বড়িশার চণ্ডীপূজা এবছর দুশো ত্রিশ বছর অতিক্রম করল। ১৭৯২ সালে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের সন্তোষ রায়চৌধুরীর বংশধর মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরী এই চণ্ডীপূজার সূচনা করেছিলেন। সংক্ষেপে এই চণ্ডীপূজার ইতিহাস নিয়ে কয়েকটি সূত্র পর্যালোচনা করব।
প্রথমেই বড়িশার প্রসঙ্গে বলি। তন্ত্রে দক্ষিণবঙ্গের কালীক্ষেত্র সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ তথ্য আছে। দক্ষিণেশ্বর থেকে আরম্ভ করে বহুলাপুর পর্যন্ত তিন যোজন ধনুকাকার ক্ষেত্রই কালীক্ষেত্র; আজকের কলকাতা। এই ক্ষেত্রে দেবী কালী এবং ক্ষেত্রের আটটি কোণে অষ্টচণ্ডী অধিষ্ঠান করেন। বহুলাপুর আজকের বেহালা অঞ্চল। সেক্ষেত্রে বড়িশার এই চণ্ডীপূজার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে। গঙ্গারিডির সময়কালে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এই অঞ্চল কালীগ্রাম নামে পরিচিত ছিল; টলেমির মানচিত্র অনুযায়ী। কালীঘাটে গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। সেক্ষেত্রে অষ্টচণ্ডীকে নিয়ে কালীর এই সুবৃহৎ অধিষ্ঠানভূমির ইতিহাস দুই হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন।
হরিবংশ অনুযায়ী চণ্ডী হলেন শবর ও পুলিন্দগণের উপাস্য দেবী; বসুবন্ধুর ‘বাসবদত্তা’ অনুযায়ী গঙ্গাতীরে কুসুমপুরে( বর্তমান মগধ ও গৌড়বঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চলে) কাত্যায়নীরূপে তিনি শুম্ভনিশুম্ভনাশিনী, প্রণত মহাদেবের জটাস্থিত গঙ্গায় তাঁর চরণ অভিষিক্ত, আবার তিনিই বেতালাভিধানা( বেতাল প্রমুখ ভীষণ অনুচরগণ পরিবৃতা)। বৈন্যগুপ্তের বৈগ্রাম তাম্রশাসনে উত্তরবঙ্গে পূজিতা কোকামুখী চণ্ডী ও কোকামুখস্বামী বিষ্ণু মূর্তির কথা জানা যায়। কোক শব্দের অর্থ বৃক বা নেকড়ে। চণ্ডীতে রক্তবীজের সাথে সংগ্রামের সময় আবির্ভূতা মাতৃকাদের মধ্যে চণ্ডিকা দেবী ছিলেন; যিনি শত শত শিবা অর্থাত শৃগালের মতো চিৎকার করেন। শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় এঁকেই কোকামুখী বলেছেন। বাঙালির লৌকিক দেবী শিবিখ্যাও সম্ভবত এই শিবামুখী মাতৃকারই রূপভেদ। কোকামুখী বা শৃগালমুখী মাতৃকার সিল মঙ্গলকোটেও পাওয়া গিয়েছে। নীহাররঞ্জন মহাশয় রাজশাহীর ক্ষীরহর গ্রামে প্রাপ্ত খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকের একটি চণ্ডী মূর্তির কথা উল্লেখ করেছেন; সেখানে দেবী চতুর্ভুজা, বরাভয়া, পদতলে দুই গোধিকা উপবিষ্ট, দেবীর দুই পাশে মঙ্গলসূচক কদলীবৃক্ষ শোভিত। তাঁর মতে বাঙালির প্রকৃতিমাতৃকার অরণ্যচারিণী রূপ এবং শস্যদায়িনী নবপত্রিকা রূপ দুইই এখানে পরিস্ফুট হয়েছে এবং এই ভাবনাই পরবর্তী সময়ে চণ্ডীমঙ্গলের আখেটক খণ্ডে কালকেতুর কাহিনীতে মধুরতর রূপ ধারণ করেছে।
বড়িশার চণ্ডীপূজার ইতিহাস প্রসঙ্গে জানা যায়; সাবর্ণ বংশের মহেশচন্দ্র রায়চৌধুরী নিজের বসতবাটি সংলগ্ন পুকুরে মায়ের অষ্টধাতুর ঘট এবং ডাব পেয়েছিলেন। তাই দিয়েই চণ্ডীর আদি অবয়ব নির্মাণ করে পূজা শুরু করেন নিজের গৃহে। এই রীতি বাঙালির ব্রাত্য সংস্কৃতিতে অত্যন্ত প্রাচীন। মাতৃকা জগত প্রসব করেন। জলরূপে সমস্ত সৃষ্টির বীজ তাঁর গর্ভে নিহিত থাকে। শস্য, বৃক্ষলতা তাঁরই রূপ। তাই ঘট, আমপাতা ও ডাবের সমন্বয়ে তাঁরই আদিরূপ নির্মিত হয়। মঙ্গলঘটের স্বস্তিক চিহ্নটিও তারই প্রতীক।
