
জগদ্ধাত্রী পুজোর শুভক্ষণ সমাসন্ন। আজ, জগদকারণ জগন্মাতার ধাত্রীরূপ: জগদ্ধাত্রীর শাস্ত্রীয় ইতিহাস।
বহুল প্রচলিত হলেও এ কথা সত্য নয় যে কৃষ্ণচন্দ্রের আগে জগদ্ধাত্রী পুজো ছিল না। ওই কিংবদন্তিতে নিহিত সত্যতা এটুকু যে মুসলমান নবাবের কারাগারে বদ্ধ থাকার ফলে দুর্গাপুজো না করতে পেরে এই জগদ্ধাত্রী পুজো করে সেই আক্ষেপ মিটিয়েছিলেন রাজা।
কিন্তু কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী পুজো কৃষ্ণচন্দ্র শুরু করেন নি। আগে থেকেই ছিল।
কার্তিকমাসে শুক্লা নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ শূলপাণি তাঁর কালবিবেক গ্রন্থে করেছেন: “পূজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং সিংহপৃষ্ঠে”। সময়কাল আনুমানিক চতুর্দশ শতক।
তারও আগে দ্বাদশ শতকে পালযুগে রাজা মদনপালের সময় নৃসিংহ ভট্টের স্মৃতিসাগর গ্রন্থে কার্তিক মাসে উমা পুজোর কথা আছে। এই উমা হৈমবতী উপমহাদেশের সুপ্রাচীন মাতৃকা, ইনি কেনোপনিষদে উল্লিখিত আছেন।
সিংহবাহিনী মাতৃকার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, নব্য প্রস্তর যুগ থেকে ইনি এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পূজিত এবং কুষাণ ও গুপ্ত যুগ থেকে ইনি ভারতে নিয়মিতভাবে পূজিত।
হেমন্তে এই উমা হৈমবতীর উপাসনার ধারা থেকেই আজকের জগদ্ধাত্রী পুজো এসেছে, এটি সঙ্গত ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।
সপ্তদশ শতকে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তাঁর তন্ত্রসারে জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমূর্তির বর্ণনা দিয়েছেন:
দেবী সিংহপৃষ্ঠে আরূঢ়। তিনি নানা অলঙ্কারে ভূষিত। দেবী চতুর্ভুজ, দুই বাম হাতে তিনি শঙ্খ ও ধনুক, এবং দুই ডান হাতে চক্র ও পঞ্চবাণ ধারণ করেন। তিনি নাগ-উপবীত ধারণ করেন। দেবী রক্তবস্ত্র পরিধান করেন এবং বালার্ক অর্থাৎ ঊষার মত তাঁর তনু। তিনি নারদ প্রমুখ মুনিদের দ্বারা পূজিত হন।
বলা দরকার জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ ষষ্ঠ শতকের গ্রন্থ শ্রী শ্রী চণ্ডীতেও আছে, স্তবে তিনি বিশ্বেশ্বরী জগদ্ধাত্রী বলে পূজিত। জগদ্ধাত্রী সম্ভবত প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্মে পূজিত ছিলেন (তিনি চক্র ধারণ করেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ), কারণ শ্রী শ্রী চণ্ডীর এই স্থানে বলা হয় জগদ্ধাত্রী হলেন বিষ্ণুমায়া, তিনি বিষ্ণুর যোগনিদ্রা। বস্তুত শ্রী শ্রী চণ্ডী পড়লে বোঝা যায় বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গেই মাতৃধর্মের আদি সংযোগ, দেবী এজন্যই বারবার নারায়ণী বলে উল্লিখিত। মহাভারতেও দেখি দুর্গাস্তবে কৃষ্ণকে মা দুর্গার ভ্রাতা বলা হয়েছে। সেই একানংশা যোগমায়া নিয়ে আগে লিখেছি। প্রসঙ্গে ফিরি।
