বঙ্কিম কি কার্ল মার্ক্সকে চিঠি লিখেছিলেন? – তমাল দাশগুপ্ত

বঙ্কিম কি কার্ল মার্ক্সকে চিঠি লিখেছিলেন?

কলকাতা থেকে একটা চিঠি গেছিল প্রথম আন্তর্জাতিকে। মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের উপস্থিতিতে ১৮৭১ সালের ১৫ই আগস্ট সে চিঠিটি পাঠ করা হয়। কলকাতা থেকে পত্রলেখক অনুমতি চেয়েছিলেন প্রথম আন্তর্জাতিকের কলকাতা শাখা তৈরি করার জন্য। সে চিঠিতে বলা হয়েছিলঃ

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। অত্যধিক কর আদায় করা হচ্ছে, সে সম্পদ ব্যবহার করা হচ্ছে খুবই খরচসাপেক্ষ একটা আমলাতন্ত্রের পেছনে। শাসকশ্রেণীর সম্পদের বাড়াবাড়ির সঙ্গে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার পার্থক্য অসহনীয়। আন্তর্জাতিকের আদর্শ এই অবস্থায় কলকাতার সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হবে যদি এখানে একটি শাখা খোলা হয়…

চিন্মোহন সেহানবিশ একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করেছিলেন, যে এই চিঠিটি কে পাঠিয়ে থাকতে পারেন। এই তালিকায় বঙ্কিম আছেন প্রথমেই, কারণ বঙ্কিমের সাম্য প্রবন্ধে (১৮৭৯) প্রথম আন্তর্জাতিকের উল্লেখ আছে। এছাড়া জেমস লং (ইংরেজ সরকার ১৮৬১ সালে তাঁকে নীল দর্পণ অনুবাদের দায়ে জেল খাটিয়েছিল), কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ Lobbe (ইনি পজিটিভিস্ট, এবং ১৮৭১-এর পারী কমিউনের সমর্থক ছিলেন), কেশব চন্দ্র সেন (১৮৭১ সালের আগস্ট মাসে অমৃতবাজার পত্রিকা একটি প্রতিবেদনে জানাচ্ছে যে কলকাতার কিছু বিশিষ্ট নাগরিক একটি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন। এরপর ১৮৭২ সালে অমৃতবাজার পুনরায় জানায় যে ১৮৭০ সালে কেশব যখন বিলেত যান, তখন সেখানকার কিছু চিন্তাবিদ তাঁকে কলকাতায় একটি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার পরামর্শ দেন), শিবনাথ শাস্ত্রী এবং শশিপদ ব্যানার্জি (এঁরা ১৮৭৪ সালে শ্রমজীবী সমিতি তৈরি করেন, এবং উপমহাদেশের প্রথম শ্রমিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ওই বছরের মে মাসে, যেখানে শিবনাথের “শ্রমজীবী” নামে কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, সে কবিতাটির বক্তব্য অনেকাংশে মিলে যায় আন্তর্জাতিক/ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের সঙ্গে)।

চিঠিটি কে লিখেছিলেন, সে প্রশ্নে চিন্মোহনবাবুর ভোট শিবনাথ এবং শশিপদের দিকেই।

কিন্তু চিন্মোহনবাবুর সম্ভাব্য তালিকায় এমন কয়েকজনের নাম নেই, যেগুলো থাকা উচিত ছিল। এঁরাও ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনালে চিঠি লিখে থাকতে পারেন। রাধানাথ শিকদার যেমন। হরিশ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় ১৮৫৮ সালে রাধানাথ শিকদার একটা প্রবন্ধ লেখেন, তাতে সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট ভাবনার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম আন্তর্জাতিক তৈরি হয়নি তখনও, ১৮৬৪ সালে তৈরি হবে। তবে মার্ক্স এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে সেযুগের বাঙালির পরিচয় ছিল মনে করা যায়। জনৈক যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ১৮৮২ সালে একটি বাংলা প্রবন্ধে মার্ক্সের কথা লিখেছেন। ১৯০৩ সালে অমৃতবাজার পত্রিকা একটি প্রবন্ধে মার্ক্সের উল্লেখ করছে (রাইজ অভ ফরেন সোশ্যালিস্টসঃ দেয়ার রিমার্কেবল গ্রোথ ইন দ্য কন্টিনেন্ট ইন রিসেন্ট ইয়ার্স)।

বঙ্কিমের কমলাকান্তের বেড়ালের কথাগুলো বেশ সোশ্যালিস্টিক ছিল। ওদিকে অরবিন্দের লেখায় পাওয়া যায় প্রোলেটারিয়েটের উল্লেখ, বিবেকানন্দের লেখাতেও আছে। উৎপল দত্ত তাঁর বই গিরিশ মানসে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আন্দোলনের একটি মার্ক্সীয় পুনর্মূল্যায়ন করেছেন, সেটা বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসকে যাঁরাই বিশ্লেষণ করেন সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য মনে করি। তাতে উৎপল বলছেন, মার্ক্সের যে কথাটা বহুল প্রচারিত, যে ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম, সেটা পুরোটা উদ্ধৃত করলে দেখা যাবে, মার্ক্স ধর্ম সম্পর্কে ওরকম একদেশদর্শী কথা বলেন নি, তিনি ধর্মকে বস্তুবাদী ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বুঝেছেন, এবং ধর্মের যে একটা anagesic annodyne anaesthetic ভূমিকা আছে, এবং ধর্ম যে একটা আশ্রয়; আত্মাহীন, হৃদয়হীন এই জগতে ধর্মের ভূমিকা যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তা যে মানব অস্তিত্বকে ধারণ করে রাখে (ভারতীয় ঐতিহ্যেও তাই বলে), সেটা মার্ক্সের সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিকে তুলে ধরলে বেরিয়ে আসছে। আমি এর আগে এটা নিয়ে লিখেছি, এই পেজে স্ক্রোল ডাউন করলে পাবেন।

পশ্চিমের বস্তুবাদের সঙ্গে বাঙালির শেকড়ে থাকা আদি সাংখ্য এবং তন্ত্রের প্রকৃতির ধারণার ভারী চমৎকার সাযুজ্য আছে আমার মনে হয়েছে। আদি সাংখ্য প্রকৃতি-প্রধান ছিল, ঈশ্বরে অনাস্থা রাখা সেই প্রকৃতির কনসেপ্ট অনেকগুলো কারণে সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম বস্তুবাদী দর্শনের মর্যাদা পাবে, উপরন্তু মাতৃকা-প্রতীকে এই প্রকৃতি প্রকাশিত হন। এই মাতৃকা-উপাসনার ভাষায় জীব ও জড় জগতকে একত্রে প্রকাশ করা বৈপ্লবিক। সে নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে আস্ত থিসিস হয়ে যাবে, কাজেই আপাতত আর কিছু বললাম না।

আজ মার্ক্সের জন্মদিন। আজ বঙ্কিমের মত সাম্প্রদায়িক, “মুসলমান-বিদ্বেষী”র নাম মার্ক্সের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে নেওয়া যায়? বঙ্কিমের আনন্দমঠে সন্তানরা শেষের দিকে মুসলমানদের গ্রামে গিয়ে বলছে, ভাই, হরিনাম করবি? সেই বঙ্কিম আর মার্ক্সের নাম একসঙ্গে?

