শাক্তধর্মের আবহমান রঙ লাল – তমাল দাশগুপ্ত

শাক্তধর্মের রঙ লাল। লাল তিলক, লাল সিঁদুর, লাল ধ্বজা কেন মা কালীর পুজোয় গুরুত্বপূর্ণ?

পৃথিবীতে প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকে মাতৃধর্ম প্ৰচলিত আছে, এবং আজ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগেকার রক্তবর্ণে রঞ্জিত (red ochre) মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ লাল রঙের সঙ্গে মাতৃকা উপাসনার সম্পর্ক প্রাগৈতিহাসিক ও আবহমান।

কেন এই লাল রঙ তাৎপর্যপূর্ণ?

এক, জন্মের সঙ্গে অর্থাৎ নতুন সৃষ্টির সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক।

দুই, লাল রঙ রজঃস্বলা পৃথিবীর প্রতীক।

তিন, লাল রঙ বলির রক্তের প্রতীক, এবং প্রাচীনকাল থেকেই মাতৃধর্মে বলির প্রচলন।

পৃথিবীর অন্যত্র মাতৃধর্ম বিলুপ্ত কিন্তু বাঙালি পৃথিবীর শেষ মাতৃকা উপাসক মহাজাতি। আমাদের মা বলিপ্রিয়া। যে পৃথিবী জন্ম দেন সেই পৃথিবীই গ্রাস করেন কাজেই বলির যৌক্তিকতা আছে। তাছাড়া বলির কারণেই সম্ভবত আমাদের মাতৃধর্ম আজও টিঁকে আছে, অন্যান্য ধর্মগুলি আজও বাংলা থেকে মাতৃধর্মকে মুছে দিতে পারে নি।

হরপ্পা সভ্যতায় সিঁদুর ব্যবহৃত ছিল। বস্তুত সিঁদুর শব্দটি সিন্ধুর থেকে এসেছে, এই সম্ভাবনা আছে। হরপ্পা সভ্যতায় লাল সিঁদুরচর্চিত মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে, বালোচিস্তানের নওশারো থেকে, সে ছবি আগেও দিয়েছি, আজ আবার পোস্ট করলাম। হরপ্পা সভ্যতায় তন্ত্রধর্মের একটি আদিরূপ প্ৰচলিত ছিল, সন্দেহ নেই। এবং হরপ্পা সভ্যতায় একটি সিঁদুরচর্চিত ফলকে সাতটি চিহ্ন আছে যা সম্ভবত কৃত্তিকা বা মাতৃকাদের প্রতীক, আস্কো পার্পোলার মতে। এছাড়া হরপ্পা সভ্যতায় ছাগবলি প্ৰচলিত ছিল, একটি প্রত্ন ফলকে মুখ্য মাতৃকার সম্মুখে সেই বলি গ্রহণ করতে সপ্ত মাতৃকার উপস্থিতি দেখা যায়। মহিষমেধ হত হরপ্পা সভ্যতায়, সেটাও প্রত্নতত্ত্বের দ্বারা প্রমাণিত। লাল রঙ কাজেই হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্রে মেধ বা বলির প্রতীক, মায়ের শক্তির প্রতীক এবং আবহমান মাতৃধর্মের ভাষা।

কিন্তু এ ছাড়াও আরেকটি তাৎপর্য আছে।

হরপ্পা সভ্যতায় লাল সিঁদুর হল ঊষার লাল রঙ।

ঊষা পূজিত ছিলেন অবৈদিক হরপ্পা সভ্যতায়, ডি ডি কোসাম্বির সিদ্ধান্ত, এবং এই ঊষার শারদীয়া বোধন থেকেই আজকে শারদীয়া দুর্গাপুজো এসেছে (রামের অকাল বোধন কাহিনী অর্বাচীন মধ্যযুগের নির্মাণ। শারদীয়া দুর্গাপুজোর আদি রূপ উপমহাদেশে হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে প্ৰচলিত)। ভোর রাতে অন্ধকারে নিকষ কালো দিগন্তে ফুটে ওঠা ঊষার লাল রঙ যিনি দেখেছেন তিনিই বুঝবেন এ লাল রঙের মাহাত্ম্য।

রক্তিম বর্ণে মায়ের আবাহন ও অধিষ্ঠান হয়। লাল তিলক হল আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত জগদকারণ প্রকৃতির চিহ্ন। এই লাল রঙে শক্তির আশীর্বাদ নিহিত আছে। এই লাল সিঁদুরে মায়ের স্পর্শ আছে। তাই এই লাল রঙ শাক্তধর্মের প্রতীক।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

ছবিতে দেখছেন হরপ্পা সভ্যতার সিঁদুরচর্চিত মাতৃমূর্তি। ইনি হরপ্পা সভ্যতায় পূজিত বলাকা বা খেচরী মাতৃকা (beaked goddess) এবং এঁকে মা কালীর আদিতম রূপের অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সময়কাল পরিণত হরপ্পা সভ্যতা অর্থাৎ প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে।

তখন রাম বলে কেউ ছিল না, কৃষ্ণ বলে কেউ ছিল না, হনুমান বলে ছিল না, মহম্মদ বলে কেউ ছিল না, খ্রিষ্ট বলে কেউ ছিল না। তখনও মা ছিলেন। এঁরা যখন থাকবেন না, তখনও মা থাকবেন।

মা ছিলেন, মা আছেন, মা থাকবেন।

জয় মা কালী। জয় জয় মা।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, তেইশ মে দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s