কালীতন্ত্র, স্বতন্ত্রতন্ত্র, সিদ্ধেশ্বরতন্ত্র, চামুণ্ডাতন্ত্র এবং বিশ্বসারতন্ত্র – এই পাঁচটি গ্রন্থ থেকে মা কালীর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ধ্যানমন্ত্র উদ্ধৃত করেছেন আগমবাগীশ তাঁর বৃহৎ তন্ত্রসারে। সব ধ্যানমন্ত্র সম্পর্কেই আগে লিখেছি। তবে এর মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় হল সিদ্ধেশ্বরতন্ত্রের ধ্যানমন্ত্র।
মা কালী শববাহনা। তিনি মহা ভীমা অর্থাৎ অতি ভয়ঙ্কর আকৃতির। তিনি ঘোর দন্তবিশিষ্টা। তিনি বরদান করেন। মা হাস্যবদনযুক্তা, ত্রিনয়না। তাঁর হাতে নরকপাল এবং কর্ত্রি। মা মুক্তকেশী এবং তাঁর জিহ্বা প্রসারিত। তিনি ঘন ঘন রুধির পান করেন। তাঁর চার বাহু, তিনি বরাভয় প্রদান করেন, তাঁর এরকম মূর্তি ধ্যান করি।
পালযুগ এক মহা মন্থনের সময়। মা কালীর বর্তমান মূর্তিরূপের আদিতম সংস্করণ, অর্থাৎ মুণ্ডমালিনী শববাহনা লোলজিহ্বা সশস্ত্র মূর্তিরূপ এই পালযুগে নির্মিত হয়েছিল। এর আগে হরপ্পা সভ্যতা থেকেই মা কালী পূজিত ছিলেন কিন্তু বর্তমান মূর্তিরূপে নয়।
পালযুগে মা কালীর একটি নির্দিষ্ট রূপ দেখা যায়, যা অষ্টম থেকে দশম শতকের মধ্যে বাংলা থেকে তিব্বতে প্ৰচলিত হয় এবং জনপ্রিয় হয়, এঁরই নাম ক্রোধ কালী।
আমরা আজকে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমে, পালযুগের কালীতত্ত্ব আলোচনা করব। দ্বিতীয়ত, ক্রোধ কালীর মূর্তিতত্ত্ব আলোচনা করব।
★ বাঙালি বর্তমান পৃথিবীর শেষ মাতৃকা উপাসক মহাজাতি। মাতৃকা উপাসনায় আমাদের এই বাঙালি মহাজাতি সংজ্ঞায়িত হয়। তাই যখনই এই মহাজাতির পুনরুত্থান ঘটেছে, যুগে যুগে আমাদের মাতৃকারা নবরূপে পুনরুদ্ভাসিত হয়েছেন। অগ্নিযুগের মহামন্ত্র বন্দে মাতরম স্মর্তব্য।
★ এভাবেই পালযুগের বাঙালির উত্থান ঘটেছিল মাতৃকা উপাসনাকে আশ্রয় করে। গোপাল ছিলেন চুন্দা উপাসক। ধর্মপাল মা তারার উপাসনা করতেন, তাঁর রাজকীয় পতাকায় মা তারার চিত্র অঙ্কিত থাকত।
★ পালযুগের শেষার্ধে বজ্রযোগিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বজ্রযোগিনীর একটি নির্দিষ্ট রূপ নারোডাকিনী যিনি পালযুগের সহজ আন্দোলনে উত্থিত হন। আগে এঁর সম্পর্কে লিখেছি। মাতৃকা উপাসনার সর্বোচ্চ ঋজুপথ নির্মাণে এঁর বিপুল অবদান ছিল। কালীকুলের অনেকগুলি দার্শনিক তত্ত্ব এই বজ্রযোগিনী (যাঁর আজকের রূপ ছিন্নমস্তা) মণ্ডল থেকে এসেছে।
★ বজ্রযোগিনীর এক রূপ ক্রোধ কালী। আমরা এঁর তত্ত্ব ও মূর্তিরূপ সম্পর্কে আলোচনায় আসার আগে পালযুগের আর একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করব যা কালীতত্ত্বে অসীম তাৎপর্যপূর্ণ। কালচক্রযান। কাল ধারণা, মহাকালের উত্থান, এবং সবার উপরে কালের কলন করেন যে কালী, এই পালযুগের গভীর দার্শনিক তত্ত্ব। জগদকারণ কালী প্রাচীন কাল থেকেই আছেন, রাত্রি রূপে। তাঁর কালো রং, তাঁর কালী নাম, কারণ জগতের উৎসে কালো। এইবার পালযুগে এক মহা তরঙ্গ এলো, কাল সাধনা, যেখানে মহাকালী তত্ত্বে কালীর নাম মাহাত্ম্য এক বৈপ্লবিক আঙ্গিক পায়: সময় বা কালের নিয়ন্ত্রক।
