বজ্রশারদার তত্ত্ব নিরূপণ

বজ্রসারদা। পালযুগের বাঙালির আরাধ্যা সরস্বতীর বজ্রযানী রূপ। হৃদয়ের বিশ্বপদ্মে চন্দ্রমণ্ডলের আভার মধ্যে তাঁকে ধ্যান করতেন সেযুগের মনস্বী সাধক। দেখতেন দেবীর প্রতিটি রোমকূপ থেকে প্রজ্ঞারশ্মির অমল প্রভার বিচ্ছুরণ। তিনি মহাবুদ্ধিবীজাঙ্কুরশ্রী অর্থাত মেধার তথা মানবচেতনার মহত্তম স্তরের উৎসরূপে বন্দিত হয়েছেন সাধনমালা গ্রন্থে।

নিচের ছবিটি নালন্দা মহাবিহারে প্রাপ্ত পালযুগের বজ্রশারদার। চার বছর আগে তুলেছিলাম। বর্তমানে নালন্দায় পুরাতত্ত্ব বিভাগের মিউজিয়ামে আছে। নালন্দা শব্দের অর্থে পদ্মের ব্যঞ্জনা নিহিত আছে। একদা বাঙালির যে জ্ঞানপীঠ সমগ্র জগতকে আলো দিয়েছিল; প্রজ্ঞার দেবী যেখানে অগণিত জ্ঞানতপস্বীর চেতনায় ধরা দিয়েছিলেন; সেখানেই তাঁর এই বিগ্রহ পূজিত হতো সেই স্বর্ণযুগে। এখানে দেবী চার সহচর পরিবৃত হয়ে বসে আছেন; ঠিক আমাদের শারদীয়া দুর্গার সপরিবার মূর্তির মতো। সারদা ও শারদার তত্ত্বে বিশেষ ব্যবধান তন্ত্রে নেই। বানানের দিক থেকেও বজ্রসারদা বহু স্থানেই বজ্রশারদা রূপে উল্লিখিত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সাধনমালায় দেবীর এই সহচরদের উল্লেখ নেই। যে শিল্পী এই মাতৃপ্রতিমা নির্মাণ করেছিলেন তিনিই এই মণ্ডলের রচনা করেছেন। এবং এই মণ্ডল মাতৃসাধনার প্রাচীন ধারার এক ধ্রুব বৈশিষ্ট্যকেই প্রকাশ করেছে। সাঙ্খ্যের পঞ্চ তন্মাত্রা, মহাযানের পঞ্চ তথাগত, ভাগবতধর্মের পঞ্চ বৃষ্ণিবীরের উপাসনা, পাঞ্চরাত্র উপাসনা, বৈদিক সাহিত্যে পঞ্চজনের দ্বারা সরস্বতীর উপাসনা, চার সন্তানের মাঝে গঙ্গারিডির দশায়ুধা মাতৃকার উপাসনা সবই সেই আদি ধারাটিরই ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি। আজও শ্রীপঞ্চমীতেই মহাশ্বেতার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তন্ত্রের আদিমাতৃকার প্রজ্ঞাময়ী বিগ্রহ সরস্বতীর সর্বময়তা বর্ণিত হয়েছে একটি অপূর্ব শ্লোকে:

“তারা ত্বং সুগতাগমে ভগবতী গৌরীতি শৈবাগমে।
বজ্রা কৌলিকশাসনে জিনমতে পদ্মাবতী বিশ্রুতা।।
গায়ত্রী শ্রুতশালিনাং প্রকৃতিরিত্যুক্তাসি সাংখ্যযানে।
মাতর্ভারতি কিং প্রভূতভণিতৈর্ব্যাপ্তং সমস্তং ত্বয়া।।”

সুগতাগমে তুমি মা তারা। শৈব আগমে তুমি মা ভগবতী গৌরী। কৌলিক শাসনে তুমি মা বজ্রা। জৈনমতে তুমি মা পদ্মাবতী। বৈদিকের কাছে তুমি গায়ত্রী, সাংখ্য দর্শনে তুমি প্রকৃতি। হে মা সরস্বতী, বেশি বলে আর কি হবে, সমস্তই তোমার দ্বারা ব্যাপ্ত।

তিনিই বেদে “অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে” বলে সম্বোধিতা। বাক রূপে; গৌরী রূপে ইনিই অক্ষর জুড়ে জুড়ে ছন্দ সৃষ্টি করেছেন।

গৌরীমির্মায় সলিলানি তক্ষতীর্
একপদী দ্বিপদী সা চতুস্পদী
অষ্টাপদী নবপদী বভূবুষী
সহস্রাক্ষরা পরমে ব্যোমন্।।

জল কেটে কেটে গৌরী নির্মাণ করলেন- একপদী দ্বিপদী চতুষ্পদী অষ্টাপদী নবপদী – পরমব্যোমে সহস্রাক্ষর হতে ইচ্ছা করে।

সেখানে তিনি গৌরী। তাঁর এই বর্ণাত্মিকা জলময়ী রূপের সূক্তটিকে সুকুমার সেন মহাশয় বলেছেন: “প্রহেলিকাময় এবং অত্যন্ত দুর্বোধ্য, প্রায়-আধুনিক কালের যোগীদের আর্য্যা- তর্জার মতো।”

অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ সরস্বতীর তিন প্রাচীন রূপের সন্ধান পেয়েছেন- ইড়া ভারতী ও সরস্বতী। জলরূপা মাতৃকা ও বাক তথা বর্ণাত্মিকা মাতৃকার এই সংযুক্তির ধারা তাম্রাশ্মযুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। সর্পমাতৃকা জগতগৌরীও এই সূত্রেই হংসাসনা সরস্বতীর সাথে একাত্ম হয়ে আছেন। তিনিই নীলসরস্বতী তারা; উপমহাদেশের নীলবর্ণা কালরূপা মাতৃকার এক মধুর বিগ্রহ। অজ্ঞানতার বিষে মৃতপ্রায় চেতনাকে তিনিই সঞ্জীবিত করেন।

সরস্বতী উপমহাদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে পূজিতা। তাঁর নামটি পর্যন্ত সেই আদিকাল থেকে এখনও অবিকৃত। গৌড় সারস্বতগণ ( পরবর্তী সময়ের সাতশতী) সুদীর্ঘকাল তাঁর উপাসনার গৌরব জাতিগতভাবে ধারণ করেছেন। তিনি নদীরূপা, তিনি বাকরূপা। বাঙালির জ্ঞানপীঠ থেকে কবির রসনা সর্বত্রই তাঁর নিত্য অধিষ্ঠান। পদকর্তা নীলকণ্ঠের ভাষায়:

প্রভাতে কুমারী মধ্যাহ্নে যুবতী
সায়াহ্নে বৃদ্ধারূপা হও নিতি নিতি
নবদ্বীপধামে নীলসরস্বতী
নীলকণ্ঠের কন্ঠে আনন্দদায়িকে

তথ্য কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s