শারদীয়া মাতৃকা উৎসব বহু পুরাতন: রামের অকাল বোধন মধ্যযুগের উদ্ভাবন – তমাল দাশগুপ্ত

শারদীয়া মাতৃকা উৎসব বহু প্রাচীন: রামের অকাল বোধন কাহিনী মধ্যযুগের উদ্ভাবন।

ষষ্ঠ শতকে রচিত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী স্বয়ং বলছেন শরৎকালে তিনি পূজিত হন। তাই মধ্যযুগে পঞ্চদশ শতকে কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামের অকাল বোধনের গপ্প জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগে থেকেই দেবী শরৎকালে পূজিত হতেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে কোথাও রামকে দেখা যায় না, দেখার কথা নয়। আবার বাল্মীকি রামায়ণে কোথাও রামের অকাল বোধনের উল্লেখ নেই, থাকার কথা নয়। রাম রাবণের যুদ্ধ শরৎকালে হয়নি। রামের অকাল বোধন মধ্যযুগের দুয়েকটি পুরাণ এবং কৃত্তিবাসের কবিকল্পনা।

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে রাজা সুরথ দুর্গাপুজো সূচনা করেন বলে যে কাহিনী আছে, সেটা শারদীয়া নয়, সেটা বাসন্তী পুজো – এরকম কোনও তথ্য শ্রীশ্রীচণ্ডী আদৌ দেয়না। কৃত্তিবাসী অকাল বোধনের সঙ্গে শ্রীশ্রীচণ্ডীর যাতে বিরোধ না ঘটে সেজন্য এই সুরথকে বাসন্তী পুজোর সঙ্গে জোর করে সংযুক্ত করা হয়েছে। আসলে শ্রীশ্রীচণ্ডী শারদীয়া দুর্গোৎসবের কথাই জানায়। মা নিজেই শরৎকালে তাঁর পূজিত হওয়ার ঘোষণা করেছেন শ্রীশ্রীচণ্ডীতে, এবং সুরথ রাজা শরৎকালেই মায়ের পুজো করেন।

লেট মি রিপিট। শারদীয়া দুর্গাপুজো শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লিখিত। পালযুগেও শরৎকালে উমা পুজোর কথা জানা যাচ্ছে। কিন্তু রামের শারদীয়া অকাল বোধনের কাহিনী মধ্যযুগে লিখিত দুয়েকটি পুরাণ ও কৃত্তিবাসের আগে কোথাও উল্লিখিত নয়।

ওদিকে শ্রীশ্রীচণ্ডী রচিত হওয়ার আটশ বছর আগে থেকে, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের ভারতে মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মাতৃকা উপাসনার তন্ত্রধর্ম এবং সেই তন্ত্রাশ্রয়ী উৎসবে মহিষমেধ আরও অনেক প্রাচীন, পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতা থেকেই প্ৰচলিত। আজকের দুর্গাপুজোর কেন্দ্রীয় অংশ সন্ধিপুজো, সন্ধিপুজোর বলিতে সেই পাঁচ সহস্র বছরের প্রাচীন ইতিহাসের ছোঁয়া আছে।

রাম এমনকি অষ্টম শতকে সম্রাট ধর্মপালের সময়েও দেবতা নন। রাজা পৃথু, রাজা নল, রাজা রাম অনেকদিন বিগত, কিন্তু এক সম্রাট ধর্মপালকে দর্শন করলেই তাদের তিনজনকে দেখার ফল লাভ হয়, পালযুগের একটি শাসনলেখ জানাচ্ছে। স্পষ্টই, সম্রাট ধর্মপাল রামের থেকেও বড়, এই ইঙ্গিত আছে। বারোশ বছর আগেকার কথা।

বাঙালি নিজের ইতিহাস জানে না, তাকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জানতে দেওয়া হয় না, মূলধারার মিডিয়া জানতে দেয় না। অথচ পুরোনো ইতিহাস না জানালে আমরা যারা মায়ের নাম নিয়ে তন্ত্রের শেকড় পুনরুদ্ধার করার সংগ্রামে ব্রতী, আমাদের সমস্যা হচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে রামের গৌরব বাড়াবেন বলে মধ্যযুগে এক শ্রেণীর উদ্যোগে দুর্গাপুজোর প্রাচীন ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। এটা অন্যায়।

দুর্গাপুজো এক আবহমান উৎসব। পৃথিবীর প্রথম সিংহবাহিনী মূর্তি নব্য প্রস্তর যুগের, প্রায় দশ হাজার বছর পুরোনো। হরপ্পা সভ্যতায় মহিষমেধ এবং মাতৃকা উপাসনা পাঁচ হাজার বছর পুরোনো। ঊষা পূজিত হতেন প্রাচীন বেদপূর্ব ব্রাত্য তন্ত্রাশ্রয়ী সভ্যতায় অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতায় (ডি ডি কোসাম্বি), এবং এই ঊষার শারদীয়া বোধন হত (সুকুমার সেন) এবং ঊষাকে বেদে দশভুজা বলা হয়েছে (হংসনারায়ণ)।

রামের জনপ্রিয় উপাসনা সারা ভারতে, এমনকি রামায়েত ধর্মের ভরকেন্দ্র উত্তর ভারতে মেরে কেটে হাজার বছর ধরে হচ্ছে, তার বেশি নয়। রাধাকৃষ্ণময় গৌড়ীয় বৈষ্ণব এবং উত্তর ভারতের রামায়েত বৈষ্ণব একেবারেই অর্বাচীন। প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ কম। জিজ্ঞেস করুন, মহাকাব্যিক চরিত্র রামের কটি মূর্তি পেয়েছেন এরা প্রাচীন যুগে? গুপ্তযুগ বা তার আগে রামের উপাসনার প্রমাণ কোথায়?

