
২০২৩ সালে কালীভক্তের সাফল্য মন্ত্র: মায়ের সন্তানদের জন্য পাঁচটি সহজ চর্যা।
নতুন পশ্চিমী বছর ২০২৩ এলো। মায়ের সন্তানরা সবাই মায়ের নাম নিয়ে এই বছরটি শুরু করেছেন নিশ্চয়ই। একজন সাধারণ নগণ্য মাতৃসাধক হিসেবে পাঁচটি জীবনশিক্ষা আমার পাথেয়, আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি নতুন বছরের শুরুতে।
১. কালী চতুর্বর্গময়ী। ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ। এর কোনও একটি বর্গ আলাদা করে নিয়ে খণ্ডজীবন কাটালে মায়ের সন্তানের উপযুক্ত কাজ হয় না।
ধর্ম অর্থ ব্যাপক, শুধু রিলিজিয়ন নয়। আপনি যে চাকরি করেন, কর্তব্য করেন, জ্ঞানার্জন করেন, সব ধর্ম। অর্থ মানেও কেবল পয়সা নয়, সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার আছে, অর্থাৎ আপনার স্মার্টফোনে এই যে আমার লেখাটা পড়ছেন, সেটা অর্থবর্গের কাজ।
কাম অর্থে কেবল যৌনতা নয়। কাম্য বস্তুর অর্জন। ধরুন আপনি নিজের বাড়ি কিনতে চান, টাকা জমাচ্ছেন, সেটা কাম বর্গের অনুশীলন।
মোক্ষ অর্থ সবাই জানেন। কালী কৈবল্যদায়িনী। এই জন্ম মৃত্যুর দুঃখময় জীবন থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার আদর্শ ভারতে প্রাচীন। সাংখ্য বলে উচ্ছিত্তি। বৌদ্ধধর্মে নির্বাণ।
এবার, তন্ত্রধর্মে শাক্তধর্মে কেবল চতুর্থ বর্গের কথা বলা নেই। চতুর্বর্গের কথা বলা আছে। চারটি বর্গই আমাদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। শাক্তধর্ম কেবল পারমার্থিক নয়, তা জাগতিকও বটে। মনে রাখবেন মায়ের সন্তানের জন্য ভুক্তি ও মুক্তি দুয়েরই ব্যবস্থা করে রেখেছেন মা। অতএব জাগতিক কর্তব্যপালন, জাগতিক প্রাপ্তিসুখ, জাগতিক কামনা পূরণ – শাক্ত হিসেবে, মায়ের সন্তান হিসেবে আপনার জীবনের অঙ্গ।
তাই চোখ বুঁজে কেবল আধ্যাত্মিক ধ্যান করে কাটিয়ে দেবেন না জীবন। মা কালীকে তো আমরা নিজেদের মধ্যেই ধ্যানে উপলব্ধি করি।
কিন্তু জাগতিক ব্যাপ্তি দরকার। মায়ের বিশাল মন্দির তৈরি করুন। বৃহৎ জাগতিক কর্ম করুন। বস্তুনিষ্ঠ থাকুন। আপনার প্রজ্ঞা যেন আপনার জাতির জন্য সুফল বয়ে আনে। বৃহৎ আনন্দের স্বাদ নিন।
অনুশীলন ধর্মের কথা বঙ্কিমের লেখায় পাবেন, অনুশীলনের মাধ্যমে আপনার মানব সম্পদকে আরও তুখোড় করুন। যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি, মনে রাখবেন। মায়ের সন্তানদের জয় হোক, এই ধ্বনিতে জগৎ মুখরিত করুন। জয় মা কালী বলে জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। জীবন বিমুখ হবেন না। আপনার সঙ্গে মা কালী আছেন, চারপাশের সবাই আপনার বিরুদ্ধে গেলেও আপনার জয় অনিবার্য।