★ পালযুগের চামুণ্ডা বা চর্চিকা তত্ত্বও কালীর বর্তমান তত্ত্বে মিশে আছে। নৈরাত্মা আছেন। পালযুগের তারাতত্ত্ব আছে। বজ্রবারাহী আছেন। বিস্তারিত আলোচনা তো সম্ভব নয় এক ফেসবুক পোস্টে, তার জন্য কয়েক খণ্ডে বই লিখতে হবে।
সব মিলিয়ে, পালযুগের তন্ত্রধর্মের মহামন্থনে কালীতত্ত্ব নির্মিত হচ্ছিল।
এইবার, পালযুগের সমস্ত কালীরূপের মধ্যে যা সম্ভবত সর্বপ্রাচীন, সেই ক্রোধকালী সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব।
★ গুরু পদ্মসম্ভব অষ্টম শতকে তিব্বতে ক্রোধ কালী তত্ত্ব নিয়ে এসেছিলেন উড্ডিয়ান তন্ত্রপীঠ থেকে যা সম্ভবত পূর্ববঙ্গে অবস্থিত ছিল, পরে যা বজ্রযোগিনী নামে পরিচিত হতে থাকে।
বজ্রযোগিনীর একটি নির্দিষ্ট রূপ ক্রোধকালী। ইনি Troma Nagmo নামে তিব্বতে পরিচিত হন, সংস্কৃতে এঁকে ক্রোধকালী বা ক্রোধেশ্বরী বা কৃষ্ণক্রোধিনীও বলা হয়।
আমাদের তন্ত্রে যেমন কুণ্ডলিনী সাধনা ও চক্রের ধারণা আছে, বৌদ্ধ তন্ত্রে ছিল তিনটি কায়া: ধর্ম, সম্ভোগ এবং নির্মাণ। দেহের নির্মাণকায়ায় অবস্থান করেন ক্রোধকালী। ইনি সর্বোচ্চ জ্ঞান, সর্বোচ্চ তত্ত্ব, এজন্য এঁকে ডাকিনীদের মধ্যে সবার আগে স্থান দেওয়া হয়েছিল।
★ ক্রোধকালীর মূর্তিরূপ। মায়ের বর্ণ ঘোর নীল। তাঁর মুখমণ্ডলের ডান দিকে একটি ক্ষুদ্র বারাহীমুখ দেখা যায়, যা বজ্রবারাহী মূর্তিরূপের মত। ডান হাতে কর্ত্রি, বাম হাতে রক্তপূর্ণ নরকপাল। মা বাম কনুই ও কাঁধ দ্বারা একটি খট্বাঙ্গ ধারণ করেন। মায়ের মস্তকে পাঁচটি নরকপাল নির্মিত মুকুট। মায়ের গলায় মুণ্ডমালা। বাম পদ তিনি নৃত্যরত অবস্থায় একটি শবের হৃদয়ে স্থাপন করেন। ক্রোধকালী একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কেন্দ্রে অধিষ্ঠান করেন।
পালযুগের এই ক্রোধকালী মূর্তিরূপ নিঃসন্দেহে আবহমান কালীতত্ত্বের এক অত্যুচ্চ দার্শনিক প্রকাশ।
★ রঙের উদযাপন করলাম আমরা বসন্তোৎসবে। এই উপলক্ষে মা কালীর মূর্তিরূপের রঙ সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব। কাল বা সময় কোনও বস্তু নয়, তাই রঙ হয় না। যদি কালের কোনও রঙ, কালস্রোতের কোনও বর্ণ কল্পনা করা সম্ভব হত, তাহলে আমরা বোধহয় কালো রঙের কথাই ভাবতাম। কালী কাল অভিন্ন, আবার কালীনামের একটি অর্থ যিনি কালের কলন করেন। কাল যদি কালো হয়, কালের কলন করেন বলে মা কালীর রঙও কালো।
★ আবার, কালী জগদকারণ। জগতের উৎসবিন্দুর যদি কোনও রঙ ভাবা যায়, তা সম্ভবত কালো।
★ সমস্ত বর্ণ এসে এই কালো রঙেই মেশে। জগতের বিস্তার, দশদিকে যিনি ব্যাপ্ত, আর কোন্ রঙেই বা তাঁর অব্যক্ত রূপের প্রকাশ ঘটতে পারে?
