
মা কালী এবং ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্ত।
ঋগ্বেদে দশম মণ্ডলে রাত্রিসূক্ত আছে, যা অনেকেই বৈদিক সাহিত্যে মা কালীর প্রাচীনতম ইঙ্গিত বলে মনে করেন। শ্রী শ্রী চণ্ডী পাঠের সময় রাত্রিসূক্ত পাঠের প্রথা আছে কারণ ঋগ্বেদের রাত্রির সঙ্গে চণ্ডী অভিন্ন ধরা হয়। চণ্ডী তো দুর্গা, তবে কি দুর্গা ও কালী অভিন্ন? হ্যাঁ, দুর্গাপুজো আসলে মা কালীর উপাসনা। দুর্গাপুজো আসলে ভদ্রকালীর উপাসনা, এবং সন্ধিপুজোর বলি গ্রহণ করেন চামুণ্ডা কালী। তার থেকেও বড় কথা হল, আদিদেবী কালীই পরে গৌরী, এই মর্মে অনেকগুলো পুরাণে একটা কাহিনী আছে যা আদি ঋগ্বেদে রাত্রি বা কৃষ্ণী থেকে ঊষার উদ্ভবের কাহিনীর রূপান্তর। রাত্রি ও তাঁর রূপভেদ ঊষা হরপ্পা সভ্যতায় পূজিত ছিলেন, সেখান থেকেই আমাদের দুর্গা কালী।
কিন্তু মা কালীর সঙ্গে রাত্রিসূক্ত কিভাবে সম্পর্কিত?
কালীর সরাসরি উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে প্রথম আছে মুণ্ডক উপনিষদে, অগ্নির সপ্ত জিহ্বার মধ্যে কালী আছেন। কিন্তু সেটা অনেক পরে। ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্ত প্রাচীন, এমনকি ঋগ্বেদের দেবীসূক্তের থেকেও ঋগ্বেদের এই রাত্রিসূক্ত আরও প্রাচীন বলে ইতিহাসবিদ মহলে ঐক্যমত্য আছে। রাত্রিসূক্ত কত প্রাচীন? চার হাজার বছর পুরোনো, অন্তত।
রাত্রিসূক্তে সরাসরি কালীর নাম নেই। তবে কেন রাত্রিসূক্ত আমাদের আদ্যা নিত্যা অব্যক্ত জগদকারণ প্রকৃতির জগন্মাতা কালীরূপ-এর সঙ্গে জড়িত? এর প্রধান কারণ দার্শনিক এবং ঐতিহাসিক। ঋগ্বেদে “নকৎ কৃষ্ণী” বা রাত্রির কৃষ্ণবর্ণা দেবী সৃষ্টির উৎস, যেন মধ্যরাতে জগৎ সৃষ্টি হয়। এবং তিনিই এরপরে সৃষ্টির সূর্যোদয়ের ঊষা: রাত্রি সূক্ত পাঠ করলে দেখা যায় ঊষা ও রাত্রি অভিন্ন।
এই রাত্রি/কৃষ্ণী/কালীই আদিদেবী মহাদেবী। এঁর উপাসনা হত অবৈদিক হরপ্পা সভ্যতায়, এবং বৈদিকরাও কিছুটা ভয়ে কিছুটা ভক্তিতে ঋগ্বেদে রাত্রি সূক্তে রাত্রি দেবীর উদ্দেশ্যে স্তব করেছেন এভাবে:
রাত্রি অতিবিস্তার করেন যখন, যারা নীচে আছে কি যারা ঊর্ধ্বে আছে, সবাইকেই তিনি আচ্ছন্ন করেন। তিনিই আলো হয়ে, ঊষা হয়ে অন্ধকার দূর করেন। রাতের অন্ধকারে মহাবৃক্ষ যেমন পাখিদের আশ্রয়, তেমনভাবে রাত্রি আমাদের পক্ষে শুভঙ্করী হন। তিনি স্পষ্ট কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার, তিনি সর্বব্যাপী, তিনি আমাদের সর্বনিকটে, তিনি আমাদের ঋণ নষ্ট করুন, তাঁকে এই সমস্ত স্তব অর্পণ করলাম।
★★★
সব রঙ এসে কালো রঙে মেশে তাই দেবী কালী। এই রাত্রি জন্ম দেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনিই দেন পরম আশ্রয়। এবং অন্তিমে তিনিই গ্রাস করেন। শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুযায়ী কালরাত্রি মহাদেবীর আরেকটি নাম।
সৃষ্টি – স্থিতি – বিনাশানং শক্তি ভূতে সনাতনী…
মা কালী হলেন কালো রাতের আলো। জগৎ সৃষ্টির শুরুতে অন্ধকার তাই তিনি কালো। সমস্ত জাগতিক জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে রাত্রির কোলেই আশ্রয় নিই আমরা, সেই আদিকাল থেকেই। চোখ বুজলে এই রাত্রিই নিদ্রা…
কালো রাত থেকে ঊষার জন্ম। তিনি অন্ধকার, কিন্তু তিনিই অন্ধকার বিনাশ করেন, তিনিই আমাদের আলো দেন, শেষে তিনিই মোক্ষ দেন, তাই দীপান্বিতা উৎসবে তাঁর উপাসনার রীতি।
“কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন…”
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় মা কালী। জয় জয় মা।
মায়ের ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, পনেরো নভেম্বর দুহাজার বাইশ