★★★
২. কালী জগদকারণ, কালী জগৎময়। রামকৃষ্ণদেব একটা কথা বলতেন, তিনিই সব হয়েছেন।
কাজেই জগতের সমস্ত কিছুই তাঁর অংশ। পারিপার্শ্বিক থেকে সমস্ত কিছু অবলোকন করুন, বিশ্লেষণ করুন, অনুধাবন করুন, কারণ পুণ্য তাঁরই জগৎ থেকে উৎপন্ন, পাপও তাঁর, সমস্ত কিছুর মধ্যেই তাঁর বার্তা আছে, পাঠ করুন মায়ের সেই সংকেত। যেখানে অনাচার, মায়ের বার্তা পাঠ করে রুখে দাঁড়ান। যেখানে সদাচার, মায়ের নির্দেশে পাশে থাকুন। কোনও রকম অন্যায় বৈষম্য মায়ের অভিপ্রায় নয়, বর্ণবৈষম্য বা লিঙ্গবৈষম্যর কোনও স্থান নেই মায়ের তন্ত্রধর্মে।
কিন্তু জগতে বৈষম্য আছে, তার মানে মা আপনাকেই সঙ্কটকালে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং কর্ম করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ মায়ের পরীক্ষা। প্রকৃতি সর্বদা পরীক্ষা নিয়ে চলেছেন।
অনাচারের অংশ হবেন না, অন্যায়ের পক্ষ সমর্থন করবেন না। কেউ মহৎ উদ্দেশ্যেও জোচ্চুরি জুমলা করতে গেলে বিরোধিতা করুন, কারণ জোচ্চোরের ভরসা কি, তার মহৎ উদ্দেশ্যেও তো জল মেশানো থাকতে পারে। কেউ খারাপ উদ্দেশ্যে আছে, আপনি জানেন সে খারাপ, অথচ দুয়েকটা ভালো কাজের চেষ্টা করছে, সতর্ক থাকুন, সরাসরি বাধা দেওয়ার দরকার নেই, কিন্তু বিপদের আশঙ্কা আছে, মা আপনাকে বলছেন। মায়ের বার্তা যেন সর্বদা আপনার মনের মাঝে পৌঁছে যায়। পশ্চিমের সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বাধুনিক বিজ্ঞানকে অনুসরণ করুন, কারণ তন্ত্র অতীতকাল থেকেই বিজ্ঞানের পরিপূরক। মহামারী এলে আমাদের বৈদ্যরা যে আয়ুর্বিজ্ঞান দিয়ে চিকিৎসা করতেন, তা তন্ত্রাশ্রয়ী। আদি সাংখ্যের সবথেকে নির্ভরযোগ্য নথি আছে একটি আয়ুর্বিজ্ঞান গ্রন্থে: চরক সংহিতা।
একটা রসিকতা আছে। ডুবন্ত এক ভক্ত খ্রিষ্টান মানুষ, মাঝ সাগরের জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। একটা জাহাজ দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো, লাইফ বেল্ট দিয়ে বাঁচাতে চাইল। কিন্তু এ এমনই ভক্ত যে বলল, না ভাই, আমাকে গড বাঁচাবেন, ক্রাইস্ট বাঁচাবেন। আরও দুয়েকটা জাহাজও এভাবেই ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চলে গেল।
তা লোকটা অবশেষে ডুবে মারা গেল। ভক্ত মানুষ, সে মরে স্বর্গে গেছে। গিয়ে অভিমান করে বলছে, একি ভগবান, আমাকে বাঁচালেন না? ভগবান ভয়ানক রেগে গিয়ে বললেন, ওই তিনটে জাহাজ কি তোর বাবা পাঠিয়েছিল?
