বঙ্কিম কি কার্ল মার্ক্সকে চিঠি লিখেছিলেন?
কলকাতা থেকে একটা চিঠি গেছিল প্রথম আন্তর্জাতিকে। মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের উপস্থিতিতে ১৮৭১ সালের ১৫ই আগস্ট সে চিঠিটি পাঠ করা হয়। কলকাতা থেকে পত্রলেখক অনুমতি চেয়েছিলেন প্রথম আন্তর্জাতিকের কলকাতা শাখা তৈরি করার জন্য। সে চিঠিতে বলা হয়েছিলঃ
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। অত্যধিক কর আদায় করা হচ্ছে, সে সম্পদ ব্যবহার করা হচ্ছে খুবই খরচসাপেক্ষ একটা আমলাতন্ত্রের পেছনে। শাসকশ্রেণীর সম্পদের বাড়াবাড়ির সঙ্গে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার পার্থক্য অসহনীয়। আন্তর্জাতিকের আদর্শ এই অবস্থায় কলকাতার সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হবে যদি এখানে একটি শাখা খোলা হয়…
চিন্মোহন সেহানবিশ একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করেছিলেন, যে এই চিঠিটি কে পাঠিয়ে থাকতে পারেন। এই তালিকায় বঙ্কিম আছেন প্রথমেই, কারণ বঙ্কিমের সাম্য প্রবন্ধে (১৮৭৯) প্রথম আন্তর্জাতিকের উল্লেখ আছে। এছাড়া জেমস লং (ইংরেজ সরকার ১৮৬১ সালে তাঁকে নীল দর্পণ অনুবাদের দায়ে জেল খাটিয়েছিল), কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ Lobbe (ইনি পজিটিভিস্ট, এবং ১৮৭১-এর পারী কমিউনের সমর্থক ছিলেন), কেশব চন্দ্র সেন (১৮৭১ সালের আগস্ট মাসে অমৃতবাজার পত্রিকা একটি প্রতিবেদনে জানাচ্ছে যে কলকাতার কিছু বিশিষ্ট নাগরিক একটি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন। এরপর ১৮৭২ সালে অমৃতবাজার পুনরায় জানায় যে ১৮৭০ সালে কেশব যখন বিলেত যান, তখন সেখানকার কিছু চিন্তাবিদ তাঁকে কলকাতায় একটি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার পরামর্শ দেন), শিবনাথ শাস্ত্রী এবং শশিপদ ব্যানার্জি (এঁরা ১৮৭৪ সালে শ্রমজীবী সমিতি তৈরি করেন, এবং উপমহাদেশের প্রথম শ্রমিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ওই বছরের মে মাসে, যেখানে শিবনাথের “শ্রমজীবী” নামে কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, সে কবিতাটির বক্তব্য অনেকাংশে মিলে যায় আন্তর্জাতিক/ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের সঙ্গে)।
চিঠিটি কে লিখেছিলেন, সে প্রশ্নে চিন্মোহনবাবুর ভোট শিবনাথ এবং শশিপদের দিকেই।
কিন্তু চিন্মোহনবাবুর সম্ভাব্য তালিকায় এমন কয়েকজনের নাম নেই, যেগুলো থাকা উচিত ছিল। এঁরাও ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনালে চিঠি লিখে থাকতে পারেন। রাধানাথ শিকদার যেমন। হরিশ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় ১৮৫৮ সালে রাধানাথ শিকদার একটা প্রবন্ধ লেখেন, তাতে সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট ভাবনার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম