
মা কালীই প্রকাশিত হন মা সরস্বতীরূপে।
জগৎ কালীময়। সমস্ত দেবদেবীই মা কালীর প্রকাশ। সরস্বতীর কালীরূপ।
আর একমাস পরেই সরস্বতী পূজা। পালসেনযুগের একটি আশ্চর্য সরস্বতী মূর্তি দেখুন। শববাহনা সরস্বতী, কি আশ্চর্য!
সরস্বতী, কিভাবে জানছি? কারণ দেবী চতুর্ভুজা, ওপরের দুই হাতে পুস্তক ও জপমালা, নিচের দুই হাতে বরাভয়। প্রপঞ্চসারতন্ত্রে সরস্বতীর ধ্যানমূর্তি এটাই। একই বর্ণনা বায়ুপুরাণে- দক্ষিণ হস্তে ওপরে জপমালা নিচে বরদমুদ্রা। বাম হস্তে ওপরে পুঁথি নিচে অভয়মুদ্রা। কালিকাপুরাণেও দেখি হুবহু এক – সরস্বতীর চার হাতে বরদ ও অভয় মুদ্রা, জপমালা ও পুস্তক।
কিন্তু সরস্বতী শবাসীনা? কিভাবে?
১. সারদা তিলকে সরস্বতীর নরকপাল হাতে মূর্তির বর্ণনা আছে।
২. সরস্বতী পূর্বাহ্নে রক্তবর্ণা, মধ্যাহ্নে শুক্লবর্ণা এবং সায়াহ্নে কৃষ্ণবর্ণারূপে পূজিত হন, পদ্মপুরাণে বলা হয়। অর্থাৎ কালো/কৃষ্ণী সরস্বতীর পূজা হত নিশাকালে।
৩. মহানীল সরস্বতী এবং নীল সরস্বতী – এই দুই রূপেও সরস্বতী পূজিত হন, যে রূপ মা তারার সঙ্গে অভিন্ন। এই দুই রূপে মায়ের সঙ্গে শবের উপস্থিতি লক্ষ্য করি। আবার জাঙ্গুলীতারার মত শ্বেত সর্পের অলঙ্কার দেখা যাচ্ছে এই মূর্তিতে মায়ের মাথার পাশে লক্ষ্য করুন। বলা দরকার যে মা জাঙ্গুলীতারার কিন্তু সরস্বতীর মতোই বীণাবাদিনী মূর্তি দেখা যায়।
মহাবিদ্যা তারা ছাড়াও আরেকজন মহাবিদ্যা হলেন ভৈরবী, যিনি মুণ্ডমালিনী, চতুর্ভুজা, ধারণ করেন অক্ষমালা ও পুঁথি, বরদ ও অভয় মুদ্রা, তাঁর সঙ্গেও মা সরস্বতীর নৈকট্য আছে।
সঙ্গের ছবির মাতৃমূর্তিকে কেউ কেউ ভৈরবী মূর্তি বলেই দাবি করছেন, যদিও এখানে মুণ্ডমালা নেই বলে সরাসরি ভৈরবী বলা যায় না। তাছাড়া ভৈরবী পদ্মাসনা হন, পদ্মের উপরে বিরাজ করেন। এই মূর্তিতে পদ্মাসন নেই, দেবী এখানে শব-আসনে উপবিষ্ট।
আর একটি বিষয় হল দশমহাবিদ্যা সেনযুগের কনসেপ্ট। সেনযুগের বৃহদ্ধর্মপুরাণে প্রথম লিপিবদ্ধ। এই মাতৃমূর্তি যদি পালযুগের হয় সেক্ষেত্রে তখনও ভৈরবী মহাবিদ্যারূপ আসেনি।
৪. সরস্বতীর প্রণামমন্ত্রে ভদ্রকালী লক্ষণীয়ভাবে আছেন: ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রে সরস্বতীর পূজা হয়।
৫. পশুবলি দিয়ে সরস্বতী পুজোর প্রথা বিশেষ করে মেষবলি দেওয়ার প্রচলন এখনও বাঙালিদের মধ্যে অনেক জায়গায় দেখা যায়।
৬. কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী, কালীর মুণ্ডমালা পঞ্চাশ বর্ণের দ্যোতক। সরস্বতী সম্পর্কেও বলা হয় তিনি বর্ণেশ্বরী, সারদা তিলক দ্রষ্টব্য। পঞ্চাশ বর্ণে সরস্বতীর মূর্তি নির্মিত, প্রপঞ্চসারতন্ত্রে বলে।
৭. কর্ণাটদেশে হয়সালেশ্বর মন্দিরে তন্ত্রের একটি নির্দিষ্ট সরস্বতীরূপ পূজিত হয় যেখানে তিনি শিব-শক্তি, শিবগৃহিণী, শিবানী। আশ্চর্যের কিছু নেই, ঋগ্বেদ থেকে পৌরাণিক যুগ অবধি তিন হাজার বছরের মধ্যে মা সরস্বতীর সঙ্গে প্রায় এক ডজন দেবতার বৈবাহিক সম্পর্ক কল্পিত হয়েছে। মহাদেবী সরস্বতীর অসীম শক্তিতে শক্তিমান হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় এইসব ঘটিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষ দেবতার উপাসকরা। যাই হোক, এখানে প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হল, সরস্বতীর সঙ্গে শবশিবের সম্পর্ক কাজেই অকল্পনীয় নয়।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় মা কালী, জয় মা সরস্বতী। জয় জয় মা।
বাংলাদেশের মাদারীপুর অঞ্চলে ২০১৭ সালে এই মাতৃমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমান অবস্থান অজানা। ছবি ফেসবুক থেকে।
সংযোজন
১ এই মাতৃমূর্তিটি একটি পুকুর থেকে উদ্ধার হয়েছিল। মূর্তি প্রায়ই জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হত মুসলিমদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। এই সংক্রান্ত সংবাদ

২ সরস্বতী সুপ্রাচীন মাতৃকা: তিনি কি ব্রহ্মার কন্যা বা স্ত্রী? https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4897073693649494&id=2343427979014091&mibextid=Nif5oz
৩ মাতঙ্গী, তন্ত্রের সরস্বতী https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4893713817318815&id=2343427979014091&mibextid=Nif5oz
৪ সরস্বতীমূর্তি দ্বিভুজা না চতুর্ভুজা https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=3790058124351062&id=2343427979014091&mibextid=Nif5oz
৫ পালযুগের ময়ূরবাহিনী সরস্বতী https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=3838028389554035&id=2343427979014091&mibextid=Nif5oz
৬ সরস্বতী প্রতিমার নানা দিক ও ধ্যানমন্ত্র https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4900481006642096&id=2343427979014091&mibextid=Nif5oz
৭ নানারূপে সর্বময়ী মা সরস্বতী। https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=4695464913810374&id=2343427979014091&mibextid=Nif5oz
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, বারো ডিসেম্বর দুহাজার বাইশ