বামাকালীর বামাচারে উপাসনা এবং সূক্ষ্ম পঞ্চ ম-কার, যা সহজসাধ্য – তমাল দাশগুপ্ত

বামাকালীর বামাচারে উপাসনা এবং পঞ্চ ম-কার ব্যাখ্যা: খুব সহজে সূক্ষ্ম বামাচারে যে কেউ পুজো করতে পারেন। শেষ অবধি পড়ুন।

বামাচার সম্পর্কে বিভ্রান্তি কাটাতে এই পোস্টটি করছি। বামাচার তন্ত্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ মার্গ, বামাকালীর উপাসনা (বামাকালী ধ্যানমন্ত্র জানতে আমার পেজে স্ক্রোল ডাউন করুন, কিছুদিন আগেই দিয়েছি) এই বামাচারী মতে ঘটে যেখানে পঞ্চ ম-কার ব্যবহার করা হয়। তন্ত্র যে বেদবাহ্য বলে খ্যাত সে অনেকটাই বামাচারী পঞ্চ ম-কারের জন্য। ইতিহাসে জানা যায় আদি শঙ্করাচার্য কাঞ্চীর মন্দিরে বামাচারী পুরোহিতকে বহিষ্কার করে একজন স্মার্ত ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করেন।

বামাচারী মতের পঞ্চ ম-কারের একটি নির্দিষ্ট রূপই তারাপীঠে বশিষ্ঠদেবের কাছে চীনাচার বলে প্রতিভাত হয়েছিল কারণ সেই যুগে আদি বামাচার সম্ভবত ভারতে এবং বাংলায় প্রবল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য সনাতনী বিরোধিতার কারণে বিলুপ্তপ্রায়, যদিও তিব্বতে তা সুপ্রচলিত। তন্ত্র পূর্ব ভারত/গৌড়বঙ্গ থেকেই তিব্বতে গেছিল, সেটা তিব্বতের ইতিহাসবিদরা সবাই বলেন। বাঙালিরা যুগে যুগে তিব্বতে গিয়ে তন্ত্র প্রচার করেন। তারাপীঠে কিংবদন্তীর বশিষ্ঠ সম্ভবত মধ্যযুগের একজন সাধক যাঁর সময় বাংলায় বামাচারী সাধনা চীনাচার নামে পুনরায় ফিরে এসেছিল। ইতিহাসে যুগে যুগে এমন প্রায়ই ঘটে। আপনারা কেউ কেউ জানেন, আমি এখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্ত্র কোর্স অনুশীলন করছি, বাংলায় অনুরূপ তন্ত্র কোর্স চালু করার লক্ষ্যে। সঙ্গে থাকুন।

★★★

বামাচার সম্পর্কে প্রথমেই বলা দরকার, একাধিক উপচার সহযোগে পূজার প্রক্রিয়া উপমহাদেশে তন্ত্রধর্মে সুপ্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা থেকেই প্ৰচলিত আছে বলে বোঝা যায়। পঞ্চ ম-কার আসলে পাঁচ উপচার, পাঁচ অঙ্গ বিশিষ্ট মাতৃকা উপাসনা, এবং জগন্মাতার আবাহন করতে পাঁচটি রিচুয়াল বা আচার হিসেবেই এর তাৎপর্য।

মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন – এই পাঁচটি হল পঞ্চ ম-কার। নামগুলোর স্থূল অর্থ স্পষ্ট, কাউকে বোঝাতে হবে না। আমরা সূক্ষ্ম অর্থে যাব, সেই অর্থও সমান প্রাসঙ্গিক, তবে তার আগে এই বামাচারী সাধনমার্গের তাৎপর্য আলোচনা করব।

