
মা চামুণ্ডা।
কালী জগদকারণ, তাঁকে জগৎপ্রসবিনী বলা হয় কালিকাপুরাণে (জগতাং প্রসূঃ)। আবার কালীই জগদবিলয়। কালী সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়। যখন প্রলয় আসে, কালী তখন চামুণ্ডা রূপ ধারণ করেন।
আর প্রলয়কালে চামুণ্ডা নৃত্যরত থাকেন। আপনারা জানেন সেই নৃত্যরুদ্রচামুণ্ডা মূর্তি, বর্ধমানে কঙ্কালেশ্বরী কালী বলে তিনি আজও পূজিত হন।
কিছুদিন আগে শ্মশানকালী সম্পর্কে লিখেছি। তন্ত্রসারে শ্মশানকালীর মূর্তিবর্ণনা আছে, চামুণ্ডার মতোই সেই মূর্তি।
বলা হয়, প্রলয়কালে চামুণ্ডা শুধু নৃত্য করেন না। তখন তিনি ভয়ঙ্করী বীণাবাদিনী। তাঁর সেই প্রলয়বীণার দণ্ড হল মেরু পর্বত, তন্ত্রী হল শেষ নাগ এবং সেই বীণার কুণ্ড বা লাউ-খোল হল চন্দ্র।
চামুণ্ডা আদিমাতৃকা। তিনি সপ্তমাতৃকার মধ্যে গণ্য হন, অতএব তিনি বলি গ্রহণ করছেন সেই আদিকালের তন্ত্রাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতা থেকেই। আজও দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজোয় বলি গ্রহণ করেন চামুণ্ডা স্বয়ং নিজেই।
চৌষট্টি যোগিনীর মধ্যেও চামুণ্ডা পূজ্য হন।
কিন্তু সেনযুগের দশমহাবিদ্যার মধ্যে চামুণ্ডার উল্লেখ নেই। কেন নেই, তা এক প্রহেলিকা, চামুণ্ডা এবং মনসা সেইযুগের বাংলায় এই দুই প্রবল জনপ্রিয় মাতৃকার অনুল্লেখ আমাদের আশ্চর্য করে।
মহাভারতে দুর্গাস্তব আছে কিন্তু চামুণ্ডার কোনও উল্লেখ নেই। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে অবশ্য চামুণ্ডা আছেন, অসুরদলনী কালীর নামান্তর চামুণ্ডা, চণ্ড ও মুণ্ড বধ করে এই নাম হয় কালীর- চামুণ্ডা। সংস্কৃত ব্যাকরণে এই ব্যুৎপত্তি সিদ্ধ হয় না। চামুণ্ডা দ্রাবিড় শব্দ সম্ভবত, সংস্কৃতে গ্রহণ করার সময় ওইভাবে সিদ্ধ করার প্রয়াস হয়েছে।
হর্ষচরিত গ্রন্থের একটি প্রাচীন বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, একদা বাঙালির গৃহে গৃহে চামুণ্ডা মণ্ডপ থাকত, আজ যেমন চণ্ডীমণ্ডপ থাকে।
মা চামুণ্ডা পালযুগে উপাস্য ছিলেন। নয়পালের সময়কালে একটি শিলালেখ শুরু হচ্ছে চর্চিকার জয়ধ্বনি করে। চর্চিকা ও চামুণ্ডা অভিন্ন। পালযুগে বাঙালি কবি শ্রীধর রচিত একাদশ শতকের সেই চর্চিকাস্তবটি উদ্ধৃত করছি:
ওঁ নমশ্চর্চ্চিকায়ৈ।।
সুরাসুর শির:শ্রেণী পটবাস সমা জগৎ।
পান্তু বিশ্বকৃতাভ্যর্চ্চর্চ্চাশ্চর্চ্চাচরণরেণব।
দ্রংষ্টা সন্ধি নিলীনমেক কবলম্বি লং বিশ্বন্তদশ্নামি কিং।
সপ্তাম্ভোধি জলানি হস্ত সুষি রে গুপ্তানি কিং পীয়তে।
ইত্যাহার দরিদ্রতাকুলতয়া শুষ্যত্তনুম্বিভ্রতী
কল্পান্তে নৃকপালমণ্ডন বিধিঃ পায়াজ্জগচ্চর্চ্চিকা।
