
বামাকালীঃ ধ্যানমন্ত্র ও মূর্তিরূপ।
বামাকালীর উপাসনা আমাদের তন্ত্রধর্মে বেশ জনপ্রিয়। মায়ের এই রূপটি সম্পর্কে সকলের মধ্যে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট জ্ঞানের প্রসার হওয়া দরকার, সেজন্যই এই লেখাটি নির্মাণ করলাম। সাধারণ বাঙালি যেরকম ব্যাপকভাবে দক্ষিণকালিকার স্নেহময়ী মাতৃরূপ উপাসনা করে, বামাকালীকে তুলনায় কম প্রকাশ্যে পূজিত হতে দেখা যায়, যদিও তন্ত্রাচারী শাক্তদের মধ্যে বামাকালীর উপাসনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু বাৎসরিক সার্বজনীন কালীপুজো, কিছু জনপ্রিয় মন্দির বা পারিবারিক পুজোতেও বামাকালী পূজিত হন, কাজেই তাঁর উপস্থিতি গণধর্মেও সমানভাবে পরিলক্ষিত।
প্রথমেই বলা দরকার, আদিকাল থেকেই তন্ত্রের আদর্শ এক সুষম ভারসাম্য, ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যে সুষুম্না যেমন। তন্ত্রে বামাচার ও দক্ষিণাচার দুটির কোনোটির স্থান একে অপরের থেকে কম বেশি নয়। বামাচারী মতেই সাধারণত বামাকালী পূজিত হন। তাঁর বাম পদ শবের বুকের ওপরে থাকে। মায়ের বাম পদ ভক্তকে সমস্ত বামগতি বা বিধি বাম হওয়া থেকে রক্ষা করে। তন্ত্রসারে বামাকালী ধ্যানমন্ত্র ও মূর্তিরূপ দেওয়া আছে, প্রধান অংশটি উদ্ধৃত করছি।
বিদ্যুৎকান্তিসমানাভ-দন্তপংক্তি বলাকিনীম্।
নমামি ত্যং বিশ্বমাতাং কালমেঘসমদ্যুতিম্।
মুণ্ডমালাবলীরম্যাং মুক্তকেশীং দিগম্বরাম্।।
লোলজিহ্বাং ঘোররাবামারক্তলোচনত্রয়াম্।
কোটিকোটিকলানাথ-বিগলম্মুখমণ্ডলাম্।।
অমাকলাসমুল্লাসকিরীটোজ্জ্বলমণ্ডলাম্।
শবদ্বয়কর্ণভূষাং নানামণিবিভূষিতাম্।।
সূর্য্যকান্তেন্দুকান্তৌঘ-প্রোল্লাসকর্ণভূষণাম্।
মৃতহস্তসহস্রৈলস্তু কৃতকাঞ্চীং হসম্মুখীম্।।
সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্ত ধারাবিস্ফুরিতাননাম্।
খড়্গমুণ্ডবরাভীতি সংশোভিতচতুর্ভুজাম্।।
দন্তুরাং পরমাং নিত্যাং রক্তমণ্ডিতবিগ্রহাম্।
শিবপ্রেতসমারূঢ়াং মহাকালোপরি স্থিতাম্।।
বামপাদং শবহৃদি দক্ষিণে লোকলাঞ্ছিতম্।
কোটিসূর্য্যপ্রতীকাশং সমস্তভুবনোজ্জ্বলম্।।
বিদ্যুৎপুঞ্জসমানাভোজ্জ্বটবিরাজিতম্।
রজতাদ্রিনিভং দেবং স্ফটিকাচলবিগ্রহম্।।
দিগম্বরং মহাঘোরং চন্দ্রার্কপরিমণ্ডিতম্।
নানালঙ্কারভূষাঢ্যং ভাস্বংস্বর্ণতনূরুহম্।।