এ প্রশ্নের উত্তরে আরেকবার মনে করি, মার্ক্সের সেই প্রবন্ধ, ১৮৫৪ সালে লেখা, “ডিক্লারেশন অভ ওয়ারঃ অন দ্য হিস্ট্রি অভ দ্য ইন্টার্ন কোয়েশ্চন”, তাতে মার্ক্স বলেছিলেন, “কোরান এবং তা থেকে উদ্ভূত মুসলমানি আইন বিভিন্ন জনমানুষের নিজস্ব ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে নামিয়ে আনে এক সুবিধাবাদী দ্বি-জাতীয় ও দ্বি-দেশীয় বিভেদেঃ যারা ইসলামে বিশ্বাসী, আর যারা অবিশ্বাসী বা কাফের। অবিশ্বাসী বা কাফের হল হার্বি, বা শত্রু। ইসলামিজম কাফেরদের জাতিকে নিষিদ্ধ করে, যার ফলে এক চিরস্থায়ী শত্রুতা তৈরি হয় মুসলমান ও অবিশ্বাসীর মধ্যে।” https://www.marxists.org/archive/marx/works/1854/03/28.htm

আমি জানি না, বঙ্কিম এ প্রবন্ধ পড়েছিলেন কিনা। সম্ভবত না। কিন্তু আনন্দমঠের শেষে সন্তানরা যা করেছিল, সেটা প্রায় যেন মার্ক্সের ব্যাখ্যার প্রতিধ্বনি।

আজ পর্যন্ত সিপিএমের কোনোও পার্টি কংগ্রেসে মার্ক্সের এ প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা হয়নি, হলে সম্ভবত সিপিএম ভেঙে যাবে আরেকবার। কিন্তু মার্ক্স একটা দিকে বঙ্কিমের থেকেও এগিয়ে। উনিশ শতকের বাংলায় ওয়াহাবি বা ফরাজির বিপদ সম্পর্কে ঈশ্বর গুপ্ত সচেতন ছিলেন। বঙ্কিমের কোনও লেখায় এই সচেতনতা পাইনি। তাঁর যা কিছু সমালোচনা সে মধ্যযুগের মুসলমানের। তিনি সমসাময়িক বাংলার হিন্দু মুসলমান সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তের ফারাক করতে রাজি ছিলেন না বঙ্কিম।

মার্ক্স কিন্তু তিতুমীর ও তাঁর আন্দোলনকে আখ্যা দিয়ে গেছেন, মোসলেম ফ্যানাটিক (নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি)। https://archive.org/…/notesonindianhis00ma…/page/n8/mode/2up

না, বঙ্কিম সম্ভবত প্রথম আন্তর্জাতিককে ওই চিঠিটা লেখেন নি। বঙ্কিম, আমাদের অশেষ দুর্ভাগ্যবশত তিনি ইংরেজ সরকারের কর্মচারী, সে ট্র্যাজেডি নিয়ে বঙ্কিমের মৃত্যুদিনে লিখেছিলাম, এই পেজে দেখতে পাবেন, কাজেই ঝুঁকি নিয়ে তিনি হয়ত মার্ক্সকে চিঠি লিখবেন না। কিন্তু আমার এই লেখা আজ যাঁরা আজ পড়লেন, তাঁরা সম্ভবত বুঝবেন, এক অর্থে এই দুজন মনীষী কথা বলেছিলেন, পরস্পর আলাপ করেছিলেন।

মনীষী থেকে মনে এল। বঙ্কিম-নামাঙ্কিত বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে সিপিআইয়ের মনীষা গ্রন্থালয়ে গেছি বেশ কয়েকবার। ঢুকলেই দেখা যায়, পেছনের দেওয়ালে বিশাল বিশাল কতগুলি তৈলচিত্র। তাতে বঙ্কিম রয়েছেন, খুব প্রমিনেন্টভাবে রয়েছেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মার্ক্সচর্চা আরও গভীর হোক। মার্ক্স এঙ্গেলস নবজাগ্রত জার্মান জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে। আমরা জানি মার্ক্স ইসলামকে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু মার্ক্সবাদ সাধারণভাবে ধর্মবিরোধী নয়, বরং ধর্মের সপ্রশংস মূল্যায়নে সক্ষম (উৎপল দত্তর গিরিশ মানস বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য এই)। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকরা ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খ্রীষ্টধর্মের পক্ষ অবলম্বন করেছেন, আমার নিজের পিএইচডির কাজ এরকম একজনের ওপরে ছিল, টেরি ইগলটন, তিনি একজন ক্যাথলিক মার্ক্সবাদী। অতএব বাঙালির জন্য, বিশেষ করে একটি বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স যা একই সঙ্গে ইসলামের ও গোবলয়ের নির্ভীক সমালোচনা করবে, বাঙালির নিজস্ব শেকড়, ধর্ম, সংস্কৃতির পক্ষে অবস্থান করবে এবং সেই সঙ্গে সমাজ বদলের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করবে, সেই কাজে মার্ক্সের গুরুত্ব ফুরিয়ে যাচ্ছে না।

কাজেই, একটি পরাবাস্তব বা জাদুবাস্তব ডাইমেনশনে আজ বঙ্কিম আর কার্ল মার্ক্সের মুখোমুখি দেখা হচ্ছে, তাঁরা করমর্দন করছেন। শুভ জন্মদিন, কার্ল…

© তমাল দাশগুপ্ত

৫ই মে ২০২০ তারিখে, http://fb.me/tdasgupto থেকে

বঙ্কিম সম্পর্কে সাতটা মিথ – তমাল দাশগুপ্ত

আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা বঙ্কিমকে নিয়ে বহুল প্রচলিত সাতটি মিথ ভাঙব আজ এই লেখায়। বঙ্কিমবিরোধী কেউ পারলে সঠিক প্রতিযুক্তি ও প্রতি-তথ্য নিয়ে অগ্রসর হোন, এই সাতটি মিথ আমি বরাবরের মত এ প্রবন্ধের মাধ্যমে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছি।

প্রথমেই সবথেকে অস্বস্তিকর ও সবথেকে বড় মিথঃ বঙ্কিম মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত স্টেটাসে এর পূর্ণাঙ্গ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এ নিয়ে আমার একটা প্রবন্ধ আছে, “বঙ্কিম কী মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন? মিথ ও মিথ্যার আবরণ সরিয়ে”।

http://shoptodina.blogspot.com/2016/03/blog-post_35.html

বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষ একটি মিথ। কিন্তু এক কথায় যেটা বলা দরকার, সেটা হচ্ছে একশ্রেণীর মুসলমানের বঙ্কিম বিদ্বেষ (সবার নয়, বঙ্কিম সম্পর্কে শ্রদ্ধাবান মুসলমানও আছেন অনেকে) -এর ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করা দরকার এবার। এর একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সে ইতিহাস পাঠ করলে বাংলার ও ভারতের বুকে ইসলামিক মৌলবাদকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।