আন্তর্জাতিক তৈরি হয়নি তখনও, ১৮৬৪ সালে তৈরি হবে। তবে মার্ক্স এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে সেযুগের বাঙালির পরিচয় ছিল মনে করা যায়। জনৈক যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ১৮৮২ সালে একটি বাংলা প্রবন্ধে মার্ক্সের কথা লিখেছেন। ১৯০৩ সালে অমৃতবাজার পত্রিকা একটি প্রবন্ধে মার্ক্সের উল্লেখ করছে (রাইজ অভ ফরেন সোশ্যালিস্টসঃ দেয়ার রিমার্কেবল গ্রোথ ইন দ্য কন্টিনেন্ট ইন রিসেন্ট ইয়ার্স)।
বঙ্কিমের কমলাকান্তের বেড়ালের কথাগুলো বেশ সোশ্যালিস্টিক ছিল। ওদিকে অরবিন্দের লেখায় পাওয়া যায় প্রোলেটারিয়েটের উল্লেখ, বিবেকানন্দের লেখাতেও আছে। উৎপল দত্ত তাঁর বই গিরিশ মানসে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আন্দোলনের একটি মার্ক্সীয় পুনর্মূল্যায়ন করেছেন, সেটা বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসকে যাঁরাই বিশ্লেষণ করেন সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য মনে করি। তাতে উৎপল বলছেন, মার্ক্সের যে কথাটা বহুল প্রচারিত, যে ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম, সেটা পুরোটা উদ্ধৃত করলে দেখা যাবে, মার্ক্স ধর্ম সম্পর্কে ওরকম একদেশদর্শী কথা বলেন নি, তিনি ধর্মকে বস্তুবাদী ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বুঝেছেন, এবং ধর্মের যে একটা anagesic annodyne anaesthetic ভূমিকা আছে, এবং ধর্ম যে একটা আশ্রয়; আত্মাহীন, হৃদয়হীন এই জগতে ধর্মের ভূমিকা যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তা যে মানব অস্তিত্বকে ধারণ করে রাখে (ভারতীয় ঐতিহ্যেও তাই বলে), সেটা মার্ক্সের সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিকে তুলে ধরলে বেরিয়ে আসছে। আমি এর আগে এটা নিয়ে লিখেছি, এই পেজে স্ক্রোল ডাউন করলে পাবেন।
পশ্চিমের বস্তুবাদের সঙ্গে বাঙালির শেকড়ে থাকা আদি সাংখ্য এবং তন্ত্রের প্রকৃতির ধারণার ভারী চমৎকার সাযুজ্য আছে আমার মনে হয়েছে। আদি সাংখ্য প্রকৃতি-প্রধান ছিল, ঈশ্বরে অনাস্থা রাখা সেই প্রকৃতির কনসেপ্ট অনেকগুলো কারণে সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম বস্তুবাদী দর্শনের মর্যাদা পাবে, উপরন্তু মাতৃকা-প্রতীকে এই প্রকৃতি প্রকাশিত হন। এই মাতৃকা-উপাসনার ভাষায় জীব ও জড় জগতকে একত্রে প্রকাশ করা বৈপ্লবিক। সে নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে আস্ত থিসিস হয়ে যাবে, কাজেই আপাতত আর কিছু বললাম না।
আজ মার্ক্সের জন্মদিন। আজ বঙ্কিমের মত সাম্প্রদায়িক, “মুসলমান-বিদ্বেষী”র নাম মার্ক্সের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে নেওয়া যায়? বঙ্কিমের আনন্দমঠে সন্তানরা শেষের দিকে মুসলমানদের গ্রামে গিয়ে বলছে, ভাই, হরিনাম করবি? সেই বঙ্কিম আর মার্ক্সের নাম একসঙ্গে?