মহিষাসুর বধের পর দেবী দুর্গাকে জগতের ধাত্রী বলে পুজো করা হয়েছে শ্রীশ্রী চণ্ডীতে: অর্চিতাং জগতাং ধাত্রী।
মূর্তিকল্প অবশ্যই মা দুর্গার থেকে কিছুটা আলাদা। মা চতুর্ভুজা। মায়ের সঙ্গে চার সন্তান নেই, অবশ্য অনেক স্থানে দুজন অনুচর জয়া ও বিজয়া থাকেন। দেবী সিংহের পিঠে উপবিষ্ট থাকেন। মহিষাসুর নেই, তবে করীন্দ্রাসুর আছে, সে প্রসঙ্গে আসছি এখুনি।
জগদ্ধাত্রী পুজোর সবই দুর্গোৎসবের মত, কেবল বোধন ও নবপত্রিকা স্থাপন হয় না, এবং নবমী তিথিতেই সম্পূর্ণ পুজো হয়, যা দুর্গাপুজোর নবমীকল্পের মতোই, অর্থাৎ একমাত্র নবমীর দিনেই সম্পূর্ণ দুর্গাপুজো করার যে প্রথা আছে, সেরকমভাবে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। দুর্গাপুজোর কল্প নিয়ে আগে লিখেছি।
শেষ কথা। জগদ্ধাত্রী প্রতিমার পদতলে মায়ের সিংহ কর্তৃক দলিত একটি হাতি থাকে, অথবা হাতির মাথা। বলা হয় করীন্দ্রাসুর। এটাও শ্রী শ্রী চণ্ডী থেকে নেওয়া কারণ যুদ্ধকালে মহিষাসুর গজরূপ ধারণ করেছিল, দেবীর খড়্গের আঘাতে মহিষাসুরের গজরূপটির নিধন ঘটে।
© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta
জয় জয় মা।
মাতৃমূর্তির ছবি পিন্টারেস্ট থেকে।
সংযোজন:
১. জগদ্ধাত্রীর সিংহতলে পিষ্ট হাতিটি যে দর্পের প্রতীক এই সংক্রান্ত শাস্ত্রীয় রেফারেন্স আছে? রামকৃষ্ণ পরমহংস এরকম একটি কাহিনী বলেছিলেন বটে, কিন্তু সেটা কোন তন্ত্র বা পুরাণ থেকে নেওয়া? মূল সোর্স খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত মহিষাসুরের গজরূপ হিসেবেই করীন্দ্রাসুরকে গণ্য করব।
আর একটা বিষয়। আমি এই পোস্টে মূলত শাস্ত্রীয় রেফারেন্সের বাইরে যাইনি। নইলে দেখুন, সিংহ কর্তৃক দলিত হস্তীর স্ট্যান্ডার্ড হিস্টোরিক্যাল রেফারেন্স আছে, তা নিয়ে ইতিহাসবিদ মহলে মোটামুটি ঐক্যমত্য আছে। উড়িষ্যার স্থাপত্যে দেখা যায়, অনেকেই জানেন। সেটা নিয়ে বলা যেত, কিন্তু সেদিকে যাইনি এই লেখায়। আমার মনে হয় হাতিটি দর্পের রূপক এই সিদ্ধান্ত করার আগে নথিবদ্ধ পৌরাণিক বা শাস্ত্রীয় তথ্য দরকার।
২. সব দেবীই তান্ত্রিক। বৈদিক দেবী বলে সেভাবে কিছু হয় না। বেদে সবথেকে বেশি উল্লিখিত যে ঊষা ও সরস্বতী, তাঁরাও তন্ত্রাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতায় মাতৃকা, অবৈদিক। মাতৃকা দেখলেই জানবেন অবৈদিক ব্রাত্য তন্ত্রাশ্রয়ী সভ্যতা থেকেই বেদে অনুপ্রবিষ্ট। বেদ অর্থে আদি ঋগ্বেদ বলছি।
তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, একত্রিশ অক্টোবর দুহাজার বাইশ