চৈতন্যসম্ভব – তমাল দাশগুপ্ত

চৈতন্যসম্ভব।

বলা হয়, চৈতন্যের দীর্ঘকাল গর্ভবাস হয়েছিল। সে কাহিনীটি প্রায় অলৌকিক, তিনি নাকি শচীমাতার জঠরে ত্রয়োদশ মাস অতিবাহিত করেন, অমিয় নিমাই চরিত জানাচ্ছে। আমি বলতে চাই বাঙালির ইতিহাস চৈতন্যসম্ভবের জন্য প্রায় পাঁচশো বছর ধরে অপেক্ষারত ছিল, সেই পালযুগে সহজযানের উত্থানের সময় থেকেই। চৈতন্যসম্ভব গৌড়ের ইতিহাসজননীর এক সুদীর্ঘ gestation-এর ফসল। বাঙালির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মধ্যযুগের অমারাতে বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হয়ে চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল। চৈতন্য আবির্ভাব বাঙালির ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রভা। বাঙালির নিয়তি দ্বারা পূর্বনির্ধারিত ছিলেন চৈতন্য, এই জাতি গৌরচন্দ্রের অপেক্ষায় ছিল, গোরারায়ের আবাহনে সদানিষ্ঠ ছিল। আমি সামান্য মানুষ, আমি সাতদিন ধরে বাঙালির সপ্তসম্ভব লেখার ব্রতে ব্রতী হয়েছিলাম, আজ চৈতন্যসম্ভব লিখে আমার ব্রত শেষ করব।

মিত্ররা হ্লাদিত হোন, শত্রুরা তটস্থ হোন, আর পূর্বমানুষরা আমায় আশীর্বাদ করুন। মা কালী আমার দুর্বল লেখনীকে শক্তি দিন, চৈতন্যনামে অশ্রুসিক্ত বাষ্পাচ্ছন্ন আমার দুই নয়নে রাধারাণী দৃষ্টি হয়ে অবতীর্ণ হোন, নতুবা এ কাজে তো আমার সাধ্য হয় না।

চৈতন্যর মধ্যে বিপ্লবী খুঁজে পায় জনআন্দোলনের জয়ধ্বনি আর রক্ষণশীল খুঁজে পায় আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শিখর। নাস্তিক এই আন্দোলনে মানব অস্তিত্বের অবলম্বন খুঁজে পায় আর আস্তিক এই আন্দোলনে পায় ঈশ্বরের বিভূতি। একাধিক কমিউনিস্ট নেতা চৈতন্যর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন গৌড়বঙ্গের প্রথম কমিউনিস্ট, আর গান্ধী স্বয়ং চৈতন্য আন্দোলনে খুঁজে পেয়েছিলেন মধ্যযুগের প্রথম অহিংস আন্দোলনের নজির। চৈতন্যস্মরণে রত হন যুক্তিবাদী থেকে ভাববাদী, লিটল ম্যাগ থেকে আনন্দবাজার, কফি হাউজ থেকে বটতলা, পণ্ডিত থেকে অজ্ঞ। তাঁর নামে ভজ গৌরাঙ্গ বলে উদ্বাহু নৃত্য করেছে সাহেব, আর অতীতে সাহেব তাড়িয়ে ভারত স্বাধীন করতে যাওয়া আত্মঘাতী বাঙালি জঙ্গী। ব্রাহ্মণ আর চণ্ডাল এই চৈতন্য আন্দোলনে পরস্পরের হাত ধরে নৃত্য করেছে। চৈতন্যের নামে এই আন্দোলনে কবির সঙ্গে অকবির আঁতাত হয়, কেজোর সঙ্গে অকেজোর মিত্রতা হয়। এই আন্দোলন সমস্ত গৌড়বঙ্গীয়ের মহামিলনমেলা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির অভিজ্ঞান।

যে নবদ্বীপে চৈতন্য অবতীর্ণ, সে নবদ্বীপ তখন ভারতশ্রেষ্ঠ, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সারস্বত পীঠস্থান। জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনচর্চায় নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য ছিল। মধ্যযুগের অন্ধকারে নবদ্বীপের এই সুতীব্র আলোকচ্ছটাকে বঙ্কিম বাঙালির প্রথম রেনেসাঁস আখ্যা দিয়েছিলেন।

“আমাদিগেরও একবার সেই দিন হইয়াছিল। অকস্মাৎ নবদ্বীপে চৈতন্যচন্দ্রোদয়;  তার পর রূপসনাতন প্রভৃতি অসংখ্য কবি ধৰ্ম্মতত্ত্ববিৎ পন্ডিত। এ দিকে দর্শনে রঘুনাথ শিরোমণি,  গদাধর,  জগদীশ; স্মৃতিতে রঘুনন্দন, এবং তৎপরগামিগণ। আবার বাঙ্গালা কাব্যের জলোচ্ছ্বাস। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, চৈতন্যের পূর্বগামী। কিন্তু তাহার পরে চৈতন্যের পরবর্ত্তিনী যে বাঙ্গালা কৃষ্ণবিষয়িণী কবিতা, তাহা অপরিমেয় তেজস্বিনী, জগতে অতুলনীয়া; সে কোথা হইতে ? আমাদের এই Renaissance কোথা হইতে ? কোথা হইতে সহসা এই জাতির এই মানসিক উদ্দীপ্তি হইল?”

সেযুগের ভারতে বাসুদেব সার্বভৌম বোধকরি শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত-দার্শনিক-নৈয়ায়িক, পরে ইনি পুরীতে চলে যান। নীলাচলে মহাপ্রভুর আগমনের জমি প্রস্তুত হয়েছিল এতদ্বারা। বাসুদেব রচিত এই বিখ্যাত শ্লোকটি রমাকান্ত চক্রবর্তীর বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মে উদ্ধৃতঃ

“কণাদের দর্শন পড়েছি। ন্যায়শাস্ত্র আমার জানা আছে। মীমাংসাও জানি। জানি সাংখ্য। যোগশাস্ত্রের সঙ্গেও পরিচয় আছে। যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে বেদান্তের চর্চা করেছি। এ সবের কোনওটাই আমার মনকে তেমনভাবে টানে না, যেমন টানে কোনও এক নন্দের ছেলের বাঁশরীর মাধুরী ধারা”।

চৈতন্য আন্দোলন পাণ্ডিত্যের বিরোধী নয়, কিন্তু অবভাস প্রশ্রয় দেয় না। চৈতন্যর ভক্তি আন্দোলন ঋজু ও স্পষ্টবক্তা, সেজন্য নব্যন্যায়ের দাঁতভাঙা পাণ্ডিত্যকে পাষণ্ডী আখ্যা দেওয়া হয় এই আন্দোলনে (রমাকান্ত চক্রবর্তী)। চৈতন্য আন্দোলন জ্ঞানমার্গের বিরোধী নয়, তবে সহজিয়া লোকায়ত চেতনা বরাবরই জ্ঞানমার্গের নামে অবভাসের যথেচ্ছাচারের বিরোধী। কারণ চৈতন্যর উত্থান বাঙালির মধ্যযুগের প্রথম জন আন্দোলন, আর অবভাসের প্রধান উদ্দেশ্য গণমানুষকে বিভ্রান্ত করা।

চৈতন্য আন্দোলন বনমালীর পরজন্মে রাধা হওয়ার আন্দোলনও বটে। সেজন্য এ আন্দোলন পুরুষতান্ত্রিকতাকে সমূলে আঘাত করে। সহজিয়া সাম্যের চেতনা শুধু তাত্ত্বিক স্তরে নয়, ব্যবহারিক স্তরেও ছিল। অসংখ্য নারী, অসংখ্য অব্রাহ্মণ গুরুপদে আসীন হয়েছেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনে, এ আন্দোলনের মধ্যে স্থানে স্থানে (উদাহরণস্বরূপ অদ্বৈত অনুগামীদের) ব্রাহ্মন্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক ঝোঁক সত্ত্বেও। একটি বহুল প্রচলিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী চৈতন্যের ৪৯০ জন পরিকরের মধ্যে ২৩৯ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ, ৩৭ জন বৈদ্য (প্রসঙ্গত চৈতন্যের দীক্ষাগুরু ঈশ্বরপুরী এবং চৈতন্যের প্রথম জীবনীকার, চৈতন্যপরিকর মুরারিগুপ্ত, দুজনেই জাতিতে বৈদ্য), ২৯ জন কায়স্থ, ১৬ জন স্ত্রীলোক ও ২ জন মুসলমান। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি তথাকথিত অব্রাহ্মণ। নিত্যানন্দের সময় থেকে সহজিয়ারা বৈষ্ণব আন্দোলনের অংশীদার হয়েছিলেন, তাঁদেরকেই জাত বোষ্টম বলা হয়, কারণ তাঁরা সহজিয়া ছিলেন বলে জাতপাত মানতেন না, ফলে জাতপরিচয় ছিল না। এ কথা অনস্বীকার্য যে সমাজে যাঁরা আউটকাস্ট, তাঁদের দৃঢ়ভাবে একসূত্রে গ্রন্থিত করেছিল বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলন।

স্মর্তব্য, তন্ত্রও জাত মানে না। এটিই বাঙালির বিপ্লবী অর্থোডক্সি, বাঙালির বিপ্লবী হেজিমনি, বাঙালির শক্তিকেন্দ্রর আদর্শ।

এইভাবে চৈতন্য আন্দোলন বাঙালির সমাজজীবনে বিপ্লবী অর্থোডক্সির সেলিব্রেশন। এটি প্রান্তিক আন্দোলন নয়, গৌণ নয়, এটি কেন্দ্রীয় এবং অর্থোডক্স, এবং আর্যাবর্তের কেন্দ্রে বৃন্দাবনে বাঙালি বৈষ্ণবরা যে ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন চৈতন্য আন্দোলনে, তা বাঙালির প্রাচীন সাম্রাজ্যস্মৃতিরই অভিনব স্থাপনা, যেভাবে বাঙালির চিরাচরিত উপনিবেশ উৎকলে চৈতন্য আন্দোলন পুনরায় বাঙালির নেতৃত্বকে আধ্যাত্মিক কাঠামোয় পুনর্নিমাণ করেছে।

বিমানবিহারী মজুমদার একটি চিত্তাকর্ষক তথ্য দিয়ে বলছেন, রামমোহনই বাঙালির আধুনিকযুগে প্রথম চৈতন্যবিরোধিতার ডাক দিয়েছিলেন তাঁর লেখায়। হ্যাঁ, রামমোহন সম্পর্কে অধুনা বিস্মৃত একটি তথ্য হল তিনি চৈতন্যবিরোধী ছিলেন। তবে অদূর ভবিষ্যতে সেই রামমোহনের ব্রাহ্ম আন্দোলনেই চৈতন্যপ্রভাব এসে গেল। ব্রহ্মানন্দ কেশব সেন চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের আদর্শ গ্রহণ করলেন আর পূজ্যপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, তিনি তাঁর পূর্বজ অদ্বৈতকে স্মরণ করে চৈতন্যয় ফিরলেন। বিমানবিহারী বলছেন গৌড়বঙ্গে চৈতন্যবিরোধিতার কোনও স্থায়ী ধারা নেই, মাঝেমধ্যে বৃথা চেষ্টা ইতস্তত যা ছড়িয়ে আছে, তা যে কোনও চৈতন্যজীবনীকার অবহেলায় অবজ্ঞা করবেন, কারণ সারবস্তুবিহীন ও অকিঞ্চিৎকর। আশা করা যায় আজ যে চৈতন্যবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদীদের ইতিউতি দেখা মেলে, সেই মূঢ়মতিরাও ভবিষ্যতে চৈতন্যে প্রত্যাবর্তন করবে।

আমাদের বাঙালিদের আদিতে, উৎসবিন্দুতে, আমাদের শেকড়ে প্রকৃতি-উপাসক একটি ধর্ম আছে, তন্ত্র ধর্ম, যার শুরুটা সম্ভবত হরপ্পা সভ্যতায়, পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে মাতৃকা-উপাসকদের সভ্যতার প্রত্নচিহ্নও তন্ত্রাশ্রয়ী সাক্ষ্য দিচ্ছে। আদিবিদ্বান কপিলের রচিত আদি সাংখ্য। অনেকে মনে করেন আদি সাংখ্য প্রকৃতিপ্রধান ধর্ম ছিল, এবং অবৈদিক ব্রাত্য আর্য, যাঁরা আমাদের পূর্বজ, যাঁদের আউটার এরিয়ান বলা হয়, তাঁদের ধর্মীয় দর্শনের প্রথম উন্নত কাঠামো কপিলের তত্ত্বে প্রকাশিত। এরকম অনুমানের পেছনে একাধিক যুক্তি আছে, সে আলোচনার স্থান আজ নয়। তো এরপর ধ্রুপদী সাংখ্য পুরুষের ধারণা আনল, এবং প্রকৃতি থেকে পুরুষের বিচ্ছিন্নতার আদর্শ তুলে ধরল (উচ্ছিত্তি, একেই থেরবাদী বৌদ্ধধর্মে মোক্ষ বলে)।

এই ধ্রুপদী সাংখ্য থেকে বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক-সহ অনেকগুলি ধর্ম তৈরি হয়েছে, এবং ভারতের হিন্দুধর্মও মোটের ওপর সাংখ্যাশ্রিত। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের পুনর্মিলন ঘটানোর জন্য বাঙালির/পূর্বভারতের ইতিহাস বহুদিন ধরে ষড়যন্ত্র করে এসেছেন। গঙ্গালদের উত্থান, অথবা গুপ্তপরবর্তীকালে জয়নাগ-শশাঙ্কর উত্থান একটা দীর্ঘ প্রিলিউড। পালযুগে যে বজ্র থেকে সহজ তৈরি হবে, এবং তারপর আদি বাংলা ভাষায় রাধা-কৃষ্ণের সহজিয়া লোকায়ত প্রেমের প্রচলিত জনপ্রিয় কাহিনী (কৃষ্ণধামালী নামে একরকম গানের প্রচলন ছিল) – সেখান থেকে সেনযুগে কবি জয়দেব তাঁর অমর কাব্য গীতগোবিন্দ রচনা করবেন, যা একাধারে পদাবলীসঙ্গীত, মঙ্গলকাব্য এবং রাধাকৃষ্ণযাত্রা, তার একটা সমসাময়িক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তো ছিলই, কিন্তু ইতিহাসের এই দীর্ঘ চাহিদাটিকেও অস্বীকার করা যায় না। প্রকৃতিকে দেহি পদপল্লবমুদারম বলার জন্য পুরুষ দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষারত ছিল বাঙালির ইতিহাসে। জয়দেব এসে তাঁর কৃষ্ণকে দিয়ে বলালেন রাধার প্রতি। প্রকৃতির পায়ের তলায় শুয়ে পড়ার জন্য পুরুষ দীর্ঘদিন ধরেই অপেক্ষা করছিল বাঙালির ইতিহাসে, পালযুগে চামুণ্ডা মূর্তিতে সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছিল।

কেননা আমরা মাতৃকা-উপাসক জাতি। তন্ত্রের প্রকৃতি-উপাসনায় এ জাতি সংজ্ঞায়িত হয়। প্রগতির একটা অর্থ নাকি অতীতের দিকে ফেরা। রেভলিউশন মানেও অবশ্য তাই। আবর্তন। সম্ভবত শেকড়ে ফেরার থেকে বড় বিপ্লব আর নেই। চৈতন্যসম্ভব বাঙালির সবথেকে বড় বিপ্লব।

১৪০৭ শকে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে চৈতন্যের জন্ম (বঙ্গাব্দের ব্যাপক প্রচলন সেযুগে ছিল না, সমস্ত চৈতন্যজীবনী শকেই তারিখের বিবরণ দেয়)। তাঁর জন্মের পরেই চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল, কথিত আছে। বৈষ্ণব কবিরা বড় চমৎকার বর্ণনা দেনঃ  নবদ্বীপে গৌরচন্দ্র উদিত হয়েছেন, অতএব আকাশে আর চন্দ্রের কি প্রয়োজন, এই বলে রাহু চন্দ্রকে গ্রাস করেছিল। ইংরেজি হিসেবে (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার) ২৭শে ফেব্রুয়ারি, ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দ। তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র শ্রীহট্ট থেকে এসেছিলেন নবদ্বীপে। প্রসঙ্গত অদ্বৈত নিজেও শ্রীহট্ট থেকেই নবদ্বীপে আসেন। শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে আসা একটি বৈষ্ণবগোষ্ঠী সক্রিয় ছিল, এঁদের বৈষ্ণব হওয়ার ইতিহাসে চৈতন্যের গুরুর গুরু (অর্থাৎ ঈশ্বর পুরীর গুরু) মাধবেন্দ্র পুরীর একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয় (রমাকান্ত চক্রবর্তী)। চৈতন্য তিরোধান নিয়ে আমি দীর্ঘদিন লেখালেখি করেছি, সে নিয়ে আজ কিছু লিখব না। তিনি সাতচল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন, ১৪৫৫ শকের আষাঢ়ে শুক্লা সপ্তমী তিথি (গৌড়ীয় মত), অথবা বৈশাখে অক্ষয় তৃতীয়া তিথি (ঔড্র মত) তাঁর তিরোধান দিবস। ইংরেজি হিসেবে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ।

