আশ্চর্য একুশে – তমাল দাশগুপ্ত

আশ্চর্য একুশে।

বাংলা নাটকের অবিস্মরণীয় শিল্পী উৎপল দত্ত বাংলা বাণিজ্যিক ছবির একজন জনপ্রিয় চরিত্রাভিনেতাও ছিলেন। তিনি একবার অভিযোগ করেছিলেন, পুরো সিনেমা জুড়ে যে খল, আচমকা লাস্ট সিনে এসে, কি আশ্চর্য, সে ভালো হয়ে যাচ্ছে, স্রেফ একটি কাঁচা চিত্রনাট্যের হ্যাপি এন্ডিং হবে বলে। উৎপল নিজে এরকম চরিত্রে অনেক বাংলা চলচ্চিত্রেই অভিনয় করেছেন, এবং বিষয়টা নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। তবে এটা উৎপল দত্তকে নিয়ে পোস্ট নয়।

বখতিয়ার থেকে শুরু করে অন্ধকার মধ্যযুগ জুড়ে সমস্ত বিজাতীয় আগ্রাসন, ইংরেজ আসার পর তিতুমীরের ওয়াহাবি ও দুদুমিয়ার ফরাজী থেকে শুরু করে বিংশ শতকে ঢাকায় মুসলিম লীগ স্থাপনা, বিংশ শতকের প্রথম চার দশক জুড়ে অনবরত বিক্ষিপ্ত হিংসা চালিয়ে হাত পাকিয়ে তারপর ছেচল্লিশ সালে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং ঐ বছরেই নোয়াখালির অসামান্য রক্তাক্ত ইতিহাস, এর পরে পঞ্চাশ সালে পূর্ববঙ্গ জুড়ে বিশেষ করে বরিশালের সেই বিখ্যাত গণহত্যা – এসবের পরে আচমকা সেকুলার চেতনা নিয়ে বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হলেন ওঁরা।

কি আশ্চর্য। বাংলাভাষী মুসলমানরা সবাই বাহান্ন সালে এসে অসাম্প্রদায়িক ভাষা আন্দোলন করে ফেললেন। তাঁরা একুশে ফেব্রুয়ারির অমর মিথের জন্ম দিলেন। যে মুজিব ছেচল্লিশ সালে ছিলেন কলকাতায় লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ঝাণ্ডাধারী, ছিলেন কশাই সুহরাওয়ার্দীর অনুগামী, তিনিই বাহান্ন সালে এসে অসাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছেন। কিভাবে এই আশ্চর্য ঘটনা সম্ভব হল?

আসলে এই দিনটি শুধু কাঁচা চিত্রনাট্য নয়, একটি মিথ্যাচারও বটে। পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমান আরব্য রজনীর সিন্দবাদের বুড়োর মত প্রথমে উর্দুভাষী মুসলমানের ঘাড়ে চেপে ভারত ভেঙে পাকিস্তান এবং তারপর বাংলাভাষী হিন্দুর ঘাড়ে চেপে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করেছেন। বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলন সিন্দবাদের বুড়োটির এক ঘাড় থেকে অন্য ঘাড়ে মাইগ্রেশন হিসেবে গণ্য হবে।

তবুও তো বাঙালির দেশ? তবুও তো বাংলাভাষা ওই দেশে গৌরবের স্থানে?

ভাষাটা আরবি ফার্সি অনুপ্রবেশ করে বিকৃত হয়ে গেছে, সংবিধান শুরু হয় বিসমিল্লাহ বলে, বাংলাভাষী হিন্দুরা সেই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। অনবরত এথনিক ক্লিনজিং এর ফলে সাতচল্লিশ সালে পূর্ববঙ্গে যে পঁয়ত্রিশ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা ছিল, আজ সম্ভবত পাঁচ কিংবা ছয় শতাংশ। নিয়মিত হিন্দুর জমি লুট হয় ওই দেশে, নিয়ম করে হিন্দুর ধর্মস্থানে আঘাত নামে, হিন্দুর মেয়েরা গনিমতের মাল হিসেবে গণ্য হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা নারকীয় পরিস্থিতিতে বেঁচে আছেন।

কিন্তু কি আশ্চর্য, তাও বছর বছর একটা অসাম্প্রদায়িক একুশে ফেব্রুয়ারি দিবস চলে আসে, আর এদের ঢপের চিত্রনাট্যের হ্যাপি এন্ডিং হয়ে যায়। এরপর অলীক সেকুলার প্রেক্ষাগৃহে আলো জ্বলে ওঠে, আর পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবাদীরা জয় বাংলা বলে আনন্দাশ্রু ফেলতে থাকে।

এই আশ্চর্য একুশে ফেব্রুয়ারির শুভেচ্ছা।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

উৎপল দত্তের ছবিটি টাইমস অভ ইন্ডিয়া সাইট থেকে।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পোস্ট, একুশ ফেব্রুয়ারি দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s