
কলিযুগে মা কালী ভিন্ন অপর কোনও দেবতা নেই, নান্যদেবঃ কলৌ যুগে। কলিযুগে কেন মা কালীই একমাত্র উপাস্য? কারণ তিনি সর্বময়ী, জগন্ময়ী, জগতের সবই তাঁর অংশ, তন্ত্রধর্মের সব দেবতাই মা কালীর প্রকাশ।
তিনি আদ্যা, নিত্যা, অব্যক্ত জগদকারণ। আমরা সীমিত মানববুদ্ধিতে বোঝার সুবিধার জন্য, ধ্যানের সুবিধার জন্য এই মাতৃরূপে, এই কালীরূপে তাঁকে ডাকি।
কালী জগতময়: মা কালীই প্রকাশিত হন জগতজুড়ে, বাকি সমস্ত দেবতা তাঁর প্রকাশ অথবা তাঁর অংশ। আজ আমরা কালীতত্ত্বের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানব: মা কালী জগন্ময়ী জগন্মাতা, মা কালী সর্বময়ী।
★ কালী ও কাল অভিন্ন। মহাকালীর পুরুষ রূপ হলেন মহাকাল। আদি মধ্য যুগের মহাকাল মূর্তি যাঁরা দেখেছেন সবাই জানেন, হুবহু কালীমূর্তির ন্যায় পুরুষ, মুণ্ডমালা ধারণ করেন, শববাহন, করালদ্রংষ্ট। আধুনিক যুগের সূচনায় এজন্য শাক্ত কবি গেয়েছেন, কালী কেবল মেয়ে নয়, কখনও কখনও পুরুষ হয়।
★মা কালীই কৃষ্ণরূপে প্রকাশিত, ঋগ্বেদে মা কালীর অন্যতম নাম কৃষ্ণী, যাঁর নামের অর্থ কালো মেয়ে। আহা, কালো মেয়ে শুনলেই মনে পড়ে শাক্ত পদাবলীর সেই অপূর্ব উক্তি: কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।
মা কালীই শ্রীরাধার মান রক্ষার্থে এক সঙ্কটের মুহূর্তে প্রকাশিত হয়েছিলেন, সেই কৃষ্ণকালী রূপ আজও বৃন্দাবনে পূজিত, বাংলায় রটন্তী কালী পুজোতেও এই কালী কৃষ্ণ অভিন্নতা ঘোষিত হয়।
★ঋগ্বেদে নিশা ও ঊষার উল্লেখ আছে, নিশা হলেন আদিদেবী, জগদকারণ, এবং সৃষ্টির সূচনায় তিনি নক্ৎ কৃষ্ণী। পরে তিনিই জগদপালিকা ঊষা। রাত্রি সূক্ত মা কালীর প্রাচীন উল্লেখ হিসেবে গণ্য হয়। ঊষা দশভুজা বলে আখ্যা পেয়েছেন।
হরপ্পা সভ্যতায় এই নিশা ঊষা পূজিত ছিলেন এমন সিদ্ধান্ত করার পেছনে একাধিক গবেষকের কাজ আছে। ঊষা হলেন নিশার রূপ। আজকের কালী দুর্গা এখান থেকেই।
অর্থাৎ, দুর্গা হলেন মা কালীর রূপ। জগদকারণ কালী: সৃষ্টির আদি মুহূর্তে অন্ধকার, কালের সূচনায় অমারাতে তিনি কালী, আর সৃষ্টির স্ফুরণ ঘটলে ঊষাকালে তিনি জগদপালিকা দুর্গা।
★দুর্গাপুজোর মন্ত্রে বস্তুত ভদ্রকালীর আবাহন ও উপাসনা হয়। দুর্গাপুজোর কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান সন্ধিপুজো, তাতে বলি গ্রহণ করেন স্বয়ং চামুণ্ডাকালী। দুর্গাপুজো যিনি তন্ত্রমতে করেছেন তিনিই জানেন যে বস্তুত এ হল মা আদ্যাকালী ভদ্রকালীর পুজো।
★ দুই গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু দেবতা গণেশ এবং স্কন্দ অবশ্যই মায়ের অংশ, মাতৃকার সন্তান।