চৈতন্য যে সময় এসেছিলেন আমাদের মধ্যে, সেই মধ্যযুগে বাংলার হিন্দু নির্যাতিত, ছত্রভঙ্গ। নবদ্বীপে নেতৃত্ব করছে, শাসন করছে জগাই মাধাই। হিন্দুধর্মের নাম করে যে রক্ষণশীল সমাজপতিরা আধিপত্য করছেন তাঁরা অনেকেই বিজাতীয় শক্তির দালাল। কাজির বিচারে বাঙালির প্রাণ ওষ্ঠাগত। গৌড়ে একের পর এক হাবসি বসছে সিংহাসনে, কিছুদিন রাজত্ব করছে, তারপর তাকে মেরে আরেকজন সিংহাসনে। এর মাঝখানে রটল, নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ রাজা হবে। রাজা গণেশের স্মৃতি তখনও অমলিন, গণেশ চৈতন্যজন্মের সত্তর বছর আগে গৌড় শাসন করে গেছেন। গণেশের মন্ত্রী নরসিংহ নাড়িয়াল ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের পূর্বপুরুষ। কাজেই নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ রাজা হওয়ার আশঙ্কা নেহাত আজগুবি ছিল না। ফলে নবদ্বীপ উজাড় হয়ে গেল সুলতানি সৈন্যের আক্রমণে। বাসুদেব সার্বভৌম এইসময়েই উৎকল চলে যান। বৈষ্ণব কবি জয়ানন্দ লিখছেন, এ অত্যাচারে নবদ্বীপ উৎসন্নে যাচ্ছিল, অবশেষে মা কালী সুলতানের স্বপ্নে এসে চুলের মুঠি ধরে নাকে কানে গরম তেল ঢেলে দিয়ে সুলতানকে ভয়াবহ পরিণতির জন্য সতর্ক করলেন। এভাবে গৌড়ের সুলতানের দুঃস্বপ্নে এসে মা কালী বাঙালির দুঃস্বপ্নের রাত শেষ করেছিলেন। এভাবে মা কালী রাধারাণীর উত্থানের পথ সুগম করেছিলেন, এভাবে বাংলায় শাক্ত ও বৈষ্ণব এক হয়ে গিয়েছিল চৈতন্যসম্ভবে। কাজিদলনের একটি টেমপ্লেট চৈতন্যসম্ভবে এইভাবে মিশে রয়েছে।

প্রাণের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল। তুহিন মুখোপাধ্যায়ের লোকায়ত শ্রীচৈতন্য দ্রষ্টব্যঃ চৈতন্যের সারা জীবন ধরেই দেখি, গৌড় জুড়ে হিন্দুনির্যাতন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। চৈতন্য বাংলা ত্যাগ করেছিলেন তাঁর ওপর হুসেন শাহের আক্রমণের আশঙ্কা ছিল বলে। এইভাবে বাঙালির অন্ধকার সময়ে চৈতন্য আন্দোলন, তার দর্শন, তার সংগঠন, তার নামসঙ্কীর্তন, সর্বোপরি তার প্রতিস্পর্ধা মহাদীপাবলির আলোকমালার মত এসেছিল।

রাধা হলেন প্রকৃতিস্বরূপা। চৈতন্য আন্দোলন রাধাকেন্দ্রিক। বাঙালির বৈষ্ণব ধর্মে রাধাধারণার সর্বোচ্চ গুরুত্ব। প্রকৃতি-পুরুষের এই তান্ত্রিক ধর্মে প্রতিস্পর্ধী অবধূত নিত্যানন্দও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তিনিই বৈষ্ণব আন্দোলনের মূল সংগঠক, তাঁর দ্বাদশ গোপাল ও তাঁদের শ্রীপাট আজও বাঙালির বৈষ্ণব ধর্মে নেতৃত্ব দেয়। অপর দিকে যবন হরিদাস যখন বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত, তিনিও এই চৈতন্যসম্ভবের পটভূমিকা রচনা করে যান।

বৈষ্ণব আন্দোলন প্রায়শ আউটকাস্টদের ক্ষমতায়ন, ক্ষতবিক্ষত মানুষদের শুশ্রূষালয়, আহত মানবসত্তার বাস্তব আশ্রয়। সেটাই অবশ্য ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য, মার্ক্সের ভাষায়ঃ আত্মাহীন জগতের আত্মা, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, নির্যাতিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, জনতার ওষুধ। ঐহিক আবিলতা থেকে উত্তরণ চাইছিলেন যারা, যাঁরা অন্যরকম মানুষ, যাঁরা বিপ্লবী, ভূতগ্রস্ত, তাঁদের অনেক দীর্ঘশ্বাস মন্থন করে এই চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল। রমাকান্ত  চক্রবর্তী একজন বৈষ্ণব কবির গভীর আর্তনাদ উদ্ধৃত করেছেনঃ

“নীতিবাগীশদের মতে আমি মোহগ্রস্ত। বেদবাদীদের মতে আমি ভ্রান্ত। বন্ধুদের বিচারে আমি বাজে লোক। আমাকে বোকা ভেবে আমার ভাইরা আমাকে ভালবাসে না। ধনীদের ধারণা আমি পাগল। বিবেকী লোকদের মতে আমি দাম্ভিক…”

বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া, সত্যেন দত্ত যথার্থই বলেছিলেন। তবে বাঙালির অসীম বেদনা মন্থন করেও চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল। আর্যাবর্তের হাতে আক্রান্ত; ইসলামের হাতে আক্রান্ত; পুরুষতান্ত্রিকতার হাতে আক্রান্ত; বিস্মৃতির হাতে আক্রান্ত; নালন্দা বিক্রমশীলা পুড়ে যাওয়ার আগুনে আক্রান্ত; মধ্যযুগের অনিবার্য মহাঝঞ্ঝায় আক্রান্ত বাঙালির বেদনা, বাঙালির ক্রমশঃ কোনঠাসা হয়ে যাওয়ার বেদনা; এভাবে অনেক বেদনার বারুদ একসঙ্গে জমে চৈতন্য বিস্ফোরণ ঘটেছিল।

সবশেষে, সাংখ্য-আশ্রিত গীতার সেই শ্লোক পুনর্বার স্মরণ করি

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত । অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥ পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ । ধর্মসংস্থাপনার্থায় #সম্ভবামি যুগে যুগে ॥

জয় গৌর, জয় নিতাই! জয় গৌড়, জয় বঙ্গ!

© তমাল দাশগুপ্ত

বঙ্কিম কি কার্ল মার্ক্সকে চিঠি লিখেছিলেন? – তমাল দাশগুপ্ত

বঙ্কিম কি কার্ল মার্ক্সকে চিঠি লিখেছিলেন?

কলকাতা থেকে একটা চিঠি গেছিল প্রথম আন্তর্জাতিকে। মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের উপস্থিতিতে ১৮৭১ সালের ১৫ই আগস্ট সে চিঠিটি পাঠ করা হয়। কলকাতা থেকে পত্রলেখক অনুমতি চেয়েছিলেন প্রথম আন্তর্জাতিকের কলকাতা শাখা তৈরি করার জন্য। সে চিঠিতে বলা হয়েছিলঃ

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। অত্যধিক কর আদায় করা হচ্ছে, সে সম্পদ ব্যবহার করা হচ্ছে খুবই খরচসাপেক্ষ একটা আমলাতন্ত্রের পেছনে। শাসকশ্রেণীর সম্পদের বাড়াবাড়ির সঙ্গে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার পার্থক্য অসহনীয়। আন্তর্জাতিকের আদর্শ এই অবস্থায় কলকাতার সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হবে যদি এখানে একটি শাখা খোলা হয়…

চিন্মোহন সেহানবিশ একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করেছিলেন, যে এই চিঠিটি কে পাঠিয়ে থাকতে পারেন। এই তালিকায় বঙ্কিম আছেন প্রথমেই, কারণ বঙ্কিমের সাম্য প্রবন্ধে (১৮৭৯) প্রথম আন্তর্জাতিকের উল্লেখ আছে। এছাড়া জেমস লং (ইংরেজ সরকার ১৮৬১ সালে তাঁকে নীল দর্পণ অনুবাদের দায়ে জেল খাটিয়েছিল), কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ Lobbe (ইনি পজিটিভিস্ট, এবং ১৮৭১-এর পারী কমিউনের সমর্থক ছিলেন), কেশব চন্দ্র সেন (১৮৭১ সালের আগস্ট মাসে অমৃতবাজার পত্রিকা একটি প্রতিবেদনে জানাচ্ছে যে কলকাতার কিছু বিশিষ্ট নাগরিক একটি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন। এরপর ১৮৭২ সালে অমৃতবাজার পুনরায় জানায় যে ১৮৭০ সালে কেশব যখন বিলেত যান, তখন সেখানকার কিছু চিন্তাবিদ তাঁকে কলকাতায় একটি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করার পরামর্শ দেন), শিবনাথ শাস্ত্রী এবং শশিপদ ব্যানার্জি (এঁরা ১৮৭৪ সালে শ্রমজীবী সমিতি তৈরি করেন, এবং উপমহাদেশের প্রথম শ্রমিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ওই বছরের মে মাসে, যেখানে শিবনাথের “শ্রমজীবী” নামে কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, সে কবিতাটির বক্তব্য অনেকাংশে মিলে যায় আন্তর্জাতিক/ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের সঙ্গে)।

চিঠিটি কে লিখেছিলেন, সে প্রশ্নে চিন্মোহনবাবুর ভোট শিবনাথ এবং শশিপদের দিকেই।

কিন্তু চিন্মোহনবাবুর সম্ভাব্য তালিকায় এমন কয়েকজনের নাম নেই, যেগুলো থাকা উচিত ছিল। এঁরাও ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনালে চিঠি লিখে থাকতে পারেন। রাধানাথ শিকদার যেমন। হরিশ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় ১৮৫৮ সালে রাধানাথ শিকদার একটা প্রবন্ধ লেখেন, তাতে সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট ভাবনার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম আন্তর্জাতিক তৈরি হয়নি তখনও, ১৮৬৪ সালে তৈরি হবে। তবে মার্ক্স এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে সেযুগের বাঙালির পরিচয় ছিল মনে করা যায়। জনৈক যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ১৮৮২ সালে একটি বাংলা প্রবন্ধে মার্ক্সের কথা লিখেছেন। ১৯০৩ সালে অমৃতবাজার পত্রিকা একটি প্রবন্ধে মার্ক্সের উল্লেখ করছে (রাইজ অভ ফরেন সোশ্যালিস্টসঃ দেয়ার রিমার্কেবল গ্রোথ ইন দ্য কন্টিনেন্ট ইন রিসেন্ট ইয়ার্স)।

বঙ্কিমের কমলাকান্তের বেড়ালের কথাগুলো বেশ সোশ্যালিস্টিক ছিল। ওদিকে অরবিন্দের লেখায় পাওয়া যায় প্রোলেটারিয়েটের উল্লেখ, বিবেকানন্দের লেখাতেও আছে। উৎপল দত্ত তাঁর বই গিরিশ মানসে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আন্দোলনের একটি মার্ক্সীয় পুনর্মূল্যায়ন করেছেন, সেটা বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসকে যাঁরাই বিশ্লেষণ করেন সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য মনে করি। তাতে উৎপল বলছেন, মার্ক্সের যে কথাটা বহুল প্রচারিত, যে ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম, সেটা পুরোটা উদ্ধৃত করলে দেখা যাবে, মার্ক্স ধর্ম সম্পর্কে ওরকম একদেশদর্শী কথা বলেন নি, তিনি ধর্মকে বস্তুবাদী ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বুঝেছেন, এবং ধর্মের যে একটা anagesic annodyne anaesthetic ভূমিকা আছে, এবং ধর্ম যে একটা আশ্রয়; আত্মাহীন, হৃদয়হীন এই জগতে ধর্মের ভূমিকা যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তা যে মানব অস্তিত্বকে ধারণ করে রাখে (ভারতীয় ঐতিহ্যেও তাই বলে), সেটা মার্ক্সের সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিকে তুলে ধরলে বেরিয়ে আসছে। আমি এর আগে এটা নিয়ে লিখেছি, এই পেজে স্ক্রোল ডাউন করলে পাবেন।

পশ্চিমের বস্তুবাদের সঙ্গে বাঙালির শেকড়ে থাকা আদি সাংখ্য এবং তন্ত্রের প্রকৃতির ধারণার ভারী চমৎকার সাযুজ্য আছে আমার মনে হয়েছে। আদি সাংখ্য প্রকৃতি-প্রধান ছিল, ঈশ্বরে অনাস্থা রাখা সেই প্রকৃতির কনসেপ্ট অনেকগুলো কারণে সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম বস্তুবাদী দর্শনের মর্যাদা পাবে, উপরন্তু মাতৃকা-প্রতীকে এই প্রকৃতি প্রকাশিত হন। এই মাতৃকা-উপাসনার ভাষায় জীব ও জড় জগতকে একত্রে প্রকাশ করা বৈপ্লবিক। সে নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে আস্ত থিসিস হয়ে যাবে, কাজেই আপাতত আর কিছু বললাম না।

আজ মার্ক্সের জন্মদিন। আজ বঙ্কিমের মত সাম্প্রদায়িক, “মুসলমান-বিদ্বেষী”র নাম মার্ক্সের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে নেওয়া যায়? বঙ্কিমের আনন্দমঠে সন্তানরা শেষের দিকে মুসলমানদের গ্রামে গিয়ে বলছে, ভাই, হরিনাম করবি? সেই বঙ্কিম আর মার্ক্সের নাম একসঙ্গে?

এ প্রশ্নের উত্তরে আরেকবার মনে করি, মার্ক্সের সেই প্রবন্ধ, ১৮৫৪ সালে লেখা, “ডিক্লারেশন অভ ওয়ারঃ অন দ্য হিস্ট্রি অভ দ্য ইন্টার্ন কোয়েশ্চন”, তাতে মার্ক্স বলেছিলেন, “কোরান এবং তা থেকে উদ্ভূত মুসলমানি আইন বিভিন্ন জনমানুষের নিজস্ব ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে নামিয়ে আনে এক সুবিধাবাদী দ্বি-জাতীয় ও দ্বি-দেশীয় বিভেদেঃ যারা ইসলামে বিশ্বাসী, আর যারা অবিশ্বাসী বা কাফের। অবিশ্বাসী বা কাফের হল হার্বি, বা শত্রু। ইসলামিজম কাফেরদের জাতিকে নিষিদ্ধ করে, যার ফলে এক চিরস্থায়ী শত্রুতা তৈরি হয় মুসলমান ও অবিশ্বাসীর মধ্যে।” https://www.marxists.org/archive/marx/works/1854/03/28.htm

আমি জানি না, বঙ্কিম এ প্রবন্ধ পড়েছিলেন কিনা। সম্ভবত না। কিন্তু আনন্দমঠের শেষে সন্তানরা যা করেছিল, সেটা প্রায় যেন মার্ক্সের ব্যাখ্যার প্রতিধ্বনি।

আজ পর্যন্ত সিপিএমের কোনোও পার্টি কংগ্রেসে মার্ক্সের এ প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা হয়নি, হলে সম্ভবত সিপিএম ভেঙে যাবে আরেকবার। কিন্তু মার্ক্স একটা দিকে বঙ্কিমের থেকেও এগিয়ে। উনিশ শতকের বাংলায় ওয়াহাবি বা ফরাজির বিপদ সম্পর্কে ঈশ্বর গুপ্ত সচেতন ছিলেন। বঙ্কিমের কোনও লেখায় এই সচেতনতা পাইনি। তাঁর যা কিছু সমালোচনা সে মধ্যযুগের মুসলমানের। তিনি সমসাময়িক বাংলার হিন্দু মুসলমান সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তের ফারাক করতে রাজি ছিলেন না বঙ্কিম।

মার্ক্স কিন্তু তিতুমীর ও তাঁর আন্দোলনকে আখ্যা দিয়ে গেছেন, মোসলেম ফ্যানাটিক (নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি)। https://archive.org/…/notesonindianhis00ma…/page/n8/mode/2up

না, বঙ্কিম সম্ভবত প্রথম আন্তর্জাতিককে ওই চিঠিটা লেখেন নি। বঙ্কিম, আমাদের অশেষ দুর্ভাগ্যবশত তিনি ইংরেজ সরকারের কর্মচারী, সে ট্র্যাজেডি নিয়ে বঙ্কিমের মৃত্যুদিনে লিখেছিলাম, এই পেজে দেখতে পাবেন, কাজেই ঝুঁকি নিয়ে তিনি হয়ত মার্ক্সকে চিঠি লিখবেন না। কিন্তু আমার এই লেখা আজ যাঁরা আজ পড়লেন, তাঁরা সম্ভবত বুঝবেন, এক অর্থে এই দুজন মনীষী কথা বলেছিলেন, পরস্পর আলাপ করেছিলেন।

