
মা মহিষমর্দিনী।
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহাভারতে দুর্গাস্তবে মা দুর্গাকে মহিষসৃকপ্রিয়ে সম্বোধন করা হয়েছে অর্থাৎ মহিষের রক্ত যাঁর প্রিয়।
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে সারা ভারতে (বাংলাসহ) একটানাভাবে অনেক মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে যেখানে মা স্বয়ং স্বহস্তে মহিষটিকে মর্দন করে মেধ করছেন। সর্বপ্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তিতে এই দুটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত:
★ মহিষাসুর নেই। মহিষাসুর সর্বপ্রথম ষষ্ঠ শতকে রচিত দেবী মাহাত্ম্য (শ্রী শ্রী চণ্ডী) গ্রন্থে দেখা যায়। মহিষাসুর চরিত্রের প্রথম পাথুরে নির্মাণ দেখা যায় সপ্তম শতকে মহাবলীপুরমে। তার আগে পর্যন্ত সমস্ত মূর্তিতেই মা মহিষমর্দিনী। বলির মহিষটি অসুরে রূপান্তরিত হয়েছে অনেক পরে।
★ সবথেকে প্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তিতে মায়ের বাহন সিংহ সাধারণত নেই। সিংহবাহিনী ভারতে প্রথমবার পূজিত হতে থাকেন কুষাণ যুগে, তার আগে সেভাবে দেখা যায় না। মহিষমর্দিনী মূর্তির যে ধ্যান আছে তন্ত্রসারে, সেখানে সিংহ নেই। তন্ত্রসারে প্রদত্ত জয়দুর্গা ধ্যানমন্ত্রে সিংহ উল্লিখিত, কিন্তু তার আগেই দেওয়া মহিষমর্দিনী ধ্যানমন্ত্রে সিংহর উল্লেখ নেই।
তবে প্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তিতে কুষাণ যুগ থেকে (মোটামুটি দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক) সিংহের উপস্থিতি দেখা যেতে থাকে। এই পোস্টের সঙ্গে যে প্রাচীন মহিষমর্দিনী মাতৃমূর্তিটি আছে, সেখানে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে দেবীর দুই পদতলে দুটি সিংহর আভাস দেখা যাচ্ছে।
এবার আমরা তন্ত্রসারে উল্লিখিত মহিষমর্দিনী ধ্যানমন্ত্র সম্পর্কে জানব।
মহিষমর্দিনী স্বাহা – এই অষ্টাক্ষর মন্ত্রে মা মহিষমর্দিনী পূজিত হন, তবে এই অষ্টাক্ষর মন্ত্রের আগে ওঁ, হ্রীঁ, ক্লীঁ, ঐঁ, স্ত্রীঁ, হূঁ – এই বীজগুলির কোনও একটি যুক্ত করে যে নবাক্ষর মন্ত্র হবে, তাতে মহিষমর্দিনীর আরাধনা করা যায়। “ওঁ ক্লীঁ মহিষমর্দিনী স্বাহা” এই দশাক্ষর মন্ত্র ত্রিভুবনের ঈশ্বর স্বরূপ এবং মহিষমর্দিনী উপাসনার জন্য প্রশস্ত।
তন্ত্রসারের ধ্যানমন্ত্রে মা মহিষমর্দিনী অষ্টভুজা। তাঁর দেহকান্তি পদ্মের মত। মণিময়কুণ্ডলশোভিত। দেবী ত্রিনয়না। তাঁর হাতে শঙ্খ চক্র খড়্গ খেটক বাণ ধনু শূল তর্জনীমুদ্রা আছে। কপালে অর্ধচন্দ্র।
তন্ত্রসারে আরও বলা হয়েছে যে এই দেবী কালীর সমতুল্য, কালীর মত তাঁকে পূজা করতে হয় এবং মহিষমর্দিনী উপাসনা কালীপূজার সমান ফলপ্রদ।
আমরা জানি, দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজোয় বলি গ্রহণ করেন কালী স্বয়ং (চামুণ্ডা কালীর উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়)।
শান্তিপুরে মা মহিষখাগী কালীর একটি প্রাচীন পুজো চালু আছে আমরা জানি।
অতএব মা মহিষমর্দিনী হলেন বলিপ্রিয়া রুধিরপ্রিয়া মা কালীরই এক সুপ্রাচীন রূপ।
আগেও অনেকবার লিখেছি, আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে তন্ত্রাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতার মাতৃধর্মে মহিষমেধ হত, এই মহিষমেধ বিষয়ে সন্দেহাতীত প্রত্নপ্রমাণ পাওয়া গেছে এবং ইতিহাসবিদরাও একমত। কাজেই মা মহিষমর্দিনীর পূজায় অনেক সহস্র বছরের তন্ত্রধর্মের স্মৃতি মিশে আছে।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ছবিতে দেখছেন অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী, অতীব প্রাচীন মূর্তি, সময়কাল আনুমানিক দ্বিতীয় খ্রিষ্টীয় শতক। তার পাশে দেখছেন বর্তমানে শান্তিপুরের মা মহিষখাগী কালীর শোভাযাত্রা।
জয় মা মহিষমর্দিনী। জয় জয় মা।
সংযোজন
১. সুপ্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তি, আনুমানিক ২০০০ বছর পুরোনো

২. সুপ্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তি, আনুমানিক ২০০০ বছর পুরোনো

৩. সুপ্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তি, আনুমানিক ২০০০ বছর পুরোনো

৪. সুপ্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তি, আনুমানিক ২০০০ বছর পুরোনো

৫. দ্বাদশ শতকের মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী, কিন্তু মা কালীর মত জিহ্বা প্রসারিত। অস্ট্রেলিয়ার একটি মিউজিয়াম।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, আট ফেব্রুয়ারি দুহাজার তেইশ