
ডাকাত কালী।
মধ্যযুগে ডাক ছিল সরকারি রাজস্ব এবং তথ্য পরিবহন ব্যবস্থা, সেই সঙ্গে চিঠিপত্রও পাঠানো যেত।
এই ডাক ব্যবস্থায় হানা দিয়ে যিনি সুলতান বাদশা নবাবের রাজস্ব লুট করে নিতেন, তিনিই ডাকাত। মধ্যযুগে বাংলার হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই ডাকাত, যে কারণে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের ইংরেজরা টেরোরিস্ট বলত। অর্থাৎ ডাকাতরা ইসলামিক শাসকের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন।
বাংলায় আরেকটি কথা আছে ডাকাবুকো। ডাকাতের মত সাহস যার বুকে। ডাকাতরা বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে বিভিন্ন যুগে জনপ্রিয় হয়েছেন, বিশেষ করে বিজাতীয় বা অত্যাচারী শাসক হলে জনতার প্রতিরোধ অনেক সময়েই ডাকাতদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, ইংল্যান্ডে যেমন কিংবদন্তীর রবিনহুড। ইউরোপের ইতিহাসে এমন সব জনপ্রিয় ডাকাত অনেক এসেছেন। জনতার প্রতিরোধের নায়ক এমন সব ডাকাতদের নিয়ে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এরিক হব্সবম এর একটি বই আছে, ব্যান্ডিটস।
★★★
বাংলার ডাকাতরা অনেকেই বিখ্যাত এবং প্রায় সবাই মাতৃকা উপাসক। এঁরা ডাকাতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্য কোনও পথ তাঁদের সামনে ছিল না।
বিশৃঙ্খলা, মাৎস্যন্যায়, অরাজকতা ছিল মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শাসকরা বস্তুত বহিরাগত হানাদার ছিলেন। তাঁদের হানাদারির অপশাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মধ্যযুগের বাংলায় ডাকাতদের উত্থান। অনেকটা নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মত। বস্তুত বখতিয়ার নিজেই একজন ডাকাত ছিল, লুটপাট করত।
আদিযুগের ইতিহাসে ডাকাত দেখা যায় না সেভাবে। মধ্যযুগে যে দেখা যায়, এর প্রধান কারণ প্রতিক্রিয়া। মধ্যযুগে বিশেষ করে সুলতানি আমলে শাসক নিজেই ডাকাত। স্বভাবত শাসকের বিরোধিতা করতে গিয়ে শাসক যে ভাষা বোঝে সেই ভাষাতেই বোঝাতে হত।
★★★
মধ্যযুগে বারেন্দ্র ভূমে ডাকাত বেণী রায় বিখ্যাত ছিলেন। তিনি নিজেই মধ্যযুগে ইসলামিক শাসকদের অত্যাচারের শিকার হয়ে প্রত্যাঘাত করতে ডাকাতির পথ ধরেন। তিনি তাঁর উপাস্য মা কালীর সামনে অত্যাচারী পাঠান হানাদারদের বলি দিতেন। মধ্যযুগের বাঙালি ও রাজশক্তি প্রবন্ধে বেণী রায়কে নিয়ে লিখেছি।
মধ্যযুগের ডাকাতদের স্মৃতি বিজড়িত মাতৃমন্দির বাংলা জুড়ে আছে। কলকাতায় চিতে ডাকাতের চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দির আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে বাঙালির সেই দাপুটে অতীতের। কলকাতায় চিতে ডাকাতের উত্থান ঘটেছিল মোগল আক্রমণে যশোর সম্রাট প্রতাপাদিত্যর শাসন অবসানের পর।
★★★
ডাকাত সর্দার বস্তুত একজন স্থানীয় রাজার সমতুল্য। তন্ত্রসারে বলা হয়েছে নরবলি একমাত্র রাজা দিতে পারেন, আর কেউ অধিকারী নয়। আমরা জানি বাংলার ডাকাতরা নরবলি দিয়ে মায়ের পুজো করতেন, যা অতীব ভয়াবহ। কিন্তু তা হল পরোক্ষ প্রমাণ যে এই ডাকাতদলের প্রধান নায়ক রাজক্ষমতার দাবিদার ছিলেন মধ্যযুগের সেই অন্ধকার সময়ে।
বাংলা জুড়ে মধ্যযুগে কালী উপাসক ডাকাতদের কথা জানা যায়। কয়েকজনের নাম: সিঙ্গুরে সনাতন বাগদি এবং সনাতন সর্দার। ত্রিবেণী বাসুদেবপুরে বুধো ডাকাত। জিরাট কালীগড় অঞ্চলে কালাচাঁদ। বর্ধমানে দক্ষিণডিহির বেহারি। আরামবাগে চক্রপুরে কাঞ্চন ও পঞ্চু।
কয়েকটি জায়গায় নাম হয়েছে এরকম মাতৃকা উপাসক ডাকাতদের নামেই। যেমন রাণাঘাট নাম এসেছে রাণা ডাকাতের থেকে। যেমন চিৎপুরের নামকরণ চিতে ডাকাতের নামে। দক্ষিণ কলকাতায় মনোহরপুকুর হচ্ছে মনোহর ডাকাতের নামে। এদের প্রত্যেকের স্থাপিত মাতৃমন্দির আজও আছে।
আরামবাগের কাছে তেলোভেলোর মাঠে মা সারদা যে ডাকাতের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তার নাম ছিল ভীম। ডালিয়া গ্রামের ডাকাত সর্দার ছিল ভীম।
কাঁচরাপাড়া অঞ্চলে রঘু ডাকাতের কালী এখনও পূজিত হন। কলকাতায় বাগবাজারে নন্দ ডাকাতের কালী।
★★★
বঙ্কিমের ভবানী পাঠক সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে সবথেকে বিখ্যাত কালী উপাসক ডাকাত। সত্যিই ভবানী পাঠক নামে ইতিহাসে একজন সন্ন্যাসী-ডাকাত ছিলেন এবং জলপাইগুড়ির সন্ন্যাসীহাটে (ময়নাগুড়ি রোড এবং রাজবাড়িপাড়ার মাঝামাঝি) ভবানী পাঠকের ডাকাতে কালীবাড়ি আছে এখনও।
গৌড়েশ্বরী বলে খ্যাত মালদার জহুরা কালী স্বয়ং ডাকাতে কালী বলেই পরিচিত ছিলেন মধ্যযুগে, যা সম্ভবত এই ইঙ্গিত দিচ্ছে: গৌড় পুনরুদ্ধার প্রয়াসী বাঙালি সমরনায়করাই ডাকাত বলে খ্যাত হতেন।
বাংলা জুড়ে আজকে ডাকাত কালীর নানা রকম মূর্তি দেখা যায়, বামাকালী, শ্মশানকালী, দক্ষিণাকালী। মূর্তি যেমন, তেমনই ধ্যানমন্ত্রে পুজো হয়।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় মা কালী। জয় জয় মা।
মায়ের ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, উনিশ জানুয়ারি দুহাজার তেইশ