দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় প্রমাণ করেছিলেন উপমহাদেশের তারাসাধনার সূত্রপাত বৃহৎ বঙ্গেই হয়েছিল। পালযুগে তারাসাধনার সুবিপুল সাধনক্রম আত্মপ্রকাশ করেছিল। শুধু নাগার্জুনের নামেই তারার বাইশ সাধনক্রম প্রচলিত ছিল। এছাড়া আরো কত জানা অজানা সাধক তারাসাধনার ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তারা ছিলেন বাঙালির রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক। রাষ্ট্রকূট বংশের নেসারি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় সমস্ত উত্তরাপথের একচ্ছত্র সম্রাট ধর্মপালের রাষ্ট্রপ্রতীকে তারামূর্তি অঙ্কিত থাকত। এই বাংলাতেই আজও দক্ষিণ রাঢ় বা সুহ্মভূমির অধিশ্বরী দেবী সুহ্মেশ্বরী পূজিত হন। মুর্শিদাবাদে দেবী আর্যতারার বিগ্রহ পূজিত হন ডোমনি দেবী নামে। চর্যাপদের ডোম্বিনীর অপরূপ অনুষঙ্গ এভাবেই আজও মিশে আছে তারানামে। তারা ছিলেন বজ্রযানে পূজিতা একমাত্র মাতৃকা যিনি পঞ্চ তথাগতের কুলেই উপাসিত হতেন। মহীপালের সময়ে প্রজ্ঞাপারমিতার একটি পুঁথি থেকে জানা যায় বৃহৎ বঙ্গে সবথেকে বেশি পীঠ ছিল দেবী তারা ও লোকনাথের নামাঙ্কিত। পালযুগের শেষার্ধ থেকে নারোপার নেতৃত্বে সহজযানের ধারা প্রবল হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে তারার মণ্ডলে মাতৃকার বহু রূপ বজ্রযোগিনী ও কালীর মণ্ডলের অন্তর্গত হতে থাকেন। তারার সুবিশাল সাধনক্রমকে আত্তীকৃত করেই কালীর বর্তমান সাধনতত্ত্বের উৎসরণ ঘটে। সৌম্য জ্ঞানদায়িনী রূপের পাশাপাশি অক্ষোভ্য কুলে তারার উগ্র রিপুদলনী যে রূপগুলি( উগ্রতারা, একজটা, মহাচীনতারা) পূজিত হতো; উড্ডিয়ানের সাধকগণের মাধ্যমে এই সময় থেকে সেই রূপের উপাসনাই সুপ্রচলিত হয়ে ওঠে। নীলবর্ণা মুণ্ডমালিনী খড়্গধারিণী তারা হয়ে ওঠেন কালীরই অভিন্ন প্রকাশ; যা আজও বাঙালির ধর্মভাবনায় বিদ্যমান। সেনযুগের গৌড়েশ্বরী বিগ্রহও উগ্রতারারই রূপ।
ছবিতে দেখছেন পালযুগের বজ্রতারা। কঠোর ও কোমলের সার্থক সমন্বয় ঘটেছে মাতৃকার এই বিগ্রহে। দুই হাতে ধনুর্বাণ রিপুনাশে উদ্যত; আবার প্রস্ফুটিত পদ্ম ও বরদমুদ্রা সাধকের হৃদয়কে ভাস্বর করে তোলে মহাকরুণা ও জ্ঞানের বিদ্যুৎশিখায়। তিনিই গৌরী, মঙ্গলা, মনসা, গায়ত্রী। তিনিই সহজানন্দ প্রদান করেন। তাঁর সাধনক্রমে আবহমান মাতৃসাধনার সমস্ত ধারা সম্মিলিত হয়েছে। তাঁর সাধনক্রম বড়ো সহজ; ঋজু। অনর্থক জটিলতা সেখানে নেই। তিনি তারণ করেন। সাঙ্খ্যের প্রকৃতিতত্ত্ব তাঁর বিগ্রহেই মূর্ত হয়েছে। তাই চর্যাকার গেয়েছেন: তো বিন তরুণী নিরন্তর নেহে বোধি কি লবভই প্রণ বি দেহে
খুলনা জাদুঘরে রক্ষিত মধ্যযুগের কালীবিগ্রহ। সময়কাল পঞ্চদশ শতকের। অর্থাত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সময়কালের শতাধিক বছর আগেকার। গুপ্তোত্তরযুগ ও পালযুগেই বাঙালির জনপ্রিয়তম মাতৃকার বর্তমান রূপ ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছিল। যদিও মুণ্ডমালিনী, শৃগাল বেতাল প্রমুখ সহচর পরিবৃতা, মুক্তকেশী, খড়্গধারিণী, করালবদনী, যুগপৎ ভয়ঙ্করী ও ভয়হরা, কালচক্রের ধারিকাপ্রমুখ বৈশিষ্ট্যগুলি তাম্রাশ্মযুগের সময় থেকেই কালীসাধনার ধারায় বিদ্যমান। দুই হাজার বছর আগেকার কলকাতার কালীগ্রাম নাম থেকে শুরু করে কুমারসম্ভবের কবি কালিদাসের নাম পর্যন্ত কালীর অমোঘ উপস্থিতি। পালযুগে মহাকাল ও বজ্রযোগিনীর মণ্ডলে কালিকা ও শ্যামাদেবী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উড্ডিয়ানের সমস্ত সাধনক্রমে নীলবর্ণা, মুণ্ডমালিনী, খড়্গধারিণী, শবারূঢ়া, নৃত্যরতা মাতৃকার আরাধনা করা হয়েছে। সেনযুগে কালী ও তারা সবথেকে জনপ্রিয় মাতৃকা। দশমহাবিদ্যার উপাসনাও এই সময় ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কল্যাণেশ্বরী, জহুরা কালী ও কালীঘাটের কালীর সাথে বল্লালসেনের নাম জড়িয়ে আছে। আবার পালযুবরাজ চৌরঙ্গীনাথও আছেন কালীঘাটের ইতিহাসের অংশ হয়ে। সেনযুগের সদুক্তিকর্ণামৃতে কালীর অনেকগুলি অপূর্ব বন্দনা সংকলিত হয়েছে। কালী ও কৃষ্ণের একীভবনের দৃষ্টান্তও মিলেছে। রামকেলির সেনযুগের গৌড়েশ্বরী বিগ্রহ যুগপৎ কালী ও তারার বৈশিষ্ট্য বহন করে।
মধ্যযুগের সূচনাকালে বৃহদ্ধর্মপুরাণে কালীর ধ্যান বর্তমান রূপের মতোই। এই সময়েই কালী প্রমুখ দশমহাবিদ্যার সাধনায় সিদ্ধ হয়েছেন মহাসাধক সর্বানন্দ। মধ্যযুগের মধ্যভাগে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সেই ধারাকেই আরো জনপ্রিয় করেছিলেন। মধ্যযুগ শিকড়বিচ্ছিন্নতার এবং ক্রমাগত সংঘাতের যুগ। বারবার অতীতের সাথে সংযোগ ছিন্ন হয়েছে। বাঙালির দিকপালরা সেই ছিন্ন সূত্র আবার সংযোজিত করেছেন। ফলে ভুলবশতঃ পুনরুজ্জীবনকারীকে প্রবর্তক ভাবার প্রবণতা চলে এসেছে। সেই প্রেক্ষিতেই পঞ্চদশ শতকের এই কালীমূর্তি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের পূর্ববর্তী সময়কালেও কালীর বর্তমান রূপের এ এক চমৎকার নিদর্শন।
মাতৃকা আবহমানা। তাঁর উপাসনার ধারাও সুপ্রাচীন। এই সহজ সত্যটি যেন আমরা বিস্মৃত না হই।
কালীসাধনার ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করছি আজ; পূর্বতন আলোচনার সূত্র ধরে।
বৈদিক সংস্কৃতিতে নিশা কালরাত্রি বা নকৃৎ কৃষ্ণা রাত্রিসূক্তে বন্দিত হয়েছেন। সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর সমগ্র জগত তোমার কোলে নিদ্রিত; তোমার উগ্র সন্তান বৃক(নেকড়ে) ও অন্যান্য নিশাচরদের থেকে তাদের রক্ষা করো। এটাই ছিল নিশাদেবীর কাছে ঋগ্বেদের ঋষির প্রার্থনা। ভয়ঙ্করের থেকে সুরক্ষার জন্য অভয়ার শরণ প্রার্থনা; নেকড়ে শৃগালদের অনিবার্য উপস্থিতি; কালীর চিরাচরিত দুটি বৈশিষ্ট্যই এখানে খুঁজে পাচ্ছি। যদিও বৈদিক পরিমণ্ডলে কালী শব্দটির প্রথম উল্লেখ অনেক পরে; মণ্ডুক উপনিষদে। সেখানে অগ্নির সপ্ত জিহ্বার সবকয়টি নামই মাতৃকার নাম এবং বিশেষভাবে কালীর সাথে জড়িত। নামগুলি হল: কালী করালী মনজবা সুললিতা সুধুম্রবর্ণা স্ফুলিঙ্গিনী ও বিশ্বরুচি। আমরা আগে দেখেছি হরপ্পা সভ্যতায় বলিদানের সময় সপ্তমাতৃকার উপাসনা হত, হরপ্পা পতনের পরে সেটাই সম্ভবত বৈদিক আর্যের যজ্ঞে অগ্নির সপ্ত জিহ্বা হয়ে গেছিল। অগ্নিশিখার লেলিহান জিহ্বার সাথে মাতৃকার নিবিড় সংযোগের বিষয়টি পরে আরো বিশদে আলোচনা করব পালযুগের দেবী চর্চিকার প্রসঙ্গে।
তাম্রাশ্মযুগের এই আদিপর্ব থেকেই কালীসাধনার আবহমান ধারার আরো দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এসেছে। তার মধ্যে প্রথমটি হল শক্তিপীঠের ধারণা। পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয়ের উৎখনন থেকে জানা যায়; পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে secondary burial পদ্ধতি এবং urn burial পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। অর্থাত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কেউ মারা গেলে তাঁকে প্রথমে সমাধিস্থ করা হতো। বেশ কিছুদিন পর সেই সমাধি খুঁড়ে দেহের অস্থিগুলো বের করে এক একটি পৃথক পাত্রে ভরে অনেকগুলি পৃথক সমাধি নির্মাণ করা হতো। যিনি এক ছিলেন; মৃত্যুর পর তিনি বহুরূপে ছড়িয়ে থাকলেন তাঁর কর্মভূমিতে। এটাই বোধহয় ছিল এই ধরণের সমাধি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য। এই ধরণের সমাধি সুদূর ভুমধ্যসাগর এবং ইউরেশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সমকালে প্রচলিত ছিল। সম্ভবত এই রীতিটিই পরে আমাদের মাতৃপূজক সংস্কৃতিতে সতীপীঠের ধারণায় এবং বৌদ্ধদের স্তূপ নির্মাণের রীতিতে পর্যবসিত হয়েছে। আমরা ভাবতেই পারি ধূসর অতীতের এক মহিয়সী নারীর কথা; যাঁকে তাঁর দেশবাসী মনে করতেন পরমা মাতৃকারই রূপ। মৃত্যুর পর তাঁর দেহখণ্ডগুলি একে একে একান্নটি সতীপীঠের মাধ্যমে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। কালীসাধনার ইতিহাস প্রসঙ্গে এই বিষয়টির উত্থাপন করছি কারণ এই পীঠ নির্মাণের সূত্রপাত যেখানে; সেই পাণ্ডুরাজার ঢিবি পক্ষীমাতৃকার উপাসনার প্রধান ক্ষেত্র ছিল; যে পক্ষীমাতৃকা আবার কালীর আদিতম প্রকাশ। তাৎপর্যপূর্ণভাবে আজও অধিকাংশ সতীপীঠে কালীই পূজিত হন তন্ত্রমতে। বাঙালির তন্ত্রের প্রথম অধ্যায় থেকেই পীঠের ধারণার সাথে কালীর নিবিড় সংযোগ বর্তমান। আগেই বলেছি; মাতৃকাই পৃথিবীরূপা। কালিকাপুরাণে পৃথিবী আসছেন জগদ্ধাত্রীরূপে, জনক রাজার কাছে, শশিভূষণ মনে করাচ্ছেন। পৃথিবীব্যাপী মাতৃকার পীঠসমূহও তারই অনবদ্য প্রকাশ। পালযুগের প্রসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা করব।
তন্ত্রের আদিপর্বের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল মাতৃকার বিমূর্ত বা aniconic প্রতীক। ত্রিকোণাকার বা কোনো বিশেষ জ্যামিতিক গঠনের শিলাখণ্ডকে মাতৃকা জ্ঞানে উপাসনার রীতি তাম্রাশ্মযুগের একটি বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাতৃকা এবং তাঁর দুই/চার সহচরীর মণ্ডল পূজিত হতেন এবং তিনটি বা পাঁচটি শিলাখণ্ড বা মুখাবয়ব উপাসিত হতো। এর মধ্যে ঈড়া পিঙ্গলা সুষুম্নার দ্যোতনা আছে। সাঙ্খ্যের প্রকৃতির পঞ্চ তত্ত্বের প্রকাশ আছে। আসানসোলের ঘাগড়বুড়ি, মালদহের জহুরা কালী, চান্না গ্রামের বিশালাক্ষী সহ বাংলার অগণিত পল্লীর গাছের তলায় বা কোনো বিশেষ থানে পূজিতা মাতৃকার শিলাময়ী রূপ সেই aniconic উপাসনার ধারাটিকেই আজও বহন করে চলেছে।
পক্ষীমাতৃকার উপাসনার পরে গঙ্গারিডি যুগে কালীসাধনার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হল। এই পর্যায়ে যদিও দুর্গার আদিরূপ দশায়ুধা, সর্পমাতৃকা এবং লক্ষ্মীর বিভিন্ন রূপই সর্বাধিক পূজিত। ভয়ঙ্করী ভয়হরা মাতৃকার সরাসরি প্রকাশ আমরা এখনও খুঁজে পাই নি। তবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়েছি যা পরোক্ষভাবে তাঁর উপস্থিতির প্রমাণ দেয়। ভয়ঙ্করী অথচ অভয়া মাতৃকার একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক দিক হল তাঁর সাথে কালচক্রের ধারণার সংযুক্তি। কাল আমাদের সভ্যতায় চক্ররূপে ধ্যেয় এবং উপাস্য। আমাদের দর্শনে সময় বা কাল একরৈখিক একমুখী নয়। আমাদের চক্রাকার কালের ধারণা বৈপ্লবিক। রেভলিউশন বা আবর্তন ঘটে আমাদের কালের ধারণায়। প্রকৃতিমাতৃকা সেই কালচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনিই ভবচক্রে নিপীড়িত জীবগণকে কৈবল্যদান করেন। চণ্ডীর সেই স্তুতি এই প্রসঙ্গে স্মরণ করি: কলাকাষ্ঠাদিরূপেন পরিণামপ্রদায়িনী যিনি কলা কাষ্ঠা ইত্যাদির( সময়ের প্রাচীন একক) রূপে পরিণাম প্রদান করেন। আজও কুমারী পূজার সময় এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত কুমারীর ক্রমান্বয়ে বিকাশের প্রতীক হিসাবে মাতৃকার ষোলোটি রূপের পূজাকে কালপূজা বলা হয়। তন্ত্র অনুযায়ী কালের সংহার করেন বলেই মাতৃকা কালী নামে পরিচিত। সেই কালচক্রের দ্যোতক মাতৃকার চক্রচিহ্ন; যা পরে বৈষ্ণব ধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। চক্র মাতৃকার বিমূর্ত বা aniconic প্রতীক। তন্ত্রাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতায় প্রচুর রিং স্টোন পাওয়া গেছে, সেগুলি মাতৃধর্মের দ্যোতক। চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় রাসচক্রমণ্ডল পাওয়া গেছে। সেখানে আটজন নারী একটি চক্রকে ঘিরে নৃত্য করছেন। তাঁরা সকলেই মৎস্যকন্যা; যেটি খুব সম্ভবত গঙ্গারিডির সাথে গ্রীক সংস্কৃতির সংযোগের প্রতীক। চক্রের কেন্দ্রে একটি অষ্টদল পদ্ম; যা সাঙ্খ্যে বর্ণিত প্রকৃতির অষ্টতত্ত্বের প্রতীক এবং পরবর্তী সময়ে তন্ত্রসাধনায় অঙ্কিত যন্ত্রের একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। তন্ত্রমতে জগতের আদিকারণ রূপী ঐ অষ্টদল পদ্মেই মাতৃকার অধিষ্ঠান হয়। সুতরাং প্রাচীন রাসমণ্ডলের চক্রও সেই মাতৃকারই প্রতীক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বৈষ্ণব ধর্মের চক্র প্রতীকটিও এই মাতৃকার সূত্রে এসেছে। চক্র যিনি ধারণ করেন, চক্রস্বামী (বিষ্ণু, নারায়ণ), তিনিই কিন্তু শক্তিমান। শক্তি অব্যক্ত, প্রকাশের অতীত, বাক্য ও মনের অগোচর, তাই শক্তিমানের উপাসনা করতেন যারা তারাই পরে বৈষ্ণব আখ্যা পেয়েছেন। গঙ্গারিডির আরেকটি মূর্তি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে একজন মাতৃকা মাথায় নাগছত্র অর্থাত সাপের ফণার মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছেন; হাতে চন্দ্রকেতুগড়ের রাসমণ্ডলের মতোই একটি চক্র। নাগছত্র সর্পমাতৃকার দিকে ইঙ্গিত করে। চক্র কালচক্রের এবং কালীর দ্যোতক। চমকপ্রদ বিষয় হল তন্ত্রে কিন্তু কালীর এরকম একটি রূপ আজও আছে; যেখানে সর্পমাতৃকা ও কালী একীভূত। সেই রূপটি হল দেবী গুহ্যকালীর। বীরভূমের আকালিপুরে মহারাজ নন্দকুমারের প্রতিষ্ঠিত মা গুহ্যকালীর প্রসঙ্গে বলা হয় ইনি মগধরাজ জরাসন্ধের ইষ্টদেবী ছিলেন। যদি এই বিষয়টিকে আমরা এইভাবে বিচার করি যে তাম্রাশ্মযুগ ও গঙ্গারিডি যুগে কালীসাধনার একটি ধারা এমন ছিল যেখানে কালচক্র এবং সর্পমাতৃকার তত্ত্বের সমন্বয় ঘটেছিল; তবে গঙ্গারিডির এই বিশেষ বিগ্রহটির তাৎপর্য বোঝা যায়। তাম্রাশ্মযুগের মাতৃকার মূর্তিশৈলীর একটি বিশিষ্ট প্রকাশ আজকের জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মুর্তিশৈলী; যা হরপ্পা সভ্যতার টেরাকোটা মূর্তিশৈলীর উত্তরাধিকার বহন করে। মূর্তির হস্ত হরপ্পাযুগে পূর্ণাঙ্গ হত না, স্কন্ধ থেকে দুদিকে সামান্য প্রসারিত, অর্থাৎ যাকে বলে schematic হত। সুগোল মুখমণ্ডলের দুদিকে চক্ষুদ্বয় সুবিশাল হত। কলেবর প্রায়ই কোমরে শেষ। যারাই হরপ্পা সভ্যতার টেরাকোটা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, সবাই বুঝতে পারবেন যে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা মূর্তিকল্পনার সঙ্গে আশ্চর্য মিল আছে। স্মর্তব্য, ওই একই রকম টেরাকোটা মূর্তি পাণ্ডু রাজার ঢিবি থেকেও পরেশ দাশগুপ্তের প্রত্নখননে পাওয়া গেছিল। এবং কালীঘাটের কালীর বিগ্রহও এই শৈলীতেই নির্মিত। আজও টেপাটেপি পুতুল, দশহরা পুতুল ও দীপাবলি পুতুল সেই শৈলী বহন করছে। শুধু আমরাই ভুলে গেছি যে এ শুধুই পুতুল নয়; আমাদের শিল্পরীতির প্রথম অধ্যায় যাকে সযত্নে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।
