মা কালীর মূর্তিরূপ বর্ণনা কোন্ গ্রন্থ কেমনভাবে করেছে – তমাল দাশগুপ্ত

মা কালীর মূর্তিরূপ বর্ণনা – কোন্ গ্রন্থ কেমনভাবে করেছে: ইতিহাসের অনুক্রমে মা কালীর মূর্তিতত্ত্ব বা আইকোনোগ্রাফির সপ্ত বিবরণ।

১. অগ্নির সপ্তজিহ্বার একটি – এই হিসেবে মা কালীর প্রথম (কিন্তু প্রান্তিক) উল্লেখ পাই বৈদিক আর্যের গ্রন্থ মুণ্ডক উপনিষদে, এটি পরবর্তী কালের উপনিষদ এবং গৌতম বুদ্ধের যুগের (৫০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) পরে রচিত বলেই মনে করা হয়।

আমি আগে বলেছি যে হরপ্পা সভ্যতায় বলিদানের সময় সপ্তমাতৃকার উপাসনা হত, হরপ্পা পতনের পরে সেটাই বৈদিক আর্যের যজ্ঞে অগ্নির সপ্ত জিহ্বা হয়ে গেছিল।

২. মহাভারত দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে লিপিবদ্ধ হয়েছিল, লিপিবদ্ধ হওয়া শেষ হয় ৪০০ খ্রিষ্টাব্দে। মহাভারতে মা কালীর ভয়াল রূপবর্ণনা আছে মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে যখন অশ্বত্থামা পাণ্ডবপক্ষীয় বীরদের শিবিরে রাতের বেলায় প্রবেশ করে সবাইকে হত্যা করছেন। তখন সেই হননস্থলে কালী এভাবে দৃশ্যমান হচ্ছেনঃ রক্তাস্যনয়না, রক্তমাল্যানুলেপনা, পাশহস্তা, ভয়ঙ্করী।

৩. হরিবংশ গ্রন্থে (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) মহাদেবীর শিবারূপ উল্লিখিত। মা এখানে শৃগালরূপে বসুদেবকে যমুনা পার হয়ে গোকুলে যাওয়ার পথ নির্দেশ করেছিলেন। যদিও এখানে কালীর নামোল্লেখ নেই সরাসরি, মহাদেবী বলা হয়েছে, কিন্তু এ বর্ণনা স্পষ্টই কোকমুখ কালীর স্মৃতিবাহী। প্রসঙ্গত আজও কিছু বিরল কালীসাধক শিবাভোগ দেন লোকালয় থেকে দূরে। মাকে শিবাদূতী বলা হয়, কারণ শৃগাল তাঁর দূত।

৪. কালিদাসের কুমারসম্ভব গ্রন্থে (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ পঞ্চম শতক) কালী হলেন নীলমেঘরাশির মধ্যে ভাসমান বলাকিনীর ন্যায়। তিনি এখানে শিবের প্ৰমথগণের মধ্যে নৃত্যরত, এবং তিনি মুণ্ডমালা (কপালাভরণ) দ্বারা শোভিত। প্রসঙ্গত রঘুবংশ গ্রন্থেও কালিদাস মা কালীকে বলাকিনী বলেছেন। রামের সঙ্গে যুদ্ধরত তাড়কা রাক্ষসীকে দেখে মা কালীর মত মনে হচ্ছিল, কালিদাস লিখেছেন। স্পষ্টই বৈদিক পৌরাণিক আর্যের কাছে মা কালীর ভয়াল রূপটি মুখ্য।

