
মা বোল্লা কালী।
মা বোল্লা কালীর পুজো আসন্ন। এই বোল্লা কালী পুজো পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাতৃধর্মীয় উৎসব, এবং পাঁঠাবলির জন্য বিখ্যাত।
প্রসঙ্গত বর্তমান পত্রিকায় দেওয়া একটি হিসেবে জানা যাচ্ছে কোরোনার আগে দুহাজার উনিশ সালে বোল্লা কালী পুজোয় ছয় হাজার পাঁঠাবলি হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরেই এই পুজোয় পাঁঠাবলির সংখ্যা বিপুল। উনিশ শো ছিয়াত্তর সালের একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে সেবছর তেইশশো পাঁঠা বলি হয়েছিল। জানা যাচ্ছে এখানে বলি প্রথা এরকম: আগে শুরুতে মহিষ এবং কুষ্মাণ্ড বলি দেওয়া হয়, এরপর পাঁঠা বলি শুরু হয়।
★★★
একজন কালী গবেষক বলেন দশম একাদশ শতক থেকেই এখানে বোল্লা গ্রামে মায়ের পুজো হচ্ছে, এবং তান্ত্রিক নির্মিত পঞ্চমুণ্ডি ছিল। বলা দরকার পালযুগে বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত ছিল এই ভূখণ্ড। এখানে তান্ত্রিক ধর্মের পুরোনো ঘাঁটি, এবং সেই সময়ে এখানে কোনও স্থানেশ্বরী অধিষ্ঠাত্রী মায়ের পুজো প্ৰচলিত ছিল এমন সিদ্ধান্ত কাজেই অস্বাভাবিক নয়। সেযুগে এখানে যে মায়ের পুজো প্ৰচলিত ছিল সেই মা বোল্লা কালী আজ রক্ষাকালী বলেই মূলত পরিচিত, এমনকি মড়কের সময় তিনি রক্ষা করেন এই বিশ্বাস আছে, প্রায় একশো বছর আগে ১৯২০ সালে মড়ক ঘটেছিল এই অঞ্চলে, এবং বোল্লা কালী মড়ক থেকে রক্ষা করেছিলেন বলে তাঁকে সেই সময় মড়কাকালী বলা হত।
মায়ের পুজোয় পঞ্চ দ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহার (পঞ্চ গুঁড়ি, পঞ্চ শস্য, পঞ্চ রত্ন, পঞ্চ পল্লব প্রভৃতি) থেকে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা যে পালযুগে হয়ত এখানে পঞ্চরক্ষিকা পুজো হত, ইনি পালযুগের রক্ষামাতৃকা ছিলেন। এছাড়া মারীভয় নিবারণ করেন, মহামারী থেকে রক্ষা করেন, এমন মাতৃকার উল্লেখও তন্ত্রগ্রন্থে আছে।
মা বোল্লা কালীর একাধিক কিংবদন্তী আছে, তার মধ্যে একটি কাহিনী হল অলৌকিক পাঁচ মাথা সম্পন্ন সর্প নিয়ে। ফলে পঞ্চরক্ষিকা ছাড়াও সর্পবাহিনী গুহ্যকালীর কথা মনে আসতে পারে। গুহ্যকালীও খুব প্রাচীন মাতৃকা।
★★★
তবে বোল্লা কালীর লিপিবদ্ধ নথিবদ্ধ ইতিহাস বেশি পুরোনো নয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বর্ধমানের জমিদার হরিমোহন গাঙ্গুলী বোল্লা গ্রাম সহ এই তল্লাটের মালিকানা পান, সেই সময় মহা ধুমধামে কালীপুজো শুরু হয়। এই জমিদারের দুই নায়েব, ভ্রাতৃদ্বয় রামসিংহ এবং চিত্তগোবিন্দ চৌধুরী পরে জমিদার হন, এবং পুজোর দায়িত্ব নেন। সেই সময় জ্যৈষ্ঠমাসের ফলহারিণী অমাবস্যায় বার্ষিক কালীপুজো হত।
এরপর রাসপূর্ণিমার পরবর্তী শুক্রবার বার্ষিক পুজোর প্রথা শুরু হয়। শুক্রবার এখানে হাটবার ছিল বলে জানা যাচ্ছে এবং সম্ভবত রাসের মেলার সঙ্গে বোল্লা কালীর মেলাকে মিলিয়ে দেওয়ার একটা প্রয়াস ছিল। প্রসঙ্গত রাস একটি প্রাচীন শাক্ত উৎসব, বৈষ্ণব ধর্মের রাস শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে জগন্মাতার রাসমণ্ডলের প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রাসপূর্ণিমার পরের শুক্রবার রাত দশটায় বার্ষিক পুজো শুরু হয়। এবছর এগারোই নভেম্বর পড়েছে।