গঙ্গারিডির কালীসাধনার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ কালীঘাট। কারণ টলেমি গঙ্গারিডির যে মানচিত্র অঙ্কন করেছিলেন; সেখানে আজকের কলকাতা অঞ্চলের নাম Collygrammam. যার বাংলা করলে হয় কালীগ্রাম। অর্থাত এই জনপদ খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকেই কালীর নামাঙ্কিত ছিল। প্রসঙ্গত বেথুন কলেজ, শিয়ালদহ, ক্লাইভ হাউস সহ কলকাতার একাধিক স্থানে গঙ্গারিডির প্রত্ন নিদর্শন মিলেছে; সেকালের কলকাতা ছিল মহাসমৃদ্ধ রাজধানী চন্দ্রকেতুগড়ের শহরতলি। সেখানে কালীর নামাঙ্কিত পীঠ এবং সেই পীঠের কালী বিগ্রহে হরপ্পার মূর্তিশৈলীর প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহ নেই। আবার আরো আশ্চর্য হল পুরীর জগন্নাথ এবং কালীঘাটের সতীপীঠে সতীর পদাঙ্গুলির মহাস্নান একই তিথিতে হয়; আষাঢ়ের স্নানযাত্রার দিনে। দক্ষিণবঙ্গ ও কলিঙ্গ সেক্ষেত্রে গঙ্গারিডি যুগে তন্ত্রের এবং কালীসাধনার এক নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিল।
গঙ্গারিডির পরে গুপ্তযুগ। কালীসাধনার ধারা এই সময়ে অনেক বিবর্তিত; অনেক পরিণত। তবুও লক্ষণীয় বিষয় হল তন্ত্রের আদিপর্বের সাথে তার সংযোগ এই পর্যায়েও ছিন্ন হয় নি। এই সময়ের কালীসাধনার সাহিত্যিক নিদর্শন অনেক আছে। সেগুলোই এক এক করে আলোচনা করব। প্রথমেই শুরু করব শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থ দিয়ে। গুপ্তযুগেই সপ্তশতী চণ্ডী তার বর্তমান রূপ লাভ করে। যদিও এই গ্রন্থে পৌরাণিক ভাবনার অভ্যন্তরে তন্ত্রের আদি ঐতিহ্যই প্রকাশিত হয়েছে। এই চণ্ডীতে কালীর উল্লেখ দুইভাবে এসেছে। প্রথম উল্লেখ কৌশিকী দেবীর আবির্ভাব প্রসঙ্গে। শুম্ভ নিশুম্ভের অত্যাচারে নিপীড়িত দেবগণ হিমালয়ে গিয়ে জগতজননী অপরাজিতার স্তব শুরু করলেন। গৌরীদেবী তখন স্নানের উদ্দেশ্যে গঙ্গায় যাচ্ছিলেন। দেবতার এই স্তব শুনে তিনি রহস্য করে প্রশ্ন করলেন: আপনারা কার স্তব করছেন? তখনই তাঁর দেহকোষ থেকে মঙ্গলময়ী অম্বিকা আবির্ভূত হলেন এবং বললেন: দৈত্যপীড়িত এই দেবগণ আমার স্তব করছেন। পার্বতীর দেহকোশ থেকে আবির্ভূতা এই দেবীই কৌশিকী নামে পরিচিত হলেন। আর তাঁর আবির্ভাবের পরেই পার্বতী দেবীর বর্ণ কালো হয়ে গেল এবং তিনি কালিকা নামে পরিচিত হলেন। এই কাহিনী কালীসাধনার ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অম্বিকা কিন্তু স্পষ্টত প্রথমে এই আখ্যানে মূল দেবী নন। কিন্তু এরপরে পরিমার্জিত করে তাঁকেই প্রধান আখ্যা দেওয়া হয়। যেহেতু তিনি পার্বতীর শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে যাঁকে দেখা গেছিল, তিনিই কালী; আজ আমাদেরও আরেকবার সে পদ্ধতিতে কালীকে খুঁজে নিতে হবে। অর্থাৎ আর্যাবর্তের বৈদিকতা আমাদের ছেড়ে চলে গেলে যিনি থাকবেন তিনিই কালী। এরপরে চণ্ডীতে কালীর সবিশেষ বিবরণ আছে চণ্ডমুণ্ড বধের সময়। চণ্ডমুণ্ডের সৈন্যদের দেখে ক্রোধে যখন দেবী কৌশিকীর মুখ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল; তখন তাঁর ভ্রুকুটিকুটিল ললাট থেকে বেরিয়ে এলেন কালী। তিনি হাতে বিচিত্র খট্বাঙ্গ অসি ও পাশ ধরে আছেন; কন্ঠে নরমালা( মুণ্ডমালা কিম্বা কর্তিত শবদেহের মালা), পরিধানে চিতাবাঘের ছাল, দেহ অতি শীর্ণ; মূর্তি অতি ভীষণ। করালবদনী লোলরসনা দেবীর চোখদুটি কোটরে ঢোকা এবং রক্তবর্ণ। তাঁর ভয়ঙ্কর হুঙ্কারে ত্রিভুবন কম্পিত। এই রূপ আজকের কালীর থেকেও বেশি মেলে পালযুগের দেবী চর্চিকার সাথে। চণ্ডীতে চণ্ড মুণ্ড বধের পরে এই কালীই চামুণ্ডা নাম পেয়েছেন। যদিও নামটির এই ব্যুৎপত্তি একেবারেই ব্যাকরণসঙ্গত নয়। বরং দ্রাবিড় ও ব্রাত্য সংস্কৃতির বিলুপ্ত ভাষারীতিই এখানে প্রকাশিত হয়েছে। হরিবংশ অনুযায়ী চণ্ডী হলেন শবর ও পুলিন্দগণের উপাস্য দেবী; বসুবন্ধুর ‘বাসবদত্তা’ অনুযায়ী গঙ্গাতীরে কুসুমপুরে( বর্তমান মগধ ও গৌড়বঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চলে) কাত্যায়নীরূপে তিনি শুম্ভনিশুম্ভনাশিনী, প্রণত মহাদেবের জটাস্থিত গঙ্গায় তাঁর চরণ অভিষিক্ত, আবার তিনিই বেতালাভিধানা( বেতালা নামে পূজিতা; বেতাল প্রমুখ ভীষণ অনুচরগণ পরিবৃতা)। বৈন্যগুপ্তের বৈগ্রাম তাম্রশাসনে উত্তরবঙ্গে পূজিতা কোকামুখী চণ্ডী ও কোকামুখস্বামী বিষ্ণু মূর্তির কথা জানা যায়। কোক শব্দের অর্থ বৃক বা নেকড়ে। চণ্ডীতে রক্তবীজের সাথে সংগ্রামের সময় আবির্ভূতা মাতৃকাদের মধ্যে চণ্ডিকা দেবী ছিলেন; যিনি শত শত শিবা অর্থাত শৃগালের মতো চিৎকার করেন। শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় এঁকেই কোকামুখী বলেছেন। চামুণ্ডা কালী ও চণ্ডীর এই মিল লক্ষণীয়। শাক্তদের মনোজগতে এই সময় মাতৃকার চণ্ডী ও কালী দুই রূপ একাকার হয়েছিল। তবে এছাড়াও আরো দুটি কথা লক্ষ্যণীয়। চণ্ডীতে কালীর দুই আবির্ভাবই অম্বিকার সাযুজ্যে। যদিও তাঁকে আদিমাতৃকা বলা হয়নি। বরং আদিমাতৃকার নিত্য রূপগুলিরই অন্যতম বলা হয়েছে। এই চণ্ডীতেই কালীর সাথে একে একে আবির্ভূত হয়েছেন ব্রাহ্মী মাহেশ্বরী কৌমারী প্রমুখ মাতৃকাগণ; যাঁরা একত্রে সপ্তমাতৃকা নামে পরিচিত। সপ্তমাতৃকার আদিতম নিদর্শন মিলেছে হরপ্পায়; আগেই বলেছি। কালীকে সেই আদি ধারার সাথে সংযুক্ত করলেও কেন্দ্রীয় আসনটি দিতে স্পষ্টতই চণ্ডীর রচনাকারের সংকোচ প্রকাশ পেয়েছে বারবার। শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছিলেন এই সময় আর্যাবর্তে কালীর এক ভীষণ সর্বগ্রাসিনী রণদুর্মদ রূপকল্প প্রচলিত ছিল। কালীকে আর্যাবর্ত ভয় পেতো; আবার উপেক্ষাও করতে পারত না। তাই চণ্ডীতে বারবার তাঁকে ভয়মিশ্রিত ভক্তির আসন দেওয়া হয়েছে। চণ্ডমুণ্ডের বধের পরেই সেখানে বলা হয়েছে: দৈত্যদের এই দুই দলপতির বধের পরে কালী অট্টহাস্য করলেন এবং “তেন নাদেন মহতা ত্রাসিতম্ ভুবনত্রয়ম্” সেই ভয়াবহ নাদে তিন ভুবন সন্ত্রস্ত হল। এই ত্রাস অবৈদিক সংস্কৃতির রণরঙ্গিণী কালরূপা মাতৃকার প্রতি বৈদিক পরিমণ্ডলের ত্রাসও বটে।
চণ্ডীতে কালীর যুদ্ধ প্রসঙ্গে আরেকটি সুন্দর তথ্য পাই যা মাতৃসাধনার ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কালীর চণ্ডমুণ্ডের সাথে যুদ্ধের সময় মুণ্ড কালীর উদ্দেশ্যে যখন শত শত চক্র নিক্ষেপ করছে এবং মেঘবর্ণা কালীর বিশাল মুখগহ্বরে যখন সেই চক্রসমূহ অন্তর্হিত হচ্ছে; তখন মেধস ঋষি তাকে বর্ণনা করছেন এই ভাবে: বভুর্যথার্কবিম্বানি সুবহূনি ঘনোদরম্ ( যেন মেঘের উদরে সমাহিত সূর্যের অগণিত প্রতিবিম্ব)। আমরা জানি দশায়ুধা দশভুজা দুর্গা আদিতে ঊষা রূপে পূজিত হতেন। দুর্গাপূজার বোধন আদিতে অন্ধকার নাশ করে পূর্ব আকাশে উদিত ঊষার বোধন; সুকুমার সেন মহাশয় বলেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন বেদে ঊষাকে দশভুজা বলা হয়েছে। মাতৃকা দশদিকে আলোর অস্ত্র হেনে অন্ধকার নাশ করেন; তাই তিনি ঊষা রূপে পূজিতা। আজও যে তন্ত্রে আমরা মাতৃকাকে প্রভাতে কুমারী; মধ্যাহ্নে যুবতী এবং সায়াহ্নে বৃদ্ধা রূপে উপাসনা করি; সূর্যমণ্ডলে তাঁর অগ্নিময়ী বৈরোচনী রূপের আরাধনা করি; এ সবই ঐ ঊষার সূত্রেই এসেছে। গঙ্গারিডির দশায়ুধা মূর্তিতেও এজন্য দেখি মাতৃকার খোঁপা থেকে দশটি অস্ত্র আলোকরশ্মির মতো দশদিকে নির্গত। মহিষ দানবিকতা ও অন্ধকারের প্রতীভূ। মহিষমর্দিনী ঊষারূপিণী মাতৃকা তাকে ধ্বংস করে আলোর বার্তা আনছেন। যেন দিগন্তে নব অরুণোদয় হচ্ছে অন্ধকারের গর্ভ থেকে। এই তত্ত্বই সম্ভবত আদি তন্ত্রসাধকরা অধিগমন করেছিলেন। সেক্ষেত্রে কালীর রূপবর্ণনায় মেঘমণ্ডলের মধ্যে সূর্যবিম্বের এই উপমা সেই আদি ঊষার সাধনার সাথেই তাঁর সাধনতত্ত্বকে সংযুক্ত করে।
চণ্ডীর পাশাপাশি গুপ্তযুগের অন্যান্য বিবরণগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করি এবার। মহাভারত দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে লিপিবদ্ধ হয়েছিল, লিপিবদ্ধ হওয়া শেষ হয় ৪০০ খ্রিষ্টাব্দে। মহাভারতে মা কালীর ভয়াল রূপবর্ণনা আছে মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে যখন অশ্বত্থামা পাণ্ডবপক্ষীয় বীরদের শিবিরে রাতের বেলায় প্রবেশ করে সবাইকে হত্যা করছেন। তখন সেই হননস্থলে কালী এভাবে দৃশ্যমান হচ্ছেনঃ রক্তাস্যনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, পাশহস্তা, ভয়ঙ্করী। কালীর ভীষণ স্বরূপ সংহারের প্রতীক; কালরাত্রিরূপিণী এই দেবী বিগ্রহবর্তী সংহার।
হরিবংশ গ্রন্থে (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) মহাদেবীর শিবারূপ উল্লিখিত। মা এখানে শৃগালরূপে বসুদেবকে যমুনা পার হয়ে গোকুলে যাওয়ার পথ নির্দেশ করেছিলেন। যদিও এখানে কালীর নামোল্লেখ নেই সরাসরি, মহাদেবী বলা হয়েছে, কিন্তু এ বর্ণনা স্পষ্টই কোকমুখ কালীর স্মৃতিবাহী। প্রসঙ্গত আজও কিছু বিরল কালীসাধক শিবাভোগ দেন লোকালয় থেকে দূরে। মাকে শিবাদূতী বলা হয়, কারণ শৃগাল তাঁর দূত। বৃহন্নীলতন্ত্রে শিবাভোগ এবং শিবারূপিণী কালিকার সাধনক্রম আলোচিত হয়েছে। বাংলায় শৃগাল ও ব্যাঘ্রের আকৃতিবিশিষ্ট কালীর প্রাচীন শিলাময়ী বিগ্রহও প্রচুর। আগের পর্বেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। পরেও আবার প্রসঙ্গটি আসবে।তবে শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় যথার্থ সিদ্ধান্ত করেছেন। এসব বর্ণনায় কালীর কোনও দেবীত্বের আভাস নাই; কালী এখানে অত্যন্ত ভীত মনের একটা ভয়ঙ্করী ছায়ামূর্তি দর্শনের ন্যায়। বলা যায়, বৃহৎ বঙ্গের সুপ্রাচীন অভয়া মাতৃকার প্রতি আর্যাবর্তের বৈদিক পরিমণ্ডলের মনোভাব যথার্থ প্রকাশ পেয়েছে এখানে।
কালিদাস কালীকে শিবের ভগিনী বলেছেন; যা আজকের তন্ত্রভাবনার নিরিখে বিস্ময়কর। কিন্তু মনে রাখতে হবে যজুর্বেদে অম্বিকা রুদ্রের ভগিনী। মহাভারতে একানংশা সুভদ্রা কৃষ্ণের ভগিনী। বেদেই রুদ্রগণের মাতারূপেও পরমা মাতৃকাকে দেখা যায়। সম্ভবত পুরুষতত্ত্বের জননী ও ভগিনী রূপেই তখন মাতৃকার উপাসনা হতো। কারণ আদি জননীর স্বামীর ধারণা তখনও অনুপস্থিত। রঘুবংশ গ্রন্থে কালিদাস মা কালীকে বলাকিনী বলেছেন। রামের সঙ্গে যুদ্ধরত তাড়কা রাক্ষসীকে দেখে মা কালীর মত মনে হচ্ছিল, কালিদাস লিখেছেন। বারবার কালীর সাথে বলাকার এই সংযোগ কাকতালীয় নয়। অতীতের পক্ষীমাতৃকার ধূসর স্মৃতি এই সময় বারবার ফিরে এসেছে। আজও কালীর পনেরোজন সহচরী বা নিত্যার মধ্যে বলাকিনী/বলাকা অন্যতম। তন্ত্রের দেহতত্ত্বে সহস্রারে মাতৃকার অধিষ্ঠান ত্রিকোণাকার ক্ষেত্রকে আজও কাকীমুখ অর্থাত স্ত্রী কাকের মুখের সাথে তুলনা করা হয়। “তব তত্ত্ব গুণত্রয় কাকীমুখ আচ্ছাদনী”; মহারাজ নন্দকুমার লিখেছিলেন। শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয়ের মতে কালী যে তখনও রীতিমত পূজিতা হতেন; স্বয়ং কুমারসম্ভবের কবি কালিদাসের নামটিই তার প্রমাণ।
বাঙালির কালীসাধনার ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্ব এখানেই শেষ করছি। পরের মাসে আসব তৃতীয় পর্ব নিয়ে।
কপিরাইট: রক্তিম মুখার্জ্জী সৌজন্যে Yatrapath Cultural Society
ছবিতে: গঙ্গারিডির মাতৃকা যিনি কালী ও সর্পমাতৃকার একীভূত রূপ; কালীঘাটের মা কালী, শৃগালমুখী কালী, কালীর পঞ্চদশ নিত্যা, জহুরা কালী, ঘাগর বুড়ি
তথ্যসূত্র: ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য; শশিভূষণ দাশগুপ্ত সুকুমার সেন মহাশয়ের প্রবন্ধসমূহ সপ্তশতী চণ্ডী তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়ের “মা কালীর উৎসরণ” প্রবন্ধ
মেদিনীপুরের কর্ণগড়ের দেবী মহামায়া ও দেবী অভয়া। কর্ণগড় অষ্টাদশ শতাব্দীর চূয়াড় বিদ্রোহের নেত্রী রাণী শিরোমণির দুর্গ ছিল। তবে মহামায়ার এই পীঠ অনেক প্রাচীন। রাণী নিত্য মা মহামায়ার আরাধনা করতেন। দেবী মহামায়া বগলামুখী রূপে ও দেবী অভয়া কালী রূপে পূজিত হন। মন্দির প্রাঙ্গণে দণ্ডেশ্বর শিব আছেন। আর আছে তন্ত্রসাধক রঘুবাবার মন্দির। ইনি এই মন্দির সংলগ্ন পঞ্চমুণ্ডীর আসনে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কষ্টি পাথরের সিঁদুর চর্চিত এই দুই মাতৃমূর্তির বৈশিষ্ট্য হল মূর্তির বিশিষ্ট নির্মাণশৈলী। তীক্ষ্ম চঞ্চুর মতো নাক, গোল চোখ; যা তাম্রাশ্মযুগের উপমহাদেশের মাতৃমূর্তির এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তা এই মূর্তিতে আছে। মূর্তির হস্ত সেযুগে পূর্ণাঙ্গ হত না, স্কন্ধ থেকে দুদিকে সামান্য প্রসারিত, অর্থাৎ যাকে বলে schematic হত। সুগোল মুখমণ্ডলের দুদিকে চক্ষুদ্বয় সুবিশাল হত। কলেবর প্রায়ই কোমরে শেষ। আজকের জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মুর্তিশৈলী, টেপা টেপি, দীপাবলি পুতুল, দশহরা পুতুল হরপ্পা সভ্যতার সেই আদি টেরাকোটা মূর্তিশৈলীর উত্তরাধিকার বহন করে। এবং কালীঘাটের মা কালীর বিগ্রহও এই শৈলীতেই নির্মিত। প্রসঙ্গত কালীর রূপের মধ্যে পক্ষীমাতৃকার নিবিড় প্রভাব আছে। হরপ্পা ও ঝোব অঞ্চলের ভীষণা পক্ষীমাতৃকাকে গবেষকগণ কালীর আদিরূপ বলে গণ্য করেন। আবার কালিদাসের কুমারসম্ভবে কপালাভরণ পরিহিতা কালী নীলাকাশে বলাকিনী রূপে বর্ণিতা। আজও কালীর পঞ্চদশ নিত্যার একজন বলাকা; সহস্রারে মাতৃকার অধিষ্ঠান কাকীমুখ নামে পরিচিত। আবার বগলামুখীর নামের মধ্যেই বগলা অর্থাত বলাকার মতো মুখের অনুষঙ্গ আছে। যদিও বগলামুখীর বর্তমান মুখাবয়ব পাখির মতো নয়; তবে তাঁর একটি বিশেষ রূপ বড়বামুখীর মুখ আজও সারসের মতো। কর্ণগড়ের মহামায়া ও অভয়ার বিগ্রহে সেই আদিরূপেরই প্রকাশ ঘটেছে।