★ অন্ধকারে শুরু হওয়া একটি নতুন দিনের জন্মক্ষণও কালো। জগৎপ্রসবিনী মা সেজন্য কালো বলেই চিহ্নিত, তিনি কালরাত্রি। এই রাত্রিই উৎসবিন্দু, রাত্রিই সৃষ্টিরহস্য ধারণ করেন।
★ জগতের শেষেও এই কালো রঙ, যখন সব রঙ শেষ হয়ে যাবে, যখন সব সময় শেষ হয়ে যাবে, সেই জগদবিলয়কালের প্রতীকও এই কালো রঙ।
★ আর লাল রঙ? হ্যাঁ, লাল, কারণ জীবনের রঙ লাল, রক্তের রঙ লাল। পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন মাতৃমূর্তির আখ্যা পেয়েছে যে প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রতিমা, চল্লিশ হাজার বছর আগেকার সেই Venus of Willendorf মূর্তি একরকম সিঁদুরের মত লাল রঙে চর্চিত ছিল। প্রাচীন যুগের মানুষের কাছে মেয়েদের লাল রজঃ ছিল পবিত্র জন্মবীজ। আবার মাতৃকা উপাসনায় মায়ের কাছে পশুবলি দেওয়া হত, কারণ প্রাচীন মানুষ মূলত মাংসাশী, এবং নিজে যা খান, ভক্তজন সেটাই মাকে নিবেদন করবেন, সেটাই সততা। সেটাই স্বাভাবিক কারণ, “আহার কর মনে কর আহুতি দিই শ্যামা মায়ে”। কাজেই লাল রঙ বলিপ্রিয়া রুধিরপ্রিয়া মায়ের প্রতীক। আবার লাল হল আগুনের রঙ। এবং আগুন মা কালীর সঙ্গে অভিন্ন, অগ্নির জিহ্বা ও মা কালীর জিহ্বা অভিন্ন। এছাড়া লাল রঙ শক্তির প্রতীক, সেজন্য ধর্ম অর্থ কাম – এই তিন বর্গের শক্তি এই লাল রঙে প্রকাশিত।
★ কিন্তু সর্বশেষে, মোক্ষ বর্গের প্রতীক হল কালো, কারণ নির্বাপিত দীপ এই নির্বাণতত্ত্বের প্রকাশ, অতএব সেই চিরপ্রণম্য কৃষ্ণবর্ণ আমাদের মায়ের রঙ।
★ লাল কালো ছিল হরপ্পা সভ্যতা থেকে পাণ্ডু রাজার ঢিবি পর্যন্ত বাঙালির পূর্বসূরীদের তান্ত্রিক রঙ। এই সমস্ত প্রত্নস্থানে লাল কালো রঙের প্রাচুর্য দেখা গেছে।
(মা কালীর আদি বর্ণ কালো। নীল বর্ণের কালী আসলে দেবী নীলা বা নীলাবতী, যাঁকে নীল সরস্বতী, নীল চণ্ডী, নীল তারা বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব পরে। সঙ্গে থাকুন)
দোলযাত্রা উৎসবে আমরা পূর্ণিমা তিথি ও তন্ত্রধর্মের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করব।
আমাদের কাছে অমাবস্যা তিথি পরমপ্রিয়, কারণ মা কালীর উপাসনা হয় এই তিথিতে। কিন্তু পূর্ণিমা তিথির গুরুত্বও তন্ত্রে যথেষ্ট।