বঙ্কিমের আনন্দমঠ বা রাজসিংহ প্রমুখ উপন্যাস বা বিভিন্ন প্রবন্ধ সম্পর্কে যেটা মুসলমান বিদ্বেষের অভিযোগ আছে, সেটা উপন্যাস বা প্রবন্ধ সমূহ পড়লেই বোঝা যায়, সেটা বিজাতীয় মুসলমানের আগ্রাসনের প্রতি একজন সৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদীর বিদ্বেষ। এর জন্য বঙ্কিম কৈফিয়ত দেবেন না কারও কাছে, তিনি এই সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি-পুরুষ দ্বৈতবাদের ভূমিতে বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছেন, একে কোনও রেসিস্ট বিদ্বেষের ছাপ দেওয়া অসভ্যতা, কারণ আত্মরক্ষার অধিকার আছে বাঙালির। সব জাতিরই আছে, আমাদেরও আছে। নিজের ভূমিতে দাঁড়িয়ে তো আরও বেশি আছে।

বাংলাভাষী মুসলমানের বিরুদ্ধে বঙ্কিম বিদ্বিষ্ট নন, বরং উল্টো প্রমাণ দিয়েছি আমার প্রবন্ধে। তবে আনন্দমঠের চরিত্রগুলিকে দেখা গেছে, তারা উপন্যাসের শেষে মুসলমানকে দিয়ে জোর করে হরিনাম করাতে চেয়েছে। চরিত্রের কাজকে উপন্যাসলেখকের কাজ ভাবা সুচিন্তিত নয়, এবং সে প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আবার আসব। তবে হরিনাম শেখানোকে বিদ্বেষ বলা যায়?

যবন হরিদাস সুলতানের আদেশে বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতে মৃতপ্রায় হয়েও হরিনাম করেছেন, তিনি মহাপ্রাণ মহাত্মা ছিলেন। তা বলপূর্বক কাজীদলনের জন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন যদি মুসলমান বিদ্বেষী না হয়, তবে আনন্দমঠের লেখক বঙ্কিমও নন।

বাংলার মুসলমানকে রাধাকৃষ্ণের প্রেমগানে মথিত করাকে বিদ্বেষ বলব না। সেটাকে বাঙালিত্ব বলব।

সাহিত্য সম্রাটের সমস্ত লেখায় মুসলমান বিদ্বেষের যাবতীয় অভিযোগের বিস্তারিত খণ্ডন পাবেন ওপরের লেখাটায়। লিঙ্কে গিয়ে অনুগ্রহ করে পড়ুন।

দ্বিতীয় মিথ। বঙ্কিম বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার, বিশেষ করে তাঁর বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন।

বঙ্কিমের উপন্যাসে সূর্যমুখী নামে একটি চরিত্র বলেছিল, বিধবার বিবাহ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক কথা। চরিত্রের উক্তি যদি উপন্যাসকারের উক্তি হয়, তাহলে পাকিস্তান ও মুসলিম লিগের মৌলবাদকে সমর্থন করার কাজে এখুনি সাত আসমান নামক উপন্যাসের লেখক শামিম আহমেদ অভিযুক্ত হবেন, কারণ ওই উপন্যাসের চরিত্র এমনই করেছে। সেকুলারিজম ভালো, কিন্তু সাহিত্যের আলোচনা এভাবে হলে তো মহা বিপদ হবে। চরিত্রকে চরিত্র হিসেবে দেখাই ভালো, বঙ্কিম সেযুগের একটি বাস্তবোচিত চরিত্র তৈরি করতে গিয়ে তার মুখে একটা সংলাপ দিয়েছেন।

দেখতে হবে বঙ্কিমের প্রবন্ধে বিধবাবিবাহ সম্পর্কে কেমন উক্তি আছে। সেখানে তো দেখছি বঙ্কিম বিধবা বিবাহের অধিকার সম্পর্কে সরাসরি সমর্থন জানাচ্ছেন। সাম্য প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট বলছেন, কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই বলছেন যে পুরুষের যেমন স্ত্রীবিয়োগের পরে পুনর্বিবাহে অধিকার, তেমনই স্ত্রীরও অধিকার আছে বিধবা হলে পুনর্বিবাহে (বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, ৩৪৭)।

তৃতীয় মিথ। বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, বহুবিবাহ বিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে বলেছেন বঙ্কিম, বঙ্কিম বহুবিবাহের সমর্থক ছিলেন। এ সংক্রান্ত বঙ্কিমের প্রবন্ধ যে-ই পড়েছে, সেই জানে, এটা সর্বৈব মিথ।

বঙ্কিম সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে যা বলেছিলেন, তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় ১। বহু বিবাহ একটি মুমূর্ষু রাক্ষস, এ রাক্ষস এমনিতেই মৃতপ্রায়।
২। তথাপি বিদ্যাসাগর একে মারতে উদ্যত হয়েছেন বলে তিনি পুণ্যাত্মা বলে গণ্য হবেন।
৩। যদি পুরুষদের বহুবিবাহ বন্ধ করতে হয় সেক্ষেত্রে বাংলায় অর্ধেক মুসলমান (সেযুগে অর্ধেক), তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত পণ্ডিত কেউ নেই, বিশেষত আরবী কায়দা হেলে না দোলে না, তাই শাস্ত্র উদ্ধৃত করে এই সমাজ সংস্কার করলে চলবে না, এবং শুধু হিন্দুর জন্য এই বহু বিবাহ নিরোধক আইন করলেও চলবে না। শাস্ত্র দেখে নয়, এবং ধর্ম দেখে নয়। সর্বত্র সব ধর্মের মধ্যে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হোক।

বঙ্কিম যা বলেছিলেন, তা থেকে বোঝা যায়, তিনি ইউনিফর্ম সিভিল কোড চেয়েছিলেন। সেযুগের প্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক।

এবং শাস্ত্র উদ্ধৃত করে সমাজ পরিচালনার বিরোধিতা বঙ্কিম অন্যত্রও করেছেন। জীবনের একদম শেষে একবার তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, সমুদ্রযাত্রায় শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তিনি কী মনে করেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, যদি তাতে মনে কর (বাঙালি) জাতির ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখো না, শাস্ত্রবচনের ওপর নির্ভর কোরো না, নির্ভয়ে সমুদ্রযাত্রা করো। ,

চতুর্থ মিথ। বঙ্কিমের সংস্কৃত দুর্বল ছিল এবং এজন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় সংস্কৃতে গ্রেস মার্ক পেয়ে পাশ করেছিলেন। সত্য হল, বঙ্কিম ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত শিখেছেন। এ নিয়ে শ্যামলী চক্রবর্তীর বই আছে, “বঙ্কিমচন্দ্র এবং ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ”, আগ্রহীজন পড়ে নিতে পারেন। এবং আরেকটা সত্য হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় আদৌ সংস্কৃতের কোনও পেপার-ই ছিল না।

পঞ্চম মিথ। বঙ্কিম দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বলে বিদ্যাসাগর তাকে একবার বাংলায় ফেল করিয়েছিলেন।

