কালরাত্রি, পূতনা এবং… (উপাস্য মাতৃকাদের কিভাবে দূষণ ঘটেছিল) – তমাল দাশগুপ্ত

কালরাত্রি, পূতনা এবং …
(উপাস্য মাতৃকাদের কিভাবে দূষণ ঘটেছিল)

আজকের পোস্টে শক লাগবে। ইংরেজিতে যাকে বলে, brace yourselves!

কথাসরিৎসাগর একটি প্রাচীন ও রঙিন গল্পের বই। একাদশ শতকে লেখা। মনোহর কাহানিয়া যাকে বলে হিন্দিভাষীরা, এ হল তাই। এতে এক জায়গায় ভয়ানক একজন ডাকিনীকে দেখানো হয়েছে, যে গপ্পের ভিলেন, এবং তার দ্বারা আক্রান্ত নায়ক হল একজন সুকুমারমতি কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ। এতে তন্ত্রকে বীভৎস রকমের খারাপ একটা বিষয় দেখানো হয়েছে, নরমাংস ভোজন তন্ত্রের ব্রতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দেখানো হয়েছে, উৎকট সব কামাচার দেখানো হয়েছে, আকাশে উড়ন্ত কামপিপাসু সব ডাকিনীদের দেখানো হয়েছে। বস্তুত আজকের দিনে বাংলায় যত উদ্ভট রোমহর্ষক ভয়াল গল্প লেখা হয় তন্ত্রকে নিয়ে, তার সবই টেমপ্লেট খুঁজে পাওয়া যাবে কথাসরিৎসাগরের এই অংশে।

এই ডাকিনীর নাম কি? কালরাত্রি। হুম। এই নামই দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু নবরাত্রির সময় সপ্তম রাতে যে দেবী পূজিত হন, তিনিও তো কালরাত্রি?

হুম। নাম ছাড়াও বর্ণনায় কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়।

সে যাক, কথাসরিৎসাগর কোনও শাস্ত্র নয়।

★★★

মহাভারতে শল্য পর্বে ষটচত্বারিংশ অধ্যায়ে সমসাময়িক ভারতে পূজিত মাতৃকাগণের তালিকা দেওয়া আছে। এই তালিকায় পূজিত মাতৃকাদের মধ্যে অন্যতম নাম পূতনা।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। পূতনা?

হুম।। সেই যে, যিনি ভাগবত পুরাণ, হরিবংশ, বিষ্ণু পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে একজন রাক্ষসী এবং কৃষ্ণ কর্তৃক নিহত (মূল ও আদি মহাভারতে যদিও কাহিনীটি নেই)।

একটা মজার কথা কি জানেন? খ্রিষ্টপূর্ব যুগে মথুরা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি ধর্ম অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল, প্রত্ন প্রমাণ অনুযায়ী। না, বৈষ্ণব ধর্ম নয়, এটিও ছিল, কিন্তু মুখ্য নয়, গৌণ ছিল। মথুরায় জনপ্রিয় ধর্মের মধ্যে একটি ছিল নাগ উপাসনা ধর্ম। আর একটি ছিল মাতৃধর্ম। এছাড়া যক্ষ উপাসক সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ছিল। বৌদ্ধ ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলে প্রাচীন যুগে সবথেকে বেশি সম্ভবত মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে, মথুরা মিউজিয়াম ঘুরে দেখে আমার তাই সিদ্ধান্ত।

তো কালীয় দমন কাহিনী বোঝাই যায় এই নাগদের দমন। আর পূতনা? মাতৃকা ধর্মকে দমন? মাতৃকার vilification?