চর্চিকাকে প্রণাম। বিশ্বের স্রষ্টা বা ঈশ্বর যিনি, চর্চিকার পদরেণু তিনিও সর্বদা ধ্যান করে থাকেন। চর্চিকার সেই পদরেণু আমাদের বিশ্বজগৎ রক্ষা করুক।
কিন্তু মাতৃকা শীর্ণ ও ক্ষুধার্ত আছেন, তিনি তাঁর করাল দন্তে এই বিশ্ব গ্রাস করবেন অথবা হাতের তালুতে গুপ্ত সমুদ্রের জল পান করে ফেলবেন, এই ভেবে আনমনা হয়ে আছেন।
★★★
প্রায় সমস্ত মাতৃকাই সর্বগ্রাসী বৈদিক পৌরাণিক পুরুষতন্ত্রের দ্বারা অধিকৃত হয়েছেন। একমাত্র চামুণ্ডা হন নি। তিনি কোনও পুরুষ দেবতার শক্তি নন। তিনি একমাত্র স্বয়ং আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত জগদকারণ জগন্মাতা মহাদেবীর শক্তি। এমনকি মহাদেবীও যখন মহাদেব দ্বারা অধিকৃত, ভগবতীও যখন ভগবান দ্বারা অধিকৃত, চামুণ্ডা তখনও একক। চামুণ্ডা সর্বোচ্চ জগন্মাতার একেশ্বরী মাতৃধর্মের জয়পতাকা উড্ডিয়ান রাখেন।
মাতৃধর্ম পৃথিবীতে একসময় দেশে দেশে প্ৰচলিত ছিল, আজ প্রায় সর্বত্র বিলুপ্ত। আমাদের বাংলায় শাক্তদের মধ্যে যে আজও মাতৃকা উপাসনার ধর্ম অম্লান, নিঃসন্দেহে মা চামুণ্ডা তাঁর কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন।
চামুণ্ডা সেই আবহমান কালাগ্নি যা আজকের মাতৃধর্মের ওপরের সমস্ত আপাত অপ্রাসঙ্গিক কুটিলতা আবিলতা বর্ণবাদ লিঙ্গবৈষম্য গুহ্যবাদ পুড়িয়ে ফেলে ভেতরের নিখাদ সুবর্ণ বের করে আনেন।
চামুণ্ডা সেই ভয়ানক অগ্নি, যা মাতৃকা উপাসক বাঙালি জাতির সমস্ত বহিঃশত্রু ও ঘরশত্রুকে গ্রাস করেন। শীত নেমে এলে চামুণ্ডা আমাদের উষ্ণতা হন। অন্ধকার নেমে এলে তিনিই আলো দেখান।
মা চামুণ্ডা সম্পর্কে আগে অনেকবার লিখেছি, লিংক কমেন্টে।
জয় মা চামুণ্ডা। জয় মা কালী। জয় জয় মা।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
রাজশাহীতে প্রাপ্ত পালযুগের এই চামুণ্ডা মূর্তির বর্তমান অবস্থান সিঙ্গাপুরের এশিয়ান সিভিলাইজেশন্স মিউজিয়াম। অনুরূপ আর একটি নৃত্যচামুণ্ডা মূর্তি বর্তমানে লস এঞ্জেলস কাউন্টি মিউজিয়ামে অবস্থান করেন।
সংযোজন
৭ প্রসঙ্গ ভুলনিবাসী দাবি খণ্ডন।
অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতের চীনা অনুবাদে আছে বুদ্ধের তপস্যাকালে তাঁকে কালী আক্রমণ করেছিলেন: কালী এবং মার দুজনেই আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত। ভুলনিবাসীকে জিজ্ঞেস করুন, বুদ্ধের যুগে কালী না থাকলে আর আক্রমণ করবেন কিভাবে 😊
বুদ্ধ তো সেদিনের। মা কালী তো হরপ্পা থেকে আছেন।
ভুলনিবাসীর সাত মিথ্যে-মিথ – তমাল দাশগুপ্ত
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, একুশ ডিসেম্বর দুহাজার বাইশ