এই স্ফীতোদর প্রসবরতা আদিজননীর উপাসনা তাম্রাশ্মযুগ এবং গঙ্গারিডির সমকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বেহালার চণ্ডীপীঠ যদি গঙ্গারিডির সমকালীন হন( যেটা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে); তাহলে এই মঙ্গলঘটের রূপে তাঁর উপাসনাকে সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যেরই পুনরুজ্জীবন বলতে হবে।
জগদ্ধাত্রী পূজার ঠিক একমাস পরের শুক্লা অষ্টমীতে বড়িশায় চণ্ডীর বিশেষ পূজা হয়। এই সময় চণ্ডীর যে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মিত হয়; সেখানে দেবীর বর্ণ উদীয়মান সূর্যের মতো লাল। ত্রিনয়না। চার হাতে বিদ্যা, জপমালা, বর ও অভয়। তিনি পঞ্চমুণ্ডের আসনে অধিষ্ঠিতা। তন্ত্রে এই রূপ পরাবিদ্যা রূপা আদি মাতৃকার। তিনিই বর্ণমালার অধীশ্বরী। আবার এই রূপের সাথে জ্ঞানরূপা মহাবিদ্যা ভৈরবীর সাদৃশ্য আছে। এখানে দেবী চণ্ডীর সাথে অষ্টসখী অবস্থান করেন। চার বা আট সহচরীর সাথে মাতৃকার মণ্ডলের ধারণা তন্ত্রে অত্যন্ত প্রাচীন।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল; চণ্ডী শব্দটি মাতৃকার অগণিত রূপের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়। মা মহিষমর্দিনী দশভুজা দুর্গাও চণ্ডী। তাঁর মন্দিরকে আমরা চণ্ডীমণ্ডপ বলি। ব্রতকর্মে অরণ্যভূমির ঈশ্বরী গোধাবাহনা দ্বিভুজা রূপে মঙ্গলচণ্ডীর পূজা হয়। সপ্তশতী চণ্ডীতে আদিমাতৃকাই চণ্ডী। আবার রক্তবীজ বধের সময়ের চণ্ডিকা শিবামুখী ভীষণা মাতৃকা। সদুক্তিকর্ণামৃতে কালীর সাথে চণ্ডী একাকার। সেখানে কালীর বিশ্বব্যাপী সহস্রবাহু আর করালবদন দেখে কবি ভাসোক চণ্ডী ভৈরবী কালরাত্রির জয়ধ্বনি করেছেন। আবার এক অজ্ঞাতনামা কবি চণ্ডীর স্তব করেছেন এইভাবে:
দেহে যেন একটুও মাংস নেই। তাই অস্থিসমূহ অতি প্রকট। উদর এত শীর্ণ যেন পাতালে প্রবেশ করেছে। চোখ যেন গভীর কূপের তলায় থাকা জলরাশির মতো অতলান্ত। মস্তকে অপূর্ব জটাজুটের অরণ্য। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা দৈত্যদের চর্বন করতে তিনি ব্যস্ত হয়ে আছেন। সেই উগ্রা তীক্ষ্ম নখযুক্তা; অখণ্ড দন্তরাশিতে হাস্যযুক্তা শোভিতা চণ্ডীকে বন্দনা করি।
এখানে চর্চিকা চামুণ্ডা ও চণ্ডীর একীভবন স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে।
এছাড়া বাংলার সর্বত্র বিভিন্ন স্থানের নামে, নদীর নামে চণ্ডীর অগণিত লৌকিক রূপ আছে। বড়িশার চণ্ডী সুপ্রাচীন কালীক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিতা। তাঁর মধ্যে তন্ত্রের জ্ঞানদা মাতৃকার অপূর্ব প্রকাশ। তাঁর চণ্ডী নামের মধ্যে ধরা আছে বাঙালির মাতৃপূজার একাধিক সুপ্রাচীন ধারার নির্যাস। সব মিলিয়ে বেহালার এই মাতৃপূজার ঐতিহ্য এক জাজ্বল্যমান আলোকশিখার মতো বাঙালির মাতৃসাধনার আকাশে বিরাজমান।
রক্তিম মুখার্জ্জী
তথ্য কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়।