মনীষী থেকে মনে এল। বঙ্কিম-নামাঙ্কিত বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে সিপিআইয়ের মনীষা গ্রন্থালয়ে গেছি বেশ কয়েকবার। ঢুকলেই দেখা যায়, পেছনের দেওয়ালে বিশাল বিশাল কতগুলি তৈলচিত্র। তাতে বঙ্কিম রয়েছেন, খুব প্রমিনেন্টভাবে রয়েছেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মার্ক্সচর্চা আরও গভীর হোক। মার্ক্স এঙ্গেলস নবজাগ্রত জার্মান জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে। আমরা জানি মার্ক্স ইসলামকে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু মার্ক্সবাদ সাধারণভাবে ধর্মবিরোধী নয়, বরং ধর্মের সপ্রশংস মূল্যায়নে সক্ষম (উৎপল দত্তর গিরিশ মানস বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য এই)। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকরা ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খ্রীষ্টধর্মের পক্ষ অবলম্বন করেছেন, আমার নিজের পিএইচডির কাজ এরকম একজনের ওপরে ছিল, টেরি ইগলটন, তিনি একজন ক্যাথলিক মার্ক্সবাদী। অতএব বাঙালির জন্য, বিশেষ করে একটি বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স যা একই সঙ্গে ইসলামের ও গোবলয়ের নির্ভীক সমালোচনা করবে, বাঙালির নিজস্ব শেকড়, ধর্ম, সংস্কৃতির পক্ষে অবস্থান করবে এবং সেই সঙ্গে সমাজ বদলের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করবে, সেই কাজে মার্ক্সের গুরুত্ব ফুরিয়ে যাচ্ছে না।

কাজেই, একটি পরাবাস্তব বা জাদুবাস্তব ডাইমেনশনে আজ বঙ্কিম আর কার্ল মার্ক্সের মুখোমুখি দেখা হচ্ছে, তাঁরা করমর্দন করছেন। শুভ জন্মদিন, কার্ল…

© তমাল দাশগুপ্ত

৫ই মে ২০২০ তারিখে, http://fb.me/tdasgupto থেকে

অক্ষয় তৃতীয়া: আজ কি চৈতন্য অবসানের দিন? – তমাল দাশগুপ্ত

আজ অক্ষয় তৃতীয়া। আমরা যারাই চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধান করেছি, তেমন বাঙালিরা আজকের এ দিনটিকে মনে রাখি বিশেষ ভাবে। কারণ চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান অনুসন্ধানে যে টেক্সটগুলোর গুরুত্ব সবথেকে বেশি, সেই উড়ে ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলোয় প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে এটাই বলা হয়েছেঃ তিনি আজ, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মারা গেছিলেন।

বাঙালিদের লেখা গ্রন্থে ভিন্ন বিবরণ (আষাঢ় মাসে তাঁর নশ্বর লীলার অবসান), কিন্তু অক্ষয় তৃতীয়া বলে দাবি করা উড়ে টেক্সটগুলো সম্ভবত বেশি অথেন্টিক। উপরন্তু তার মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আছে, কাজেই তা আমাদের সঙ্গত কৌতূহলের উদ্রেক করে।

উড়িয়া গ্রন্থগুলোর এক এক করে আলোচনা করি। ঈশ্বরদাসের চৈতন্যভাগবত বলে, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন চৈতন্য বৈকুন্ঠে গমন করেছিলেন। তিনি নগর পরিক্রমা করে তারপর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকে শ্রীবিগ্রহে চন্দনলেপন করেন (প্রসঙ্গত চৈতন্য জগন্নাথ বিগ্রহের নিকটে যেতেন না, দূর থেকেই দর্শন করতেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে জগন্নাথের স্পর্শে তিনি ভাবপ্লাবিত হতেন। তবে প্রথমবার পুরী গিয়ে তিনি যখন জগন্নাথকে আলিঙ্গন করতে যান, তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল পাণ্ডারা, এবং বাসুদেব সার্বভৌম এসে না বাঁচালে হয়ত সেদিনই চৈতন্যকে পাণ্ডারা মেরে ফেলত, অতএব চৈতন্যের জগন্নাথ সন্নিকটে না যাওয়ার রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে। যাই হোক, সেই চৈতন্য, যিনি দীর্ঘ চব্বিশ বছর নীলাচলবাসের সময় জগন্নাথকে স্পর্শ করলেন না, গর্ভগৃহেই প্রবেশ করলেন না, সেই তিনি যে এতদিন পরে এইভাবে স্বহস্তে জগন্নাথে চন্দনলেপন করতে গেছিলেন, এটি চমকপ্রদ ঘটনা বটে। মনে রাখবেন এর আগে একদিন তিনি যখন স্পর্শ করেছিলেন, সেদিনের মত আজ কোনও বাসুদেব সার্বভৌম ছিলেন না।) এবং জগন্নাথ এই সময় মুখব্যাদান করেন, তার মধ্যে চৈতন্য অন্তর্হিত হন। এই ঘটনার পরে রাজা প্রতাপরুদ্রের ক্রোধ প্রজ্জ্বলিত হলে প্রভু “জগন্নাথ” স্বয়ং ক্রোধ নিবারণ করতে আদেশ দেন, এবং চন্দনযাত্রা/চন্দনবিজয় সম্পূর্ণ করতে আদেশ দেন। এখানে বলা দরকার, অক্ষয়তৃতীয়ার দিন জগন্নাথের চন্দনযাত্রা হয়।

ঈশ্বরদাস জানাচ্ছেন যে চৈতন্যের মৃতদেহ এরপর “জগন্নাথের আদেশেই” প্রাচী নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, চৈতন্য হত্যার কিনারা করতে গিয়ে যিনি খুন হয়েছিলেন পুরীতে, সেই জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের হাতে একটি উড়ে গ্রন্থ এসেছিল, বৈষ্ণবদাস রচিত “চৈতন্য গৌরাঙ্গ চকড়া” নামে এই পুঁথিটি পুরীনিবাসী পদ্মশ্রী সদাশিব রথশর্মা গঞ্জাম জেলায় আবিষ্কার করেন, এবং এই কীটদষ্ট পুঁথির কিয়দংশ তিনি জয়দেববাবুকে দিয়েছিলেন। বলা হয় চৈতন্যের মৃত্যু নিয়ে এই পুঁথিতে কিছু বিস্ফোরক তথ্য ছিল। দুঃখের কথা, জয়দেববাবু খুন হওয়ার পরে সে পুঁথির আর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় নি। জয়দেববাবুর অসমাপ্ত গ্রন্থ কাঁহা গেলে তোমা পাই পড়লে জানা যায়, পুঁথির রচয়িতা বৈষ্ণবদাস নিজের চোখে চৈতন্যের মৃতদেহ দেখেছিলেন, তবে দিন-ক্ষণ মাস-তারিখ কিছু বলা নেই। জগন্নাথের চন্দনবিজয়ের পরে রাত দশটার সময় গরুড় স্তম্ভের পেছনে চৈতন্যের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছিল।

উড়িষ্যার পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের দিবাকরদাসও লিখে গেছেন, কলিকালে বেঁচে থাকা নিরর্থক বিবেচনায় নিজধামে গমন করবার বাসনা থেকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন চৈতন্য লীন হয়েছিলেন জগন্নাথ অঙ্গে।

পঞ্চসখার আরেকজন অচ্যুতানন্দ, ইনি বলছেন অক্ষয় তৃতীয়ার আগের দিন গভীর রাতে (সম্ভবত অক্ষয় তৃতীয়া তিথি শুরু হয়ে গেছিল) চৈতন্যর মৃত্যুর কথা। স্থান অবশ্য সেই জগন্নাথমন্দির, এবং লীলাবসান ওই শ্রীবিগ্রহে লীন হয়েই।

মাধব পট্টনায়ক চৈতন্য সমসাময়িক এবং তিনি চৈতন্যলীলার প্রত্যক্ষদর্শী (লীলাবসানেরও বটে)। অক্ষয় তৃতীয়ার আগের অমাবস্যায় (রুক্মিণী অমাবস্যা) পথে নামসঙ্কীর্তনে নৃত্যরত চৈতন্যর পায়ে ইঁটের খোঁচা লাগে,এবং ফলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হন। তাঁকে ধরাধরি করে জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং সেখানে তাঁর শুশ্রূষা চলে, যদিও কোনও কবিরাজ-বৈদ্যকে ডাকা হয়নি (গরম জলের সেঁক দেওয়া হয়েছিল মাত্র)। তাঁর শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে, সারা দেহ ফুলে যায়। লক্ষণীয়, কয়েকদিন ধরে অসুস্থ, অথচ কোনও বৈদ্যকে ডাকা হয়নি। অবশেষে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ব্রাহ্মক্ষণে (খুব ভোরে) জগন্নাথ মন্দিরেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। চন্দনযাত্রায় যোগ দিতে প্রতাপরুদ্র আসছিলেন, তিনি সোজা মন্দিরে এসে পৌঁছলে চৈতন্যের মৃতদেহের সামনেই আলোচনাসভা বসে। রায় রামানন্দ বলেন, গৌড়ীয়রা নানা কুকথা বলবে, হয়ত গৌড়ের “ম্লেচ্ছ” রাজাকে “খর” ভাষণ করবে (উড়িষ্যা আক্রমণ করতে উৎসাহ দেবে), কাজেই এ শবদেহ বাইরে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। কোইলি বৈকুণ্ঠ (জগন্নাথের দারুমূর্তি যেখানে সমাধিস্থ হয়)-তে চৈতন্যকে সমাধি দেওয়া হোক। প্রতাপরুদ্র সম্মতি জানালে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চৈতন্যর নশ্বর দেহটিকে পুঁতে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। সেই ভীষণ কার্য সমাপনান্তে মন্দিরের দরজা খুলে চন্দনযাত্রায় আগত ভক্তদের বলা হয়, চৈতন্য জগন্নাথদেহে লীন হয়ে গেছেন।

প্রসঙ্গত কোইলি বৈকুণ্ঠে সমাধি দিতে গেলে এরপরে জগন্নাথের দারুমূর্তি সমাহিত করতে গেলে সে দেহাবশেষ বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা, কাজেই এ চত্ত্বরে শেষ পর্যন্ত সমাধি সম্ভবত হয়নি, মন্দিরের অন্যত্র চৈতন্যকে সমাহিত করা হয়েছিল।

মানুষের পক্ষে মূর্তিতে লীন হওয়া সম্ভব নয়, সেযুগেও গল্পটা বিশ্বাস করেনি লোকে। কিন্তু বৈষ্ণব ভক্তদের পাণ্ডাচক্র সম্বন্ধে সন্দেহকে ধামাচাপা দিতে এই জগন্নাথে লীন হওয়ার কাহিনী প্রচারিত হয়।

জগন্নাথে লীন হওয়ার কাহিনী যাঁরা প্রচার করেছিলেন, সেই পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ মাধবের বর্ণনা পড়লেই বোঝা যায় যে তাঁরা নিজেরাও জানতেন, এটি গল্পগাছা, কারণ লীন হওয়ার গল্প প্রচারের পাশাপাশি চৈতন্যর মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে সে নিয়েও বন্দোবস্ত সমান তালে চলছে।

চৈতন্যের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। জগন্নাথমন্দিরে আবিষ্কৃত কঙ্কালদ্বয়ের ফরেনসিক টেস্ট আজও হয়নি, সেটা হলে মৃত্যুর সঠিক কারণ বোঝা যেত।

আজ অক্ষয় তৃয়ীয়ার দিন। আজ চৈতন্যকে স্মরণ করার দিন। চৈতন্য এক সাম্যময় গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সে আদর্শকে স্তব্ধ করা সম্ভব হয়নি।

আজ, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন চৈতন্য আন্দোলনের সেই অসমাপ্ত কাজকে সুসম্পূর্ণ ও সুসম্পন্ন করার প্রতিজ্ঞা করব আমরা।

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২৬শে এপ্রিল ২০২০

বঙ্কিম সম্পর্কে সাতটা মিথ – তমাল দাশগুপ্ত

আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা বঙ্কিমকে নিয়ে বহুল প্রচলিত সাতটি মিথ ভাঙব আজ এই লেখায়। বঙ্কিমবিরোধী কেউ পারলে সঠিক প্রতিযুক্তি ও প্রতি-তথ্য নিয়ে অগ্রসর হোন, এই সাতটি মিথ আমি বরাবরের মত এ প্রবন্ধের মাধ্যমে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছি।

প্রথমেই সবথেকে অস্বস্তিকর ও সবথেকে বড় মিথঃ বঙ্কিম মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত স্টেটাসে এর পূর্ণাঙ্গ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এ নিয়ে আমার একটা প্রবন্ধ আছে, “বঙ্কিম কী মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন? মিথ ও মিথ্যার আবরণ সরিয়ে”।

http://shoptodina.blogspot.com/2016/03/blog-post_35.html

বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষ একটি মিথ। কিন্তু এক কথায় যেটা বলা দরকার, সেটা হচ্ছে একশ্রেণীর মুসলমানের বঙ্কিম বিদ্বেষ (সবার নয়, বঙ্কিম সম্পর্কে শ্রদ্ধাবান মুসলমানও আছেন অনেকে) -এর ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করা দরকার এবার। এর একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সে ইতিহাস পাঠ করলে বাংলার ও ভারতের বুকে ইসলামিক মৌলবাদকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।

বঙ্কিমের আনন্দমঠ বা রাজসিংহ প্রমুখ উপন্যাস বা বিভিন্ন প্রবন্ধ সম্পর্কে যেটা মুসলমান বিদ্বেষের অভিযোগ আছে, সেটা উপন্যাস বা প্রবন্ধ সমূহ পড়লেই বোঝা যায়, সেটা বিজাতীয় মুসলমানের আগ্রাসনের প্রতি একজন সৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদীর বিদ্বেষ। এর জন্য বঙ্কিম কৈফিয়ত দেবেন না কারও কাছে, তিনি এই সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি-পুরুষ দ্বৈতবাদের ভূমিতে বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছেন, একে কোনও রেসিস্ট বিদ্বেষের ছাপ দেওয়া অসভ্যতা, কারণ আত্মরক্ষার অধিকার আছে বাঙালির। সব জাতিরই আছে, আমাদেরও আছে। নিজের ভূমিতে দাঁড়িয়ে তো আরও বেশি আছে।

বাংলাভাষী মুসলমানের বিরুদ্ধে বঙ্কিম বিদ্বিষ্ট নন, বরং উল্টো প্রমাণ দিয়েছি আমার প্রবন্ধে। তবে আনন্দমঠের চরিত্রগুলিকে দেখা গেছে, তারা উপন্যাসের শেষে মুসলমানকে দিয়ে জোর করে হরিনাম করাতে চেয়েছে। চরিত্রের কাজকে উপন্যাসলেখকের কাজ ভাবা সুচিন্তিত নয়, এবং সে প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আবার আসব। তবে হরিনাম শেখানোকে বিদ্বেষ বলা যায়?

