
ক্রোধ কালী।
পালযুগ এক মহা মন্থনের সময়। মা কালীর বর্তমান মূর্তিরূপের আদিতম সংস্করণ, অর্থাৎ মুণ্ডমালিনী শববাহনা লোলজিহ্বা সশস্ত্র মূর্তিরূপ এই পালযুগে নির্মিত হয়েছিল। এর আগে হরপ্পা সভ্যতা থেকেই মা কালী পূজিত ছিলেন কিন্তু বর্তমান মূর্তিরূপে নয়।
পালযুগে মা কালীর একটি নির্দিষ্ট রূপ দেখা যায়, যা অষ্টম থেকে দশম শতকের মধ্যে বাংলা থেকে তিব্বতে প্ৰচলিত হয় এবং জনপ্রিয় হয়, এঁরই নাম ক্রোধ কালী।
আমরা আজকে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমে, পালযুগের কালীতত্ত্ব আলোচনা করব। দ্বিতীয়ত, ক্রোধ কালীর মূর্তিতত্ত্ব আলোচনা করব।
★ বাঙালি বর্তমান পৃথিবীর শেষ মাতৃকা উপাসক মহাজাতি। মাতৃকা উপাসনায় আমাদের এই বাঙালি মহাজাতি সংজ্ঞায়িত হয়। তাই যখনই এই মহাজাতির পুনরুত্থান ঘটেছে, যুগে যুগে আমাদের মাতৃকারা নবরূপে পুনরুদ্ভাসিত হয়েছেন। অগ্নিযুগের মহামন্ত্র বন্দে মাতরম স্মর্তব্য।
★ এভাবেই পালযুগের বাঙালির উত্থান ঘটেছিল মাতৃকা উপাসনাকে আশ্রয় করে। গোপাল ছিলেন চুন্দা উপাসক। ধর্মপাল মা তারার উপাসনা করতেন, তাঁর রাজকীয় পতাকায় মা তারার চিত্র অঙ্কিত থাকত।
★ পালযুগের শেষার্ধে বজ্রযোগিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বজ্রযোগিনীর একটি নির্দিষ্ট রূপ নারোডাকিনী যিনি পালযুগের সহজ আন্দোলনে উত্থিত হন। আগে এঁর সম্পর্কে লিখেছি। মাতৃকা উপাসনার সর্বোচ্চ ঋজুপথ নির্মাণে এঁর বিপুল অবদান ছিল। কালীকুলের অনেকগুলি দার্শনিক তত্ত্ব এই বজ্রযোগিনী (যাঁর আজকের রূপ ছিন্নমস্তা) মণ্ডল থেকে এসেছে।
★ বজ্রযোগিনীর এক রূপ ক্রোধ কালী। আমরা এঁর তত্ত্ব ও মূর্তিরূপ সম্পর্কে আলোচনায় আসার আগে পালযুগের আর একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করব যা কালীতত্ত্বে অসীম তাৎপর্যপূর্ণ। কালচক্রযান। কাল ধারণা, মহাকালের উত্থান, এবং সবার উপরে কালের কলন করেন যে কালী, এই পালযুগের গভীর দার্শনিক তত্ত্ব। জগদকারণ কালী প্রাচীন কাল থেকেই আছেন, রাত্রি রূপে। তাঁর কালো রং, তাঁর কালী নাম, কারণ জগতের উৎসে কালো। এইবার পালযুগে এক মহা তরঙ্গ এলো, কাল সাধনা, যেখানে মহাকালী তত্ত্বে কালীর নাম মাহাত্ম্য এক বৈপ্লবিক আঙ্গিক পায়: সময় বা কালের নিয়ন্ত্রক।
★ পালযুগের চামুণ্ডা বা চর্চিকা তত্ত্বও কালীর বর্তমান তত্ত্বে মিশে আছে। নৈরাত্মা আছেন। পালযুগের তারাতত্ত্ব আছে। বজ্রবারাহী আছেন। বিস্তারিত আলোচনা তো সম্ভব নয় এক ফেসবুক পোস্টে, তার জন্য কয়েক খণ্ডে বই লিখতে হবে।
সব মিলিয়ে, পালযুগের তন্ত্রধর্মের মহামন্থনে কালীতত্ত্ব নির্মিত হচ্ছিল।
এইবার, পালযুগের সমস্ত কালীরূপের মধ্যে যা সম্ভবত সর্বপ্রাচীন, সেই ক্রোধকালী সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব।
★ গুরু পদ্মসম্ভব অষ্টম শতকে তিব্বতে ক্রোধ কালী তত্ত্ব নিয়ে এসেছিলেন উড্ডিয়ান তন্ত্রপীঠ থেকে যা সম্ভবত পূর্ববঙ্গে অবস্থিত ছিল, পরে যা বজ্রযোগিনী নামে পরিচিত হতে থাকে।
বজ্রযোগিনীর একটি নির্দিষ্ট রূপ ক্রোধকালী। ইনি Troma Nagmo নামে তিব্বতে পরিচিত হন, সংস্কৃতে এঁকে ক্রোধকালী বা ক্রোধেশ্বরী বা কৃষ্ণক্রোধিনীও বলা হয়।
আমাদের তন্ত্রে যেমন কুণ্ডলিনী সাধনা ও চক্রের ধারণা আছে, বৌদ্ধ তন্ত্রে ছিল তিনটি কায়া: ধর্ম, সম্ভোগ এবং নির্মাণ। দেহের নির্মাণকায়ায় অবস্থান করেন ক্রোধকালী। ইনি সর্বোচ্চ জ্ঞান, সর্বোচ্চ তত্ত্ব, এজন্য এঁকে ডাকিনীদের মধ্যে সবার আগে স্থান দেওয়া হয়েছিল।
★ ক্রোধকালীর মূর্তিরূপ। মায়ের বর্ণ ঘোর নীল। তাঁর মুখমণ্ডলের ডান দিকে একটি ক্ষুদ্র বারাহীমুখ দেখা যায়, যা বজ্রবারাহী মূর্তিরূপের মত। ডান হাতে কর্ত্রি, বাম হাতে রক্তপূর্ণ নরকপাল। মা বাম কনুই ও কাঁধ দ্বারা একটি খট্বাঙ্গ ধারণ করেন। মায়ের মস্তকে পাঁচটি নরকপাল নির্মিত মুকুট। মায়ের গলায় মুণ্ডমালা। বাম পদ তিনি নৃত্যরত অবস্থায় একটি শবের হৃদয়ে স্থাপন করেন। ক্রোধকালী একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কেন্দ্রে অধিষ্ঠান করেন।
পালযুগের এই ক্রোধকালী মূর্তিরূপ নিঃসন্দেহে আবহমান কালীতত্ত্বের এক অত্যুচ্চ দার্শনিক প্রকাশ।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় মা কালী। জয় জয় মা।
মায়ের ছবি পিন্টারেস্ট থেকে। তিব্বতে এখনও পূজিত ক্রোধকালীর কিছু চিত্র কমেন্টে রইল।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, নয় মার্চ দুহাজার তেইশ
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, নয় মার্চ দুহাজার তেইশ
সংযোজন
ক্রোধকালী বা Troma Nagmo (Laura Santi sacred art থেকে


ক্রোধকালী বা Troma Nagmo (dharmatreasures dot com থেকে)