কর্ণগড়ের অবস্থান প্রাচীন বৃহৎ বঙ্গের কলিঙ্গে; তাম্রলিপ্তের কাছে। গঙ্গারিডির রাজধানী গঙ্গে( সেনযুগের চন্দ্রকেতুগড়) নগরও খুব দূরে নয়। অন্যদিকে বৃহৎ বঙ্গের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তসীমাও খুব দূরে নয়। ফলে যুগপৎ মাতৃসাধনার প্রবল প্রভাব এবং প্রান্তভূমির প্রেক্ষাপটেই এই প্রাচীন পীঠকে বিচার করতে হবে। প্রান্তভূমিতে মাতৃকার ললিত রূপের তুলনায় ভয়ঙ্করী ভয়হরা রূপ অধিক জনপ্রিয় হয়। আমাদের পশ্চিম প্রান্তে মা ঘাগরবুড়ি( ঘাগর বা রণবাদ্যের ধ্বনিতে যিনি প্রীত হন) এবং উত্তর পূর্ব প্রান্তে মা কেচাইখান্তি( রিপুগণের কাঁচা রক্ত যাঁর প্রিয়) আছেন। সেভাবেই প্রাচীন বৃহৎ বঙ্গের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে এই পীঠ পক্ষীমাতৃকার ভীষণা অভয়দাত্রী রূপের অধিষ্ঠান। আরো একটি কথা। মাতৃকার তিন, চার, পাঁচ সহচর/সহচরী সমেত মণ্ডলই সাধারণত বেশি দেখা যায়। তবে এক সহচরী সমেত রূপও খুব বিরল নয়। মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতে মা চণ্ডীকে পদ্মার সাথে দেখি; যা এই মণ্ডলের দৃষ্টান্ত। কর্ণগড়েও মহামায়া বগলামুখী ও অভয়া কালিকা সেই রীতিতেই অধিষ্ঠিতা।
রক্তিম মুখার্জ্জী
মন্দির সংক্রান্ত তথ্য ও ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই অঙ্গিরা দত্ত দণ্ডপৎ দিদিকে। পক্ষীমাতৃকার উপাসনা বিষয়ক তথ্য পেয়েছি তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়ের কাছে।
শিবের জাগরণের তিথি অতিক্রান্ত। বছর শেষ হতে বাকি আর পাঁচটি রাত। যে ভূমিতে আদিবিদ্বান কপিল প্রকৃতির পঞ্চ তত্ত্বের বর্ণনা করেছেন আদি সাঙ্খ্যে; যেখানে পাঞ্চরাত্রের পথে ভাগবতধর্মে মাতৃকার অধিষ্ঠান ঘটেছে; আদিজননীর পঞ্চ তত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে গঙ্গারিডির দশায়ুধা মাতৃকার মণ্ডল থেকে শুরু করে শ্রীচৈতন্যদেবের সময় পর্যন্ত; সেই মাতৃসাধনার মহাতীর্থ বৃহৎ বঙ্গে বছরের এই শেষ পঞ্চরাত্রি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখন প্রতি সন্ধ্যায় শৈবক্ষেত্রসমূহে ভক্তদের সমাগম। সারাদিন কঠোর সংযমে থেকে সন্ধ্যার সময় শৈবতন্ত্রের অনুসারীদের মহা উল্লাসের ক্ষণ এখন। আকন্দ আর কল্কে ফুলের মালা কন্ঠে ধারণ করে হাতে বেতের লাঠি নিয়ে ঢাকের তলে “বলো শিব মহাদেব” ধ্বনিতে তাঁরা মাতিয়ে তুলবেন আকাশ বাতাস। নাচবেন তাঁদের চিরায়ত নৃত্য। দুই পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে নির্দিষ্ট তালে এই নাচের মধ্যেও নিহিত আছে তন্ত্রের গূঢ় ব্যঞ্জনা। দুইদিকে দুইজন সহচর/সহচরীর মাঝে মধ্যবর্তী মাতৃকার রূপকল্প এই উপমহাদেশে সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে আছে। একেই দেহতত্ত্বের ভাষায় ঈড়া পিঙ্গলার মাঝে সুষুম্নার গতির সাথে তুলনা করা চলে। সেই আদি তন্ত্রের ভাবনাই এই নাচের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলেছে। এরপর মন্দির প্রাঙ্গণে সকলে শিবকে বন্দনা করবেন সন্ধ্যাভাষার রহস্যময় ছড়ায়:
আট পাটকাঠি বর্ণ আলেরকোমভীরাবর্ণ ডাইনে চন্দ্রবর্ণ আর বর্ণ সরস্বতীর গান শীতলার বর্ণ গোঁসাই যায় জল্লীবাণ
গবেষক যমুনাপ্রসাদ দাস মহাশয় প্রমাণ করেছিলেন এই পদটি শশাঙ্কের শেষ রাজ্যাঙ্ক অর্থাত সপ্তম শতকের মধ্যভাগ থেকে প্রচলিত আছে। এখানে সাঙ্খ্যের পঞ্চ তত্ত্বের পথে মহাযান আর শৈবধর্ম প্রবেশ করেছে মাতৃসাধনার ধারায়। তাই তো ছড়ায় আছে: সুড়ুম তুড়ুম নিদের ঘোর পাঁচ ব্রাহ্মণ চাহে ক্রোড় শিবের শক্তিসমন্বিত বাণমূর্তির উপাসনার লগ্ন এখন। বাণের মধ্যে যুক্ত হয়েছেন তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের শূন্যতত্ত্ব। “সোনে ভরিলি করুণা ণাবি” তাই তো কাঠের বাণসোনার বিগ্রহ নিয়ে ভক্তদের এত আনন্দ। গুপ্তোত্তরযুগে জয়নাগ ও শশাঙ্কের চেষ্টায় গৌড়তন্ত্রের পুনরুত্থানের সোনালি দিনগুলোর স্মৃতি আজও মিশে আছে এই বাণসোনার উপাসনার রীতিতে।
কিন্তু এহ বাহ্য। এর পরেও আছে সমস্ত রাত্রি জুড়ে তন্ত্রাচারী এই মহাজাতির অপূর্ব সাধনপদ্ধতি। শ্মশানবোলানের বহিরঙ্গের মধ্যে দিয়ে সেখানে আজও প্রকাশিত হয় ভীষণা ভয়হারিণী মাতৃকার আদি অকৃত্রিম রূপকল্পের দ্যোতনা। কান্দি সংলগ্ন রূপপুরের রুদ্রদেবের গাজনে এই দিকটি বিশেষভাবে ধরা পড়ে। রুদ্রদেব অক্ষোভ্য বুদ্ধ। বজ্রযানে ও সহজযানে অক্ষোভ্যকুলের গুরুত্ব অপরিসীম। অক্ষোভ্যকুলের দেবদেবীগণ ঘন নীলবর্ণ; প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক। একজটা, পর্ণশবরী, হেবজ্র, আর্যজাঙ্গুলি, মহাচীনতারা, যমান্তক, মহাকাল, চর্চিকা, নৈরাত্মার উপাসনার পথে; উড্ডিয়ানের সাধকদের বিশিষ্ট সাধনক্রমের মাধ্যমে এই কুলেই ভয়ঙ্করী ভয়হরা আদিমাতৃকার আদি সাধনার ধারাটি পুনরায় আত্মপ্রকাশ করেছিল পাল-সেনযুগে। কালীর বর্তমান রূপের উত্থানও এই কুলের সাথে সংযুক্ত। তাই রূপপুরে অক্ষোভ্যের এই পীঠে দেখি গাজনের রীতিতে তন্ত্রের আশ্চর্য সমাবেশ। এখানে ভক্তদের সুবিশাল বাহিনী নিজ নিজ কুলপতির নামে নামাঙ্কিত। কেউ লাউসেনপাতা, কেউ রুদ্রদেবপাতা, কেউ কালিকাপাতা। এখানে পাতা অর্থে পালনকর্তা। মনে রাখতে হবে পা শব্দটি সহজযানে চুরাশি মহাসিদ্ধের নামের সাথে সংযুক্ত ছিল। লুইপা, কুক্কুরীপা, সরহপা, কাহ্নুপা থেকে শুরু করে নারোপা, বিরূপা, ঢেন্ঢণপা পর্যন্ত এই রীতিই দেখা যায়। পাতা শব্দটি কি সেই নামকরণের রীতির সাথেই যুক্ত? কল্পনা করুন পালযুগের উড্ডিয়ান। দেবী বজ্রযোগিনীর মহাপীঠে অগণিত সহজযানীর সমাবেশ ঘটেছে। তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। কেউ দারিকপা শিষ্য। কেউ শবরীপার সহচর। কেউ অজোকাপার সাথে এসেছেন। কেউ ভুসুকুপার সাথে। রুদ্রদেবের গাজনে ভক্তদের এই নামকরণও বোধহয় সেভাবেই হয়েছে; তন্ত্রের এক একটি ধারার ঐতিহ্য সঙ্গে নিয়ে। এখানে কোনো দল আসেন ঘোর লালরঙে নিজেদের আপাদমস্তক রাঙিয়ে। কেউ আসেন কালোরঙ মেখে। লাল কালো এই দুই রঙ উপমহাদেশে মাতৃসাধনার সাথে বহুকাল ধরেই নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। আবার সাদা, লাল, কালো, হলুদ ও সবুজ এই পাঁচ রঙ বজ্রযান ও সহজযানে পঞ্চ কুলের বর্ণও বটে। যাই হোক; ভক্তরা এই রঙের পাশাপাশি নিজেদের সাজান সাদা ফুলের মালায়। আর পরিধান করেন নরকরোটির মালা। চমকে উঠবেন না। এ অতি রাবীন্দ্রিক আধুনিক বিশ্বমানব ভদ্রলোকদের সমাবেশ নয়। গঙ্গারিডির দুর্দান্ত গৌড়ীয় জাতির চারণভূমি। মশালের আলোয় অন্ধকার রাতে কালো আর লাল রঙে, ফুলের মালা আর নরকপালের সাজে তাঁদের নাচ দেখলে কালিদাসের কুমারসম্ভবের সেই বর্ণনা মনে পড়ে। নরকপালের মালা পরিহিতা কালীকে সেখানে কবি দেখেছেন নীলাকাশে বলাকিনীর মতো। ভক্তদের এই সাজ যেন মাতৃকার সেই নৃত্যরতা বলাকিনী রূপের অণুরণন। কি ভাবছেন? এত ভয়ঙ্কর সাধনা কেন? সহজযানের ঋজুপথে চলার পথে যে অনেক বাধা; অনেক বিভ্রান্তির গোলকধাঁধা। সেই যে কাহ্নুপা গেয়েছিলেন: ডোম্বী! তুমি নগরের বাইরে থাকো। ব্রাহ্মণ্যের অহঙ্কার আর ভিক্ষুর আত্মগর্ব তোমায় ছুঁতে পারে না। তোমার জন্য আমি হাড়ের মালা পরে ঘৃণা ত্যাগ করে কাপালিক অবধূত হবো। এই গাজনের সাধনরীতি সেই অবধূতমার্গেরই বহিঃপ্রকাশ।
রুদ্রদেবের প্রাঙ্গণে এরপর কঙ্কালের দেহাবশেষ নিয়ে শুরু হয় শ্মশান বোলান। কাক শকুনের নৃত্য; শেয়ালের সমবেত কলরবের সেই পরিবেশনা দেখলে মাতৃকার বিচরণক্ষেত্রের অতিভয়াকুল রূপটি চোখের সামনে ফুটে উঠতে বাধ্য। তবু ভক্ত নির্ভয়। তার চেতনা তখন শিবারূপিণী মায়ের ধ্যানে আর চর্যার গুহ্যগীতির সুরে নিমগ্ন।
উপ গোঁসাই প্রভাত হয়ে পরের লেখা নাদ লেখিয়ে সোনার ঘাটে পা ভাড়িয়ে রূপার ঘাটে পা ফেলিয়ে সাষ্যি হইয়ো নিলাম বোর আজ আমাদের এক প্রহর এ প্রহর আমরা শিবকে দিয়ে যে বর মাগি সে বর পেয়ে মনের বাঞ্ছা পূর্ণ হয় মহাদেব মহাদেব মহাদেব
রক্তিম মুখার্জ্জী
তথ্য কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয় ও ঈশানু আচার্য।
গঙ্গারিডি যুগে বাংলায় কালীসাধনার ধারা প্রবল ছিল; আগেই বলেছি। আজকের কলকাতা ছিল সেকালের কালীগ্রাম। তাই কালীসাধনা অবশ্যই হতো। তাহলে বিশেষ করে গুহ্যকালীর প্রসঙ্গ কেন? কারণ মা গুহ্যকালীর সাধনার ইতিহাস সেইদিকে ইঙ্গিত করে।
মহারাজ নন্দকুমার মা গুহ্যকালীর যে মূর্তি ওয়ারেন হেস্টিংসের নজর এড়িয়ে কাশীরাজ চৈৎ সিংহের প্রাসাদ থেকে এনে বীরভূমের আকালিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন; জনশ্রুতি অনুযায়ী সেই মা গুহ্যকালী ছিলেন মহাভারতের যুগের মগধরাজ জরাসন্ধের ইষ্টদেবী। বঙ্গবগধচের জনপদ পক্ষীমাতৃকার উপাসক ছিল; বৈদিক পরিমণ্ডলে ব্রাত্য ছিল। পক্ষীমাতৃকার উপাসনার আদি নিদর্শন হরপ্পার পরেই যেখানে আমরা পাই; সে হল বাংলায় বীরভূম বর্ধমানের সংযোগস্থলে অজয়ের তীরে পাণ্ডুরাজার ঢিবি। মহাভারতের যুগ ঠিক কতকাল আগে; সে নিয়ে কোনো বিতর্কে যাব না। তবে জরাসন্ধের গুহ্যকালী সাধনাকে তন্ত্রের আদিপর্বের সাথে যুক্ত করা অসঙ্গত হবে না। কিন্তু সমস্যা হল মহারাজ নন্দকুমার মা গুহ্যকালীর যে বিগ্রহ নিয়ে আসেন; যার জন্য আকালিপুর আজও আপামর বাঙালির তীর্থভূমি; সেই মূর্তি অত প্রাচীন নয়।
আদিযুগের মাতৃকার মূর্তিশৈলী বুঝতে হলে হরপ্পার ও পাণ্ডুরাজার ঢিবির মাতৃমূর্তিগুলি দেখা আবশ্যক। মূর্তির হস্ত সেযুগে পূর্ণাঙ্গ হত না, স্কন্ধ থেকে দুদিকে সামান্য প্রসারিত, অর্থাৎ যাকে বলে schematic হত। সুগোল মুখমণ্ডলের দুদিকে চক্ষুদ্বয় সুবিশাল হত। কলেবর প্রায়ই কোমরে শেষ। আজকের জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মুর্তিশৈলী, টেপা টেপি, দীপাবলি পুতুল, দশহরা পুতুল হরপ্পা সভ্যতার সেই আদি টেরাকোটা মূর্তিশৈলীর উত্তরাধিকার বহন করে। এবং কালীঘাটের মা কালীর বিগ্রহও এই শৈলীতেই নির্মিত। কিন্তু আজকের গুহ্যকালী বিগ্রহের শিল্পরীতি অনেক পরিণত; বড়োই নয়নাভিরাম। এ রীতি পাল সেনযুগের অনেক পরবর্তী; মধ্যযুগের; সন্দেহ নেই। সম্ভবত গুহ্যকালীর সাধনার একটি পরম্পরা সুপ্রাচীন বৃহৎ বঙ্গে ছিল; জনৈক মগধরাজের তাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানও ছিল। আজকের আকালিপুরের মা গুহ্যকালীর বর্তমান রূপ সেই পরম্পরাতেই বহুকাল পরে নির্মিত হয়েছে। মা তাই তাঁর আদি ঐতিহ্যের জনশ্রুতি আজও ধারণ করে আছেন।
সে তো হল। কিন্তু গঙ্গারিডিতে গুহ্যকালীর সাধনার সূত্র কোথায়? তার জন্য আগে তন্ত্রে দেবী গুহ্যকালীর যে বিবরণ দেওয়া আছে সেটা দেখতে হবে। গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ তাঁর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। তিনি নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা। স্পষ্টতই এই রূপে তন্ত্রের আদিপর্বের ছায়াসম্পাত ঘটেছে। এখানে শিব মাতৃকার পুত্রবৎ। আবার আকালিপুরের মূর্তিতে শিব একেবারেই অনুপস্থিত। মাতৃকা একাই সর্বেশ্বরী; আদি সাঙ্খ্য ও আদি তন্ত্রের প্রকৃতির মতো। কাজেই অনুমান করা যায় একটি অতি প্রাচীন মূর্তিকল্প থেকেই এই বিগ্রহটি পরবর্তী যুগে নির্মিত। শশাঙ্কপূর্বযুগে শিবের সঙ্গে শক্তির পতি পত্নীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি আমরা জানি, আগে অনেকবার লিখেছি। শ্রী শ্রী চণ্ডী গ্রন্থেও শিবের সঙ্গে শক্তির কোনও বিশেষ সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে গুহ্যকালীর মধ্যে সর্পমাতৃকার নিবিড় সংযোগ আছে। সর্পমাতৃকা উপাসনার প্রাচীন প্রথা উপমহাদেশে হরপ্পা সভ্যতা থেকে মহাভারত যুগে অনবরত চলেছে, চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় সর্পমাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে। পালযুগে সমস্ত প্রতিমার মধ্যে সবথেকে বেশি যে মূর্তি পাওয়া যায়, তা হল মনসা বা সর্পমাতৃকা। এছাড়া সর্প তন্ত্রের দেহতত্ত্বের সাথে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট। তন্ত্রে আদিমাতৃকা কুণ্ডলিনীকে ভুজঙ্গিনী রূপে ধ্যান করা হয়। মাতৃকা সেই সর্পরূপ অঙ্গে ধারণ করেন। সুতরাং গুহ্যকালীর মধ্যে সর্পমাতৃকা ও কালরূপা কালীর একীভবন ঘটেছে। আর এই সূত্রেই আমরা গঙ্গারিডির এক বিশেষ মাতৃমূর্তির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত এই মূর্তিতে মাতৃকার মাথায় নাগছত্র। হাতে একটি চক্রাকার মণ্ডল। ভয়ঙ্করী অথচ অভয়া মাতৃকার একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক দিক হল তাঁর সাথে কালচক্রের ধারণার সংযুক্তি। কাল আমাদের সভ্যতায় চক্ররূপে ধ্যেয় এবং উপাস্য। আমাদের দর্শনে সময় বা কাল একরৈখিক একমুখী নয়। আমাদের চক্রাকার কালের ধারণা বৈপ্লবিক। রেভলিউশন বা আবর্তন ঘটে আমাদের কালের ধারণায়। প্রকৃতিমাতৃকা সেই কালচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনিই ভবচক্রে নিপীড়িত জীবগণকে কৈবল্যদান করেন। চণ্ডীতে মহাদেবী সম্বন্ধে বলা হয়েছে: তিনি কলা কাষ্ঠা ইত্যাদির( সময়ের প্রাচীন একক) রূপে পরিণাম প্রদান করেন। আজও কুমারী পূজার সময় এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত কুমারীর ক্রমান্বয়ে বিকাশের প্রতীক হিসাবে মাতৃকার ষোলোটি রূপের পূজাকে কালপূজা বলা হয়। তন্ত্র অনুযায়ী কালের সংহার করেন বলেই মাতৃকা কালী নামে পরিচিত। সেই কালচক্রের দ্যোতক মাতৃকার চক্রচিহ্ন; যা পরে বৈষ্ণব ধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। চক্র মাতৃকার বিমূর্ত বা aniconic প্রতীক। তন্ত্রাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতায় প্রচুর রিং স্টোন পাওয়া গেছে, সেগুলি মাতৃধর্মের দ্যোতক। চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতায় রাসচক্রমণ্ডল পাওয়া গেছে। আমাদের আলোচ্য মাতৃকার হাতের ঐ চক্রাকার মণ্ডল গঙ্গারিডিরই রাসমণ্ডলের সমতুল্য অন্যান্য মণ্ডলের সাথে হুবহু মিলে যায়। তাই কালচক্রের দ্যোতক এই চক্রধারিণী মাতৃকাকে স্বভাবতই কালীর আদিরূপের সাথে যুক্ত করা চলে। অন্যদিকে এই মাতৃকার মাথায় নাগছত্র সর্পমাতৃকার প্রতীক। ঠিক আজকের গুহ্যকালীর মতোই কালরূপা কালী ও নাগমাতা এখানে একাকার। জরাসন্ধের উপাসনার কাহিনীতে যদি তন্ত্রের আদিপর্বের ইঙ্গিত নিহিত থাকে; তবে গঙ্গারিডির এই মাতৃকাকে মা গুহ্যকালীর সাথে যুক্ত করা চলে।