এটি মিথ কেননা অর্ধসত্য। অতএব মিথ্যার থেকেও ভয়ানক।

ঘটনা যা ঘটেছিল বলি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে বিদ্যাসাগর পরীক্ষক ছিলেন। ইংরেজি ও বাংলা মিশ্রিত একটি ল্যাঙ্গুয়েজ পেপার ছিল। ইংরেজি অংশের পরীক্ষক ছিলেন Grapel এবং বাংলা অংশের বিদ্যাসাগর। ইংরেজিতে খুব ভালো নম্বর পেয়েছিলেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরের পেপারে বঙ্কিম পাশ করতে পারেন নি। প্রসঙ্গত, এই একবার মাত্র নয়। এর আগে একবার হুগলি কলেজে যখন বঙ্কিম ছাত্র এবং বিদ্যাসাগর বাংলার পরীক্ষক, তখনও বঙ্কিমের বাংলা পছন্দ হয়নি বলে বিদ্যাসাগর তাঁকে ফেল করিয়েছিলেন। বঙ্কিমের ছাত্রজীবনের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় হগলি কলেজে পাঠরত অবস্থায় প্রত্যেক বছরই তিনি ডিস্টিংশন পেয়েছিলেন। ওই একটা বছরেই পান নি।

বঙ্কিম কিন্তু এর আগেই ঈশ্বর গুপ্তের প্রিয় শিষ্য। কিশোর বয়সেই তিনি সংবাদ প্রভাকরে লিখছেন। কালেজীয় কবিতাযুদ্ধ নামে একটা ভারী চমৎকার সিরিজ (একরকম কবির লড়াই বলতে পারেন) হয়েছিল এইযুগে সংবাদ প্রভাকরে, ঈশ্বর গুপ্তের তিনজন স্নেহভাজন কিশোর লেখকের মধ্যেঃ বঙ্কিম, দীনবন্ধু আর দ্বারকানাথ অধিকারী। দ্বারকানাথের অকাল মৃত্যু না হলে বাকি দুজনের মত তিনিও সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রূপে আত্মপ্রকাশ করতেন।

তো যে বঙ্কিমকে বিদ্যাসাগর ফেল করাচ্ছেন, সে বঙ্কিম কিন্তু দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন না। কারণ তাঁর এই সময়ে লেখা বাংলা ঈশ্বর গুপ্তের কল্যাণে সুরক্ষিত আছে, চাইলে আপনিও দেখে নিতে পারবেন। এবং যারা ভাবেন বঙ্কিমের বাংলা দাঁতভাঙা ছিল, আসলে তারা বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ছাড়া আর কিছুই পড়েন নি। বস্তুত দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বিদ্যাসাগর নিজেই, সেটা যারা বিদ্যাসাগরের গদ্য রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত সবাই জানেন, এবং সেজন্যই সম্ভবত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ছাত্রের লেখা unorthodox বাংলা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পছন্দ হয় নি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র জ্ঞান আছে সেই জানে বিদ্যাসাগরের বাংলা কতটা রক্ষণশীল আর বঙ্কিমের বাংলা কতটা বৈপ্লবিক ছিল সে যুগে।

ষষ্ঠ মিথ। বঙ্কিম ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট ছিলেন। বস্তুত বঙ্কিম ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের হাতে বিধ্বস্ত হয়েছেন বারবার। পুরো চাকরিজীবন ধরে ইংরেজদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছেন, এবং সেজন্য বারবার আঘাত পেতে হয়েছে শাসকের থেকে। সেটা বঙ্কিমের জীবন সম্পর্কে ওয়াকবহাল প্রত্যেকে জানেন। আনন্দমঠ লেখার পর বারবার শাস্তিমূলক বদলি এবং এমনকি ডিমোশন হয়েছে বঙ্কিমের। এ নিয়ে বঙ্কিমের মৃত্যুদিনে লিখেছি, সেটার লিঙ্ক দিলাম।

https://matshonyay.home.blog/2020/04/10/%e0%a6%ac%e0%a6%99%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%a3%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a6%b8%e0%a7%87-%e0%a6%a4%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%aa/

আনন্দমঠের শেষে ইংরেজ জিতছে, সেটা দেখানোর জন্য বঙ্কিমকে যদি ইংরেজ-অনুগত ভাবতে হয়, তাহলে স্মরণ করাতেই হয়, ঐতিহাসিক উপন্যাসের শেষটা কেমন হবে সেটা নিয়ে লেখকের হাত বাঁধা থাকে। ম্যাজিক রিয়েলিজম জাতীয় কিছু ঘটানোর প্রথা তখনও আসেনি। সীতারামের শেষে সীতারামের পরাজয় দেখিয়েছেন বলে তাহলে বঙ্কিমকে হিন্দুবিদ্বেষী বলতে হবে, যদি আনন্দমঠে ইংরেজের বিজয় দেখানোর জন্য তিনি ইংরেজপ্রেমিক হয়ে থাকেন। ইতিহাসে ইংরেজ জিতেছিল, আর ইতিহাসে সীতারাম হেরেছিলেন। ঐতিহাসিক উপন্যাসে বঙ্কিম কেমনভাবে অন্যরকম দেখাবেন?

সপ্তম মিথ। বঙ্কিম হিন্দুধর্মের কুসংস্কারগুলোকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। যিনি সেযুগে প্রখর জনপ্রিয় শশধর তর্কচূড়ামণির দ্বারা হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও জনপ্রিয়করণের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছেন, সেই বঙ্কিম কুসংস্কারের পক্ষপাতী, এই অভিযোগে বাঙালির ইতিহাস হেসে ফেলবে (প্রসঙ্গত যারা জানেন না, তাঁদের বলি, শশধর আজকের হিন্দুত্ববাদীদের বৈজ্ঞানিক অস্পৃশ্যতা, অথবা গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি, অথবা মহাভারতে ইন্টারনেট ইত্যাদি তত্ত্বের পূর্বসূরী ছিলেন, উদাহরণস্বরূপ তিনি হিন্দুধর্মের টিকিতে ইলেক্ট্রিসিটি পেতেন)