যবন হরিদাস সুলতানের আদেশে বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতে মৃতপ্রায় হয়েও হরিনাম করেছেন, তিনি মহাপ্রাণ মহাত্মা ছিলেন। তা বলপূর্বক কাজীদলনের জন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন যদি মুসলমান বিদ্বেষী না হয়, তবে আনন্দমঠের লেখক বঙ্কিমও নন।

বাংলার মুসলমানকে রাধাকৃষ্ণের প্রেমগানে মথিত করাকে বিদ্বেষ বলব না। সেটাকে বাঙালিত্ব বলব।

সাহিত্য সম্রাটের সমস্ত লেখায় মুসলমান বিদ্বেষের যাবতীয় অভিযোগের বিস্তারিত খণ্ডন পাবেন ওপরের লেখাটায়। লিঙ্কে গিয়ে অনুগ্রহ করে পড়ুন।

দ্বিতীয় মিথ। বঙ্কিম বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার, বিশেষ করে তাঁর বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন।

বঙ্কিমের উপন্যাসে সূর্যমুখী নামে একটি চরিত্র বলেছিল, বিধবার বিবাহ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক কথা। চরিত্রের উক্তি যদি উপন্যাসকারের উক্তি হয়, তাহলে পাকিস্তান ও মুসলিম লিগের মৌলবাদকে সমর্থন করার কাজে এখুনি সাত আসমান নামক উপন্যাসের লেখক শামিম আহমেদ অভিযুক্ত হবেন, কারণ ওই উপন্যাসের চরিত্র এমনই করেছে। সেকুলারিজম ভালো, কিন্তু সাহিত্যের আলোচনা এভাবে হলে তো মহা বিপদ হবে। চরিত্রকে চরিত্র হিসেবে দেখাই ভালো, বঙ্কিম সেযুগের একটি বাস্তবোচিত চরিত্র তৈরি করতে গিয়ে তার মুখে একটা সংলাপ দিয়েছেন।

দেখতে হবে বঙ্কিমের প্রবন্ধে বিধবাবিবাহ সম্পর্কে কেমন উক্তি আছে। সেখানে তো দেখছি বঙ্কিম বিধবা বিবাহের অধিকার সম্পর্কে সরাসরি সমর্থন জানাচ্ছেন। সাম্য প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট বলছেন, কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই বলছেন যে পুরুষের যেমন স্ত্রীবিয়োগের পরে পুনর্বিবাহে অধিকার, তেমনই স্ত্রীরও অধিকার আছে বিধবা হলে পুনর্বিবাহে (বঙ্কিম রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, ৩৪৭)।

তৃতীয় মিথ। বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, বহুবিবাহ বিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে বলেছেন বঙ্কিম, বঙ্কিম বহুবিবাহের সমর্থক ছিলেন। এ সংক্রান্ত বঙ্কিমের প্রবন্ধ যে-ই পড়েছে, সেই জানে, এটা সর্বৈব মিথ।

বঙ্কিম সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে যা বলেছিলেন, তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় ১। বহু বিবাহ একটি মুমূর্ষু রাক্ষস, এ রাক্ষস এমনিতেই মৃতপ্রায়।
২। তথাপি বিদ্যাসাগর একে মারতে উদ্যত হয়েছেন বলে তিনি পুণ্যাত্মা বলে গণ্য হবেন।
৩। যদি পুরুষদের বহুবিবাহ বন্ধ করতে হয় সেক্ষেত্রে বাংলায় অর্ধেক মুসলমান (সেযুগে অর্ধেক), তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত পণ্ডিত কেউ নেই, বিশেষত আরবী কায়দা হেলে না দোলে না, তাই শাস্ত্র উদ্ধৃত করে এই সমাজ সংস্কার করলে চলবে না, এবং শুধু হিন্দুর জন্য এই বহু বিবাহ নিরোধক আইন করলেও চলবে না। শাস্ত্র দেখে নয়, এবং ধর্ম দেখে নয়। সর্বত্র সব ধর্মের মধ্যে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হোক।

বঙ্কিম যা বলেছিলেন, তা থেকে বোঝা যায়, তিনি ইউনিফর্ম সিভিল কোড চেয়েছিলেন। সেযুগের প্রেক্ষিতে বৈপ্লবিক।

এবং শাস্ত্র উদ্ধৃত করে সমাজ পরিচালনার বিরোধিতা বঙ্কিম অন্যত্রও করেছেন। জীবনের একদম শেষে একবার তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, সমুদ্রযাত্রায় শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তিনি কী মনে করেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, যদি তাতে মনে কর (বাঙালি) জাতির ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখো না, শাস্ত্রবচনের ওপর নির্ভর কোরো না, নির্ভয়ে সমুদ্রযাত্রা করো। ,

চতুর্থ মিথ। বঙ্কিমের সংস্কৃত দুর্বল ছিল এবং এজন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় সংস্কৃতে গ্রেস মার্ক পেয়ে পাশ করেছিলেন। সত্য হল, বঙ্কিম ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত শিখেছেন। এ নিয়ে শ্যামলী চক্রবর্তীর বই আছে, “বঙ্কিমচন্দ্র এবং ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ”, আগ্রহীজন পড়ে নিতে পারেন। এবং আরেকটা সত্য হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় আদৌ সংস্কৃতের কোনও পেপার-ই ছিল না।

পঞ্চম মিথ। বঙ্কিম দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বলে বিদ্যাসাগর তাকে একবার বাংলায় ফেল করিয়েছিলেন।

এটি মিথ কেননা অর্ধসত্য। অতএব মিথ্যার থেকেও ভয়ানক।

ঘটনা যা ঘটেছিল বলি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে বিদ্যাসাগর পরীক্ষক ছিলেন। ইংরেজি ও বাংলা মিশ্রিত একটি ল্যাঙ্গুয়েজ পেপার ছিল। ইংরেজি অংশের পরীক্ষক ছিলেন Grapel এবং বাংলা অংশের বিদ্যাসাগর। ইংরেজিতে খুব ভালো নম্বর পেয়েছিলেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরের পেপারে বঙ্কিম পাশ করতে পারেন নি। প্রসঙ্গত, এই একবার মাত্র নয়। এর আগে একবার হুগলি কলেজে যখন বঙ্কিম ছাত্র এবং বিদ্যাসাগর বাংলার পরীক্ষক, তখনও বঙ্কিমের বাংলা পছন্দ হয়নি বলে বিদ্যাসাগর তাঁকে ফেল করিয়েছিলেন। বঙ্কিমের ছাত্রজীবনের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় হগলি কলেজে পাঠরত অবস্থায় প্রত্যেক বছরই তিনি ডিস্টিংশন পেয়েছিলেন। ওই একটা বছরেই পান নি।

বঙ্কিম কিন্তু এর আগেই ঈশ্বর গুপ্তের প্রিয় শিষ্য। কিশোর বয়সেই তিনি সংবাদ প্রভাকরে লিখছেন। কালেজীয় কবিতাযুদ্ধ নামে একটা ভারী চমৎকার সিরিজ (একরকম কবির লড়াই বলতে পারেন) হয়েছিল এইযুগে সংবাদ প্রভাকরে, ঈশ্বর গুপ্তের তিনজন স্নেহভাজন কিশোর লেখকের মধ্যেঃ বঙ্কিম, দীনবন্ধু আর দ্বারকানাথ অধিকারী। দ্বারকানাথের অকাল মৃত্যু না হলে বাকি দুজনের মত তিনিও সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রূপে আত্মপ্রকাশ করতেন।

তো যে বঙ্কিমকে বিদ্যাসাগর ফেল করাচ্ছেন, সে বঙ্কিম কিন্তু দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন না। কারণ তাঁর এই সময়ে লেখা বাংলা ঈশ্বর গুপ্তের কল্যাণে সুরক্ষিত আছে, চাইলে আপনিও দেখে নিতে পারবেন। এবং যারা ভাবেন বঙ্কিমের বাংলা দাঁতভাঙা ছিল, আসলে তারা বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ছাড়া আর কিছুই পড়েন নি। বস্তুত দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বিদ্যাসাগর নিজেই, সেটা যারা বিদ্যাসাগরের গদ্য রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত সবাই জানেন, এবং সেজন্যই সম্ভবত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ছাত্রের লেখা unorthodox বাংলা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পছন্দ হয় নি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র জ্ঞান আছে সেই জানে বিদ্যাসাগরের বাংলা কতটা রক্ষণশীল আর বঙ্কিমের বাংলা কতটা বৈপ্লবিক ছিল সে যুগে।

ষষ্ঠ মিথ। বঙ্কিম ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট ছিলেন। বস্তুত বঙ্কিম ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের হাতে বিধ্বস্ত হয়েছেন বারবার। পুরো চাকরিজীবন ধরে ইংরেজদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছেন, এবং সেজন্য বারবার আঘাত পেতে হয়েছে শাসকের থেকে। সেটা বঙ্কিমের জীবন সম্পর্কে ওয়াকবহাল প্রত্যেকে জানেন। আনন্দমঠ লেখার পর বারবার শাস্তিমূলক বদলি এবং এমনকি ডিমোশন হয়েছে বঙ্কিমের। এ নিয়ে বঙ্কিমের মৃত্যুদিনে লিখেছি, সেটার লিঙ্ক দিলাম।

https://matshonyay.home.blog/2020/04/10/%e0%a6%ac%e0%a6%99%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%a3%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a6%b8%e0%a7%87-%e0%a6%a4%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%aa/

আনন্দমঠের শেষে ইংরেজ জিতছে, সেটা দেখানোর জন্য বঙ্কিমকে যদি ইংরেজ-অনুগত ভাবতে হয়, তাহলে স্মরণ করাতেই হয়, ঐতিহাসিক উপন্যাসের শেষটা কেমন হবে সেটা নিয়ে লেখকের হাত বাঁধা থাকে। ম্যাজিক রিয়েলিজম জাতীয় কিছু ঘটানোর প্রথা তখনও আসেনি। সীতারামের শেষে সীতারামের পরাজয় দেখিয়েছেন বলে তাহলে বঙ্কিমকে হিন্দুবিদ্বেষী বলতে হবে, যদি আনন্দমঠে ইংরেজের বিজয় দেখানোর জন্য তিনি ইংরেজপ্রেমিক হয়ে থাকেন। ইতিহাসে ইংরেজ জিতেছিল, আর ইতিহাসে সীতারাম হেরেছিলেন। ঐতিহাসিক উপন্যাসে বঙ্কিম কেমনভাবে অন্যরকম দেখাবেন?

সপ্তম মিথ। বঙ্কিম হিন্দুধর্মের কুসংস্কারগুলোকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। যিনি সেযুগে প্রখর জনপ্রিয় শশধর তর্কচূড়ামণির দ্বারা হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও জনপ্রিয়করণের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছেন, সেই বঙ্কিম কুসংস্কারের পক্ষপাতী, এই অভিযোগে বাঙালির ইতিহাস হেসে ফেলবে (প্রসঙ্গত যারা জানেন না, তাঁদের বলি, শশধর আজকের হিন্দুত্ববাদীদের বৈজ্ঞানিক অস্পৃশ্যতা, অথবা গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি, অথবা মহাভারতে ইন্টারনেট ইত্যাদি তত্ত্বের পূর্বসূরী ছিলেন, উদাহরণস্বরূপ তিনি হিন্দুধর্মের টিকিতে ইলেক্ট্রিসিটি পেতেন)

বস্তুত, বঙ্কিম প্রখর যুক্তিবাদী ছিলেন। এককালে নাস্তিক ছিলেন। এবং যদিও পরে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে পড়েন, কিন্তু তাঁর লেখা কৃষ্ণচরিত্র বা ধর্মতত্ত্ব পড়লে বোঝা যায় নাস্তিকেরও কোনও সমস্যা হয় না এই ধর্মের সংজ্ঞায়, কারণ এই ধর্ম ধারণ করে। যে সাংখ্যের সবথেকে বিখ্যাত উক্তি ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ, অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্বই অসিদ্ধ, তাকে বাংলার হিন্দুধর্মের কেন্দ্রস্থলে স্থান দিয়ে বঙ্কিম অবশ্যই একাধারে ধর্ম ও দর্শনের বিবর্তনের প্রক্রিয়ার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকার, অন্যদিকে তিনি বাঙালিকে এমন এক ধর্মের ঈঙ্গিত দিয়ে গেছেন, যাকে বিনা কুসংস্কারে এমনকি বিনা ঈশ্বরবিশ্বাসেও গ্রহণ করতে অসুবিধা হয় না। এছাড়া তাঁর বঙ্গদর্শনের বিজ্ঞান নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন বঙ্কিম, তিনি বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার একজন বীজপুরুষ। জ্যোতিষ নিয়ে এককালে আগ্রহ থাকলেও তাঁর মেয়ের জ্যোতিষী নির্ধারিত “রাজজোটক” বিবাহের পর জামাইটি মেয়েকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার পর (আদালতে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়েছিল, শোনা যায় জামাইয়ের দাদুর কাতর আবেদনের ফলে বঙ্কিম আর জামাইয়ের শাস্তিবিধান করেন নি, নইলে সে রত্নটির ফাঁসি হত) বঙ্কিম প্রৌঢ় বয়সে এই জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতায় আস্থাশীল হন। হ্যাঁ, তিনি কালাপাহাড় বা ইয়ং বেঙ্গল ধরণের বিদ্বেষ দেখান নি বাংলার হিন্দুধর্ম সম্পর্কে (ভাগ্যিস দেখান নি), কিন্তু সেজন্যই তিনি ঋষি। তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না। তিনি সেযুগে বসে ধর্ম সম্পর্কে যা অনুধাবন করেছেন, তা বৈপ্লবিক। তাঁর ধর্মতত্ত্ব ও সাম্য পাশাপাশি রাখলে সেই কাজ বিংশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকায় লিবারেশন থিওলজি, বর্তমান ইউরোপে ঈগলটন বা জিজেক প্রমুখের মার্ক্সবাদী ক্রিশ্চান তত্ত্বর সমপর্যায়ে আসবে। তিনি যুক্তিবাদের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে যুক্তিকে বৃহতের আঙ্গিকে এনেছেন। তিনি ধর্মের সঙ্গে শুধু সামাজিক ন্যায়কে জোড়েন নি। তাঁর প্রবন্ধে বোঝা যায়, তিনি সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত বাঙালির শাক্ত, বৈষ্ণব ও অজস্র লোকায়ত ধর্মাচারের ন্যারেটিভগুলির প্রয়োজনীয়তা সেযুগে বসেই অনুধাবন করেছেন। আজকে ইউভাল হারারির মত পণ্ডিতও সে প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, অর্থাৎ ধর্মের কাহিনীগুলো আমাদের মধ্যে সমষ্টি নির্মাণ করে। সে সমষ্টি প্রয়োজনীয়। ডকিন্স, বিখ্যাত নাস্তিক, তিনি বলছেন, ইংল্যান্ডের স্কুলে বাইবেল পড়ানো বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের আইকন বঙ্কিমকে নমস্কার করে, তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত সাতটি মিথকে যথোপযুক্তভাবে ধ্বংস করে এই লেখা শেষ করছি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যে যে বাঙালি আছেন বঙ্কিমবিরোধী, তাঁদের সকলের উদ্দেশ্যে খোলা চ্যালেঞ্জ রাখলাম, সাধ্য থাকলে প্রতিযুক্তি ও প্রতিতথ্য সহকারে আমার সঙ্গে সম্মুখ তর্কযুদ্ধে আসবেন। নতুবা এ সাতটি মিথকে বরাবরের মত এই আমি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করলাম।

বন্দেমাতরম।

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২০শে এপ্রিল ২০২০

চৈতন্য অন্তর্ধানের সংক্ষিপ্ত বিবরণপঞ্জী – তমাল দাশগুপ্ত

চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনাবসান ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে পুরীতে। এই ঘটনা কিভাবে তাঁর জীবনীগুলিতে বিবৃত হয়েছে, সে নিয়েই এই পোস্ট। চৈতন্য অন্তর্ধান নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শুধুমাত্র একটা স্টেটাসে পুরোটা জানতে চান? পড়ুন।

১। স্বরূপ দামোদর চৈতন্যদেবের নীলাচল লীলার অন্তরঙ্গ সাক্ষী, বাঙালি পরিকরদের মধ্যে অগ্রগণ্য। স্বরূপ দামোদরের কড়চা আর পাওয়া যায় না। অথচ এই গ্রন্থটি কৃষ্ণদাস কবিরাজ দেখেছেন, কবি কর্ণপুরও দেখেছেন। কৃষ্ণদাস বিশেষভাবে বলছেন, যে চৈতন্যলীলার শেষটা স্বরূপ দামোদর লিখে গেছেন (প্রভুর যে শেষ লীলা স্বরূপ দামোদর/ সূত্র করি গাঁথিলেন গ্রন্থের ভিতর), ভক্তবৈষ্ণব পাঠককে বলছেন, প্রভুর লীলাবসানের কথা জানতে স্বরূপ দামোদরের লেখা পড়তে। স্বরূপ দামোদরের কড়চা হল হোলি গ্রেইলের মত, চৈতন্য গবেষকদের কাছে। যাই হোক, এ গ্রন্থটি আজও মেলেনি।

২। প্রসঙ্গত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ নিজে চৈতন্যের জীবনাবসান নিয়ে নীরব। চৈতন্যচরিতামৃতে কেবল লিখে গেছেন, চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান হয়েছিল (শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নবদ্বীপে অবতারি/অষ্টচল্লিশ বৎসর প্রকট বিহারি/চৌদ্দশত সাত শকে জন্মের প্রমাণ/চৌদ্দশত পঞ্চান্নে হইল অন্তর্ধান)। কবি কর্ণপুরও নীরব, চৈতন্যচন্দ্রোদয়ে শুধু বলছেন সাতচল্লিশ বছর বয়েসে মহাপ্রভুর মৃত্যু হয়। কোথায়, কিভাবে? নীরব।

৩। মুরারি গুপ্তর কড়চা কেবলমাত্র জগাম্‌ নিলয়ং বলেছে, এ ব্যতীত চৈতন্য অন্তর্ধানের ব্যাপারে আর কিচ্ছু বলা নেই।

৪। চৈতন্যের উড়িয়া ভক্ত রায় রামানন্দ এবং কাহ্নাই খুন্টিয়া মহাপ্রভুর শেষদিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অন্য অনেক বিষয়ে এঁরা লিখে রাখলেও এই ব্যাপারে নীরব, কিচ্ছু লেখেন নি।

৫। বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত একটি অসম্পূর্ণ গ্রন্থ। এমন না যে গ্রন্থ অসমাপ্ত রেখেই অকালে প্রয়াত, গ্রন্থ রচনার পরেও বহুদিন ধরাধামে ছিলেন, অথচ অসমাপ্ত গ্রন্থটিতে চৈতন্যদেবের শেষলীলা নেই। তবে জানা যাচ্ছে এই অসমাপ্ত গ্রন্থের অপ্রকাশিত শেষাংশ নিয়ে একটা এডিশন প্রকাশ করেন বর্ধমান জেলার দেনুড় শ্রীপাটের অধিকারী অম্বিকাচরণ ব্রহ্মচারী, এবং সেই চৈতন্যভাগবতে বলা হচ্ছে বৈশাখী পূর্ণিমা ত্রয়োদশীতে জগন্নাথ মন্দিরে চৈতন্যদেবের “অন্তর্ধান” ঘটে। শুধু চৈতন্যদেব না, স্বরূপ দামোদরেরও “অন্তর্ধান” ঘটে, বলা হচ্ছে। এখানে বলা দরকার, চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে প্রচুর গবেষণা হলেও, স্বরূপ দামোদরের অন্তর্ধান নিয়ে গবেষণা হয়নি সেভাবে।