মাতৃকার উপাসনা বাঙালির ধর্মভাবনার প্রাচীনতম প্রবাহ। বহুরূপে মা আছেন আমাদের জাতীয় জীবনে। তাঁর তত্ত্ব বড়ো মধুর আবার বড়ো দুর্জ্ঞেয়ও বটে। মায়ের বর্তমান রূপের প্রতিষ্ঠাতার ভাষাতেই বলি: শ্রীনন্দকুমার কয় তত্ত্ব না নিশ্চয় হয় তব তত্ত্ব গুণত্রয় কাকীমুখ আচ্ছাদনী ভুবন ভোলাইলি মা …
এ শরীরে কাজ কি রে ভাই দক্ষিণা প্রেমে না গেলে এ রসনায় ধিক ধিক যদি কালী নাম নাহি বলে
এই পদ গেয়েছিলেন মাতৃসাধক রামপ্রসাদ সেন। বড়োই সত্য কথা। বাঙালির জাতীয় জীবন যুগ যুগ ধরে কালীময়। কালী ছাড়া বাঙালির প্রাণের ভুবন আঁধার। তন্ত্রেও বলা আছে: কালিকা বঙ্গদেশে চ। বঙ্গভূমির নাম তাঁর সাথে এতটাই নিবিড়ভাবে সংযুক্ত যে তাঁকে বঙ্গেশ্বরী অভিধা দেওয়া হয়েছে। বাঙালির রাজধানীও কালীক্ষেত্র কলকাতা। মনে রাখতে হবে বাকি ভারতেও বহুকাল ধরেই কালীসাধনার ধারা আছে। বাঙালির আদি পূর্বসূরিদের সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানও আছে। কিন্তু সেই সাধনার মধ্যে আছে ভয়ঙ্করী রণরঙ্গিণীর প্রকাশ। তাঁর এলোকেশে প্রলয় দোলে; পদভারে ত্রিভুবন কাঁপে। শুধু বাঙালিই সেই কালরূপাকে তাঁর সমস্ত মহিমা অক্ষুণ্ণ রেখেও আদরিণী শ্যামা মায়ে পরিণত করে যতনে হৃদয়ে ধরে রাখতে পেরেছে। বাঙালিই কখনও মায়ের মধুর রূপের সমুদ্রে ডুবে সাধক কমলাকান্তের কন্ঠে বলেছে: শ্যামা মা কি আবার কালো? আবার রামপ্রসাদের পদে সেই বাঙালিই বলেছে:
কালোরূপ অনেক তো হয় এ বড়ো আশ্চর্য কালো এ রূপ হৃদয়মাঝে রাখলে পরে হৃদিপদ্ম করে আলো
শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে বাঙালি পদকর্তাদের সম্বন্ধে বলেছেন: …তাঁহারা অসুরবিনাশিনী ভয়ঙ্করী কালী মূর্ত্তিকে নিজেদের হৃদয়পদ্মে স্থাপিত করিয়া যে রূপান্তর ঘটাইয়াছেন তাহাই বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।…কালীর কালো দেহে রুধিরের ছটা যেন কালিন্দীর কালো জলে ভাসিয়া যাওয়া কিংশুকের ছটা। আবার মনে হইতেছে, মায়ের মুখখানি যেন নীলকমল- চূড়ার অর্ধচন্দ্র এই নীলকমলের উপরেই অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। …..কোনো কোনো কবি আবার মায়ের পদনখে রবি শশীর বিভা আনিয়াই ক্ষান্ত হন নাই; উন্মাদিনী রণরঙ্গিণী মায়ের চরণে নুপূরও বাঁধিয়া ছাড়িয়াছেন।”
কালী হয়েছেন বাঙালির যুগযন্ত্রণার নিরসনের চিরশীতল আশ্রয়। তাই বাংলায় তাঁকে নিয়ে কত কাহিনী; কত লীলামাধুর্যের উপাখ্যান। যে রামপ্রসাদের পদ দিয়ে আলোচনা শুরু করলাম; স্বয়ং তাঁরই ঘরে ” মা ভক্তে ছলিতে তনয়া রূপেতে বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া।”
আগের তিনটি পর্বে তারাসাধনার ইতিহাস আলোচনা করেছি। এবার আলোচনা করব কালীসাধনার ধারার ইতিহাস। তিনিই কালী; কৈবল্যদায়িনী। তিনিই ভয়ঙ্করী; তিনিই ভয়হরা। কবি নজরুলের ভাষায়:
তাঁরে অসুরে কয় ভয়ঙ্করী ভক্ত তাঁয় অভয়া বলে
তাঁকে কেন্দ্র করেই বাঙালির তন্ত্রের বর্তমান ধারাটি চলমান। তাঁর মহিমা কীর্তন করতে; যুগযন্ত্রণার মর্মকথা তাঁর চরণে নিবেদন করতেই মধ্যযুগের শেষলগ্নে শাক্ত পদাবলীর মধুর আত্মপ্রকাশ। আজ সাধ্যমত সেই ইতিহাসেরই পর্যালোচনা করব।
বাঙালির মাতৃসাধনার ইতিহাসের অন্যান্য ধারার মতোই কালীসাধনার বিষয়েও নানা ধারণা প্রচলিত আছে। তার কয়েকটি ভ্রান্ত; আরোপিত। কয়েকটি অজান্তেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বহন করে। তাঁকে নিয়ে অনেক কৌতূহল; অনেক প্রশ্ন। কালী কি ভয়ঙ্করী? রক্তপ্রিয়া রণোন্মত্তা? যেমনটা পুরাণ ও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য বলেছে। নাকি তিনি ঘরের মেয়ে? বাগদির বেটি? যাঁর চরণে নিজের সমস্ত ব্যথা; জীবনের সব ভার নিঃশেষে ব্যক্ত করে মহাসাধক কমলাকান্তের মতো বলা যায়: আর কিছুই নাই মা শ্যামা শুধু দুটি চরণ রাঙা
সাধককবি কমলাকান্ত প্রশ্ন করেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি? মা কালীর উত্থানের ইতিহাস রচনায় এই প্যারাডক্স মাথায় রাখতে হয়। তিনি প্রকৃতি, কাজেই আদ্যা এবং নিত্যা। যে মা অনাদি অনন্ত আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত জগদকারণ, যিনি নারী পুরুষ নির্বিশেষে, জীব জড় নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বজগতের উৎপত্তি, বিস্তার ও বিলয়, আমরা সীমিত মানববুদ্ধিতে নিজেদের চিন্তার সুবিধার জন্য সেই মায়ের প্রতিমা এভাবে যুগে যুগে নির্মাণ করেছি।
কালীর উপাসনার আলোচনায় মনে রাখতে হবে বঙ্কিমের সেই বিখ্যাত অ্যানেকডোট, সিংহ-শিকারের চিত্র দেখে সিংহটা বলেছিল, সিংহরা ছবি আঁকতে জানলে ছবিটা অন্যরকম হত। শশাঙ্ক প্রায়শঃ শত্রুহস্তে চিত্রিত। অতএব পাঠ করতে গেলে against the grain পদ্ধতিতে পড়তে হয়। প্রকৃতি বা শক্তিও শত্রুহস্তে চিত্রিত হয়েছেন। hostile depiction ঘটেছে। আরও একটা কথাও আছে। আমাদের এই ভীষণদর্শনা মাতৃকাকে যখন শত্রুরা ভয় পেয়েছে, সেটা আমাদের সাহায্যে এসেছে, কাজেই সে রূপ আমরাও স্বীকার করেছি। বীভৎস রস থেকে বীর রসের জন্ম হয়, মায়ের এই রূপ আমাদের বীরত্বে সহায়ক, মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে সাহায্য করে। অগ্নিযুগের চারণকবি মুকুন্দ দাস সেজন্যই লিখেছেন, ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।
এভাবেই আমাদের মাতৃকা হয়ে উঠেছেন যুগপৎ ভয়ঙ্করী ও অভয়া। ভয় এবং অভয়ের এই আশ্চর্য সমন্বয় বা ভয়াভয়া রূপ উপমহাদেশের মাতৃকা উপাসনার এক ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। আর এইটিই উপমহাদেশে মাতৃকার প্রাচীনতম মূর্তিকল্পের খোঁজে আমাদের সহায়কও বটে। আর এই সূত্রেই সর্বপ্রাচীন যে প্রত্নমূর্তিগুলি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেগুলি হল সিন্ধু সরস্বতী বদ্বীপের উত্তরে মেহরগড় ঝোব অঞ্চলের মাতৃমূর্তি। প্রশ্ন উঠতে পারে বাঙালির কালীসাধনার ইতিহাস খুঁজতে ভারতের অপর প্রান্তের প্রসঙ্গ আনার কারণ কী? কারণ এই অঞ্চলেই উপমহাদেশের প্রাচীনতম মাতৃপূজক নগরসভ্যতার পত্তন ঘটেছিল তাম্রাশ্মযুগে। সিন্ধু সভ্যতায় ভবিষ্যতের বাঙালির মাতৃসাধনার ধারার সমস্ত আদি লক্ষণ বিদ্যমান। অতুল সুর মহাশয় অনুমান করেছিলেন এই অঞ্চলের অধিবাসীরাই তাম্রাশ্মযুগের শেষদিকে বীরভূম বর্ধমানের সীমায় অজয় অববাহিকায় পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে বাঙালির প্রথম নগরসভ্যতার নির্মাণ করেছিলেন। দুই সভ্যতার সমতুল্য মৃৎপাত্র( লাল কালো), খাদ্যাভ্যাস( মাছ), নৌ পরিবহনের আধিক্য, মাতৃমূর্তির এবং সেগুলোর নির্মাণশৈলীর সাদৃশ্য এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। নৃতাত্ত্বিক প্রমাণও দিয়েছিলেন রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়। কাজেই বাঙালির কালীসাধনার আদিতম বীজটিও এখানেই নিহিত ছিল। এই বালুচিস্তান ঝোব অঞ্চলে অনেকগুলি মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে যাঁরা প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে ভয়ঙ্করী ভয়হারিণী রূপের আদিতম দৃষ্টান্ত। বেলুচিস্তানের কুল্লি ঢিপিতে আবিষ্কৃত এ-জাতীয় মূর্তির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে স্টেন মন্তব্য করেছেন, this strikingly confirms the view previously advanced that these figures represent a divinity of fertility, the ‘mother-goddess’ of many eastern cults। বেলুচিস্তানের মেহি-ঢিপিতে আবিষ্কৃত মূর্তিকা-প্রসঙ্গেও তাঁর মন্তব্য প্রায় একই। ঝোব্ উপত্যকার মূর্তিকাগুলির রূপ কিন্তু ভীষণা, কখনও বা করোটির মত। তবুও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এগুলির মূলেও আদিম উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাসই অনুমান করেছেন। এ-জাতীয় মূর্তির বর্ণনায় পিগট্ যেমন বলেছেন, a grim embodiment of the mother-goddess who is also the guardian of the dead – an underworld deity connected like with the corpse and the seed-corn buried beneath the earth” (দেবীপ্রসাদ ভারতীয় দর্শন ৭২)। অর্থাৎ যেভাবে মৃতদেহ ও বীজ উভয়েই মাটির নিচে চাপা থাকে, সেভাবে এই মাতৃকা উর্বরতাসূচক, এবং মৃতদের রক্ষক, তিনি পাতাললোকের ঈশ্বরী। ডান হাতে খড়্গ নিয়ে বাম হাতে শঙ্কাহরণ করা যে মাতৃকার অপূর্ব বৈশিষ্ট্য; এভাবেই তাঁর আদি রূপের উৎসরণ ঘটেছিল। প্রসঙ্গত মাতৃকাদেবী তন্ত্রে পৃথিবীর সাথে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট। মার্কণ্ডেয় পুরাণে চণ্ডী হচ্ছেন মহীদেবী। আধারভূতা যদস্তমেতাঃ মহীস্বরূপেন যতঃ স্থিতাসি (সকলের আধার রূপে মহীরূপে তুমি নিত্য বিদ্যমান।) আদিমাতৃকার বসুধারা রূপটি তার সার্থক দৃষ্টান্ত। প্রসঙ্গান্তরে এই নিয়ে আলোচনা করব।
বালুচিস্তান মেহেরগড়ের এই মাতৃকা ছিলেন পক্ষীমাতৃকা। অর্থাত পাখির মতো তীক্ষ্ম চঞ্চু; জননীর মতো স্তন্যদায়িনী; আবার দেবীর মতো ঐশ্বর্যলক্ষণ তাঁর মূর্তিতে। তাম্রাশ্মযুগের মাতৃমূর্তির এ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বস্তুত আজও তন্ত্রে মাতৃকার সাথে পক্ষীর অপূর্ব সংযোগ আছে। কালীসাধনার বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে আলোচনার সময় এটি বারবার প্রতিভাত হবে। সুকুমার সেন মহাশয় জানিয়েছেন ঊষা এবং নিশা নামে যে দুই ভগিনী দেবীর কথা বেদে উল্লিখিত হয়েছে; তাঁরাই দুর্গা ও কালীর আদিতম প্রকাশ। এর মধ্যে ঊষাই আদি দশভুজা; তাঁর পূজা উপলক্ষ্যে শূলাঘাতে মহিষমেধের প্রত্ন প্রমাণ উপস্থাপিত করেছেন আস্কো পারপোলা ও শিরিন রত্নাগর। অশ্বত্থ বৃক্ষে ঊষার সাথে সাতজন মাতৃকার পূজা করছেন পুরোহিত; বলিদান করছেন একটি সুবৃহৎ ছাগ; এমন সিলও পাওয়া গেছে। প্রসঙ্গত চণ্ডী অনুযায়ী সপ্তমাতৃকার মধ্যে কালী/চামুণ্ডাও আছেন। আজও বাংলা তথা দাক্ষিণাত্যে এই সপ্তমাতৃকার উপাসনার সুপ্রাচীন নিদর্শনের অভাব নেই। কাজেই সিন্ধু সভ্যতায় যে কালীর আদিতম রূপ প্রকাশিত হয়েছিল সেটা বোঝা কঠিন নয়। এর সাথে সিন্ধু সভ্যতার প্রান্তে ঝোব ও বালুচিস্তানের ভয়ঙ্করী ভয়হারিণী ঐ মাতৃমূর্তিগুলির প্রমাণকে যোগ করলে আমরা কালীসাধনার একদম গোড়ার দিকের চিত্রটি অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারি। সিন্ধু সভ্যতার অন্তিম পর্বেই বীরভূমের পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে অবিকল একই রকম পক্ষীমাতৃকার মূর্তি পাচ্ছি। সাথে পাচ্ছি একদম সমতুল্য লাল কালো মৃৎপাত্র। এই লাল আর কালোর সমাহার মাতৃকা উপাসনার শুরু থেকে আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সিন্ধু ও বালুচিস্তানের মাতৃমূর্তিতেও এই দুই রঙের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। ঘোর অমানিশার অন্ধকার ভেদ করে ঊষাকালীন সূর্যের মতো রক্তবর্ণ ধারণ করে মাতৃকা উদিত হচ্ছেন বরাভয়ের আশ্বাস দিতে; সম্ভবত এটাই ছিল প্রথম মাতৃসাধকদের অন্তরের অনুভব। সেটাকেই তাঁরা এই দুই রঙে ধরে রেখেছিলেন। ঘন কালো চুলের মাঝে সিন্দুরের তিলক এবং সমুদ্র সন্নিহিত সভ্যতার অলঙ্কার রূপে শঙ্খও সম্ভবত এভাবেই যুক্ত হয়েছিল মাতৃপূজার ধারায়। হরপ্পার মাতৃমূর্তিতে তাই সিন্দুর ব্যবহার এবং শঙ্খের অলঙ্কারের বাহুল্য অত্যন্ত প্রচলিত ছিল। পরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেই আনন্দময় উপাসনার রীতিকে সংকুচিত করেছে; শাঁখা সিন্দুরকে বিবাহিত নারীর জন্য বাধ্যতামূলক করে তার মূল তাৎপর্য হরণ করা হয়েছে। তবু আজও মাতৃসাধনার সময় সিন্দুরের তিলকে; মাষভক্ত বলির সময় কালো রঙের মাষকলাইয়ে লাল সিন্দুর মাখানোর রীতিতে; বিজয়া দশমীর সিন্দুর খেলায় এবং সর্বোপরি মা কালীর মূর্তিতে লাল কালোর অপূর্ব সমন্বয় বড়ো অনায়াসেই তন্ত্রের আদিপর্বের মধুর এক অধ্যায়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রূপকথার গল্পেও বোধহয় সেজন্যই সাতমহলা পুরীর রাজকন্যার প্রধান সহচরী লালসখী ও কালোসখী।
