বিপুল-পুরট-ধামা কঞ্জদৃকপাদপাণিঃ
শুভদসুখদনামা কর্ণহৃদ্ধারিবাণিঃ
জলধরমদমোষে ডম্বর দিব্যবেশ
কুমল-হৃদয়কোষে ভাতু মে জাহ্নবেশঃ।।
পদ্মের মতো হস্তপদ, বিশাল কলেবর, পুণ্যনাম, “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া” হৃদয়কে ধন্য করে দেয় এমন বাণী, বর্ষার মেঘের মতো বা রুদ্রের ডম্বরুর মতো গম্ভীর হুঙ্কার, লীলাবশে ধরেছেন দিব্যবেশ। জাহ্নবা দেবীর সেই হৃদয়বল্লভ মলিন হৃদয়কোষে প্রকাশিত হোন।
মঙ্গলাচরণের এই শ্লোকটি পেয়েছি হরিদাস দাস মহাশয়ের গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান থেকে।
আজ বাঙালির প্রেমের হাটের রাজা নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি। তিনি অবধূতশ্রেষ্ঠ; তন্ত্রের মহাসাধক। মস্তকে ধারণ করেছেন ত্রিপুরাসুন্দরীর তত্ত্ব। তাঁর হরিনামের হুঙ্কারে কম্পিত হয়েছে মধ্যযুগের অত্যাচারী শাসক আর পথভ্রষ্ট সমাজপতিদের কুচক্র। তিনি পরম মমতায় সমাজে স্থান দিয়েছেন পাল-সেনযুগের তন্ত্রধারার উত্তরাধিকারী বাউল, সহজিয়াদের। জগাই মাধাইয়ের কলসির কানার আঘাতকে হেলায় অগ্রাহ্য করে হয়ে উঠেছেন সেই মহাকরুণার অবতার; যে মহাকরুণার পথেই একদিন বাঙালি সিদ্ধাচার্য তারা, লোকনাথ, প্রজ্ঞাপারমিতার সাধনা করেছিল।
তিনি চৈতন্যদেবের অভিন্নহৃদয় সহচর। তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের কর্ণধার। তাঁর তত্ত্ব বোঝা বড়ো দায়। শ্রীবাস অঙ্গনের রুদ্ধদ্বার কীর্তনকে তিনিই নবদ্বীপের পথে নিয়ে এসেছিলেন। গৃহী সাধকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সন্ন্যাসের পথ ত্যাগ করে বসুধা ও জাহ্নবা দেবীর সাথে বিবাহ করেছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে নারীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী। চৈতন্যজীবনী কাব্যসমূহের গ্রন্থনায় সূত্রধর রূপে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তাঁর ধর্ম কঠোরতায় মলিন নয়; আনন্দের সমস্ত বর্ণে বর্ণময়। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর প্রধান সহচর দ্বাদশ গোপালের মাধ্যমে মধ্যযুগের বিধ্বস্ত বাঙালির কাছে তিনি সার্বভৌম রাজার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বাঙালি মহাজাতির পুনরুত্থানে তাঁর ভূমিকা সহস্র মুখেও বলে শেষ করা যায় না। তিনি ছিলেন বলেই আঘাতে আঘাতে দীর্ণ বাঙালি অত্যাচারী শাসককে বলতে পেরেছিল: ঝাট কৃষ্ণ বোল নইলে ছিণ্ড এই মাথা। খড়দহের শ্রীপাটে তিনি শারদীয়া কাত্যায়নী দুর্গার পূজা প্রচলন করেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন বাঙালির শাক্ত আর বাঙালির বৈষ্ণব দুই ধারাই তন্ত্রের সূত্রে বাঁধা। পানিহাটির মহোৎসবে ছত্রিশ জাতির সমন্বয় ঘটিয়ে বাঙালির আদি সমাজভাবনার পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
তাঁর নাম নিতে উদ্ধারণ দত্ত, রঘুনন্দনের মতো বিত্তবান থেকে বৃন্দাবনদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজের মতো নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব সাধক, শাক্ত, বাউল, ফকির, সহজিয়া সবাই একাকার হয়ে যান। আজও সহজিয়া বাউল পদ ধরেন:
হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই
রক্তিম মুখার্জ্জী