◆■■◆ প্রথম তাৎপর্য: তন্ত্র হল ভুক্তি এবং মুক্তির সামঞ্জস্য বিধান। তন্ত্রে পবিত্র এবং অপবিত্রর বিভাজন থাকে না, উচ্চ নিচ বিভাজন নেই, দেহ এবং চৈতন্য তন্ত্রে পৃথক নয়। তন্ত্র হল বস্তু এবং ভাবের সমন্বয়। কাজেই সমদৃষ্টি অবলম্বনের জন্য তন্ত্রে কতগুলি অনুশীলন আছে। বামাচার হল এমন একটি অনুশীলন। গূঢ়তম ভাব, নিরেট বস্তু। নির্বাণ এবং ভোগ। মোক্ষমার্গ, প্রবৃত্তি। উপভোগ, আনন্দ যেখানে সাধনার অঙ্গ।

তন্ত্র কষ্টসাধ্য ক্লেশময় সাধনার পক্ষপাতী নয়,সেটা বোঝাতেও পঞ্চ ম-কার।

◆■■◆ দ্বিতীয় তাৎপর্য: তন্ত্রমার্গ সংসারত্যাগী নয়, সংসারে নিবৃত্তি শেখায় না। নির্বাণপ্রয়াসী বা ব্রহ্ম-অন্বেষণকারী যথাক্রমে বৌদ্ধ বা ঔপনিষদিক ধর্মকে পরিত্যাগ করার আহ্বান জানানোর কারণেও তন্ত্রে পঞ্চ ম কার। উঁচু নিচ বিভেদ, ব্রাহ্মণ শূদ্র বিভেদ, পবিত্র অপবিত্র বিভেদ, বস্তু ভাব বিভেদ, দেহ আত্মা বিভেদ, নারী পুরুষ বিভেদ এবং সর্ব প্রকার বৈষম্য পরিত্যাগ করার আহ্বান জানায় তন্ত্র। এজন্যও পঞ্চ ম-কার। বর্ণবাদ এবং শুচিবাই নিয়ে সাধনা হয় না, শীল হয় না, এজন্য পঞ্চ ম-কার একটা সুতীব্র শক থেরাপি।

◆■■◆ তৃতীয় তাৎপর্য: বামাচার শব্দের দুটি প্রধান অর্থ। বাম অর্থাৎ বাঁদিকের পথ। দ্বিতীয়ত বামা হল আমাদের জগন্মাতা মা কালীর অন্যতম শাস্ত্রীয় নাম, এই নামটি মা তারার উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হয়। অতএব বামাচার হল কালীপথ বা তারাপথ।

কিন্তু বাঁদিক কেন? বাম শব্দের একটি অর্থ হল বিপরীত। যেমন বিধি বাম মানে বিপরীত বিধি। এই অর্থে বাম মার্গ নেগেটিভ অর্থ, কারণ বিপরীত পথ। কিন্তু বিষে বিষে বিষক্ষয় হয়, তাই বামাচার দুই নেগেটিভ মিলে পজিটিভ তৈরির আদর্শ।

বাম অর্থ বিভ্রান্তিও হয়। এক্ষেত্রে বামাকালীর অন্যতম তাৎপর্য হল যিনি বিভ্রান্তি দূর করে দেন। যেমন দক্ষিণাকালীর তাৎপর্য: যাঁর ভয়ে দক্ষিণদিকের অধিপতি যম পালিয়ে যান।

আবার সাংখ্যর সঙ্গে তন্ত্রের প্রাচীন যোগাযোগ আছে। সংখ্যা গণনা আদিযুগে বামদিকে হত: অঙ্কস্য বামা গতি। যেহেতু তন্ত্রর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল সংখ্যাবিজ্ঞান, সেজন্যও বাম মার্গ নাম হতে পারে।

◆■■◆ চতুর্থ তাৎপর্য: মা কালীর বামাচার আদি প্রস্তর যুগ থেকে, ঠিকঠাক বললে চল্লিশ হাজার বছর আগে যখন থেকে প্রথম মাতৃকা মূর্তি পাওয়া যায়, তখন থেকে প্ৰচলিত আদিম মাতৃসাধনার সুবিশাল আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য বহন করে। অনেক আদিম জাতি মাতৃকা উপাসনা করত, মাতৃধর্মের উৎসব হত। এবং যেহেতু মদ্য ও মাংস পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় আদিমকালে উৎসবে ব্যবহার করা হত, তাই অনেক গবেষক মনে করেন যে বামাচার সেই আদিম স্মৃতিবাহী।