প্রসঙ্গে ফিরি। হরপ্পার পক্ষীমাতৃকার উপাসনার ধারাই পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে প্রকাশিত হয়েছিল। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পূর্ব ভারতের অধিবাসীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে: বয়াংসি বঙ্গবগধশ্চেরপাদাঃ অর্থাত বঙ্গ, বগধ( কারো মতে মগধ; কারো মতে আজকের বাগদি জাতির সাথে সম্বন্ধিত বাংলার কোনো প্রাচীন ভূখণ্ড) এবং চের জনপদের অধিবাসীরা পক্ষীভাষী। অতুল সুর মহাশয়ের মতে প্রাচীন বাঙালির নগরসভ্যতায় পক্ষীমাতৃকার উপাসনার যে ধারাটি অত্যন্ত প্রবল ছিল; সম্ভবত তার কারণেই বৈদিক পরিমণ্ডলে অবৈদিক ব্রাত্য সংস্কৃতির এই মহাজাতি পক্ষীভাষী বলে উল্লিখিত হয়েছেন। গঙ্গাসাগর সন্নিহিত সুন্দরবন অঞ্চলে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের একটি মৃৎফলকে একজন মুনির চিত্র পাওয়া গেছে। তিনি বাঙালির আদিবিদ্বান কপিল হতে পারেন। তাঁর হাত পা হাঁসের মতো লিপ্তপদ যুক্ত। সম্ভবত পক্ষীমাতৃকার উপাসক জাতির এক সুসন্তানকে উপাস্য মাতৃকার মতো করেই আঁকা হয়েছিল। এভাবেই পক্ষীমাতৃকার উপাসনার নিবিড় প্রভাব আমরা লক্ষ্য করতে পারি বাঙালির ধর্মভাবনার আদিতম অধ্যায়ে। প্রত্নতাত্ত্বিক পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয়ের উৎখননের ফলে খ্রীষ্টপূর্ব দুই হাজার থেকে এগারোশো শতাব্দীর পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে হাঁস, বলাকা এবং কাকের মতো মুখযুক্ত পক্ষীমাতৃকার মূর্তি পাওয়া যায়। আজও কালীর সাথে এই পক্ষীদের নিবিড় সংযোগ আছে। কালীর পঞ্চদশ নিত্যা অর্থাত প্রধানতম পনেরোজন সহচরীর মধ্যে বলাকিনী অন্যতম। গুপ্তযুগের মহাকবি কালিদাস সাদা নরকপালের( মড়ার মাথার খুলির) মালা পরিহিতা ঘন নীলবর্ণা কালীকে দেখে নীলাকাশে শুভ্র বলাকার উপমা দিয়েছেন। পক্ষীমাতৃকার তীক্ষ্ম চঞ্চু পরে বিবর্তিত হয়ে আজকের লোলজিহ্বায় পরিণত হয়েছে; তাঁর দুই ডানা রূপান্তরিত হয়েছে খড়্গে। এমনটাই মনে করেছেন গবেষক তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়। দুইদিকে দুই ডানা মেলে উড়ন্ত পাখির দেহভঙ্গিতে আদি মাতৃসাধকেরা খুঁজে পেয়েছিলেন ঈড়া ও পিঙ্গলা এই দুই নাড়ির মাঝে সুষুম্না নাড়ির পথে কুলকুণ্ডলিনীর গতির ইঙ্গিত; দেহতত্ত্বের সুগভীর তাৎপর্য। তাই বারবার পক্ষীমাতৃকার আভাস ফুটে উঠেছে পরবর্তী সময়ের তন্ত্রে। শ্মশানে মা কালীর সহচর সহচরীদের মধ্যে কাক, বলাকা ও শকুনদের সমাবেশ। মায়ের নিত্য সহচর শৃগালবাহিনী। আবার হরিবংশে যোগমায়া দেবী শৃগালরূপে বসুদেবকে গোকুলের পথ দেখান। চণ্ডীতে দেবী চণ্ডিকা শিবাদূতী; শত শত শৃগালের রবের মতো অশুভ অট্টহাসিতে তিনি দানবদের সন্ত্রস্ত করেন। শৃগাল এবং কোকা বা নেকড়ের মতো মুখবিশিষ্ট মাতৃকা শিবিখ্যা এবং কোকামুখী কালী তথা চণ্ডীর দুই রূপ। বীরভূমের সুপুরে সুরথ রাজার ঢিবির কাছে শিবিখ্যা দেবীর থান আছে। পুরাণ অনুযায়ী মহারাজা সুরথই প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন। সুতরাং পক্ষী ও পশুর মতো মুখবিশিষ্টা মাতৃকাই যে বাঙালির তন্ত্রধর্মের প্রথম আত্মপ্রকাশকালে জনপ্রিয় ছিলেন; তা বোঝা কঠিন নয়। এটি অবশ্য বহির্বিশ্বের মাতৃসাধনার ধারার ক্ষেত্রেও সত্য। দেবীকে মানবব্যাঘ্র বলে আখ্যা দিয়েছেন সুকুমার সেন মহাশয় এবং অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃতিতে এরকম উদাহরণ টেনেছেন। অন্যত্র শৃগাল পরিবেষ্টিত চণ্ডিকার সঙ্গে নেকড়ে পরিবেষ্টিত গ্রীক পুরাণের পৃথিবীদেবীর তুলনা করেছেন। সিংহবাহিনী মাতৃকার প্রসঙ্গে এই বিষয়টি আরো বিশদে আলোচনা করব। তবে সুমেরের ইনন্যার ভগিনী পাতালের রণরঙ্গিনী দেবী এরেশকিগল থেকে ফিনল্যান্ডের মৃতদের অধিশ্বরী কালমা; ভয়ঙ্করী ভয়হারিণী মাতৃকার কাল্টের এক সুপ্রাচীন সুবিস্তৃত লীলাভূমি বারবার ধরা পড়ে। রৈবতক সেনগুপ্ত মহাশয়ের কাছে জেনেছি ইউরোপের কেল্ট জাতির কয়েকটি পাত্র ডেনমার্কে উদ্ধার করা হয়েছে। Gundestrup Cauldron নামে পরিচিত এই পাত্রগুলির একটিতে এক মাতৃকা চিত্রিত। তাঁর দুই সহচরী, যার মধ্যে একজন মাতৃকার কেশ (বা শিরোভূষণের বন্ধনী) স্পর্শ করে রয়েছেন পরিচর্যার ভঙ্গীতে। মাতৃকার এক হস্ত উত্থিত, সেখানে একটি ছোট পাখি বসে রয়েছে। এছাড়াও আরও দুটি বিশেষ পক্ষী মাতৃকার দুপাশে পক্ষবিস্তার করে অবস্থান করছে। চিত্রের নিম্নে একটি মনুষ্য শবের মত শায়িত, এবং তার মুখ থেকে একটি বিরাট জিহবা নির্গত হয়ে দৃশ্যমান। এই রূপ স্পষ্টতই কালীর পক্ষীমাতৃকা রূপের সাথে সংযুক্ত। কেল্টরা মূলতঃ প্রকৃতি-উপাসনাকারী, মাতৃকাপূজক। খৃষ্টধর্মে Mother Goddess Cult-এর প্রভাববিস্তারের ক্ষেত্রে কেল্ট এবং স্লাভদের অবদান সুবিদিত। এই চিত্রগুলি তন্ত্রের আদিপর্বে ভয়হরা মাতৃকার সেই সুপ্রাচীন ধারাটির চরম সমৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করে; বর্তমান বাঙালির কালীসাধনা সমগ্র পৃথিবীতে যে ধারার একমাত্র টিকে যাওয়া প্রবাহ।
কালীর পক্ষীমাতৃকা রূপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বর্ণমালার সাথে সংযুক্তি। তন্ত্র নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা জানেন তন্ত্রে বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণকে মাতৃকার রূপ বলে উপাসনা করা হয়। মায়ের কন্ঠের মুণ্ডমালাকে পঞ্চাশটি বর্ণের বহিঃপ্রকাশ রূপে গণ্য করেই কালীপূজার সময় বাহ্যমাতৃকান্যাস করা হয়। বর্ণেশ্বরী রূপে কালীর উপাসনা এবং প্রতিটি বর্ণকে সাধনার এক একটি বীজ রূপে সমগ্র দেহে ধারণা করার মাধ্যমেই ন্যাসের অগণিত রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। সাধক রামপ্রসাদ গেয়েছিলেন:
যত শোনো কর্ণপুটে সবই মায়ের মন্ত্র বটে কালী পঞ্চাশত বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে
বেশ বোঝা যায় আমাদের বর্ণমালার সাথে মাতৃসাধনার একটি ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে। কিন্তু এর সূত্রপাত কোথায়? বাঙালির লিপির আদিতম রূপ; যা বঙ্গলিপি নামে পরিচিত; ললিতবিস্তর এবং মহাবস্তু অবদান অনুযায়ী সেই লিপি বুদ্ধের সময় সুপ্রচলিত ছিল। এই লিপিকে অনামা লিপিও বলা হয় এবং ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অতুল সুর প্রমুখের মতে এই লিপি বাস্তবে তন্ত্রের বিভিন্ন প্রতীকের সমাহার। এমনকি ব্রাহ্মীর যে আদিতম রূপটি বাংলায় প্রচলিত ছিল তার সাথে তৎকালীন মাতৃমূর্তিগুলির আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। যেমন কাকমুখী পক্ষীমাতৃকার মূর্তির সাথে ব্রাহ্মী লিপির ক অক্ষর হুবহু মিলে যায়। তন্ত্রের সেই আদিযুগে কালীর আদিরূপ পক্ষীমাতৃকার বিভিন্ন মূর্তি এবং তন্ত্রের বিভিন্ন রহস্যাবৃত প্রতীককেই কি বঙ্গলিপিতে বর্ণের রূপ দেওয়া হয়েছিল? সেই কারণেই কি আজও কালীপূজায় বর্ণমালা এত গুরুত্বপূর্ণ ? বিষয়টি নিঃসন্দেহে গবেষণার দাবি রাখে। কালী তথা মাতৃকার বিভিন্ন নাম এই প্রসঙ্গে লক্ষণীয়। চামুণ্ডা, চণ্ডী, চর্চিকা/চর্চা, চুন্দা/চুন্দী(চন্দ্রী) এই নামগুলি কোনোটাই বিশুদ্ধ সংস্কৃত নয়। প্রাকৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী তথা বঙ্গলিপির সাথে কালীর এই নিবিড় সংযোগ কি বেদের ভাষার বিপরীতে পূর্বভারতীয় ব্রাত্য সংস্কৃতির নিজস্ব ভাষারীতির নিদর্শন? আজও বাংলায় চণ্ডী ও কালীর বহু নাম আছে; যেগুলো স্থানের নামের সাথে আই প্রত্যয় যোগে উৎপন্ন। যেমন বেতাই, মেলাই, গোমাই। এই বৈশিষ্ট্য দ্রাবিড় ও ব্রাত্য আর্যদের ভাষারীতির নিদর্শন। কালীসাধনার আদিতম পীঠের লোকসংস্কৃতি এভাবেই এই ধারায় সম্মিলিত হয়ে আজও রাষ্ট্রভাবনার সাথে সেযুগের মাতৃসাধকদের যোগসূত্রের দিকে ইঙ্গিত করে।
বাঙালির কালীসাধনার ইতিহাসের প্রথম পর্ব এখানেই শেষ করছি। পরের মাসে আসব দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে।
কপিরাইট: রক্তিম মুখার্জ্জী সৌজন্যে Yatrapath Cultural Society
ছবিতে: ১) কৃষ্ণনগরের একটি উনবিংশ শতকের কালীমূর্তি ২) কোপেনহেগেন মিউজিয়ামে বাঙালির তন্ত্রভাবনার প্রতীক হিসেবে রক্ষিত কালীমূর্তি ৩) ও ৪) ঝোব উপত্যকার মাতৃকা ৫), ৬) ও ৭) পাণ্ডুরাজার ঢিবির পক্ষীমাতৃকা ৮) কেল্ট জাতির উপাস্য মাতৃকা ৯) কোকামুখী বা শৃগালমুখী মাতৃকা; টেরাকোটার মন্দিরে
তথ্যসূত্র: ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য; শশিভূষণ দাশগুপ্ত সুকুমার সেন মহাশয়ের প্রবন্ধসমূহ ভারতীয় দর্শন; দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় Excavations at Pandu Rajar Dhibi; পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়; অতুল সুর তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়ের “মা কালীর উৎসরণ” প্রবন্ধ রৈবতক সেনগুপ্ত মহাশয়ের Gundestrup Cauldron বিষয়ক প্রবন্ধ
পালযুগের পর এবার সেনযুগ ও মধ্যযুগের তারাসাধনার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করব। সেনযুগেও তারাসাধনার ব্যাপ্তি সুবিশাল ছিল। তবে পালযুগের প্রথমার্ধের অর্থাত অষ্টম ও নবম শতকের মতো নয়। তার কারণ পালযুগের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থাত দশম শতকে মহীপালের সময় থেকে যখন চুরাশি সিদ্ধগণের সহজযানের ধারা প্রবল হয়ে উঠছিল; তখন বাঙালির মাতৃকা উপাসনা ধর্মের একটি পটপরিবর্তন ঘটেছিল। উড্ডিয়ানে উদ্ভূত সাধনক্রমে সিদ্ধগণের শিরোমণি নারোপা ও নিগু ডাকিনী এই সময় বজ্রযোগিনীর সাধনক্রমকে জনপ্রিয় করে তোলেন। মাতৃকা বজ্রযোগিনীর বিষয়টি স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধে বিশদে উল্লেখের দাবি রাখে। নারোপা ও নিগুমা নাঢ়া নাঢ়ী নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে এঁদের নাম থেকেই সহজিয়া সাধক সাধিকারা বাংলায় নেড়া নেড়ি নামে পরিচিত। অর্থাত সেই সময় বাঙালির তন্ত্রধর্মের তাঁরা অবিসংবাদিত নেতৃপদে আসীন ছিলেন। ফলে বজ্রযোগিনীর প্রবল উত্থানে তারার সাধনক্রম একটু পিছনে সরে যায়। এই সময়েই সহজযানের চর্যাপদে নৈরাত্মা, বজ্রযোগিনী, জাঙ্গুলি ডোম্বী, চণ্ডালী, শবরী রূপে বর্ণিত হচ্ছেন। কালী পূজিত হচ্ছেন নৈরাত্মা, চর্চিকা ও বজ্রযোগিনীর মণ্ডলে। এই ধারাটিই মধ্যযুগের সূচনাকালে সেনযুগের শেষে মা কালীর বর্তমান রূপ নির্মাণ করবে; যা আজও বাঙালির প্রাণের সাথে বাঁধা। বজ্রযানের অনেক দেবী তারার রূপভেদ বা সহচরী হিসাবে পূজিত হতেন; আগেই বলেছি। পালযুগের শেষার্ধ থেকে তাঁরাই বজ্রযোগিনী ও কালীর মণ্ডলের অন্তর্গত হয়ে গেলেন। যেমন অমিতাভকুলের লোহিতবর্ণা কুরুকুল্লা আগে তারোদ্ভবা বা রক্ততারা রূপে তারার মণ্ডলে পূজিত হতেন। সেনযুগের পর থেকে তিনিই কালীর পঞ্চদশ নিত্যার অন্তর্গত এবং তাঁর ধ্যানও কালীর মতোই; শ্যামবর্ণা, হাতে অসি, মুণ্ডমালিনী, দিগম্বরী। তারার বজ্রযানী সাধনক্রমে এই সময় কিছুটা ভাঁটা পড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে তারার সাধনা পালযুগের শেষার্ধে কিম্বা সেনযুগে অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। বরং এই সময় তারার সাধনক্রমের দুটি অভিনব দিক আমরা খুঁজে পাই। প্রথমটি হল মা তারার রূপকল্পের পরিবর্তন। এর আগে আমরা দেখেছি পঞ্চ তথাগতের কুলেই তারার সাধনা প্রচলিত ছিল। অমিতাভ, বৈরোচন, রত্নসম্ভব ও অমোঘসিদ্ধি কুলে আর্যতারা, সিততারা, হরিত্তারা, শ্যামতারা/খদিরবনি তারা, সিতাতপর্ণী তারা, উষ্ণীষবিজয়া, বজ্রতারা, মহাশ্রীতারার যত রূপ ছিল তাঁরা সকলেই সৌম্য শান্তরসের বিগ্রহ। একমাত্র অক্ষোভ্যকুলে তারা ছিলেন উগ্রমূর্তি। কারণ এই কুলে তাঁকে ধারণা করা হতো অজ্ঞানতা ও পাপরূপী রিপুদের দলন করার জন্য। জগতের প্রতি মহাকরুণার প্রকাশরূপেই তাঁর এই রৌদ্ররসের বিগ্রহ। এখানে তিনি একজটা, মহাচীনতারা, উগ্রতারা, মহোগ্রতারা রূপে পূজিত হতেন। কটিতে ব্যাঘ্রচর্ম; অঙ্গে সাপের উপবীত, মাথায় পিঙ্গল জটা, হাতে খড়্গ কর্তৃ ও নরকপাল নিয়ে তিনি প্রজ্জ্বলিত চিতার মধ্যে শবদেহের উপর নৃত্যরতা। সেনযুগের সূচনাকাল থেকে এই রূপটিই ক্রমশঃ গৌড়বঙ্গে তারার জনপ্রিয়তম রূপ হিসেবে উঠে এল। এটা শুধু তারাসাধনার ক্ষেত্রে ঘটেনি; মারীচি, জাঙ্গুলি, কুরুকুল্লা, বজ্রযোগিনীর সাধনক্রমেও এটাই ঘটেছে। রূপকল্পের এই পটপরিবর্তনের পিছনে উড্ডিয়ানের সাধকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কারণ এই সমস্ত সাধনক্রমের সবগুলোই সাধনমালায় উড্ডিয়ানপীঠান্তর্গত; উড্ডিয়ানবিনির্গত প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত হয়েছে। মা কালীর বর্তমান রূপের উত্থানও এই পথেই। তাই সেনযুগের তারাসাধনা মূলতঃ উগ্রতারা মহাচীনতারা একজটার সাধনা। মধ্যযুগ এবং আজকের দিনেও গৌড়বঙ্গে তারার এই রূপগুলিকেই তান্ত্রিকগণ থেকে শুরু করে আমরা সাধারণ মানুষ উপাসনা করি। এই রূপকল্পের সূত্রেই আজকের বাঙালির মননে তারা আর কালী একাকার হয়ে গিয়েছেন।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল তারাসাধনার সাথে অন্যান্য মাতৃকাদের সংযুক্তি। আমরা দেখেছি পালযুগের বজ্রযানেই এর বীজ নিহিত ছিল। তারার সাথে কুরুকুল্লা, চুন্দা, জাঙ্গুলি, প্রজ্ঞাপারমিতার নিবিড় সংযোগের কথা আগেই বলেছি। সেনযুগে সেটাই আরো বিকশিত হয়েছে। বৌদ্ধ বহিরঙ্গ প্রায় ত্যাগ করে তারার সাথে অন্যান্য শাক্ত দেবীদের একাত্ম করে বিশ্বজননীর উপাসনাই এই সময় মুখ্য হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় মহাশয় বাঙালির ইতিহাস আদিপর্বে সেনযুগের সদুক্তিকর্ণামৃতের একজন অজ্ঞাতনামা কবির তারাস্তোত্রের দুটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। যার অর্থ এইরকম:
এই সময়ের মা তারার একটি সিংহবাহিনী মূর্তি পাওয়া যায়, যা কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত। এই মূর্তির সাথে উমা বা জগদ্ধাত্রীর অদ্ভুত মিল আছে।
মা তারার আরেক রূপ বসুধারা আজকের মা লক্ষ্মীর মধ্যে প্রবহমান। পদ্মালয়া মা তারার সঙ্গে পদ্মে আসীন মা লক্ষ্মীর অন্তর্লীন সাযুজ্য আছে, মা তারাকে পদ্মাবতী অমৃতকলসধারিণী বলা হয়েছে পালযুগের সাধনামালার একটি শ্লোকে। শ্রী/লক্ষ্মী এবং তারার সৌম্যরূপের পারস্পরিক সংযোগের কথা দীনেশ সরকার স্বয়ং উল্লেখ করেন। মা লক্ষ্মী যেমন আমাদের ধন দান করেন; সেইরকম ধনদাত্রী ধনদাতারা পালযুগে উপাস্য ছিলেন।