★ মহালক্ষ্মী সিংহবাহিনী, মহাসরস্বতীও সিংহবাহিনী, এঁরা দুর্গার সমতুল্য। এবং তথাকথিত অলক্ষ্মী বা নীল লক্ষ্মী এবং তন্ত্রের নীল সরস্বতীর মধ্যে মা কালীর শ্যামা বা নীল রূপ নিহিত।
★ মা তারা দ্বিতীয় মহাবিদ্যা রূপে মা কালীর তারিণী রূপের প্রকাশ, এই রূপে তিনি সন্তানদের সংসার সমুদ্রে তারণ করেন। তারার নামের প্রধান অর্থ তাই: যিনি তারিণী। কিন্তু আরেকটি অর্থ হল তারা, তারকা, যা অন্ধকার রাতে আমাদের নৌসাধনোদ্যত পূর্বসূরিদের পথ প্রদর্শক। রাত্রি এবং তারা অবিচ্ছেদ্য। মা কালী অবশ্যই রাত্রি। মা কালীর আকাশে মা তারা বিরাজমান।
★ মা কালীই সন্তানকোলে ষষ্ঠী, কারণ তিনি জগদকারণ প্রকৃতি, এবং আমরা সবাই তাঁর সন্তান।
★ মা মনসার সঙ্গে মা কালীর সর্পময়ী গুহ্যকালী রূপের সংযোগ আছে, সে তো সবাই বোঝেন। কিন্তু মনসাকালী মূর্তি পশ্চিমবঙ্গে কোথাও কোথাও আজও দেখা যায়।
★ কালীই প্রকাশিত হন সর্বরোগহর শীতলা রূপে, কারণ মা কালীর একটি গর্দভবাহিনী রূপ আছে শাস্ত্রে। মায়ের নাম আমাদের সুশীতল করে, তাই কালীই শীতলা।
★ মা কালীই সিংহবাহিনী রূপে প্রকাশিত হন, রক্ষাকালী সিংহবাহিনী হন আমরা জানি, তাই তিনিই সিংহবাহিনী চণ্ডী ও জগদ্ধাত্রী।
★ মা কালীর পুজো শনিবার সবথেকে বড় ভাবে হয়, তাই বড় ঠাকুর, গ্রহরাজ শনিও মা কালীর বিভূতির প্রকাশ, তিনি মা কালীর পাশে মায়ের অংশ হিসেবে এবং মায়ের দ্বারপাল ক্ষেত্রপাল ন্যায়পাল হিসেবে বিরাজ করেন।
★ যত শোন কর্ণপুটে সবই মায়ের মন্ত্র বটে। সব শব্দই মায়ের মন্ত্র, যত আহার সবই মায়ের আহুতি, বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণ মাতৃকাবর্ণ, ইতিহাসের প্রত্যেক অনুক্ষণ মাতৃকা যুগ, এ ভূমির প্রতিটি ক্ষেত্রই কালীক্ষেত্র এবং আমাদের তন্ত্রাশ্রয়ী ধর্মের সব দেবতাই মায়ের প্রকাশ।
এজন্য কালী ভিন্ন কলিযুগে অপর দেবতা নেই, শাস্ত্রে বলা হয়েছে: ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবাদীনাং শিরোরত্ন পদাম্বুজা। কলৌ কালী কলৌ কালী নান্যদেবঃ কলৌ যুগে।।
অর্থাৎ, ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব যাঁর পাদপদ্মকে সর্বদা নিজের নিজের মাথার মুকুট হিসেবে ধ্যান করেন, সেই মা কালী ভিন্ন কলিযুগে অপর কোনও দেবতা নেই।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
সর্বদা মা কালীর জয়ধ্বনি করবেন। জয় মা কালী। জয় জয় মা।
মায়ের ছবি ইন্টারনেট থেকে।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, বারো মে দুহাজার তেইশ