“সকল দেশেই জন-কতক লোক থাকে মা, যাদের জাতই আলাদা….. দেশের মাটি এদের গায়ের মাংস, দেশের জল এদের শিরার রক্ত; শুধু কি কেবল দেশের হাওয়া-আলো, – এর পাহাড় পর্বত, নদীনালা, চন্দ্রসূর্য যেখানে যা কিছু আছে- সব যেন সর্বাঙ্গ দিয়ে এরা শুষে নিতে চায়! বোধহয় এদেরই কেউ কোন্ সত্যকালে জননী- জন্মভূমি কথাটা প্রথম আবিষ্কার করেছিল।” ( পথের দাবি; শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
এক শতাব্দী প্রাচীন কারাগার তার দৈত্যাকার প্রাচীর, পাথরে বাঁধানো রাস্তা, প্রকাশ্য ফাঁসিমঞ্চ আর দমবন্ধ ছোট্ট কুঠুরির অন্ধকার নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেই কারাগারের প্রতিটি কোণে বন্দি প্রাণের দীর্ঘশ্বাস, অত্যাচারিতের হাহাকার আর অসহায়ের অশ্রুজল জমে আছে পুঞ্জীভূত হয়ে। তবুও আজ তার অপূর্ব মহিমা। আজ তার প্রতিটি ধূলিকণা তীর্থের রজের মতো পবিত্র। আজ সেই কারাগারে বন্দেমাতরম ধ্বনিত হলে চাবুকের বন্যা নামে না; নীরবে অশ্রুর মালা গাঁথা হয় দর্শকদের চোখে। আর যাঁদের জন্য এই অসাধ্যসাধন সম্ভব হয়েছে; তাঁরা কালসমুদ্রের অপর পারে মৃত্যুঞ্জয়ীর সিংহাসনে চিরগৌরবে অধিষ্ঠিত।
বলছি ব্রিটিশ ভারতের কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের কথা। এখন যার পরিচিতি আলিপুর জেল মিউজিয়াম। তারই ওয়ার্ড নং চার, পাঁচ, ছয় ও সাতে রাখা হতো পরাধীন দেশের রাজনৈতিক বন্দিদের। পাশেই জেল হাসপাতাল। অমানুষিক অত্যাচারে, অনাহারে রোগগ্রস্ত বন্দিদের যেখানে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হতো। এখানেই বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে চিরতরে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন কানাইলাল আর সত্যেন। এই জেলেই আলিপুর বোমা মামলার মুখ্য আসামী অরবিন্দ পেয়েছিলেন আধ্যাত্মিক পথনির্দেশ। ফাঁসির আগে দীনেশচন্দ্র গুপ্তের কবিতাগুলো শেষবারের মতো আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছিল। আরো কত … সব ঘটনার কথাও আজ আমরা জানি না। সেই ঘটনার পিছনের নায়কদের মুখও ঢেকে রেখেছে বিস্মৃতির আঁধার।
তত্ত্বকথা অনেক হল। এবার একটু কেজো তথ্য দিই। মিউজিয়াম খোলা থাকে সপ্তাহে সোমবার বাদে বাকি ছয়দিন; বেলা এগারোটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত। মিউজিয়াম ঘোরার টিকিট অবশ্য পাঁচটার পর আর দেয় না। আমরা যে কয়েকজন বন্ধু আজ গিয়েছিলাম; পাঁচটা দশে পৌঁছেছি বলে মিউজিয়াম দেখার টিকিট জোটে নি। তবে সেটা পুষিয়ে দিয়েছে এখানকার লাইট এণ্ড সাউণ্ড শো। দুটো শো হয় চল্লিশ মিনিটের। একটা সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ছয়টা চল্লিশ; হিন্দিতে। অন্যটা সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাতটা চল্লিশ; বাংলায়। শীতের রাতে আটটা পর্যন্ত বাইরে থাকা কঠিন