সন্তানকোলে মাতৃকার মূর্তি হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত সমস্ত মাতৃমূর্তির মধ্যে সবথেকে বেশি সংখ্যায় পাওয়া গেছে, ইনিই আদি মাতা আদ্যাশক্তি সন্দেহ নেই। সন্তানকোলে মাতৃমূর্তি চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গাল সভ্যতায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় পাওয়া গেছে। এই সন্তানের স্থানটি শিবকে দেওয়া হয়েছিল, এই রূপেই তারাপীঠের মা তারা উপাস্য হন। বলা দরকার বৌদ্ধ তন্ত্রে হারীতি অথবা আজকের মা ষষ্ঠী সবাই এই সন্তানকোলে মাতৃকার স্বরূপ। এবং মা তারার অন্যতম প্রকাশ এই সন্তানকোলে জগন্মাতা।
বশিষ্ঠ তারার যে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার সাথে আশ্চর্য মিল পাওয়া যায় গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোকের। সেখানে জয়দেব বলছেন:
( আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন। বনভূমি সেই অন্ধকারের শ্যামলিমা মেখে আশ্চর্য সুন্দর। হে রাধে! এই ঘোর রাতে এই ভীত বালককে তুমি গৃহে পৌঁছে দাও। নন্দের এই অনুরোধে যে রাধা যে মাধবকে কোলে নিয়ে কুঞ্জের পথে গমন করলেন; যমুনাকুলে সেই রাধামাধবের কেলিলীলার জয় হোক।)
দেখতে পাচ্ছি বশিষ্ঠারাধিতা তারা যেমন শিবকে শিশুরূপে কোলে আশ্রয় দিয়েছেন; তেমনি গীতগোবিন্দের রাধারাণীও ভয়ার্ত শিশু কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে কুঞ্জবনে প্রবেশ করেছেন। গঙ্গারিডির সেই মাতৃমূর্তির ভাবনাই এখানে রূপায়িত। এবং সদুক্তিকর্ণামৃতের ঐ তারাস্তোত্রের নিরিখে বলা যায় সেনযুগের সহজিয়া বৈষ্ণব ধারাতেও তারাসাধনার নির্যাস প্রবেশ করেছিল।
সেনযুগের তারাসাধনার বৃত্তান্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে গৌড়েশ্বরীর কথা না বললে। বর্তমান মালদহের প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবতীর্থ রামকেলিতে আছে মা গৌড়েশ্বরীর একটি শিলামূর্তি। জনশ্রুতি অনুযায়ী ইনি গৌড়ের সেনসম্রাট বল্লালসেনের কুলদেবী। রামকেলি সুলতানি যুগেও গৌড়ের শাসনকেন্দ্রের খুব নিকটস্থ ছিল। শ্রীচৈতন্যদেব হোসেন শাহের অমাত্য দবির খাস ও সাকর মল্লিক (পরবর্তী জীবনে প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব আচার্য রূপ ও সনাতন) এর সাথে সাক্ষাতের জন্য রামকেলি এসেছিলেন। কাছেই আছে বল্লাল ঢিবি, লক্ষ্মণাবতী। সুতরাং সেনবংশের কুলদেবীর মন্দির এখানে থাকা খুবই সম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই গৌড়েশ্বরী মূর্তি মা উগ্রতারার। তিনি চতুর্ভুজা, মুণ্ডমালিনী, খড়্গ কর্তৃ পদ্ম ও কপাল হাতে শবের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। সুতরাং জনশ্রুতি ও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ একত্র করে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া যায় যে পালবংশের মতো সেনবংশেও তারাসাধনার রীতি ছিল। গৌড়েশ্বরীর আদি মূর্তি ও মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বর্তমান মূর্তিটি সেই প্রাচীন মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ ছিল। আজও এখানকার কুণ্ডে নারীরা নিজ হাতে মৃত পূর্বসূরিদের পিণ্ডদান করতে পারেন। মাতৃতান্ত্রিক বাঙালির আদি সমাজভাবনার এক অনবদ্য নিদর্শন এই রীতি; যা তারাসাধনার সূত্রে আজও বিরাজমান।
মধ্যযুগের তারাসাধনার ধারা মোটামুটি সেনযুগের খাতেই প্রবাহিত হয়েছে। এই সময় দশমহাবিদ্যার সাধনক্রম অত্যন্ত জনপ্রিয়। তারা এঁদের মধ্যে দ্বিতীয় মহাবিদ্যা এবং তাঁর রূপটি হল পূর্বে বর্ণিত উগ্রতারার। উগ্রতারা, একজটা ও মহাচীনতারার উপাসনাই মধ্যযুগে অনুসৃত হয়েছে। সাথে নীলসরস্বতীর সাধনাও প্রচলিত ছিল। নীলসরস্বতীর মধ্যে অতীতের প্রজ্ঞাদায়িনী আর্যতারা ও প্রজ্ঞাপারমিতার ছায়াসম্পাত লক্ষণীয়। তন্ত্রসারে বলা হয় যে তারা ও নীলসরস্বতী বা নীলরূপিনী সারদা অভিন্ন: ইনি শ্যামা, ত্রিনয়না, দ্বিভুজা, এক হাতে বরমুদ্রা অন্য হাতে পদ্ম। তিনি মুক্তবিভূষিতা, তিনি হাসিমুখে বিরাজ করছেন চতুর্দিকে বহুবর্ণা ও বহুরূপা শক্তি পরিবেষ্টিত হয়ে। তাঁর পায়ে রত্নপাদুকা। তিনি বাক প্রদান করেন। যদিও ইনি সরস্বতীর রূপভেদ কিন্তু বর্তমানকালে সরস্বতীর এই রূপ আর সাধারণের মধ্যে পরিচিত বা জনপ্রিয় নয়। ইনি নীলাবতী বা নীলচণ্ডী রূপেও উপাস্য ছিলেন।
চীনাচার, নীলাচার, বামাচার, বীরাচার ও কৌলাচারে তারাসাধনা হয়েছে এই সময়। বৃহন্নীলতন্ত্রে নীলসরস্বতীর সাধনক্রম পাওয়া যায়। বাঙালির সরস্বতী পুজোর রীতিতে নীলসরস্বতী ও ভদ্রকালীর প্রভাব আছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে তারাকে শুধুমাত্র শ্যামবর্ণা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি তারা বহুবর্ণা, নানা বর্ণের তারা আছেন। তিনি রক্তবর্ণের, তিনি শ্বেতবর্ণেরও। সিতাতারা হলেন শ্বেতবর্ণা তারা এবং তাঁর শ্বেতমূর্তির সঙ্গে আজকের সরস্বতীর শ্বেতবর্ণের সাযুজ্য আছে। সিতাতারা শুক্লা, ত্রিনেত্রা, তাঁর মুকুটে পঞ্চ তথাগত অবস্থান করেন। তিনি নানা অলঙ্কার ধারণ করেন। তাঁর সামনের দুই হাতে উৎপলমুদ্রা এবং অপর দুটি হাতের মধ্যে ডাইনে চিন্তামণিরত্নসহ বরদা মুদ্রা এবং বাঁদিকের হাতে পদ্মকোরক। প্রসঙ্গত তারার আরেক রূপ প্রজ্ঞাপারমিতা, যিনি প্রজ্ঞাদায়িনী সরস্বতীর সঙ্গে মিশে আছেন। পালযুগে বিদ্যার দেবী রূপে প্রজ্ঞাপারমিতা ও আর্যতারা যেভাবে পূজিত হতেন; সরস্বতীর সূত্রে সেই ধারা আজও অটুট আছে। সরস্বতীর পূজাবিধির পাশাপাশি এর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত হল সাধককবি নীলকন্ঠের একটি পদ। ‘উমা এলোকেশী জয় মা যোগেশী” এই পদে পদকর্তা ভারতের কোথায় মাতৃকার কোন রূপ পূজিত হন তার একটি তালিকা দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে: নবদ্বীপধামে নীলসরস্বতী। মধ্যযুগের ভারতের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠ নবদ্বীপ। সেই বিদ্যাক্ষেত্রে নীলসরস্বতীর উপাসনা আমাদের সিদ্ধান্তটিকেই সমর্থন করে। তারাসাধনার সাথে কৌল নাথগণের এই সময়ে গভীর সম্পর্ক ছিল। কৌলচূড়ামণি সর্বানন্দ ঠাকুর; যিনি দশমহাবিদ্যার দর্শন পেয়েছিলেন; তাঁর গুরু পরম্পরায় আজও চীনাচারে একজটা পূজিত হন। তথাগত বা বুদ্ধরূপী জনার্দন আজও এই পরম্পরার গুরুপংক্তিতে আরাধিত হন। অন্যদিকে তারাপীঠের বশিষ্ঠ প্রবর্তিত সাধনক্রমে আমরা পাই মীননাথ, কূর্ম্মনাথ ও হরিনাথকে। মীননাথই নাথযোগী মৎসেন্দ্র; গোরক্ষনাথের গুরু। পরের দুজনও নাথপন্থার অন্তর্গত। সুতরাং নাথদের একাংশ কৌলাচারের পথে তারাসাধনার ধারাটিতে সম্মিলিত হয়েছিলেন এই সময়।
মধ্যযুগের তারাসাধকদের মধ্যে আছেন বরেন্দ্রের রত্নগর্ভ ভট্টাচার্য। যিনি গোঁসাই ভট্টাচার্য নামেও পরিচিত ছিলেন এবং বারো ভুঁইয়ার অন্যতম চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের গুরু ছিলেন। সুতরাং তিনি ষোড়শ শতকের শেষভাগে বিদ্যমান ছিলেন। তিনি দিগম্বরীতলায় সাধনা করে তারাসিদ্ধ হয়েছিলেন বলে প্রসিদ্ধি আছে।
সপ্তদশ শতকে শাক্তানন্দতরঙ্গিণীর রচয়িতা ও কালীসিদ্ধ সাধক পূর্ণানন্দের গুরু ব্রহ্মানন্দ পরমহংস ছিলেন তারাসিদ্ধ।
উনবিংশ শতকে বীরভূমের তারাপীঠের দুই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হলেন মহাসাধক বামদেব (বামাখ্যাপা) ও তাঁর গুরু ব্রজবাসী কৈলাসপতি। ব্রজবাসী বাবার জীবনকাহিনী রহস্যাবৃত। তবে সমসাময়িক বিবরণে তাঁর যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার সাথে তন্ত্রোক্ত কৌলাচারী সিদ্ধগণের এবং বশিষ্ঠের গুরু বুদ্ধরূপী জনার্দনের আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। সম্ভবত তিনিও চীনাচারে তারাসিদ্ধ ছিলেন। এক হাতে মদ্যপাত্র; অন্য হাতে বীণা নিয়ে প্রকৃতিসাধনায় মহাসিদ্ধ তিনি। শ্যাম ও শ্যামাকে তিনি অভেদ দর্শন করতেন। ব্রজবাসী নামটি তারই সাক্ষ্য দেয়। গোঁসাই ভট্টাচার্য ও ব্রজবাসী কৈলাসপতির নামে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব সম্ভবত তারাসাধনার সাথে সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের সুপ্রাচীন সংযোগটিরই নিদর্শন বহন করছে। মহাসাধক বামদেবের কাহিনী আমরা সকলেই জানি। তাঁকে বশিষ্ঠ মুনির পুনর্জন্ম বলা হয়। তারাপীঠের বশিষ্ঠের সিদ্ধাসনেই তিনি উগ্রতারার দর্শনলাভ করেছিলেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। সন্তানভাবে মাতৃকার সাধনা করে রামকৃষ্ণদেবের সমকালে তন্ত্রের গ্লানি দূরীভূত করেছিলেন বামদেব। সিদ্ধসাধক তারানাথ (তারা খ্যাপা) ও স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী বামদেবেরই সাধনপরম্পরার দুই সার্থক উত্তরসূরি।
উপসংহারে বলতে পারি; বাঙালির তারাসাধনার ইতিহাস সুপ্রাচীন। গঙ্গারিডি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত কখনও শাক্ত কখনও বজ্রযানী কখনও সহজযানী এমনকি বৈষ্ণব ধারাতেও তারারূপে মাতৃকা আমাদের প্রাণের অর্ঘ্য পেয়েছেন। তাঁর সাধনমার্গ বড়ো সহজ; বড়ো ঋজু। চর্যাপদে তো বলাই আছে: ঋজু পথ ছেড়ে বাঁকা পথে যেও না। বোধি নিকটেই আছে। তার জন্য সুদূর লঙ্কাদ্বীপে যেতে হবে না। উজুরে উজু ছাড়ি মা জাহুরে বঙ্ক নিয়ড়ি বোহি মা জাহুরে লঙ্ক
আধুনিকযুগে নবদ্বীপ রাজবংশের সন্তান শিবচন্দ্র রায় মা তারার রূপ বর্ণনা করেছেন তাঁর অনবদ্য পদে: নীলবরণী নবীনা রমণী নাগিনী জড়িত জটা বিভূষণী নীলনলিনী জিনি ত্রিনয়নী নিরখিলাম নিশানাথ নিভাননী
পরিশেষে; সাধককবি রামপ্রসাদের পদটিই যেন বাঙালির তারাসাধনার হৃৎস্পন্দনকে সবথেকে সরলভাবে প্রকাশ করেছে: এমন দিন কি হবে না তারা যবে তারা তারা তারা বলে তারা বেয়ে পড়বে ধারা
হৃদিপদ্ম উঠবে ফুটে মনের আঁধার যাবে টুটে ধরাতলে পড়ব লুটে তারা বলে হব সারা
ত্যজিব সব ভেদাভেদ ঘুচে যাবে মনের খেদ ওরে শত শত সত্য বেদ তারা আমার নিরাকারা
গুপ্তোত্তরযুগের তারাসাধনার বিষয়টি দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয়ের সিদ্ধান্ত থেকেই জেনেছি। এবার দেখব পালযুগের তারাসাধনার ধারাটি বাংলায় কতটা এবং কিভাবে বিস্তৃত হয়েছিল।
গোপালের সময় থেকে ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকালে বজ্রযানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে কুলভাবনা। মহাযানে যে পঞ্চবুদ্ধকে জগতের রূপ বেদনা সংজ্ঞা সংস্কার বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্দের প্রতীকরূপে ধারণা করা হত; সেই পঞ্চবুদ্ধ হয়ে ওঠেন পঞ্চকুলের প্রতিভূ। বজ্রযান অনুযায়ী ধ্যানগম্য শূন্যতার সাথে করুণার মিলনে এই পঞ্চকুলের উদ্ভব ঘটে; প্রতি কুলে সাধকের চৈতন্যে বিভিন্ন বাসনার পরিস্ফুরণের ফলে বিশেষ বীজ বা ধারণীকে অবলম্বন করে অগণিত দেবদেবীর উৎপত্তি হয়।
এই দেবদেবীগণ নিজ কুলের প্রতীক হিসেবে সেই কুলের বুদ্ধচিহ্ন মুকুটে ধারণ করেন। পরবর্তী সময়ে বৈরোচন অক্ষোভ্য অমিতাভ রত্নসম্ভব অমোঘসিদ্ধি এই পঞ্চবুদ্ধের কুলসমূহে বাঙালির প্রকৃতি উপাসনার ধারা প্রবল হতে থাকে; পাঁচ বুদ্ধের নামাঙ্কিত কুলাচারকে সংকেতার্থে পাঁচ নারীর নামাঙ্কিত করা হয়। ডোম্বী রজকিনী চণ্ডালিনী ব্রাহ্মণী নটিনী। বজ্রযান থেকে সহজযানের উদ্ভবের এ একটি বিশেষ পর্যায়। আবার সাধনতত্ত্বে ডোম্বী হয়ে ওঠেন দ্বৈতভাবের দ্যোতক, চণ্ডালী দ্বৈত থেকে অদ্বৈতভাবে বিকাশের মধ্যবর্তী ভাব, এবং বিশুদ্ধ প্রকৃতিপরায়ণ অদ্বৈতভাবকে বঙ্গালী নামে অভিহিত করা আরম্ভ হয়।
লক্ষণীয় বিষয় হল এই পর্বে ধীরে ধীরে করুণার নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বের পথেই মাতৃকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বৌদ্ধ মহাযান ও বজ্রযানের অন্তরে। আদি সাঙ্খ্যে জগতকে দুঃখময় বলা হয়েছে; সেই দুঃখ নিরূপণের মার্গ হিসাবে প্রকৃতির চতুর্বিংশতি তত্ত্বের সম্যক অনুধাবনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন হতে বলা হয়নি। এখানে বক্তব্য হল প্রজ্ঞাবান হও, কিন্তু জগতবিচ্ছিন্ন নিষ্করুণ হয়ো না। অথচ এই দুঃখবাদের ওপর নির্মিত জৈন, হীনযান, বৈদান্তিক এই তিন মতেই প্রকৃতি থেকে উচ্ছৃতি বা নির্বাণ প্রধান হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির অতীত শূন্যতাকে এরপর মহাযান প্রজ্ঞা ও করুণার দ্বারা অভিষিক্ত করেছে; সেখানে জগতের কল্যাণে লোভনীয় নির্বাণসুখ ত্যাগ করেছেন অবলোকিতেশ্বর। অর্থাত্ সাঙ্খ্যের সিদ্ধান্ত পুনরায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এরপর ক্রমান্বয়ে পালযুগে শূন্য অপেক্ষা প্রজ্ঞা ও করুণারই জয়জয়কার। সেখানে দশবল লোকনাথের হৃদয় কারুণ্যরত্নপ্রমুদিত, তিনি তত্ত্বজ্ঞানের ধারায় অজ্ঞানপঙ্ক দূর করেন; আবার তিনিই বিপুল করুণা প্রতিপালিত, রাজশ্রীর মতো বজ্রাসনে স্থিরভাবে ধারণ করেছেন সর্বজ্ঞতাকে।( খালিমপুর তাম্রশাসন)
শেষ পর্যন্ত এই করুণা এবং প্রজ্ঞার পথেই মাতৃকার নৈর্ব্যক্তিক রূপ সাকার মূর্তি ধারণ করেছে।
পুরাতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিক প্রমাণ নিঃসংশয়ে ইঙ্গিত করছে পালযুগে তারাসাধনা চরম উচ্চতায় পৌঁছায়। তারা সম্ভবত বজ্রযান ও সহজযানে উপাসিতা একমাত্র মাতৃকা যিনি পঞ্চ তথাগতের কুলেই পূজিত হতেন। যদিও বর্তমান তারাসাধনার ধারাটি অক্ষোভ্যকুলের অন্তর্গত। তারা এই সময় মাতৃকাদের মধ্যে প্রধানতম। তাই চুন্দা, মারীচি, প্রজ্ঞাপারমিতা, জাঙ্গুলি, কুরুকুল্লা প্রমুখ মাতৃকাকে তারারই রূপ বলে ধারণা করা হয়েছে বজ্রযানে। জাঙ্গুলির শ্বেতবর্ণ সৌম্যমূর্তিকে বলা হয়েছে আর্যতারারূপিণী। কুরুকুল্লা যে মূর্তিতে হাতে ধনুর্বাণ বজ্র ও পদ্ম ধারণ করে প্রজ্ঞাদান ও রিপুদলনের জন্য নৃত্যরতা; সাধনমালায় সেই রূপটির নাম তারোদ্ভবা কুরুকুল্লা। অর্থাত তারা থেকে উদ্ভূত কুরুকুল্লা। চুন্দা সপ্তকোটি বুদ্ধের জননী। প্রজ্ঞাপারমিতা বিমল প্রজ্ঞাদায়িনী। আর্যতারার রূপের মধ্যে এই দুটি বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। এছাড়া অবলোকিতেশ্বরের একটি মণ্ডল থেকে বোঝা যায় মারীচির অশোককান্তা রূপটি একজটা তারার সাথে সম্পর্কিত। এযাবত্ বাংলায় তারার যে সৌম্যভাবের সমস্ত মূর্তি পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে আর্যতারা, মহাশ্রীতারা এবং খদিরবনি তারা প্রধান। এই সমস্ত রূপের মূল বৈশিষ্ট্য হল: দেবী বিশ্বপদ্মে অধিষ্ঠিতা। সাধকের বোধিচিত্ত যখন শূন্যতার ভাবে ভাবিত হয়; তখনই হৃদয়ে বিশ্বপদ্ম প্রস্ফুটিত হয়। সেই বিশ্বপদ্মে তারা আবির্ভূত হন মহাকরুণা ও প্রজ্ঞার বিমল বিগ্রহরূপে। তাঁর মুকুটে থাকে সাধকের ভাব অনুযায়ী পঞ্চ তথাগতের কোনো একজনের কুলচিহ্ন। কখনও কখনও আবার সেটি অনুপস্থিত থাকে। সেখানে মাতৃকাই সর্বেশ্বরী। আর্যতারা চন্দ্রালোকের মতো শুভ্রবর্ণা। হাতে বরাভয়, পদ্ম ও বজ্র। অতীশ দীপঙ্করশ্রী জ্ঞান এই আর্যতারা বিগ্রহের সাধনা করতেন বলে জানা যায় তিব্বতি সূত্র থেকে। মহাশ্রীতারা রত্নসম্ভবকুলের। তাঁর দুই পাশে বিমল প্রজ্ঞার প্রতীক দুটি প্রস্ফুটিত উৎপল(পদ্ম)। তাঁর বামে থাকেন একজটা ও আর্যজাঙ্গুলি। দক্ষিণে অশোককান্তা ও মহামায়ূরী। তিনিও বিশ্বপদ্মে আসীনা।পাঁচজন ধ্যানী বুদ্ধ তাঁর মুকুটের চারিদিকে অবস্থিত। চার সহচরী সমেত মাতৃকার বিগ্রহ বাঙালির ধর্মভাবনার একটি সুপ্রাচীন এবং ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে সম্ভবত দুইদিকে ঈড়া ও পিঙ্গলার প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিমুখী গতি এবং মধ্যে সুষুম্না; এই তিন নাড়ির দেহতাত্ত্বিক তাৎপর্য আছে। আবার সাঙ্খ্যের আদি পঞ্চতত্ত্বের দ্যোতনাও আছে। মহাশ্রীতারার চার সহচরী মাতৃকাই আবার অবলোকিতেশ্বরের মূর্তির চারপাশে থাকেন। এটি প্রমাণ করে মহাকরুণার মূর্ত বিগ্রহ অবলোকিতেশ্বরের তত্ত্ব বাস্তবে তারার মধ্যে নিহিত আর্ততারণকারিণী মাতৃকার আবহমান রূপকল্পেরই অভিনব প্রকাশ মাত্র। ত্রিতাপদুঃখময় জগত থেকে পরিত্রাণের জন্য সাঙ্খ্য যে প্রকৃতির তত্ত্ব অধিগমন করতে বলেছে; সেই প্রকৃতিমাতৃকাই তারা; আবার অবলোকিতেশ্বরও তাঁরই রূপভেদ। বজ্রযানের সমস্ত দেবতাই এই প্রকৃতিমাতৃকার শূন্যতা ও করুণার যুগনদ্ধরূপ থেকে উৎসারিত।
দুই সহচরী সমেত দ্বিভুজা তারা দণ্ডায়মান অবস্থায় একহাতে বর ও অন্য হাতে অভয়দান করছেন এমন মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। আবার সৌম্য আর বীররসের মিলনের সার্থক দৃষ্টান্ত বজ্রতারা বিগ্রহ। এখানেও তারা বিশ্বপদ্মে বসে আছেন; মুখে সৌম্য হাসি। দুই হাতে বরদ মুদ্রা ও পদ্ম। আবার অন্য দুই হাতে ধনুকে বাণ সংযোজিত করে ধনুকের জ্যা আকর্ণ টেনে আছেন নিক্ষেপের জন্য। এখানে পদ্ম নির্মল চিত্তের প্রতীক। বর মাতৃকার করুণার প্রতীক। ধনুর্বাণ অজ্ঞাননাশের জন্য নিক্ষিপ্ত জ্ঞানালোকের প্রতীক।
দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় ধারণীসংগ্রহ এবং নারায়ণপরিপৃচ্ছ নামক দুটি বজ্রযানী পুস্তকে মহামায়াবিজয়বাহিনী নামে তারাদেবীর একটি রূপের সন্ধান পেয়েছেন। এই রূপে তারা সহস্রমুখী, সহস্রভুজা। সমস্ত তথাগতগণের জননী। এই রূপকে মা তারার বিশ্বরূপ বলা চলে। এবং প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল এই রূপে তারাদেবীকে বলা হয়েছে বজ্রসত্ত্ববন্দিতা। মহাযান ও বজ্রযানে শূন্যতার বিগ্রহ বজ্রসত্ত্ব হলেন আদিবুদ্ধ। তাঁর থেকেই পঞ্চ তথাগতের সৃষ্টি হয়। বেদান্তের ব্রহ্মের সমতুল্য বলা চলে। মহামায়াবিজয়বাহিনী তারা বজ্রসত্ত্বেরও উপাস্যা। অর্থাত বজ্রযানের সর্বোচ্চ আসনটি তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। তিনি ব্রহ্মময়ী নন; বরং বলা চলে ব্রহ্মও তাঁর বন্দনা করেন। এই বিষয়টি তারাসাধনার উত্তুঙ্গ উচ্চতার পরিচয় দেয়।
তারাসাধনার সেসময় বাঙালির রাজশক্তির সাথেও গভীর সম্পর্ক ছিল। অষ্টম শতকে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের নেসরি তাম্রশাসন জানাচ্ছে যে পালসম্রাট ধর্মপালের রাজপতাকায় ও রাজদণ্ডে তারামূর্তি অঙ্কিত ছিল। বলা চলে ধর্মপালের রাজত্বকালে তারাসাধনা বাঙালির রাষ্ট্রধর্ম ছিল। পাল ও সেনযুগে মা তারা শুধু বাঙালির আধ্যাত্মিক জগতের কেন্দ্রেই ছিলেন না; রাষ্ট্রভাবনার সাথেও জড়িয়ে ছিলেন। এই সময় সমগ্র বৃহৎ বঙ্গে অগণিত তারাপীঠ ছিল। তারাসাধনার সূত্রে বাঁধা পড়েছিল গৌড়,সমতট, বরেন্দ্র, রাঢ়, বঙ্গ। দশম-একাদশ শতকে পালসম্রাট মহীপালের সময় একটি অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থে পালরাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রসমূহের একটি তালিকা আছে। বরেন্দ্রভূমিতে রাণা গ্রামে, রাঢ় অঞ্চলে তাড়িহা গ্রামে, সমতট অঞ্চলে বুদ্ধর্থি গ্রামে এবং চন্দ্রগোমিনের বাসভূমি চন্দ্রদ্বীপে তারাপীঠ ছিল বলে জানা যাচ্ছে। এছাড়া ইলামবাজারের কাছে দেবীপুর অঞ্চলে পূজিতা প্রাচীন সুহ্মেশ্বরী দেবী পালযুগের আর্যতারা। সুহ্ম ছিল দক্ষিণ রাঢ়ের প্রাচীন নাম। সুহ্মের যিনি অধিশ্বরী তিনিই সুহ্মেশ্বরী। মা তারার এই নামটিই প্রমাণ করে তাঁর সাধনা বাঙালির রাষ্ট্রভাবনার সাথে কতটা নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিল।
গুপ্তোত্তরযুগ ও পালযুগে তারাসাধনার এই ব্যাপ্তি লক্ষণীয়। এই সময়েই চুন্দা, জাঙ্গুলি, মারীচি, কুরুকুল্লা ও উড্ডিয়ানের একাধিক মাতৃকা তারার রূপ বলে গণ্য হচ্ছেন। এই সময়েই শান্তরক্ষিত কমলশীল ও পদ্মসম্ভব বৃহৎ বঙ্গ থেকে তিব্বত ও চীনে বজ্রযানের ধারা নিয়ে যাচ্ছেন। বশিষ্ঠারাধিতা তারার প্রতিষ্ঠাও কি এই সময়ে? চীনাচারসারতন্ত্রে বুদ্ধরূপী জনার্দনের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার সাথে পদ্মসম্ভবের সাদৃশ্য আছে। সে যাই হোক; বুদ্ধরূপী জনার্দনের চীনাচার যে বজ্রযানেরই রূপভেদ সেটা বেশ বোঝা যায়। সুতরাং এই বশিষ্ঠও পালযুগেই বিদ্যমান ছিলেন। তারার্ণব তন্ত্র অনুযায়ী বশিষ্ঠ দীর্ঘদিন সাধনা করেও অসফল হয়েছিলেন বলে তারামন্ত্রকে নিষ্ফল হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন। সেই মন্ত্রের শাপোদ্ধারের জন্য উপাসনাকালে তারামন্ত্রে বিশেষ একাক্ষরী বীজ ও ধারণী যোগ করতে হয়। এই যে বীজ ও ধারণীর ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব; এটিও পালযুগে বজ্রযানের প্রাবল্যের ইঙ্গিত দেয়।
এই প্রসঙ্গে বীরভূম বিবরণ গ্রন্থের রচয়িতা হেতমপুর রাজবংশের সন্তান নিখিলনাথ মহাশয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিয়েছেন। তারাপীঠে যে গুরুবন্দনার রীতি আছে সেখানে দিব্যৌঘ, সিদ্ধৌঘ ও মানবৌঘ গুরুদের বন্দনা করা হয়। তারাপীঠের চারজন সিদ্ধৌঘ হলেন বশিষ্ঠ কূর্ম্মনাথ মীননাথ ঔ হরিনাথ। এঁদের মধ্যে মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্র গোরক্ষের গুরু এবং দশম একাদশ শতকে বিদ্যমান ছিলেন। সেক্ষেত্রে বশিষ্ঠের সময়কাল আনুমানিক নবম বা দশম শতক।
একাদশ শতকে ভারতবিখ্যাত পণ্ডিত রাঢ়ের সিদ্ধলগ্রামের অধিবাসী এবং বঙ্গালরাজ হরিবর্মার সান্ধিবিগ্রহিক মন্ত্রী( যুদ্ধ ও সন্ধি বিষয়ে পরামর্শ দিতেন যিনি; আজকের বিদেশমন্ত্রীর সমতুল্য) ভবদেব ভট্টের পূর্বসূরি রূপে এক বশিষ্ঠকে পাই আমরা। অনন্তবাসুদেব মন্দিরে উৎকীর্ণ শিলালেখে লিপিবদ্ধ তাঁর বংশতালিকা নিম্নরূপ:
সাবর্ণগোত্রীয় বেদগর্ভের পুত্র বশিষ্ঠ। বশিষ্ঠের তিন পুত্র। মহাদেব, প্রথম ভবদেব ও অট্টহাস। প্রথম ভবদেবের পুত্র রথাঙ্গ। রথাঙ্গের পুত্র অত্যঙ্গ। অত্যঙ্গের পুত্র বুধ। বুধের পুত্র আদিদেব। তাঁর পুত্র গোবর্ধন। গোবর্ধন ও সাঙ্গোকার পুত্র ভট্ট ভবদেব।
এই বংশাবলিতে বশিষ্ঠ ভট্ট ভবদেবের ঊর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষ। এবং বশিষ্ঠের পুত্র অট্টহাস। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবদেব যদি একাদশ শতাব্দীতে জীবিত থাকেন তাহলে বশিষ্ঠের সময়কাল দাঁড়ায় নবম শতক। আবার বীরভূম ও বর্ধমানের দুই শক্তিপীঠ তন্ত্রসাধক অট্টহাসের নামাঙ্কিত; এবং সেই অট্টহাস ভবদেবের পূর্বসূরি বলেই পরিগণিত হন। অট্টহাস পীঠে দেবী দন্তুরা চর্চিকা পূজিত হন অট্টহাসরূপে। তন্ত্রসাধক অট্টহাসের পিতা এই বশিষ্ঠই কি তবে তারাসিদ্ধ বশিষ্ঠ? সময়কাল মিলে যাচ্ছে। বংশের তন্ত্রচর্চার ধারার সাথেও চমৎকার সাযুজ্য পাচ্ছি। সাবর্ণ গোত্রীয় এই রাঢ়নিবাসী সাধকই হয়তো চীনাচারে পূজা করেছিলেন তারা মাতৃকাকে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর বিশ্বজননী রূপ।
পরবর্তী পর্বে সেনযুগ ও মধ্যযুগের তারাসাধনার ইতিহাস নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব।
মহাতপস্বী বশিষ্ঠ দীর্ঘদিন একাগ্র চিত্তে নীলাচলে দেবী তারার সাধনায় ব্রতী হয়ে থাকলেন। কিন্তু সফল হলেন না। তখন তিনি সাধনার জন্য গমন করলেন যোনিপীঠ কামাখ্যায়। দীর্ঘদিন কেটে গেল দেবী তারার ধ্যানে। তথাপি সংসারতারিণী তারা কৃপা করলেন না। ক্রুদ্ধ বশিষ্ঠ তারার বীজমন্ত্রকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন। তখনই দৈববাণী হল। বশিষ্ঠের সাধনার রীতি ভ্রান্ত। তাঁকে মহাচীনে গমন করতে হবে। সেখানে বুদ্ধরূপী জনার্দনের কাছে চীনাচার শিক্ষা করতে হবে। বশিষ্ঠ উপলব্ধি করলেন নিজের অসফলতার কারণ। নব উদ্যমে যাত্রা করলেন আজকের তিব্বত; তখনকার মহাচীনে। সেখানে গিয়ে বুদ্ধরূপী জনার্দনের কাছে চীনাচার শিক্ষা করে ফিরে এলেন। গুরুর নির্দেশমতো বক্রেশ্বরের ঈশানে ও বৈদ্যনাথের পূর্বে উত্তরবাহিনী দ্বারকার তটে শ্বেতশিমূল বৃক্ষের তলায় সাধনা করে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে মা তারার দর্শনলাভে ধন্য হলেন। তখন থেকেই বীরভূমের তারাপীঠের মা তারার একটি নতুন নাম হল “বশিষ্ঠারাধিতা।” ভক্ত সাধকের নামকে অমর করে রাখলেন মা তারা।
উপরের কাহিনীটি আমরা অনেকেই জানি। আর কাহিনীটি শোনার পরে স্বভাবতই মনে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসে। মা তারা আসলে কে? সত্যিই কি তিনি হিন্দুদের দেবী? নাকি বৌদ্ধদের দেবী? যেমনটা বিনয়তোষ ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছেন। আর এই বশিষ্ঠই কি রামায়ণে রঘুবংশের গুরু; সপ্ত ঋষির এক ঋষি সেই পুরাণের বশিষ্ঠ? নাকি সম্পূর্ণ অন্য কোনো সাধক? সেসব আলোচনায় যাওয়ার আগে কয়েকটা তথ্য জানিয়ে রাখি। এই কাহিনীটি পাওয়া যায় তন্ত্রের দুটি প্রাচীন গ্রন্থ; রুদ্রযামল ও চীনাচারসারতন্ত্রে। আর কালিকাপুরাণ এই বশিষ্ঠকেই ঐ পুরাণের বশিষ্ঠ ঋষি বলছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সে আলোচনা যথাসময়ে করব। আগে বরং দেখি সেই মা তারাকে; যাঁর কৃপা পেতে এত কঠোর সাধনা করেছিলেন বশিষ্ঠ মুনি।
আমাদের আলোচনার বিষয় হল বাঙালির তারাসাধনার রূপরেখা। বাঙালির জনপ্রিয়তম মাতৃকার মধ্যে দুর্গা ও কালীর সাথে একসারিতেই মা তারার নামটিও উচ্চারিত হয়। জানি না কতটা সত্য; তবে শুনেছি সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী অধিকাংশ গড়পড়তা বাঙালি সকালে উঠে যে নামটি স্মরণ করে দিন শুরু করেন সেটি হল মা তারা। এই সমীক্ষার সত্যতা নিয়ে আলোচনায় না গিয়েও এটুকু বলাই যায় যে তারা বাঙালির মধ্যে আজও অত্যন্ত জনপ্রিয় মাতৃকা এবং অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাবো এই জনপ্রিয়তার ইতিহাস অত্যন্ত সুপ্রাচীন। সংক্ষেপে বাঙালির এই প্রধান মাতৃকার উপাসনার ইতিহাসের অনুসন্ধান করব এই প্রবন্ধে। তারাসাধনার উৎস সম্বন্ধে অনেক ধারণা প্রচলিত আছে। কেউ মনে করেন তিব্বত থেকে এই ধারা এসেছে; কেউ মনে করেন দাক্ষিণাত্য থেকে। কিন্তু তারাসাধনার সূত্রপাত আমাদের বাংলাতেই হয়েছিল। এবং শুধু তাইই নয়; তারাসাধনার আজকের যে রূপটি ভারতে এবং ভারতের বাইরে ছড়িয়ে আছে; তার পিছনে সিংহভাগ অবদান প্রাচীন বাঙালির। না এটা মনগড়া কাহিনী নয়। ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় অগণিত প্রমাণ সহযোগে এই বিষয়টি প্রমাণ করেছিলেন। দীনেশ সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মা তারার ইতিহাস সম্পর্কে একটি ব্যতিক্রমী সেমিনার আয়োজন করেছিলেন, সেখানে পরিবেশিত সন্দর্ভসমূহ একত্রে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালির প্রাণের শাক্ত বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে সেমিনার কেউ করে না সাধারণত। সেজন্য দীনেশ সরকারের কাজটি ব্যতিক্রমী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে: কেবলমাত্র মা তারার ওপরে একটা পুরো আন্তর্জাতিক সেমিনার আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে তিনি আয়োজন করেন। সেই প্রথম। সেই শেষ। বাঙালির তারাসাধনার ইতিহাস নিয়ে এরকম উচ্চমানের একাডেমিক সেমিনার আর একটাও হয়নি তারপর। কারণ? সে তো বহু আগেই বঙ্কিমচন্দ্র বলে দিয়েছেন। আমরা ইতিহাসবিস্মৃত শিকড়বিচ্ছিন্ন জাতি। যাই হোক। আমরা এজন্য দীনেশ সরকারের মত গ্রহণ করার পক্ষপাতী যে মা তারার উৎস গৌড়বঙ্গে বা বৃহৎ বঙ্গে, কারণ তাঁর মতন এই বিষয়ের এত গভীরে আর কেউ যান নি। নইলে তারার উৎসে তিব্বত থেকে দক্ষিণ ভারত ইত্যাদি খুঁজে পেয়ে নানা মুনির নানা মত আছে।
দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় বাঙালির তারাসাধনার সুপ্রাচীনত্বের সপক্ষে যে যুক্তি উপস্থাপিত করেছিলেন সেটি হল: প্রাচীন গৌড়বঙ্গের সুবিখ্যাত ব্যাকরণবিদ চন্দ্রগোমিন তারার উপাসক ছিলেন। তাঁর বিষয়ে তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারানাথ জানিয়েছেন: চন্দ্রগোমিনের সাথে বরেন্দ্রের রাজকুমারী তারার বিবাহ নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু ইষ্টদেবীর সাথে প্রেয়সীর নাম যাতে এক না হয় সেই ভেবে তিনি বিবাহে অসম্মত হন। বরেন্দ্ররাজ তাঁকে সমতটের দক্ষিণে একটি দ্বীপে নির্বাসন দেন। সেখানে তিনি তারাসাধনা করতে থাকেন। তাঁর নামে সেই দ্বীপের নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ( মধ্যযুগের বাকলা চন্দ্রদ্বীপ; আজকের বাংলাদেশের বাখরগঞ্জ)। হিউয়েন সাঙের বিবরণে চন্দ্রগোমিনের নাম আছে। পাণিনির ব্যাকরণের কিছু অসম্পূর্ণতার সংশোধন করে তিনি যে ব্যাকরণবিধি প্রচলিত করেছিলেন তা পূর্ব ভারত, চীন, তিব্বত ও সিংহলে জনপ্রিয় ছিল। চন্দ্রগোমিন নামক তারাদেবীর বন্দনাগীতির রচয়িতা। হিউয়েন সাঙ জানিয়েছেন চন্দ্রদ্বীপে তারাদেবীর একটি বিখ্যাত পীঠস্থান ছিল। চন্দ্রগোমিনের গ্রন্থে গুপ্তসম্রাট স্কন্দগুপ্তের সমকালীন হুণ আক্রমণের বিবরণ থেকে দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় সিদ্ধান্ত করেছেন চন্দ্রগোমিন গুপ্তযুগে খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকে জীবিত ছিলেন। তারাসাধনার এত প্রাচীন উল্লেখ দক্ষিণ ভারত তথা তিব্বতের কোথাও নেই। যা আছে তা সপ্তম থেকে একাদশ শতাব্দীর। দীনেশচন্দ্র সরকার আয়োজিত তারাসাধনা বিষয়ক সেই সেমিনারে অন্যান্য পুরাতাত্ত্বিকরা ভারতের অন্যান্য প্রান্ত, তিব্বত ও চীনের যত তারাসাধনার নিদর্শন উপস্থাপিত করেছিলেন কোনোটিই সপ্তম শতকের থেকে বেশি প্রাচীন ছিল না।
দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয়ের এই অসাধারণ পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে বাঙালির তারাসাধনা খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতক থেকেই সুপ্রচলিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ের কিছু পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি বাঙালির তারাসাধনার আদিরূপটির উদ্ভব সম্ভবত আরো সাতশো বছর আগে। খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত বাঙালির গঙ্গারিডি সভ্যতা সগৌরবে সমগ্র ভারতে নিজ প্রভাব বিস্তার করেছিল। টলেমি, পেরিপ্লাস, মেগাস্থিনিস, কার্টিয়াস, ডিওডোরাস প্রমুখ গ্রীক ও রোমান ঐতিহাসিক ও পর্যটকদের বিবরণী থেকে আমরা সেই সভ্যতার সুসমৃদ্ধ নগরায়ণ, পরাক্রমী সমরনায়কগণ এবং ইউরেশিয়ার সুবিশাল ভূখণ্ডে বিস্তৃত সমুদ্রবাণিজ্যের কথা জানতে পারি। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে জানা গেছে উত্তরে দিনাজপুরের বাণগড় থেকে দক্ষিণে তাম্রলিপ্ত; পূর্বে বাংলাদেশের উয়ারি বটেশ্বর থেকে পশ্চিমে ভাগলপুর পর্যন্ত এই সভ্যতার অগণিত নগরকেন্দ্র ছিল। নন্দবংশের মহাপদ্মনন্দ ও ধননন্দ এই গঙ্গারিডি জাতির নায়ক ছিলেন এবং তাঁরা যখন মগধের সম্রাট ছিলেন তখন গান্ধার থেকে অস্মক পর্যন্ত ষোড়শ মহাজনপদে বাঙালির প্রতিপত্তি প্রসারিত হয়েছিল। নন্দবংশের গরিমাকে ঐতিহাসিকরা প্রায়শই দেখেও অস্বীকার করেন। বারান্তরে সে নিয়ে আলোচনা করব। আপাতত গঙ্গারিডির কথা বলি। গঙ্গারিডির রাজধানী ছিল বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়ে; যদিও নামটা তখন ছিল গঙ্গে। সেযুগের উত্তর কলকাতা ছিল এই গঙ্গে নগরীর শহরতলি। বেথুন কলেজ থেকে নাগের বাজারের একাধিক স্থানে তার নিদর্শন পাওয়া গেছে। দেগঙ্গা (প্রাচীন নাম দেবগঙ্গা বা দ্বিগঙ্গা) সেই গঙ্গে নগরের স্মৃতি বহন করে। এই গঙ্গে বা পরবর্তী সময়ের চন্দ্রকেতুগড়ে অগণিত মাতৃকার মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। দেখে বোঝা যায় আমাদের আজকের উপাস্যা দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী, পদ্মা বা মনসা এবং তারার আদিরূপ এঁদের মধ্যেই নিহিত আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বিদেশিদের বর্ণনায় যে সভ্যতার গৌরব সমুজ্জ্বল হয়ে আজে; দেশীয় পুরাণসাহিত্য তার নামোল্লেখ পর্যন্ত করে নি। ঐতিহাসিকদের মতে তৎকালীন পৌরাণিক আর্য সমাজের সাথে এই গঙ্গারিডির অবৈদিক ব্রাত্য আর্য সমাজের সংঘাত ছিল। যথাসময়ে সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাবে। আপাতত আমরা গঙ্গারিডির সেই মাতৃমূর্তির মধ্যে তারা দেবীর আদিরূপ কোথায় আছে সেই নিয়ে আলোচনা করি। তার জন্য আমাদের আজকের তারাপীঠের বশিষ্ঠারাধিতা তারা মূর্তির দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তারাপীঠের মা তারার মূর্তি এইরকম:
অর্থাত তিনি দ্বিভুজা। সাপের উপবীত ধারণ করেছেন। তাঁর বাম কোলে শিব শিশুপুত্ররূপে অবস্থান করছেন। এই রূপ তন্ত্রোক্ত তারা দেবীর অগণিত রূপের কোনোটির সাথেই মেলে না। যদিও বশিষ্ঠ চীনাচারে তারাসাধনা করেছিলেন; কিন্তু মহাচীনতারার মূর্তি চতুর্ভুজা; ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা। হাতে খড়্গ, কর্তৃ, নীলপদ্ম ও কপাল। বোঝা যাচ্ছে বশিষ্ঠের আরাধিত রূপটির একটি স্বকীয়তা আছে। তাহলে প্রশ্ন হল সেই রূপের আদি প্রকাশ কি কোথাও আছে? যার থেকে বিবর্তিত হয়ে এই রূপটি এসেছে? উত্তর হল: হ্যাঁ। সেই আদিরূপটিই আমরা পাই গঙ্গারিডি সভ্যতায়। ঐ মাতৃমূর্তিগুলির মধ্যে এমন বেশ কয়েকটি মূর্তি আছে যেখানে একজন দেবী তাঁর কোলে একজন ক্ষুদ্রাকার পুরুষকে ধরে আছেন। দেবী বলছি; মানবী বলছি না; কারণ তাঁর আভরণ; কবরীর বিন্যাস ও ঐশ্বর্যলক্ষণ অন্যান্য দেবীমূর্তির সাথে মিলে যাচ্ছে। আর শিশু না বলে ক্ষুদ্রাকৃতি পুরুষ বলছি কারণ যাকে তিনি কোলে ধরে আছেন তিনি মুকুট পরিহিত এবং মুখ পূর্ণবয়স্কের মতো। অর্থাত তিনি একজন দেবতা কিন্তু এই মায়ের কোলে শিশুর মতো অবস্থিত। বশিষ্ঠারাধিতা তারার ধ্যানটি দেখুন। তাঁর কোলে শিব আছেন; কিন্তু শিশুরূপে। সাঙ্খ্যের ভাষায় এখানে পরমা প্রকৃতির কোলে আছেন নির্গুণ পুরুষতত্ত্ব। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আদিবিদ্বান কপিলের সাঙ্খ্যদর্শনেই বাঙালির তন্ত্রের আদি বীজ লুকিয়ে আছে। সেই যে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন: যখন বাঙালির ঘরে দুর্গাপূজা দেখি; আমার সাঙ্খ্য মনে পড়ে। মধ্যযুগে বশিষ্ঠারাধিতা তারার মূর্তির একটি পৌরাণিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে সমুদ্র মন্থনের সময় যখন কালকূট বিষ পান করে শিব নীলকন্ঠ হয়েছিলেন তখন জগত সংসার বিষের প্রভাব থেকে রক্ষা পেলেও শিব নিজে বিষের জ্বালায় কাতর হয়ে পড়েন এবং বারবার কাতর স্বরে জগতজননীকে ডাকতে থাকেন। মহাদেবী শিবের প্রতি করুণাবশতঃ তারা রূপ ধারণ করে শিবকে পুত্রজ্ঞানে কোলে নেন এবং নিজের স্তন্যসুধা পান করিয়ে বিষের হাত থেকে রক্ষা করেন। এই কাহিনী থেকে এটুকু বোঝা যায় বশিষ্ঠের দ্বারা পুনঃপ্রবর্তিত গঙ্গারিডি যুগের মাতৃকার এই তারা রূপ এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পৌরাণিক ধারাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পাশাপাশি ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব যে পরমা মাতৃকার পুত্র; তিনিই যে আদিজননী; তন্ত্রের সেই আদি ধারণাটিও এখানে প্রকাশ পেয়েছে। মা তারার সমস্ত সাধনমার্গেও এই বিশ্বজননী রূপটিই বারবার বন্দিত হয়েছে।
তারাসাধনার আদিরূপ গঙ্গারিডির এই মূর্তিতে যে সাধনদর্শন প্রকাশ পেয়েছে; তার সমতুল্য ভাবনা পরবর্তী সময়ে সেনযুগের বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল। কবিপতি জয়দেবের লেখা মধুরকোমলকান্ত পদাবলীর কাব্য গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোকটিই তার দৃষ্টান্ত। সেনযুগের তারা সাধনার বিষয়ে আলোচনার সময় বিস্তারিত বলব এই বিষয়ে। সুতরাং বাঙালির তারাসাধনার আদিরূপটি আমরা গঙ্গারিডি সভ্যতার মাতৃকার মূর্তিতে পাচ্ছি। এই মূর্তিগুলি মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকের; অর্থাত আজ থেকে প্রায় তেইশশো বছর আগেকার। তারার বর্তমান রূপের এর সমকালীন আদি নিদর্শন উপমহাদেশের আর কোথাও পাওয়া যায় নি। দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় যে সিদ্ধান্ত করেছিলেন তারাসাধনার উৎস গৌড়বঙ্গে; এটিই তার অভ্রান্ত প্রমাণ।
বাঙালির তথা এই উপমহাদেশের তারা সাধনার সুপ্রাচীন ধারা আছে। পরমা প্রকৃতি আদিমাতৃকা জগতকে তারণ করেন এই অর্থে বারংবার তারা নামে অভিহিত হয়েছেন। মহাভারতে দুর্গাস্তবে জগতজননী তারিণী বলে উল্লিখিত। চণ্ডীতেও অর্গলাস্তবে তিনি “তারিণীং দুর্গসংসারসাগরস্য” ; অর্থাত দুর্গম সংসারসাগর থেকে উদ্ধার করেন। এই আর্ততারণের সূত্রে চণ্ডীতে দুর্গা এবং তারা একাকার হয়ে গিয়েছেন। দুর্গাসি দুর্গভবসাগরনৌরসঙ্গা ( তুমিই দুর্গা; তুমিই নৌকারূপে দুর্গম ভবসাগরে একমাত্র পরিত্রাতা)। উপনিষদে মাতৃকা এইভাবে বন্দিত হয়েছেন: “দুর্গাম্ দেবীম্ শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ” ( সেই দুর্গাদেবীর শরণ গ্রহণ করি; সেই সুচারুরূপে তারণকারিণীকে প্রণাম করি।) অনেক পরে চণ্ডীতে উল্লিখিত সুরথরাজার মা দুর্গার কৃপায় বিপদ থেকে উদ্ধারের কাহিনীটিকে সাধককবি রামপ্রসাদ অমর করে রেখেছেন এইভাবে: তারায় দিয়ে ভার সুরথ রাজার লক্ষ অসিঘাতেও প্রাণ গেল না শ্রীদুর্গা নাম ভুলো না ভুলো না ভুলো না ভুলো না
অর্থাত তারণকারিণী রূপে মাতৃকার ভাবনা বহু প্রাচীন। আর তারা শব্দটির অর্থই হল: যিনি তারণ করেন।
এবার আসি বৌদ্ধতন্ত্রে তারার আবির্ভাব প্রসঙ্গে। মহাযানে তারা প্রথমে বোধিসত্ত্ব; পরে মহাকরুণা ও প্রজ্ঞার বিমল রূপ। মহাযানে মাতৃকার তারা রূপ ধারণের একটি অপূর্ব কাহিনী আছে। কাহিনীটি এইরকম:
বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর সম্বোধি প্রাপ্তির জন্য গভীর ধ্যানে লীন হয়ে আছেন। একে একে সমাধির বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে দশম ভূমিতে উপস্থিত হয়েছে তাঁর চেতনা। সামনে খুলে যাচ্ছে নির্বাণের চির আলোকিত পথ। সেখানে কোনো যন্ত্রণা নেই; কামনার অতৃপ্তি নেই। পুনর্জন্ম নেই। শুধুই শান্তি আর পরমানন্দ। তিনি নির্বাণের উদ্দেশ্যে একটি পা বাড়িয়েছেন; তখনই কানে এল অগণিত জীবের আর্তনাদ। বোধিসত্ত্ব দেখলেন অনেক নিচে জগতের কোটি কোটি অসহায় আর্ত জীব ক্রন্দন করছে। করুণায় তাঁর দুই চোখে অশ্রু ভিড় করে এল। তিনি ঘোষণা করলেন জগতের প্রত্যেকের উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তিনি নির্বাণ গ্রহণ করবেন না। জগতের প্রতি করুণার এই মহত্তম প্রকাশই মহাকরুণা। ত্রাণকারিণী মাতৃকাই মহাকরুণার মূর্ত রূপ। জগতের প্রতি অবলোকিতেশ্বরের এই মহাকরুণাময়ী দৃষ্টিই তাঁকে করে তুলল বন্দনীয়। বড়ো মধুর সেই অবলোকন। তাই তিনি অবলোকিতেশ্বর। আর তাঁর সেই ঝরে পড়া অশ্রু থেকেই মূর্তি পরিগ্রহ করলেন করুণাময়ী তারা। দুটি রূপে। আর্যতারা ও ভৃকুটি। তিনি জগতমাতৃকা। তিনি সংসারতারিণী। তিনিই অবলোকিতেশ্বরের মহাকরুণার উৎস। তাঁকে আশ্রয় করেই অবলোকিতেশ্বর মহাযানে বুদ্ধের থেকেও গরিমাময় আসনে অধিষ্ঠিত। কারণ বুদ্ধ জগতের কল্যাণে নিজের নির্বাণ প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। এই কাহিনীর মূলেও সেই আর্ততারণের ভাবনা; আদি সাঙ্খ্যের অপূর্ব রূপায়ণ। এরপর তারার বাইশটি সুবৃহৎ সাধনক্রমের উত্থানের সাথে পাই মহাযানী আচার্য নাগার্জুনকে। বজ্রযানের সাধনমালা ও গুহ্যসমাজতন্ত্রে এই রূপগুলির উপাসনার পদ্ধতি ও ধ্যান বর্ণিত আছে। যথা সিততারা, হরিততারা, রক্ততারা, সিতাতপর্ণী তারা, খদিরবনি তারা, ভৃকুটিতারা, মহাশ্রীতারা, বজ্রতারা, আর্যতারা প্রমুখ। শ্বেতবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণ ছাড়াও তাঁর পীত, নীল, শ্যামা – বিভিন্ন বর্ণ হয়। উপমহাদেশে হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে যে উষা/নিশা উপাসনা, যেটা আজ আমাদের দুর্গা/কালী উপাসনায় প্রকাশিত, সে বিষয়টাই পালযুগে আর্যতারা (শ্বেত) এবং উগ্রতারা (কৃষ্ণ) দ্বিত্বে প্রকাশিত। সেই যে মহাসাধক কমলাকান্ত গেয়েছেন: মা কখনও শ্বেত কখনও পীত কখনও নীল লোহিত রে আমি আগে নাহি জানি কেমন জননী ভাবিতে জনম গেল রে
শ্যামামায়ের এই বর্ণময়ী রূপের মধ্যে পালযুগের তারার রূপ মিশে আছে। এছাড়া তারা ও চারজন সহচরী বা যোগিনীর যে উপাসনা প্রচলিত ছিল (এই চারজন হলেন ডাকিনী – যিনি পণ্ডিত, শাকিনী বা শঙ্খিনী – যিনি শঙ্খ বা সুবেশ ধারণ করেন, লাকিনী বা রঙ্কিনী – যিনি জীর্ণ শীর্ণ ক্ষুধাতুরা ও হাকিনী- যিনি ভৈরবী, অর্থাৎ ভয়াবহ শব্দ করেন), সেটা আমাদের মধ্যে বহু প্রাচীন, চন্দ্রকেতুগড়েও মা দশায়ুধার সঙ্গে চার সহচরী থাকতেন। এটাই আজকে পরিবর্তিত হয়ে মা দুর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী গণেশ কার্তিক সরস্বতী হয়ে গেছে। গুপ্তোত্তরযুগে খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে সিদ্ধাচার্য কাহ্নুপার কাহিনী প্রসঙ্গে সমগ্র বৃহৎ বঙ্গের তারাসাধনার উল্লেখ করেছেন লামা তারানাথ। হিউয়েন সাঙের বিবরণ অনুযায়ী সপ্তম শতকে নালন্দার ভিক্ষুদের মধ্যে তারা উপাসনা সুপ্রচলিত ছিল।
পালযুগের তারাসাধনার ধারা নিয়ে আলোচনা করব পরবর্তী পর্বে।
ছবিতে : গঙ্গারিডির সন্তানকোলে মাতৃকা, বশিষ্ঠারাধিতা তারা, পালযুগের দ্বিভুজা তারা।
তথ্যসূত্র: Shakta cult and Tara; Dinesh Chandra Sircar বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব; নীহাররঞ্জন রায় ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য; শশিভূষণ দাশগুপ্ত সাধনমালা ( বিনয়তোষ ভট্টাচার্য মহাশয় কর্তৃক সম্পাদিত) তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়ের প্রবন্ধসমূহ