মনে রাখতে হবে, স্থূলভাবে এই পাঁচটি ম আনন্দ, সম্পদ এবং প্রাণসৃষ্টির কারণ। মা আদ্যা। তিনি আদি থেকে আছেন। আমরা সুসভ্য একুশ শতকের মানুষ যেমন তাঁর সন্তান, আদিম মানুষও আদিম উপায়ে তাঁর উপাসনার সমান অধিকারী ছিল।

◆■■◆ পঞ্চম তাৎপর্য: অর্থাৎ স্থূল অর্থে বামাচারের প্রয়োগ তন্ত্রের বাইরে নয়, সম্পূর্ণভাবে তন্ত্র অনুমোদিত। কিন্তু সূক্ষ্ম অর্থে বামাচারের প্রয়োগ বর্তমান সভ্য সমাজে, গৃহী ব্যক্তি অনেক সহজে করতে পারেন। মা আদ্যা এবং নিত্যা। কিন্তু আমরা তাঁর সীমাবদ্ধ সন্তান, আমরা প্রাচীন প্রস্তরযুগের মত অথবা আদিম মাতৃকা উপাসক জাতিগুলোর মত অবাধ নই, কারণ সভ্যতা অগ্রসর হলে আমাদের কিছু কিছু নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়।

আসুন, বামাচারের পঞ্চ ম-কারের সূক্ষ্ম তাৎপর্য জানি এবার।

★★★★★ প্রথম ম-কার: সূক্ষ্ম অর্থে বামাচারে মদ্য হল সাধক যখন অতিশয় আনন্দে থাকেন, অথবা খেচরী মুদ্রা অভ্যাস করেন, তখন মুখের মধ্যে নিঃসৃত লালা। সুস্থ মানুষের মুখের মধ্যে লালা নিঃসৃত হয়েই থাকে, মুখ শুকিয়ে গেলেই সেটা চিন্তার, ডাক্তার দেখাতে হয় অনেকসময়। কাজেই এইভাবে প্রথম ম-কারে মায়ের আবাহনে কঠিন কিছু নেই।

লালা কেন মদ্যের প্রতীক? অতিশিশু এবং অতিবৃদ্ধরা বেসামাল থাকেন, লালা সামলাতে পারেন না। মানুষ বিবশ হলে লালাক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মদ্য অনুরূপভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীনতা বা অবশতার প্রতীক। সেজন্য লালা হল সূক্ষ্ম মদ্য।

★★★★★দ্বিতীয় ম-কার: মাংস হল জিহ্বা থেকে উদ্গাত মাতৃমন্ত্র।

জিহ্বা তো মাংসল অঙ্গ বটেই, সচেতন মাংস। জিহ্বা সেই মাংস যা মন্ত্রপূত, মন্ত্রপ্রবিষ্ট, মন্ত্রের উচ্চারক। মায়ের মন্ত্র উচ্চারণ তো সবাই করেন পূজার সময়, কাজেই দ্বিতীয় ম-কারে কঠিন কিছুই নেই।

★★★★★ তৃতীয় ম-কার: মৎস্য হল চক্ষু। চর্মচক্ষু বা মানসচক্ষু দিয়ে মায়ের মূর্তি দর্শন বা ধ্যান করাই মৎস্য উপচারে মায়ের পুজো। এটাও আমরা করে থাকি অবলীলায়।

মাছকে চক্ষুর সঙ্গে তুলনা করা হয় প্রাচীন কাল থেকেই। মীনাক্ষী হল মহাদেবীর অন্যতম নাম। মাছের মতোই আমাদের চক্ষু যেন চঞ্চলভাবে সাঁতার কাটে, ডুবে যায়, ভেসে ওঠে, বিহার করে, কামনার বড়শিতে আটকে যায়, আবার কখনও কখনও পরিযান করে এক জলরাশি থেকে আরেক জলরাশিতে। তা আপনার চোখ মৎস্য এখন কি করছে পাঠক?