আসলে বাসুদেবকেন্দ্রিক একটা বৈষ্ণব ধর্ম ছিল আগে। গুপ্তযুগের শেষে সেই আদি ভাগবত বা আদি বৈষ্ণব ধর্ম সঙ্কটে পড়ে (সুধাকর চট্টোপাধ্যায় দ্রষ্টব্য), যখন শৈব ধর্মের বিপুল উত্থান ঘটে, শিবের সঙ্গে নীলাবতী বা উমা/পার্বতীর বিবাহ পরিকল্পনা হয়। এই সঙ্কট থেকে বেরোতে সীতারাম এবং রাধাকৃষ্ণ কেন্দ্রিক এক নতুন বৈষ্ণব ধর্ম তৈরি হয় গুপ্তোত্তর ভারতে, মূলত আদি মধ্য যুগে, যার স্ফুরণ অন্তিম মধ্য যুগে বাংলায় কৃত্তিবাস আর উত্তর ভারতে তুলসীদাস।

এদের রাম মূলত মধ্যযুগে উঠেছেন। আমার জগন্মাতার উপাসনা প্রাচীন প্রস্তর যুগেও ছিল। লাল সিঁদুর দিয়ে গর্ভবতী জগন্মাতা অথবা জগৎপ্রসূতা জগদকারণ জগন্মাতার উপাসনা হত এমনকি সেই প্রাচীন প্রস্তর যুগেও, আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে।

যে কথাটি জানানোর। তন্ত্র কোর্স করার পর এবার বৈষ্ণবধর্মের ইতিহাস, তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে অক্সফোর্ডের সেন্টার ফর হিন্দু স্টাডিজে পড়াশোনা শুরু করলাম।

অদ্বৈত বেদান্তবাদী আদি শঙ্কর বলেছিলেন, সাংখ্য প্রধানমল্ল। অর্থাৎ বেদান্তের জন্য সাংখ্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। আজকে আমি মনে করছি, গেরুয়া গোবলয় রামায়েত বৈষ্ণব ধর্ম আমাদের মাতৃকা উপাসনার ধর্মের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই এদের অনৈতিহাসিক এবং অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করতেই হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে পরম নিষ্ঠায় এদের ইতিহাস ও তত্ত্ব এবং প্রয়োগ অধ্যয়ন করাও অত্যন্ত জরুরি।

রামায়েত বৈষ্ণবরা নিজেদের অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকুন, তাতেই সবার মঙ্গল। তাঁদের ধর্মকে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার অপব্যবহার করছে এবং বাংলার মাতৃকা উপাসক তন্ত্রাশ্রয়ী মাটিতে জোর করে চাপাতে চাইছে রামকে। এতে করে রামায়েত বৈষ্ণব ধর্মের কোনও উপকার হবে না। বিজেপি রামের নাম নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে ভোট পেতে চাইছে। কিন্তু বাংলার শাক্ত নিজের মাটি ধরে রাখতে জানে। আমাদের তন্ত্র ধর্মের রক্ষা করেন স্বয়ং মহাকাল ভৈরব। পালযুগে সম্রাট ধর্মপালের আদলে মহাকাল মূর্তি নির্মিত হত, এজন্য মহাকালের আরেক নাম ধর্মপাল।

যিনি শূদ্রের মুণ্ডচ্ছেদ করেন এবং স্ত্রীর অগ্নিপরীক্ষা নেন, সেই রাম কোনোমতে তন্ত্রাশ্রয়ী মাতৃকা উপাসক বাঙালি জাতির আদর্শ বা উপাস্য হতে পারেন না। এমনিতেও মা কালী ছাড়া কলিযুগে অপর উপাস্য নেই, কলৌ কালী কলৌ কালী নান্যদেবঃ কলৌ যুগে। তাছাড়া মা কালী বাংলার একমাত্র অধিষ্ঠাত্রী: কালিকা বঙ্গদেশে চ।

জয় মা কালী। জয় জয় মা।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

গতকাল উধারবন্দে মা কাঁচাকান্তির মন্দিরে গেছিলাম মাকে দর্শন করতে। মা কাঁচাকান্তি কাছাড় অধিষ্ঠাত্রী। কাছাড়, যা কিনা ঈশান বাংলা। মা কাঁচাকান্তি সম্পর্কে আগেও লিখেছি। ছবিটি গতকাল আমার তোলা।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, ঊনত্রিশ এপ্রিল দুহাজার তেইশ।

সংযোজন ১

এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ পোস্ট। যতদিন না এই পোস্টে আশানুরূপ রিচ এবং লাইক হচ্ছে, তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজের বাকি সমস্ত পোস্ট বন্ধ থাকবে। তা নয়ত প্রতিবার লোকজন এসে বলবে, আর্টিকল পোস্ট করুন, অথচ আগেকার পোস্ট তাদের নজর এড়িয়ে যাবে।

পেজের পাঠকরা এই পোস্টটি যথাসম্ভব সর্বত্র শেয়ার করুন। কারণ এই তথা সবার জানা দরকার।

সংযোজন ২

কাছাড় অধিষ্ঠাত্রী মা কাঁচাকান্তি

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s