■■■

পূতনা অনেক গ্রন্থেই বলাকা হিসেবে বর্ণিত। পূতনা কি সেক্ষেত্রে প্রাচীন বলাকা মাতৃকার স্মারক? আগের ওই কথাসরিৎসাগরের কাহিনীটিতে দেখি, ডাকিনীরা সব খেচরী বিদ্যা অনুশীলন করছে। তারা উড়ছে।

◆◆◆

বলাকা থেকে মনে পড়ল। কবি কালিদাস মা কালীকে বলাকিনী বলে উল্লেখ করেছেন। কোথায় জানেন?কালিদাস তাঁর রঘুবংশে লিখেছেন, রামের সঙ্গে যুদ্ধরত তাড়কা রাক্ষসীকে মা কালীর মত দেখাচ্ছিল: “তাড়কা চলকপালকুণ্ডলা কালিকেব নিবিড়া বলাকিনী”।

★★★

তাড়কা রাক্ষসী? মা কালী? এক পংক্তিতে? একই রকম দেখতে? হুম, কালিদাস তেমনই লিখেছেন।

আচ্ছা, এই তাড়কা কোনও প্রান্তেশ্বরী মাতৃকা ছিলেন না তো?

ও, ভালো কথা। পূতনা নিয়ে বলছিলাম না? যে মাতৃকাগণের তালিকা মহাভারতে আছে, সেখানে পূজিত মাতৃকাদের মধ্যে পূতনার পাশাপাশি কালীও উল্লিখিত।

পূতনা, কালী একই পংক্তিতে?

ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন।

★■■★

তাহলে, আমরা কি সিদ্ধান্ত নেব? প্রশ্নটি সহজ, আর উত্তরও তো জানা। The answer my friend is blowin in the wind…

আমাদের মাতৃকা শত্রুহস্তে চিত্রিত। বঙ্কিমের সেই anecdote মনে আছে? একটা চিত্র, তাতে একজন মানুষ একটা সিংহকে শিকার করছে। সে ছবিটা দেখানো হয়েছিল এক সিংহকে। সিংহ ছবিটা ভালো করে দেখে শুনে বলেছিল, সিংহরা ছবি আঁকতে জানে না, জানলে ছবিটা অন্যরকম হত।

উত্তর ভারতের তন্ত্রবিরোধী বর্ণবাদী বৈদিক গোবলয়ের হাতে মাতৃকা বিকৃত হয়েছেন, মাতৃকা দূষণ ঘটেছে। আজ হুদূর দেখে ভাববেন না, এই এক নতুন। কিচ্ছু নতুন নয়, এগুলো সব বিজাতীয় বলয়ের অভ্যস্ত বাঁদরামি। এখনও দেখেন না, মা কালী সম্পর্কে ভয় দেখায় ওরা? মা কালীর পুজো গৃহস্থ বাড়িতে করতে নেই, এসব জ্ঞান শোনেন নি ফেসবুকে? মা সম্পর্কে সন্তানকে ভুল বুঝিয়ে সন্তানকে বিপথে চালিত করতে চায় এরা।

আপনি জানেন না, আপনার প্রাণের তন্ত্র ধর্মের বিরুদ্ধে, মাতৃকা উপাসনার বিরুদ্ধে কত ধরণের আগ্রাসন ঘটেছে অতীতে। জানলে শিহরিত হবেন।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

জয় মা কালী। জয় জয় মা।

ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।

সংযোজন:

বাল্মীকি রামায়ণে রামের অকালবোধন নেই। বাল্মীকির রাম লঙ্কায় রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের আগে সূর্যের উপাসনা করেন, দুর্গার নয়। অকালবোধন অর্বাচীন কাহিনী, পূর্বভারতে রামকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে নির্মিত, মধ্যযুগে কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে জনপ্রিয় করেন, এছাড়া দুয়েকটি অর্বাচীন পুরাণে পাওয়া যায় সেগুলোও মধ্যযুগের, এবং পূর্ব ভারতের।

মহাভারতে দুর্গাস্তব আছে। ঋগ্বেদে দেবী সূক্ত আছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দুর্গা সপ্তশতী আছে। এসব তো আছেই। তবে সবগুলোই পরবর্তীতে প্ৰক্ষিপ্ত, আদি রচনায় ছিল না, ইতিহাসবিদদের মতে। আমি নিজেই শল্যপর্বে উল্লিখিত উপাস্য মাতৃকাদের তালিকা ব্যবহার করেছি এই লেখায়।