বলে হিন্দি শোতেই গিয়েছিলাম। শো দেখার জায়গাটা এমনই যাতে সামনের মাঠের অপর পাড়ে উপরিউক্ত চারটি ওয়ার্ড আর জেল হাসপাতাল একসাথেই চোখে পড়ে। প্রোজেক্টারের সাহায্যে অগ্নিযুগের ইতিহাসের অনেকটাই তুলে ধরা হয়েছে; উপযুক্ত নেপথ্য কন্ঠ এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে। পরিবেশনায় নিষ্ঠা ও সদিচ্ছার কোনো খামতি ছিল না। কয়েকটি তথ্যগত ত্রুটি ছিল। ফরাজি আন্দোলনের নেতা দুদু মিঞাকে নীলবিদ্রোহের অগ্রণী নেতৃত্ব দেখানোর চেষ্টা শুরুতেই তালভঙ্গ করেছিল। তবুও বাকিটা যথেষ্ট চলনসই। পূর্ণিমার আলো ভরা খোলা আকাশের নিচে পুরোনো এই কারাগার যেন উগরে দিচ্ছিল তার গর্ভে জমে থাকা সমস্ত ইতিহাসের উত্তাপ। প্রবেশপথ থেকে শো দেখানোর জায়গা পর্যন্ত যাওয়ার আর ফেরার পথদুটোও এমনই যে কারাগারের প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলো ( ফাঁসির মঞ্চ, শহীদ বেদী, কারাগারের কক্ষগুলি) সবই চোখে পড়ে। এক জায়গায় দেখলাম মা দুর্গার একটি বিগ্রহ আছে। এই ভূমির আদিজননী দশভুজা মহিষমর্দিনী রূপে দাঁড়িয়ে আছেন অগ্নিযুগের দেশমাতৃকার প্রতীক হয়ে; ঋষি বঙ্কিমের “মা যা হইবেন” হয়ে। সব দেখতে দেখতে একটাই বেদনা বারবার মনকে বিষণ্ণ করছিল। এত ত্যাগ, এত রক্তের মূল্য কি হল? বাংলাকে স্বাধীনতা দেখতে হল অর্ধেক অঙ্গচ্ছেদের রক্ত মেখে। বাঙালি বিপ্লবীরা দেশের স্বাধীনতা আনার পাহাড়প্রমাণ দায়িত্বের সিংহভাগ বহন করলেন। তবুও স্বাধীনতার পর ব্রাত্য দশা আজও ঘুচলো না। কারণ আমরা আত্মবিস্মৃত, পদদলিত; আমরা বিশ্বমানবিক সাজতে গিয়ে জাতির শক্তিকেন্দ্র নির্মাণের কৌশলই ভুলে গিয়েছি।
ইতিহাস আর উপভোগ্য শো ছাড়াও এখানে একটি কফি হাউস আছে। ইতিহাসের গন্ধ মেখে সুলভে সান্ধ্য আড্ডার উপযুক্ত পরিবেশ। চারিদিকে ইতিহাসের যে পরিমাণ অবমাননা দেখতে পাই; তার বিপরীতে এই মিউজিয়ামে অগ্নিযুগের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যম সত্যিই সাধুবাদের যোগ্য।
বছরের শীতলতম রাতে ফিরে আসার সময় রীতিমতো কাঁপুনি ধরেছিল আমাদের। তার কতটা শৈত্যের জন্য আর কতটা শিহরণের জন্য; বলা বড়ো কঠিন। মনে পড়ছিল কথাশিল্পীর পথের দাবি উপন্যাসেরই কথাগুলো:
তুমি দেশের জন্য সমস্ত দিয়াছ, তাই তো দেশের খেয়াতরী তোমাকে বহিতে পারে না, সাঁতার দিয়া তোমাকে পদ্মা পার করিতে হয়; তাই তো দেশের রাজপথ তোমার জন্য রুদ্ধ, দুর্গম পাহাড় পর্বত তোমাকে ডিঙাইয়া চলিতে হয়; – কোন্ বিস্মৃত অতীতে তোমারই জন্য তো প্রথম শৃঙ্খল রচিত হইয়াছিল, কারাগার তো শুধু তোমাকে মনে করিয়াই নির্মিত হইয়াছিল, সেই তো তোমার গৌরব! …. দুঃখের দুঃসহ গুরুভার তুমি বহিতে পারো বলিয়াই তো ভগবান এত বড় বোঝা তোমারই স্কন্ধে অর্পণ করিয়াছেন! …. মুক্তিপথের অগ্রদূত! পরাধীন দেশের হে রাজবিদ্রোহী! তোমাকে শতকোটি নমস্কার।
রক্তিম মুখার্জ্জী