৬। লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল বলছে আষাঢ়ের সপ্তমী তিথি, রবিবার বেলা তিনটের সময় চৈতন্যদেব গুণ্ডিচা মন্দিরে যান জগন্নাথদেবের দর্শনে (সেবছর রথযাত্রা হয়েছিল তৃতীয়ায়, ফলে এইসময় জগন্নাথ বিগ্রহ গুণ্ডিচা মন্দিরেই ছিল)। মন্দিরের কপাট বন্ধ হয়, এরপরে বাইরে থাকা ভক্তরা প্রভুর অদর্শনে ব্যাকুল হয়ে পড়িছা অর্থাৎ পাণ্ডাকে জিজ্ঞেস করেঃ
বিপ্রে দেখি ভক্ত কবে শুনহ পড়িছা।

ঘুচাহ কপাট প্রভু দেখি বড় ইচ্ছা।।

ভক্ত আর্ত্তি দেখি পড়িছা কহয় তখন।

গুঞ্জা বাড়ীর মধ্যে প্রভুর হৈল অদর্শন।।

সাক্ষাৎ দেখিল গৌর প্রভুর মিলন।

নিশ্চয় করিয়া কহি শুন সর্ব্বজন।।

৭। ঈশান নাগর তাঁর অদ্বৈতপ্রকাশে জানাচ্ছেন, জগন্নাথ মন্দিরে মহাপ্রভু ঢুকেছিলেন, এবং প্রবেশমাত্র কপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কপাট কিছুক্ষণ পরে আপনা আপনি খুলে যায়। এতে সবাই বুঝলেন, চৈতন্য “অপ্রকট” হয়েছেন। ঈশানের গ্রন্থে সময় একই দেওয়া আছে। কিন্তু সেসময় জগন্নাথ মন্দির শূন্য, কাজেই সেখানে যে কিভাবে চৈতন্যদেব “জগন্নাথ নিরখিয়া/ শ্রীমন্দিরে প্রবেশিলা হা নাথ বলিয়া”, সেটা একটা বড় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।

৮। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল। মাধব পট্টনায়কের অনুগামী, যদিও মৃত্যুর সময়কাল ও তিথির বিষয়ে নয়। মাধব পট্টনায়কই প্রথম বলেন যে চৈতন্য নামসংকীর্তনকালে নৃত্যরত অবস্থায় পায়ে ইঁটের খোঁচা লেগে মারা গেছিলেন। কিন্তু মাধব বলেন অক্ষয় তৃতীয়ার আগের অমাবস্যার (রুক্মিণী অমাবস্যা) সন্ধ্যায় সংকীর্তনে সময় চৈতন্যের পায়ে ইঁটের খোঁচা লাগে এবং সেই আঘাত বিষিয়ে গিয়েই অবশেষে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন তাঁর মৃত্যু।

জয়ানন্দ মৃত্যুর কারণ এক রাখলেও সময়টা পাল্টে দিয়েছেন, বৈশাখকে আষাঢ় করেছেন, অক্ষয় তৃতীয়াকে রথযাত্রা করেছেন। জয়ানন্দ যে দিনটার কথা বলছেন, সেটা আবার লোচনদাসের সঙ্গে মেলে, আষাঢ়ের সপ্তমী তিথি। সময় অবশ্য হুবহু মেলে না, জয়ানন্দ রাত দশটায় মহাপ্রভু দেহত্যাগের কথা লিখছেন। বর্ণনাও মেলে না, লোচন কোনও আঘাতের কথা লেখেন নি, প্রভু দিব্যি সুস্থ অবস্থায় গুণ্ডিচা মন্দিরে ঢুকছেন। আর যেটা মিলছে না, সেটা হল দেহত্যাগের স্থান। “টোটাএ শয়ন অবশেষে” জয়ানন্দের বক্তব্য। এই টোটা কথাটার অর্থ বাগানবাড়ি বা বাগান ঘেরা মন্দির। টোটা গোপীনাথ হতে পারে, আইটোটা (জগন্নাথবল্লভ উদ্যান) হতে পারে, এমনকি গুণ্ডিচাবাড়িও হতে পারে।

৯। উড়িয়া লেখক মাধব পট্টনায়ক অনেকগুলো কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষকে উনিই প্রথম উড়িয়া (যাজপুরের বাসিন্দা) বলে দাবি করেছিলেন (সমসাময়িক কোনও সোর্সে এমন কথা বলা নেই)। চৈতন্যর পূর্বপুরুষ পাশ্চাত্য বৈদিক ছিলেন, দাক্ষিণাত্য বৈদিক ছিলেন না। আজকে উড়েরা যে সমস্ত নামকরা জিনিস এবং লোকজনকে নিজেদের বলে দাবি করেন, এই প্রবণতার উৎসে মাধব। মাধব পট্টনায়ক চৈতন্যের সমসাময়িক ছিলেন, এবং উনি চৈতন্যের মৃত্যুর যে কারণ দেখান, পরে জয়ানন্দ সেটাই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু মাধব চৈতন্যের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী, উনি বলছেন, মহাপ্রভুর মৃতদেহ দেখে গৌড়ীয়রা কদর্থ করবে এই আশঙ্কায় মৃতদেহটিকে চুপচাপ জগন্নাথ মন্দিরে কোইলি বৈকুণ্ঠ (নবকলেবরের সময় যেখানে পুরোনো দারুমূর্তির সমাধি দেওয়া হয়)-এ পুঁতে দেওয়া হয়। এরপরে সিংহদ্বার খোলা হয়, ভক্তদের বলা হয় মহাপ্রভু জগন্নাথবিগ্রহে বিলীন হয়েছেন।

মাধব যে সময়টা দিচ্ছেন, সেটা অবশ্য জয়ানন্দ অনুসরণ করেন নি। মাধবের মতে অক্ষয়তৃতীয়ার আগের অমাবস্যায়, অর্থাৎ রুক্মিণী অমাবস্যার দিন সন্ধ্যার কিছু আগে সঙ্কীর্তন চলাকালীন চৈতন্য ইঁটের খোঁচায় আহত হয়েছিলেন। এরপর অক্ষয়তৃতীয়ার দিন জীবনাবসান ঘটে, জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গনেই (অক্ষয়তৃতীয়ার আগের রাত্রে স্বচক্ষে চৈতন্যকে জগন্নাথে লীন হতে দেখেছেন, এরকম দাবি উড়িষ্যার পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের অচ্যুতানন্দ তাঁর শূন্যসংহিতায় দাবি করেন)। এবং মাধব ও মাধব অনুসারী জয়ানন্দ ছাড়া আর কেউই চৈতন্যের পায়ে চোট লাগার কথা বলেন নি, না বাঙালি লেখক, না উড়িয়া লেখক।

১০। চৈতন্য হত্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যিনি খুন হয়েছিলেন, সেই জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের কাছে একটি উড়িয়া পুঁথি, বৈষ্ণবদাস রচিত চৈতন্য গৌরাঙ্গ চকড়ার খণ্ডাংশ এসে পৌঁছেছিল। শোনা যায় তাতে বেশ কিছু বিস্ফোরক তথ্য ছিল। দুঃখের কথা জয়দেববাবুর মৃত্যুর পর ওঁর কোনও কাগজপত্রই আর পাওয়া যায় নি। কাঁহা গেলে তোমা পাই জানাচ্ছে যে এই গ্রন্থে বলা আছে এক পূর্ণিমা তিথিতে রাত দশটার সময় জগন্নাথের চন্দনবিজয়ের পরে গরুড় স্তম্ভের পেছনে চৈতন্যের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছিল। মাস বলা নেই।

এ লেখা শেষ করা যাক ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের বক্তব্য দিয়ে। তিনি জয়দেববাবুকে লিখেছিলেনঃ “চৈতন্যদেবকে গুম খুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোনও অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল। … এই বয়সে শহীদ হওয়ার ইচ্ছে নেই বলেই বলতে পারবো না, ঠিক কোথায় চৈতন্যকে খুন করা হয়েছিল।”

(চৈতন্যর মৃত্যু/অন্তর্ধান সম্পর্কে প্রাইমারি টেক্সটগুলির বয়ান সংক্রান্ত আমার এই পুরোনো লেখাটা ঋতুপর্ণা খুঁজে পেয়েছেন, সমস্ত কৃতিত্ব তাঁরই ❤️

আমি এ লেখার পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টায় ছিলাম, তার তো আর প্রয়োজন নেই। তবে আরও বিস্তারিত ও বিন্যস্ত একটি কাঠামোয় এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা নিয়ে এসে আর একটা লেখা দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলাম।

আগের লেখাটা এ পোস্টে সামান্য পরিমার্জন করেছি)

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৯শে এপ্রিল ২০২০

চৈতন্যহত্যা: পোস্ট স্ক্রিপ্ট – তমাল দাশগুপ্ত

চৈতন্যহত্যা : পোস্টস্ক্রিপ্ট (২০১৬ সালের লেখা)

(১)

চীনে ভাষায় (এই চীনে কথাটা বলতে গিয়েই মনে হল, অপমান করা হচ্ছে নাকি? উড়েদের উড়ে বললে নাকি অপমান হয় শুনছি) একটা অভিশাপ আছে, এরিক হবসবমের বইতে পড়েছিলাম। তুমি যেন আকর্ষণীয় সময়ে বেঁচে থাকো। মে ইউ লিভ ইন ইন্টারেস্টিং টাইমস।

চৈতন্যদেব যে সময়ে ধরাধামে অবতীর্ণ, সেটাকে ইন্টারেস্টিং টাইমস বলা যায়। বাংলায় নবদ্বীপ তখন সম্ভবত সারা পৃথিবীতে দর্শনচর্চার শ্রেষ্ঠ স্থান, ভারতের শ্রেষ্ঠতম তো বটেই। বঙ্কিম বলছেন যে এসময় বাংলায় একটা রেনেসাঁস হয়েছিল। সক্রেটিস প্লেটো অ্যারিস্টটলের প্রাচীন গ্রীস যেমন একসময়ে ছিল, যেমন প্রাচীন ভারতের নালন্দা ছিল একসময়ে, সে হচ্ছে চৈতন্যের নবদ্বীপ। অথচ ঘাড়ের ওপরে ঝুলছে কাজীর খাঁড়া, গৌড়ের সুলতান থেকে থেকেই অত্যাচার করছেন। পৃথিবীতে আর কোথাও এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দার্শনিক কাজ কোনওদিনও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। দার্শনিক কাজ তো ছেড়ে দিন, আহার নিদ্রা মৈথুনই চালানো যায় না। বাংলাদেশে অনবরত অত্যাচারের শিকার কোণঠাসা ছত্রভঙ্গ হিন্দুদের মধ্যে যদি এখন হঠাৎ করে একটা প্রবল ইন্টেলেকচুয়াল আন্দোলন ওঠে তখন যেমন অবাক হবেন, বা কাল যদি দেখতে পান পশ্চিমবঙ্গের যে সব হিন্দুত্ববাদীদের সর্বক্ষণ ওই মুসলমানে খেয়ে ফেলল বলে ফেসবুক টুইটারে পোস্ট করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই তারা আচমকা মারাত্মক সব উঁচুদরের প্রবন্ধ কি কবিতা লিখে ফেলছে, দারুণ সব চিন্তাভাবনা করে ফেলছে, তখন যেমন হাঁ হয়ে যাবেন, সেরকম অবাক আমরা কিন্তু কেউই হইনা নবদ্বীপ রেনেসাঁস নিয়ে। অথচ সে সময়টা এমন, যে তখন হিন্দুসমাজে জগাই মাধাইয়েরই আবির্ভাব ঘটছে গণ্ডায় গণ্ডায়, ওদিকে কাজীর বিচার বলে যে বাংলা ইডিয়মটা চালু আছে, সেটা থেকে বোঝা যায়, মধ্যযুগে এইসব শরীয়া কোর্টগুলোতে বিচারের কিরকম ছিরি ছিল। চূড়ান্ত ডামাডোল আর অরাজকতার মধ্যেও, এহেন নবদ্বীপে রেনেসাঁস ঘটছে, বাসুদেব সার্বভৌম আসছেন, এ যে কি করে সম্ভব হয়েছিল, সে ভাবলে আমি আমার পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়ে পড়ি।

এই বাসুদেব সার্বভৌম, সেযুগের ভারতের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক ও পণ্ডিত। সার্বভৌম পুরীতে চলে যান, রাজার আমন্ত্রণে। চৈতন্য যে পুরীতে গিয়ে আস্তানা গাড়লেন, সেটা বাসুদেবের সাহায্য ও প্রশ্রয় ছাড়া হতই না। প্রতাপরুদ্রের গুরুদেব তিনি, অতএব জগন্নাথ মন্দিরে এইবার এক বাঙালির প্রাধান্য শুরু হয়। পাণ্ডাচক্র বাসুদেবকে ভয় পেত। তিনি অকুস্থলে এসে চৈতন্যদেবকে না বাঁচালে জগন্নাথ মূর্তিকে আলিঙ্গনের অপরাধে প্রথম দিনই চৈতন্যকে পাণ্ডারা খুন করতে উদ্যত হয়েছিল।

গৌড়তন্ত্র কথাটা শশাঙ্কের রাজত্ব সম্পর্কে ব্যবহার করা হয়। আমরা যদি গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনকে বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে দেখব, এই আন্দোলনকেও গৌড়তন্ত্র বলা যায়। অনেকগুলো কারণেই বলা যায়, সেগুলো এর পরে এক এক করে লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছে আছে। এই আন্দোলন গৌড়ের মনীষাকে বাকি ভারতের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, গৌড়ের প্রজ্ঞার ছায়ায় মধ্যযুগের ভারতকে ধর্মসংস্কারে ব্রতী করতে পেরেছিল।

এবং এই গৌড় মানেই মুসলমান, ম্লেচ্ছ, পাণ্ডাদের কাছে। আজকের হিন্দুত্ববাদীদের মত সেযুগের পাণ্ডাও নিজের মলমূত্র ছাড়া আর কিছু ত্যাগ করত না, কাজেই মৌরসীপাট্টা ত্যাগ করার তো প্রশ্নই নেই। হরিদাসকে যারা কোনওদিন জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে দেয়নি, সে পাণ্ডাচক্র চৈতন্য আন্দোলনকেও গৌড়ের মুসলমান শাসকের ষড়যন্ত্র বলবে, এতে আর আশ্চর্যের কি! তবে একটা ব্যাপার হল, বাসুদেব আর চৈতন্য না হয় গৌড়ের মুসলমান শাসকের স্পাই, কিন্তু উড়িষ্যার বিপদ কি শুধু মুসলমান শাসকের কাছ থেকে আসছিল?

না।

প্রতাপরুদ্রের ওপরে তো বিজয়নগরের হিন্দু রাজা কৃষ্ণদেবও অনবরত আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। বারংবার পরাজয়ের পরে প্রতাপের পুত্র বন্দী হয়, প্রতাপকে এক অপমানজনক সন্ধির শর্ত মেনে নিতে হয়, তাঁর সুন্দরী বিদুষী কন্যা তুক্কা কৃষ্ণদেবের হারেমে স্থান পায়। তুক্কা ধর্ষিতা হয়েছিলেন কৃষ্ণদেবের হাতে। হিন্দুর হাতে ধর্ষিতা হলে সম্ভবত ধর্ষণের অপমানটা হয় না। আমি ব্যঙ্গ করছি বটে, কিন্তু গেরুয়া মর্কটদের শুধিয়ে দেখবেন, এরা অনেকে সত্যি সত্যিই এমন ভাবে। মস্তিষ্কে ঘিলুর জায়গায় গোবর থাকলে যা হয়।

বিশ্বহিন্দুরা আজ যেমন ইতিহাস পড়ে না, সেযুগের পাণ্ডাদের অনুগত চামচারাও নিশ্চয়ই অনুরূপভাবে নির্বোধ ছিল। চৈতন্যসহ গৌড়ীয়রা নাহয় মুসলমানের স্পাই (চৈতন্যের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে মাধব পটনায়কের প্রথম দুশ্চিন্তা, “গৌড়ীয় কদর্থ করিবে, ম্লেচ্ছ রাজাকে খর বলিবে”, অর্থাৎ বাঙালিরা কুকথা বলবে আর মুসলমান শাসককে গিয়ে উড়িষ্যার বিরুদ্ধে খ্যাপাবে)। তা বিজয়নগরে তো হিন্দু রাজা, সেই হিন্দু রাজ্যও তো উড়িষ্যাকে সেযুগে বিধ্বস্ত করতে ছাড়েনি। বিশ্বহিন্দুত্বের পলকা ফানুস সামান্য ইতিহাসজ্ঞান থাকলেই ফেটে চৌচির হয়ে যায়। উড়ে পাণ্ডা একদিন চৈতন্যকে হত্যা করেছিল, চৈতন্যহত্যার অনুসন্ধান করতে গেছিলেন যিনি, সেই লেখক জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে হত্যা করেছিল। আর আজ তাদের সরকারের মদতে একদল উড়ে মহোল্লাসে চর্যাপদ, জয়দেব, রসগোল্লা চুরি করছে। হ্যাঁ হে গেরুয়া, কোথায় আছে তোমাদের বিশ্বহিন্দুত্ব? কোন পাপোষের তলায়, কোন বিছানার নিচে লুক্কায়িত আছে?

