃকন্ঠ ধ্বনিত হল। ” অন্তরের মহাসমরে তোমার জয় হয়েছে সুরথ। সুখদুঃখ প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি ভোগ ও যোগে তোমার তুল্যজ্ঞান হয়েছে। আজ তুমি যথার্থই দ্বন্দ্বাতীত তত্ত্বদর্শী সাধক। এই পথ তোমাকে কালচক্র থেকে উত্তীর্ণ করবে কালাতীত পরমানন্দ বোধের মহাসমুদ্রে। সেখানে শুধুই আমার নিত্যস্বরূপের অমৃতে মগ্ন থাকবে তুমি। তবে আর কখনও জগতে প্রত্যাবর্তন হবে না তোমার। সমস্ত গতাগতির এখানেই পরিসমাপ্তি।”
সহসা আমার গতি রুদ্ধ হল। অনুভব করলাম সুরথের অন্তর বিচলিত হয়ে উঠেছে। আর কখনও প্রত্যাবর্তন হবে না? যে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করলাম তার কোনো সুফল আমার সন্তানতুল্য প্রজাবর্গকে দিতে পারবো না? তারা যে তিমির সেই তিমিরেই থাকবে আর আমি স্বার্থপরের মতো আত্মরতিতে মগ্ন থাকব? আমার কানে এল দূরাগত অগণিত ক্রন্দনধ্বনি। যারা এখনও মাতৃনামামৃতের সন্ধান পায়নি; এখনও সংসারের দ্বন্দ্বে নিত্য জর্জরিত; তাদের আকুলতা আমার হৃদয় স্পর্শ করল। আমার অন্তরে আবার সুরথের কন্ঠ ধ্বনিত হল। “মা। তোমার কৃপায় আমি এই সাধনসমর উত্তীর্ণ হয়েছি। অপার শান্তির দ্বার খুলে গেছে আমার সামনে। কিন্তু জগতের প্রতি ঘরে যতক্ষণ এই অমৃতবার্তা না দিতে পারছি; মাতৃনামের বন্যায় যতক্ষণ তাদের প্লাবিত না করতে পারছি; ততক্ষণ আমি কি করে অবকাশ গ্রহণ করব? আমি ঐ নিত্যানন্দলোকে এখন যেতে পারব না। আমার জগতবাসী যতদিন তোমার এই অপার করুণায় ধন্য না হয়; এই মুক্তিপথ যতদিন তাদের অধিগত না হয়; ততদিন আমি জগতেই থাকব। প্রতি নরনারীর জীবনে; প্রকৃতির প্রতি রূপে আমি তোমার মহালীলা প্রত্যক্ষ করব। মাতৃনামে দীক্ষিত করব আপামর প্রজাবর্গকে। কেউ হীন নয়; কেউ উচ্চ বা নিম্নবর্ণ নয়; সকলেই জগজ্জননী রাজরাজেশ্বরীর সন্তান; এই বার্তা সকলকে শুনিয়ে যাবো। এই বর দাও যেন আমি আমার ব্রতে সফল হই। “
জগত্তারিণী মহাদেবীর কন্ঠ শোনা গেল: ” আজ এই মুহূর্তে তুমি মনুত্বে উপনীত হলে পুত্র। আমি তোমার চৈতন্যরূপ সূর্যের মূলাশক্তি সবর্ণা। তুমি আমার পুত্র। তাই তুমি সবর্ণাপুত্র সাবর্ণি। আজ তোমার নবজন্ম হল। যাও। সমগ্র জগতকে আমার ভাবে ভাবিত করে তোলো এক মন্বন্তরকাল যাবত্। তারপর জগতের কার্য সমাপ্ত করে আমার কোলে অবকাশ লাভ করবে। ততদিন তোমার চেতনায় আমি নিত্য বিরাজিতা থাকব। সাবর্ণি! তোমার জয় হোক পুত্র।”