পুজো শেষ হয় সোমবার। এবছর চোদ্দ নভেম্বর।
বার্ষিক পুজো ছাড়াও প্রতি সপ্তাহেই শুক্রবার মায়ের অন্নভোগ হয়। এছাড়া রোজই মায়ের নিত্য পুজো হয়। একটি কালো শিলাখণ্ডে মায়ের নিত্য পুজো হয়।
বার্ষিক পুজোর আগে বিশাল মাতৃমূর্তি নির্মিত হয়।
★★★
এই পুজো ঘিরে বিরাট মেলা বসে। আশেপাশে বালুরঘাটে ও গঙ্গারামপুরের হোটেলগুলো ভর্তি হয়ে যায়, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কালীভক্তরা আসেন। এখানে পাঁঠাবলির মানত করার পাশাপাশি মায়ের মূর্তি নির্মাণ করেও নিবেদন করা হয়। দুহাজার উনিশে দুহাজার কালীমূর্তি নির্মাণ করে মায়ের পুজোয় নিবেদন করেন ভক্তরা। এই কালী মূর্তিগুলি মা বোল্লা কালীর বার্ষিক পুজোয় পূজিত মূল মূর্তির মতোই।
মায়ের পুজোয় প্রসাদ হিসেবে কদমা বিখ্যাত, বৃহৎ আকৃতির দুই কিলোর কদমাও পাওয়া যায় এই সময়।
মাকে বেশ কয়েক কিলোগ্রাম সোনার গয়না পরানো হয় পুজোর সময়।
★★★
মা জাগ্রত বলে খ্যাত আছে। ১৯২৩ সালে মায়ের মূর্তি তৈরি করার সময় শিল্পী নকড়ি মহান্ত মায়ের নাকের সামনে কেরোসিনের লম্ফ ধরে কাজ করছিলেন, রাতের বেলায়, মা সেই ধোঁয়ায় বিরক্ত হওয়ায় জ্বলন্ত লম্ফটি উড়ে গিয়ে হাটখোলায় অগ্নি কাণ্ড ঘটায়, এরকম একটি কিংবদন্তী আছে।
এমন কিংবদন্তী বাংলা জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে মা কালী সহ অন্যান্য পূজিত মাতৃকা সম্পর্কে প্ৰচলিত। অস্যার্থ, মৃন্ময়ী মাকে নিছক মাটির মূর্তি ভাবা ঠিক নয়, কারণ তাতে শক্তির সঞ্চার আছে।
★★★
বোল্লা নামের পেছনে কারণ হিসেবে বলা হয় চারশ বছর আগে বল্লভ চৌধুরী নামে একজন জমিদার এই কালীমূর্তি নির্মাণ করেন, ফলে বল্লভকালী, সেই থেকে বোল্লা কালী। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় যাঁরা নায়েব এবং পরে জমিদার হন, সেই চৌধুরী উপাধির বাবুদের সঙ্গে বল্লভ চৌধুরীর সম্পর্ক কিছু ছিল কি না, স্থির জানতে পারিনি, তবে অসম্ভব নয়। জমিদার থেকে অনেকেই নায়েবে পরিণত হতেন, এবং আবার নায়েব থেকেও জমিদার হওয়ার অনেক উদাহরণ আছে।
বোল্লা নামের সঙ্গে বল্লাল কোনওভাবে যুক্ত থাকতে পারে কি না জানা নেই, যদিও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শাক্ত রাজা বল্লালের স্মৃতিবিজড়িত মাতৃকা উপাসনাপীঠ আছে।
★★★
এখানে মায়ের রঙ আকাশী নীল অর্থাৎ শ্যামা। মায়ের মূর্তি চোদ্দ হাত লম্বা বলে জানতে পারছি দুয়েকটি বই থেকে, তবে একটি স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী বর্তমানে সাড়ে সাত হাত দীর্ঘ প্রতিমা তৈরি হয়।
মা বোল্লা কালীর মন্দিরটির চূড়া বেশ দীর্ঘ: চুরাশি ফুট উঁচু।
বালুরঘাট স্টেশন থেকে বাস বা অটোয় যাওয়া যায় মা বোল্লা কালীর মন্দিরে। মল্লিকপুর স্টেশন থেকেও অটো বা রিকশায় যাওয়া যায় বোল্লা গ্রামে। বালুরঘাট শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার পূর্বে এই বোল্লা গ্রাম। কলকাতা থেকে বাস রাস্তায় সরাসরি সংযুক্ত।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
মায়ের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে।
জয় মা বোল্লা কালী। জয় জয় মা।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, নয় নভেম্বর দুহাজার বাইশ