বস্তুত, বঙ্কিম প্রখর যুক্তিবাদী ছিলেন। এককালে নাস্তিক ছিলেন। এবং যদিও পরে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে পড়েন, কিন্তু তাঁর লেখা কৃষ্ণচরিত্র বা ধর্মতত্ত্ব পড়লে বোঝা যায় নাস্তিকেরও কোনও সমস্যা হয় না এই ধর্মের সংজ্ঞায়, কারণ এই ধর্ম ধারণ করে। যে সাংখ্যের সবথেকে বিখ্যাত উক্তি ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ, অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্বই অসিদ্ধ, তাকে বাংলার হিন্দুধর্মের কেন্দ্রস্থলে স্থান দিয়ে বঙ্কিম অবশ্যই একাধারে ধর্ম ও দর্শনের বিবর্তনের প্রক্রিয়ার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকার, অন্যদিকে তিনি বাঙালিকে এমন এক ধর্মের ঈঙ্গিত দিয়ে গেছেন, যাকে বিনা কুসংস্কারে এমনকি বিনা ঈশ্বরবিশ্বাসেও গ্রহণ করতে অসুবিধা হয় না। এছাড়া তাঁর বঙ্গদর্শনের বিজ্ঞান নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন বঙ্কিম, তিনি বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার একজন বীজপুরুষ। জ্যোতিষ নিয়ে এককালে আগ্রহ থাকলেও তাঁর মেয়ের জ্যোতিষী নির্ধারিত “রাজজোটক” বিবাহের পর জামাইটি মেয়েকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার পর (আদালতে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়েছিল, শোনা যায় জামাইয়ের দাদুর কাতর আবেদনের ফলে বঙ্কিম আর জামাইয়ের শাস্তিবিধান করেন নি, নইলে সে রত্নটির ফাঁসি হত) বঙ্কিম প্রৌঢ় বয়সে এই জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতায় আস্থাশীল হন। হ্যাঁ, তিনি কালাপাহাড় বা ইয়ং বেঙ্গল ধরণের বিদ্বেষ দেখান নি বাংলার হিন্দুধর্ম সম্পর্কে (ভাগ্যিস দেখান নি), কিন্তু সেজন্যই তিনি ঋষি। তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না। তিনি সেযুগে বসে ধর্ম সম্পর্কে যা অনুধাবন করেছেন, তা বৈপ্লবিক। তাঁর ধর্মতত্ত্ব ও সাম্য পাশাপাশি রাখলে সেই কাজ বিংশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকায় লিবারেশন থিওলজি, বর্তমান ইউরোপে ঈগলটন বা জিজেক প্রমুখের মার্ক্সবাদী ক্রিশ্চান তত্ত্বর সমপর্যায়ে আসবে। তিনি যুক্তিবাদের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে যুক্তিকে বৃহতের আঙ্গিকে এনেছেন। তিনি ধর্মের সঙ্গে শুধু সামাজিক ন্যায়কে জোড়েন নি। তাঁর প্রবন্ধে বোঝা যায়, তিনি সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত বাঙালির শাক্ত, বৈষ্ণব ও অজস্র লোকায়ত ধর্মাচারের ন্যারেটিভগুলির প্রয়োজনীয়তা সেযুগে বসেই অনুধাবন করেছেন। আজকে ইউভাল হারারির মত পণ্ডিতও সে প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, অর্থাৎ ধর্মের কাহিনীগুলো আমাদের মধ্যে সমষ্টি নির্মাণ করে। সে সমষ্টি প্রয়োজনীয়। ডকিন্স, বিখ্যাত নাস্তিক, তিনি বলছেন, ইংল্যান্ডের স্কুলে বাইবেল পড়ানো বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের আইকন বঙ্কিমকে নমস্কার করে, তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত সাতটি মিথকে যথোপযুক্তভাবে ধ্বংস করে এই লেখা শেষ করছি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যে যে বাঙালি আছেন বঙ্কিমবিরোধী, তাঁদের সকলের উদ্দেশ্যে খোলা চ্যালেঞ্জ রাখলাম, সাধ্য থাকলে প্রতিযুক্তি ও প্রতিতথ্য সহকারে আমার সঙ্গে সম্মুখ তর্কযুদ্ধে আসবেন। নতুবা এ সাতটি মিথকে বরাবরের মত এই আমি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করলাম।

বন্দেমাতরম।

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২০শে এপ্রিল ২০২০

সপ্তসংঘর্ষে সাহিত্যসম্রাট – তমাল দাশগুপ্ত

সপ্তসঙ্ঘর্ষে সাহিত্যসম্রাট

বঙ্কিম তাঁর সারা জীবনে অনেকগুলি আদর্শগত যুদ্ধ করেছেন। বঙ্কিমকে নিয়ে গবেষণা সেভাবে হয়নি, যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হয়েছে। আমি আজ বঙ্কিমজীবনের সঙ্ঘর্ষগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত সংকলন করব এখানে।

১। ১৮৮২ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতার বাঙালি ভদ্রলোকরা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেন। রেভারেন্ড হেস্টি নামক এক ক্রিশ্চান মিশনারির এতে মর্মান্তিক হয়। তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি, পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত এতগুলি এনলাইটেনড বাঙালি কিভাবে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটা রিচুয়াল অর্থাৎ শ্রাদ্ধে যোগদান করল। ফলত, হেস্টি একটি থান ইঁট ছুঁড়লেন এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে, ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ রচনা করলেন। এতে হিন্দুধর্মের মূর্তিপুজোকেও আক্রমণ করেন। হিন্দুধর্মকে মন্সট্রাস বা দানবিক আখ্যা দেন, হিন্দু দেবদেবী বিশেষত শাক্ত মাতৃকাদের পার্সনেশন অভ ইভিল বা মূর্তিমান অশুভ আখ্যা দেন, এবং হিন্দুধর্মকে সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন অভ ডিজিজ বা মানসিক রোগ আখ্যা দেন। বঙ্কিম এর কড়া প্রত্যুত্তর দেন। প্রথমে ছদ্মনামে (সরকারি চাকুরে ছিলেন) কিন্তু বিষয়টা গোপন ছিল না। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এবং কপালকুণ্ডলার লেখক হিসেবে পত্রলেখককে চিহ্নিত করেন। পত্রযুদ্ধ হয়েছিল স্টেটসম্যান কাগজে। বঙ্কিম এই পত্রযুদ্ধের শেষ পত্রে স্বনামে সাক্ষর করেছিলেন।
দুঃখের বিষয় সাধারণ বাজারচলতি বঙ্কিম রচনাবলী যেগুলোর দুটো খণ্ড থাকে, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাতে বঙ্কিমের এই ইংরেজি পত্রপ্রবন্ধগুলি সংকলিত হয় না। তবে সুখের কথা সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বাংলা আকাডেমি ছয় খণ্ডে বঙ্কিম রচনাবলী যেটা প্রকাশ করেছে তাতে বঙ্কিমের সমস্ত ইংরেজি লেখা আছে, এবং এই পত্রগুলোও আছে।

