আজ চৈত্র সংক্রান্তি, আজ চড়ক উৎসব – তমাল দাশগুপ্ত

আজ চৈত্র সংক্রান্তি, আজ চড়ক উৎসব। এই চড়ক শব্দটি চক্র থেকে এসেছে এবং চক্র হল মাতৃকার প্রতীক, মাতৃকার যন্ত্র একটি চক্রকে কেন্দ্র করেই নির্মিত। সেই হরপ্পা সভ্যতা থেকেই চক্র প্রতীকে মায়ের উপাসনা হয়। কালচক্র, ঋতুচক্র, পৃথিবীর আবর্তন, বছরের আবর্তন, এমনকি জীবনের সুখ দুঃখের চক্রাকার আবর্তন এই চড়ক উৎসবে উদযাপিত হত প্রাচীন কালে এই চেতনা থেকে যে এই চক্র মায়ের প্রতীক।

ভারতীয় মননে সময়স্রোত চক্রবৎ বয়ে চলে। চড়কের গাছে যে ঘূর্ণি তৈরি হয় তা আমাদেরই ভবচর্যা। শাক্ত কবি গেয়েছিলেন, মা আমায় ঘুরাবি কত। কষ্ট আছে জীবনের এই ভবচক্রে, তা সহ্য করার শিক্ষাও দেয় চড়ক।

এছাড়া তন্ত্র ও তন্তু cognate শব্দ। তন্ত্রের অর্থ যে বলা হয়, তনুকে ত্রাণ, সে অনেক পরে এসেছে, মূলত মধ্যযুগের দেহবাদী তন্ত্রের অর্থ। প্রাচীন তন্ত্র হল সামগ্রিক অর্থে গ্রন্থনা এবং একত্রিত সিস্টেম, যেমন গৌড় তন্ত্র। তন্তু বুনে তন্ত্র। আলাদা আলাদা তত্ত্বকে একত্রে বুনোট হল তন্ত্র। সামগ্রিক অদ্বয়বাদী দৃষ্টির প্রতীক হিসেবে তাই চরকার গুরুত্ব, যেখানে সব তন্তু একত্রে গ্রন্থিত। এই তন্তুবয়নশিল্প হরপ্পা থেকে মধ্যযুগের বাংলা পর্যন্ত অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাঙালির জন্য পাঁচ হাজার বছর ধরে। বাংলাকে পৃথিবীর তাঁতঘর বলা হত। চড়ক উৎসবের চক্র কাজেই সেই তন্তু ও চরকারও প্রতীক।

আমরা চড়কে “উড্ডিয়ান” থাকি। আমাদের প্রাচীন বলাকা মাতৃকার (স্মর্তব্য, হরপ্পা থেকে পাণ্ডু রাজার ঢিবি সর্বত্র বলাকা মাতৃকা পূজিত। আমাদের প্রাচীন বাঙালিদের এজন্যই বয়াংসি বলা হয়েছিল) আবছায়া স্মৃতি ধরা আছে তন্ত্রের খেচরী বিদ্যা, খেচরী মুদ্রা প্রভৃতি তত্ত্বে। আকাশের কাছাকাছি উড়ে গেলে আমাদের মোক্ষদায়িনী মায়ের জগৎব্যাপী ঐশ্বর্য প্রত্যক্ষ করা যায়। সে যে প্রত্যক্ষ করেছে সেই একমাত্র জানে, বাকিদের বোঝানো মুশকিল। চড়ক গাছ কাজেই আমাদের মায়ের বলাকা রূপের দ্যোতনা। আজও মা কালীর একজন নিত্যা হলেন বলাকা। মা কালীর একাধিক শ্লোকে বলাকার উল্লেখ আছে। এছাড়া কালিদাসের কাব্যেও মা কালীকে বলাকিনী বলা হয়েছে।

চড়ক গাছের সামরিক তাৎপর্য ছিল। প্রবল পরাক্রান্ত গঙ্গারিডাই থেকে পালসাম্রাজ্য থেকে সেনসাম্রাজ্য, এমনকি এই সেদিন যশোর সম্রাট প্রতাপের সেনাতেও চড়ক গাছের মত একটি উঁচু চলমান স্তম্ভের সাহায্যে শত্রুর দুর্গ জয় করার জন্য প্রশিক্ষিত কম্যান্ডো সৈন্যদের (মূলত তীরন্দাজ) ব্যবহার করা হত। তন্ত্রের সাম্রাজ্য এবং সামরিক শক্তির লুপ্ত ইতিহাসের স্মৃতি আছে চড়ক উৎসবে, সেই স্মৃতির নবরূপে পুনর্জন্ম হোক।

চড়ক উৎসব শুভ হোক। শুভ চৈত্র সংক্রান্তি। এই চড়ক আমাদের বর্ষবরণ উৎসব, সেই আসন্ন নববর্ষ শুভ হোক। জয় মা কালী। জয় জয় মা।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

ইউরোপীয়রা আমাদের দেশে আসার পর তাদের শিল্পীরা বিপুল জনপ্রিয় চড়ক উৎসবের একাধিক ছবি এঁকেছেন। এখানে দেখছেন ১৭৯৮ সালে বাংলার চড়কের ছবি। এ ছবিটি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে আছে।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, চোদ্দ এপ্রিল দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s