শক্তিপীঠ – তমাল দাশগুপ্ত

শক্তিপীঠ।

১. শক্তিপীঠধারণা অত্যন্ত প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহাভারতে বনপর্বে তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে তিনটি শক্তিপীঠ উল্লিখিত, এর মধ্যে দুটি ছিল জগন্মাতার যোনিকুণ্ড: একটি পঞ্চনদের বাইরে ভীমাস্থানে এবং অন্যটি উদ্যতপর্বত নামক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ছিল। এছাড়া একটি স্তনকুণ্ড ছিল, গৌরীশিখর নামক পাহাড়চূড়ায়।

এই ভীমাস্থান মহাভারত রচনার এক হাজার বছর পরেও সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং দেখে গেছেন এবং লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ভীমা দেবীর গাঢ় নীল প্রস্তর মূর্তি দেখেছিলেন তিনি।

বোঝা যায়, উপমহাদেশের তন্ত্রনির্ভর মাতৃকা উপাসনায় শক্তিপীঠের ধারণা আবহমান: প্রাচীন যুগ থেকেই ছিল, এবং অনেক হাজার বছর ধরে একটানাভাবে আছে।

২. কিন্তু বিষ্ণুচক্র কর্তৃক সতীর দেহ খণ্ড বিখণ্ড করে শিবের তাণ্ডব থামানোর কাহিনীটি একেবারেই প্রাচীন নয়, সেটি প্রথম পাওয়া যায় দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে সেনযুগে রচিত বৃহদ্ধর্ম পুরাণে। এই কাহিনী অন্যত্র নেই। বেশিরভাগ পুরাণে সতী দক্ষযজ্ঞে তনুত্যাগ করেন, অথবা অগ্নিপ্রবেশ করেন, এবং তাঁর পুনর্জন্ম ঘটে পার্বতী রূপে। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু তাঁর দেহকে বিষ্ণুচক্র কর্তৃক খণ্ড বিখণ্ড করা পরবর্তী যুগের পৌরাণিক কল্পনা।

৩. খণ্ড সমাধি (ফ্র্যাগমেন্ট বেরিয়াল) উপমহাদেশের প্রাচীন তান্ত্রিক প্রথা। পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতায় খণ্ড সমাধি দেখা গেছে। চার হাজার বছর আগে পাণ্ডু রাজার ঢিবি, যা ছিল মাতৃকা উপাসক, এবং পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন প্রত্ন সভ্যতা, সেখানেও খণ্ড সমাধি দেখা গেছে। এই ধারাতেই কোনও পূজ্য আদি মাতার দেহখণ্ড উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রোথিত করা হয়ে থাকবে।

তিব্বতের তন্ত্র ধর্মে এখনও খণ্ড সমাধি দেখা যায়। গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে যখন রক্ষিত হয়েছিল, তা অবশ্যই এই তন্ত্রধর্মের প্রথার অনুসরণ ছিল।

৪. শক্তিপীঠ কিন্তু কেবল খণ্ড সমাধির স্মৃতিবাহী নয়। সবথেকে প্রাচীন, যেমন মহাভারতের শক্তিপীঠ উল্লেখ খণ্ড সমাধিরই প্রথা, সেটা বোঝা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বিভিন্ন স্থানেশ্বরী অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তীর্থস্থান শক্তিপীঠের আখ্যা পেয়েছিল। ইতিহাসবিদ নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেছেন যে আঞ্চলিক মাতৃকাদের উপাসনা এক বিশ্বজনীন মাতৃধর্মে সুসংহত করার পদ্ধতি হিসেবে শক্তিপীঠ তত্ত্বের উত্থান ঘটেছিল।

৫. এই প্রসঙ্গে শক্তিপীঠ তত্ত্বের পেছনে উপমহাদেশের আরেকটি তন্ত্রধর্মীয় প্রথাও স্মর্তব্য: একাধিক মাতৃকার উপস্থিতি, যেমন হরপ্পা সভ্যতা থেকে পূজিত সপ্ত মাতৃকা, যেমন পৌরাণিক কাহিনীর কৃত্তিকা। মহাভারতে শল্য পর্বে ষটচত্বারিংশ অধ্যায়ে মাতৃকাগণের নামের একটি তালিকা আছে: বিশালাক্ষী, ভদ্রকালী, কালিকা, চতুষ্পথরতা, চতুষ্পথনিকেতা – এরকম অনেক নাম সেখানে পাওয়া যায়। নাম দেখে বোঝা যায় এঁরা অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত প্রাচীন পথের স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারসেকশনে পূজিত হতেন, কারণ দেবী নগরেশ্বরী অধিষ্ঠাত্রী হন। আজও আমরা দেখি মাতৃমন্দির স্থাপনার স্থানগুলি ব্যস্ত নাগরিক পথের নিকটে হয়, যদিও নির্জন সাধনস্থানেও মাতৃমন্দির স্থাপনার প্রথা আছে (বিজাতীয় আগ্রাসনের অন্ধকার নেমে এলে নির্জন স্থানে মাতৃমন্দির স্থাপনের কিছু কৌশলগত প্রয়োজন বৃদ্ধি হয়ে থাকবে)।

যোগিনীর সংখ্যা চৌষট্টি, এই প্রসঙ্গে অগ্নিপুরাণের বক্তব্য বেশ চিত্তাকর্ষক। মাতৃকা আট জন, এবং প্রত্যেকের আট রকম প্রকাশ, তাই পূজিত মাতৃকার সংখ্যাটা চৌষট্টি, অগ্নি পুরাণে বলা হয়েছে।

৬. বৃহদ্ধর্ম পুরাণে প্রদত্ত একান্ন শক্তিপীঠের সংখ্যা কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে দেওয়া তালিকার সঙ্গে মেলে না। কিন্তু বলা দরকার এই একান্ন শক্তিপীঠের বেশিরভাগ বাংলায় অবস্থিত। সবথেকে বিখ্যাত শক্তিপীঠ অবশ্যই কলকাতা, যা কালীক্ষেত্র, যেখানে কালীঘাট অবস্থিত, যেখানে দেবীর ডান পায়ের আঙুল আছে।

৭. দেবী ভাগবত পুরাণে ভারত জুড়ে শক্তিপীঠ এবং সেখানে পূজিত শক্তিপীঠেশ্বরীর তালিকা আছে, সেখানে বৃন্দাবন শক্তিপীঠে পূজিত শ্রীরাধার উল্লেখ আছে!

সবশেষে বলা দরকার, তন্ত্রধর্মের রাষ্ট্রধারণা, ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় আমাদের জগন্মাতা আছেন। দেবী বলেছেন অহং রাষ্ট্রী। এই শক্তিপীঠগুলি আমাদের শক্তিকেন্দ্র, আমাদের জাতির রাষ্ট্রবিন্দু। বীরভূমে লাভপুরে দেবী ফুল্লরা, নলহাটিতে দেবী নলাটেশ্বরী, মুর্শিদাবাদে দেবী কিরিটেশ্বরী সহ অনেকগুলি শক্তিপীঠ আছে পশ্চিমবঙ্গে। আমাদের ভূমি শাক্তভূমি, আমরা জয় মা ধ্বনি দিয়ে নিজেদের বাঙালি জন্ম সার্থক করি।

জয় মা কালী। জয় জয় মা।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

মায়ের ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, ষোল ফেব্রুয়ারি দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s