মুহূর্তে সমস্ত দৃশ্যপট পরিবর্তিত হল। লক্ষ করলাম, আমি কমলাকান্ত আবার কালপুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের সম্মুখে শয্যায় উঠে বসেছেন সুরথ। তাঁর মুখমণ্ডলে এক অপূর্ব প্রজ্ঞার জ্যোতি। আজ তিনি মনুজ থেকে মনু হয়েছেন। অন্তররিপুর লক্ষ খড়্গাঘাতও এই মাতৃসাধকের চেতনার বিনাশ ঘটাতে পারেনি। দুর্গানামের এমনই মহিমা। আপ্লুত চিত্তে আমি গেয়ে উঠলাম সাধকশ্রেষ্ঠ রামপ্রসাদের সেই গান:
যদ্যপি কখনও বিপদ ঘটে
শ্রীদুর্গানাম স্মরণ করিও সঙ্কটে
তারায় দিয়ে ভার সুরথ রাজার
লক্ষ অসিঘাতেও প্রাণ গেল না।
কালপুরুষ আবার আমাকে নিয়ে অগ্রসর হলেন কালযাত্রাপথে।
সুরথ সংবাদ পাওয়া মাত্র ছুটে গেলেন অন্তঃপুরের দিকে। সম্রাজ্ঞীর কক্ষের দ্বারে ধাত্রী তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে নিজ ক্রোড়ে ধৃত সদ্যোজাত শিশুটিকে দর্শন করাল। এক অপরূপা কন্যারত্নের জন্ম হয়েছে। তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখমণ্ডলের দিকে দৃষ্টি পড়তেই সুরথ পুলকে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। সেই মুখ। তাঁর ইষ্টদেবীর যে নয়নাভিরাম মুখচ্ছবি সাধনকালে প্রত্যক্ষ করেছিলেন; সেই মুখচন্দ্রই পুনরায় উদিত হয়েছে তাঁর দৃষ্টিপথে। কন্যারূপে জগন্মাতা এসেছেন তাঁর ঘরে; অথবা বলা যায় কন্যার মধ্যেই আজ সুরথ খুঁজে পেয়েছেন বিশ্বজননীকে। অন্তরের আবেগ সংযত করে জিজ্ঞাসা করলেন: মহারাণী কেমন আছেন? ধাত্রী বলল: একেবারে নিরাপদ। নাড়িছেদনের পরেই প্রসূতির তত্ত্বাবধানে বৈদ্যগণ নিয়োজিত হয়েছেন। প্রসবের পরে প্রসূতির রক্তক্ষরণ আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু শল্যবিদ আত্রেয়ের দক্ষতায় অত্যল্পকালের মধ্যেই রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এখন চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে আপনি এখন সেখানে যাবেন না। আগামীকাল প্রভাতে প্রসূতি ও কন্যা উভয়কে দর্শন করবেন। ” উত্তম।” বলে সুরথ পরিতৃপ্ত চিত্তে ফিরে এলেন উদ্যানে। তাঁর অন্তর পরিতৃপ্ত। আজ তাঁর জীবন সার্থক। মাতৃপূজক স্বপুরের সাথে ভাগবত পৌণ্ড্ররাজ্যের সমন্বয়ে এক মহান রাজনৈতিক শক্তি জন্ম নিয়েছে। এই সুবিশাল ভূখণ্ডের সর্বত্র প্রকৃতিপূজার আদর্শে একটি মহাজাতি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিজের অস্তিত্বের মূলাধার। সর্বোপরি তাঁর জগন্মাতা আদ্যাকেই তিনি পেয়েছেন তাঁর কন্যারূপে। মহামায়ার বরেই লাভ হয়েছে এই অবিভ্রংশ রাজ্য।
