চামুণ্ডা, যিনি সপ্তমাতৃকার আদি গৌরবময় স্মৃতি – তমাল দাশগুপ্ত

চামুণ্ডা, যিনি সপ্তমাতৃকার আদি গৌরবময় স্মৃতি।

কালীক্ষেত্র আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হল বাঙালি জাতিকে তার তন্ত্রধর্মের শেকড়ে ফেরানো, মা কালীর মহামন্ত্রে আজকের বাঙালিকে নবদীক্ষা দেওয়া। এই উদ্দেশ্যে সপ্তাহে সাত দিনই কোনও না কোনও নতুন কালীক্ষেত্র অথবা মাতৃকা উপাসনার তত্ত্ব ও ইতিহাস আপনাদের সামনে তুলে ধরেন এই পেজের সাত জন সুলেখক গবেষক। আলাদা করে কারও নাম উল্লেখ করি না আমরা, কারণ সবাই কালীক্ষেত্র আন্দোলনের পদাতিক সৈন্য, আমরা সবাই মা কালীর কম্যান্ডো, এই আমাদের সবথেকে গর্বের পরিচয়।

লক্ষ্য করুন, এই সাত সংখ্যাটি তন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তমাতৃকা ছিলেন হরপ্পা সভ্যতায়, তাঁরা বলি গ্রহণ করতেন, প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে। বৈদিকদের মধ্যে বলি গ্রহণ করতেন অগ্নি সেজন্য অগ্নির সপ্ত জিহ্বা রূপে এই সপ্ত মাতৃকার উল্লেখ আছে মুণ্ডক উপনিষদে, সেখানে মা কালীর উল্লেখ আছে। পরবর্তী যুগে এই সপ্তমাতৃকার প্রায় সবাই কোনও না কোনও পৌরাণিক দেবতার শক্তি বা ছায়ায় পর্যবসিত হন, তাঁদের নিজস্ব অস্তিত্ব হারিয়ে যায়, ব্রহ্মাণী ইন্দ্রাণী বৈষ্ণবী প্রভৃতি। কিন্তু চামুণ্ডা নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখেন, তিনি কোনও পুরুষ দেবতার শক্তি নয়।এজন্য আজ পর্যন্ত চামুণ্ডাই স্বমহিমায় বিরাজ করছেন। ব্রহ্মাণী ইন্দ্রাণী বৈষ্ণবী বাদ দিন, ভারতে কটা জায়গায় আজ ইন্দ্র বা ব্রহ্মা বা বিষ্ণু স্বনামে পূজিত? বিষ্ণুর দুই অবতার রাম আর কৃষ্ণ পূজিত হন যদিও, কিন্তু কথা হচ্ছে, আমাদের মাতৃকারা কেবলমাত্র পুরুষ দেবতাদের হ্লাদিনী শক্তি বা রুদ্র শক্তি হয়ে গেলে তো মহা সমস্যা হতে পারে কারণ এই সব পুরুষ দেবতারা তো স্থির নন, এরা আসেন এবং যান। রাম তো চিরকাল ছিলেন না, চিরকাল থাকবেন না। কিন্তু আমাদের মাতৃকারা তো চিরন্তন। ফলে আজ আর ইন্দ্রাণী কিভাবে পূজিত হবেন, ইন্দ্র নিজেই তো হারিয়ে গেছেন। আদি সপ্তমাতৃকা তত্ত্বের বিপর্যয় ঘটিয়ে যারা বলিপ্রিয়া আদ্যাশক্তি মাতৃকাগণের স্বকীয় পরিচয় বিনষ্ট করে তাঁদের এভাবে আর্যাবর্ত পৌরাণিক দেবতাদের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন, তারা চামুণ্ডার ক্ষেত্রে সফল হন নি, এ আমাদের জন্য আজ বড় শিক্ষা।

পালযুগে চর্চিকা নামে পূজিত হতেন মা চামুণ্ডা। পালযুগে নয়পালের সময় বাণগড় লিপিতে চর্চিকা স্তব পাওয়া যায়, এবং তিনি এই সময় সবথেকে জনপ্রিয় আরাধ্যা উপাস্য মাতৃকা ছিলেন। দুর্গাপুজোর সময়েও সন্ধিপুজোর মহামুহূর্তে স্বয়ং মা চামুণ্ডা বলি গ্রহণ করেন। সপ্তম শতকে বাণভট্টের লেখায় জানা যায়, উত্তর ভারত থেকে গৌড়ের দিকে যত এগিয়ে আসা যেত তত বেশি করে গৃহে গৃহে চামুণ্ডা মণ্ডপ দেখা যেত, আজ যেমন সম্পন্ন বাঙালির গৃহে চণ্ডী মণ্ডপ দেখা যায়।

চামুণ্ডা প্রাচীন দেবী, এবং শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুযায়ী মা কালীর আরেক নাম চামুণ্ডা। কিন্তু চণ্ড মুণ্ড বধ থেকে চামুণ্ডা নামের ব্যুৎপত্তি সিদ্ধ হয় না। বলিপ্রিয়া মায়ের এই চামুণ্ডা নামটি সম্ভবত দ্রাবিড়।

মহাভারতে চামুণ্ডা নামের উল্লেখ নেই, যদিও দুর্গাস্তব আছে দুটি এবং মা কালীর উল্লেখ আছে বেশ কয়েক জায়গায়। কিন্তু মহাভারতে শল্য পর্বে সেযুগের ভারতে পূজিত মাতৃকাদের নামের একটি তালিকার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃকাদের মূর্তি ও মণ্ডল বিবরণ আছে, তাতে দেখা যায় যে দেবী শ্মশানবাসিনী এবং নিমাংসাগাত্রী (অর্থাৎ কঙ্কালসার)। এটি নিঃসন্দেহে মা চামুণ্ডারই বিবরণ।

হারিয়ে যাওয়া সপ্তমাতৃকার সগর্ব পুনরুদ্ধার হলেন ।এ চামুণ্ডা। আজ বর্ধমানে যে কঙ্কালেশ্বরী মায়ের পুজো হয়, তিনি পালসেনযুগের রুদ্রচর্চিকা এবং তিনি নৃত্যচামুণ্ডা। এঁর সম্পর্কে তমাল দাশগুপ্ত পেজের প্রবন্ধ আছে, সেটির লিংক রইল কমেন্টে।

জয় সপ্তমাতৃকা, জয় মা চামুণ্ডা।

© কালীক্ষেত্র আন্দোলন

মায়ের ছবি boloji থেকে

কালীক্ষেত্র আন্দোলন ফেসবুক পেজ, পঁচিশ মার্চ দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s