
সুন্দরবন অঞ্চলের অধিষ্ঠাত্রী স্থানেশ্বরী মা বনদুর্গা/বনচণ্ডী বা বনদেবীকে বনবিবি আখ্যা দিয়ে, ইসলামিক সংস্কৃতি আরোপ করে জহুরানামা শীর্ষক দুটি অর্বাচীন কাহিনী রচিত হয়েছিল, একটি বাংলা ১২৮৭ এবং অন্যটি বাংলা ১৩০৫ সনে, অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষে। প্রথম কাহিনীর লেখক মহম্মদ খাতের তাঁর গ্রন্থকে বলেছেন বনবিবি কেচ্ছা। তবে তুলনায় দ্বিতীয় লেখক মহম্মদ মুনসির লেখায় আরবি ফার্সি শব্দের বাহুল্য আরও বেশি দৃষ্টিকটু।
বনবিবি নামটি সম্ভবত মধ্যযুগেই প্ৰচলিত। কিন্তু এই নামটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যে বিশেষ কাহিনী জহুরানামায়, সেটি সম্ভবত অর্বাচীন, এবং তার ইসলামিক zeal নিঃসন্দেহে সমসাময়িক ওয়াহাবি ফরাজী আন্দোলনের ফসল। এবং এই কেচ্ছা বা কিসসা জনপ্রিয় হওয়ায় একাধিক যাত্রাপালার নির্মাণ ঘটে ইসলামিক কাহিনীটি আরও ছড়িয়ে পড়ে। বনবিবি সম্পর্কে আগে তমাল দাশগুপ্ত পেজে লেখা হয়েছে, লিংক কমেন্টে। আমাদের দেশে অরণ্যচণ্ডী বা বনদুর্গার উপাসনার সুপ্রাচীন প্রথা ছিল, সেটিই আজ বিবর্তিত রূপে বনবিবি। সুন্দরবন অঞ্চলে এর পাশাপাশি সম্ভবত বাঘে মানুষে একটি প্রাচীন সঙ্ঘাতের কাহিনী ছিল, অত্যাচারী বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বনদেবীর শরণাপন্ন হতেন প্রাচীন বাঙালি। সেই কাহিনীই পাল্টে দিয়ে বাঙালির আবহমান মাতৃকাকে বনবিবি নাম দিয়ে জহুরানামা তৈরি।
বনদেবী ছিলেন আদি থেকেই। তিনি বনবিবি হয়েছেন। এই পর্যন্ত আমরা মোটামুটি জানি, বনদুর্গা সম্পর্কে বা উত্তরবঙ্গে পূজিত রালদুর্গা সম্পর্কে আমরা অবগত।
যেটা অনেকেই জানেন না, তা হল অরণ্যকালী বা জঙ্গলকালীর কথা, যাঁর প্রকাশ ঘটে বনবিবির মধ্যে। কারণ এই বনবিবির একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রের শুরুতে তাঁকে মা কালীর সঙ্গে অভিন্ন বলা হয়েছে। বাংলায় মন্ত্রটি, যা স্বাভাবিক। কারণ সংস্কৃতায়ন ঘটেনি এই প্রাচীন মাতৃকা উপাসনার। এই পুজোর পুরোহিতরা অনেকেই বাউল নামে অভিহিত হন, এই উপাসনা সহজধর্মী তন্ত্রের অন্তর্গত সন্দেহ নেই।
“কালী কালী মহাকালী তুমি কালী দয়া
অধম বাল্লকে ডাকে দিও পদছায়া।”
এই মন্ত্রের পুরোটা শশাঙ্কশেখর দাসের বনবিবি গ্রন্থে উদ্ধৃত। আরো কয়েকটি মন্ত্র আছে, যেখানে ডাকিনী যোগিনী উল্লিখিত হয়েছেন, এই ডাকিনী যোগিনী মা কালীর গণ বা অনুচর হিসেবে গণ্য এবং মা কালীর দুই পার্শ্বে পূজিত হন কালীপুজোর সময় (যদিও আসলে এঁরা মা ছিন্নমস্তার মণ্ডল থেকে এসেছেন)।
বলা দরকার রাণী রাসমণি তাঁর সুন্দরবনের জমিদারিতে বনবিবি থান তৈরি করেন। বনবিবি নাম বলা হলেও এই মাতৃকা মূলত হিন্দুদের দ্বারাই পূজিত, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যেও তাঁর সমান জনপ্রিয়তা, এবং মাতৃকা উপসনার প্রবল ধারাকে culturally appropriate করতেই এই বনবিবি কেচ্ছা তৈরি।
কিন্তু ওপরের মন্ত্রটি সাক্ষ্য দেয়, এই দেবী কালীর সঙ্গে অভিন্ন। আমরা জানি দুর্গা অবশ্যই মা কালীর এক রূপ। জয়দুর্গা যেমন মা কালীর সঙ্গে অভিন্ন। দুর্গা ভদ্রকালী অভিন্নতার কথাও আমরা জানি। সেভাবেই, বনদুর্গা/বনদেবী/বনবিবি আসলে মা কালীরই প্রকাশ। বৃহৎ বঙ্গের বিভিন্ন জঙ্গলাকীর্ণস্থানে জংলা কালী পূজিত হন, সেই পর্যায়ে আসবেন সুন্দরবনের অধিষ্ঠাত্রীও। তিনি কালীর মত কালো নন কিন্তু কালী সর্বদা কৃষ্ণবর্ণা নন (কাছাড় অধিষ্ঠাত্রী মা কাঁচাকান্তি স্মর্তব্য)। তাঁর মুণ্ডমালা থাকে না, এদিক থেকে মূর্তিকল্পের সঙ্গে কালীর মিল নেই। কিন্তু মা কালীর একটি তত্ত্ব হল তিনি জগদকারণ, জগতের উৎস, সেই তত্ত্বের মূর্ত প্রকাশ রূপে তিনি আমাদের তন্ত্রের প্রাচীন উপাস্য মাতৃকা, হরপ্পা থেকে চন্দ্রকেতুগড় থেকে পালসেনযুগে সমান জনপ্রিয় সন্তানকোলে মাতৃকার প্রতীকে। সন্তানকোলে মা তারার মূর্তি এক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য। বনবিবিও সর্বদা সন্তানকোলে চিত্রিত হন। এই তো মাতৃধর্ম। সুন্দরবনের বাঙালি মায়ের কোলে, মায়ের পায়ে চিরকাল পরম আশ্রয় খুঁজে নিক। জয় মা কালী। জয় জয় মা।
ছবিটি ইউনাইটেড কিংডমের “টাওয়ার হ্যামলেট আর্টস” ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
© কালীক্ষেত্র আন্দোলন
কালীক্ষেত্র আন্দোলন ফেসবুক পেজ, এগারো মার্চ দুহাজার তেইশ