★ শুক্লপক্ষ আমাদের মাতৃধর্মের নবরাত্রি এবং পঞ্চরাত্রি উপাসনার ধারক। বসন্ত হোক বা শরৎ, শারদীয়া দুর্গাপুজো হোক বা বাসন্তী দুর্গাপুজো, দেবীপক্ষ সর্বদাই শুক্লপক্ষে শুরু হয়, এবং এই দেবীপক্ষ পূর্ণিমা তিথিতে শেষ হয়। শারদ পূর্ণিমা বা কোজাগরী পূর্ণিমা মা লক্ষ্মীর উপাসনায় জাগরুক হওয়ার সময়। যদিও উত্তর ভারতে দীপাবলির দিনই লক্ষ্মীর পুজো হয়, এবং আগমবাগীশও তন্ত্রসারে দীপাবলির কার্তিকী অমাবস্যায় লক্ষ্মীপুজোর উল্লেখ করেছেন। আসলে আলোকোজ্জ্বল রাত্রিই মা লক্ষ্মীর আগমনবার্তা ঘোষণা করে।
★ সম্ভবত পূর্ণিমা রাতে মা লক্ষ্মীর আগমন একটি প্রাচীন তন্ত্রধর্মীয় প্রথা। এর নানা ব্যাখ্যা হতে পারে, অন্যতম ব্যাখ্যা এই যে বণিকদের জন্য পূর্ণিমা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং হরপ্পা সভ্যতার পণি থেকে বাঙালি জাতির বণিক, সবাই পূর্ণিমা তিথিতেই মায়ের উপাসনা করতেন ও করেন। কেন? সম্ভবত প্রাচীন যুগের বাণিজ্য ক্যালেন্ডারে এই পূর্ণিমা তিথির কিছু তাৎপর্য ছিল। স্বর্ণের মত সুন্দর প্রফুল্ল মনোরম জ্যোৎস্নালোকে বণিকদের বাণিজ্য উপলক্ষে যাত্রা করতেও সুবিধা হত নিশ্চয়ই।
★ বাঙালি গন্ধবণিক জাতি আজও বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মা গন্ধেশ্বরীর উপাসনা করেন। তিনি মূলত সিংহবাহিনী চণ্ডী বা মহালক্ষ্মী। পূর্ণিমা তিথির সঙ্গে কাজেই মাতৃকা উপাসনার একটি প্রাচীন সম্পর্ক আছে। সারা বছর জুড়েই পূর্ণিমা তিথির মাতৃধর্মীয় উদযাপন দেখি। রাসপূর্ণিমা তিথিতে রাসমণ্ডল আসলে ছিল মাতৃকা উপাসনার উৎসব, আগে সেই আলোচনা করেছি আমার পেজে।
★ হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই পূর্ণিমা এবং অমাবস্যা যথাক্রমে উদ্ভাসিত ঊষা এবং আদিমাতা নিশার প্রতীক। আমাদের তন্ত্রধর্মে পূর্ণিমা তিথি আলোকোজ্জ্বল প্রাচুর্যের তাৎপর্য বহন করে। জগতের উৎসে জগদকারণ অব্যক্ত প্রকৃতির কালো রঙ, অমানিশা কালরাত্রি। কিন্তু জগতের বিস্তার ও স্থিতির সময় তিনি পূর্ণচন্দ্রের মত উদ্ভাসিত: পূর্ণিমা তিথি জগতের স্থিতি ও উদ্ভাস।
★ সেজন্যই পূর্ণিমায় বা শুক্লপক্ষে মহালক্ষ্মী বা দুর্গা বা চণ্ডী পূজিত হন। শরতের চন্দ্রের সঙ্গে মা চুন্দা তুলনায়িত হয়েছেন একটি প্রাচীন শ্লোকে, চুন্দা ছিলেন পালযুগের সূচনায় সম্রাট গোপালের উপাস্য মাতৃকা।
হিন্দুর ধর্মে এমন একটি উৎসব নেই যা মাতৃকা উপাসনার প্রাচীন ধারায় পুষ্ট নয়। দুর্ভাগ্য হল, প্রাচীন উৎসবের কেন্দ্রে অধিষ্ঠানরত মাতৃকাকেই মুছে দেওয়া হয়েছে অনেক সময়। এই দোলপূর্ণিমা অন্যতম উদাহরণ। এই দিনে আগে মাতৃকা উপাসনা হত। এখন একে সবাই বৈষ্ণব ধর্মের উৎসব বলেই জানেন, একে মাতৃকা উপাসনার উৎসব বলে সাধারণ মানুষ চেনেন না।