(২)

পূজ্যপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। প্রথমে ব্রাহ্ম, পরে উনিশ শতকের বাংলার নববৈষ্ণব আন্দোলনের পুরোধা। পুরীতে ছিলেন, অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলেন, জগন্নাথ পাণ্ডারা পুনরায় শঙ্কিত, এবং উনি মারা যান মাত্র আটান্ন বছর বয়েসে। বিষপ্রয়োগে মৃত্যু? সেরকম একটা তত্ত্বই সামনে আসছে।

আবার, যেসময়ে চৈতন্য হত্যা নিয়ে প্রায় কোনও বাঙালিই ওয়াকিবহাল নয়, সেসময় বিজয়কৃষ্ণ নাকি চৈতন্য অন্তর্ধান নিয়ে মাথা ঘামাতেন, এবং এ নিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর উদ্দেশ্যে তাঁর আকুল প্রশ্ন ছিল, এ কথা বিজয়কৃষ্ণের শিষ্য কুলদানন্দ লিখে গেছেন সদগুরুসঙ্গ নামক পুস্তকে।

যদি বিজয়কৃষ্ণ বিষপ্রয়োগে পুরীতে মারা গিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে পাণ্ডাচক্রের ওপরে আমাদের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।

আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের একটা তীব্র বাঙালিবিদ্বেষী চক্র সেই মহাপ্রভুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই কুকাজগুলো করে বেড়াচ্ছে, অথচ বাঙালির কোনও তাপোত্তাপ নেই। আত্মবিস্মৃত জাতি কি বঙ্কিম সাধে বলেছেন!

এক ফেসবুক বন্ধু জানিয়েছেন বিজয়কৃষ্ণ জটিয়াবাবা বলে পরিচিত ছিলেন সেখানে সাধারণের মধ্যে। আবার পাণ্ডারা আধিপত্য ক্ষুন্ন হবার ভয়ে চক্রান্ত শুরু করে। একদিন মহাপ্রসাদ বলে একটি লাড্ডু নিয়ে এসে দেয় তারা। এবং তৎক্ষণাৎ সেটি খেতে বলে। বলে, এই মহাপ্রসাদ ফেলে রাখতে নেই।
তার পরই চূড়ান্ত অসুস্থতা। এবং মৃত্যু।

(৩)

চৈতন্যকে হত্যা করা হয়েছিল, এটা যারা কোনওমতেই মানতে চান না এমন যে কোনও বাঙালিকে জিগ্যেস করুন, যে মহাপ্রভুর অন্তর্ধান কি করে হল, তিনি বলবেন, ওই তো তিনটে মত আছে। ভক্ত বলে জগন্নাথে বিলীন, যুক্তিবাদী বলে পায়ে ইঁটের খোঁচায় মৃত্যু, এছাড়া পুরীর সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে মহাপ্রভু দেহত্যাগ করেছিলেন, ভক্তিবাদী ও যুক্তিবাদী দুজনেরই পছন্দের এই মতটাও আছে।

আউলিয়াচাঁদ তত্ত্ব ইজ নট রিয়েলি অ্যান অপশন, কাজেই ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই, আমিও যাচ্ছি না। যদিও জয়দেব মুখার্জি এবং মালীবুড়ো দুজনেই পরম ভক্তিভরে ওই তত্ত্বের এবং তার প্রোপোনেন্ট শান্তা মায়ীর উল্লেখ করেছেন, কিন্তু দুজনের কেউই ওটা মন থেকে বিশ্বাস করেন নি, করা যায়ও না (যারা জানেন না,

তাদের জন্যঃ চৈতন্য পুরী থেকে অন্তর্ধান করে আরও দুশো চুরাশি বছর বেঁচেছিলেন এবং কর্তাভজা সম্প্রদায়ের নেতা আউলিয়াচাঁদই চৈতন্য, এই মিথ হল আউলিয়াচাঁদ তত্ত্ব। এটা চৈতন্য হত্যা মানেন না এমন লোকেরা সাড়ে তিন নম্বর অপশন করতে পারেন, তবে অ্যাট দেয়ার ওউন রিস্ক)।

আশ্চর্য কথা হল, পুরীর সমুদ্রের জলে মহাপ্রভু বিলীন হয়েছিলেন, এটা বহুদিন ধরে প্রচলিত থাকলেও, আসলে কোনও বৈষ্ণব লেখক, মহাপ্রভুর কোনও জীবনীকারই কিন্তু এরকম লিখে যান নি, এবং এটা নিতান্তই রটনা। মহাপ্রভুর তিরোধান সমুদ্রে হয়েছিল কোনও জীবনীগ্রন্থ এমনটা বলেনি কোথাও।

দীনেশ সেন সর্বপ্রথমে এই ব্যাপারে আলোকপাত করেছিলেন, এবং এই মিথটিকে ভেঙেছিলেন তাঁর চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ বইতে। কোথাও লেখা নেই, তাহলে এই সমুদ্রের জলে মিশে যাওয়ার কথাটা চালু হল কেন এবং কিভাবে? উত্তর হল, কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদ হয়ে সমুদ্রের জলে একবার চৈতন্য ঝাঁপ দিয়েছিলেন এবং দীর্ঘক্ষণ পরে তাঁকে উদ্ধার করা হয়, এরকম বর্ণনা কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতে পাওয়া যায়। চৈতন্যজীবনী ভালোভাবে পড়া নেই, এরকম কোনও ব্যক্তিই সম্ভবত প্রথম এই সমুদ্রে বিলীন হওয়ার কথাটা চালু করেছেন। মেলভিল টি কেনেডি তাঁর ইংরেজি বই দ্য চৈতন্য মুভমেন্ট বইতে এই সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার তত্ত্বেই বিশ্বাস করেছেন, সেটা নেহাতই আনাড়ির মত কাজ হয়েছে। মেলভিলের অনুমাননির্ভর যুক্তি, আগেও তো একবার ঝাঁপ দিয়েছিলেন, সুতরাং পরেও দিয়ে থাকতে পারেন। আগেও তো পাণ্ডারা চৈতন্যদেবকে খুন করতে উদ্যত হয়েছিল দেখেছি লিপিবদ্ধ আছে, সেক্ষেত্রে পরেও সেরকমটা তারা করে থাকতে পারে, এরকম অনুমানও তো করা যায়, তাই না? কিন্তু মেলভিল অনুমানের ব্যাপারে নিতান্তই পাণ্ডাবাঁচোয়া। চৈতন্যদেব সমুদ্রে লীন হয়ে থাকলে সেটার আভাস কোনও না কোনও বৈষ্ণব গ্রন্থকার দিতেন, সেটা কিন্তু কোথাও নেই। দীনেশ সেন থেকে শুরু করে হালের মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল, সবাই সমুদ্রে বিলীন হওয়ার তত্ত্বকে খারিজ করেছেন।

অতএব, যারা চৈতন্যহত্যা মানেন না, তাদের অপশন তিন থেকে কমে দাঁড়ালো দুই। জগন্নাথ বিগ্রহে চৈতন্যদেব বিলীন হয়েছেন, আর ইঁটের টুকরোর খোঁচায় মৃত্যু হয়েছে। এই দুটো অপশনকে নেড়েচেড়ে দেখবেন? চলুন, দেখা যাক। জগন্নাথ বিগ্রহে রক্তমাংসের একটা মানুষ মিশে গেল, এরকম স্পেশাল এফেক্টে আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না, এক যদি না মন্দিরের (গুণ্ডিচাবাটী/জগন্নাথ মন্দির/তোটা গোপীনাথ মন্দির) ভেতরে চৈতন্যদেবকে পুঁতে ফেলার দিকেই ইঙ্গিতটা থেকে থাকে। সেক্ষেত্রে দ্বিমতের জায়গা নেই।

ইঁটের খোঁচায় সেপ্টিক হয়ে মারা যাওয়ার কথা শুধু দুজন বলেছেন। মাধব পটনায়ক, এবং মাধব পটনায়ককে অনুসরণ করে জয়ানন্দ।

আচ্ছা, ইঁটের খোঁচায় মারা গেলে মহাপ্রভুর মরদেহটি লোপাটের প্রয়োজন হল কেন, এবং মহাপ্রভুর অন্যান্য পরিকরদেরই বা রাতারাতি উধাও করা হল কেন?

চৈতন্য মহাপ্রভুর সমাধি দেখতে পাই না কেন পুরীতে? মহাপ্রভুর মরদেহটা কোথায় গেল? যদি অসুখে মৃত্যু হয়, মৃতদেহটি গুম করা হল কেন, কিসের ভয়ে?

(৪)

বাংলার কবিগান আর কবিয়ালদের নিয়ে একটা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি বা জাতিস্মর ফিল্ম যা উৎসাহ সৃষ্টি করে গেছে, সেরকমটা প্রবন্ধ লিখে করা যেত না। ঈশ্বর গুপ্ত (নিজেও কবিগান বাঁধতেন এককালে) বাংলার কবিয়ালদের ইতিহাস প্রথম লিখে রাখেন, তিনি না লিখে রাখলে এগুলো কিচ্ছু পেত না পরবর্তী প্রজন্ম। তবে ঈশ্বর গুপ্তের লেখা কবিওয়ালাদের ইতিহাসের কথা আজ প্রায় কেউ জানে না। কারণ ইতিহাস লোকে পড়ে না, কিন্তু ফিল্ম দেখে। ফিল্ম সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টা পৌঁছে দিয়েছে।

সেরকম ভূমিকাই পালন করেছে চৈতন্য হত্যা নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলো। সবাই উল্লেখ করেন কালকূটের জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্যর, সেটি চৈতন্যহত্যা নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস, এরকমই শুনেছি এতদিন। এরপরে কাঁহা গেলে তোমা পাই, জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের। রূপক সাহার ক্ষমা করো হে প্রভু খুব সাম্প্রতিককালে। অভিজিত তরফদারের গতবছর শুকতারায় প্রকাশিত লেখাটা খুবই কাঁচা তাই ধর্তব্য নয়।

চৈতন্যহত্যা নিয়ে আর কি কোনও উপন্যাস লেখা হয়েছে এখনও পর্যন্ত? আমার মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে।

আমি জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য সম্প্রতি পড়তে শুরু করেছি। পড়তে গিয়ে বেশ চমকে উঠলাম। তুহিন মুখোপাধ্যায় আর মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল – দুজনেই তাদের স্টাডিতে বলছেন যে কালকূট চৈতন্যকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। কালকূট কিন্তু উপন্যাস লেখেন নি। সাল তারিখ দিয়ে রীতিমত ইতিহাস লিখেছেন। স্রেফ তথ্যপঞ্জী দেন নি বলে সেটাকে উপন্যাস বলা যায় না, বরং এ লেখাটা পপুলার হিস্ট্রির পর্যায়ে পড়ে।

কালকূট ছদ্মনামে সমরেশ বসু উপন্যাস লিখেছেন অনেক, এবং জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্যকেও উপন্যাস ভেবে নেওয়ার প্রবণতা সেখান থেকেই এসেছে। যেমন ধরা যাক, নীললোহিতের লেখা মানেই আমরা যেমন ধরে নেব ভ্রমণ-কাহিনী। কিন্তু কালকূটের এই লেখাটা তথ্যভিত্তিক ইতিহাস, আমি পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।

এই “উপন্যাসে”র শুরুতে লেখক কি বলছেন দেখুন।
“সুলতান হোসেন শাহের আমলে হিন্দু বাঙালীদের প্রতি কী রকম আচরণ করা হত সে-সব ঘটনা আমাকে নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করতে হবে। আমাকে নিজেকে কিছু বানিয়ে বলতে হবে না। কারণ এখন আমি গৌড়-বঙ্গের সেই স্বাধীন সুলতানদের আমলেই চলেছি। আমি কালকূট। আমার পক্ষে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক নিয়ে

সাম্প্রদায়িকতা করার কোন দরকার নেই। কারণ কালকূটের কোনও জাত নেই। সম্প্রদায় নেই। যে-পথেই তার যাত্রা হোক, পাদভৌম ধুলা পথে, অথবা ইতিহাসের পাতায়, বুকের জ্বালা নিবারণের জন্য, সে তার হলাহলকে অমৃতে পরিণত করতে চায়।”

এটা পড়ে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে কালকূট ইতিহাস লিখছেন, কল্পকাহিনী নয়। হ্যাঁ, ইতিহাস লেখার পাদটীকা কণ্টকিত নিয়ম না মেনে, ফিকশন লেখার সহজবোধ্য চালেই লিখে গেছেন। কিন্তু ইতিহাসবিদের একটা প্রয়োজনীয় কোয়ালিটি হল কবিত্বগুণ, কলহন তো বলেই গেছেন।

(৫)

নরসিংহ নাড়িয়াল নামটা যদি আপনার চেনা চেনা না লাগে, তাহলে আশ্চর্যের কিছু নেই। রাজা গণেশের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। নরসিংহ নাড়িয়াল ছিলেন এই রাজা গণেশের মন্ত্রী, যার সু(বা কু, ডিপেন্ডিং অন দ্য পার্সপেকটিভ)পরামর্শে গণেশ সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন,ফলে মধ্যযুগে গৌড়ে অবিচ্ছিন্ন মুসলমান শাসনের মাঝখানে হিন্দু শাসন শুরু হয়েছিল।

এই নরসিংহ নাড়িয়াল ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের পূর্বপুরুষ, ঈশান নাগরের অদ্বৈত প্রকাশ গ্রন্থে জানা যাচ্ছে। নরসিংহ শ্রীহট্টের মানুষ, পরে গৌড়ের রামকেলিতে চলে আসেন। গণেশ নামটাই তুর্কো-পাঠানদের কাছে প্রচণ্ড ধিক্কৃত, সুফি ধর্মগুরুরা গণেশের বিরুদ্ধে পবিত্র জেহাদের ডাক দিয়েছিলেন। কাফের হয়ে সিংহাসনে চেপে বসা নিতান্তই অনাসৃষ্টি ব্যাপার। সেই গণেশের রাজকাণ্ডের নাটের গুরু ছিলেন নরসিংহ নাড়িয়াল।

হুসেন শাহের সময়ে একটা গুজব উঠেছিল যে নবদ্বীপের কোনও ধনুর্ধারী ব্রাহ্মণ গৌড়ের রাজা হবে। ফলে প্রচণ্ড অত্যাচার শুরু হয় নবদ্বীপে। যদিও এর পরে সেই অত্যাচার কিঞ্চিত প্রশমিত হয়েছিল, কারণ অনেককে মেরেও তীরধনুকের খোঁজ মেলেনি। এখন নরসিংহর বংশধর অদ্বৈত আচার্য যে বৈষ্ণব আন্দোলনের নেতা, তার সম্বন্ধে নতুন করে গুজব ছড়ানোর সম্ভাবনা আশ্চর্য নয়! চৈতন্যকে যে রামকেলি থেকে উড়িষ্যায় পাঠিয়ে দেওয়া হল, তার কারণ অবশ্যই বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলন সেযুগের ইসলামিক শাসকের কাছে একটা থ্রেট।

লক্ষ্য করুন, শাক্তরা কিন্তু থ্রেট ছিলেন না। সেযুগের শাক্তরা কোনও সংগঠিত জনআন্দোলনের ধার তো ধারতেনই না, ওদের প্রবণতা ছিল গুপ্তসাধনার দিকে। উপরন্তু নিজেরাই অনেক সময়ে বিজাতীয় শাসকের সঙ্গে মিশে দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করতেন। জগাই মাধাই চৈতন্য নিত্যানন্দের শ্রীচরণে ঠাঁই নেওয়ার আগে শাক্ত ছিলেন।

অদ্বৈতে ফিরি। অদ্বৈত আচার্যর বংশ বাংলার ইতিহাসে, বাঙালি মানসে যে স্থান অধিকার করে আছে, দুর্ভাগ্যের বিষয় ইতিহাসবিদ প্রায়ই সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করতে অক্ষম হন। পূজ্যপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কথা এর আগে একদিন বলেছিলাম। অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখছেন, তিনি অদ্বৈতর বংশধর শুনে বৃন্দাবনে এক মৃতপ্রায় বাঙালি বৃদ্ধ তাঁর পা জড়িয়ে ধরে আধঘণ্টা ধরে হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন, সে বর্ণনা দীনেশ সেনের বৃহৎ বঙ্গে আছে, পড়লে চক্ষু বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই লেভেলের জনপ্রিয়তা, আমাদের বৈষ্ণব নায়কেরা যেরকম পেয়েছেন, তাতে প্রমাণিত, এই জাতির নেতৃত্ব তাঁরাই করে আসছেন মধ্যযুগ থেকে।