এ প্রশ্নের উত্তরে আরেকবার মনে করি, মার্ক্সের সেই প্রবন্ধ, ১৮৫৪ সালে লেখা, “ডিক্লারেশন অভ ওয়ারঃ অন দ্য হিস্ট্রি অভ দ্য ইন্টার্ন কোয়েশ্চন”, তাতে মার্ক্স বলেছিলেন, “কোরান এবং তা থেকে উদ্ভূত মুসলমানি আইন বিভিন্ন জনমানুষের নিজস্ব ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে নামিয়ে আনে এক সুবিধাবাদী দ্বি-জাতীয় ও দ্বি-দেশীয় বিভেদেঃ যারা ইসলামে বিশ্বাসী, আর যারা অবিশ্বাসী বা কাফের। অবিশ্বাসী বা কাফের হল হার্বি, বা শত্রু। ইসলামিজম কাফেরদের জাতিকে নিষিদ্ধ করে, যার ফলে এক চিরস্থায়ী শত্রুতা তৈরি হয় মুসলমান ও অবিশ্বাসীর মধ্যে।” https://www.marxists.org/archive/marx/works/1854/03/28.htm
আমি জানি না, বঙ্কিম এ প্রবন্ধ পড়েছিলেন কিনা। সম্ভবত না। কিন্তু আনন্দমঠের শেষে সন্তানরা যা করেছিল, সেটা প্রায় যেন মার্ক্সের ব্যাখ্যার প্রতিধ্বনি।
আজ পর্যন্ত সিপিএমের কোনোও পার্টি কংগ্রেসে মার্ক্সের এ প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা হয়নি, হলে সম্ভবত সিপিএম ভেঙে যাবে আরেকবার। কিন্তু মার্ক্স একটা দিকে বঙ্কিমের থেকেও এগিয়ে। উনিশ শতকের বাংলায় ওয়াহাবি বা ফরাজির বিপদ সম্পর্কে ঈশ্বর গুপ্ত সচেতন ছিলেন। বঙ্কিমের কোনও লেখায় এই সচেতনতা পাইনি। তাঁর যা কিছু সমালোচনা সে মধ্যযুগের মুসলমানের। তিনি সমসাময়িক বাংলার হিন্দু মুসলমান সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তের ফারাক করতে রাজি ছিলেন না বঙ্কিম।
মার্ক্স কিন্তু তিতুমীর ও তাঁর আন্দোলনকে আখ্যা দিয়ে গেছেন, মোসলেম ফ্যানাটিক (নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি)। https://archive.org/…/notesonindianhis00ma…/page/n8/mode/2up
না, বঙ্কিম সম্ভবত প্রথম আন্তর্জাতিককে ওই চিঠিটা লেখেন নি। বঙ্কিম, আমাদের অশেষ দুর্ভাগ্যবশত তিনি ইংরেজ সরকারের কর্মচারী, সে ট্র্যাজেডি নিয়ে বঙ্কিমের মৃত্যুদিনে লিখেছিলাম, এই পেজে দেখতে পাবেন, কাজেই ঝুঁকি নিয়ে তিনি হয়ত মার্ক্সকে চিঠি লিখবেন না। কিন্তু আমার এই লেখা আজ যাঁরা আজ পড়লেন, তাঁরা সম্ভবত বুঝবেন, এক অর্থে এই দুজন মনীষী কথা বলেছিলেন, পরস্পর আলাপ করেছিলেন।
মনীষী থেকে মনে এল। বঙ্কিম-নামাঙ্কিত বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে সিপিআইয়ের মনীষা গ্রন্থালয়ে গেছি বেশ কয়েকবার। ঢুকলেই দেখা যায়, পেছনের দেওয়ালে বিশাল বিশাল কতগুলি তৈলচিত্র। তাতে বঙ্কিম রয়েছেন, খুব প্রমিনেন্টভাবে রয়েছেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের মার্ক্সচর্চা আরও গভীর হোক। মার্ক্স এঙ্গেলস নবজাগ্রত জার্মান জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে। আমরা জানি মার্ক্স ইসলামকে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু মার্ক্সবাদ সাধারণভাবে ধর্মবিরোধী নয়, বরং ধর্মের সপ্রশংস মূল্যায়নে সক্ষম (উৎপল দত্তর গিরিশ মানস বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য এই)। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকরা ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খ্রীষ্টধর্মের পক্ষ অবলম্বন করেছেন, আমার নিজের পিএইচডির কাজ এরকম একজনের ওপরে ছিল, টেরি ইগলটন, তিনি একজন ক্যাথলিক মার্ক্সবাদী। অতএব বাঙালির জন্য, বিশেষ করে একটি বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স যা একই সঙ্গে ইসলামের ও গোবলয়ের নির্ভীক সমালোচনা করবে, বাঙালির নিজস্ব শেকড়, ধর্ম, সংস্কৃতির পক্ষে অবস্থান করবে এবং সেই সঙ্গে সমাজ বদলের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করবে, সেই কাজে মার্ক্সের গুরুত্ব ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
কাজেই, একটি পরাবাস্তব বা জাদুবাস্তব ডাইমেনশনে আজ বঙ্কিম আর কার্ল মার্ক্সের মুখোমুখি দেখা হচ্ছে, তাঁরা করমর্দন করছেন। শুভ জন্মদিন, কার্ল…
© তমাল দাশগুপ্ত

৫ই মে ২০২০ তারিখে, http://fb.me/tdasgupto থেকে