
শ্মশানকালী।
মায়ের এই রূপ সম্পর্কে জানা শাক্ত মাত্রেই অবশ্যকর্তব্য কিন্তু নানা কুসংস্কার ও ভয়ের কারণে এই বিষয়ে সেভাবে লেখেন না কেউ, ফলে নানা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। ইন্টারনেটেও নানা ভুলভাল লেখা থাকে। তাই আজ এই দুরূহ কর্তব্য পালনে অগ্রসর হলাম, আজ মা শ্মশানকালীর কথা বলব।
আপনারা যাঁরা মায়ের সন্তান, মাতৃস্নেহের দাবিদার, সবাই নির্ভয়ে পাঠ করুন। আর যারা মাতৃকাদূষক, মায়ের সন্তানদের দ্বেষক, তারা ভীত হয়ে চোখ বুঁজে ফেলুন, কারণ মা আপনাদের ভক্ষণ করবেন।
★★★
লেখার শুরুতে মাকে প্রণাম। হৃদি শ্মশানকালিকায়ৈ দেবতায়ৈ নমঃ।
“শ্মশানে ভীরু ভয় পায়, সাধক সেখানে সিদ্ধিলাভ করে।”
“শ্মশান ভালোবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি”
★ কালী জগদকারণ, কালী জগদবিলয়। কালী সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়। শ্মশানকালী আমাদের মানব জীবনের অন্তিম আশ্রয় শ্মশানে অবস্থান করে কালস্রোতের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছেন। কালী, কারণ কালকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কালী, কারণ সব রঙ এসে কালো রঙে মেশে। যেমন সমস্ত মানবশরীর সমাপ্তিতে শ্মশানে এসে মেশে।
★ গৃহী ব্যক্তি নিজ গৃহে শ্মশানকালীর উপাসনা করতে পারেন না বলে প্রবাদ আছে। না, ঠিক নয়। আগমবাগীশ তাঁর তন্ত্রসারে বলছেন যে গৃহীও তাঁর নিজের গৃহে মা শ্মশানকালীর উপাসনা করতে পারেন। গৃহী কিভাবে শ্মশানকালীর পূজা করতে পারেন সেই নির্দিষ্ট পদ্ধতি তন্ত্রসারে বলে দেওয়া আছে।
★ কিন্তু শ্মশানকালী কেবলমাত্র ধ্বংসের দেবী নন। ঐঁ হ্রীঁ শ্রীঁ ক্লীঁ কালিকে ক্লীঁ শ্রীঁ হ্রীঁ ঐঁ নমঃ – এই একাদশাক্ষর মন্ত্রে শ্মশানকালীর পূজা করেন যে ভক্ত, মা শ্মশানকালী সেই সাধককে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ – চতুর্বর্গ প্রদান করেন।
মা শ্মশানকালীর পুরশ্চরণ করতে গেলে একাদশ লক্ষ জপ এবং তার দশাংশ হোম করতে হয়।
★ এছাড়া মা শ্মশানকালীর একটি সপ্তাক্ষর মন্ত্র আছে, ক্লীঁ কালিকায়ৈ নমঃ।
★ শ্মশানকালীর পুজোয় অষ্টশক্তি এবং অষ্টভৈরবের উপাসনা করতে হয়।
★ শ্মশানকালীর মূর্তি: মায়ের কাজলপাহাড়ের মত রঙ (অঞ্জনাদ্রিনিভাং)। মা শ্মশানবাসিনী। মায়ের নেত্র রক্তপিঙ্গলবর্ণ, তাঁর কেশ মুক্ত, তাঁর দেহ (চামুণ্ডার মত) অতি ভৈরবা শুষ্কমাংসা। তাঁর বাম হাতে মদ্যমাংসপূর্ণ পাত্র এবং ডান হাতে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড। দেবী হাস্যবদনা এবং মাংস চর্বণ করছেন। দেবী নানা অলঙ্কার ধারণ করেন এবং তিনি দিগবসনা।
★ তন্ত্রসারে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী হুবহু নির্মিত শ্মশানকালী বর্তমান বাংলায় বিরল। তবে পালযুগে নির্মিত এমন মূর্তি অনেক পাওয়া গেছে, সেগুলি সবই চামুণ্ডা মূর্তি বলেই পরিচিত হয়, যদিও সেখানে ডান হাতে সাধারণত পাত্র আর বাম হাতে নরমুণ্ড, কিন্তু পালযুগ আর আগমবাগীশের মধ্যে প্রায় ছয়শ বছরের ব্যবধান আছে।
★ বস্তুত শ্মশানে যে মা কালী প্রতিষ্ঠিত আছেন, বাংলা জুড়ে তিনিই শ্মশানকালী বলে পরিচিত হন। কিন্তু এ কথা সত্যি যে তন্ত্রসারে বর্ণিত এই শ্মশানকালী মূর্তির অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য এখনও বাংলা জুড়ে শ্মশানকালীর মধ্যে দেখা যায়। সেগুলি হল-
শ্মশানকালীর মূলানুগ মূর্তি যদি হয়, সেখানে তিনি জিহ্বা প্রসারিত করে থাকেন না। এবং তিনি হাসিমুখে থাকেন।
শ্মশানকালীর ডান হাতে ছিন্ন মুণ্ড এবং বাম হাতে পাত্র থাকে।
শ্মশানকালী বেশিরভাগ কালীমূর্তির মতই দিগবসনা।
শ্মশানকালী কৃষ্ণবর্ণা হন, কারণ অঞ্জনাদ্রির মত রঙ। নীল বা শ্যামা নন সাধারণত।
★ তবে আগেই বলেছি, শ্মশানের মন্দিরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দক্ষিণা কালীর সাধারণ মূর্তিই প্রতিষ্ঠিত থাকেন। শ্মশানে আছেন যে কালী তিনিই শ্মশানকালী, মায়ের বিশেষত্ব তাই কেবল মূর্তিতত্ত্বে নয়, সর্বাগ্রে স্থানমাহাত্ম্যেই প্রকাশিত হয়।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
পালযুগে একাদশ শতকের গৌড়বঙ্গে উৎকীর্ণ দ্বাদশভুজা চামুণ্ডা মূর্তি। বর্তমান অবস্থান লস এঞ্জেলস কাউন্টি মিউজিয়াম অভ আর্ট।
জয় মা কালী। জয় জয় মা।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, ষোল ডিসেম্বর দুহাজার বাইশ