৫. এরপর মা কালীর বর্ণনা পাই শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে (খ্রিষ্টীয় পঞ্চম ষষ্ঠ শতক। যদিও মার্কণ্ডেয় পুরাণ তৃতীয় শতকের গ্রন্থ, কিন্তু এই শ্রীশ্রী চণ্ডী অংশটি পরবর্তী কালে রচিত)। এখানে শুম্ভ নিশুম্ভর সঙ্গে যুদ্ধকালে মা চণ্ডীর ভ্রূকুটিকুটিল ললাট থেকে কালী বেরিয়ে আসেন। তিনি করালবদনা, খট্বাঙ্গধারিণী, নরমালাবিভূষিতা, ব্যাঘ্রচর্মপরিহিতা, শুষ্কমাংসা, অতি ভীষণ রব করছেন (অতিভৈরবী), অতি বড় হাঁ করে আছেন (অতিবিস্তারবদনা), তাঁর জিভ লকলক করছে (জিহ্বাললনভীষণা), তাঁর রক্তবর্ণ চক্ষু চোখের কোটরে ঢুকে আছে (নিমগ্নারক্তনয়না), তাঁর সিংহনাদে চারদিক প্রকম্পিত (নাদাপূরিতদিঙমুখা)।

প্রসঙ্গত শ্রীশ্রী চণ্ডী যখন রচিত হচ্ছে, তখনও শিবের সঙ্গে জগন্মাতার কোনও বিশেষ সম্পর্ক কল্পিত হয়নি, যেটা আমরা শ্রীশ্রী চণ্ডী পড়লেই বুঝতে পারি। এ কল্পনা সম্রাট শশাঙ্ক কর্তৃক বৈশাখী নববর্ষ প্রচলনকালে চৈত্রশেষে শিব ও নীলাবতীর বিবাহের উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে বলবতী হবে। আমি কিছুদিন আগে গুপ্তযুগের বেশ কিছু শিবলিঙ্গ দেখে এলাম মথুরা মিউজিয়ামে, সেই সব শিবলিঙ্গে কোথাও গৌরীপট্ট নেই। স্পষ্টতই শশাঙ্কযুগের আগে এই বিষয়টি ছিল না, ফলে আদিযুগে মা কালীর মূর্তিতত্ত্বে শিবের উপস্থিতি নেই।

৬. সিদ্ধেশ্বর তন্ত্রের রচনাকাল জানা নেই, তবে সেটি তন্ত্রসারে সংকলিত। এখানে মা কালীর বর্ণনা নিম্নরূপ।

শবারূঢ়াং মহাভীমাং ঘোরদ্রংষ্টাং বরপ্রদাম্
হাস‍্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্তৃকাকরাম্
মুক্তকেশীং ললজিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহুঃ
চতুর্বাহুযুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ।

অর্থাৎ মা কালী শবারূঢ়া, তাঁর ঘোর দন্তরাশি উন্মুক্ত, তিনি বর প্রদান করছেন হাস্যমুখে, তিনি ত্রিনেত্র, তিনি একদিকের হাতে নরকপাল ও কর্তৃকা (খড়্গ, কাটারি) নিয়ে আছেন। তাঁর কেশ উন্মুক্ত, তিনি জিহ্বা প্রসারিত করে আছেন, তিনি ক্ষণে ক্ষণে রক্তপান করছেন, তাঁর চারবাহুর অন্য দিকের দুটি হাতে তিনি বর ও অভয় মুদ্রা প্রদর্শন করছেন।

বর্ণনা দেখে পালযুগের বজ্র ও সহজ আন্দোলনে এবং পরবর্তীকালে সেনযুগে শবারুঢ় মাতৃমূর্তির কথা মনে পড়ে। এই শবটিই পরে মধ্যযুগে শিবের রূপ পেয়েছিল।

৭. মধ্যযুগে সংকলিত তন্ত্রসার গ্রন্থে (আনুমানিক সপ্তদশ শতক) মা কালীর পাঁচটি ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়। সিদ্ধেশ্বর তন্ত্রের মন্ত্রটি সবথেকে বিখ্যাত, সেটি ওপরে দিয়েছি। এছাড়া কালীতন্ত্রোক্ত মন্ত্রটি এরকম।