আসুন, আজ দোলপূর্ণিমায় মাতৃকা উপাসনার প্রমাণ দেখব আমরা।
বসন্ত পঞ্চমীর দিন মা সরস্বতীর উপাসনার মাধ্যমে ঋতু পরিবর্তনকালীন উৎসবের একটি ক্যালেন্ডার শুরু হত এবং দোলপূর্ণিমা সেই উৎসবের চূড়ান্ত ক্ষণ ছিল।
এই দোল উৎসবে রঙের বাহুল্য শ্রী বা মা লক্ষ্মীর প্রাচুর্যের প্রতীক। হরপ্পা সভ্যতায় বহুবর্ণ পুঁতির মালা জনপ্রিয় ছিল, বিভিন্ন রঙের সমাহার সমৃদ্ধির দ্যোতনা বহন করত। নানারকম রঙিন পাথর বিদেশে রফতানি করে হরপ্পা সভ্যতার পণি (আমাদের বণিক) বাণিজ্যিক প্রাচুর্যের অধিকারী হতেন। পাণ্ডু রাজার ঢিবিতেও অনুরূপ নানা রঙের পুঁতি পাওয়া গেছে। লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে আসেন, সমুদ্র বহুবর্ণের সম্পদ ধারণ করে।
জগৎ বহুবর্ণ, এবং তন্ত্রে রঙের প্রতীকী ব্যবহার। কৃষ্ণ এবং লাল রঙ প্রাচীন কাল থেকে মা কালীর দ্যোতনা বহন করে, এই লাল কালো রং ছিল হরপ্পা থেকে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে প্রধান রঙ। আবার শ্বেত রঙ মা সরস্বতীর। পালযুগে মা তারার বিভিন্ন রঙের প্রতিমা নির্মিত হত, প্রত্যেক রঙের সুনির্দিষ্ট তাৎপর্য। সমস্ত রঙ এই দোলপূর্ণিমায় একত্রিত হয়ে আমাদের তন্ত্রধর্মের উৎসব রচনা করত। বসন্তের বাসন্তী রঙ, পলাশ শিমূলের লাল আগুনরঙ দিগন্তে দিগন্তে – বসন্তে বহুবর্ণ প্রকৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটত এই দোলের উৎসবে।
যেহেতু বৈষ্ণব ধর্ম প্রথম থেকেই শ্রী বা লক্ষ্মীর আশ্রয়ে বর্ধিত, তাই দোলপূর্ণিমা আজকে আমরা বৈষ্ণব উৎসব রূপেই জানি। কিন্তু কেন্দ্রে থাকা আবহমান মাতৃকা চোখের আড়ালে চলে গেছেন, সে বড় দুঃখের।
মাতৃকার প্রধান দুই রূপ, অমাবস্যায় তিনি মহাকালী আর পূর্ণিমা তিথিতে তিনি মহালক্ষ্মী।
দেবী মহিষমর্দিনীর উপাসনা হয় শ্রীরামপুরে এই দোলপূর্ণিমা তিথিতে, দেবীর দুই দিকে জয়া বিজয়া থাকেন। এই মহিষমর্দিনী অবশ্যই দেবী মহালক্ষ্মী। পালযুগে শরতের পূর্ণিমা তিথিতে মা চুন্দা পূজিত হতেন, যিনি চণ্ডীর সঙ্গে অভিন্ন, অর্থাৎ কিনা সেই মহালক্ষ্মী। বসন্তের পূর্ণিমা তিথিও মা মহালক্ষ্মীর উপাসনার সময় ছিল।
গতকাল এই পাথরের লক্ষ্মীমূর্তিটি আমার শ্বশুরবাড়ির একটি পুকুর থেকে পাওয়া গেছে। প্রতিমা তেমন পুরোনো নয়, গত শতকের মনে হচ্ছে। কারা কেন ফেলে গিয়েছিল, জানা যায় নি। মাকে স্থাপনা করা হয়েছে, পুজো করা হচ্ছে।