চৈতন্য আন্দোলনের যে চেতনা, তা অবশ্যই রাজনৈতিক। চৈতন্য হত্যাকে এইজন্য রাজনৈতিক হত্যা হিসেবেই দেখতে হবেঃ চৈতন্য হত্যা একটা আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক হত্যা। এবং আমার স্টেটাস পড়ার পরে এই প্রশ্নটা বারবার করেন অনেকে, আর আমাকেও বারবারই উত্তর দিয়ে যেতে হয়, এই উত্তর আবার তাই দিচ্ছি। হিন্দু হলেই বাই ডিফল্ট বাঙালি হয় না, মুসলমান হলেই বাঙালিত্ব-বিচ্যুত হয় না। যবন হরিদাসের ইতিহাস পাঠ করেও এ কথা যে বোঝেনি, তাকে বোঝানোর চেষ্টাই পণ্ডশ্রম। চৈতন্য আন্দোলনের শত্রু যতটা ইসলাম, ততটাই পাণ্ডা-হিন্দুত্ব, সে আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ করলেই বোঝা যাচ্ছে।

নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে মিশন নেতাজি বলে একটা সংগঠন তৈরি হয়েছিল, অনুজ ধর তারপরে দুর্দান্ত কিছু বই লিখেছেন। মুখার্জি কমিশন হয়েছিল, তাতে অনেক অজানা তথ্য সামনে এসেছিল। খুব সম্প্রতি ডিক্ল্যাসিফিকেশনও হয়েছে কিছু।

চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে কোনও মিশন চৈতন্য জাতীয় কিছু যে আজও তৈরি হয়নি, হতে পারেনি, সেটা প্রমাণ করে, যে গান্ধী পরিবার, কংগ্রেস দল আর আনন্দবাজারের মিলিত শক্তির থেকেও পাণ্ডাচক্র এবং চৈতন্যবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী লবি অনেক বেশি ভয়ানক, অনেক বেশি বিপজ্জনক।

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৬ই এপ্রিল ২০২০

চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে – তমাল দাশগুপ্ত

কয়েক বছর আগে আমি চৈতন্য হত্যা নিয়ে লেখার পর থেকে বিষয়টা নিয়ে একাধিক রচনা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি সম্পর্কে হতাশ হলেও একথা মুক্তকণ্ঠে বলব, কলকাতা থেকে গত সাত আট বছরে চৈতন্য হত্যা বিষয়ক অন্তত দশটি উচ্চমানের গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায়, বাঙালিরা বিষয়টি নিয়ে ক্রমেই আগ্রহী হচ্ছে। সিপিএম জমানা শেষ হল, বাঙালি তার কমিউনিস্ট নিশ্চয়তা হারালো, এবং চৈতন্যকে পুনরাবিষ্কার করল, ব্যাপারটা এত সোজা আমি বলছি না। গত দেড়শো বছর ধরেই বাঙালি চৈতন্যকে আবিষ্কার করছে। বঙ্কিম প্রথম বলেছিলেন, যে চৈতন্যের সময় বাঙালির প্রথম রেনেসাঁস। শিশির ঘোষের অমিয় নিমাই চরিত একটি ম্যাগনাম ওপাস, তার পর থেকে বাঙালি ক্রমশঃ নিজের বৈষ্ণব শেকড় নিয়ে অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছে। দুর্ভাগ্য যে মেনস্ট্রিম বিশ্বমানবিক অ্যাকাডেমিয়ায় এ বিষয় নিয়ে এখনও সেমিনার ওয়ার্কশপ সেভাবে হতে দেওয়া হয় না, কিন্তু অবস্থাটা অবশ্যই পাল্টাবে। আমরা সপ্তডিঙার পক্ষ থেকে সেই উদ্দেশ্যে তো কাজ করছি। বিজেপির আপদগুলো ঘাড়ের ওপরে এসে নিয়মিত দেশজুড়ে গোবর এবং গণেশ নিয়ে ঘটা করে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক সম্মেলন না করলে আমাদের কাজটা আরও সোজা হত, কিন্তু কি করা যাবে।

চৈতন্যহত্যার অনুসন্ধানে সংক্রান্ত আমার লেখাটা ইন্টারনেটে আছে। কিন্তু চৈতন্যহত্যা পোস্টস্ক্রিপ্ট বলে একটা লেখা তৈরি করেছিলাম, আমার ফেসবুক দুটি প্রোফাইল গতবছর ডিজেবল হওয়ার পর সেটা আর কোথাও সহজলভ্য নয়। সেটা এই পেজে দেব এবার।

চৈতন্য আন্দোলনের বাঙালি জাতীয়তাবাদী পাঠ রচনা করার অনেকদিনের পরিকল্পনা। সে কাজ এবার শুরু করছি। তার গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে নিজেরই পুরোনো লেখা একটু ফিরে দেখছি।

চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে আরেকবার রইল। একটু পরে চৈতন্য হত্যা পোস্টস্ক্রিপ্ট দিচ্ছি।

http://bongodorshon.blogspot.com/2017/08/blog-post.html

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৬ই এপ্রিল ২০২০

সপ্তসংঘর্ষে সাহিত্যসম্রাট – তমাল দাশগুপ্ত

সপ্তসঙ্ঘর্ষে সাহিত্যসম্রাট

বঙ্কিম তাঁর সারা জীবনে অনেকগুলি আদর্শগত যুদ্ধ করেছেন। বঙ্কিমকে নিয়ে গবেষণা সেভাবে হয়নি, যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হয়েছে। আমি আজ বঙ্কিমজীবনের সঙ্ঘর্ষগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত সংকলন করব এখানে।

১। ১৮৮২ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতার বাঙালি ভদ্রলোকরা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেন। রেভারেন্ড হেস্টি নামক এক ক্রিশ্চান মিশনারির এতে মর্মান্তিক হয়। তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি, পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত এতগুলি এনলাইটেনড বাঙালি কিভাবে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটা রিচুয়াল অর্থাৎ শ্রাদ্ধে যোগদান করল। ফলত, হেস্টি একটি থান ইঁট ছুঁড়লেন এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে, ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ রচনা করলেন। এতে হিন্দুধর্মের মূর্তিপুজোকেও আক্রমণ করেন। হিন্দুধর্মকে মন্সট্রাস বা দানবিক আখ্যা দেন, হিন্দু দেবদেবী বিশেষত শাক্ত মাতৃকাদের পার্সনেশন অভ ইভিল বা মূর্তিমান অশুভ আখ্যা দেন, এবং হিন্দুধর্মকে সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন অভ ডিজিজ বা মানসিক রোগ আখ্যা দেন। বঙ্কিম এর কড়া প্রত্যুত্তর দেন। প্রথমে ছদ্মনামে (সরকারি চাকুরে ছিলেন) কিন্তু বিষয়টা গোপন ছিল না। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এবং কপালকুণ্ডলার লেখক হিসেবে পত্রলেখককে চিহ্নিত করেন। পত্রযুদ্ধ হয়েছিল স্টেটসম্যান কাগজে। বঙ্কিম এই পত্রযুদ্ধের শেষ পত্রে স্বনামে সাক্ষর করেছিলেন।
দুঃখের বিষয় সাধারণ বাজারচলতি বঙ্কিম রচনাবলী যেগুলোর দুটো খণ্ড থাকে, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাতে বঙ্কিমের এই ইংরেজি পত্রপ্রবন্ধগুলি সংকলিত হয় না। তবে সুখের কথা সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বাংলা আকাডেমি ছয় খণ্ডে বঙ্কিম রচনাবলী যেটা প্রকাশ করেছে তাতে বঙ্কিমের সমস্ত ইংরেজি লেখা আছে, এবং এই পত্রগুলোও আছে।

২। কৈলাস চন্দ্র সিংহ নামটা আজ প্রায় বিস্মৃত। ইনি আদি ব্রাহ্ম সমাজের বেতনপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন, এবং ছিলেন একজন বঙ্কিম-বিদ্বেষী। বঙ্কিমের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি বিতর্ক হয়েছিল, যে প্রসঙ্গে পরে আসব। সেক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ বিতর্কে প্রবেশ করার আগে এই কৈলাসই প্রথম গুলিগোলা চালাতে শুরু করেন বঙ্কিমের বিরুদ্ধে। কৈলাসের অনেক অভিযোগ বঙ্কিমের বিরুদ্ধে। বঙ্কিমের নিজস্বতা নেই, বঙ্কিম নাকি অন্যের গবেষণা থেকে চুরি করেন, বঙ্কিম গুরুগিরি করেন, বঙ্কিম নেহাত অনুবাদের ওপরে নির্ভর করে কাজ করেন, ইত্যাদি অনেক কুৎসা করেন কৈলাস। কিন্তু এগুলো বাহ্য। আসলে কৈলাস একটা ব্রাহ্ম আতঙ্ককে রিপ্রেজেন্ট করছেন। বাংলার তান্ত্রিক, শাক্ত, বৈষ্ণব হিন্দুধর্মের একটা পুনরুত্থান ঘটছে। বঙ্কিম বলছেন হিন্দুধর্মের শেকড়ে সাংখ্য, এবং সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে আমাদের হিন্দু ধর্ম – সেই প্রকৃতি বৈষ্ণবের রাধা, সেই প্রকৃতি শাক্তের কালী। অর্থাৎ অলিখিত সাব টেক্সটঃ যে বেদ, যে বেদান্ত নিয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলন এত মুগ্ধ, সেটা আসলে বাংলার হিন্দুধর্মের শেকড়ই নয়। ফলত, কৈলাসের বঙ্কিম দূষণ।
প্রসঙ্গত, কৈলাস খানিকটা যাকে বলে কন্সটিপেটেড লোক ছিলেন। কেবল বঙ্কিমদ্বেষী তিনি নন। প্রসঙ্গান্তরে তিনি বাঙালির ইতিহাসের অন্যান্য দিকগুলির প্রতিও বিদ্বেষ দেখিয়েছেন, তবে তা নিয়ে আজ আলোচনার প্রয়োজন নেই।
বঙ্কিম একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিধ্বংসী প্রবন্ধে (আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়) কৈলাসকে ভৃত্য ও নায়েব আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি খণ্ডন করেন।
৩। রামগতি ন্যায়রত্ন। এঁকে আমরা ancient regime বা রক্ষণশীলতার প্রতিভূ ধরতে পারি। বঙ্কিম সম্পর্কে একটা মিথ হল যে বঙ্কিম রক্ষণশীল ছিলেন। না। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছিলেন। জাতীয়তাবাদ কিন্তু রক্ষণশীলতা নয়। যেমন বঙ্কিমকে একবার জিগ্যেস করা হয়েছিল, যে সাগরপাড়ি দেওয়া সম্পর্কে শাস্ত্র-নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তিনি কি ভাবছেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। যদি মনে কর তাতে ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখো না।
বঙ্কিম সম্পর্কে মিথ নিয়ে আজ আলোচনা করছি না, সেটা আরেকদিনের জন্য তোলা থাকল। কিন্তু বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রোক্তি-নির্ভর সমাজসংস্কার সম্পর্কেও বঙ্কিমের আশ্চর্য রকমের মুক্তমনা উক্তি ছিল, যদি মনে করি তাতে আমাদের জাতির ভালো হবে, তো শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। বস্তুত বঙ্কিমের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের একটি তাত্ত্বিক সঙ্ঘর্ষ হয়েছিল। কিন্তু সেটা বিধবা বিবাহ নিয়ে নয়। বিধবার যে বিয়ে দেয় সে যদি পণ্ডিত হয় তাহলে মূর্খ কে, এই মর্মে তাঁর উপন্যাসে একটি চরিত্রের উক্তি কোনও তাত্ত্বিক অবস্থান নয়, চরিত্রের উক্তিকে লেখকের উক্তি বলে ভাবা অশিক্ষিতের কাজ। কাজেই বিধবা বিবাহ নিয়ে বঙ্কিমের বিরুদ্ধতা তাতে প্রমাণ হয় না। বরং অন্যত্র বঙ্কিম উল্টোটাই বলেছেনঃ হিন্দু বিধবার পুনরায় বিবাহের অধিকার থাকা উচিত, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে গেছেন বঙ্কিম। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে যে বিষয়ে বঙ্কিমের প্রকৃত বিতর্ক হয়েছিল, সেটা ছিল বহুবিবাহ নিবারণে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রোক্তি-নির্ভরতা। বঙ্কিম কিন্তু বহুবিবাহ সমর্থন করেন নি একবারও। বরং বিরোধিতাই করেছেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, যদি বহু বিবাহ নিবারণ করতে হয়, তাহলে শাস্ত্র দেখার দরকার নেই। এবং বাংলার অর্ধেক মুসলমান (সেযুগে অর্ধেক)। যদি বহু বিবাহ নিবারণ করতে হয়, তাহলে তাদের জন্যও করা হোক, তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত শাস্ত্রোক্তি-উদ্ধৃত করা পণ্ডিত কেউ আসেন নি বলে তাদের মেয়েরা সতীনজ্বালা ভোগ করবে, আর হিন্দুদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত শাস্ত্রজ্ঞ এসেছেন বলে হিন্দুদের মেয়েরাই কেবল উদ্ধার হবে, এটাকে বঙ্কিম একচোখোমি বলেছেন।
প্রসঙ্গে ফিরি। রামগতি ন্যায়রত্ন বিদ্যাসাগরি বাংলার সমর্থক ছিলেন। যারা বঙ্কিমি বাংলাকে দুরূহ ভাবেন, তারা বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ছাড়া আর কিছু পড়েন নি। বস্তুত বঙ্কিমের বাংলা সেযুগে এক বিপ্লব, এবং বিদ্যাসাগরের বাংলাই ছিল দাঁতভাঙা। বঙ্কিমকে বিদ্যাসাগর দুবার ফেল করিয়েছিলেন বাংলা পরীক্ষায়। কিন্তু সে ফেল বঙ্কিম দাঁতভাঙা বাংলা লিখতেন বলে নয়। বঙ্কিম সেযুগে ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্য, প্রথমে হুগলি কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্কিমের পরীক্ষার খাতায় তাঁর বাংলা সেযুগে বিদ্যাসাগরের কাছে অতিরিক্ত র‍্যাডিক্যাল প্রতিভাত হয়েছিল নিঃসন্দেহে।
রামগতির আপত্তি ছিল প্রচলিত কথ্য ভাষা কেন অনুপ্রবেশ করবে বাংলা সাহিত্যে। কারণ এই ভাষা তো দুই ভ্রাতা অথবা পিতা পুত্র একসঙ্গে বসে পাঠের অযোগ্য। বঙ্কিম এই অবস্থানকে ল্যাম্পুন করে, ব্যঙ্গ করে একটি প্রবন্ধে দেখান, যে শুদ্ধ সংস্কৃতে দুই ভাই অথবা পিতা-পুত্র আলোচনা করলে সেটা কি ভীষণ বিষম লাগার মত ব্যাপার হবে।
৪। চণ্ডী চরণ সেন। ইনি কৃষ্ণনগর আদালতের মুন্সেফ ছিলেন। একটি রায়দানে তিনি লেখেন, ৯৯% বাঙালি বিধবা চরিত্রহীন হয়। বঙ্কিম অতি সংক্ষিপ্ত একটি প্রত্যুত্তর লিখেছিলেন। তাতে একটা রসিকতা স্মরণ করেছিলেন। গুরু এসেছে শিষ্যবাড়িতে। শিষ্য দশখানা বড় বড় কই ধরে এনে ঝোল রেঁধেছে অতি উপাদেয়। গুরু খেতে শুরু করে লোভে পড়ে ন’খানাই খেয়ে ফেললেন। মোটে একখানা কই পড়ে আছে দেখে শিষ্য তখন হতাশ স্বরে গুরুকে বলেছিল, ওটি আর দয়া করে রাখলেন কেন, ওটিও খেয়ে নিন। বঙ্কিম ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ওই এক শতাংশ বাঙালি বিধবাকে আর কেন বাকি রাখলেন, একটি নতুন রায় লিখে তাতে ওই এক শতাংশকেও টেনে নিন চণ্ডীবাবু।
মূর্খ বাঙালির স্বজাতিবিদ্বেষের সংক্ষিপ্ত প্রত্যুত্তর কিভাবে দিতে হয়, বঙ্কিম এভাবে শিখিয়েছেন।
৫। যুবক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রৌঢ় বঙ্কিমের একটি বিতর্ক ঘটেছিল। বিতর্কের বিষয় ছিল সত্য। ব্রাহ্মরা সেযুগের ভিক্টোরীয় চিন্তাধারায় বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন, এবং সত্যকে একটি ধ্রুব গুণ মনে করতেন। বঙ্কিমের চিন্তা এক্ষেত্রে ছিল বৈপ্লবিকঃ তিনি বলছেন সত্য আপেক্ষিক। কথাটা অবশ্য নতুন নয়। প্রি-রোম্যান্টিক কবি উইলিয়াম ব্লেকের বড় মনোরম পংক্তি আছে এ প্রসঙ্গেঃ আ ট্রুথ টোল্ড উইদ ব্যাড ইন্টেন্ট, ইজ ওয়ার্স দ্যান অল লাইজ ইউ ক্যান ইনভেন্ট। অর্থাৎ যতগুলি মিথ্যা তুমি কল্পনা করতে পারো তাদের সবার থেকে খারাপ হল, খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে বলা একটি সত্য। প্রাচীন ভারতেও এরকম একটা নীতি ছিল। সত্য প্রকাশ করে একজন মুনিকে নরকস্থ হতে হয়েছিল, কারণ তাঁর সত্যনিষ্ঠার জন্য একজন প্রাণ হারিয়েছিল। কৃষ্ণচরিত্রে বঙ্কিম এই ঘটনাটি তুলে ধরে সত্য ও মিথ্যার আপেক্ষিক চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। আমাদের সত্য অনেকটা পুরোনো ইংরেজি শব্দ troth এর মত, বঙ্কিম বলেন। অর্থাৎ সত্য এবং truth এক নয়। একইভাবে আমরা অবশ্য জানি, ধর্ম আর religion এক নয়, যাই হোক।
এই সত্য নিয়ে বঙ্কিমকে আক্রমণ করে আদি ব্রাহ্ম সমাজ। প্রথমে বেতনভূক কৈলাস, তারপরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অবতীর্ণ হন। এ বিতর্কে বঙ্কিমকে হারাতে পারেন নি রবীন্দ্রনাথ। এবং ব্রাহ্মদের ট্রুথ কাল্ট যে ইংরেজের অন্ধ অনুকরণ, তা আমাদের দেশজ ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত, এ ঐতিহাসিক নির্ণয় করেছিলেন বঙ্কিম।
৬। এই নামটি বড় আশ্চর্যের। ঈশ্বর গুপ্ত।
আসলে, বঙ্কিম তাঁর গুরু ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর পরে কিছুটা সময় ইংরেজপ্রেমী এবং হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন। ভিক্টোরিয়ান চিন্তাভাবনা তাঁর যুগধর্ম ছিল, এবং যতদিন না এরপর তিনি তাঁর যুগযন্ত্রণা অনুভব করেন এবং শেকড়ে ফেরার উদ্যোগ নেন, এই মাঝের সময়টা তিনি ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন। শুধু ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি নয়। রাজমোহন’স ওয়াইফ গ্রন্থে দেখবেন তিনি ক্র্যাব লাইক ফিগার অভ দুর্গা এবং গ্রিম ব্ল্যাক ফিগার অভ কালী লিখেছেন। বঙ্কিম একটা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, পশ্চিমি প্রভাব আসছিল। বাদবাকি শিক্ষিত বাঙালির মত বঙ্কিমকেও গ্রাস করছিলেন মেকলে। প্রসঙ্গত, বঙ্কিম যখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলেন, প্রায় সেই সময়েই ঈশ্বর গুপ্ত মারা যান। ২৩শে জানুয়ারি ১৮৫৯। এর মাত্র বছরখানেক আগে বঙ্কিম গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন।
ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে বঙ্কিম বলেছেন, তিনি খাঁটি বাঙালি কবি ছিলেন, খাঁটি বাঙালি কবি আর জন্মায় না, জন্মানোর উপায় নেই, জন্মে কাজ নেই। শেষ বয়সে তিনি ঈশ্বর গুপ্তের লেখার সংকলন করেন, এটি তাঁর গুরুদক্ষিণা ছিল সম্ভবত। কিন্তু মাঝের সময়টায়? বঙ্কিম তাঁর একটি ইংরেজি প্রবন্ধে ঝাঁজালো ভাষায় স্বর্গত একদা-গুরুকে আখ্যা দিয়েছেন অনৈতিক, অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। ঈশ্বর বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানতেন না, সেজন্যও সমালোচনা করেছেন। ঈশ্বরের মতামত ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং সংকীর্ণ। কবির যে উচ্চতর গুণ থাকা উচিত তার কিছুই ছিল না। ভাষা ছিল অভদ্র, কৃষ্টিবিহীন। মোটা দাগের অশ্লীলতা ছিল তাঁর লেখা কবিতায়। সৌভাগ্যের কথা কবি ঈশ্বর গুপ্ত দ্রুত বিস্মৃত হচ্ছেন, বঙ্কিম লিখেছেন।
ভিক্টোরিয়ান বঙ্কিমকে এখানে খুঁজে পাচ্ছি আমরা। প্রৌঢ় বয়সে বঙ্কিমকৃত ঈশ্বর গুপ্ত রচনা সংকলনের ভূমিকা দেখলে বোঝা যায়, বঙ্কিম তাঁর মতামত অনেকাংশে পাল্টেছেন। পরিণত বঙ্কিমের লেখা ঈশ্বর গুপ্ত-অনুরাগী ভূমিকা বহুলপ্রচারিত, ইংরেজিতে যুবক বঙ্কিমের ঈশ্বর-বিদ্রোহ আমরা ভুলে গেছি। বঙ্কিম ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শুরু করেছেন। পশ্চিমি এনলাইটেনমেন্ট হয়ে, মেকলে হয়ে তবে পুনরায় ফিরেছেন ঈশ্বরে। এঁকে বলে ফুল সার্কল।
৭। ইংরেজ। আজকের আলোচনায় শেষ বঙ্কিম সঙ্ঘর্ষ।