★★★★★ চতুর্থ ম-কার: মুদ্রা হল আমাদের শরীরের নানা রকম অঙ্গভঙ্গি এবং অবশ্যই যোগমুদ্রা। আপনি মাকে নমস্কার করলে দুহাত জড়ো করে যা করছেন, তাও মুদ্রা। মায়ের সামনে পদ্মাসনে উপবিষ্ট হয়ে পুজো করছেন, সেটা মুদ্রা। অষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেও মুদ্রা। হরপ্পা সভ্যতায় নানারকম যোগমুদ্রা প্ৰচলিত ছিল, প্রত্ন প্রমাণ আছে।

★★★★★ পঞ্চম ম-কার: মৈথুন হল কুণ্ডলিনী সাধনা। কুণ্ডলিনী তত্ত্ব তন্ত্রের অন্যতম কেন্দ্রীয় তত্ত্ব। এবং দেহে মূলাধার চক্র থেকে সহস্রার চক্র পর্যন্ত কুণ্ডলিনী গমন করলে সেখানে কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে চেতনা/পুরুষতত্ত্ব/কনশাসনেসের মৈথুন ঘটে।

শেষ করি এই বলে। পঞ্চ ম-কার তন্ত্রের বলিষ্ঠ বস্তুনিষ্ঠতার প্রতীক। স্থূল হোক বা সূক্ষ্ম, পঞ্চ ম-কার আমাদের বস্তুজগৎ থেকে উৎপন্ন, সংশ্লিষ্ট, সম্পৃক্ত ভাব। মা জগদকারণ। তিনিই বিশ্বচরাচর। তাই জীব ও জড়, ভাব ও বস্তু, দেহ এবং চেতনা আলাদা নয়। পঞ্চ ম-কার সেই শিক্ষা দেয়।

মা রূপে সেই অব্যক্ত প্রকৃতির ধ্যান করি, আবাহন করি, সেজন্যও আরাধনায় ম অক্ষরের এত প্রাবল্য।

★★■★★ এবং সবথেকে বড় কথাটা সব শেষে বলি। ওই সূক্ষ্ম পঞ্চ ম-কার সম্পর্কে সবথেকে আশ্চর্য বিষয় কি জানেন? মায়ের পুজো তো আসলে নিজের দেহে করতে হয়। মা আমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত আছেন। স্থূল পঞ্চ ম-কার বাহ্যিক। কিন্তু সূক্ষ্ম পঞ্চ ম-কার আসলে আমাদের দেহকে ব্যবহার করেই মায়ের পুজো। সেজন্য পঞ্চ ম-কারের এই সূক্ষ্ম অর্থে লালা (মদ্য), জিভ (মাংস) চোখ (মৎস্য), সমগ্র শরীর (মুদ্রা) এবং কুণ্ডলিনী (মৈথুন) সহযোগে মাতৃকার ধ্যান আসলে আমাদের দেহ মন্দিরেই মায়ের পুজো। এবং মায়ের ভক্ত মাত্রেই অনায়াসে এই পুজোর অধিকারী। এই যে একটা ধারণা আছে যে বামাচার হল দুরূহ, কেবলমাত্র গুহ্য, কেবলমাত্র সংসারত্যাগী, কেবলমাত্র তান্ত্রিকদের – এটা ঠিক নয়। স্থূল বামাচার অসামাজিক হতে পারে, কিন্তু সূক্ষ্ম বামাচার সকলের জন্যই সহজ ও ঋজুপথে মাতৃসাধনা সুগম করে। তাই মায়ের সন্তান মাত্রেই বামাচারে মা বামাকালীর পুজো করতে পারেন। বরং সূক্ষ্ম বামাচার, সূক্ষ্ম পঞ্চ ম-কারেই মায়ের পুজো অনেক বেশি তদ্গত ও তন্নিষ্ঠ হয়, কারণ এক্ষেত্রে দেহমন্দিরেই মায়ের ঐশ্বর্যের আবাহন ও উদযাপন হয়, বাহ্যিক আড়ম্বর ছাড়া।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

জয় মা বামাকালী। জয় জয় মা।

মায়ের ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।

তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, আঠের জানুয়ারি দুহাজার তেইশ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s