তিনি আমাদের অন্ধকারতম কালরাত্রিকেও আলোকোজ্জ্বল করেন, সেজন্য আমরা কার্তিকী অমাবস্যায় তাঁর উপাসনায় দীপাবলি পালন করি।
তিনি কালের কলন করেন। তাঁর ভয়ে দক্ষিণদিকের অধিপতি যম পালিয়ে যান সেজন্য তিনি দক্ষিণাকালী নামে প্রসিদ্ধ, আর সেজন্য তাঁর ভক্ত মৃত্যুঞ্জয় হন।
তিনি জগতের উৎস, জগদকারণ প্রকৃতি। আবার অন্তিমে তিনিই জগদবিলয়। এ বিশ্বজগতের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তিনিই। তাঁকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, তিনি অব্যক্ত। কিন্তু আমরা ক্ষুদ্র মানববুদ্ধিতে তাঁর এই মূর্তি গড়ে নিয়েছি ধ্যানের সুবিধা হবে বলে।
তাঁর চার হাত চতুর্বর্গ। তাঁর খড়্গ সমস্ত জাগতিক মোহজাল ছিন্ন করে। তিনি বলিপ্রিয়া, তাঁর প্রসারিত জিহ্বা বলি গ্রহণ করার প্রতীক। তিনি দিগবসনা কারণ তিনি দিগদিগন্তে চরাচর জুড়ে ব্যাপ্ত। তাঁর দক্ষিণ পদ ও বাম পদ সাধনার দুই প্রধান মার্গ নির্দেশ করে। তাঁর পদতলের শব শুধুমাত্র তাঁর পাদস্পর্শের জোরে শিবত্ব পায়।
তিনি কেবল তাঁর মন্দিরে ও প্রতিমায় আবদ্ধ নন। তিনি বিশ্বচরাচর জুড়ে ব্যাপ্ত। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠতম প্রতিমা আমাদের হৃদয়ে। হৃদি কালিকাদেবতায়ৈ নমঃ।
তিনি মা বলে ডাকলে সাড়া দেন: এক কথায় গূঢ়, গভীর, অনন্ত কালীতত্ত্বের সারমর্ম হল এই।
মা কালী কেন শ্মশানবাসিনী? গুপ্তসাধনতন্ত্রের ব্যাখ্যা।
নানাভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। মা কালী জগদবিলয়, তিনি সৃষ্টি ও স্থিতির পর প্রলয় আনেন। তাই শ্মশান তাঁর প্রতীক, যেখানে জগতের অন্ত। আবার কালী মোক্ষদা, তিনি অন্তিমে কৈবল্য প্রদান করেন। সেজন্যও শ্মশান, যেখানে সমস্ত জাগতিক মোহ পুড়ে ছাই হয়। আবার প্রাচীন কাল থেকেই আগুন ও মা কালীর সংযোগ, সেজন্যও শ্মশানের আগুনে তাঁর অধিষ্ঠান।
তবে মা কালী কেন শ্মশানবাসিনী, এই প্রশ্নের উত্তর গুপ্তসাধনতন্ত্রে এভাবে দেওয়া আছে। এটি আগমবাগীশ তাঁর তন্ত্রসারে উদ্ধৃত করেছেন।
★ মা রক্ষাকালী লেলিহান রূপে প্রকাশিত, তিনি অট্টহাস্য করেন, মহা ঘোর শব্দ করেন এবং তিনি সুভীষণা।
বিশ্বসারতন্ত্রের এই মন্ত্রেই বাংলায় রক্ষাকালী পূজিত হন যদিও এই মন্ত্রে সরাসরি রক্ষাকালীর উল্লেখ নেই। প্রসঙ্গত পালযুগে পঞ্চরক্ষিকা মায়ের পুজো হত, যিনি শরণাগত সন্তানকে সমস্ত আপদ বিপদ থেকে রক্ষা করতেন। এবং রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে উপাস্য মায়ের পুজো তন্ত্রধর্মে অত্যন্ত প্রাচীন প্রথা। একাধিক বিখ্যাত রক্ষাকালী আছেন বাংলায়, যেমন বোল্লা কালী।