মা চতুর্ভুজা, মুক্তকেশী, করালবদনা, ঘনমেঘের মত শ্যামবর্ণ, মুণ্ডমালাবিভূষিতা, দিগম্বরী, দুই বামহস্তে সদ্যছিন্ন মুণ্ড ও খড়্গ, দুই ডান হাতে অভয়া ও বরদা মুদ্রা। মুণ্ডমালা নির্গত রক্তে মা রঞ্জিত। দুই কানের কুণ্ডল দুটি শব, মায়ের কটি দেশের মেখলা নির্মিত হয়েছে শবদেহের ছিন্ন হস্ত দ্বারা। দুই কস দিয়ে রক্ত ঝরছে, কিন্তু মায়ের মুখে হাসি। প্রভাতসূর্যের মত মায়ের তিন নেত্র। মায়ের দন্তরাশি সুউচ্চ। শবরূপ মহাদেবের হৃদয়ে দণ্ডায়মান অবস্থায় মা মহাকালের সঙ্গে বিপরীত বিহারে রত।

সারা উপমহাদেশ জুড়ে এবং বিশেষ করে বাঙালির মধ্যে প্ৰচলিত জনপ্রিয় দক্ষিণা কালী মূর্তি যদিও মূলত তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী নির্মিত, কিন্তু সেই কালীমূর্তিতে প্রায় এই বিপরীত বিহাররত মূর্তি দেখা যায় না বললেই হয়। এটি অন্ধকার মধ্যযুগে গুহ্য তান্ত্রিকদের অবদান, সাধারণ বাঙালির মধ্যে জনপ্রিয় হয়নি। এই মূর্তিতে শিবের উপরে উত্তানভাবে শায়িত একটি মহাকাল মূর্তি থাকেন।

প্রসঙ্গত আগমবাগীশ তাঁর তন্ত্রসার গ্রন্থে কালীতন্ত্র সহ অন্যান্য তন্ত্রগ্রন্থ থেকে যে শ্লোক সংকলন করেছেন, সেটিই শ্যামাকালী বা দক্ষিণাকালীর প্রথম রূপ এই মর্মে একটা কথা চালু আছে, কিন্তু সেটা ঠিক নয়। তার অনেক আগেই, ত্রয়োদশ শতকে বৃহদ্ধর্ম পুরাণে কালীরূপ বর্ণিত হয়েছে।

বৃহদ্ধর্ম পুরাণে কালীমূর্তি বর্ণিত এরকমভাবে:

মা কালী শ্যামবর্ণা, দিগম্বরী, মুক্তকেশী এবং লম্বোদরা। মা শববাহনা, শবরূপ মহাদেবের উপরে তাঁর আসন। মায়ের জিহ্বা প্রসারিত। দুই বাম হাতে অসি ও মানুষের মাথা। জীবের সংহারকাল উপস্থিত হলে তাঁর যে সংহারী মূর্তি দৃশ্যমান হয়, সেই মূর্তি নিয়ে তিনি কোটি কোটি পাপ বিনাশ করছেন। তিনি নানা অলঙ্কারে বিভূষিতা, মুখে হাসি, তাঁর দুই ডান হাতে অভয় ও বরদান মুদ্রা আছে।


যে মা অনাদি অনন্ত আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত জগদকারণ, যিনি নারী পুরুষ নির্বিশেষে, জীব জড় নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বজগতের উৎপত্তি, বিস্তার ও বিলয়, আমরা সীমিত মানববুদ্ধিতে নিজেদের চিন্তার সুবিধার জন্য সেই মায়ের প্রতিমা এভাবে যুগে যুগে নির্মাণ করেছি। এজন্যই শাক্ত পদাবলীতে বলেছে, ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি।

জয় মা কালী।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

মা কালীর ছবি টুইটার থেকে।

আমার এই লেখাটি দুহাজার একুশ সালের। মাঝে মাঝে অতীতের লেখাগুলো পুনরায় তুলে ধরা প্রয়োজন।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, চার এপ্রিল দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s