অর্থাৎ দুই ধরণের প্রক্ষেপ হচ্ছে।

এক, আর্যাবর্ত গ্রন্থে মাতৃকা উপাসনা আসছে। সে আসতে বাধ্য। হরপ্পা সভ্যতার প্রভাব এত সহজে নষ্ট করা যায় না। উত্তর ভারতে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাতৃকা উপাসনা এথমও অসম্ভব জনপ্রিয়। ওদের রাম শিব প্রমুখ পুরুষ দেবতারা তো ওদের ধর্মের কেন্দ্রে আছেন সন্দেহ নেই কিন্তু সাধারণ মানুষ দস্তুরমত ছাগল বলি দিয়ে এখনও মায়ের পুজো করে। বাঙালি তো হরপ্পা থেকে হনুমানের মত লাফ দিয়ে পূর্ব ভারতে পৌঁছে যায়নি। উত্তর ভারতের দাস জাতি যাঁরা মহাভারতে উল্লিখিত তাঁরা হরপ্পা সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করেন, তাঁরা বাঙালির সঙ্গে সম্পর্কিত, এ সম্ভাবনা আছে। বস্তুত পশ্চিমে বালুচিস্তান থেকে উত্তর ভারতের মধ্যে দিয়ে পূর্ব ভারত অবধি মাতৃকা উপাসক সম্প্রদায়ের এক বিস্তীর্ণ বেল্ট আছে, সে সংস্কৃতি গরুর বলয় আর মরুর বলয়ের সমস্ত আগ্রাসন সত্ত্বেও আজও মুছে যায় নি।

দুই, বাংলায় রাম আসছে। কিন্তু এ দুটোই পরে আসছে। আদি সাবর্ণ গোবলয় মাতৃকা উপাসক নয়, আদি বাংলাও রামকে মানত না। খাঁটি গোবলয় এখনও ভেতর থেকে মাতৃকাকে মানে না (ইয়ে দুর্গা কওন হ্যায়, দিলু ঘোষের উবাচ)। কিন্তু মাতৃধর্মকে বাদ দিয়ে উপমহাদেশের কোনও ধর্মই চলতে পারেনি। এখানে স্থানীয় ইসলাম যদি বনবিবির পুজো করে থাকে তাহলে বাংলার বিজেপিও ঘটা করে সল্ট লেকে দুর্গা পুজো আয়োজন করেছিল।

কিন্তু খাঁটি বাঙালি রাম টাম মানে না, আল্লা ফাল্লা মানে না। কৃষ্ণ মানলেও সে রাধার পা ধরে থাকা কৃষ্ণ।

পাঠকদের কমেন্ট

রক্তিম মুখার্জি বলছেন: হরিবংশে এবং শ্রীমদভাগবতে পূতনা হলেন বকাসুর এবং অঘাসুরের ভগিনী। বকাসুর বিশালদেহী বলাকা এবং অঘাসুর এক সুবিশাল নাগ। তাঁরা আবার আদিদৈত্য শঙ্খাসুরের বংশধর। এখানে বলাকা আর নাগের সংযোগ তো লক্ষণীয় বটেই। শঙ্খ নামটিও আবার আদিবিদ্বান কপিলের সাথে সংযুক্ত। মাতৃপূজক সংস্কৃতির অনেকগুলি হারানো সূত্রই এভাবে জড়িয়ে আছে।

জয়মাল্য ভট্টাচার্য বলছেন: সামবেদী মনুষ্য বাস্তুযাগে মনুষ্য বাস্তুমণ্ডলের এক দেবী হলেন পূতনা। তিনি পিলীপিঞ্জাদি ৫৩ জন বাস্তু দেবদেবীদের মধ্যস্থ নৈঋত কোনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন পূতনা।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, তেরো মার্চ দুহাজার তেইশ


https://www.facebook.com/2343427979014091/posts/6095284940495024/?mibextid=Nif5oz

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s