আজ আমরা মা কুরুকুল্লা সম্পর্কে জানব। ইনি পালযুগের তন্ত্রধর্মে একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী, বজ্রযানে অমিতাভ কুলের অন্তর্গত, মা তারার একটি রূপ বলে গণ্য এবং তিব্বতে এখনও জনপ্রিয়। কিন্তু তিনি মা কালীর এক প্রাচীন রূপও বটেন।
কুরুকুল্লার অনেক প্রকারের রূপ জনপ্রিয় ছিল পালযুগের তন্ত্রধর্মে বাংলা জুড়ে, সাধনমালা গ্রন্থ সাক্ষ্য দেয়। একটি মূর্তিরূপ অনুযায়ী তিনি দ্বিভুজা এবং শুক্লবর্ণা। আর একটি মূর্তিরূপে তিনি চতুর্ভুজা, রক্তবর্ণা, রক্তপদ্মাসীনা, রক্তবস্ত্রপরিহিতা। আর একটি ষড়ভুজা মূর্তিরূপ পাওয়া যায়, সেখানেও দেবী রক্তবর্ণা। কুরুকুল্লার অষ্টভুজা মূর্তিও দেখা যায়। ইনি ব্যাপকভাবে পূজিত ছিলেন নতুবা এত আলাদা আলাদা মূর্তিরূপ হত না। চতুর্ভুজা কুরুকুল্লার নানাবিধ মূর্তিরূপ দেখা যায়: তারোদ্ভব কুরুকুল্লা, উড্ডিয়ান কুরুকুল্লা, হেবজ্রক্রম কুরুকুল্লা এবং কল্পোক্ত কুরুকুল্লা। এঁদের মধ্যে উড্ডিয়ান কুরুকুল্লা আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
পালযুগের শেষে মা কালীর বর্তমান মূর্তিকল্পের উত্থান ঘটেছিল, যাতে মা কুরুকুল্লার ব্যাপক প্রভাব ছিল, বিশেষ করে উড্ডিয়ান কুরুকুল্লার মূর্তিরূপ।
প্রাচীনযুগের বিখ্যাত তন্ত্রক্ষেত্র উড্ডিয়ান কোথায় অবস্থিত ছিল, তা নিয়ে নানা মত। বিক্রমপুরে বজ্রযোগিনীর আগের নাম উড্ডিয়ান, এরকম একটি সম্ভাবনা আছে।
উড্ডিয়ান কুরুকুল্লার মূর্তিরূপ: দেবী চতুর্ভুজা, ভীষণা, করালবদনা, মুণ্ডমালিনী, ললজিহ্বা, পিঙ্গলবর্ণ ও জ্বলন্ত ঊর্ধ্বকেশ বিশিষ্টা, শববাহনা। মায়ের মাথায় পঞ্চ নরকপাল। মা ব্যাঘ্রচর্মনির্মিত বসন এবং সর্পনির্মিত ভূষণ ধারণ করেন। তাঁর ত্রিনয়ন রক্তবর্ণা।
মা কুরুকুল্লার মন্ত্র এখনও বাংলায় বিভিন্ন তন্ত্রধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়, যেমন বশীকরণ প্রভৃতি।
ব্রহ্মাবিষ্ণুশিবাদীনাং শিরোরত্নপদাম্বুজা। কলৌ কালী কলৌ কালী নান্যদেবঃ কলৌ যুগে।। —পিচ্ছিলাতন্ত্র। ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব যাঁর পাদপদ্ম নিজেদের মাথার রত্ন হিসেবে ধ্যান করেন, সেই কালী ভিন্ন কলিযুগে অপর দেবতা নেই।