২। কৈলাস চন্দ্র সিংহ নামটা আজ প্রায় বিস্মৃত। ইনি আদি ব্রাহ্ম সমাজের বেতনপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন, এবং ছিলেন একজন বঙ্কিম-বিদ্বেষী। বঙ্কিমের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি বিতর্ক হয়েছিল, যে প্রসঙ্গে পরে আসব। সেক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ বিতর্কে প্রবেশ করার আগে এই কৈলাসই প্রথম গুলিগোলা চালাতে শুরু করেন বঙ্কিমের বিরুদ্ধে। কৈলাসের অনেক অভিযোগ বঙ্কিমের বিরুদ্ধে। বঙ্কিমের নিজস্বতা নেই, বঙ্কিম নাকি অন্যের গবেষণা থেকে চুরি করেন, বঙ্কিম গুরুগিরি করেন, বঙ্কিম নেহাত অনুবাদের ওপরে নির্ভর করে কাজ করেন, ইত্যাদি অনেক কুৎসা করেন কৈলাস। কিন্তু এগুলো বাহ্য। আসলে কৈলাস একটা ব্রাহ্ম আতঙ্ককে রিপ্রেজেন্ট করছেন। বাংলার তান্ত্রিক, শাক্ত, বৈষ্ণব হিন্দুধর্মের একটা পুনরুত্থান ঘটছে। বঙ্কিম বলছেন হিন্দুধর্মের শেকড়ে সাংখ্য, এবং সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে আমাদের হিন্দু ধর্ম – সেই প্রকৃতি বৈষ্ণবের রাধা, সেই প্রকৃতি শাক্তের কালী। অর্থাৎ অলিখিত সাব টেক্সটঃ যে বেদ, যে বেদান্ত নিয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলন এত মুগ্ধ, সেটা আসলে বাংলার হিন্দুধর্মের শেকড়ই নয়। ফলত, কৈলাসের বঙ্কিম দূষণ।
প্রসঙ্গত, কৈলাস খানিকটা যাকে বলে কন্সটিপেটেড লোক ছিলেন। কেবল বঙ্কিমদ্বেষী তিনি নন। প্রসঙ্গান্তরে তিনি বাঙালির ইতিহাসের অন্যান্য দিকগুলির প্রতিও বিদ্বেষ দেখিয়েছেন, তবে তা নিয়ে আজ আলোচনার প্রয়োজন নেই।
বঙ্কিম একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিধ্বংসী প্রবন্ধে (আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়) কৈলাসকে ভৃত্য ও নায়েব আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি খণ্ডন করেন।
৩। রামগতি ন্যায়রত্ন। এঁকে আমরা ancient regime বা রক্ষণশীলতার প্রতিভূ ধরতে পারি। বঙ্কিম সম্পর্কে একটা মিথ হল যে বঙ্কিম রক্ষণশীল ছিলেন। না। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছিলেন। জাতীয়তাবাদ কিন্তু রক্ষণশীলতা নয়। যেমন বঙ্কিমকে একবার জিগ্যেস করা হয়েছিল, যে সাগরপাড়ি দেওয়া সম্পর্কে শাস্ত্র-নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তিনি কি ভাবছেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। যদি মনে কর তাতে ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখো না।
বঙ্কিম সম্পর্কে মিথ নিয়ে আজ আলোচনা করছি না, সেটা আরেকদিনের জন্য তোলা থাকল। কিন্তু বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রোক্তি-নির্ভর সমাজসংস্কার সম্পর্কেও বঙ্কিমের আশ্চর্য রকমের মুক্তমনা উক্তি ছিল, যদি মনে করি তাতে আমাদের জাতির ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। বস্তুত বঙ্কিমের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের একটি তাত্ত্বিক সঙ্ঘর্ষ হয়েছিল। কিন্তু সেটা বিধবা বিবাহ নিয়ে নয়। বিধবার যে বিয়ে দেয় সে যদি পণ্ডিত হয় তাহলে মূর্খ কে, এই মর্মে তাঁর উপন্যাসে একটি চরিত্রের উক্তি কোনও তাত্ত্বিক অবস্থান নয়, চরিত্রের উক্তিকে লেখকের উক্তি বলে ভাবা অশিক্ষিতের কাজ। কাজেই বিধবা বিবাহ নিয়ে বঙ্কিমের বিরুদ্ধতা তাতে প্রমাণ হয় না। বরং অন্যত্র বঙ্কিম উল্টোটাই বলেছেনঃ হিন্দু বিধবার পুনরায় বিবাহের অধিকার থাকা উচিত, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে গেছেন বঙ্কিম। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে যে বিষয়ে বঙ্কিমের প্রকৃত বিতর্ক হয়েছিল, সেটা ছিল বহুবিবাহ নিবারণে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রোক্তি-নির্ভরতা। বঙ্কিম কিন্তু বহুবিবাহ সমর্থন করেন নি একবারও। বরং বিরোধিতাই করেছেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, যদি বহু বিবাহ নিবারণ করতে হয়, তাহলে শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। এবং বাংলার অর্ধেক মুসলমান (সেযুগে অর্ধেক)। যদি বহু বিবাহ নিবারণ করতে হয়, তাহলে তাদের জন্যও করা হোক, তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত শাস্ত্রোক্তি-উদ্ধৃত করা পণ্ডিত কেউ আসেন নি বলে তাদের মেয়েরা সতীনজ্বালা ভোগ করবে, আর হিন্দুদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত শাস্ত্রজ্ঞ এসেছেন বলে হিন্দুদের মেয়েরাই কেবল উদ্ধার হবে, এটাকে বঙ্কিম একচোখোমি বলেছেন।
প্রসঙ্গে ফিরি। রামগতি ন্যায়রত্ন বিদ্যাসাগরি বাংলার সমর্থক ছিলেন। যারা বঙ্কিমি বাংলাকে দুরূহ ভাবেন, তারা বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ছাড়া আর কিছু পড়েন নি। বস্তুত বঙ্কিমের বাংলা সেযুগে এক বিপ্লব, এবং বিদ্যাসাগরের বাংলাই ছিল দাঁতভাঙা। বঙ্কিমকে বিদ্যাসাগর দুবার ফেল করিয়েছিলেন বাংলা পরীক্ষায়। কিন্তু সে ফেল বঙ্কিম দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বলে নয়। বঙ্কিম সেযুগে ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্য, প্রথমে হুগলি কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্কিমের পরীক্ষার খাতায় তাঁর বাংলা সেযুগে বিদ্যাসাগরের কাছে অতিরিক্ত র‍্যাডিক্যাল প্রতিভাত হয়েছিল নিঃসন্দেহে।
রামগতির আপত্তি ছিল প্রচলিত কথ্য ভাষা কেন অনুপ্রবেশ করবে বাংলা সাহিত্যে। কারণ এই ভাষা তো দুই ভ্রাতা অথবা পিতা পুত্র একসঙ্গে বসে পাঠের অযোগ্য। বঙ্কিম এই অবস্থানকে ল্যাম্পুন করে, ব্যঙ্গ করে একটি প্রবন্ধে দেখান, যে শুদ্ধ সংস্কৃতে দুই ভাই অথবা পিতা-পুত্র আলোচনা করলে সেটা কি ভীষণ বিষম লাগার মত ব্যাপার হবে।
৪। চণ্ডী চরণ সেন। ইনি কৃষ্ণনগর আদালতের মুন্সেফ ছিলেন। একটি রায়দানে তিনি লেখেন, ৯৯% বাঙালি বিধবা চরিত্রহীন হয়। বঙ্কিম অতি সংক্ষিপ্ত একটি প্রত্যুত্তর লিখেছিলেন। তাতে একটা রসিকতা স্মরণ করেছিলেন। গুরু এসেছে শিষ্যবাড়িতে। শিষ্য দশখানা বড় বড় কই ধরে এনে ঝোল রেঁধেছে অতি উপাদেয়। গুরু খেতে শুরু করে লোভে পড়ে ন’খানাই খেয়ে ফেললেন। মোটে একখানা কই পড়ে আছে দেখে শিষ্য তখন হতাশ স্বরে গুরুকে বলেছিল, ওটি আর দয়া করে রাখলেন কেন, ওটিও খেয়ে নিন। বঙ্কিম ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ওই এক শতাংশ বাঙালি বিধবাকে আর কেন বাকি রাখলেন, একটি নতুন রায় লিখে তাতে ওই এক শতাংশকেও টেনে নিন চণ্ডীবাবু।
মূর্খ বাঙালির স্বজাতিবিদ্বেষের সংক্ষিপ্ত প্রত্যুত্তর কিভাবে দিতে হয়, বঙ্কিম এভাবে শিখিয়েছেন।
৫। যুবক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রৌঢ় বঙ্কিমের একটি বিতর্ক ঘটেছিল। বিতর্কের বিষয় ছিল সত্য। ব্রাহ্মরা সেযুগের ভিক্টোরীয় চিন্তাধারায় বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন, এবং সত্যকে একটি ধ্রুব গুণ মনে করতেন। বঙ্কিমের চিন্তা এক্ষেত্রে ছিল বৈপ্লবিকঃ তিনি বলছেন সত্য আপেক্ষিক। কথাটা অবশ্য নতুন নয়। প্রি-রোম্যান্টিক কবি উইলিয়াম ব্লেকের বড় মনোরম পংক্তি আছে এ প্রসঙ্গেঃ আ ট্রুথ টোল্ড উইদ ব্যাড ইন্টেন্ট, ইজ ওয়ার্স দ্যান অল লাইজ ইউ ক্যান ইনভেন্ট। অর্থাৎ যতগুলি মিথ্যা তুমি কল্পনা করতে পারো তাদের সবার থেকে খারাপ হল, খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে বলা একটি সত্য। প্রাচীন ভারতেও এরকম একটা নীতি ছিল। সত্য প্রকাশ করে একজন মুনিকে নরকস্থ হতে হয়েছিল, কারণ তাঁর সত্যনিষ্ঠার জন্য একজন প্রাণ হারিয়েছিল। কৃষ্ণচরিত্রে বঙ্কিম এই ঘটনাটি তুলে ধরে সত্য ও মিথ্যার আপেক্ষিক চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। আমাদের সত্য অনেকটা পুরোনো ইংরেজি শব্দ troth এর মত, বঙ্কিম বলেন। অর্থাৎ সত্য এবং truth এক নয়। একইভাবে আমরা অবশ্য জানি, ধর্ম আর religion এক নয়, যাই হোক।
এই সত্য নিয়ে বঙ্কিমকে আক্রমণ করে আদি ব্রাহ্ম সমাজ। প্রথমে বেতনভূক কৈলাস, তারপরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অবতীর্ণ হন। এ বিতর্কে বঙ্কিমকে হারাতে পারেন নি রবীন্দ্রনাথ। এবং ব্রাহ্মদের ট্রুথ কাল্ট যে ইংরেজের অন্ধ অনুকরণ, তা আমাদের দেশজ ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত, এ ঐতিহাসিক নির্ণয় করেছিলেন বঙ্কিম।
৬। এই নামটি বড় আশ্চর্যের। ঈশ্বর গুপ্ত।
আসলে, বঙ্কিম তাঁর গুরু ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর পরে কিছুটা সময় ইংরেজপ্রেমী এবং হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন। ভিক্টোরিয়ান চিন্তাভাবনা তাঁর যুগধর্ম ছিল, এবং যতদিন না এরপর তিনি তাঁর যুগযন্ত্রণা অনুভব করেন এবং শেকড়ে ফেরার উদ্যোগ নেন, এই মাঝের সময়টা তিনি ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন। শুধু ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি নয়। রাজমোহন’স ওয়াইফ গ্রন্থে দেখবেন তিনি ক্র্যাব লাইক ফিগার অভ দুর্গা এবং গ্রিম ব্ল্যাক ফিগার অভ কালী লিখেছেন। বঙ্কিম একটা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, পশ্চিমি প্রভাব আসছিল। বাদবাকি শিক্ষিত বাঙালির মত বঙ্কিমকেও গ্রাস করছিলেন মেকলে। প্রসঙ্গত, বঙ্কিম যখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলেন, প্রায় সেই সময়েই ঈশ্বর গুপ্ত মারা যান। ২৩শে জানুয়ারি ১৮৫৯। এর মাত্র বছরখানেক আগে বঙ্কিম গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন।
ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে বঙ্কিম বলেছেন, তিনি খাঁটি বাঙালি কবি ছিলেন, খাঁটি বাঙালি কবি আর জন্মায় না, জন্মানোর উপায় নেই, জন্মে কাজ নেই। শেষ বয়সে তিনি ঈশ্বর গুপ্তের লেখার সংকলন করেন, এটি তাঁর গুরুদক্ষিণা ছিল সম্ভবত। কিন্তু মাঝের সময়টায়? বঙ্কিম তাঁর একটি ইংরেজি প্রবন্ধে ঝাঁজালো ভাষায় স্বর্গত একদা-গুরুকে আখ্যা দিয়েছেন অনৈতিক, অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। ঈশ্বর বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানতেন না, সেজন্যও সমালোচনা করেছেন। ঈশ্বরের মতামত ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং সংকীর্ণ। কবির যে উচ্চতর গুণ থাকা উচিত তার কিছুই ছিল না। ভাষা ছিল অভদ্র, কৃষ্টিবিহীন। মোটা দাগের অশ্লীলতা ছিল তাঁর লেখা কবিতায়। সৌভাগ্যের কথা কবি ঈশ্বর গুপ্ত দ্রুত বিস্মৃত হচ্ছেন, বঙ্কিম লিখেছেন।
ভিক্টোরিয়ান বঙ্কিমকে এখানে খুঁজে পাচ্ছি আমরা। প্রৌঢ় বয়সে বঙ্কিমকৃত ঈশ্বর গুপ্ত রচনা সংকলনের ভূমিকা দেখলে বোঝা যায়, বঙ্কিম তাঁর মতামত অনেকাংশে পাল্টেছেন। পরিণত বঙ্কিমের লেখা ঈশ্বর গুপ্ত-অনুরাগী ভূমিকা বহুলপ্রচারিত, ইংরেজিতে যুবক বঙ্কিমের ঈশ্বর-বিদ্রোহ আমরা ভুলে গেছি। বঙ্কিম ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শুরু করেছেন। পশ্চিমি এনলাইটেনমেন্ট হয়ে, মেকলে হয়ে তবে পুনরায় ফিরেছেন ঈশ্বরে। এঁকে বলে ফুল সার্কল।
৭। ইংরেজ। আজকের আলোচনায় শেষ বঙ্কিম সঙ্ঘর্ষ।

