মা কালীর মুণ্ডমালার তাৎপর্য – তমাল দাশগুপ্ত

মা কালীর মুণ্ডমালিনী রূপ আমাদের মুগ্ধ করে। আসুন আজ মুণ্ডমালার তাৎপর্য জেনে নেব।

★ ছিন্ন মুণ্ড বা নরকপাল দ্বারা অলঙ্কৃত মা কালীর উল্লেখ কালিদাসের কাব্যে আছে। মহাভারতে বা শ্রী শ্রী চণ্ডীতে যেখানে মা কালীর উল্লেখ পাই, সেখানে মায়ের রূপ ভয়ঙ্করী। এর প্রধান কারণ মা কালী সেখানে শুধুই ধ্বংসের দেবতা।

অতএব মুণ্ডমালার এটি অন্যতম তাৎপর্য। মা কেবল জগদকারণ নন, মা সেই সঙ্গে জগদবিলয়। তিনি প্রলয়কালের স্মারক রূপে এই মুণ্ডমালা ধারণ করেন।

★ মুণ্ডমালায় পঞ্চাশ মুণ্ড থাকে। এই প্রতিটি মুণ্ড এক একটি বর্ণের দ্যোতনা বহন করে। আমাদের বর্ণমালা তন্ত্রাশ্রয়ী, প্রতিটি বর্ণ মাতৃকাবর্ণ। এই বিষয়ে তমাল দাশগুপ্ত পেজের প্রবন্ধ আছে।

★ মুণ্ডমালা বিভিন্ন আলাদা আলাদা উপাদানের একত্রে গ্রন্থনা, যা তন্ত্রের প্রতীক। তন্ত্রের অন্যতম অর্থ তন্তুবয়ন, বিভিন্ন পৃথক তত্ত্বকে একত্রিত করে অদ্বয় ও অভেদ অবস্থায় পৌঁছনো। গ্রন্থিত মালা সেই অদ্বয় তত্ত্বের তাৎপর্য বহন করে। ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি, শাক্ত কবি গেয়েছেন। তাই মায়ের মুণ্ডমালিনী রূপ অদ্বয় তত্ত্বের প্রকাশ।

★ ফুলের মালা বা বহুমূল্য সোনার মালা পরিধান করতেন রাজা বা ব্রাহ্মণ বা ধনী। এর বিপরীতে গিয়ে কাপালিক তান্ত্রিকরা মুণ্ডমালা ধারণ করে সমাজে উচ্চ নিচ ভেদ, বা বৈষম্য ভেঙে দিতেন। মুণ্ডমালা কাজেই বৈষম্যহীনতার প্রতীক। জীবন ও মৃত্যুর ভেদাভেদ, পুরুষ নারীর ভেদাভেদ, ধনীদরিদ্র ভেদাভেদ, পবিত্র অপবিত্র ভেদাভেদ, ইত্যাদি অনেক বৈষম্য বেড়াজাল ভেঙে মায়ের সাধনা করতে হয়। মুণ্ডমালা সেই পদ্ধতির স্মারক।

★ পুরাণে এক জায়গায় বলা হয় ব্রহ্মার একটি মুণ্ড কেটে নেন শিব। প্রাচীন ভারতে ব্রহ্মহত্যার পাপ যে করত তাকে স্মারক হিসেবে সেই মৃত ব্রাহ্মণের মুণ্ড নিয়ে ভ্রমণ করতে হত। অক্সফোর্ডে আলেক্সিস স্যান্ডার্সন কিছুদিন আগে এক লেকচারে এটি উল্লেখ করে বলেন যে কাপালিকের মুণ্ডমালা কাজেই বৈদিক পৌরাণিক বর্ণবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মুণ্ডচ্ছেদ করার প্রতীকী প্রায়শ্চিত্ত এবং একই সঙ্গে সোল্লাস উদযাপন।

★ আর একটি বিষয় হল, পালযুগে বাঙালির ভারত জোড়া তন্ত্রাশ্রয়ী সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর একটি অংশে উত্তর পূর্ব ভারতের পার্বত্য উপজাতি রেজিমেন্ট ছিল যারা মুণ্ডমালা ধারণ করত। পালযুগ থেকেই নিয়মিত মুণ্ডমালিনী মাতৃমূর্তি পাওয়া যায়।

★ হরপ্পা সভ্যতা থেকে পাণ্ডু রাজার ঢিবি পর্যন্ত সেকেন্ডারি ফ্র্যাগমেন্ট বেরিয়াল দেখা যায়। শক্তিপীঠসমূহে আদিমাতার দেহাংশ এর একটি স্মারক। অনুরূপ তত্ত্ব আজও পঞ্চমুণ্ডী বা নবমুণ্ডী আসনে দেখা যায়। অতএব মুণ্ডমালার মধ্যে সেই প্রাচীন তান্ত্রিক তত্ত্ব আছে।

জয় মা কালী।

© কালীক্ষেত্র আন্দোলন

ছবিতে দেখছেন হরিণডাঙ্গা রক্ষাকালী মাতা। ছবি সংগৃহীত।

কালীক্ষেত্র আন্দোলন ফেসবুক পেজ, ছয় মে দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s