আনন্দমঠ লিখে বঙ্কিম ইংরেজের বিষদৃষ্টিতে পড়েন, এবং এজন্য প্রথম সংস্করণের ইংরাজ-ভাঙিতেছে-চলো-আক্রমণ-করি পালটে গিয়ে নেড়ে-ভাঙিতেছে-চলো-আক্রমণ -করি হয়ে যায়। এই উপন্যাস লেখার ফলে বঙ্কিমের ডিমোশন হয়েছিল চাকরিতে, বারবার অপমানজনক ও শাস্তিমূলক বদলি শুরু হয়। আনন্দমঠ যে ইংরেজের বিরুদ্ধে লেখা নয়, এই মর্মে একটি শংসাপত্র যোগাড় করতে বাধ্য হন কেশব সেনের ভাইয়ের কাছ থেকে (সেযুগের ভারতীয়দের মধ্যে কেশব সেন সবথেকে বেশি ইংরেজের আস্থাভাজন ছিলেন)। কিন্তু ইংরেজের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ শুধু আনন্দমঠে হয়নি। ইংরেজের বিরুদ্ধে ও ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বঙ্কিমের লেখা বারবার লড়াই করেছে। এশিয়াটিক রিসার্চের নামে সাহেবদের কাণ্ডকারখানার বহু সমালোচনা তিনি করেছেন। ইংরেজের নীতি ছিল বাঙালির মধ্যে বিশ্বমানবতা ও স্বজাতিবিদ্বেষ তৈরি করা (আজও আমাদের শিক্ষানীতি সেটাই করছে বাস্তবিকপক্ষে), বঙ্কিম তার বিরুদ্ধে বারবার লেখনী ধরেছেন। চাকুরিজীবনে ইংরেজের দ্বারা বহুবার অপমানিত হয়েছেন বঙ্কিম, সেজন্যই রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, তিনি ইংরেজের জুতোর চোটে বেঁকে গেছেন। বঙ্কিম কম্প্রাদর শ্রেণী থেকে এসেছিলেন। তাঁর বাবাও ইংরেজের কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম যে স্বজাতির পক্ষ বেছে নিলেন, তাতে তাঁর শ্রেণীগত অবস্থানের সঙ্গে তাঁর আদর্শগত অবস্থানের একটা যুদ্ধ হয়, সে যুদ্ধের ফল তাঁর মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়ে মৃত্যু।

বঙ্কিম দীর্ঘজীবী হোন। তাঁকে পাঠ করার প্রয়াস আমি এবং আমরা জারি রাখব।

© তমাল দাশগুপ্ত

আমার একটি ইংরেজি প্রবন্ধ আছে যথাক্রমে বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের পৃথক পৃথক সাতটি আদর্শযুদ্ধ নিয়ে, সেটা জার্নাল অভ বেঙ্গলি স্টাডিজে প্রকাশিত হয়েছিল, এই লিঙ্কে গিয়ে পড়তে পারেন https://bengalistudies.blogspot.com/2018/03/jbs-vol-6-no-1-age-of-bhadralok-bengals.html

ছবিঋণ ঋতু

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৫ই মার্চ, ২০২০

চৈতন্য আন্দোলন: ধর্মীয় না বিপ্লবী? – তমাল দাশগুপ্ত

চৈতন্যের জীবদ্দশায় তাঁর এই একটিই ছবি আঁকা হয়েছিল।

চৈতন্য আন্দোলনঃ ধর্মীয় না বিপ্লবী?

আউল-বাউল কথাটা এসেছে আকুল-ব্যাকুল থেকে। আজকের আলোচনায় এই আউল-বাউল শব্দটি আমাদের দিকনির্দেশ করতে চলেছে, তাই প্রণিধান করুন। এবার প্রসঙ্গে আসি।

চৈতন্য আন্দোলন সম্পর্কে এরকম কথাও বলা হয়েছে যে আসলে উনি ছিলেন একজন বিপ্লবী, বৈষ্ণব ধর্ম ছিল ছদ্মবেশ। পুরোটাই রাজনৈতিক আন্দোলন, বাংলায় বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস। মানে বৈষ্ণবরাই মধ্যযুগের বলশেভিক আর কি।

এরকম একটা কথা অনেক চৈতন্য জীবনীতে লেখা হয়, ঠিক এভাবে লেখা না হলেও এই স্পিরিটে বক্তব্য রাখা হয়।

এখন, শুনুন। ঠিক এই কথা, ঠিক এই কথাটাই যীশু সম্পর্কেও বলা হয়েছে। যে উনি আসলে ছিলেন বিপ্লবী, ধর্মের বেশে সমাজবিপ্লবী। বস্তুত চৈতন্য আন্দোলনকে বিপ্লবী প্রমাণ করতে চাওয়ার পেছনে এই পশ্চিমী তত্ত্বের প্রভাব আছে যে যীশুও বিপ্লবী ছিলেন।

যীশুর ধর্ম আন্দোলন কি নিছক বিপ্লবী? না, এ আসলে সরলীকরণ। টেরি ইগলটনের একটা সুন্দর লেখা (সেটা আসলে ওর সম্পাদনা করা ক্রিশ্চান গস্পেলের ভূমিকা) আছে এই নিয়ে, ভার্সো থেকে বেরয়।

তাতে ইগলটন বলছেন, যীশু সত্যি ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন, তার সম্পূর্ণ আস্থা ছিল আব্রাহামিক পরমপিতার ওপরে। কাজেই এদিক থেকে তিনি বিপ্লবীরা যা হয় (যুক্তিবাদী, বাস্তববাদী, প্ল্যানমাফিক), তার তুলনায় বেশ খানিকটা কমই ছিলেন, একটা ডিসপ্লেসমেন্ট ছিল বলা যায়।

কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন এক আমূল পরিবর্তনে, বিপ্লবীদের মত স্রেফ অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, উনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীতে অন্যরকম মানুষ আসবে, কারণ শেষবিচারের দিন আসন্ন। বিপ্লবীরা আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের কথা বলেন না, যীশু যেহেতু বলতেন, এই হিসেবে তিনি বিপ্লবীরা যা হয় তার তুলনায় বেশ খানিকটা বেশিই ছিলেন, অর্থাৎ এক্ষেত্রেও বিপ্লবের লোগোসকে যীশু খানিকটা ডিসপ্লেস করেছেন।

ইগলটনের বিখ্যাত উক্তি, Jesus was both more and less than a revolutionary.

চৈতন্য সম্পর্কেও এরকম একটা কথা আমি বলতে চাই। চৈতন্য বিপ্লবী ছিলেন না। তিনি বিপ্লবীর থেকে খানিকটা বেশি ছিলেন। আবার বিপ্লবীর থেকে খানিকটা কমও ছিলেন। তিনি আউলবাউল ছিলেন।

চৈতন্য নিছক বিপ্লবী ছিলেন না, আবার নিছক ভাবোন্মাদ ছিলেন না। তিনি একজন বিপ্লবীর থেকে বেশি ছিলেন, বিপ্লবীর থেকে কমও ছিলেন। ধর্মীয় ভাবান্দোলন এবং বিপ্লবী পরিবর্তনের সবথেকে আশ্চর্য সংশ্লেষের উদাহরণ সম্ভবত চৈতন্য আন্দোলন কর্তৃক কাজি দলন।

অর্থাৎ, এবং আমার এই পোস্টে এইটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, চৈতন্য আন্দোলনে কিন্তু বিপ্লব ও ধর্ম দুটোই বিনির্মিত হচ্ছে।

বিপ্লবী বড় বেশি বহিরঙ্গে মজে আছে। সে বড় বেশি ইতিহাসের, সমাজতত্ত্বের। সে বড় বেশি অর্থনীতির। দিনবদলের সময়ে সে স্লোগান। দর্শনে সে কার্ল মার্ক্স।

অন্যদিকে ধর্ম অনেক বেশি কবিতা। অন্তর্লীন। প্রেম। সংস্কৃতি। দুর্গাপুজোর শরতকালের মত বড় বেশি কাশফুল। মহালয়ায় সে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ। দর্শনে সে নিরীশ্বর সাংখ্যের পুরুষ প্রকৃতি।

দুটোই অসামান্য, কিন্তু দুটোই নিজের নিজের জায়গায় সীমাবদ্ধ।

তাই এ দুটোই একে অন্যের থেকে শিখেছে বারবার। অগ্নিযুগের বিপ্লববাদ নিয়ে আমাদের অনেক পাঁড় আঁতেলই দুচ্ছাই করেন। কি সব গীতা হাতে করে, কি সব কালিমূর্তির সামনে শপথ, কি সব যাচ্ছেতাই বন্দেমাতরম। এটা তারা বোঝেন না, বিপ্লবও ধর্ম থেকে সমৃদ্ধ হতেই পারে, বারবার হয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র।

ল্যাটিন অ্যামেরিকার কোনও চিন্তাবিদ অবিশ্যি লিবারেশন থিওলজি নিয়ে এমন দুচ্ছাই করেছেন বলে আমার জানা নেই।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাথলিক লেফট ছিল, অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা টেরি ইগলটন।

বিপ্লবের যে চিরাচরিত সীমারেখা আমরা দেখি, সেই বাউন্ডারি ভাঙার সময় হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ধর্মকেও ভাঙার সময় এসেছে।

নয়ত বাঙালির মধ্যে বিপ্লবের একচেটিয়া ঠিকেদার হবে একদল কাঠগোঁড়া বামপন্থী (অথবা কফি হাউসে তাদের সৌখিন কাউন্টারপার্ট), আর ধর্মের ঠিকেদার হবে একপাল গেরুয়া কাঠচাড্ডি (অথবা কর্পোরেট জগতে তাদের সৌখিন কাউন্টারপার্ট)।

চৈতন্য আন্দোলন থেকে তাই আজকের বাঙালিকে শিখতে হবে। গৌর-নিতাই আউলবাউল ছিলেন। ওঁরা দুজন ধর্ম এবং বিপ্লবের আমূল বিনির্মাণ ছিলেন। ওঁরা আমাদের আগামীর পথনির্দেশ করে গেছেন।

(কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে দুহাজার পনেরোয় এ লেখা ফেসবুকে দিয়েছিলাম)

© তমাল দাশগুপ্ত

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ২২শে নভেম্বর ২০১৯

শশাঙ্ক – তমাল দাশগুপ্ত

ছবিতে দেখছেন সম্রাট শশাঙ্কের স্বর্ণমুদ্রা। ষাঁড়ের ওপরে শিব উপবিষ্ট, শিবের হাতে ত্রিশূল, নিচে লেখা “শ্রী জ”। মুদ্রার অপরপিঠে লক্ষ্মী, পদ্মের ওপরে আসীন, “শ্রী শশাঙ্ক” লেখা।

শশাঙ্কযুগ সম্পর্কে আমার এই লেখাটি পড়তে পারেন https://shoptodina.wordpress.com/2018/11/06/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%99%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%93-%e0%a6%ac%e0%a7%8c%e0%a6%a6-6/

শশাঙ্কের এই মুদ্রায় “শ্রী জ” সম্ভবত জয়নাগের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কিত হওয়ার ইঙ্গিত। জয়নাগ নিয়ে আমার এই প্রবন্ধটি পড়তে পারেন। https://shoptodina.wordpress.com/2018/12/16/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a7%83%e0%a6%a4-%e0%a6%97%e0%a7%8c%e0%a7%9c%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9f-%e0%a6%9c%e0%a7%9f%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a7%87/

http://fb.me/tdasgupto থেকে, ১৯শে নভেম্বর ২০১৯