যোগনিদ্রাধরং শম্ভুং স্মেরাননসরোরুহম্।
বিপরীতরতাসক্তাং মহাকালেন সন্ততম্।।
অশেষব্রহ্মাণ্ডভাণ্ড প্রকাশিত মহোজ্জ্বলাম্।
শিবাভির্ঘোররাবাভির্ব্বেষ্টিতাং প্রলয়োদিতাম্।।
কোটিকোটিশরচ্চন্দ্রন্যক্কৃতানখমণ্ডলাম্।
সুধাপূর্ণশীর্ষহস্ত যোগিনীভির্ব্বিরাজিতাম্।।
আরক্তমুখমদ্যাভি-স্মর্ত্তাভিরম্বগাং বৈ।
ঘোররূপৈর্ম্মহানাদৈ-শণ্ডতাপৈশ্চ ভৈরবৈঃ।
গৃহীতশবকঙ্কাল জয়শব্দপরায়ণৈঃ।
নৃত্যাদ্ভির্ব্বাদনপরৈ রনিশঞ্চ দিগম্বরৈঃ।
শ্মশানালয়মধ্যস্থাং ব্রহ্মাদ্যুপনিষেবিতাম্।।
★ মা বামাকালীর দন্তপংক্তি বিদ্যুৎকান্তির মত, মা হলেন বলাকিনী। মা কে বিশ্বমাতা সম্বোধনে প্রণাম করা হয়েছে। মায়ের দ্যুতি কালমেঘের মত।
★ মা মুণ্ডমালা ধারণ করেন, মা মুক্তকেশী এবং দিগম্বরী। মা লোলজিহ্বা এবং মায়ের তিনটি নয়ন রক্তবর্ণ।
★ মায়ের মুখমণ্ডল থেকে কোটি কোটি চন্দ্র বিগলিত হচ্ছে। তাঁর শিরোদেশে অতিশয় উল্লাসযুক্ত উজ্জ্বল কিরীট।
★ মায়ের কর্ণদ্বয়ে শবকুণ্ডল শোভা পাচ্ছে। সূর্যকান্ত এবং চন্দ্রকান্ত মণি সহ নানা মণি দ্বারা মায়ের কর্ণভূষণ মণ্ডিত। কটিদেশ অর্থাৎ কোমর পরিবেষ্টিত শবহস্ত নির্মিত কাঞ্চীমালা দ্বারা।
★ মায়ের মুখমণ্ডল হাস্যময়। মুখের দুই কোণে রক্তধারা এবং মায়ের মুখমণ্ডল বিস্ফুরিত। মায়ের চতুর্ভুজ খড়্গ, মুণ্ড, বর এবং অভয় দ্বারা শোভিত।
★ মায়ের দন্তরাজি সু উচ্চ। মায়ের বিগ্রহ রক্তমণ্ডিত। মা শিবপ্রেতারূঢ়া, অর্থাৎ শববাহনা। মা মহাকালের উপরে স্থিতা।
★ মায়ের বাম পা শবের বুকের ওপরে। দক্ষিণ পদ মহাকাল শঙ্করের উপরে।
★ মা বামাকালী ঘোর রব করা শিবাদল দ্বারা পরিবেষ্টিতা। মা প্রলয়কালের মূর্তি ধারণ করেন। তাঁর নখমণ্ডল কোটি কোটি সূর্য চন্দ্র তুচ্ছ করে দিচ্ছে।
★ মায়ের মস্তকমণ্ডল এবং করসমূহ ঘিরে যোগিনীগণ বিরাজ করছেন, যোগিনীগণ সুধাধারিণী এবং আরক্তমুখী। ঘোর মহানাদকারী দিগম্বর নৃত্যবাদ্যরত ভৈরবগণ মা বামাকালীকে চতুর্দিকে পরিবেষ্টন করে মায়ের জয়জয়কার ঘোষণা করছেন।
★ মা শ্মশানবাসিনী। তিনি ব্রহ্মাদি সমস্ত দেবতাগণ দ্বারা পূজিত।
জয় মা বামাকালী। জয় জয় মা।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
মায়ের ছবি ইন্টারনেট থেকে।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, তিন জানুয়ারি দুহাজার তেইশ