ভক্তটি বিড়বিড় করে বলল, বাবাই পাঠিয়েছিল তাহলে। আওয়ার ফাদার হু আর্ট ইন হেভেন…
★★★
তাই ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিককে অবহেলা করে, বিশেষজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মানুষকে উপেক্ষা করে কদাপি ভাববেন না আপনি বিশাল মাতৃভক্ত হয়েছেন। তেমন করলে কসমিক একটি থাপ্পড়ে মা আপনাকে বুঝিয়ে দেবেন, মায়ের বার্তা জগৎ মাঝে মায়ের সন্তানদের মাধ্যমেই প্রস্ফুটিত হয়, মায়ের ডাককেই আমরা অবহেলা করি যদি আমরা মায়ের সেই বার্তা না শুনি। কারণ তিনি প্রকৃতি, আর আমরা সবাই প্রকৃতির অংশ।
৩. কালীভক্ত সর্বদা মায়ের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় কারিণী রূপ মাথায় রাখবেন। মা তো, মা কি সন্তানের বলি চাইতে পারে, ইত্যাদি যারা বলে তারা নিজের মা, টুনির মা ইত্যাদির সঙ্গে জগদকারণ জগদবিলয় জগন্মাতাকে গুলিয়ে ফেলছে। যে পৃথিবী জন্ম দেন, সেই পৃথিবীই গ্রাস করেন।
তাই বিপদে আশঙ্কিত হবেন না, মনে রাখবেন, এক আশ্চর্য ভবচক্রের আবর্তন ঘটে চলেছে, এই চক্র মায়েরই প্রতীক, তার আবর্তন বুঝতে গেলে অনুশীলন করতে হবে, অথবা এমন প্রজ্ঞাবান মানুষের দ্বারস্থ হতে হবে যিনি অনুশীলনের মাধ্যমে মায়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। বাঙালি যদি বিধ্বস্ত হয়ে থাকে, তার কারণ সে জগন্মাতার ধর্মে তন্নিষ্ঠ থাকে নি।
পড়াশোনা করলে পরীক্ষায় ফেল করবেন না, অন্তত স্বাভাবিক অবস্থায় এমন হবে না।
ফাঁকিবাজি করলে মহৎ কাজ হয় না।
দেবো দুর্বলঘাতক, দেবতারাও দুর্বলের ঘাতক, এই মর্মে সংস্কৃত শ্লোকটি তো আগেও পেজে দিয়েছি। দুর্বলতা পরিহার করুন।
এবং সমস্ত প্রয়াসের পরে, অনুশীলনের পরে এই অহঙ্কার যেন না আসে, যে সর্বজয়ী দিগ্বিজয়ী হয়েই গেছি। এক ইঞ্চি ভূমি জয় করার জন্য দীর্ঘ অনেক দিনের সংগ্রাম করতে হতে পারে, আবার দীর্ঘদিনের জয়ের ফসল এক মুহূর্তের অসতর্কতার ফলে বিনষ্ট হতে পারে।
দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ। সাংখ্যযোগ থেকে পাই। অর্থাৎ, দুঃখে ভেঙে পড়বেন না, সুখে আত্মহারা হবেন না।
৪. কালী হলেন কালের অধিষ্ঠাত্রী। কালস্রোত, কালপ্রবাহ, কালগ্রাসের প্রতি তাই বিনম্র থাকুন। মা চাইলে এই কালের কলন করবেন, মা চাইলে কালস্রোতে ভাসিয়ে দেবেন। মানুষ অমর নয়, কালজয়ী হওয়ার অহঙ্কার মানুষকে মানায় না। জগন্মাতা জন্ম দিয়েছেন, সময় হলে তিনি তাঁর কোলে আবার টেনে নেবেন। জন্ম মৃত্যু কালীভক্তের কাছে পায়ের ভৃত্য, কারণ মা আমাদের শ্মশানবাসিনী। কালীভক্ত অকুতোভয় হবেন, কারণ মায়ের সন্তানের থেকে বড় বীর মানুষ পৃথিবীতে আর হয় না। কালীভক্ত ত্রিকালজ্ঞ হবেন, কারণ অতীতকালকে নিবিড়ভাবে পাঠ করলে ও বর্তমানকে নিষ্ঠাভরে বিশ্লেষণ করলে মায়ের সন্তানদের ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা জন্মায়।