এই সুখদৃশ্য দেখতে দেখতে তন্ময় হয়েছিলাম। সহসা অনুভব করলাম এক অপার্থিব গতিতে স্বপুর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি আমি। পুনর্বার সেই ভীষণ কালপথে ধাবিত হচ্ছি। আমার চেতনা আবার লুপ্তপ্রায় হতে থাকল। কালপুরুষের অমোঘ কন্ঠস্বর ধ্বনিত হল: “তোমার কালপরিক্রমা এখানেই সমাপ্ত হল। স্বারোচিষ মনুর কালের সেই সমস্ত তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য তুমি প্রত্যক্ষ করেছ যার পরিণামে তোমার মাতৃভূমি জগন্মাতার চরণবন্দনার গৌরবলাভ করেছে। এখন বর্তমান কালে প্রত্যাবর্তন করে সেই ইতিহাসের বিশ্লেষণ করো। উপলব্ধি করো সেই বিশ্লেষণজাত সত্যকে। সার্থক করো তাকে তোমার স্বজাতির জাতীয় জীবনে। এই অমৃতজ্ঞানই হোক তোমার জীবনে মহামায়ার প্রসাদ। মায়ের সেই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করো।”
তাঁর কথা শুনে অভিভূত হয়ে পড়লাম। হঠাত্ কানে এল নারীকন্ঠ। “প্রসাদ নাও।” আবেগে শিহরিত হলাম। এ যে জগন্মাতার সুধাকন্ঠ। চোখ খুলে দেখলাম। সহসা সম্মুখের সমস্ত দৃশ্যপট ফুটে উঠল স্পষ্টভাবে। আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই গ্রাম্য চণ্ডীমণ্ডপে। মায়ের আরতি সমাপ্ত হয়েছে। শীতলভোগের প্রসাদ হাতে ভক্তগণ মায়ের নামে জয়ধ্বনি করছে। পুনর্বার শুনলাম: প্রসাদ নাও।
দেখলাম আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক দশবছরের বালিকা। হাতে একটি পর্ণপুটে শীতলভোগের প্রসাদ। আমার হাতে ধরিয়ে বলল: “কতক্ষণ ধরে বলছি। সাড়াই দিচ্ছ না। কি দেখছিলে ঐভাবে?”
এ প্রশ্নের কি উত্তর দেব? আমি চৈত্রের জীবনী শুনেছি। সুরথের বীরত্ব দেখে পুলকিত হয়েছি। নন্দীর কুটিলতা; নহুষের স্বার্থান্ধ মনোভাব আমাকে শিহরিত করেছে। দ্যায়ুর্নিশার রণোন্মত্তায় আতঙ্কিত হয়েছি। মেধার মুখে মাতৃনাম শ্রবণে, সুরথের তপোলব্ধ সমাধির ধ্যানগম্যা মাতৃকার রূপদর্শনে ধন্য হয়েছি। ভাবতে ভাবতে সেই বালিকার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। সেই মুখ; সেই হাসি; নয়নে সেই অমল জ্যোতি। এই মুখ আমি দেখেছি কালযাত্রার পূর্বে দশভুজা রাজরাজেশ্বরীরূপে; এই রূপ সুরথ দেখেছেন তাঁর শিশুকন্যার মুখে। মনে মনে বললাম: তোকেই দেখছিলাম মা। কত যুগ চলে যায়। মনু থেকে মন্বন্তর অতীত হয়। কত মেধার মেধা তোর কৃপায় দীপ্ত হয়ে ওঠে। কত সুরথ কত সমাধি তোর কৃপায় উদ্ধার হয়। কিন্তু তুই সেই একই থাকিস। চিরকাল এই ভূমিতে ধ্বনিত হয় তোর অমল পদধ্বনি। মানসচক্ষে দেখলাম আকাশপথে সমস্ত বিস্মৃত নায়কগণ সমাগত। আদিবিদ্বান কপিল থেকে শুরু করে চৌরাশি সিদ্ধগণ সকলেই করজোড়ে মাতৃকার নামকীর্তনরত; বন্দনারত। আমি পুলকিত চিত্তে মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করে সেখান থেকে নবোদ্যমে যাত্রা শুরু করলাম। অন্তরে তখনও ধ্বনিত হচ্ছে: শ্রীদুর্গানাম ভুলো না ভুলো না ভুলো না ভুলো না।