আনন্দমঠ লিখে বঙ্কিম ইংরেজের বিষদৃষ্টিতে পড়েন, এবং এজন্য প্রথম সংস্করণের ইংরাজ-ভাঙিতেছে-চলো-আক্রমণ-করি পালটে গিয়ে নেড়ে-ভাঙিতেছে-চলো-আক্রমণ -করি হয়ে যায়। এই উপন্যাস লেখার ফলে বঙ্কিমের ডিমোশন হয়েছিল চাকরিতে, বারবার অপমানজনক ও শাস্তিমূলক বদলি শুরু হয়। আনন্দমঠ যে ইংরেজের বিরুদ্ধে লেখা নয়, এই মর্মে একটি শংসাপত্র যোগাড় করতে বাধ্য হন কেশব সেনের ভাইয়ের কাছ থেকে (সেযুগের ভারতীয়দের মধ্যে কেশব সেন সবথেকে বেশি ইংরেজের আস্থাভাজন ছিলেন)। কিন্তু ইংরেজের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ শুধু আনন্দমঠে হয়নি। ইংরেজের বিরুদ্ধে ও ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বঙ্কিমের লেখা বারবার লড়াই করেছে। এশিয়াটিক রিসার্চের নামে সাহেবদের কাণ্ডকারখানার বহু সমালোচনা তিনি করেছেন। ইংরেজের নীতি ছিল বাঙালির মধ্যে বিশ্বমানবতা ও স্বজাতিবিদ্বেষ তৈরি করা (আজও আমাদের শিক্ষানীতি সেটাই করছে বাস্তবিকপক্ষে), বঙ্কিম তার বিরুদ্ধে বারবার লেখনী ধরেছেন। চাকুরিজীবনে ইংরেজের দ্বারা বহুবার অপমানিত হয়েছেন বঙ্কিম, সেজন্যই রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, তিনি ইংরেজের জুতোর চোটে বেঁকে গেছেন। বঙ্কিম কম্প্রাদর শ্রেণী থেকে এসেছিলেন। তাঁর বাবাও ইংরেজের কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম যে স্বজাতির পক্ষ বেছে নিলেন, তাতে তাঁর শ্রেণীগত অবস্থানের সঙ্গে তাঁর আদর্শগত অবস্থানের একটা যুদ্ধ হয়, সে যুদ্ধের ফল তাঁর মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়ে মৃত্যু।

