মা নীলা – তমাল দাশগুপ্ত

মা নীলা।

★ নীলাবতী, নীলষষ্ঠী, নীলচণ্ডী/নীলাইচণ্ডী, নীলসরস্বতী, নীলতারা অথবা শুধুই মা নীলা: মায়ের অনেক নাম।

★ অতীতে তাঁর জনপ্রিয়তা অকল্পনীয় ছিল, এমনকি কিছু প্রাচীন শাস্ত্রে নীলা হলেন মহাবিদ্যা। এখনও দ্বিতীয় মহাবিদ্যা তারার মধ্যে তাঁর ছায়া আছে। শ্যামা কালী বা নীল বর্ণের কালীর মধ্যেও নীলা আছেন। কিন্তু বর্তমানে মা নীলার স্বতন্ত্র উপাসক সম্প্রদায় এবং নীলা মন্দির বা পুজোর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। একমাত্র বছরে একটি দিন, চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীল ষষ্ঠী ব্রতে আমরা তাঁর অতীতের বিপুল জনপ্রিয়তার লুপ্তপ্রায় আবছায়া স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে এক আঁজলা জল মাথায় ঠেকাই।

★ এই বিস্মৃতির পেছনে সম্ভবত মা নীলার সঙ্গে শিবের বিবাহ কল্পনা দায়ী। শিব একাই নীলা উপাসনার জনপ্রিয়তার অমৃতর সবটুকু গ্রহণ করে নিয়েছেন, আর মা নীলা পান করেছেন বিস্মৃতির বিষ, পান করে অন্তরালে চলে গেছেন। ওই পুরাণের সমুদ্র মন্থন কাহিনীর উল্টো ঘটনা ঘটেছে আর কি। নীলা একা নন। প্রবল পরাক্রান্ত পুরুষ দেবতারা অনেক সময়েই জনপ্রিয় মাতৃকাদের উপাসনা, অস্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য আত্মসাৎ করে তাঁদেরই মুছে দিয়েছেন। মাতৃধর্মের যে কোনও গবেষক জানবেন, উদাহরণ প্রচুর।

★ চণ্ডী, কালী, সরস্বতী, তারা, ষষ্ঠী – সবারই নীল রূপ দেখা যায়। লক্ষ্মীর নীল রূপ নেই? আছে। সমুদ্র মন্থনের কথা হচ্ছিল। যিনি স্বয়ং সমুদ্র থেকে উঠে এসেছেন তাঁর নীল রূপ নেই হতেই পারে না। সমুদ্রবাণিজ্য সেই হরপ্পা সভ্যতার পণি থেকে পরবর্তী বাঙালি বণিকদের জন্য লক্ষ্মীলাভের সমতুল। বস্তুত পুরাণে যিনি অলক্ষ্মী আখ্যা পেয়েছেন, তিনিও লক্ষ্মীর মতোই সমুদ্রসম্ভূত, তিনি লক্ষ্মীর নীল রূপ। তিনি নীল লক্ষ্মী।

★ নীল বর্ণের তাৎপর্য অনেক। অন্যতম প্রধান হল জল। হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রধর্মে জল অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মা নীলা এই জলের তাৎপর্য বহন করেন। মা নীলার সেই ঐতিহ্যেই তারা তারিণী আদিতে তারণ করতেন, ভবসমুদ্র পার করতেন, এখনও করেন।

নীল বর্ণ রাত্রিরও অন্যতম রং। ঋগ্বেদে রাত্রিসূক্ত স্মর্তব্য। প্রাচীন তন্ত্রে নিশা বা নক্ত কৃষ্ণী পূজিত হতেন। মা কালীর দর্শনে এই রাত্রিতত্ত্ব কেন্দ্রীয় স্থানে।

নীল বর্ণ আগুনের অন্যতম রং। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য মুণ্ডক উপনিষদে আগুনের সপ্তজিহ্বা। হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রে বলি গ্রহণ করতেন সপ্ত মাতৃকা, তাঁরাই পরবর্তী কালে বৈদিকদের যজ্ঞে অগ্নির সপ্ত জিহ্বা। মা নীলা এই ক্ষেত্রে মা বলিপ্রিয়ার স্মারক।

নীল বর্ণ আকাশেরও রং। আকাশ থেকে জল থেকে আগুন, মা নীলা সর্বত্র।

★ হিউয়েন সাং সপ্তম শতকে গান্ধার প্রদেশে প্রাচীন ভীমা স্থানের উল্লেখ করেছেন। এটি প্রাচীনযুগে, খ্রিষ্টপূর্ব কালে মহাভারতে উল্লিখিত প্রাচীন তিনটি শক্তিপীঠের অন্যতম (একান্ন শক্তিপীঠের ধারণা এবং সেই সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনী অনেক পরে এসেছে)। এই ভীমা স্থানে মা ভীমা গাঢ় নীল বর্ণের প্রস্তর মূর্তিতে পূজিত হতেন।

★ বাঙালির বৈশাখী নববর্ষ আদ্যোপান্ত তন্ত্রধর্মীয় উৎসব। নীলষষ্ঠী তো অবশ্যই মাতৃকা উপাসনার উৎসব ছিল, এবং চড়ক এসেছে মাতৃকার চক্র থেকে, আমার এই বিষয়ে লেখা আছে। হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই চক্র হচ্ছে মাতৃকার যন্ত্র (votive disc), এ বিষয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়েছে। এই নীলের দিন এবং চড়কের উৎসবের মাধ্যমে নতুন বছরের আগমন শুভ হোক।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

জয় মা নীলা। জয় জয় মা।

হরিপালে মা নীল সরস্বতীর এই ছবিটি এবছর সরস্বতী পুজোর দিন তোলা।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, বারো এপ্রিল দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s