৫. মা কালীর মূর্তি সন্তানকে সিদ্ধিদান করে, তাই বাড়িতে, এবং সম্ভব হলে নিজের খুব কাছেই সর্বদা মাতৃমূর্তি, মাতৃচিত্র রাখবেন। আমার ফ্ল্যাটে প্রত্যেক ঘরে মায়ের একাধিক ছবি/মূর্তি আছে। বাকি কারও মূর্তি বা ছবি না থাকলেও চলে, কিন্তু মা কে সঙ্গে রাখবেন।
নান্যদেবো কলৌ যুগে, তাই মায়ের পুজো করলে আর অন্য কারও পুজো করতে হয় না, অস্যার্থ: এক এই মায়ের পুজো করলেই বাকি সকলকে পুজোর ফল হয়। আমি বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি ভীষণ অনুরাগী। আমাদের সমকালে নাথযোগী এবং তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্য যোগীপাল চৌরঙ্গীর সমাধিস্থল সম্পর্কে আমিই জন সচেতনতা তৈরি করেছি। আমি বৌদ্ধধর্মের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করি। যে বৈদিক ও পৌরাণিক ধর্মের সমালোচনা করি, তাকেও অতি যত্নে পাঠ করি। এমনকি খ্রিষ্ট বা মুসলিম ধর্ম সম্পর্কেও আমি দীর্ঘদিন ছাত্রের অধ্যবসায় নিয়ে পঠন পাঠন করেছি, আমার পিএইচডির বিষয় ছিল আইরিশ জাতীয়তাবাদ ও ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্ম।
আমি মা মনসার প্রচণ্ড ভক্ত, মা মনসাকে আমি কুণ্ডলিনীজ্ঞানে পুজো করি। আমি দুর্গাভক্ত বলা বাহুল্য, সহজ দুর্গাপুজো শুরু করেছি, আমিই এই সমকালে সহজ দুর্গাপুজোর প্রবর্তক। আমি জগন্মাতার সরস্বতী রূপের একনিষ্ঠ উপাসক, কারণ কুলে আমি বৈদ্য, বৈদ্যরা সারস্বত ব্রাহ্মণ। এছাড়া শীলে আমি অধ্যাপক, সেজন্যও সরস্বতী উপাস্য। তন্ত্রধর্মে কুলশীল মান্য হয়, বর্ণবাদ নয়। আমি বজ্রযোগিনী এবং নারোডাকিনীর উপাসনা করি, কারণ নারোপা আমার গুরু। আমি সকলের নাম নিতে পারব না, তবে আধুনিক যুগে বঙ্কিমের মত পথ প্রদর্শক পেয়ে অন্য অনেক শিক্ষিত বাঙালির মত আমিও ধন্য। কিন্তু সবার জয়ধ্বনি করতে গেলে এই এক জীবন যথেষ্ট হবে না।
তাই সর্বদা মনে রাখি, মা কালী তো সর্বময়ী। মা কালীর নাম করলে আর আলাদা করে কারও নাম নিতে হয় না, সমস্ত পাঠ, সমস্ত সাধনার পরে এই প্রতীতি জন্মেছে। পশ্চিমের শ্রেষ্ঠতম দর্শন, পূর্বের শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞা, সমস্ত দেবতার নির্যাস এবং সমগ্র জীব ও জড় জগতের স্পন্দন এই কালীর মধ্যে এসে কেন্দ্রীভূত। বাঙালি হয়ে জন্ম নিয়ে নিয়ে যে কালীনাম করল না, সে অতি হতভাগা।
কালিকা বঙ্গদেশে চ। মা কালী বঙ্গেশ্বরী।
কলৌ কালী কলৌ কালী। মা কালী কলিযুগেশ্বরী। কলিযুগের একমাত্র গতি কালী।
কালীকে একমাত্র ইষ্ট করুন। জগদকারণ আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত প্রকৃতির ধর্মে তন্নিষ্ঠ থাকুন। মায়ের আশীর্বাদে মায়ের সন্তানদের ভালো হবে।
মায়ের ধর্ম সর্বব্যাপী হোক।
জয় মা কালী। জয় জয় মা।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
মায়ের ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, দুই জানুয়ারি দুহাজার তেইশ