বঙ্কিম দীর্ঘজীবী হোন। তাঁকে পাঠ করার প্রয়াস আমি এবং আমরা জারি রাখব।

© তমাল দাশগুপ্ত

আমার একটি ইংরেজি প্রবন্ধ আছে যথাক্রমে বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের পৃথক পৃথক সাতটি আদর্শযুদ্ধ নিয়ে, সেটা জার্নাল অভ বেঙ্গলি স্টাডিজে প্রকাশিত হয়েছিল, এই লিঙ্কে গিয়ে পড়তে পারেন https://bengalistudies.blogspot.com/2018/03/jbs-vol-6-no-1-age-of-bhadralok-bengals.html

ছবিঋণ ঋতু

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৫ই মার্চ, ২০২০

বঙ্কিম: ফিরে দেখা, এগিয়ে চলা – তমাল দাশগুপ্ত

২০১৩ সালের ছাব্বিশে জুন তারিখে বঙ্কিমের বয়েস হয়েছিল ১৭৫ বছর। সপ্তডিঙা তখনও পরিকল্পনার স্তরে, পত্রিকা প্রকাশিত হবে এবং সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন হবে আরও দুবছর পরে। সেইসময় সেই প্রোটো-সপ্তডিঙার পক্ষ থেকে কলকাতায় অ্যাকাডেমি অভ ফাইন আর্টসের কনফারেন্স হলে একটি সভা আয়োজিত হয়েছিল, বঙ্কিমঃ ফিরে দেখা, এগিয়ে চলা। আমাদের জানামতে বঙ্কিমের ১৭৫ বার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করার কাজ হয়নি বাংলায়। কেউ করেনি। বিজেপি তৃণমূল লিটল ম্যাগাজিন রাবীন্দ্রিক আনন্দবাজার গ্রুপ থিয়েটার এন জি ও – কেউ না।

সেই অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এই বার্তাটি লিখেছিলাম।

বঙ্কিমঃ ফিরে দেখা, এগিয়ে চলা

তমাল দাশগুপ্ত

বঙ্কিমকে নতুন করে না পড়লে বাঙালিরই লোকসান। বাঙালি সত্ত্বার আবাহন করেছিলেন বঙ্কিম, ওঁকে ছাড়া বোধহয় বাঙালি পরিচয়ের সংজ্ঞা খোঁজা যায় না। অগ্নিযুগ নিয়ে আমরা জার্নাল অভ বেঙ্গলি স্টাডিজ এর প্রথম সংখ্যাটা যখন প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, সেটা ২০১১ সালের শেষের দিক, বাংলার বিপ্লবীদের ওপরে কিছুটা পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল, প্রাইমারি ও সেকন্ডারি দু-রকমেরই (অর্থাৎ বিপ্লবীদের নিজেদের লেখা, এবং বিপ্লবীদের সম্পর্কিত অন্যান্য লেখাপত্র), এবং একটা বিষয় বার বার উঠে এসেছিলঃ বঙ্কিম বাংলার বিপ্লববাদের জনক, জাতীয়তাবাদেরও জনক। এবং সেই বিপ্লববাদকে জাতীয়তাবাদ থেকে আলাদা করা যায় না, সেই জাতীয়তাবাদকেও বিপ্লববাদ থেকে আলাদা করা যায় না।
মার্ক্সীয় চিন্তাবিদ টেরি ইগলটন একজন আইরিশ জাতীয়তাবাদী এবং ক্রিশ্চান তাত্ত্বিক। তিনি তাঁর আলোচনায় মার্ক্সবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও খ্রীষ্টধর্ম মিলিয়েছেন, এবং সেজন্য ইউরোপীয় মার্ক্সবাদীরা তার মুণ্ডুপাত করেন না। ভারতে কোনও মার্ক্সবাদী অবশ্য বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ (রেভলিউশনারি ন্যাশনালিজম, যার সম্পর্কে ইগলটন বলে থাকেন যে বিংশ শতকে সাড়া পৃথিবী জুড়ে মানবমুক্তি ঘটানোর পেছনে সবথেকে বেশি অবদান এই রাজনৈতিক আন্দোলনেরই) নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাবেন না। ভারতের কমিউনিস্টরা আসলে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনকে ব্রিটিশ জেলের মধ্যে সাবভার্ট করে, ব্রিটিশের হাত মজবুত করে উঠেছিলেন, তাই সে আন্দোলন নিয়ে ভারতের মার্ক্সবাদীরা উচ্চবাচ্য করবেন না, তাতে আর আশ্চর্য কি। আর বঙ্কিম থেকে তো এরা শতহাত দূরে থাকেন।
বঙ্কিম লিখছেন হিন্দুধর্মের কথা, তিনি বাঙালির ইতিহাস চেয়েছেন, তিনি বাঙালি জাতির রূপরেখা খুঁজেছেন তার জনসংস্কৃতিতে, তার মহাকাব্যে, তার পুরাণে। তিনি বন্দে মাতরম দিয়েছেন, ধর্মতত্ত্ব দিয়েছেন, সাম্য দিয়েছেন। কৃষ্ণচরিত্র লিখেছেন, কমলাকান্তের দপ্তর লিখেছেন, মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত লিখেছেন। বাংলা উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন, এবং আজ পর্যন্ত তিনি ছাড়া বাংলা সাহিত্যে বোধহয় আর কোনও আদর্শ নেই, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যেমনটা এক সময় বলেছিলেন। এ-হেন যুগনায়কের ১৭৫-তম জন্মবার্ষিকীতে এ দেশে যা হওয়ার কথা ছিল, তার সামান্য ভগ্নাংশও কলকাতায় কি বাংলায় হচ্ছে না। বাঙালিরই ভগ্নদশা, কি আর করা!
সপ্তডিঙা সবে পথ চলতে শুরু করেছে। বঙ্কিমের নাম নিয়ে যাত্রা শুরু হল।

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৯